০৩. রোম

রোম

জোর করে লেগে থাকলে দেখছি অসাধ্যও সাধন করা যায়। এভরিম্যানের অনুবাদে চার ভ্যালুম মমসেনের রোমের ইতিহাস শেষ হয়ে গেল। অবশ্য এ পুথির শেষে পৌঁছে দেখি গোড়ার দিককার অনেক কথা, মনের মধ্যে ঝাপসা হয়ে এসেছে। কেল্টজাতির স্বাধীনতা রক্ষার নিস্ফল চেষ্টার করুণ কাহিনি, স্যামনাইটদের রোমের নাগপাশ থেকে মুক্তির বৃথা প্ৰয়াসের ইতিহাসকে একরকম ঢেকে ফেলেছে। সিজারের জয়ধ্বনিতে, হ্যানিবালের তুতিগানও প্রায় ডুবে গেছে। সন তারিখের তো কথাই নাই। প্রথম থেকেই তার গোলযোগ শুরু হয়েছে, এবং শেষ পর্যন্ত সব একাকার হয়ে গোলযোগের সম্ভাবনারও লোপ ঘটেছে। মোট কথা, রোমের ইতিহাসে পরীক্ষা দিতে বসলে যে, সে পরীক্ষাতে ফেল হব। এটা নিশ্চয়। তবুও ল্যাটিন জাতির বিজয়যাত্রার এই অধ্যায়গুলি, মমসেনের বর্ণনায় মনের মধ্যে যে দাগ কেটে গেছে, তা সহসা মুছে যাবে না। ভূমধ্যসাগরের চার পাশের যে ভুখণ্ডকে আধুনিক যুগের রোমের ঐতিহাসিকেরাও পৃথিবী বলেই উল্লেখ করেন, তার বহু রাজ্য ও বিচিত্ৰ জাতিগুলির রোমের এক-রাট ও একছত্ৰ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, মনকে যে দোলা দিয়েছে, তার বেগ শেষ হতে কিছু সময় লাগবে।

পাঠকেরা শঙ্কিত হবেন না। মমসেন থেকে দুটো অধ্যায় ইংবেজি অনুবাদের বাংলা তর্জমা করে দিয়ে লব্ধ-প্ৰতিষ্ঠ ঐতিহাসিকপদ লাভের কোনও চেষ্টাই করব না। রোম সম্বন্ধে এখানে যা কিছু বলতে যাচ্ছি তা নিতান্তই এলোমেলো রকমের। তাতে প্রত্নতত্ত্বের পাণ্ডিত্য এবং ইতিহাসের গাম্ভীর্য—এ দুয়েব অত্যন্ত অভাব। সুতরাং যাঁরা প্রবন্ধের নাম দেখে পড়তে শুরু করেছেন তাঁরা হয়তো আর অগ্রসর না হলেই ভাল করবেন। আর যাঁরা নাম দেখেই পাতা উলটে যেতে চাচ্ছেন, তাঁরা ধ্রুস্কার শেষ পর্যন্ত পড়বার চেষ্টা কবলেও করতে পারেন।

 

