• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

ড্যান কগিন্স নিবাস নিউইয়র্ক

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » প্রবন্ধ » ড্যান কগিন্স নিবাস নিউইয়র্ক

ড্যান কগিন্স নিবাস নিউইয়র্ক
দিলওয়ার হাসান

মাথার ওপরে চৈত্র মাসের সূর্য। রোদে খাঁ খাঁ করছে চারদিক। এলোমেলো হাওয়া বাতাসে উত্তপ্ত বালু ছড়াচ্ছে। ডানে বয়ে চলেছে পদ্মা। জলের ধারার পাশ দিয়ে যতদূর চোখ যায়, বালু আর বালু।
নদীর পাড় দিয়ে ক্লান্ত পায়ে প্যাডেল করতে করতে সাইকেল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন এক শ্বেতাঙ্গ। পরনে তাঁর হাফপ্যান্ট, গায়ে গেঞ্জি, মাথায় ক্যাপ। পিঠের ওপরে ঝুলছে একটা ট্রাভেল ব্যাগ। রোদের তাপে তাঁর লাল টুকটুকে রং তামাটে হয়ে উঠেছে। ঘামে ভিজে গেছে গায়ের গেঞ্জি।
পদ্মার একেবারে ধার ঘেঁষে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। শুকনো মৌসুম। নদীতে পানি এখন খুব কম। বিস্তীর্ণ বালুচর দেখে শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক নদীর বিশালতা অনুমান করতে পারেন। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা—বাংলার এই তিন বিশাল নদীর কথা শুনেছেন তিনি।
কাঠফাটা রোদের দোর্দণ্ড প্রতাপ উপেক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছেন শ্বেতাঙ্গ ভদলোক। জানেন না, কখন তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন। বড় একটা জনবসতির ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। কোথাও জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। যে দেশে এক রাতে রাজধানী শহরের কয়েক হাজার লোক মর্টার আর মেশিনগান দেগে হত্যা করা হয়েছে, যে দেশের গ্রামগঞ্জে ঢুকে পড়েছে সশস্ত্র সেনা, কথায় কথায় গুলি করে মারা হচ্ছে মানুষ, মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর্মি ক্যাম্পে, চলছে নির্বিচারে রেপ, টর্চার, সে দেশের রাস্তায় লোকজনের স্বাভাবিক চলাচল আশা করা যায় না—এ কথা জানা সত্ত্বেও জনবহুল এই এলাকার স্তব্ধ নির্জনতায় তিনি বিস্মিত না হয়ে পারেন না।
দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ক্লান্ত শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক নদীতীরে একটা বড় বটগাছের নিচে সাইকেল রেখে মাটিতে শুয়ে পড়েন। মাথার ওপরে বটের পাতায় মৃদুমন্দ বাতাসের আনাগোনা আর তাতে যে শনশন শব্দ হচ্ছে, তার আঁচ পেয়ে তাঁর মনে অজানা পুলকের জন্ম দিচ্ছে। স্নিগ্ধ বাতাসে শরীর জুড়াচ্ছে বটে, তবে তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। সঙ্গে আনা বোতলের পানির মজুদ শেষ। আশপাশে ঘরবাড়িও চোখে পড়ছে না। একটুখানি পানির জন্য ছটফট করতে থাকেন। বটগাছের ছায়ায় শুয়ে শুয়ে স্পষ্ট দেখতে পান, কাছেই একটা গাছে ঝুলছে এক কাঁদি কচি ডাব। তাঁর তৃষ্ণা প্রবলতর হয়ে ওঠে। চোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ শুয়ে থাকেন। ব্যাগ থেকে লেবুর সুঘ্রাণ দেওয়া লজেন্স বের করে চোষেন। তৃষ্ণা মেটে না, জিবের ডগা মিষ্টিতে ভরে ওঠে, বুক শুকিয়ে আসে।
