• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৪.বিপ্লবের সাথী প্ৰমীলা

লাইব্রেরি » অতুল সুর » প্রমীলা প্রসঙ্গ (১৯৩৯) » ০৪.বিপ্লবের সাথী প্ৰমীলা

বিপ্লবের সাথী প্ৰমীলা

অন্তঃপুরে থেকেই যে প্ৰমীলা পুরুষ ভজে, তা নয়। বিপ্লবেও সে পুরুষের সাথী হয়। অন্তত বাংলা উপন্যাসে আমরা তাই দেখি। বাংলা উপন্যাসে বিপ্লবী নারীর সংখ্যা খুবই কম। এখানে আমরা মাত্র, পাঁচজন বিপ্লবী নারীর কাহিনী বিবৃত করছি। যে পাঁচখানা উপন্যাসে আমরা এদের সাক্ষাৎ পাই, সে পাঁচখানা উপন্যাস হচ্ছে বঙ্কিমের ‘ত্ৰয়ী’-যথা আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী ও সীতারাম, শরৎচন্দ্রের পথের দাবী ও রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায়। বঙ্কিমের নায়িকারা হচ্ছে শান্তি, প্ৰফুল্ল ও শ্ৰী, শরৎচন্দ্রের সুমিত্রা ও রবীন্দ্রনাথের এলা। প্ৰথম তিনজন নায়িকার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর বিস্রস্ত ইতিহাসের বিশৃঙ্খলতার মধ্যে, আর শেষের দুজনের বিংশ শতাব্দীর স্বাধীনতা-সংগ্রামের চঞ্চলতার মধ্যে। প্ৰথম তিনজন ছিল বিবাহিতা; শেষের দুজন অবিবাহিত।

শান্তি ও প্ৰফুল্লর কর্মব্যঞ্জনার অভিকেন্দ্র ছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির অভ্যন্তরে। অনাবৃষ্টির জন্য ফসল হয়নি। দুর্ভিক্ষের করালা ছায়ায় সমগ্ৰ দেশ আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। অনশনে ও মহামারীতে দেশের এক-তৃতীয়াংশ লোক মারা গিয়েছিল। মহম্মদ রেজা খাঁ তখন রাজস্ব-আদায়ের কর্তা। দেশের এই নিদারুণ দুঃসময়ে রেজা খাঁ একেবারে শতকরা দশ টাকা হারে রাজস্ব বাড়িয়ে দিয়েছিল। জমিদাররা রাজস্ব দিতে পারল না। হেষ্টিংস ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের কৃপায় ইজারাদার দেবীসিংহ জমিদারীসমূহ জলের দামে কিনে নিল। জমিদারদের ঋণ শোধ হল না। দেনার ওপর দেন হল। দেবীসিংহের

অত্যাচার বাড়তে লাগল। দেশকে অত্যাচার ও অরাজকতার হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য সন্ন্যাসীরা রুখে দাঁড়াল। সাধারণ গৃহীরাও সন্ন্যাসীর দলে যোগ দিল। সন্ন্যাসীদের সেই কর্মযজ্ঞ অবলম্বন করেই রচিত হয়েছিল আনন্দমঠ ও দেবী চৌধুরাণী।

সীতারামের পটভূমিকা আরও ষাট-সত্তর বছর আগেকার। মুরশিদকুলি খাঁ তখন বাঙলার মসনদে অধিষ্ঠিত। তার আমলে বাঙলার সর্বত্র হিন্দুর ওপর নির্মম ও নিষ্ঠুর অত্যাচার চলেছিল। মুরশিদকুলি শুনলেন বাঙলার সর্বত্র হিন্দু ধুলায় লুষ্ঠিত, কেবল ভৌমিক সীতারামের রাজ্যেই তাদের বড় প্রশ্ৰয়। তখন তিনি ফৌজদার তোরাব খাঁর প্রতি আদেশ পাঠালেন- ‘সীতারামকে বিনাশ কর’। সেই পরিস্থিতিতেই সীতারাম রচিত।

বঙ্কিমের তিনখানি উপন্যাসই ঐতিহাসিক মহাকাব্য। কিন্তু উপন্যাসগুলি ঘটনাপ্রবাহের নিছক অনুবৃত্তি নয়। জনশ্রুতির এলোমেলো নৃত্যকে বঙ্কিম তার অসামান্য সংহতি প্ৰতিভার সাহায্যে ছন্দোবদ্ধ করে এক মূৰ্তিমতী কল্পলোকের সৃষ্টি করেছিলেন। সেকল্পলোকের মানুষরা হিন্দুরাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নটা সম্পূর্ণ বঙ্কিমের নিজস্ব। অনুশীলনতত্ত্বের উন্মাদন তখন বঙ্কিমকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সেই কুহেলিকাময় আচ্ছন্নতার মুকুৱেই বঙ্কিম হিন্দুরাজ্য স্থাপনের স্বপ্নবিলাসে মত্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস বাঙলায় এরূপ হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠা প্রয়াসের কথা লেখে না।

পথের দাবী ও চার অধ্যায়ের পটভূমিকা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। উদ্দেশ্যও পৃথক। প্রথম মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে দেশের মধ্যে যে সন্ত্রাসবাদ প্ৰকাশ পেয়েছিল, তারই পটভূমিকায় পথের দাবী ব্ৰহ্মদেশের কলকারখানার মজুরদের সঙ্ঘবদ্ধ করবার প্রয়াসের ইতিহাস।

চার অধ্যায় রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ত্ৰিশের দশকে। দেশের তরুণ-তরুণীরা যখন স্বাদেশিকতার মাদকতায় মত্ত হয়ে দেশকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করবার জন্য আন্দোলনে লিপ্ত হয়েছিল, এখানি তারই এক বান্ময় ব্যঞ্জনা।

বঙ্কিম ও রবীন্দ্ৰনাথ, এই উভয়েরই মননশীলতায় অন্তঃসলিলার মতো প্ৰবাহিত হয়েছিল গীতার শিক্ষা ও আদর্শ। শান্তি সত্যানন্দকে বলছে‘অৰ্জ্জুন যখন যাদবী সেনার সহিত অন্তরীক্ষ হইতে যুদ্ধ করিয়াছিলেন, কে তাঁহার রথ চালিয়েছিল? দ্ৰৌপদী সঙ্গে না থাকিলে, পাণ্ডব কি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুঝিত?’ আবার চার অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ইন্দ্রনাথের মুখ দিয়ে এলাকে বলিয়েছেন—‘শ্ৰীকৃষ্ণ অৰ্জ্জুনকে এই কথাটাই বুঝিয়েছিলেন। নির্দয় হবে না, কিন্তু কৰ্তব্যের বেলা নির্মম হবে।‘

বিপ্লবের অভিধানিক অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন। সেদিক থেকে পাঁচখানা উপন্যাসের ফলশ্রুতি একই। বর্ণিত বিপ্লবসমূহের ফল ছিল নেতিবাচক। বঙ্কিমের তিনখানা উপন্যাসেই বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুরাজ্য স্থাপন করা। ইতিহাস বলে যে এরূপ কিছু ঘটেনি। তিন উপন্যাসের উপসংহােরও তাই বলে। শান্তি ও প্ৰফুল্ল ফিরে এসেছিল ব্ৰহ্মচারিণীরূপে নিজ নিজ গৃহে। শ্ৰী-ও ফিরে আসতে চেয়েছিল সীতারামের সঙ্গিনীরূপে, কিন্তু বিপরীত স্রোতে পড়ে সে সন্ন্যাসিনীই থেকে গিয়েছিল। এদিক থেকে এই তিন নায়িকার মধ্যে একটা মিল আছে। শরৎচন্দ্রের পথের দাবীর উদ্দেশ্য ছিল ব্ৰহ্মদেশের কলকারখানার মজুরদের সঙ্ঘবদ্ধ করে তাদের ন্যায্য অধিকার অর্জনের জন্য বিপ্লব ঘটানো। যে কাহিনী শরৎচন্দ্ৰ বিবৃত করেছেন, সে কাহিনী অনুযায়ী এ-বিষয়ে বিপ্লবীদের উদ্দেশ্য বিফল হয়েছিল। সুমিত্ৰা ফিরে গিয়েছিল ঐশ্বৰ্য ভোগ করবার জন্য।

এ চারখানা উপন্যাসের মধ্যে অনেক অসঙ্গতি ও অবাস্তবতাও আছে। কিন্তু তা বিবৰ্ণ করেনি মূল কাহিনীকে। সত্য ও কল্পনা আলোছায়ার মতো পরস্পরকে জড়িয়ে থেকে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছে বিশাল মহাকাব্যিক ঘটনাধারার চমকপ্রদ চালচিত্র। অবাস্তবতার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়।‘ অনেকটা মুক্ত। কল্পনার চেয়ে সত্যকেই সেখানে দেওয়া হয়েছে শ্রেষ্ঠ আসন। তরুণ-তরুণীরা কোন উদ্দেশ্যসাধনের জন্য যখন দলবদ্ধ হয় ও পরস্পরের সান্নিধ্যে আসে, তখন যা ঘটে, রবীন্দ্রনাথ সেই বাস্তব ও জৈবসত্যের বাসরঘরে শেষচুম্বন দিয়েই তাঁর কাহিনীর সমাপ্তি ঘটিয়েছেন।

 

***

 

শাস্তিকে আমরা পাই ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পদচিহ্নে উদ্ভূত সন্ন্যাসীবিদ্রোহের মধ্যে। শান্তি চরিত্র বঙ্কিমের এক অনুপম সৃজন। শান্তির পিতা অধ্যাপক ব্ৰাহ্মণ। অতি শৈশবেই শান্তির মাতৃবিয়োগ হয়েছিল। সেজন্য গৃহে আর কোন লোক ছিল না। বঙ্কিম লিখেছেন-’যে সকল উপাদানে শান্তির চরিত্র গঠিত, ইহা তাহার মধ্যে প্রধান’। পিত যখন টোলে ছাত্রদের পড়াতেন, শান্তি তখন তাঁর কাছে বসে থাকত। টোলের ছাত্ররা শান্তিকে আদর করত। শান্তি তাদের সঙ্গেই খেলা করত, তাদের কোলে-পিঠে চড়ত। এভাবে নিয়ত পুরুষ-সাহচর্যের ফলে, শান্তি মেয়ের মতো কাপড় পরতে শিখল না। ছেলের মতো কেঁচা করে কাপড় পরত। টোলের ছাত্ররা খোপা বঁধে না, সুতরাং শান্তিও খোঁপা বাঁধত না। বড় হলে টোলের ছাত্ররা যা পড়ত, শান্তিও শুনে শুনে তা শিখত। এভাবে শান্তি ভট্ট, রঘু, কুমার, নৈষধাদির শ্লোক ব্যাখ্যা সমেত মুখস্থ করতে লাগল। এইসব দেখেশুনে শান্তির পিতা শান্তিকে মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ ও দু-একখানা সাহিত্যও পড়ালেন। তারপর শান্তির পিতৃবিয়োগ হল। টোল উঠে গেল। শান্তি নিরাশ্রয় হল। একজন ছাত্র তাকে সঙ্গে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। সে-ই পরে সন্তান সম্প্রদায়ে প্রবেশ করে জীবানন্দ নাম গ্ৰহণ করেছিল। জীবানন্দের পিতামাত শাস্তির সঙ্গে জীবানন্দের বিবাহ দিল। কিন্তু বিবাহের পর সকলেই অনুতাপ করতে লাগিল। কেননা, শান্তি মেয়েদের মতো কাপড় পারল না, চুল বঁধিল না, পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলা করতে লাগল। নিকটস্থ জঙ্গলে গিয়ে কোথায় ময়ুর, কোথায় হরিণ, কোথায় দুর্লভ ফুল এইসব খুঁজে বেড়াতে লাগল। শ্বশুর-শাশুড়ী প্ৰথমে নিষেধ, পরে ভর্ৎসনা, শেষে প্ৰহার ক’রে, শিকল দিয়ে শান্তিকে বেঁধে রাখল। একদিন খোলা পেয়ে, কাউকে কিছু না বলে শান্তি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল।