প্রাচীন হিন্দুজাতি এবং তাদের সভ্যতা আমাদের পশ্চিমের মাস্টারমশায়দের কাছে অনেক রকম গঞ্জনা শুনেছে। তিরস্কারের একটা প্রধান বিষয় এই যে বংশপরিচয়ে তাঁরাও ছিলেন রোমানদেরই জ্ঞাতি। সুতরাং সেই একই রক্ত শরীরে থাকতে তাঁরা যে কেমন কবে হিন্দুসভ্যতার মতো এমন দুর্বল ও বিকৃত সভ্যতা গড়ে বসলেন, এটা পণ্ডিতদের মনে যেমন বিরাগেরও সঞ্চার করেছে তেমনি জিজ্ঞাসারও জন্ম দিয়েছে। এবং এই সংশয়ের সমাধানে তাঁরা নানারকম সম্ভব-অসম্ভব, অবশ্য সকলগুলিই ‘বৈজ্ঞানিক’, মতবাদের প্রচার করেছেন। গল্প আছে, ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় চার্লস রয়েল সোসাইটির নতুন প্রতিষ্ঠা করে পণ্ডিতদের এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন যে, মাছ মরলেই ঠিক সেই সময়টা তার ওজন বেড়ে যায় কেন? পণ্ডিতেরা উত্তর খুঁজে গলদঘর্ম হয়ে গেলেন। অবশেষে একজন বললেন, আচ্ছা দেখাই যাক না ওজন করে, মাছটা মরলেই তা যথার্থ বেশি ভারী হয়ে ওঠে কি না। মমসেনের বিপুলায়তন পুথি শেষ করে এই কথাটাই বারবার মনে হয়েছে, যে যাঁরা এই রোমানসভ্যতার তুলনায় প্রাচীন হিন্দু-সভ্যতাকে অতি খাটো ও নিতান্ত হালকা বলেছেন, ‘সভ্যতা’ বলতে তাঁরা কী বোঝেন? সভ্যতার কোন মাপকাঠিতে তাঁরা এই দুই সভ্যতাকে মাপ করেছেন? কোন তৌলে এদের ওজনে তুলেছেন? এই যে রোমানসভ্যতা, যার গৌরবের দীপ্তিতে পণ্ডিতদের চোখ ঝলসে গেছে, এ তো একটা একটানা পরের দেশ জয় ও অন্য জাতির উপর আধিপত্য স্থাপনের ইতিহাস। প্রথম ‘লেশিয়ামের’ উপর রোমের প্রভুত্ব বিস্তার, তারপর তারই সাহায্যে উত্তরের ইট্রাসকানদের ধবংস করে ইতালির আর সকল জাতিগুলোকে পিষে ফেলে গোটা দেশটায় নিজের আধিপত্য স্থাপন। আবার মেডিটারেনিয়নের ওপারের প্রবল রাজ্যটি, সিসিলির সেতু পার হয়ে এই আধিপত্যের কোনও বিঘ্ন ঘটায়, এই আশঙ্কাতেই কার্থেজের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে বিজিত ইতালির সাহায্যে তাকে সমুলে উচ্ছেদ; এবং কার্থেজের অধিনায়ক ‘হ্যামিলকার বারকা’ বা বিদ্যুতের বংশধর, স্পেন থেকেই যাত্রা শুরু করে বাজ হয়ে রোমের মাথায় ভেঙে পড়েছিল বলে, শত্রুর শেষ রাখতে নাই এই নীতি অনুসারে স্পেনেও রাজ্যবিস্তার। এমনি করে দক্ষিণ আর পশ্চিমের ভাবনা যখন ঘুচল তখন স্বভাবতই দৃষ্টি গেল পুবের দিকে। গায়ে জোর থাকলে এ আশঙ্কার তো আর শেষ নাই! পুবে তখন ছিল আলেকজেন্ডারের ভাঙা সাম্রাজ্যের গোটা কয়েক বিচ্ছিন্ন টুকরো। ওরই মধ্যে যে দুটি একটু প্রবল–ম্যাসিডন আর এশিয়া, তাঁরা তখন রোমেরই মতো আশপাশের রাজ্যগুলিকে গ্ৰাস করে নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টায় ছিল। এ ব্যাপারকে অবশ্য উপেক্ষা কি মার্জনা কিছুই করা চলে না। কেননা পরের দেশ জয় করে রাজা ও বলবুদ্ধি জিনিসটি মানুষের ইতিহাসের আদিযুগ থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিরই নিজের পক্ষে খুব সুসঙ্গত ও অত্যাবশ্যকীয় এবং অন্য সকলের বেলাই নিতান্ত বিসদৃশ ও অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বলে মনে হয়েছে। সুতরাং বাধ্য হয়েই রোমকে এ দুটি রাজ্য আক্রমণ করতে হল; এবং এদের বাহুল্য অংশগুলি