তৃষ্ণা আর ক্লান্তি উপেক্ষা করে আবার সাইকেলে ওঠেন। সময় নষ্ট করার সময় কোথায় তাঁর। আর কতদূর সেই অমৃতগ্রাম? যেখানে পাবেন তাঁর শ্রেষ্ঠ এক্সক্লুসিভের সন্ধান? কিছুদূর এগোনোর পর একটা টিউবওয়েল চোখে পড়ল। দ্রুত ব্রেক কষলেন। ক্ষিপ্রগতিতে টিউবওয়েলের হ্যান্ডেল চাপতে লাগলেন। না, পানি উঠছে না—শুকিয়ে খটখটে হয়ে আছে। হতাশ হয়ে আবার সাইকেলে উঠলেন।
কিছুটা এগোনোর পর দেখতে পেলেন, নদীর ধার থেকে মোড় নিয়ে রাস্তাটা লোকালয়ের ভেতর ঢুকে গেছে। লোকালয় যখন আছে, লোকজনও পাওয়া যাবে, লোকজন থাকলে পানির অভাব হবে না—এই ভেবে আশ্বস্ত হলেন শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক। পা চলতে চাইছে না, প্রচণ্ড তৃষ্ণায় মাথা ঘুরছে বোঁ বোঁ করে।
ঝাঁকড়া একটা আমগাছের নিচে ছোট্ট একটা মুদি দোকানে হাতপাখায় হাওয়া করতে করতে ঝিমোচ্ছে এক দোকানি। সাইকেল থামিয়ে দোকানের সামনে পাতা বাঁশের ফালি কেটে বানানো বেঞ্চের ওপর থপ করে বসে পড়লেন। অবশ হয়ে আসছে তাঁর শরীর।
দোকানির তন্দ্রালস্য ভাব কেটে গেলে হঠাৎ চোখে পড়ল লাল টুকটুকে এক সাহেব তার দোকানের সামনে বসে আছেন। সাহেবদের গল্প শুনেছে, চোখে দেখেনি। চোখের সামনে জলজ্যান্ত সাহেব দেখে হাঁ হয়ে গেল দোকানি। ড্যাবড্যাবে চোখে তাঁর দিকে তাকাল।
তৃষ্ণাকাতর শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক অঙ্গুলি নির্দেশ করে দোকানির গ্লাসটি দেখালেন। সাহেব পানি খেতে চান, এটা বোঝার পর দ্রুত কলতলায় ছোটে দোকানি। আয়রনে লাল হয়ে যাওয়া গ্লাসটা ভালো করে ধুয়ে সাহেবকে পানি দেয়, সঙ্গে দুটি বিস্কুট; কেননা অতিথিকে শুধু পানি দিতে নেই।
পানিটা খুব মিষ্টি আর ঠান্ডা। বিস্কুট ফিরিয়ে দেন। স্বস্তিবোধ করেন। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ—কথাটা বার কয়েক উচ্চারণ করেন, পরক্ষণেই ভাবেন, এই লোকটা তো তাঁর কথা বুঝতে পারবে না। তিনি মিষ্টি করে দোকানির দিকে তাকান আর তাতেই সৌজন্যবোধের সবটুকুই ফুটে ওঠে সাহেবের চোখেমুখে। বেঞ্চের ওপর সটান শুয়ে পড়েন। বিরল আয়েশে চুরুট ধরান। দোকানিকেও একটা দেন। চুরুটের সুগন্ধি খুব ভালো লাগে দোকানির।
চিত হয়ে শুয়ে আছেন তিনি। ওপরে ঘন আমের পাতার নিশ্চিন্ত ছায়ায় বসে কোকিল ডাকছে। দূরে কোথাও ঘু ঘু ডাকছে—গুগুগু গুগুগু, আপন পুত বুকে থু, হতির পুত পিটঠে থু গুগুগু। তাঁর মনে হয়, কোনো স্বপ্নলোকে প্রবেশ করেছেন। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন।
একটু পরেই ধড়মড় করে উঠে পড়েন। ঝটপট পানির বোতল ভরে নিয়ে আবার সাইকেলে ওঠেন। রাস্তার ওপর এক বাঁশের সেতু দেখে থমকে দাঁড়ান। ভেবে পান না, সাইকেল নিয়ে কী করে পার হবেন। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন গ্রামের এক যুবক। সাহেবের অবস্থা দেখে এগিয়ে এলেন। সাইকেল কাঁধে নিয়ে সাহেবের হাত ধরে নির্বিঘ্নে ওপারে পৌঁছে দিলেন। পকেট থেকে ডলার বের করে যুবককে দিতে গেলেন শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক। অপ্রস্তুত হাসিতে উদ্ভাসিত হলো যুবকের মুখ। ডলার ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দূর সাহেব, টেকা লাগব না। কিন্তুক ভাঙাচুরা এই সাইকেল নইয়া কই যান?’ সাহেব কিছুই বোঝেন না। যুবকের সঙ্গে দীর্ঘ করমর্দন করে বলেন, ইয়েস ইয়েস ইয়েস।
খেয়া পার হতে হলো গোটা পাঁচেক। মাঝিদের ডলার সেধেছিলেন, নেয়নি। কী বিচিত্র দেশ এটা? নগদ অর্থ হাতে পেয়ে ফিরিয়ে দেয়? পরের জন্য পরিশ্রম করে, কিন্তু পারিশ্রমিক নেয় না। এই সরল মানুষগুলোর আতিথেয়তা মুগ্ধ করল তাঁকে। অভিভূত হলেন তিনি। পথের ক্লান্তি ভুলে গেলেন। অনেক দেশে গেছেন, পাড়ি দিয়েছেন দুর্গম এলাকা—এ রকম ভালো মানুষ কমই দেখেছেন।
একবার তাঁর মনে হলো, তিনি কোন দেশ থেকে এসেছেন তা জানতে পারলে এই লোকগুলো কি তাঁকে ঘৃণা করবে? বিশ্বের কে না জানে, বাঙালিদের মুক্তিসংগ্রামের বিপক্ষে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। তাদের সরবরাহ করা অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি নিধন করছে।…তিনি সাইকেলে দ্রুত প্যাডেল করতে লাগলেন।
দুপুর গড়িয়ে যায়, বিকেল নামে। গ্রামের রাস্তায় এক-দুজন লোক দেখা যাচ্ছে। তারা অবাক হয়ে লক্ষ করছে, সাদা চামড়ার একটা মানুষ সাইকেলে করে গ্রামের পথ অতিক্রম করছে। তাদের মনে প্রশ্ন, কোথায় যাচ্ছে এই লোক। এই মহাদুর্যোগের সময় লোকটা কি দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছে? নাকি কোনো মতলব আছে তার? কে জানে?
তিনি যখন সুতালরী গ্রামে পৌঁছালেন তখন সন্ধ্যা। একটা মাঠের ওপর সাইকেল থামালেন।
লোকজনের পথনির্দেশিকা সঠিক হলে এই গ্রামই সুতালরী। কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করবেন? কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে মাটিতে রাখলেন, তারপর শুয়ে পড়লেন চিত হয়ে।
আহ্, কী ভীষণ ক্লান্তি। ঘুম জড়িয়ে আসছে চোখে। থমথম করছে চারদিক। দূরে একটা আলোর আভাস। মাথার ওপরে অপার আকাশ, চাঁদ বা তারা—কোনোটাই নেই, শুধু কালো কালো মেঘ ভেসে যাচ্ছে।…
‘সাত দিনও হয়নি এ দেশে এসেছি। এর মধ্যেই আমার নোটবুকের পাতা ভরে উঠেছে। রোলের পর রোল শেষ করেছি ছবি তুলে। দুর্লভ সব এক্সক্লুসিভ!
ঢাকার রাজপথে একজন রিকশাওয়ালার কাপড় খুলে দেখা হচ্ছে, সে হিন্দু না মুসলমান। কে কাকে পরীক্ষা করছে? যুগপৎ কান্না ও হাসি পেয়েছে আমার। যারা পরীক্ষা করছে, তারা নিজেরাও মুসলমান। মুসলমান হয়ে আরেক মুসলমানকে হত্যা করছে, মেয়েদের রেপ করছে, টর্চার করছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে, লুট করছে।
‘যুবতী মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিচ্ছে সশস্ত্র সৈনিক, মাকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। দাউদাউ করে জ্বলছে গ্রামের পর গ্রাম। রাস্তার পাশে লাশের ওপর নৃত্য করছে শকুন, শবের নাড়িভুঁড়ি টেনে বের করছে তীক্ষ ঠোঁটে।
‘খাল দিয়ে ভেসে যাচ্ছে ফুলে ঢোল হয়ে ওঠা যুবতীর লাশ, বুকের ওপর তার মরা বাচ্চা, মায়ের স্তন তখনো তার মুখে। কল্পিত চিত্র নয়, নিজের চোখে দেখা।
‘অনেক দেশের যুদ্ধ, দাঙ্গা, দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, মহামারি কভার করতে হয়েছে আমাকে। এ রকম বর্বরতা ও নৃশংসতা আর কোথাও দেখিনি। এই নিষ্ঠুরতা, এই পশুত্ব, এই হত্যাযজ্ঞ তুলে ধরার ভাষা আমি কোথায় পাব? হত্যা, রেপ, টর্চার, অগ্নিসংযোগ আর তার মোকাবিলায় যে বীরত্বপূর্ণ ঘটনা আমি প্রত্যক্ষ করেছি, তা কি শুধুই খবর? নিউজ স্কুপ?
