• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

মির্জা নাথানের চোখে বাংলার ভুঁইয়াদের হাতি

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » প্রবন্ধ » মির্জা নাথানের চোখে বাংলার ভুঁইয়াদের হাতি

মুঘল বাহিনীর হয়ে বাংলাদেশে ১৬ বছর যুদ্ধ করেন মির্জা নাথান। সে ইতিহাস তিনি লিখেছেন বাহারীস্তান-ই-গায়বী বইটিতে। প্রতিপক্ষ হলেও বারোভুঁইয়াদের বীরত্ব, আত্মত্যাগের কথা লিখেছেন তিনি। ভোলেননি সেইসব হাতির কথা যাদের হাতে মুঘলবাহিনী নাকাল হয়েছে।

মহাভারত থেকে আইন-ই-আকবরী সর্বত্র একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আছে হাতি। মগধ রাজ্যের হাতির খুব নামডাক শুনে গ্রিক সেনারা আর এগোতে না চাওয়ায় আলেকজান্ডারকে ফিরে যেতে হয়েছিল। এটা স্কুলের ছাত্ররাও জানে। পাল ও সেন রাজাদের হাতির বহরের কথা তাঁদের সভাকবিরা ‘বিশেষণে সবিশেষ লিখে’ গেছেন প্রশস্তি ও তাম্রলিপিতে। মুঘল যুগের আঁকা ছবিতে মুঘল হাতির দাপট, দেহসৌষ্ঠব, সদম্ভ পদচারণ আজও রীতিমতো সম্ভ্রম আদায় করে। বাংলার নবাবদেরও ছিল যুদ্ধে সুশিক্ষিত হাতির বিশাল বাহিনী। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার হস্তীবাহিনী নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের কূটচালে।

উপমহাদেশের ঐতিহাসিক প্রায় সব যুদ্ধের জয়-পরাজয়ে হাতির ছিল বিশাল ভূমিকা। ভারতে মুসলমান অভিযানের সাফল্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে ঐতিহাসিক অধ্যাপক মো· হাবিবুল্লাহ মুসলমান বাহিনীর সুশিক্ষিত ঘোড়ার তড়িৎগতির আক্রমণকে বিজয়ের একটি বড় কারণ হিসেবে শনাক্ত করেছেন। পক্ষান্তরে হাতির বহরের ওপর ভারতীয় বাহিনীর নির্ভরশীলতা স্থানীয় রাজাদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছেন তিনি। সহজেই দিক পরিবর্তনে সমর্থ দ্রুতগতিসম্পন্ন ঘোড়ার তুলনায় বিশাল এবং ধীরগতির হাতি আগন্তুক মুসলমান বাহিনীর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেনি। উত্তর ভারতের শুষ্ক আবহাওয়ায় এবং বৃষ্টিবিহীন মাঠঘাটে ঘোড়ার এই তুলনামূলক সুবিধাগুলো নদীমাতৃক, বৃষ্টিবহুল জলাজঙ্গুলে বাংলাদেশের ভেজা স্যাঁতসেঁতে যুদ্ধের মাঠে অনেকটাই অকেজো হয়ে দাঁড়ায়। উত্তর ভারতের যুদ্ধের প্রান্তরে ঘোড়ার দাপট বাংলা মুকুলকে এসে অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। এর প্রমাণ রয়েছে ইংরেজ বণিক র‌্যেলফ ফ্লিচের (১৫৮৩-১৫৯০) বর্ণনায়, যিনি আকবরের জন্য রানি এলিজাবেথের চিঠি নিয়ে হিন্দুস্থানে এসেছিলেন।