ছেটে ফেলে যাতে এরা অতঃপর বেশি। নড়াচাড়া না করে ভদ্রভাবে জীবন যাপন করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হল। এমনকী সঙ্গে সঙ্গে রোম একটা মহানুভবতার পরিচয় দিতেও কসুর করলে না। ইতালিতে তখন হেলেনিক সভ্যতার স্রোত বইতে আরম্ভ করেছে। তারই গুরুদক্ষিণা হিসাবে গ্রিসের ছোট ছোট নখদন্তহীন নাগরিক রাজ্যগুলিকে ম্যাসিডনের প্রভুত্ব থেকে মুক্ত করে রোম তাদের একবারে স্বাধীনতা দিয়ে দিল। কিন্তু দুঃখের কথা মহানুভবতার এ খেলাও রোম বেশিদিন খেলতে পারল না। কারণ দানে পাওয়া স্বাধীনতার মানেই হল–স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োগটা করতে হবে দাতারই ইচ্ছা অনুসারে। সুতরাং গ্রিসের চপল প্রকৃতির লোকগুলি যখন নিয়মের ব্যতিক্রম করে, ম্যাসিডনের আবার মাথা তুলবার চেষ্টা দেখে, তাকেই নায়ক ভেবে কিঞ্চিৎ চাঞ্চল্যের লক্ষণ প্রকাশ করল, তখন এই পুবের দেশগুলির আধা স্বাধীনতা আধা অধীনতার বিশ্ৰী অবস্থাটা ঘুচিয়ে সোজাসুজি এদের করায়ত্ত করে নেওয়া ছাড়া রোমের আর গত্যন্তর থাকল না। এর পর রোমান চোখের দিকচক্রবালে যে দুটি রাজ্য বাকি থাকল, সিরিয়া আর মিশর, তাদের নিয়ে অবশ্য বেশি বেগ পেতে হল না। অবস্থা দেখে তাঁরা আপনারাই এসে রোমের পায়ে মাথা ঠেকালে। সাম্রাজ্য যখন গড়ে উঠল তখন কাজে কাজেই তার বৈজ্ঞানিক চৌহদি’রও খোজ পড়ল। কৃষ্ণসাগরতীরের মিথরেডেটিস-এর রোমের শিকল ভেঙে হাত পা ছড়াবার দুরাকাঙক্ষা দমন উপলক্ষে, রাজ্যের পুব-সীমা ইউফ্রেটিসে গিয়ে ঠেকাল এবং স্বয়ং জুলিয়াস কেল্টদের মৃতদেহের উপর দিয়ে রোম সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমা আটলান্টিক পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলেন। সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্রাটেরও আবির্ভাব হতে খুব বেশি বিলম্ব ঘটল না। কেননা তিনশো বছর রাজ্যজয়ে আর রাজ্যভোগে প্রাচীন রোমান বল-বীৰ্য-ঐক্য সকলেরই তখন লোপ হয়েছে। প্রকৃতির পরিশোধা! আর পররাজ্যজয়ে যে সাম্রাজ্য ও সভ্যতার প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধজয়ী সেনাপতি তার নায়কত্ব না পেলেই বরং বিস্ময়ের কারণ হত। সিজারের উত্তরাধিকারীরা আরও তিনশো। বছর ধরে এই রোম-সাম্রাজ্য, যাকে কোনওরকমেই আর রোমাঞ্চন সাম্রাজ্য বলা চলে না, শাসন ও রক্ষা করলেন। রাজ্যের সকল জাতির লোকের মধ্যে রোম-নাগরিকের অধিকার ছড়িয়ে দেওয়া হল, কেননা তখন সকলেই রোম-সম্রাটের সমান প্ৰজা, ‘ফেলো সিটিজেনের অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘ফেলো সাবজেক্ট’। উচু আশা ও বড় আকাঙক্ষার তাড়না না থাকলে যে শান্তি আপনিই আসে, রাজ্যজুড়ে সে শান্তি বিরাজ করতে লাগল। ঘরকন্নার ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের উপযোগী পাকা আইন-কানুন এই বহুজাতি ভূয়িষ্ঠ রাজ্যের মধ্যে গড়ে উঠল। তারপর মানুষের গড়া অপর সকল রাজ্যের মতো রোম-সাম্রাজ্যও ভেঙে পড়ল। ইউরোপের সভ্যতার কেন্দ্ৰ ভূমধ্যসাগর ছেড়ে আটলান্টিক মহাসাগরকে আশ্রয় করল। তারই তীরে তীরে নবীন সব জাতির মধ্যে মানুষের সভ্যতার চির-পুরাতন ও চির-নূতন খেলার আরম্ভ হল।