শান্তি বালক সন্ন্যাসীবেশে এক সন্ন্যাসীর দলে গিয়ে ভিড়ল। বঙ্কিম বলেছেন : ‘তখনকার দিনের সন্ন্যাসীরা দলবদ্ধ, সুশিক্ষিত, বলিষ্ঠ, যুদ্ধবিশারদ এবং অন্যান্য গুণে গুণবান ছিল। তাহারা সচরাচর একপ্রকার রাজবিদ্রোহী-রাজার সর্বস্ব লুঠিয়া খাইত। ’ বলিষ্ঠ বালক পেলেই তারা তাকে নিজেদের দলভুক্ত করে নিত। শান্তির বুদ্ধির চাতুৰ্য, চতুরতা এবং কর্মদক্ষতা দেখে, তারা তাকে নিজেদের দলভুক্ত করে নিল। তাদের দলে থেকে শান্তি ব্যায়াম করত এবং পরিশ্রমসহিষ্ণু হয়ে উঠল। ক্রমশ শান্তির যৌবনলক্ষণ দেখা দিল। সন্ন্যাসীরা সচরাচর জিতেন্দ্ৰিয়। কিন্তু সবাই নয়। একজন সন্ন্যাসী শান্তিকে প্রলুব্ধ করবার চেষ্টা করলে শাস্তি সন্ন্যাসীর দল ছেড়ে পালিয়ে নিজের গৃহে ফিরে এল। শাশুড়ী তাকে স্থান দিল না। জীবানন্দের বোন নিমাইয়ের বিবাহ হয়েছিল। ভৈরবপুরে। ভগ্নীপতির সঙ্গে জীবানন্দের খুবই সদ্ভাব; জীবানন্দ শান্তিকে ভৈরবপুরে নিয়ে গেল এবং সেখানেই সুখে বসবাস করতে আরম্ভ করল। তারপর জীবানন্দ একদিন সন্তানধর্ম গ্ৰহণ করে শান্তিকে ছেড়ে চলে গেল। শান্তি একাই রুক্ষকেশে ছিন্নবসনে নিজের পর্ণকুটিরে বাস করতে লাগল।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অনুবর্তনে বাঙলায় বড় গুরুতর ব্যাপার ঘটেছিল। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ তার অন্যতম প্ৰকাশ। বঙ্কিমের আনন্দমঠে সন্ন্যাসী-বিদ্রোহের যে চিত্ৰপট দেওয়া হয়েছে, সেই চিত্ৰপট অনুযায়ী বিদ্রোহী সন্ন্যাসীদের নেতা ছিলেন সত্যানন্দ। তাঁর তিন উপযুক্ত সহকর্মী ছিলেন। তঁরা হচ্ছেন জীবানন্দ, ভবানন্দ ও জ্ঞানানন্দ। গভীর অরণ্যের মধ্যে তাঁরা নিজেদের আস্তানা করেছিলেন। আশ্রমবাসী ও গৃহী সন্ন্যাসীর সংখ্যা ছিল হাজার হাজার। আশ্রমবাসী সন্ন্যাসীদের। ব্ৰত ছিল যতদিন না, যবনের হাত থেকে দেশমাতার উদ্ধায় হয়, ততদিন। তারা ব্ৰহ্মচৰ্য পালন করবে ও গৃহধর্ম ত্যাগ করবে। আত্মীয়স্বজন সকলের সংস্রব ত্যাগ করবে ও ইন্দ্ৰিয় জয় করবে। বঙ্কিম সত্যানন্দের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন—’আমরা রাজ্য চাহি না-কেবল মুসলমানরা ভগবানের বিদ্বেষী বলিয়া তাহাদের সবংশে নিপাত করিতে চাই।‘

রাজসরকার থেকে কলকাতায় যে খাজনা চালান যাচ্ছিল, সন্ন্যাসীরা তা লুঠে নিল। নিকটে সত্যানন্দকে পেয়ে সিপাহীরা তাকে বন্দী করল। সত্যানন্দকে উদ্ধার করতে বেরিয়েছেন জীবানন্দ। সত্যানন্দের সমীপবর্তী হলে জীবানন্দ শুনলেন, সত্যানন্দ গাইছেন— ‘ধীর সমীরে তটিনীতীরে বসতি বনে বরনারী’। এটা সত্যানন্দের সঙ্কেত বুঝতে পেরে জীবানন্দ নদীর ধারে গেলেন। সেখানে দেখলেন এক স্ত্রীলোকের মৃতদেহ আর এক জীবিত শিশুকন্যা। জীবানন্দ শিশুকন্যাটিকে তুলে নিয়ে ভৈরবপুরে তাঁর ভগিনী নিমাইয়ের নিকট রাখতে এলেন। নিমাই কৌশলে জীবানন্দের সঙ্গে শান্তির সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দিল। শান্তিকে দেখে জীবানন্দের বড় দুঃখ হল। জীবানন্দ বললেন, ‘দেশ নিয়ে আমি কি করব? তোমা হেন স্ত্রীকে আমি কেন ত্যাগ করলাম।‘ জীবানন্দ সন্তানধর্ম ত্যাগ করতে মনস্থ। শান্তি বলল-’ছি—তুমি বীর! আমার পৃথিবীতে বড সুখ যে, আমি বীরপত্নী। তুমি অধম স্ত্রীর জন্য বীরধর্ম ত্যাগ করবে? তোমার বীরধর্ম কখনও তুমি ত্যাগ কোরো না।‘

নিজ কুটিরে প্রত্যাগমন করেই শান্তি সিদ্ধান্ত করে ফেলল যে স্বামী যে-ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন, সহধর্মিণী হিসাবে তার পক্ষেও সেই– ধর্মই অনুসরণ করা কর্তব্য। একখানা শাড়ির পাড় ছিড়ে কাপড়খানাকে গেরিমাটি দিয়ে গেরুয়া বসনে পরিণত করল। নিজের মাথার চুল কেটে নকল গোফ-দাড়ি তৈরি করল। তারপর সেই গৈরিক বসনখানি অর্ধেক ছিড়িয়া ধড়া করিয়া চারু অঙ্গে শান্তি পরিধান করিল। অবশিষ্ট অর্ধেকে হৃদয় আচ্ছাদিত করিল।‘ এভাবে সজ্জিত হয়ে সেই নূতন সন্ন্যাসী রাত্রি দ্বিপ্রহরের অন্ধকারে একাকিনী গভীর বনমধ্যে প্ৰবেশ করল। চলতে চলতে গাইতে লাগল-’সমরে চলিনু আমি হামে না ফিরাও রে/হরি হরি হরি বলি রণরঙ্গে/ঝাঁপ দিব প্ৰাণ আজি সমর তরঙ্গে/তুমি কার, কে তোমার, কেন এসে সঙ্গে/রমণীতে না সাধ, রণজয় গাওরে।।‘

পরদিন প্ৰভাতে আনন্দমঠের সন্তান সম্প্রদায় দেখল যে মঠে এক নূতন সন্ন্যাসী এসেছে সন্তানধর্মে দীক্ষিত হবার জন্য। মঠাধ্যক্ষ সত্যানন্দ তাকে দীক্ষিত করলেন ও তার নাম দিলেন নবীনানন্দ। কিন্তু সত্যানন্দকে সে প্রতারিত করতে পারল না। নূতন নাম দেবার পর সত্যানন্দ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন–’একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, তোমার পূর্বে কি নাম ছিল? শান্তি বলল—’আমার নাম শান্তিরাম দেবশৰ্মা।‘ উত্তরে সত্যানন্দ বললেন—’তোমার নাম শান্তিমণি পাপিষ্ঠ।‘ এই বলে সত্যানন্দ শান্তির জাল দাড়ি টেনে খসিয়ে দিলেন। তারপর স্ত্রীলোকের বাহুবলের প্রশ্ন উঠল। সত্যানন্দ বললেন- ‘সন্তানরা বাহুবলের পরিচয় দেয় এই ইস্পাতের ধনুকে এই লোহার তারের গুণ দিয়ে। যে গুণ দিতে পারে, সে-ই প্ৰকৃত বলবান। এই ধনুকে মাত্র চারজন গুণ দিতে সমর্থ-আমি, আর জীবানন্দ, ভবানন্দ ও জ্ঞানানন্দ ‘’ শান্তি অবহেলে ধনুকে গুণ দিলে, সত্যানন্দ বিস্মিত, ভীত ও স্তম্ভিত হলেন। সত্যানন্দ জানলেন শান্তি জীবানন্দের গৃহিণী। তিনি বললেন—’তুমি কেন পাপাচার করতে এসেছ? সামান্ত মনুষ্যদিগের মন স্ত্রীলোকে আসক্ত এবং কাৰ্যে বিরত করে। এই জন্য সন্তানের ব্ৰতই এই যে, রমণী জাতির সঙ্গে একাসনে উপবেশন করিবে না। জীবানন্দ আমার দক্ষিণ হস্ত। তুমি আমার ডান হাত ভাঙ্গিয়া দিতে আসিয়াছ।‘ শান্তি বলল-’আমি আপনার দক্ষিণ হস্তে বল বাড়াইতে আসিয়াছি। আমি ব্ৰহ্মচারিণী, প্রভুর কাছে ব্ৰহ্মচারিণীই থাকিব। আমি সহধর্মিনী হিসাবে কেবল ধর্মাচরণের জন্য আসিয়াছি। ’ তারপর শান্তি আশ্রমের নিকট বনমধ্যে এক পর্ণকুটিরে জীবানন্দের সঙ্গে অবস্থান করতে লাগল। কিন্তু কোনদিন স্বামীর সঙ্গে একাসনে বসিল না।