ফ্লিচ দুবার বাংলায় আসেন-১৫৮৩ এবং ১৫৮৪ সালে। তখন দখলদার মুঘলশাসন সবেমাত্র বাংলায় ভিত গেড়ে বসার চেষ্টা করছে, আর দক্ষিণ বাংলায় স্বাধীনতাকামী বারোভুঁইয়াদের সঙ্গে মুঘলদের যুদ্ধ লেগেই রয়েছে। সম্মুখযুদ্ধ ছাড়াও বারোভুঁইয়ারা কিছুটা আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের ধরনে আকবরের বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রাখার কৌশল নিয়েছিল। স্থানীয় অধিবাসীদের আকবরের প্রতি বিরোধিতা বেশ ভালোভাবেই ধরা পড়েছিল ফ্লিচের চোখে। আকবরের ঘোড়াগুলোর নাকাল হওয়ার ঘটনাও তাঁর রচনায় ধরা পড়েছে-‘···বাংলাদেশের চাটিগাঁও থেকে আমি বাকোলোতে আসি।···বাকোলো থেকে আমি সিরিপুর যাই। এটি গঙ্গা নদীর ওপর অবস্থিত। রাজার নাম চাঁদ রায়। কাছাকাছি সব দেশের লোকেরা জালালউদ্দিন আকবরের বিরোধী। এ দেশে এত নদী আর দ্বীপ যে লোকে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে পালিয়ে যায়। আকবরের ঘোড়সওয়ারেরা তাদের কিছুই করতে পারে না···।’
বারোভুঁইয়ারা নিজেদের কোনো ইতিহাস লিখে রেখে যাননি। বাংলাদেশের সে সময়কার অবস্থা জানার উপায় পর্যটক ইবনে বতুতার বিবরণ ও চীন দেশের সরকারি প্রতিবেদন। মুঘল সেনানী মির্জা নাথান যদি বাংলার মুঘল বনাম বারোভুঁইয়ার যুদ্ধবিগ্রহ এবং তাঁদের আত্মসমর্পণের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস না লিখতেন তাহলে বারোভুঁইয়াদের ইতিহাস বা তাঁদের হাতির বহর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। বারোভুঁইয়াদের বশ্যতা আদায়ের জন্য মুঘল বাহিনীর হয়ে বাংলাদেশে ১৬ বছর যুদ্ধ করেন তিনি। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ হিসেবে তাঁর লেখার মূল্য অপরিসীম। এই প্রামাণ্য দলিলটি না থাকলে বারোভুঁইয়াদের বীরত্বগাথা, তাঁদের আত্মত্যাগ এবং স্বাধিকার রক্ষার্থে জীবনপণ যুদ্ধ-সবই বি্নৃতির অতলে হারিয়ে যেত।

মির্জা নাথানের বইটির নাম বাহারীস্তান-ই-গায়বী। বীর বারোভুঁইয়াদের সর্বশক্তি দিয়ে মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, ক্রমান্বয়ে তাঁদের পরাজয় এবং আত্মসমর্পণের লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে খাজা ওসমানের আমরণ প্রতিরোধ চালিয়ে দেশের স্বাধিকারের জন্য জীবনদানের অসামান্য কাহিনী লিখেছেন তিনি। লিখেছেন পূর্ববাংলার নদ-নদী, জলাজঙ্গল, পাখপাখালির কথা। এই বই থেকেই আমরা প্রথম জানতে পারি যে জাহাঙ্গীরের আমলে মুঘলদের অধিকার থেকে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে প্রকৃত নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুসা খাঁ মসনদে আলা ও তাঁর মিত্ররা এবং ভাটির অবিসংবাদিত নেতা খাজা ওসমান। অনেকের মতে, মুসা খাঁ ও খাজা ওসমান ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশ নিলে বাংলার ইতিহাস হয়তো ভিন্ন পথে মোড় নিত।
এই যুদ্ধে বাংলার হস্তীবাহিনীর ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নাথান সেই সব হাতির কথাও লিখেছেন। তিনি ছিলেন পশুপ্রেমী, তাঁর ছিল অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। হাতির জীবন প্রণালী জানতেন তিনি, হাতির মর্জি-মেজাজ আর যুদ্ধক্ষেত্রে তার আবশ্যিকতা বুঝতেন; যুদ্ধক্ষেত্রে হাতিকে উজ্জীবিত করার প্রক্রিয়া ছিল তাঁর নখদর্পণে।