 

এই যে ছয়-সাতশো বছরের রাজ্যজয় ও রাজ্যশাসনের পলিটিক্যাল ইতিহাস, রোমান সভ্যতা ও গৌরবের কাহিনিরও এই হল অন্তত চোদে আনা। একে বাদ দিলে রোমান সভ্যতার যা অবশিষ্ট থাকে তার গৌরবের কাছে প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার কথা দূরে থাক, তার চেয়ে অনেক ছোট সভ্যতারও মাথা নিচু করার কোনও কারণ দেখা যায় না। হেলেনিক সভ্যতার দৃষ্টান্তটি চোখের সামনে থাকতে নিজেদের সভ্যতার এই স্বরূপ সম্বন্ধে রোমানদের মনেও সংশয়ের কোনও অবসর ছিল না। আগস্টসের সভাকবি তার যুগের আত্মবিস্মৃতি রোমানদের প্রকৃত রোমান-গৌরব স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে বলছেন, ‘জানি আর আর সব জাতি আছে যাঁরা কঠিন ধাতুকে সুষমাময় গড়ন দিতে পারে, পাথরের হিম দেহ থেকে প্ৰাণের বিপুল উচ্ছাস খুঁড়ে বের করতে পারে, জ্ঞানের আঙুল আকাশে তুলে নক্ষত্ৰলোকেরও সকল বার্তা একে দেখাতে পারে, কথার সঙ্গে কথা গেথে লোকের করতালি নিতেও তাঁরা পটু, কিন্তু রোমান, এসব কাজ তোমার নয়। তোমার কাজ হল–সকল জাতির উপর রাজত্ব করা। সেই হল তোমার শিল্পকলা। তোমার গৌরব হল বিজিত রাজ্যে শান্তি আনা, উচুমাথাকে যুদ্ধে নিচু করা, পতিত যে শত্রু তাকে করুণা দেখান।’ ‘এনিড’ যে ইতিহাস নয়, কাব্য, পতিত শক্রকে করুণা দেখানের কথা বলে ভার্জিল বোধ হয় তারই ইঙ্গিত করেছেন। কেননা রোমের ইতিহাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এ বস্তুটি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। যাহোক, লাতিন কবির রোমান সভ্যতা ও গৌরবের এই বর্ণনাটি আধুনিক কালের রোমানতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরাও একরকম সকলেই মেনে নিয়েছেন। কারণ না মেনে উপায় নাই। এবং এরই মধ্যে মানুষের সভ্যতা, প্রকৃতি ও শক্তির বিরাট বিকাশ দেখে তাঁরা বিস্ময়ে স্তম্ভিত ও প্রশংসায় উচ্ছসিত হয়ে উঠেছেন। মানি, বহু জাতিকে যুদ্ধে পরাজয় করতে হলে জাতির মধ্যে যে বীর্য, যে ঐক্য, যে রাজনৈতিক বুদ্ধি ও বন্ধনের প্রয়োজন, তার মূল্য কিছু কম নয়। কিন্তু এই বস্তুকে সভ্যতার একটা শ্রেষ্ঠ বিকাশ বললে মানুষের প্রকৃতিকেই অপমান করা হয়। আর জাতির এই বীৰ্য, ঐক্য ও বুদ্ধি যখন পরের দেশ জয় ও পরের উপর আধিপত্যেই নিঃশেষে ব্যয় হয়, তখন তার শক্তি দেখে অবশ্য স্তম্ভিত হতে হয়, যেমন কালবৈশাখীর রুদ্রমূর্তিতে মানুষ স্তম্ভিত হয়। প্রকৃতপক্ষে একটা সমগ্ৰ জাতি, নবীন শক্তি সঞ্চারের আকস্মিক উন্মাদনায় নয়, কিন্তু যেমন মমসেন দেখিয়েছেন, শতাব্দীর পর শতাব্দীর সূক্ষ্ম লাভ লোকসানের হিসােব গণনা করে চোখের সুমুখে যখনই যাকে প্রবল বা বর্ধিষ্ণু দেখেছে তারই বুকের উপর পড়ে তার জীবনের বল নিঃশেষে শুষে নিয়ে নিজেকে পুষ্ট করেছে, রোমান ইতিহাসের এই ব্যাপারটি তার ভীষণতায় মানুষকে স্তম্ভিত না করেই পারে না; খ্রিস্টান ও পারসি পুরাণে যে অন্ধকার ও অমঙ্গলের দেবতার কল্পনা আছে সেটা ভিত্তিহীন নয় বলেই মানুষের বিশ্বাস জন্মায়।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রোমের এই প্ৰবল পলিটিক্যাল সভ্যতা, কেবল সমসাময়িকদেরই মাথা ভয়ে হেঁট করিয়ে রাখেনি, কিন্তু উত্তরকালের ঐতিহাসিকদেরও শ্রদ্ধায় নতমুণ্ড করে রেখেছে। প্ৰাণতত্ত্ববিদেরা হয়তো বলবেন মানুষ পশুরই বংশধর; শক্তির বিকাশ দেখলেই পূজা না করে থাকতে পারে না। মমসেন বলেছেন, এথেন্স যে রোমের মতো রাষ্ট্র গড়তে পারেনি, সে জন্য তার দোষ ধরা মূর্থিতা। কেননা গ্রিক প্রকৃতির যা কিছু শ্ৰেষ্ঠত্ব ও যা কিছু বিশেষত্ব, তা ছিল তেমন একটা রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রতিকূল। অনিয়ন্ত্রিত রাজতন্ত্রকে বরণ না করে, গ্রিসের পক্ষে জাতীয় একতা থেকে রাষ্ট্রীয় ঐক্যে পৌঁছান সম্ভব ছিল না। সেই জন্য গ্রিসে জাতীয় একত্বের যখনই বিকাশ ঘটেছে সেটা কোনও রাষ্ট্রীয় ভিত্তির উপর ভর করে নয়। অলিম্পিয়ার ক্রীড়াঙ্গন, হোমারের কবিতা, উরিপিডিসের নাটক, এইসবই ছিল হেলাসের ঐক্য বন্ধন। ঠিক আবার তেমনি ফিডিয়াস কি আরিস্টফেনিসের জন্ম দেয়নি বলে রোমকে অবহেলা করা অন্ধতা। কেননা রোম স্বাধীনতার জন্য স্বাতন্ত্র্যকে, রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য ব্যক্তির ইচ্ছা ও শক্তিকে নির্মমভাবে দমন করেছে। ফলে হয়তো ব্যক্তিগত বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়েছে, প্রতিভার ফুলও মুকুলেই ঝরে পড়েছেঃ কিন্তু তার বদলে রোম পেয়েছে স্বদেশের উপর এমন মমত্ববোধ ও ‘পেট্রিয়টিজম’, গ্রিসের জীবনে যার কোনওদিন প্ৰবেশ ঘটেনি। এবং প্রাচীন সভ্যজাতিগুলির মধ্যে রোমই স্বাধীন রাজতন্ত্রের ভিত্তির উপর জাতীয়-ঐক্যের প্রতিষ্ঠায় কৃতকাৰ্য হয়েছে। সেই জাতীয়-ঐক্যের ফলে কেবল বিচ্ছিন্ন হেলিনিক জাতির উপরে নয়, পৃথিবীর সমস্ত জানা অংশের উপর প্রভুত্ব, তাদের করতলগত হয়েছিল।