শীঘ্রই বিদ্রোহ দমন করবার জন্য ক্যাপ্টেন টমাসের অধীনে ইংরেজের ফৌজ এসে হাজির হল। বনমধ্যে টমাসের সঙ্গে শাস্তির দেখা হল। টমাস জিজ্ঞাসা করল-’তুমি কে?’ শান্তি উত্তর দিল।‘আমি সন্ন্যাসী’। টমাস বলল-’তুমি rebel। আমি তোমায় গুলি করিয়া মারিব।‘ বিদ্যুদ্‌বেগে শান্তি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিল। শান্তি বলল–’সাহেব আমি স্ত্রীলোক, কাহাকেও আঘাত করি না। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, হিন্দু-মুসলমানে মারামারি হইতেছে, তোমরা মাঝখানে কেন?’ তারপর ইংরেজের সঙ্গে সন্ন্যাসীদের যুদ্ধ হল। শান্তিও যুদ্ধে গেল, কিন্তু অলক্ষ্যে রইল। যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্য পরাহত হল। সন্তানরা উচ্চনিনাদে গাইল-’বন্দে মাতরম’।

 

***

 

রাষ্ট্রীয় বিপ্লবে শান্তি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সম্পূর্ণ প্ৰস্তুতি নিয়ে। সে টোলে পড়েছিল, শাস্ত্ৰ অনুশীলন করেছিল, শারীরিক ব্যায়ামে দক্ষতালাভ করেছিল। প্ৰফুল্লর ক্ষেত্রে এসব কিছুই ছিল না। সে সম্পূর্ণ নিরক্ষরা ছিল। বিধবার সে একমাত্ৰ অনিন্দ্যসুন্দরী রূপসী মেয়ে ছিল। তার রূপের জন্যই ভূতপুরের জমিদার হরিবল্লভ, তাঁর পুত্ৰ ব্ৰজেশ্বরের সঙ্গে তার বিবাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার অদৃষ্ট সুখ ছিল না। বড়ঘরে বিবাহ হচ্ছে বলে তার মা যথাযথ মৰ্যাদা রাখবার জন্য নিজের যাবতীয় সম্পত্তি বিক্রয় করে বিবাহের রাত্রে বরযাত্রীদের যথোচিত সমাদরের সঙ্গে উপযুক্ত আহারের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু কন্যাপক্ষীয়দের জন্য ব্যবস্থিত আহারের নিকৃষ্টতা দেখে, কন্যাপক্ষীরা তাঁৱ। বাড়িতে সমাগত হয়েও আহার গ্ৰহণ করল না। প্ৰফুল্পর মাকে শাস্তি দেবার জন্য তারা পাকস্পর্শের দিন হরিবল্লাভের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে, সেখানে রটনা করল ষে প্ৰফুল্পর মা কুলটা।

কিছুকাল পরে প্রফুল্লর মা প্রফুল্পকে নিয়ে হরবল্লভের বাড়ি যায়। হরিবল্লাভের গৃহিণী প্ৰথমে তাদের দেখে বিমুখ হলেও, পরে প্রসন্না হয়ে পুত্রবধূকে গ্ৰহণ করবার জন্য হরিবল্লাভের কাছে অনুনয়-বিনয় করে। হরবল্লভের পুত্র ব্রজেশ্বরও এ-সম্বন্ধে প্রয়াস করে। কিন্তু তাদের। সব চেষ্টাই বিফল হয়। হরিবল্লভ তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। সে কি-ভাবে খাবে, প্রশ্ন করলে, হরিবল্লভ প্ৰফুল্লকে বলে—’চুরিডাকাতি করে খাবে’। প্ৰফুল্ল মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসে। মা অসুস্থ হয়ে পড়ে, এবং কিছুদিন পরে মারা যায়। তার অসহায় অবস্থা দেখে, স্থানীয় জমিদারের নায়েব পরাণ চক্রবর্তী তাকে অপহরণ করে। কিন্তু পথিমধ্যে অন্য লোক দেখে, তাদের ডাকাত ভেবে, ডাকাতের ভয়ে পরাণ ও তার পালকিবাহকরা পালিয়ে যায়। সেই অবসরে প্ৰফুল্ল পালকি থেকে বেরিয়ে নিকটস্থ জঙ্গলে প্ৰবেশ করে এবং এক পায়ে-হাটা শীর্ণ পথের রেখা ধরে এক ভগ্ন অট্টালিকায় এসে পৌছায়। সেখানে এক বৃদ্ধিকে মৃত্যুশয্যায় শায়িত দ্যাখে। মৃত্যুর পূর্বে বৃদ্ধের সেবাশুশ্ৰষা করে। শ্ৰীত হয়ে বুদ্ধ তার সঞ্চিত ধনের গুপ্তকক্ষের সন্ধান প্ৰফুল্পকে দেয়। বুদ্ধের মৃত্যুর পর প্রফুল্ল তার শেষকৃত্যাদি সম্পন্ন করে ও মাটির তলার সেই গুপ্তকক্ষ থেকে কুড়ি ঘড়া মোহর ও ধনরত্নাদি পায়।

ধনরত্নাদি পেয়ে প্রফুল্প ভাবল—‘এখন কি করি? কোথায় যাই? এ নিবিড় জঙ্গল ত থাকিবার স্থান নয়, এখানে একা থাকিব কি প্রকারে? যাই বা কোথায়? বাড়ী ফিরিয়া যাইব? আবার ডাকাইত ধরিয়া লইয়া যাইবে। আর যেখানে যাই, এ ধনগুলি লইয়া যাইব কি প্রকারে? লোক দিয়া বহিয়া লইয়া গেলে জানাজানি হইবে, চোরডাকাত কাড়িয়া লইবে। লোকই বা পাইব কোথায়? যাহাকে পাইব, তাহাকেই বা বিশ্বাস কি? আমাকে মারিয়া ফেলিয়া টাকাণ্ডাল কাড়িয়া লইতে কতক্ষণ? এ ধনরাশির লোভ, কে সম্বরণ করিবে?’ এরূপ নানারূপ চিন্তা করে, শেষ পর্যন্ত প্রফুল্ল জঙ্গলে থাকাই সিদ্ধান্ত করল এবং গৃহকর্মে প্ৰবৃত্ত হল। কিন্তু হাড়ি, কাঠ, চাল-ডাল সকলেরই অভাব। প্ৰফুল্ল একটা মোহর নিয়ে হাটের সন্ধানে বেরুল। পথিমধ্যে এক ব্ৰাহ্মণের সঙ্গে দেখা হল। প্ৰফুল্ল ব্ৰাহ্মণকে হাটের পথ জিজ্ঞাসা করল। ব্ৰাহ্মণ বলল-‘হাট এক বেলার পথ, তুমি একা যেতে পারবে না।‘ ব্ৰাহ্মণ বলল-’এই জঙ্গলে আমার একটা দোকান আছে। তুমি সেখান থেকে চাল-ডাল, হঁড়ি ইত্যাদি কিনতে পার। দোকান থেকে চাল-ডাল, হাড়ি ইত্যাদি কিনে প্ৰফুল্ল তাকে একটা মোহর দিল। ব্ৰাহ্মণ বলল-’মোহর ভাঙ্গিয়ে দিই, এত টাকা আমার কাছে নাই। তুমি পরে দাম দিও, চল তোমার ঘর চিনে আসি।‘ প্রফুল্ল বলল— ‘আমার ঘরেও পয়সা নেই, সবই মোহর।‘ ব্ৰাহ্মণ বলল-’সবই মোহর? তা হোক চল তোমার ঘর চিনে আসি।‘ প্ৰফুল্লর সন্দেহ হল। ব্ৰাহ্মণ বুঝল। বলল–’মা, আমি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করবো না, আমার নাম ভবানী পাঠক, আমি ডাকাইতের সর্দার।‘ ভবানী পাঠকের নাম প্ৰফুল্প নিজগ্রাম দুর্গাপুরেও শুনেছিল। ভবানী পাঠক বিখ্যাত দলু্য। প্ৰফুল্লর বাক্যক্ষুতি হল না। ইতিমধ্যে ব্ৰাহ্মণ ঘরের ভিতর হতে একটা দামামা বের করে তাতে গোটাকতক ঘা দিল। মূহুর্তমধ্যে পঞ্চাশ-যাটজন কালান্তক যমের মতো জওয়ান লাঠি-সড়কি নিয়ে উপস্থিত হল। ভবানী তাদের বলল—’তোমরা এই বালিকাকে চিনে রােখ। আমি ঐকে মা বলেছি। ঐকে তোমরা সকলে মা বলবে, মার মত দেখবে, ঐর কোন অনিষ্ট করবে না, আর কাকেও করতে দেবে না। এখন তোমরা বিদায় হও।

এরপর চলল প্ৰফুল্পর জীবনের ক্রান্তিপর্ব। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার ভিতর দিয়ে প্ৰফুল্পর পরবর্তী পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হল। প্ৰফুল্লর সঙ্গে থাকবার জন্য দুজন শ্ৰীলোক দেওয়া হল। একজন গোবরার মা, সে মাত্র হাটবাজার করে। আর একজন নিশি, সে প্ৰফুল্পর সখীরূপে রইল। প্রফুল্ল নিরক্ষর ছিল। নিশি তাকে বর্ণশিক্ষা, হস্তলিপি, কিঞ্চিৎ শুভঙ্করী আঁক শিক্ষা দিল। পরে ভবানী ঠাকুর তাকে ভট্টি, রঘু, কুমার, নৈষধ, শকুন্তলা প্ৰভৃতি পড়ালেন। তারপর সাংখ্য, বেদান্ত, ন্যায়, যোগশাস্ত্র ও শ্ৰীমদ্ভগবদগীতা। অশনে-বসনেও প্রফুল্পকে নিয়মামুবর্তিতার ভিতর দিয়ে চলতে হল। প্ৰথম বৎসর তার আহার মোটা চাউল, সৈন্ধব, ঘি ও কঁচকলা। দ্বিতীয় বৎসরেও তাই। তৃতীয় বৎসরে নুন, লঙ্কা ও ভাত। চতুর্থ বৎসরে প্রফুল্লর প্রতি উপাদেয় ভোজ্য খাইতে আদেশ হইল, কিন্তু প্ৰফুল্ল প্ৰথম বৎসরের মতো খাইল। পরিধানে প্ৰথম বৎসর চারিখানা কাপড়, দ্বিতীয় বৎসরে দুইখানা, তৃতীয় বৎসরে গ্ৰীষ্মকালে মোটা গড়া, অঙ্গে শুকাইতে হয়, শীতকালে একখানি ঢাকাই মলমল অঙ্গে শুকাইয়া লইতে হয়। চতুর্থ বৎসরে পাট কাপড়, ঢাকাই কলকাদার শান্তিপুৱী। প্ৰফুল্ল সে-সকল ছিড়িয়া খাটাে করিয়া পরিত। পঞ্চম বৎসর বেশ ইচ্ছামতো। প্ৰফুল্ল মোটা গড়াই বাহাল রাখিল ৷ মধ্যে মধ্যে ক্ষারে কাচিয়া লইত! কেশবিন্যাস ও শয়ন সম্বন্ধেও এইরূপ কঠোর বিধানের ভিতর দিয়া প্ৰফুল্ল তার ধর্ম, কর্ম, সুখ, দুঃখ সবই শ্ৰীকৃষ্ণকে সমর্পণ করল। ভবানী ঠাকুর বললেন’এদেশে রাজা নাই। মুসলমান লোপ পাইয়াছে। ইংরেজ সম্প্রতি ঢুকিতেছে—তাহার রাজ্যশাসন করিতে জানে না, করেও না। আমি দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন করি। এ জঙ্গলে ডাকাইতি করে ধর্মাচারে প্ৰবৃত্ত থাকি।‘