মুঘলদের সঙ্গে বাংলার বারোভুঁইয়ার যুদ্ধে হাতির গুরুত্ব বুঝতে একটিমাত্র মাপকাঠিই যথেষ্ট। সেটি হলো মুঘল বাহিনীর বারো ভুঁইয়াদের দেওয়া আত্মসমর্পণের শর্তাবলি, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হাতি সম্পর্কিত শর্তটি। শর্তটি এই-পরাজিত ভুঁইয়াদের হাতিশালার সব ‘ফিলান-ই-দান্দানদার’ অর্থাৎ সব দাঁতাল হাতি মুঘল ফৌজের হাতে সমর্পণ করতে হবে। সঙ্গে থাকবে এক পুত্র বা ভাই। আত্মসমর্পণকারী ব্যবহারের জন্য কয়েকটি মাদি হাতি রাখতে পারবে। বেশির ভাগ নৌকাই বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছিল এবং বড় বড় নৌকা ভেঙে ফেলা হচ্ছিল। হাতি আর নৌকা থাকলে বাংলার জলাজঙ্গলে ঘোড়া নয়, হাতিই যুদ্ধের প্রধান সহায়। বন-জঙ্গল আর অগভীর জলা ভেঙে ঘোড়ার পক্ষে চলাচল প্রায় অসম্ভব। শুধু যুদ্ধের মাঠে তো বটেই, ভারী কামান, কামানের গোলাবারুদ এবং যুদ্ধের অন্যান্য রসদ এই জলাজঙ্গলের পথে নিরাপদে বয়ে নেওয়ার জন্যও হাতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। হাতি নিজেই একটি মারাত্মক যুদ্ধাস্ত্র-অনেকটা আধুনিক যুগের ট্যাংকের মতো পদাতিক ও ঘোড়সওয়ার বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করতে বেজায় পারঙ্গম।

মির্জা নাথান চর মারফত যুদ্ধে তাদের হাতিগুলোর হিংস্রতা এবং রণক্ষেত্রে দক্ষতা সম্পর্কে আগাম খবর রাখতেন। প্রতিপক্ষের হাতিগুলোর যুদ্ধে অভিজ্ঞতা ও যুদ্ধের ধরন মাথায় রেখেই তিনি সেনাদল সাজাতেন। যাতে সুযোগমতো ধারালো তরবারি দিয়ে পা কেটে ফেলে হাতিগুলোকে অকেজো করে দেওয়া যায়; ভুঁইয়াদের হাতির আক্রমণে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি যেন কম হয়। মির্জা নাথান তাঁর গ্রন্থে ওসমানের হাতিগুলোর যুদ্ধ-নৈপুণ্য নিয়ে ‘ওসমানের হাতির অদ্ভুত কৌশল’ নামে একটি উপ-পরিচ্ছেদ লিখেছেন।
ঐতিহাসিক আর সি মজুমদার খাজা ওসমানের দুটি প্রধান হাতির নাম উল্লেখ করেছেন-বাজ ও বাখতা। মির্জা নাথান খাজা ওসমানের আরও কয়েকটি তারকা হাতির নাম উল্লেখ করেছেন-অনুপা, সিঙ্গালি বা সিংহলি, দাস্তা, সতরঞ্জি ইত্যাদি। মুঘল হাতিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাঘদলন, বালসুন্দর, চঞ্চল, ফাতহা, গোপাল ও রণসিঙ্গার। সিলেটের প্রখ্যাত ভুঁইয়া বায়েজিদের প্রধান হাতির নাম আবর। এ ছাড়া তাঁর আরও নয়টি প্রধান হাতি ছিল। নাথান লিখেছেন, বাঙালিদের হাতিগুলো মুঘল সেনাদের অনেকবার ছত্রভঙ্গ করেছে।

খাজা ওসমান জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুঘলদের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব ঘৃণাভরে ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন দিয়ে অনন্য বীরত্বগাথা রেখে গেছেন। খাজা ওসমানের প্রতি মুঘলদের আত্মসমর্পণের শেষ এবং চরমপত্রের কিছু অংশ মির্জা নাথানের লেখা থেকে তুলে দেওয়া যাক। আত্মসমর্পণের প্রস্তাবের বলা হয়’···যদি তিনি [খাজা ওসমান] বাদশা সালামতের [সম্রাট জাহাঙ্গীর] কাছে আত্মসমর্পণ করেন, তবে তাঁকে ক্ষমা করা হবে এবং তিনিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাবেন···বাদশার আদেশে পাঁচহাজারি মনসবদারের মর্যাদা গ্রহণ করা হবে। তাঁর জন্য বাদশার পক্ষ থেকে চিরস্থায়ী অনুগ্রহ।’ বারবার তাগাদা সত্ত্বেও খাজা ওসমান বশ্যতা স্বীকার করেননি।