আমাদের শাস্ত্ৰে ‘পুরুষের’ শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই, তাই শেষ, তাই ‘পরা গতি’। পরিচিত সমস্ত পৃথিবীর উপর অবাধ প্ৰভুত্ব কি মানবসভ্যতার ‘পুরুষ, তার ‘কাষ্ঠা’ ও ‘পরা গতি’! এ প্রভুত্ব তো কালে উঠে কিছুকালের পরই বিলোপ হয়; মানুষের সভ্যতার ভাণ্ডারে কিছুই স্থায়ী সম্পদ রেখে যায় না। আমার সুমুখে উরিপিডিসের কয়েকখানি নাটক রয়েছে। এগুলি তো কেবল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর হেলাসের ঐক্য-বন্ধন নয়। তেইশশো বছর আগেকার এথেন্সের নাগরিকের মতো আমিও যে আজ সে কাব্যের রসে মেতে উঠছি। এগুলি যে চিরদিনের জন্য মানবসভ্যতার অক্ষয় মঞ্জুষায় সঞ্চিত হয়ে গেছে। যুগের পর যুগ বিশ্বজন এর সুধা আনন্দে পান করবে। আর রোমের প্রভুত্ব?–সেটি রয়েছে— ওই মমসেনের পৃষ্ঠায়। এই যে প্রভেদ, এ তো মমসেনের চার ভালুমও মুছে ফেলতে পারেনা। একে কেবল মানুষের সভ্যতার প্রকার ভেদ বলে আপস-মীমাংসার চেষ্টায় কোনও ফল নাই। এর একটির চেয়ে আর-একটি শ্রেষ্ঠ, নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ; যেমন জড়ের চেয়ে জীবন শ্রেষ্ঠ, প্ৰাণের চেয়ে মন শ্রেষ্ঠ।