প্ৰফুল্ল ভবানী ঠাকুরের অনুগত শিষ্য হয়ে ধর্মাচরণে প্ৰবৃত্ত হল। নূতন নাম হল দেবী চৌধুরাণী। নিপীড়িত, অত্যাচারিত, দুঃখী লোকদের কাছে রানীমা নামে পরিচিত হল। দু’হাতে তাদের ধন বিলাতে লাগল।

ইজারাদার দেবীসিংহের অত্যাচারে দেশ প্ৰপীড়িত। একবার হরবল্লভের তালুক হতে টাকা চালান আসছিল। ডাকাতের তা লুঠে নিল। সেবার দেবীসিংহের খাজনা দেওয়া হল না। হরিবল্লাভের দশ ‘ হাজার টাকা মূল্যের একখানা তালুক দেবীসিংহ আড়াইশত টাকায় নিজে কিনে নিল। তাতে বাকী খাজনার কিছুই পরিশোধ হল না, দেনার জের চলল। দেবীসিংহের পীড়াপীড়িতে কয়েদের আশঙ্কায় হরিবল্লভ আর একটা সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে ঋণ পরিশোধ করল। আবার দেবীসিংহের পঞ্চাশ হাজার টাকা বাকী পড়ল। হরিবল্লভ রায়কে গ্রেপ্তার করবার পরওয়ানা বের হল। পুত্ৰ ব্ৰজেশ্বরের মধ্যম স্ত্রী সাগরের পিতা ধনীলোক! বাপকে গ্রেপ্তারের হাত থেকে বঁাচাবার জন্য ব্ৰজেশ্বর শ্বশুরের কাছে গেল। টাকার ব্যাপার নিয়ে কথা কাটাকাটি হল। শ্বশুর রুক্ষভাবে বললেন—’তোমার বাপ বাঁচলে আমার মেয়ের কি? আমার মেয়ের টাকা থাকলে দুঃখ ঘুচবে-শ্বশুর থাকলে দুঃখ ঘুচিবে না।‘ ব্ৰজেশ্বর রাগ করে চলে যাচ্ছে দেখে শাশুড়ী জামাইকে ডাকলেন। তিনি জামাইকে অনেক বুঝালেন, কিন্তু জামাইয়ের রাগ পড়ল না। তারপর সাগরের পালা, সাগব ব্ৰিজেশ্বরের পায়ে পড়তে গেল। ব্ৰজেশ্বর তখন রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। পা টানতে গিয়ে সাগরের গায়ে লাগল। সাগর বলল—’তুমি আমায় লাথি মারবে নাকি?’ কুপিত ব্ৰজেশ্বর বলল—’যদি মারিয়াই থাকি? তুমি না হয় বড়মানুষের মেয়ে, কিন্তু পা আমার-তোমার বড়মানুষ বাপও এ পা একদিন পূজা করিয়াছিলেন।‘ সাগর রাগে জ্ঞান হারাল। বলল—’ঝকমারি করেছিলেন। আমি তার প্রায়শিচত্ত করব। ’ ব্ৰজেশ্বর বলল-’পালটে লাথি মারবে নাকি?’ সাগর বলল-’আমি তাত অধম নই। কিন্তু আমি যদি বামুনের মেয়ে হই, তবে তুমি আমার পা—’। এমন সময় পিছনের জানালা হতে কে বলল-’আমার পা কোলে নিয়ে চাকরের :মত টিপে দিবে। ’ ব্ৰজেশ্বর চলে গেল। পিছনের জানালা হতে যে কথা বলেছিল, সে এখন ঘরে প্রবেশ করল। সাগর জিজ্ঞাসা করল-’তুমি কে? স্ত্রীলোক, উত্তর দিল—’আমি দেবী চৌধুরাণী’। নাম শুনে সাগর প্রথম ভয় পেল। কিন্তু পরমুহুর্তে প্ৰফুল্পকে চিনতে পারল। প্ৰফুল্ল সাগরকে নিজ বজরায় নিয়ে গেল।

দেবী চৌধুরাণী নিজ বজরায় ফিরে এসে অমুচর রঙ্গরাজকে আদেশ দিল ব্ৰজেশ্বরকে বজরায় ধরে নিয়ে আসতে। আদেশমতে ব্ৰজেশ্বরকে বজরায় ধরে নিয়ে আসা হল। পর্দার আড়াল থেকে দেবীর সঙ্গে তার কথা হল। ব্ৰজেশ্বর মুক্তিপণ জানতে চাইল। উত্তর-’এক কড়া কানাকড়ি’ ৷ ব্ৰজেশ্বর কানাকড়ি দিতে পারল না। তখন কামরার ভিতরে আর-এক স্ত্রীলোক বলল-’রানীজি, যদি এক কড়া কানাকড়িই এই মানুষটার দর হয়, তবে আমি এক কড়া কানাকড়ি দিচ্ছি। আমার কাছে ওকে বিক্রয় করুন।‘ ব্ৰজেশ্বর ভিতরে প্রবেশ করে দেখল, যে স্ত্রীলোক তাকে কিনল সে মসনদের ওপর শুয়ে আছে। –তার মুখের ওপর একখানা বড় মিহি জরির বুটাদার ঢাকাই রুমাল ফেলা। তার আদেশমতে ব্ৰজেশ্বর তার পা টিপতে লাগল। তারপর রুমালখানা সরাবার পর ব্ৰজেশ্বর দেখল সে-স্ত্রীলোক আর কেউই নয়, সাগর। সাগরের প্রতিজ্ঞারক্ষা হল। ব্ৰজেশ্বর বিস্মিত হল। সাগর বলল-’দেবী চৌধুরাণী তার সম্পর্কিত বোন। তারপর ব্রজেশ্বরকে দেবী চৌধুরাণীর কাছে নিয়ে যাওয়া হল। ব্ৰজেশ্বর আবার বিস্মিত হল। প্ৰফুল্লর সঙ্গে তার সাদৃশ্য লক্ষ্য করল। দেবী ব্ৰজেশ্বরকে এক কলসী মোহর দিল, যার মূল্য পঞ্চাশ হাজার টাকার ওপর; দেবী বলল-’টাকা আমার নয়, টাকা দেবতার, দেবত্র সম্পত্তি থেকে এ টাকা আপনাকে কার্জ দিচ্ছি।‘ দেবী বলল-’আগামী বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমীর রাত্রে এই ঘাটে টাকা আনবেন।‘ দেবী উপহারস্বরূপ ব্ৰজেশ্বরকে একটা আংটি দিল। ফেরবার পথে ব্ৰজেশ্বর আংটি পরীক্ষা করে দেখল ‘এ ংটি, তারই আংটি, প্ৰফুল্পকে সে-ই এই আংটি দিয়েছিল। আংটিটা তার অভিজ্ঞান বা ‘আইডেন্টিটি’র সূত্র হয়ে দাঁড়াল। ব্রজেশ্বরের মারফত টাকা পেয়ে হরিবল্লভ খুশী হল। কিন্তু টাকা শোধ করবার উদ্যোগ করল না। ভাবল—’বৈশাখী শুক্ল সপ্তমীতে যদি দেবীকে ধরিয়ে দিতে পারি, তা হলে টাকাও শোধ করতে হবে না, বরং ইংরেজদের কাছ থেকে কিছু পুরস্কার পাওয়া যাবে।‘ সেরূপই উদ্যোগ করল। পিতা ঋণ পরিশোধের কোনরূপ উদ্যোগ করছেন না। দেখে, নির্দিষ্ট দিনে ব্ৰজেশ্বর আরও কিছু সময় প্রার্থনার জন্য দেবীর বজরায় এসে হাজির হল। এদিকে হরিবল্লাভের কথামতো ইংরেজরা বৈশাখী শুক্লা সপ্তমীতে দেবীকে ধরবার জন্য পাঁচশত সিপাহী সমেত লেফটানেণ্ট ব্রেনানকে পাঠিয়ে দিল। দেবী প্ৰথমে নিজেকে ধরা দেওয়াই সিদ্ধান্ত করেছিলেন। নিজের দলের সমস্ত লোককে তিনি বিদায় দিলেন।‘একটা মেয়ে মানুষের প্রাণের জন্য এত লোক তোমরা মরিবার বাসনা করিয়াছ—তোমাদের কি কিছু ধৰ্মজ্ঞান নাই? অামার পরমায়ু শেষ হইয়া থাকে, আমি একা মরিব—আমার জন্য এত লোক মরিবে কেন? অামায় কি তোমরা এমন অপদার্থ ভাবিয়াছ যে আমি এত লোকের প্রাণ নষ্ট করিয়া আপনার প্রাণ বঁাচাইব।‘ কিন্তু ঘটনাচক্রে ও ভগবানের ইচ্ছায় কালবৈশাখীর ঝড় উঠে দেবীর সব সিদ্ধান্ত ওলট-পালট করে দিল। ইংরেজ সৈন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। দেবীর মরা হল না। দেবী ব্ৰজেশ্বরের সঙ্গে আবার নিজ শ্বশুরবাড়িতে ‘নতুন বৌ’ হিসাবে ফিরে এল।