মির্জা নাথান ওসমানের কথা লিখেছেন বস্তুনিষ্ঠভাবে; পরাজিত শত্রুকে তিনি বিদ্বেষবাণে বিদ্ধ করেননি, তাঁর চরিত্রহরণও করেননি। সমস্ত পূর্ব তথ্য বাতিল করে নাথানই আমাদের জানান যে দৌলাম্বাপুরের যুদ্ধে ওসমান বন্দুকের গুলিতে নয়, তীরের আঘাতে অন্ধ হয়ে যান। তবু তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সম্ভবত এই যুদ্ধক্ষেত্রেই তাঁর মৃত্যু হয়; তাঁর লাশ নিয়ে ওসমানের পুত্র ও ভাইয়েরা অক্নাৎ যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন। চাপের মুখে থাকা মুঘল বাহিনী প্রথমটা বিশ্বাস করতে পারেনি যে তাদের প্রতিপক্ষ যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর অবশ্য খাজা ওসমানের পুত্ররা আবার যুদ্ধের ময়দানে ফিরে এসে প্রবলবেগে মুঘলদের আক্রমণ করেন। এই দৌলাম্বাপুরের যুদ্ধে ওসমানের হাতির যে যুদ্ধনৈপুণ্য দেখিয়েছে তাঁর বিশ্বস্ত বিবরণ দিয়েছেন নাথান। যুদ্ধের একপর্যায়ে ওসমানের হাতি বাখতা নাথানের জীবন সংশয় করে তুলেছিল। শত্রুপক্ষের হাতি বলে নাথান কিন্তু কোনো অসত্যচারণের আশ্রয় নেননি।