মানুষের সভ্যতার ধারা দুই। এক ধারা বয়ে যাচ্ছে–কেবলই কালের মধ্য দিয়ে— জাতিকে, সভ্যতাকে ভাসিয়ে নিয়ে স্মৃতি ও বিস্মৃতির মহাসাগরে মিশিয়ে দিচ্ছে। নূতন জাতি, নূতন সভ্যতার স্রোত এসে ধারার প্রবাহকে সচল রাখছে। আর এক ধারা জন্ম নিয়েছে কালেরই মধ্যে, কিন্তু কালকে অতিক্রম করে ধ্রুবলোকে অক্ষয় স্রোতে নিত্যকাল প্রবাহিত হচ্ছে। নূতন স্রোত এসে এ ধারাকে পুষ্ট করছে, কিন্তু এতে একবার যা মিশছে, তার আর ধ্বংস নেই, তা অচ্যুত। কেননা এ লোকে তো পুরাতন কিছু নেই, সবই সনাতন, অর্থাৎ চিরনূতন। সভ্যতার সৃষ্টির এই যে নশ্বর দিকটা এ কিছু তুচ্ছ নয়। এইখানেই বিবিধ মানবের বিচিত্র লীলা, সমাজ গঠনে, রাষ্ট্র নির্মাণে, শৌর্যে, বীর্যে, মহত্ত্বে, হীনতায় চিরদিন তরঙ্গিত হয়ে উঠছে। হোক না এ মৃত্যুর অধীন, তবুও জীবনের রসে ভরপুর। কিন্তু মানুষ তো কেবল জীব নয়। সে যে মর-আমরের সন্ধিস্থল। মৃত্যুর পথে যাত্রী হয়েও সে অমৃতলোকেরই অধিবাসী। তাই তার সৃষ্টির যেটা শ্রেষ্ঠ অংশ সেটা কালের অধীন নয়। তার ইতিহাস আছে কিন্তু তা ঐতিহাসিক নয়। সেখানে যে ফুল একবার ফোটে তার প্রথম দিনের গন্ধ সুষমা চিরদিন অটুট থাকে; যে ফল একবার ফলে, রসে আস্বাদে তো চিরদিন সমান মধুর।

দুই সভ্যতার যদি শ্রেষ্ঠত্বের মীমাংসা করতে হয়, তবে মানুষের সভ্যতার এই অক্ষয় ভাণ্ডারে কার কতটা দান, তাই হল বিচারের প্রধান কথা। এ মাপকাঠিতে মাপলে, রোমান সভ্যতা গ্রিক কি হিন্দুসভ্যতার সঙ্গে এক ধাপে দাড়াতে পারে না। তাকে নীচে নেমে দাঁড়াতে হয়। যত দিন তার সাম্রাজ্য ছিল, তত দিন তার বলের কাছে–সবারই মাথা নিচু করে থাকতে হয়েছে। কিন্তু উত্তরকালের লোকেরা কেন তার কাছে সম্রামে নতশির হবে? তাদের জন্য তো সে বিশেষ কিছু সঞ্চয় করে রেখে যায়নি। তার যা প্রধান দাবি, তার পলিটিক্যাল শক্তি ও বুদ্ধি, তার পাওনা তো তার সমসাময়িকেরা একরকম ষোলো আনাই মিটিয়ে দিয়েছে। আমাদের কাছে সে দাবির জোর খুব বেশি নয়। তার গৌরবের চোদে আনা হল তার ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাস জীবনের কাহিনি হলেও জীবন নয়, কেবলই কাহিনি। তার পৃষ্ঠার সঙ্গে মানুষের আত্মার কোনও সাক্ষাৎ যোগ নাই। একজন ফরাসি পণ্ডিত রোমানদের দার্শনিক আলোচনা সম্বন্ধে বলেছেন যে, সেগুলি এখন বক্তৃতা-শিক্ষার ইস্কুলের ছাত্রদের লেখা প্ৰবন্ধের মতো মনে হলেও যাদের জন্য সেগুলি লেখা হয়েছিল তাদের জীবনে ওর প্রভাব ছিল খুব বেশি। সুতরাং এ সব দার্শনিকের মূল্য বুঝতে হলে সেই সময়কার রোমের ইতিহাসের সঙ্গে সে-সব মিলিয়ে পড়তে হবে। হায় রোম, তোমার দার্শনিক চিন্তারও ইতিহাসের হাত থেকে মুক্তি নাই!

 

রোমের পলিটিক্যাল গৌরবের গুণগান মুখে যতই কেন থাকুক না, রোমান সভ্যতার এই প্রকৃতিটি পণ্ডিতদের মনে অস্বস্তির সঞ্চার না করে যায়নি। সেই জন্য ইউরোপের বর্তমান সভ্যতা, রোমের সভ্যতা ও সাম্রাজ্যের কাছে কেমন করে কতটা ঋণী, মমসেন তার বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এবং ছোট বড় মাঝারি সকল পণ্ডিতই তার পুনরাবৃত্তি করেছেন। সে ব্যাখ্যার প্রধান কথাটা এই—রোম সাম্রাজ্যের প্রাচীর যদি বর্তমান ইউরোপীয় জাতিগুলির অসভ্যকল্প পূৰ্বপুরুষদের ঠেকিয়ে না রাখত, তবে তাঁরা যখন রোম সাম্রাজ্যের উপরে পড়ে তাকে ধবংস করেছিল, সে ঘটনাটি ঘটত আরও চারশো বছর আগে। এবং তা হলে বিস্তীর্ণ রোম সাম্রাজ্যের মধ্যে–স্পেনে, গলে, ড্যানিউবের তীরে তীরে, আফ্রিকায়, হেলেনিক সভ্যতার নব সংস্করণ মেডিটারেনিয়ন সভ্যতা যে শিকড় বসাতে সময় পেয়েছিল, তা আর ঘটে উঠত না। আর তার ফল হত এই যে, ওই অর্ধসভ্য জাতিগুলি ওই সভ্যতার সংস্পর্শে এসে যে আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা গড়ে তুলেছে, তা কখনও গড়তে পারত না।