‘এসব দেখে এ দেশের মানুষের জন্য যে মমতা আমার মনের ভেতর জন্ম নিয়েছে, তাকে কী অভিধায় অভিহিত করব আমি? আর যা-ই হোক, নিছক জার্নালিজমের গণ্ডিতে বাঁধা যায় না তাকে।’…
এসব ভাবতে ভাবতে খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। গুঞ্জনের শব্দে ঘুম ভাঙল। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ১০-১২ জন লোক। হাঁ করে দেখছে তাঁকে। আঁধার করে এসেছে। কারও মুখ দেখা যায় না। চার ব্যাটারির টর্চ হাতে সে সময় ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন সুতালরী হাইস্কুলের অঙ্কের শিক্ষক মাইনুদ্দিন বিএসসি। ভিড় দেখে থমকে দাঁড়ালেন। শ্বেতাঙ্গ দেখে কৌতূহল হলো তাঁর। ভিড় ঠেলে কাছে গেলেন। দুর্বল ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কী করিয়া আসিলেন ভাবিয়া অবাক হইতেছি। কোথায় যাইবেন?’ ইংরেজি জানা লোক পেয়ে শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক খুব খুশি হলেন। বললেন, ‘সে ভাই অনেক কথা। তাহার আগে বলুন, এই গ্রামের নাম কি সুতালরী?’
‘বিলক্ষণ।’
‘শুনিয়া প্রীত হইলাম। আমি এখানকার চেয়ারম্যানের বাড়িতে যাইব—আবদুর রহমান চেয়ারম্যান।’ খুবই অবাক হলেন বিএসসি—এই ভদ্রলোক তো দেখি মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির সন্ধান করছে। তিনি সন্দেহের চোখে শ্বতাঙ্গ ভদ্রলোকের দিকে তাকান। তাঁকে রীতিমতো জেরা করতে থাকেন।
‘কোন দেশের নাগরিক আপনি? চেয়ারম্যানের বাড়িতে কী প্রয়োজন?’
‘আমার নিবাস নিউইয়র্ক নগর। সেটা যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে আমার কী প্রয়োজন, এই মুহূর্তে বলিতে পারিব না। সেখানে লইয়া গেলে সবকিছু বলিব।’ মাইনুদ্দিন ভাবলেন, সোজা লোক নয় এই শ্বেতাঙ্গ। গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে চলুন, আপনাকে লইয়া যাই।’
মাইনুদ্দিনের ডাকাডাকিতে চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে তালপাতার সেপাই মতন এক লোক বেরিয়ে এসে চিৎকার করতে থাকে, ‘কিরা, কিরা ডাকে?’
‘আমি মাইনুদ্দিন বিএসসি। সাতে ভিনদেশি মানুষ, স্যারেরে সম্বাদ দাও।’ তালপাতার সেপাই কুতকুতে চোখে সাহেব দেখে তারপর বিড়বিড় করে বলে, ‘কথান থিকা কারে আবর দইরা আনলেন মাস্টার সাব। বিলতি সাহেব মনে অয়। ইয়ারে পরথম অ্যারেস্ট করি, হ্যাশে স্যারেরে সম্বাদ দেই।’
‘থও তুমার অ্যারেস্ট, হারাহারি স্যারেরে খবর দ্যাও। রাইত ম্যালা হইচে।’
দুজন মুক্তিযোদ্ধা বেরিয়ে আসেন। বলেন, ‘বলুন, এখানে আপনার কী প্রয়োজন?’ এ কথা বলে তাঁরা তাঁদের কাঁধের রাইফেল নামিয়ে হাতে রাখেন।
‘আমার নাম ড্যান কগিন্স। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা। এখানকার ২২ থানার মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাই।’ কগিন্স তাঁর পরিচয়পত্র বের করে দেখালেন। তাঁর কথা শুনে মুক্তিযোদ্ধাদের মাথায় বজ্রপাত হলো যেন। শত চেষ্টা করেও পাকিস্তানি বাহিনী তাঁর টিকির হদিস বের করতে পারেনি, আর এই সাহেব কি না সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে এসে তাঁরই ঘাঁটির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করছেন। খুবই আশ্চর্যের বিষয়।
তাঁরা নিজেদের বিস্ময় কাটিয়ে ওঠার আগেই বললেন, ‘আগে আমরা আপনাকে গ্রেপ্তার করিব, তাহার পর অন্য কথা। এই ঠিকানা পাইলেন কী করিয়া?’
কগিন্স হেসে ফেললেন। বললেন, ‘তাহা করুন আপত্তি নাই, কিন্তু যথাশীঘ্র সম্ভব ক্যাপ্টেনকে সংবাদ দিন। আমি অনেক কষ্ট করিয়া এখানে আসিয়াছি।’
সব শুনে ক্যাপ্টেন নিজেই বেরিয়ে এলেন। মুখে চাপদাড়ি, পরেন লম্বা কল্লিদার পাঞ্জাবি, মাথায় কিস্তি টুপি। সিগারেটে ঘন ঘন টান দিচ্ছিলেন।
তাঁকে দেখে বিস্ময়ের অন্ত রইল না ড্যান কগিনেসর। এই মাওলানা কিনা ২২ থানার মুক্তিযোদ্ধাদের অধিনায়ক। নিতান্ত অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তিনি ভাবলেন, এই ব্যক্তিই যদি ক্যাপ্টেন হন, তবে এবারের সফরে তিনিই তাঁর শ্রেষ্ঠ এক্সক্লুসিভ মাওলানা লিডস ফ্রিডম ফাইটার্স… মনে মনে হাসলেন তিনি। সেই হাসির খানিকটা তাঁর মুখমণ্ডলে সঞ্চারিত হলো।
দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, পাঠ করতে চাইলেন একে অপরের হূদয়, বুঝতে চাইলেন মনের ভাব। শুধু একটুখানি সময়, তারপরই দুজন নিজেদের হাত বাড়িয়ে দিলেন। ক্যাপ্টেন কগিন্সকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি অনুভব করলেন, এ বুক নিছক একজন পেশাদার সাংবাদিকের নয়, যিনি সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে অ্যাসাইনমেন্ট কভার করার জন্য এখানে এসেছেন। এই দেশ আর এই দেশের মানুষের জন্য ওই বুকে খানিকটা ভালোবাসাও হয়তো জমে আছে।
স্মিত হেসে ক্যাপ্টেন বললেন, ‘মিস্টার কগিন্স, এখন আর কোনো কথা নহে। আপনি পরিশ্রান্ত। হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রাম করুন। আমি আপনার ডিনারের বন্দোবস্ত দেখি।’
রাত প্রায় ১০টার দিকে পোলাও আর ঝাল করে রাঁধা মুরগির মাংস দিয়ে ডিনার করলেন কগিন্স। খাবার শেষে কয়েকটা কচি ডাব কেটে দেওয়া হলো তাঁকে। পরম তৃপ্তিতে ঢেকুর তুলতে লাগলেন। বিছানায় শুয়ে আয়েশ করে চুরুট ধরালেন একটা। ঘরের সব কটা জানালা খোলা। ঝিরঝির করে ঠান্ডা বাতাস আসছে। একটু পরে বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েন কগিন্স।