উপসংহারে বঙ্কিম বলেছেন–‘রঙ্গরাজ, দিবা ও নিশি দেবীগড়ে শ্ৰীকৃষ্ণচন্দ্রের প্রসাদ ভোজনে জীবন নিৰ্বাহ করিয়া পরলোক গমন করিলেন। ভবানী ঠাকুরের অদৃষ্টে সেরূপ ঘটিল না। ইংরেজ রাজ্যশাসনের ভার গ্ৰহণ করিল। রাজ্য সুশাসিত হইল। সুতরাং ভবানী ঠাকুরের কাজ ফুরাইল। দুষ্টের দমন রাজাই করিতে লাগিল। ভবানী ঠাকুর ডাকাইতি বন্ধ করিলেন। তখন ভবানী ঠাকুর মনে করিলেনআমার প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন। এই ভাবিয়া ভবানী ঠাকুর ইংরেজকে ধরা দিলেন, সকল ডাকাইতি একরার করিলেন, দণ্ডের প্রার্থনা করিলেন। ইংরেজ হুকুম দিল, যাবজীবন দ্বীপান্তর বাস। ভবানী পাঠক প্ৰফুল্লচিত্তে দ্বীপান্তরে গেল। প্ৰফুল্পকে সম্বোধন করে বঙ্কিম বলেছেন : ‘একবার এই সমাজের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বল দেখি, আমি নূতন নহি, আমি পুরাতন। আমি সেই বাক্যমাত্র; কতবার আসিয়াছি, তোমরা আমায় ভুলিয়া গিয়াছ, তাই আবার আসিলাম—‘পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম। ধর্মসংস্থাপনার্থীয় সম্ভবামি যুগে যুগে’।।‘

 

***

 

শ্ৰী ভূষণার জমিদার সীতারাম রায়ের স্ত্রী। বিবাহের দু-চারদিন পরে সে স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছিল, কেননা তার নষ্টকোষ্ঠী উদ্ধারের পর প্রকাশ পেয়েছিল যে-তার কোষ্ঠীতে বলবান চন্দ্র স্বক্ষেত্রে অর্থাৎ কর্কট রাশিতে থেকে শনির ত্ৰিংশাংশগত হয়েছিল, যার ফলে সে প্রিয়প্ৰাণহস্ত্রী হবে। স্বামী-পরিত্যক্ত হয়ে তাকে মাতৃ-আলয়েই ফিরে আসতে হয়েছিল। মাতৃ-অ্যালয়ে বিধবা মা, সে ও ভাই গঙ্গারাম। মার অন্তিমকালে গঙ্গারাম রাত্রিকালে বেরিয়েছেন কবিরাজ ডাকতে। সরু পথের ওপর আড়াআড়িভাবে এক ফকির শুয়ে ছিল। গঙ্গারামের শত অনুরোধ সত্ত্বেও সে যখন তাকে পথ দিল না, গঙ্গারাম তখন তাকে ডিঙিয়ে যেতে গিয়ে তার গায়ে নিজের পা ঠেকিয়ে ফেলে। ফকির কাজীর কাছে গিয়ে নালিশ করে। কাজী গঙ্গারামকে জীবন্ত কবর দেবার আদেশ দেয়। পরদিন মায়ের সৎকার করে গঙ্গারাম যখন বাড়ি ফিরাছিল, ফৌজদারের পেয়াদা এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। শ্ৰী এই বিপদে বহুকাল পরে সীতারামের কাছে যায় ও গঙ্গারামকে রক্ষা করবার প্রার্থনা জানায়। বহুদিন পরে শ্ৰীকে দেখে সীতারামের মন টলে। সীতারাম গঙ্গারামকে বঁাচাবার প্রতিশ্রুতি দেয়। পরদিন ‘গঙ্গারামকে জীবন্ত কবর দেবার জন্য যথাস্থানে নিয়ে আসা হয়। জীবন্ত মানুষের কবর দেখবার জন্য লোকে লোকােরণ্য হয়। এদিকে শ্ৰীকে প্ৰতিশ্রুতি দেবার পর সীতারাম গঙ্গারামকে বঁাচাবার জন্য তার গুরুদেব চন্দ্রচূড় তর্কালঙ্কার ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে। যেখানে কবর দেওয়া হয়, সেখানে এক গাছের উপর উঠে বসলেন চন্দ্রচূড় ও নিচে গাছের দুই শাখার উপর দাড়িয়ে রইল লাল শাড়ি পরা শ্ৰী। কবর দেওয়ার জন্য যেখানে মাটি খোড়া হয়েছিল, সেখানে গঙ্গারামকে কবরের মধ্যে ফেলবার ঠিক পূৰ্বমুহুর্তে এসে উপস্থিত হল। অশ্বারোহণে সীতারাম। অশ্ব থেকে অবরোহণ করে। সীতারাম কাজী ও ফকিরের কাছে ছুটে গেল। প্রার্থনা করল, যেকোন মূল্যে, এমনকি তার নিজের প্রাণের পরিবর্তে গঙ্গারামের প্ৰাণভিক্ষা। কিন্তু প্রার্থনা মঞ্জুর হল না। এমন সময় কামার (যে রাত্রিশেষে চন্দ্রচূড় ঠাকুরের কাছ থেকে কিছু টাকা খেয়েছিল) কাজী সাহেবকে বলল-’আজিকাল ভাল লোহা পাওয়া যাচ্ছে না; রাজ্যে দুস্কৃতকারীদের সংখ্যা বাড়ছে, আমি আর হাতকড়া ও পায়ের বেড়ি যোগাতে পারছি না। যদি হুকুম দেন তো কয়েদীকে কবরে গাড়বার আগে হাতকড়া ও পায়ের বেড়ি খুলে নিই; সরকারী হাতকড়া ও বেড়ির লোকসান হবে কেন? হাতকড়া ও বেড়ি খুলে নেবার হুকুম হল। মুক্ত হয়ে গঙ্গারাম একবার এদিক-ওদিক চাইল। তারপর চকিতের মধ্যে সীতারামের হাত হতে চাবুক কেড়ে নিয়ে, একলাফে সীতারামের ঘোড়ায় চেপে সেই জনারণ্য থেকে বেরিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেল। সিপাহীরা তার পিছনে ছুটতে গেল। কিন্তু কালান্তক যমের মতো কতকগুলি বলিষ্ঠ অস্ত্ৰধারী হিন্দু এসে তাদের পথরোধ করল। হিন্দু ও মুসলমানে ঘোরতর দাঙ্গা লাগল। এমন সময় হিন্দুরা দেখল গাছের উপর লাল শাড়ি পরে দাড়িয়ে চণ্ডীর মতো এক দেবী শাড়ির আঁচল ঘুরিয়ে বলছেন—’মার, মার’। সকলেই বলল ‘চণ্ডী এসেছেন, চণ্ডীর হুকুম মার, মার, মার, জয় চণ্ডিকে’। নিমেষের মধ্যে হিন্দুদের জয় হল, মুসলমানরা পালাল, ফকিরের মুণ্ডচ্ছেদ হল। বিদ্রোহদমনার্থ ফৌজদার কামান গোলাগুলি নিয়ে আসছে শুনে, লোকেরা সব সরে পড়ল। সীতারাম শ্ৰীকে নিয়ে, গঙ্গারাম যেখানে ছিল সেখানে এসে গঙ্গারামকে বলল, ‘তুমি বড় নদী পার হয়ে ভূষণার বাইরে আমার জমিদারী শ্যামপুরে চলে যাও। আমি তোমার ভগিনীকে নিয়ে সেখানে যাচ্ছি। ’ পথিমধ্যে শ্ৰী বলল—’আমি কুলটা নই, জাতিভ্ৰষ্টাও নই, তোমার সহধর্মিণী, তুমি যখন আমাকে ত্যাগ করেছ, তখন আমি তোমার সঙ্গে যাব না।‘ শ্ৰী আগুহিতা হয়ে গেল। শ্ৰী শ্ৰীক্ষেত্রের পথ ধরল। পথে বৈতরণীতীরে তার সমবয়স্ক এক অপরূপ লাবণ্যময়ী সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে দেখা হল। নাম তার জয়ন্তী ৷ জয়ন্তীর প্রভাবে শ্ৰীও সন্ন্যাসিনী হল। এদিকে সীতারাম শ্যামপুরে এসে এক নগর নির্মাণ, করল। সেখানে হিন্দুরাজ্য স্থাপন করল। ভূষণ এবং নিকটস্থ অঞ্চলের হিন্দুরা সেখানে এসে বসবাস ও দোকানপাট স্থাপন করল। মুসলমানদের রোষ এড়াবার জন্য সীতারাম নগরের নাম দিল মহম্মদপুর। গঙ্গারামকে সে কোতোয়াল নিযুক্ত করল, আর মৃন্ময় নামে এক ব্যক্তিকে সৈন্যধ্যক্ষ করল। দিন দিন সীতারামের রাজ্য বাড়তে লাগল। সীতারাম চিন্তা করল দিল্লির বাদশাহের কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধি না পেলে, তার রাজ্যের স্বীকৃতি নেই। সেই কারণে সীতারাম দিল্লি যাত্রা করল। শ্রীকে পরিত্যাগের পর সীতারাম আরও দুই বিবাহ করেছিল,—রানী নন্দ ও রানী রম! সীতারামের দিল্লীযাত্রার অনুপস্থিতিতে গঙ্গারাম কনিষ্ঠ রানী রামার রূপলাবণ্যে আকৃষ্ট হয়ে তাকে পাবার জন্য দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হল। এদিকে সীতারামের অনুপস্থিতিতে মুসলমানরা সীতারামের রাজ্য আক্রমণ করবার পরিকল্পনা করল। রামাকে পাবার জন্য গঙ্গারাম বিশ্বাসঘাতকতা করে মুসলমানদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। স্থির হল গঙ্গারাম এমন ব্যবস্থা করবে যাতে মুসলমানরা বিনা প্রতিরোধে সীতারামের রাজ্য জয় করতে পারে এবং পুরস্কারস্বরূপ পাবে রামাকে। আক্রমণের আগের দিন মহম্মদপুরে আবির্ভূত হল ত্রিশূলধারিণী ভৈরবীবেশে শ্ৰী ও জয়ন্তী! জয়ন্তী গঙ্গারামের কক্ষে গিয়ে উপস্থিত হল। গঙ্গারাম তাকে দেবী ভেবে ভয় পেয়ে গেল! জয়ন্তীর নির্দেশমতো তাকে দিল কিছু কামান, গোলাবারুদ ও একজন দক্ষ গোলন্দাজ। এদিকে মৃন্ময়কে বলল যে মুসলমানরা দক্ষিণের পথে আক্রমণ করতে আসছে। মৃন্ময় সৈন্য নিয়ে, নগর অরক্ষিত রেখে, সেইদিকে রওনা হল। কিন্তু গঙ্গারামের পরামর্শ অনুযায়ী মুসলমানরা সৈন্যসামন্ত নিয়ে উত্তরদিকে ঠিক নগরের বিপরীত তীরের ঘাটে হাজির হয়। নৌকাযোগে মুসলমান সিপাহীরা নদী পার হতে শুরু করে। হঠাৎ নদীর এপার থেকে আওয়াজ হল ‘গুডুমী’। আবার ‘গুডুমা, আবার ‘গুডুম’। নদীবক্ষে সিপাহী-বোঝাই নৌকাসমূহ ধ্বংস হল। মুসলমান সৈন্য পালাল। হিন্দুদের জয়জয়কার। বলা বাহুল্য, গোল বারুদ কামান সবই জয়ন্তী কর্তৃক পুর্বরাত্রে গঙ্গারামের কাছ থেকে সংগৃহীত, আর গোলন্দাজ স্বয়ং সীতারাম। দিল্লী থেকে ফিরে আসামাত্রই নদীর ঘাটে জয়ন্তীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল। সীতারাম নিজ রাজ্যে ফিরে এসে প্ৰথমেই গঙ্গারামকে বন্দী করেন। এদিকে দেশের মধ্যে গঙ্গারাম ও ছোট রানীকে নিয়ে নানারকম রটনা হতে থাকে। নিরপরাধিনী রমা প্ৰাণত্যাগ করতে চাইল। নন্দার অনুরোধে সীতারাম বিচার আহবান করলেন। অনেকেই গঙ্গারামের বিপক্ষে এবং রম যে নিরপরাধিনী সে-বিষয়ে সাক্ষ্য দিল। রামাও প্ৰকাশ্য দরবারে এসে সাক্ষ্য দিল। গঙ্গারাম সকলের সাক্ষী অস্বীকার করল। সভায় জয়ন্তীর আবির্ভাব ঘটল। জয়ন্তী এসে গঙ্গারামের বুকে ত্ৰিশূল রেখে, তাকে সত্য কথা বলতে বলল। গঙ্গারাম জয়ন্তীকে দেবী ভেবে সত্য কথা বলল। গঙ্গারামকে শূলে দেবার আদেশ হল। কিন্তু জয়ন্তী সীতারামের কাছে তার প্রাণভিক্ষা চাইল। জয়ন্তীকে রাজলক্ষ্মী ভেবে সীতারাম বললেন-গ্ৰী নামে আমার প্রথম মহিষী আমার জীবনস্বরূপ। আপনি দেবী, সব দিতে পারেন। আমার জীবন আমায় দিয়া, সেই মূল্যে গঙ্গারামের জীবন ফিরিয়া লউনা।‘ জয়ন্তী বলল-’মহারাজ! আপনি আজ অন্তঃপুর-দ্বার সকল মুক্ত রাখিবেন, আর অন্তঃপুরের প্রহরীদিগকে আজ্ঞা দিবেন, ত্ৰিশূল দেখিলে যেন পথ ছাড়িয়া দেয়। আপনার শয্যাগৃহে আজ রাত্ৰিতেই মূল্য পৌছিবে। গঙ্গারামের মুক্তির হুকুম হউক।‘ গঙ্গারাম মুক্তি পায়, এবং তৎক্ষণাৎ রাজ্য ত্যাগ করে।

তারপর রাত্ৰে সঁতারামের শয্যাগৃহে শ্ৰীর আবির্ভাব হয়। কিন্তু এ তো সে শ্ৰী নয়। যে শ্ৰীকে সীতারাম চেয়েছিল, এ সে নয়। এ সন্ন্যাসিনী শ্ৰী। সীতারাম বললেন- ‘এখন তুমি আমার মহিষী হইয়া রাজপুরী আলো কর।‘ শ্ৰী উত্তর দিল—’মহারাজ! নন্দার প্রশংসা বিস্তর শুনিয়াছি। তোমার সৌভাগ্য যে তুমি তেমন মহিষী পাইয়াছ। অন্য মহিষীর কামনা করিও না। যেদিন তোমার মহিষী হইতে পারলে আমি বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মীও হইতে চাহিতাম না, আমার সেদিন গিয়াছে। আমি সন্ন্যাসিনী; সর্বকৰ্ম ত্যাগ করিয়াছি।‘ রাজা বললেন’তোমাকে দেখিলেই আমি সুখী হইব। ’ শ্ৰী বলল—’তুমি স্বামী, তুমি রাজা, তুমি উপকারী। তোমার আজ্ঞা শিরোধার্য। তবে আমাকে রাজপুরী মধ্যে স্থান না দিয়া আমাকে একটু পৃথক কুটির তৈয়ার করিয়া দিবেন।‘ শ্ৰী কিছুতেই রাজপুরী-মধ্যে থাকতে রাজী হল না। তখন ‘সীতারাম ‘চিত্তবিশ্ৰাম’ নামে এক ক্ষুদ্র অথচ মনােরম প্রমোদভবন শ্ৰীর নিবাসার্থ নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন। শ্ৰী তাহাতে বাঘছাল পাতিয়া বসিল। রাজা প্ৰত্যহ তাহার সাক্ষাৎ জন্য যাইতেন। পৃথক আসনে বসিয়া তাহার সঙ্গে আলাপ করিয়া ফিরিয়া আসিতেন।‘ প্ৰথমে প্ৰহরেক থেকে চলে আসতেন, তারপর ক্রমশ রাত্রি বেশী হতে লাগল। তারপর চিত্তবিশ্রামেই নিজের সায়াহ্ন। আহার এবং রাত্রিতে পৃথক শয়নের ব্যবস্থা করলেন। রাজকাৰ্যে অমনোযোগী হলেন। রাজকর্মচারীরা চুরি করে রাজ্য দেউলিয়া করে দিল। এদিকে রাজা কর্তৃক অবহেলিত হয়ে রমার মৃত্যু ঘটল।

সন্ন্যাসিনী যে রাজার প্রথম স্ত্রী শ্ৰী, তা কেউই জানািল না। রাজ্যময় রটনা হল যে, সে রাজার উপপত্নী। কেউ বলল ডাকিনী, রাজাকে বশ করে রেখেছে।

রাজ্যময় বিশৃঙ্খলা প্ৰকাশ পেল। রাজ্য যায়-যায় অবস্থা। এমন সময় জয়ন্তী এসে শ্ৰীকে অন্যত্র সরিয়ে দিল। রাজা শ্ৰীকে না পেয়ে, জয়ন্তীকে বন্দী করলেন। ক্রুদ্ধ রাজা তাকে বিবসনা করে প্রকাশ্যে বেত্ৰাঘাতের আদেশ দিলেন। নন্দ ও অন্যান্য পুরনারীরা এসে জয়ন্তীকে ঘিরে দাঁড়াল। নন্দা বলল – ‘মহারাজ! আমি পতি-পুত্ৰবতী। আমি জীবিত থাকিতে তোমাকে কখনও এ পাপ করিতে দিব না। তাহ হইলে আমার কেহ থাকিবে না।‘

প্ৰজার রাজাকে ধিক্কার দিয়ে মহম্মদপুর ত্যাগ করতে লাগল। এসব খবর পেয়ে মুসলমানরা সীতারামের রাজ্য আক্রমণ করল। সেনাপতি মৃন্ময় মুসলমান সেনার হাতে নিহত হল! মুসলমানের লক্ষ্য যোদ্ধা। সীতারামের তখন একশতও নাই। সকলেই পলাতক। গত্যন্তর না দেখে সীতারাম সর্বাঙ্গে অস্ত্রদ্বারা শোভিত হয়ে বীরদৰ্পে মৃত্যুকামনায় একাকী দুৰ্গদ্বারাভিমুখে চললো। দুৰ্গদ্বারে গিয়ে দেখলেন, যে বেদীতে জয়ন্তীকে বোত্রাঘাতের জন্য আরূঢ় করেছিলেন, সেই বেদীতে কে বসে আছে। দেখলেন ত্ৰিশূল হস্তে গৈরিকভম্মরুদ্ৰাক্ষবিভূষিত ভৈরবীবেশে জয়ন্তী ও শ্ৰী। মঞ্চ হতে শ্ৰী নেমে সীতারামের চরণের ওপর পড়ে উচ্চস্বরে বলতে লাগল-’এই তোমার পায়ে হাত দিয়ে বলছি, আমি আর সন্ন্যাসিনী নই। আমার অপরাধ ক্ষমা কর। আমাকে আবার গ্ৰহণ কর।‘ সীতারাম বললেন- ‘তুমিই আমার মহিষী।‘ জয়ন্তী বলল –’আজ থেকে অনন্তকাল আপনারা উভয়ে জয়যুক্ত, হউন।‘ সীতারাম জয়ন্তীকে বললেন- মা, আমি তোমার কাছে অপরাধী, আমি বুঝেছি তুমি যথার্থ দেবী। আমায় বল তোমার কাছে কি প্ৰায়শ্চিত্ত করলে তুমি প্ৰসন্ন হও। ওই শোন মুসলমানের কামানের গর্জন। আমি ওই কামানের মুখে এখনই এই দেহ সমৰ্পণ করব। আর সময় নেই। তুমি বল কি করলে তুমি প্ৰসন্ন হও।‘ শ্ৰী বললো-’মহারাজ! আমি বা নন্দ। মরতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু নন্দ ও রমার কতকগুলি পুত্রকন্যা আছে, তাদের রক্ষার কিছু উপায় করুন।‘ সীতারাম বললেন–’আমি নিরুপায়।‘ জয়ন্তী বলল-—‘মহারাজ, নিরুপায়ের এক উপায় আছে। আপনি ঐশ্বৰ্যমদে নিরুপায়ের সেই উপায়কে ভুলে গেছেন।‘ সীতারাম তখন নিরুপায়ের সেই উপায় ‘ঈশ্বরী’ চিন্তা করলেন। জয়ন্তী ও শ্ৰী মঞ্চের ওপর জানু পেতে সেই মহাদুর্গের চারদিক প্ৰতিধ্বনিত করে গগনবিদারী কলবিহঙ্গনিন্দী কণ্ঠে গেয়ে উঠল—’ত্বমাদিদেবঃ পুরুষঃ পুরাণত্ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম। বেত্তাসি বেদ্যঞ্চ পরঞ্চ ধাম ত্বয়া ততং বিশ্বমনস্তরূপ ॥’ যে ক’জন যোদ্ধা তুর্গমধ্যে ছিল, তারা সেই গীত শুনে অনুপ্ৰাণিত হল। তাদের সঙ্গে মহারাজ অগ্রসর হয়ে দুর্গের দ্বার খুলে দিলেন। সম্মুখেই ত্রিশূলধারিণী গৈরিকভস্মরুদ্রাক্ষবিভূষিত জয়ন্তী ও শ্ৰীকে দেখে শত্রুসৈন্য মন্ত্ৰমুগ্ধ ভুজঙ্গের ন্যায় নিশ্চল হয়ে গেল। শ্ৰী ও জয়ন্তী দ্রুতপদে এসে কামানের সামনে দাঁড়াল। হকচকিয়ে গোলন্দাজের হাত থেকে পলতে পড়ে গেল। সে কামান থেকে সরে দাঁড়াল। সীতারাম একলম্ফে এসে তার মাথা কেটে ফেললেন। দেখা গেল গোলন্দাজ আর কেউই নয়, স্বয়ং গঙ্গারাম; শ্ৰী সহোদরেরই প্রাণঘাতিনী হল। এইভাবে বিধিলিপি ফলল ৷ জয়ন্তী ও শ্রী আর সীতারামের সঙ্গে দেখা করল না। সেই রাত্রে তারা কোথায় অন্ধকারে মিলিয়ে গেল কেউ জানল না।

 

***

 

‘পথের দাবী’তে ঘটনা অপেক্ষা সংলাপের বাহুল্যই বেশি। সংলাপ সবই ‘বিপ্লব’ সম্পর্কিত। অপূর্ব বাঙলাদেশের ছেলে। চাকরির সন্ধানে ব্ৰহ্মদেশে গিয়ে যে বাসায় আশ্রয় নিয়েছে, তার ওপরতলার বাসিন্দা এক ক্রীশ্চন পরিবারের সঙ্গে তার ঝগড়া হয়। ঝগড়া আদালত পৰ্যন্ত গড়ায়। অপূর্ব নিগৃহীত হয়। কিন্তু পরে ওই পরিবারের মেয়ে ভারতী তার প্রতি প্ৰণয়াসক্ত হয়। অপূর্ব পাঁচশত টাকা মাহিনায় বোথা কোম্পানীর ম্যানেজার নিযুক্ত হয়। ভারতীর মাধ্যমে অপূর্ব বিপ্লবী ‘পথের দাবী’ দলের সভানেত্রী সুমিত্রার সংস্পর্শে আসে। সুমিত্রার পিতা ছিলেন একজন বাঙালী ব্ৰাহ্মণ, সুরভায়া রেল স্টেশনে চাকরি করতেন। মা ছিলেন একজন ইহুদী মহিলা। সুমিত্রার শিক্ষাদীক্ষা সবই মিশনারী স্কুলে। সুমিত্ৰা অসামান্য সুন্দরী। পিতার মৃত্যুর পর চোরা অহিফেন কারবারীদের প্রভাবে পড়ে। তারা সুমিত্ৰাকে নিযুক্ত করে রেলপথে অহিফেনের পেটিক এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় স্থানান্তরিত করত। একবার এক রোল-স্টেশনে সে অহিফেনের পেটিকা সমেত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সেখানে পথের দাবী দলের নেতা সব্যসাচী সুমিত্রাকে স্ত্রী বলে স্বীকার করে ও ওই অহিফেন-পেটিকার স্বত্ব অস্বীকার করে। সুমিত্ৰা মুক্তি পায়। কিন্তু অহিফেনের চোরা কারবারীদের দল তাদের পিছন নেয়। এক হোটেলের ওপরতলার ঘরে অবস্থান করছিল সুমিত্ৰা, আর নীচের তলার ঘরে সব্যসাচী। সেখানে চোরাকারবারী দলের আট-দশজন দুর্দান্ত প্ৰকৃতির লোক এসে সুমিত্ৰাকে স্ত্রী বলে দাবী করে। সুমিত্ৰা তাদের অস্বীকার করে। পরদিন রাত্রে তারা সুমিত্রাকে বলপূর্বক অপহরণ করতে আসে। কিন্তু সব্যসাচীর গুলিতে তারা আহত ও দু-একজন নিহত হয়। সব্যসাচী বেপরোয় নিৰ্ভীক বিপ্লবী। সে বহুরূপী। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সে জাপান থেকে জাভা পর্যন্ত সমগ্ৰ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিপ্লবী দল গঠন করে। সুমিত্ৰাকে চোরাচালানীরা সহজে ছাড়বে না এবং প্ৰতিশোধ নেবে এই চিন্তা করে সব্যসাচী তাকে ব্ৰহ্মদেশে নিয়ে আসে এবং সেখানে দল গঠনের কাজে তাকে নিযুক্ত করে। ভারতীকে সে সহায় পায় এবং তাকে নিয়ে সে ব্ৰহ্মদেশের কলকারখানার মজুরদের নিয়ে দল গঠন করবার সঙ্কল্প করে। কলকারখানার শোষিত মজুরদের দীন-হীন অবস্থা ও পশুর মতো জীবনযাত্ৰা তাদের সহায়ক হয়। ভারতীর মাধ্যমে অপূর্বও পথের দাবী দলে যোগ দেয়। দলের প্ৰথম দিনের সভায় অপূর্বই হয় প্রধান বক্তা। জনসভায় অপূর্ব কখনও এর আগে বক্তৃতা দেয়নি। কিন্তু প্ৰথম দিনের সাফল্য সম্বন্ধে সুমিত্রার কাছ থেকে প্ৰশংসাসূচক চিঠি পেয়ে, সে দ্বিতীয় দিনের সভার বক্তৃতার মহড়া দিতে থাকে তার অফিসে } এটা লক্ষ্য করে অফিসে তার প্রিয় বন্ধু চীফ অ্যাকাউণ্টটেণ্ট রামদাস তালওয়ার। অপূর্ব তাকে সব কথা বলে। তখন সে জানল যে তালওয়ারও একজন পাকা বিপ্লবী। ভারতে সে জেলও খেটেছে। তালওয়ার এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেয়। রাজদ্রোহের অপরাধে সে গ্রেপ্তার হয়। নিজের চাকরির নিরাপত্তার জন্য অপূর্ব পুলিশের কাছে পথের দাবী দল সম্বন্ধে সব কথা বলে। পথের দাবীর দল তাই জেনে অপূর্বকে ধরে নিয়ে যায়। তার বিচারের জন্য। ভারতীকে সেখানে ডেকে পাঠানো হয়। ভারতী সেখানে গিয়ে দেখে যে বিচারকমণ্ডলীর সভানেত্রী সুমিত্ৰা। সব্যসাচীও সেখানে উপস্থিত। আরও উপস্থিত ব্ৰজেন্দ্ৰ নামে একজন কুৎসিত দুর্ধর্ষ প্রকৃতির লোক। বিচারে রায় দেওয়া হয় ‘ডেথ’। ব্রজেন্দ্র অপূর্বক মেরে এক পুরাতন কুপের মধ্যে ফেলে মাটি চাপ। দেওয়ার জন্য প্ৰস্তুত হয়। ভারতীর সজলনয়নের দিকে তাকিয়ে সব্যসাচীর মন টলে। পিস্তল দেখিয়ে সে দুর্ধর্ষ ব্ৰজেন্দ্রকে নিরস্ত করে। অপূৰ্বকে মুক্তি দেয়, এবং তিনদিনের মধ্যে ব্রহ্মদেশ ত্যাগ করে নিজের দেশে ফিরে যেতে আদেশ দেয়। দেশে ফিরে অপূর্ব দেখে মা অন্তিমশয্যায় শায়িত, ও অন্য পুত্ৰগণ কর্তৃক অবহেলিত। মাকে নিয়ে অপূৰ্ব আবার ব্ৰহ্মদেশে ফিরে যায়। ভারতীর সঙ্গে দেখা করতে যায়। কিন্তু অপূৰ্বর আচরণে ভারতী তখনও ক্ষুব্ধ। সে অপূৰ্বর সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃত হয়। কিন্তু বিকালে সে যখন দাসীর মুখে অপূৰ্বর মায়ের মৃত্যুসংবাদ পায়, তখন সে নিজেই ছুটে যায় অপূৰ্বর বাসায়। অপূৰ্বকে সে নিজ বাসায় নিয়ে আসে।

এর ঠিক অব্যবহিত পূর্বে ভারতীর মন ভরে গিয়েছিল পরিপূর্ণ ঘৃণায় যখন সে শুনল যে দলের সদস্য নবতার স্বামীর মৃত্যুর সাতদিন পরে আবার বিয়ে করছে। দলের কবি শশীকে। শশী বিয়েতে তাদের নিমন্ত্রণ করল। বিয়ের দিন সব্যসাচী ভারতীকে নিয়ে শশীর বাড়ি গেল। গিয়ে শুনল নবতারা সেদিন দুপুরে আহমেদ নামে কলের এক মিস্ত্রিকে বিয়ে করেছে। ভারতী আরও বিমর্ষ হয়ে পড়ল। সহসী। সেখানে এল সুমিত্রা ও ব্ৰজেন্দ্র। সুমিত্রা জানাল যে সে তার মাতামহের এক বিরাট সম্পত্তি পেয়েছে এবং সেই কারণে সুরভায়ায় ফিরে যাচ্ছে। এদিকে ব্ৰজেন্দ্ৰ সব্যসাচীকে সরিয়ে দিতে চায়, সুমিত্রাকে পাবার জন্য।

এর কয়েকদিন আগে থেকেই সব্যসাচী ভারতীকে বোঝাচ্ছিল, এ বিপ্লবের পথে ভারতীর আর থাকা উচিত নয়। ভারতীও রক্তপাতের ভিতর দিয়ে বিপ্লবের উদ্দেশ্যসাধন চাইছিল না। এখন সুমিত্রার সুরভায়ায় ফিরে যাবার সঙ্কল্পে পথের দাবীর দল ভেঙে পড়ল। সুমিত্ৰা গেল, ভারতী গেল, নবতারা গেল, তালওয়ার জেলে গেল; রইল শুধু সব্যসাচী। এদিকে ব্ৰজেন্দ্ৰ বিশ্বাসঘাতকতা করে দলের অন্যান্য যে-সব শাখা ছিল সেগুলি পুলিশকে জানিয়ে দিল। সব্যসাচী পায়ে-হাটা পথে চীনে যাবে ঘোষণা করেছিল। সেজন্য ব্ৰজেন্দ্ৰ সেপথে ওৎ পেতে রইল। সব্যসাচীকে ধরিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু সব্যসাচী তা জানতে পেরে স্টীমারে করে জাভা চলে গেল।

 

***

 

হিন্দিতে একটা বচন আছে : ‘গাগরী মে সাগর ভর দিয়া গয়া হায়’। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ তাই। এখানা দেশোদ্ধারের রঙ্গমঞ্চে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী। এর কেন্দ্র-চরিত্র হচ্ছে এলা। এলা অপূর্বসুন্দরী। বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে এলার ছেলেবেলাটা কেটেছিল। মা ছিলেন বেহিসাবী মেজাজের লোক। কারণ্যে-অকারণে মেয়ের দোষ। ধরতেন। বলতেন, ‘তুই মিছে কথা বলছিস। অথচ অবিমিশ্র সত্যকথা বলাই এলার একটা ব্যসন-বিশেষ ছিল। বাবা ছিলেন বিলাত-শিক্ষিত সাইকোলজির অধ্যাপক। তীক্ষ্ণ বৈজ্ঞানিক বিচারশক্তির জন্য তাঁর ছিল সুনাম। কিন্তু সাংসারিক বিচারবুদ্ধি ছিল তাঁর কম। ভুল করে লোককে বিশ্বাস করা ও বিশ্বাস করে নিজের ক্ষতি করার বারবার অভিজ্ঞতাতেও তাঁর শোধন হয়নি। বিশ্বাসপরায়ণ ঔদার্যগুণে তার বাপকে কেবলই ঠকতে ও দুঃখ পেতে দেখে বাপের ওপর এলার ছিল ব্যথিত স্নেহ। নানা উপলক্ষে মায়ের কাছে বাবার অসম্মান দেখে এলা চোখের জলে রাত্রে তার বালিশ ভিজিয়ে ফেলত। একদিন এলা বাবাকে বলেছিল-’এরকম অন্যায় চুপ করে সহ্য করাই অন্যায়।‘ পিতা পুত্রীকে উত্তর দিয়েছিলেন—’স্বভাবের প্রতিবাদ করাও ষ, আর তপ্ত লোহায় হাত বুলিয়ে তাকে ঠাণ্ডা করতে যাওয়াও তাই।‘

পিতা দেখলেন। এইসব পারিবারিক দ্বন্দ্বে মেয়ের শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মেয়ে কলকাতার বোর্ভিঙে যেতে চাইল। বাবা পাঠিয়ে দিলেন। এল স্কুল-কলেজের সব পরীক্ষায় পাস করল। ইতিমধ্যে মাবাবা দু’জনেই মারা গেলেন। কাক ডাকবিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। ষ্ঠার ওপরই পড়ল এলার ভার। কাকীমা এলাকে ভাল চোখে দেখলেন। না। একদিন সেখানে নিমন্ত্রণে এল ইন্দ্ৰনাথ। দেশের ছাত্রসমাজের উপর ছিল তার অসীম আধিপত্য। এলা তাকে একটা কাজের কথা বলল। ইন্দ্ৰনাথ বলল-’কলকাতায় সম্প্রতি নারায়ণী হাইস্কুল মেয়েদের জন্য খোলা হচ্ছে। তোমাকে তার কত্ৰীপদ দিতে পারি। কিন্তু সংসারের বন্ধনে কোনদিন বদ্ধ হবে না, এই প্ৰতিজ্ঞ তোমাকে স্বীকার করতে হবে।‘ এলা রাজী হয়ে গেল।

নারায়ণী বিদ্যালয়ে এসে এলা পড়ল স্বদেশসেবার গোপন সাধনার আবর্তে। অনেক তরুণ ও তরুণীর সংস্পর্শে এল। আদর্শ ও প্ৰতিজ্ঞা অনুযায়ী ওদের কর্মপ্রয়াস চলতে লাগল। তারপর ওদের দলে এল অতীন্দ্র। অতীন্দ্রকে এলা ভালবেসে ফেলল। প্ৰতিদ্বন্দ্বী জুটল। বটু। ঈর্ষায় বটু অতীন্দ্রের নানারকম অনিষ্ট করার চেষ্টা করতে লাগল। শেষকালে করল বিশ্বাসঘাতকতা। অতীন্দ্রের দল একজায়গায় লুঠ করে আনল এক বুড়ির যথাসর্বস্ব। বুড়ি দলের একজনকে চিনতে পারায়, ওরা বুড়ির প্রাণান্ত করল। বটু পুলিশের কাছে সব ফাস করে দিল। ভোর রাতে পুলিশ আসবে অতীন্দ্রকে ধরতে। শেষরাত্রে অতীন এল এলার ঘরে; এল অতীন্দ্রের পা জড়িয়ে ধরে বলল –মারে, অামাকে অন্তু নিজের হাতে। তার চেয়ে সৌভাগ্য আমার কিছু হতে পারে না।‘ অতীনকে বার বার চুমু খেয়ে বলল-‘মারো, এইবার মারো।‘ ছিড়ে ফেলল বুকের জামা। বলল—‘একটুও ভেবো না অন্ত। আমি যে তোমার, সম্পূর্ণ তোমার—মরণেও তোমার। নাও আমাকে। নোংরা। হাত লাগাতে দিয়ে না। আমার গায়ে, আমার এ দেহ তোমার। ’

 

***

 

যদিও পাঁচখানা উপন্যাসই বীররসে সিক্ত, তা হলেও তাদের রচয়িতারা ছিলেন আদিরসের মহাকবি। বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্ৰনাথ সকলেই। বস্তুত আদিরসের মৈনাকভিত্তিক শৈলস্তম্ভে ধাক্কা খেয়েই বিপ্লবসমূহ ধ্বসে পড়েছিল।

শান্তি ও এলা যথাক্ৰমে বঙ্কিম ও রবীন্দ্ৰনাথের অনুপম সৃজন।  দু’জনেই আশৈশব বিদ্রোহী; শান্তি অদৃষ্টবিপাকে, আর এলা পারিবারিক পরিবেশের প্রতিঘাতে। প্ৰফুল্ল ও শ্ৰী ভবিতব্যের শিকার। ভবিতব্য তাদের টেনে নিয়ে গিয়েছিল বিপ্লবের আবহের মধ্যে। সুমিত্ৰা ঘটনাপ্রবাহের অগ্নিবাহিকা। এদের সকলের চরিত্রেই লক্ষ্য করা যায়। বীররস ও অাদিরসের অপূর্ব সম্মিলন। বঙ্কিমের উপন্যাসসমূহে এই দুই রসের যুগল ধারা গঙ্গা-যমুনার মিলিত ধারার মতো পরম সৌখ্যতার বেণীবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুললিত গতিতে প্ৰবাহিত। সুমিত্রার চরিত্রে আদিরসের ধারা স্তিমিত, কিন্তু এলার চরিত্রে পূর্ণমাত্রায় প্রস্ফুটিত। আবার শান্তির চরিত্র কৌতুকরসেরও পয়ঃকুম্ভ। এর নিদর্শন আমরা পাই বনমধ্যে ক্যাপ্টেন টমাসের সঙ্গে তার কথোপকথনে ও আশ্রমমধ্যে জীবানন্দের ঘরে জীবানন্দের সঙ্গে তার সংলাপে। কৌতুকরসের অবতারণায় প্ৰফুল্লর ভূমিকাও কম নয়। এর দৃষ্টান্ত আমরা পাই বজরার মধ্যে যখন ব্ৰজেশ্বরকে ধরে এনে সাগরের পা টেপানো হয়েছিল। বা লেফটানেণ্ট ব্রেন। ান ও হরিবল্লভকে ধরে এনে তাদের সঙ্গে প্ৰফুল্লর ইঙ্গিতে দিবা ও নিশার কৌতুকপূৰ্ণ তামাসায়। এসব নাটকীয় দৃশ্য রোমান্সের বিচিত্র রঙে রঞ্জিত হয়ে সুগ্ধ কমেডি-রসের সৃষ্টি করেছে।

নায়িকারা সকলেই অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতার মূৰ্তিময়ী প্রতীক। শান্তি এক লহমায় বিদ্যুদবেগে কেড়ে নেয় ক্যাপ্টেন টমাসের বন্দুক ও বিনা ক্লোশে ইস্পাতের ধনুকে লোহার গুণ পর্যায়। দেবী চৌধুরানীর বীরত্ব ও সাহসিকতায় ইংরেজ সন্ত্রস্ত। শ্ৰী বৃক্ষশাখায় আরোহণ করে লাল শাড়ির আচল ঘুরিয়ে উৎসাহ দেয় হিন্দু জনতাকে মেচ্ছনিধনে, ও শেষ যুদ্ধে কামানের মুখে দাঁড়িয়ে। সুমিত্রা ও এলারও সাহসের অন্ত নেই। বীরাঙ্গনা হলেও এরা সকলেই ছিল বাঙালী ঘরের কুলাঙ্গনা। এমনকি পথের দাবীর আনুষঙ্গিক চরিত্র ভারতী বিজাতীয় ক্রীশচান সমাজভূক্ত হলেও আমরা তাকে দেখি বাঙালী ঘরের চিরপরিচিত মেয়েরূপে। বাঙালী কুলাঙ্গনা বলেই শান্তি, প্ৰফুল্প ও শ্ৰী পতিপ্ৰাণী। সুমিত্রা ও এল অনুঢ়া, সেজন্য তার প্ৰেম নিবেদন করেছে দায়িতের পাদপদ্মে। শান্তি যেমন সত্যানন্দের কাছে বলছে–সে সহধর্মিণী হিসাবে স্বামী যে ধর্ম অবলম্বন করেছে, সেই ধর্মপালনের জন্যই সন্তান সম্প্রদায়ে যোগ দিয়েছে; চার অধ্যায়ে এলাও তেমনই অতীনকে বলছে—আমি স্বয়ংবরা, আমাকে বিয়ে কর অন্তু। আর সময় নেই-গান্ধৰ্ব বিবাহ হোক, সহধর্মিণী করে নিয়ে যাও তোমার পথে। সব্যসাচীর প্রতি সুমিত্রার মনের প্রগাঢ় অনুরাগ ভারতীর কাছে অজ্ঞাত ছিল না, যদিও শরৎচন্দ্ৰ সুমিত্ৰা চরিত্রকে সেরকম জীবন্ত করতে পারেননি, যেরকমভাবে তিনি সজীব করে তুলেছেন ভারতীর বেদনাসিক্ত অন্ত ঘন্দ্বের দাবদাহকে।

উপন্যাস হিসাবে চার অধ্যায় স্বল্পপরিমিত হলেও তাতে পূৰ্ণ প্ৰকাশিত হয়েছে এলার চরিত্র। অতীন্দ্ৰ ও ইন্দ্ৰনাথের সঙ্গে এলার ংলাপের ভিতর দিয়ে রবীন্দ্রপ্রতিভা এল চরিত্রকে পুণবিকশিত ও মহীয়সী করে তুলেছে। এল সুমিত্রার মতো বিপ্লবের রঙ্গমঞ্চে নেপথ্যবর্তিনী নয়। সমগ্র বিশ্বের সামনে সে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেছে, তার অন্তরের গুহায় অবরুদ্ধ হৃদয়বৃত্তির প্রচণ্ড দহন ব্যক্ত করে।

Share on FacebookShare on TwitterShare on WhatsAppShare on TelegramShare on SMS
Category: প্রমীলা প্রসঙ্গ (১৯৩৯)
পূর্ববর্তী:
« ০৩. বিবাহের মঞ্চে প্ৰমীলা
পরবর্তী:
০৫. প্ৰমীলা রহস্যময়ী »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