মানুষের ইতিহাসে যে ঘটনাটা একরকমে ঘটে গেছে, সেটা সেরকম না ঘটে অন্য রকম ঘটলে তার ফলাফল কী হত এ তর্ক নিরর্থক। তাতে ‘স্বপ্নলব্ধ’ ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। সুতরাং রোম সাম্রাজ্যকে তার চৌকিদারির প্রাপ্য প্রশংসাটা নির্বিবাদেই দেওয়া যাক। কিন্তু এ তো রোমান সভ্যতার কোনও গৌরবের কাহিনি নয়! এবং রোম সাম্রাজ্যকে যাঁরা চারশো বছর ধরে রক্ষা করেছিলেন তাঁরা নিশ্চয়ই আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার মুখ চেয়ে তা করেননি! আর এটাও যদি গৌরবের কথা হয় তবে রোমকে আরও একটা গৌরবের জন্য পূজা দিতে হয়। সে হচ্ছে ঠিক সময়ে সাম্রাজ্যের প্রাচীরকে রক্ষা করতে না পারা। কেননা রোম যদি আরও চারশো বছর সাম্রাজ্যকে অটুটই রাখতে পারত, তবে তো আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা আরও চারশো বছর পিছিয়ে যেত এবং হয় তো সে সভ্যতা আর তখন গড়েই উঠতে পারত না! ইতিহাসে তার ওজন কত, সেটা সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের মাপ নয়।

এই যে চারশো বছর ধরে পৃথিবীর একটা বৃহৎ অংশে বিচিত্র সব জাতি পরস্পরের সংস্পর্শে এল তার ফলে সৃষ্টি হল কী? মেডিটারেনিয়ন সভ্যতার এই প্রকাণ্ড শূন্যতা, সমস্ত পলিটিক্যাল সভ্যতা–রাজ্য-জয় ও রাজ্য-শাসনের সভ্যতার উপর একটা বিস্তৃত ভাষ্য। বিস্তীর্ণ বাগানের চারপাশে পাথর দিয়ে বেড় দেওয়া হল পাছে আকস্মিক বিপৎপাতে বাগান নষ্ট হয়। পাথরের দেয়াল খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, কিন্তু বাগানে ফুলও ফুটিল না, ফলও পাকল না।

 

রোমান সভ্যতার এই যে উচ্চ জয়গান, এ যে কেবল মিথ্যা তুতি তা নয়, এর কলরোল পৃথিবীর প্রবল জাতিগুলির মন চিরদিন বিপথের দিকেই টানবে। যেই যখন শক্তিশালী হয়ে উঠবে তারই মনে হবে মানুষের বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে পৃথিবীর যতটা অংশের উপর পারা যায়, নিজের আধিপত্যের একরঙা তুলিটা বুলিয়ে নেওয়া কেবল স্বাৰ্থ সিদ্ধির উপায় নয়, সভ্যতায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভেরই পথ। এ যে অতিশয়োক্তি নয়, তার প্রমাণ মমসেন থেকেই তুলে দিচ্ছি। সিজারের গল বিজয়ের বর্ণনা মমসেন এই বলে আরম্ভ করেছেন–’যেমন মাধ্যাকর্ষণ ও আর আর পাঁচটা প্রাকৃতিক নিয়ম যার অন্যথা হবার জো নেই তেমনি এও একটা প্রাকৃতিক নিয়ম যে, যে জাতি রাষ্ট্র হয়ে গড়ে উঠেছে সে তার অ-রাষ্ট্রবদ্ধ প্রতিবেশী জাতিগুলিকে গ্ৰাস করবে, এবং সভ্যজাতি, বুদ্ধিবৃত্তিতে হীন তার প্রতিবেশীদের উচ্ছেদ করবে। এই নিয়মের বলে ইতালি জাতি (প্রাচীন জগতের একমাত্র জাতি যে শ্রেষ্ঠ পলিটিক্যাল উন্নতির সঙ্গে শ্রেষ্ঠ সভ্যতা মেশাতে পেরেছিল, যদিও শেষ বস্তুটির বিকাশ তাতে অপূর্ণভাবে এবং কতটা বহিরাবরণের মতোই ছিল) পুবের গ্রিকদের, যাদের ধ্বংসের সময় পূর্ণ হয়ে এসেছিল, তাদের করায়ত্ত করতে, এবং পশ্চিমের কেল্ট জার্মনদের, যাঁরা সভ্যতার সিঁড়ির নীচের ধাপে ছিল, তাদের উচ্ছেদ সাধন করতে সম্পূর্ণ অধিকারী ছিল।’