মাতঙ্গের জমিদার পাহলোয়ান ছিলেন সবচেয়ে সাহসী এবং বীর যোদ্ধা। তিনি তাঁর প্রতিপক্ষ মুঘল শামসুদ্দিনকে পরাজিত ও নিহত করে নিজেও যুদ্ধে নিহত হন। নাথানের লেখায়ই আমরা জানতে পারি পাহলোয়ানের বিখ্যাত হাতি বাজের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী। বাজ ফটক ভেঙে শত্রুর দুর্গের ভেতরে সহজেই ঢুকে যেত। বাজের পায়ে ঝুলে ঝুলে পাহলোয়ানের সেনারা দুর্গে ঢুকে হাতাহাতি যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। মুঘল সেনারা বাজের চারটি পা-ই কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে। বাজ কিন্তু আসন্ন বিপদ টের পেয়েও যুদ্ধের মাঠ থেকে পালায়নি। আমরা ঘোড়ার প্রভুভক্তির কথা শুনে অভ্যস্ত, কিন্তু বাংলার এসব প্রভুভক্ত হাতির আত্মত্যাগের কথা ইতিহাসে খুব কমই লেখা হয়েছে। নাথান ওসমানের প্রধান হাতি বাখতারেওে বর্ণনা দিয়েছেন। বাখতা আকারে পাহাড়ের মতো। দুর্গের পাথর ভেঙে ফেলার মতো প্রচণ্ড শক্তি ছিল তার। মাহুতের হুকুম ছাড়া বাখতাকে একপাও নড়ানো যেত না। এই বিশেষ গুণটি যুদ্ধের মাঠে আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যাপারে বাখতাকে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। বাদশা জাহাঙ্গীর তাঁর জীবন্নৃতিতে বাখতাকে গজপতি নামে উল্লেখ করেছেন। এসব যুদ্ধ-হাতির অধিকাংশই ইস্পাত নির্মিত বর্মের মতো আচ্ছাদন ব্যবহার করত, যাকে বলা হতো পাখার। ইকবালনামায় উল্লেখ আছে, খাজা ওসমান তাঁর বাখতাকে সামনে রেখে মুঘলদের অগ্রবর্তী বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতেন। ওসমান তাঁর সব হাতি একসঙ্গে যুদ্ধের মাঠে নামাতেন না। রিজার্ভ হিসেবে দু-চারটি জঙ্গলে লুকিয়ে রাখতেন। বাখতাকে তিনি এভাবে লুকিয়ে রেখে যুদ্ধের চরম পর্যায়ে মাঠে নামাতেন।
মির্জা নাথান লিখেছেন, দৌলাম্বাপুরের সেই ভাগ্যনির্ধারক যুদ্ধে মুঘল হাতি গোপাল বাংলার হাতির পরাক্রমের সামনে টিকতে না পেরে মাহুতসহ রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিল। মির্জা নাথানের হাতি বাঘদলনকে ওসমানের একটি শক্তিশালী হাতি অনুপা নাজেহাল করে ছেড়েছিল। যার ফলে বাঘদলন পিছু হটতে বাধ্য হয়। নাথান আরও জানিয়েছেন, তাঁর হাতি চঞ্চল দুরন্ত সাহসে ওসমানের হাতি বাখতাকে তেড়ে আসে; কিন্তু ওসমানের সওয়ারের গুলিতে আহত হয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। ওসমানের আরেক হাতি সিংহলি মুঘল বাহিনীর বালসুন্দরকে আক্রমণ করে চাপের মুখে ফেলে। সিংহলি অবশ্য পরে মুঘলদের দুটি হাতির যৌথ আক্রমণে টিকতে না পেরে পিছু হটে। ওসমানের মৃতদেহ পাঠিয়ে দিয়ে তাঁর পুত্র ও ভাইয়েরা বাখতাকে নিয়ে আবার মুঘলবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মির্জা নাথানকে কোণঠাসা করে ফেলেন। ওসমানের বাখতা মির্জা নাথানের সেনাদের ছত্রভঙ্গ করে ফেলে এবং বাখতা মির্জা নাথানকে দাঁত দিয়ে শূন্যে তুলে ঘোড়াসহ দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়। নাথান মারাত্মকভাবে আহত হয়ে কোনো রকমে প্রাণরক্ষা করেন। ভাগ্য ভালো যে নাথান সেযাত্রা বেঁচে যান। তা না হলে খাজা ওসমান ও তাঁর হাতির বীরত্বকাহিনী আমাদের অজানাই থেকে যেত। মুঘল সেনারা বাখতাকে ঘিরে ধরে তার পা, শুঁড় ও দাঁত টুকরো টুকরো করে কেটে তাকে হত্যা করে। বীর বাখতা তার প্রভুর মতোই ভাগ্যবান, যুদ্ধক্ষেত্রে দুজনই বীরের মতো মরণকে আলিঙ্গন করেছে। প্রভুর মতো বাখতাকেও আর বন্দি হয়ে মুঘল রাজধানীতে গোলামির জীবন কাটাতে হয়নি।
খাজা ওসমানের পুত্র ও ভাইদের আত্মসমর্পণের পর তাঁদের সব হাতি ‘জাহাঙ্গীরনগর প্রকাশ ঢাকায়’ সুবেদার ইসলাম খানের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইসলাম খান ঢাকার পোলো খেলার মাঠে এসব যুদ্ধবন্দি হাতির প্রদর্শনীর আয়োজন করেন এবং নিজে উপস্থিত থেকে প্রদর্শনীর শোভা বৃদ্ধি করেন। কারণ, এর অব্যবহিত পরেই এসব হাতি মুঘল রাজধানীতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে সম্রাটের নিজের হাতিশালায়। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে, এই দীর্ঘ পথ চলতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে বেশ কিছু হাতি পথেই মারা যেত।

পোলো মাঠে প্রদর্শনীর সময় ওসমানের হাতি দাস্তা হঠাৎ ছুটে এসে একজন মুঘল সেনাকে আক্রমণ করে বসে। এসব হাতি অত্যন্ত সুশিক্ষিত, কুচকাওয়াজে অভ্যস্ত। কাজেই ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা হয়তো নয়। হাতির ্নৃতিশক্তি প্রখর এবং প্রতিশোধস্পৃহা দীর্ঘস্থায়ী হয়। তবে কি দাস্তা সেই দৌলাম্বাপুরের যুদ্ধের দুঃসহ ্নৃতিতে তাড়িত হয়ে এই মুঘল সৈনিককে আক্রমণ করে বসেছিল? কয়েক দিন পর হাতিসহ বায়েজিদ এবং সিলেটের অন্য প্রধানেরা ঢাকায় এসে পরিবারসহ আত্মসমর্পণ করলে ইসলাম খাঁ আবার ঝড়োকায় বসে প্রদর্শনী দেখলেন, অনুগত সেনাদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করলেন এবং হাতিগুলোকে অচিরেই মুঘল রাজধানীতে পাঠানোর আয়োজন করতে লাগলেন। খাজা ওসমানের হাতি সতরঞ্জিসহ যেসব হাতি যুদ্ধে আহত বা অসুস্থ হওয়ায় আগে পাঠানো সম্ভব হয়নি, হাতিগুলো সুস্থ করে রাজধানীতে পাঠানোর জন্য মির্জা নাথানের ওপর হুকুম হলো।
নাথানের বর্ণনা থেকে একটি তথ্য পরিষ্কার যে স্বশিক্ষিত হস্তীবিশারদ নাথান হাতিকে যুদ্ধের উপকরণ এবং যুদ্ধজয়ের সামগ্রী হিসেবেই দেখেননি, দেখেছেন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, পশুপ্রেমীর আগ্রহে এবং প্রকৃতিদরদির যত্নে। লেখায় তিনি দক্ষ ও কৃতী সেনাদের যেমন প্রশংসা করেছেন, তেমনি রণক্ষেত্রে হাতিগুলোর কষ্টসহিষ্ণুতা ও আত্মত্যাগের জন্য একটি একটি করে নাম ধরে এগুলোর বীরত্ব বর্ণনা করেছেন। তাঁর চোখে হাতিগুলো যেন একেকটি বিশ্বস্ত, অনুগত ও জীবনবাজি রাখা সৈনিক; এরা প্রাণপণে যুদ্ধ করেছে, আহত হয়ে রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়নি, যুদ্ধের মাঠেই মারা গেছে। প্রতিপক্ষের হাতিগুলোর নামধাম তিনি জানতেন, এমনকি সেগুলোর সাহসিকতা ও ডাকাবুকো স্বভাবের প্রশংসাও করেছেন। প্রতিপক্ষের যোদ্ধার চেয়ে নাথান যেন তাদের হাতিগুলোর প্রতি বেশি দরদি। এই নাথান বাংলা দখল আর বাঙালি দমনকারী নাথান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
খাজা ওসমান ও বায়েজিদের রণক্লান্ত বন্দী হাতিগুলো সুদূর মুঘল রাজধানীর দিকে পদযাত্রা শুরু করল। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে কয়টি হাতি গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছিল জানা যায় না। হাতিগুলোর জন্য শাহি মেহমানের মর্যাদা অপেক্ষায় ছিল না, ছিল পায়ে বেড়ি পরার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। বাংলার শ্যামল বন্যতার নিবিড় মাতৃক্রোড় ছেড়ে মাহুত বন্ধুর বাঁশিয়াল আদরের বিপরীতে হাতিগুলোর কপালে জুটল মুঘল রক্ষীর আকশী বল্লম। আরও জুটেছিল বন-পাহাড়, মুক্ত আকাশ, অবারিত আলো-হাওয়ার পরিবর্তে হঠাৎ যবনিকা টানা নীরেট পাথরের জঙ্গল আর আগ্রার গরমের তপ্ত প্রদাহ। মুঘল শিল্পীদের তুলিতে বাংলার শস্য-শ্যামল প্রান্তর আর বর্ষার মিষ্টি পানির ঝঙ্কারের চমৎকার সব হাতির ছবি আঁকা আছে। এই হাতিগুলোর মধ্যে বিষণ্ন নয়ন কয়েকটি হাতির ছবিও চোখে পড়ে। এই হাতিগুলোর মধ্যে যে বাংলা থেকে কেড়ে নেওয়া দু-চারটি হাতি নেই এমন কথা কে বলবে!

কথায় আছে, বাংলা মুলুকের একটি স্বভাব লাবণ্য রয়েছে, যা মোহ বিস্তার করে। মির্জা নাথান বাংলায় ১৬ বছর কাটিয়েছিলেন। তাঁর রচনায় বাংলার গরম, ঝড়ের তাণ্ডব, নদীর প্রমত্ততা, রোগ-ব্যাধি কোনো কিছু নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই, নেই ভিনদেশির অহেতুক শঙ্কা অথবা দর্পিত সেনানীর অসহিষ্ণু সমালোচনা। তবে কি নাথানও বাংলার কুহকে মজেছিলেন? কে জানে!

মাহবুব আলম
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৫, ২০০৮

Category: প্রবন্ধTag: মাহবুব আলম
Previous Post:মার্কেসের বিদায়ী চিঠি
Next Post:Carrot Raita and Saucy Eggs

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