পরদিন সকালে মুক্তাঞ্চল সফরে বেরোলেন ক্যাপ্টেনের সঙ্গে। জেলা সদর থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে এই এলাকা। প্রমত্তা পদ্মা নীরব প্রহরীর মতো পাহারা দিয়ে চলেছে এই এলাকাটা। এ অঞ্চলে ঢুকতে হলে পদ্মা পাড়ি দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। নদীর কিনারায় শত্রুর গতি রোধ করতে পারলে পুরো এলাকা নিরাপদ।
সব দেখে অবাক হলেন কগিন্স। একেবারে সাধারণ সব অসামরিক লোকজন যুদ্ধ করছে। কেউ ছাত্র, কেউ শ্রমিক বা কৃষক। ছাত্রদের সংখ্যাই বেশি। পাকিস্তানি আর্মি, প্যারামিলিশিয়া আর পুলিশ থেকে বেরিয়ে আসা কিছু সাধারণ সৈনিক ও অফিসারও আছেন। তাঁরা মূলত প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। কগিন্স দেখলেন, প্রায় সবার পরনেই লুঙ্গি, গায়ে আধা ময়লা জামা। ফরমাল কোনো পোশাক নেই। লুঙ্গিতে মালকোচা মেরে ট্রেনিং করছেন, পিটি প্যারেডে অংশ নিচ্ছেন। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তাঁদের কাছে খুব বেশি একটা নেই। পুরোনো আমলের কিছু থ্রি নট থ্রি, এসএলআর ও এসএমজি গোটা কতক আর পাকিস্তানিদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা কিছু চায়নিজ রাইফেল। তাঁদের জন্য বিশেষ কোনো খাবারের ব্যবস্থা নেই। মাছ, মাংস, ডিম বা এই জাতীয় দামি খাবার তাঁরা বলতে গেলে পান না। গ্রামের সাধারণ মানুষের মতো ডাল-ভাত আর সবজি খান তাঁরা। গ্রামের লোকজনই তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করে।
ক্যাপ্টেনের সঙ্গে অনেক বিষয়ে আলাপ করলেন কগিন্স। নিলেন দীর্ঘ ফরমাল ইন্টারভিউ। শত শত ছবি তুললেন। কথা প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেনকে বললেন, ‘মিস্টার ক্যাপ্টেন, আপনি শুনিয়া আনন্দিত হইবেন যে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মানুষ আপনাদের এই যুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত। তাহাদের অনেকেই আপনাদের পক্ষে আছে, আপনাদিগকে পাঠাইবার জন্য অর্থ সংগ্রহ করিতেছে। আপনাদের সমর্থনে সভা-সমাবেশ করিতেছে। কাগজে বিবৃতি দিতেছে। গায়কগণ গান গাহিয়া আপনাদের জন্য চাঁদা তুলিতেছে। ইহার মূল্যও কিন্তু একেবারে কম নহে। আমার রিপোর্টগুলি প্রকাশিত হইলে আপনাদের প্রতি জনসমর্থন আরও বাড়িবে বলিয়া আশা করিতেছি।’
ক্যাপ্টেন বললেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের দেশের জন্য আপনি যে আন্তরিকতাপূর্ণ মনোভাব ব্যক্ত করিলেন, তাহার জন্য মুক্তিযোদ্ধা ও এই দেশের মানুষের পক্ষ হইতে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আপনার এই পরিশ্রমের বিনিময়ে হূদয়ের ভালোবাসা ভিন্ন দেবার মতো কিছুই আমাদের নাই।’
পরের দিন খুব ভোরে ভাঙাচোরা সাইকেলটা নিয়ে পথে নামলেন ড্যান কগিন্স। বিদায়মুহূর্তে চোখ ছলছল করতে লাগল তাঁর। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ক্যাপ্টেনকে বললেন, ‘বাংলার মানুষকে আমি ব্যক্তিগতভাবে ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছি। আপনাদের জন্য আমার প্রাণ সর্বদা কাঁদিবে। আপনাদের জন্য সদা চিন্তিত থাকিব। মিস্টার ক্যাপ্টেন, একটা কথা বলি—ইভেন ইউ হ্যাভ গট হাফ এ ব্রোকেন রাইফেল, কিপ দ্য রেভল্যুশন অ্যালাইভ ইনসাইড। ইউর ইনডিপেনডেন্স ইজ অ্যাসিওরড।’

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৩, ২০১১

Category: প্রবন্ধ
Previous Post:আর্জেন্টিনার রবিতীর্থ – আহমেদ হেলাল
Next Post:হুমায়ূন আছেন হুমায়ূনের মতোই – বেলাল বেগ

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