প্রাকৃতিক নিয়ম যে কেমন করে অধিকারে পরিণত হয় সে রহস্যের চাবি হয়তো হেগেলের লজিকেও মিলবে না। সে যাই হোক এ নিয়ম’ ও ‘অধিকারের’ মুশকিল। এই যে এর জন্য পৃথিবীর সমস্ত জাতিকে সারাক্ষণ নখদন্ত বের করেই থাকতে হয়। কেননা মল্লাঙ্গনই হচ্ছে এ ‘অধিকার’ প্রমাণের একমাত্র স্থান। কারণ বুকের উপর চেপে বসতে পারলেই প্ৰমাণ হল যে চেপে বসার অধিকার আছে; আর তাই হল এ অধিকার প্রমাণের একমাত্র শাস্ত্রীয় প্রথা। তারপর শক্তি থাকলেই যখন অধিকার’ আছে, তখন শক্তির পরীক্ষার অধিকার থেকেও কাউকে বঞ্চিত করা চলে না। পরীক্ষা না করলে তো শক্তিটা ঠিক আছে কি না তা আগে থেকে আমনি জানিবার উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত ফেলা হলেও ‘হলে’ ঢোকার অধিকার অস্বীকার করা যায় কেমন করে? গেল চার বছর ধরে এই পরীক্ষাটা সারা ইউরোপ জোড়া চলছে। মমসেনের সৌভাগ্য যে বেঁচে থেকে তার প্রণালীর ফলটা দেখে যেতে হয়নি। কিন্তু প্রাচীন রোমের গুণগানে যাঁরা মুখর, আধুনিক জার্মানির উপর মুখ বঁকানোর তাদের কোনও অধিকার নেই। কার্থেজ ও মিশর বিজয় যদি রোমের পক্ষে ছিল গৌরবের, তবে বেলজিয়মকে গ্ৰাস করা জার্মানির পক্ষে আগৌরবের কীসে? আজকাল পলিটিকসে যা হীন, কালকার ইতিহাসে তা মহৎ হয় কোন ন্যায়ের জোরে?

এই যে পলিটিক্যাল শক্তি ও সভ্যতার তুতিগান–এ মূলে হল একটা ‘মায়া’। শঙ্কর ব্যাখ্যা করেছেন মায়ার প্রকৃতি অধ্যাস’, —একের ধর্ম অন্যে আরোপ করা। পৃথিবীর আদিযুগ থেকে যখন জাতিতে জাতিতে লড়াই চলে আসছে আর কোনও ‘লিগ অব নেশনে’-ই তা শেষ হবে বলে যখন বোধ হয় না, (কেননা ‘লিগের’। একটা অর্থ হচ্ছে এর ভিতরে যাঁরা আসবে না। তাঁরা শত্ৰু, আর বাইরে যাদের রাখা হবে তাদের এজমালিতে দমন করা চলবে) তখন জাতির রাষ্ট্ৰীয় শক্তি তার আত্মরক্ষার পক্ষে অমূল্য। জাতির প্রাণই। যদি না বাঁচে তবে তার মনের বিকাশও কাজে কাজেই বন্ধ হয়। কিন্তু এই শক্তি যখন আত্মরক্ষায় নয়-পর-পীড়নেই রত থাকে, রক্ষার চেষ্টায় নয়–ধ্বংসের লীলাতেই মেতে ওঠে তখনও যে তার পূজা, তার মূলে হল অধ্যাস’। একের গুণ আর একজনে দেখা, রামের পাওনা শ্যামকে বুঝিয়ে দেওয়া। অবিশ্যি এ দুয়ের সম্বন্ধ অতি নিকট। কিন্তু একান্ত ‘অবিষয় হলে তো ‘অধ্যাসেরও উৎপত্তি হয় না।

আশ্বিন ১৩২৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *