• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

এডওয়ার্ড ডিমক ও জীবনানন্দ দাশ – হাসান ফেরদৌস

লাইব্রেরি » বাংলা লিরিক্স » ফোক গান » এডওয়ার্ড ডিমক ও জীবনানন্দ দাশ – হাসান ফেরদৌস

জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে আমাদের আগ্রহ ও বি্নয় প্রায় অন্তহীন। বিশ শতকের অন্য কোনো বাঙালি কবি আমাদের কল্পনায় এমন প্রবলভাবে দাগ কাটেনি। অন্য আর কোনো কবি নেই-রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে মাথায় রেখেই বলছি-যার কবিতা সব বয়সের বাঙালি পাঠককে এমন প্রবল রকম আলোড়িত করে। তাঁর কবিতার চিত্রময়তা, যার সঙ্গে আমরা অনায়াসে ঘনিষ্ঠ বোধ করি, এই জনপ্রিয়তার একটি কারণ। যে প্রকৃতির বর্ণনা জীবনানন্দ করেন, বাস্তবে তাকে আমরা আর খুঁজে পাই না। পাই না বলেই হয়তো হারানো সে সৌন্দর্যকে আমরা নিজের ভেবে আরও প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণ আমার মনে হয়, জীবনানন্দের কবিতার সাবজেক্টিভিটি। একই কবিতা একেকভাবে তা আমাদের কাছে ধরা দেয়। অনেক সময় তাঁর উচ্চারিত শব্দচিত্র আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। সম্রাট বিম্বিসার কে, বিদর্ভ নগর কোথায়, তা না জেনেই মনে মনে নিজের মতো এক চিত্র ও ধ্বনির জগৎ আমরা গড়ে নিই। আগাগোড়া তাঁর কবিতার সুর বিষণ্ন, সবচেয়ে উজ্জ্বল যে রং তাও ধূসর, অথচ তা সত্ত্বেও এই কবির কবিতায় আমরা ব্যক্তিগত প্রণোদনার উৎস খুঁজে পাই। অন্য আর একমাত্র যে কবিকে আমরা এই রকম ‘যে যার মতো’ করে আবিষ্কার করি, তিনি হলেন কিটস।

বাংলার বাইরে জীবনানন্দ দাশের পরিচিতি কার্যত শূন্য। তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ-অন্য ভাষার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম-খুব বেশি নয়। নিজে বুদ্ধদেব বসুর উৎসাহে গোটা কয়েক কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। লীলা রায় ও হুমায়ুন কবিরের হাতে করা বেশ কটি কবিতার অনুবাদও পড়েছি। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ফখরুল আলম জীবনানন্দ দাশের কবিতার একটি সরল কিন্তু সুপাঠ্য অনুবাদ সংকলন প্রকাশ করেছেন। ইংরেজি ভাষার একমাত্র যে কবি সরাসরি বাংলা থেকে জীবনানন্দের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, তিনি হলেন জো উইন্টার। বেঙ্গল দি বিউটিফুল নামে রূপসী বাংলা এবং নেকেড লোনলি হ্যান্ড নামে জীবনানন্দের নির্বাচিত কবিতার খুবই চমৎকার অনুবাদ প্রকাশ করেছেন এই ইংরেজ কবি। কোথাও কোথাও জীবনানন্দের কবিতার আক্ষরিক ও সরলীকৃত ভাষান্তর হয়েছে এ কথা ঠিক, কিন্তু বাঙালি কবির ধ্বনিচিত্র তিনি যেভাবে রূপান্তরিত করেছেন তাতে মুগ্ধ হতে হয়। মার্কিন লেখক ও ভাষাবিদ ক্লিনটন সিলি, যাঁর বাংলা ভাষা জ্ঞান ও সাহিত্যবোধ আমাদের বি্নিত করে, ইংরেজি ভাষায় জীবনানন্দের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবনী ও তাঁর কবিতার ব্যাখ্যা নির্মাণ করেছেন। এ পোয়েট অ্যাপার্ট নামের সে জীবনীগ্রন্থে জীবনানন্দের কবিতা থেকে অসংখ্য উদাহরণ ব্যবহার করেছেন সিলি। ইংরেজ কবি উইলিয়াম রাদিচি সিলির অনুবাদ ও ব্যাখ্যাকে সঠিক ও সবচেয়ে যোগ্য বলে বাহবা দিয়েছেন।

কিন্তু আমার বিবেচ্য সিলি নয়, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষক এডওয়ার্ড ডিমক। বৈষ্ণব সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথকে তিনি অসীম ভালোবাসা এবং গভীর প্রজ্ঞার সঙ্গে বিশ্বের পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ওপর বাউল-সাহিত্যের, বিশেষ করে লালনের গানের প্রভাব নিয়ে তাঁর আলোচনা একদিকে পাণ্ডিত্যের পরিচায়ক, অন্যদিকে বাংলা ভাষা ও তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রমাণবহ। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় ভাষা ও সভ্যতা বিভাগ ডিমকের নিজ হাতে গড়া। জীবনানন্দের সঙ্গে সিলির পরিচয় এই ডিমকের মাধ্যমেই। ডিমক ও বুদ্ধদেব বসু উভয়েই তাঁকে জীবনানন্দ নিয়ে কাজ করতে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। ডিমক নিজে জীবনানন্দ নিয়ে কোনো গ্রন্থ প্রণয়ন করেননি, কিন্তু বিভিন্ন বক্তৃতায় ও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে এই বাঙালি কবিকে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। বক্ষ্যমাণ আলোচনায় আমরা নজর দেব অধ্যাপক ডিমকের ভাষ্যে জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটি। দি জার্নাল অব এশিয়ান স্টাডিস পত্রিকায় (আগস্ট ১৯৭৪) প্রকাশিত তাঁর সে প্রবন্ধের শিরোনাম ‘কবি যখন প্যাঁচা ও ইঁদুর।’

ডিমকের বিবেচনায় বাংলা কবিতার দুটি ধারা-তার একটি ধ্রুপদী, অন্যটি আধুনিক। এই দুই ধারার একদিকে রবীন্দ্রনাথ, যিনি বাংলা ধ্রুপদী ধারার শেষ কবিদের একজন; অন্যদিকে জীবনানন্দ, যিনি ‘আধুনিক’ বাঙালি কবিদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য।

জীবনানন্দ ‘কল্লোল’ যুগের কবি, আর এই কল্লোল কবি গোষ্ঠীর সদস্যরা একসময় রবীন্দ্রনাথকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে দ্বিধা করেননি। ফলে ডিমকের বিবেচনায় কবি হিসেবে তাঁদের দুজনের মধ্যে একটি চেতনাগত বৈপরীত্য আছে। এ দুই কবির মধ্যে-কার্যত এ দুই কাব্যধারার মধ্যে-মিল ও অমিল কোথায়, তা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ডিমক ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটিকে রবীন্দ্রনাথের ‘বিদায়-রীতি’র প্রতি তুলনা হিসেবে উপস্থিত করেছেন। দুটি কবিতারই কেন্দ্রীয় বিষয় মৃত্যু-চিন্তা। জীবনানন্দের কবিতায় মৃত্যু যেখানে বিষণ্ন, নির্জন ও ভয়াবহ, সেখানে রবীন্দ্রনাথের চোখে মৃত্যু ‘শান্ত, নিয়মবদ্ধ এমনকি হাস্যমধুর’।

‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটি গভীরভাবে বিষণ্ন, এক অর্থে মরবিড। গলায় ফাঁস জড়িয়ে এক পুরুষের আত্মহত্যার ভেতর দিয়ে কবিতাটির উদ্বোধন। কেন এই মৃত্যু, তার ব্যাখ্যায় জানতে পারি, পুরুষটির কোনো দুঃখ ছিল না। একজন গৃহী, স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে প্রেমময় ও সুখী জীবনই সে যাপন করেছে। তার পরও মৃত্যুকে সে বেছে নেয়, কারণ-
‘নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ নয় সবখানি।
অর্থ নয়, কীর্তি নয়-সচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বি্নয়
আমাদের রক্তের ভেতর খেলা করে;
লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাইঃ
তাই।’

বুদ্ধদেব বসু আমাদের ধরিয়ে দিয়েছেন, এখানে কবিতাটি শেষ হলে তা মোটেই উল্লেখযোগ্য হতো না। কবিতার শেষ পাদে এসে কবি মৃত্যুর নয়, জীবনের জয়ধ্বনি উচ্চারণ করেছেন, কবিতাটি সে কারণেই উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে। একটি বুড়ো পেঁচা, যে অন্ধকারে জেগে থাকে কিন্তু আত্মহত্যায় উদ্যত পুরুষটিকে বাধা দেয় না, কবি তাকে ফিরিয়ে আনেন এই কবিতায় এবং তার মুখ দিয়ে শোনান প্রসন্নতার আদিম আনন্দ। “আর এই প্রগাঢ় পিতামহীর দৃষ্টান্তের কবি উদ্বুদ্ধ হলেন-‘আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাড়ার।’ এভাবে মৃত্যু পার করে বেজে উঠল জীবনের জয়ধ্বনি, আর সে সঙ্গে নির্বোধ ও পাশবিক জীবনের প্রতি চৈতন্যের বিদ্রূপ।”

কবিতাটি নিয়ে সমালোচনার জবাবে জীবনানন্দ নিজে কিছুটা আত্মরক্ষামূলক ভাষায় বলেছেন, এটি মোটেই তাঁর সেরা কবিতার একটি নয়, এমনকি তাঁর কবিতার প্রতিনিধিত্বমূলকও নয়। তাঁর যুক্তি, এই কবিতা ‘সাবজেক্টিভ নয়, একটা ড্রামাটিক রিপ্রেজেন্টেশন মাত্র।’ অন্য কথায়, এ কথাগুলো কবি নিজের বিষয়ে বলছেন না, আত্মহত্যার সপক্ষে কোনো যুক্তিতর্কও এখানে নেই। এই কবিতার উদাহরণে একজন সমালোচক জীবননান্দ দাশকে ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’র অভিযোগে আক্রমণ করেছিলেন। কিন্তু এই আত্মঘাতী ক্লান্তি তো কবির নিজের নয়, যেমন হ্যামলেটের বা ম্যাকবেথের আত্মঘাতী ক্লান্তি শেক্সপিয়ারের ব্যক্তিগত নয়। প্রকৃতপক্ষে জীবনানন্দের ভাষ্যে, কবিতাটির আসল সুর মোটেই আত্মঘাতমূলক নয়। কবিতার শেষে এসে দেখি ‘প্রকৃতির প্রাচুর্য ও ইতিহাসের প্রাণশক্তির সঙ্গে একাত্ম করে আনন্দিত করে রেখেছে কবিকে।’ কবিতার সেটাই আসল সুর, তার মূল কথা।
ডিমক সম্ভবত জীবনানন্দ ও বুদ্ধদেব বসুর ব্যাখ্যার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। সে ব্যাখ্যার সঙ্গে তিনি স্পষ্টতই মতৈক্য পোষণ করেন, কিন্তু পাশাপাশি এ কবিতার একটি গভীরতর অর্থও তাঁর কাছে ধরা পড়ে, যা অন্য কোনো বাঙালি বা ভারতীয় লেখক-পাঠকের কাছে ধরা পড়েছে বলে আমি জানি না। ডিমকের প্রস্তাব, প্রবলভাবে ইউরোপীয়-চেতনা মুগ্ধ এই কবি ‘জ্ন ও মৃত্যু তাৎপর্যার্থে অভিন্ন,’ এই ভারতীয় দর্শনচিন্তা ও মতবাদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং এই কবিতায় সে কথারই একটি ‘প্রতীকী আড়াল’ নির্মাণ করেছেন। তাঁর বক্তব্যের সূত্র হিসেবে ডিমক উপনিষদের একটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় এ রকমঃ ‘আমি খাদ্য, আমি খাদ্য, আমি খাদ্যের খাদক, আমি খাদ্যের খাদক···। আমি খাদ্য যে খাদ্যের খাদককে ভক্ষণ করে। আমি বিশ্বকে পদানত করি।’

ডিমকের বিবেচনায়, খাদ্য গ্রহণ ও খাদ্য হিসেবে পরিণত হওয়া আসলে ‘জীবন’ ও ‘মৃত্যু’-জীবনের এই দুই রূপকে প্রকাশ করে। কারণ, জীবন ও মৃত্যু আসলে একটি বাইনারি বা দুই-বিপরীতমুখী অস্তিত্বের দুই ভিন্ন ভিন্ন রূপ বা প্রকাশ মাত্র। মৃত্যুর ভেতর দিয়ে জীবনের সমাপ্তি হয় না, জীবন অস্তিত্বের এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে বা রূপে প্রবেশ করে মাত্র। ডিমকের যুক্তি, এ কবিতায় প্রকৃতপক্ষে জীবনের (ও মত্যুর) এই বাইনারি রূপ প্রকাশ পেয়েছে। এ কাজে জীবনানন্দ পেঁচাকে ব্যবহার করেছেন দ্ব্যর্থবোধক অর্থে। পেঁচা মৃত্যুর প্রতীক, তার খাদ্য গ্রহণ অর্থাৎ বেঁচে থাকা নির্ভর করে অন্য জীবনের ওপর, এই কবিতায় যার প্রকাশ ঘটেছে ইঁদুরের ভেতর দিয়ে। যে পুরুষটির আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুর কথা এ কবিতায় ঘোষিত হলো, মৃত্যুর খাদ্য সংগ্রহের মাধ্যমে সে নিজের অমরতা অর্জন করে। অন্য কথায়, যা মৃত্যু, তা-ই জীবন। ডিমকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, জীবনানন্দ আসলে একই সঙ্গে জীবন ও মৃত্যুর কথা বলছেন। ‘জীবন মানে ক্ষয়, যার অর্থ মৃত্যু, যার অর্থ জীবন।’ কবি শুধু একবার মর্গ, যা মৃত্যুর সমার্থক শব্দটি ব্যবহার করেন। অন্যথায় তাঁর ব্যবহৃত শব্দ হলো ‘লাশকাটা ঘর’। অর্থাৎ এই শবের ভেতরেও জীবনের সম্ভাবনা রয়েছে, এই ঘরে শুধু মৃত্যু নয়, সেখানে জীবন অথবা জীবনের সম্ভাবনা বাস করে। লাশকাটা ঘরে মৃত পুরুষটি অপেক্ষা করে শব ব্যবচ্ছেদের, অথবা চিকিৎসক-ছাত্রদের, যারা সে শব কাটাছেঁড়া করবেন জীবনকে দীর্ঘায়িত করার সম্ভাবনা অন্বেষণে। ডিমক ্নরণ করেছেন, মৃত্যুর এক অর্থ অন্ধকার, কিন্তু এ অন্ধকারেই পেঁচা খুঁজে নেয় তার শিকারকে, যে শিকার (তার) জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে। অন্ধকারের কোনো রং নেই, অথচ সে অন্ধকারেই জোনাকি পোকা আলো ছড়ায়। তার মানে যা জীবন তা-ই মৃত্যু; যা অন্ধকার, তা-ই আলো। এই কবিতার কোনো গূঢ়ার্থ যদি খুঁজতেই হয় তা হলো এই যে, সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে আসলে একই সঙ্গে জীবন ও মৃত্যু, অস্তিত্বের এই দুই প্রকাশের ভেতর মূর্ত।

ডিমক জীবনানন্দের এই কবিতাটিকে ‘পীড়াদায়ক’ এবং তার কবিকে ‘আহত-পীড়িত’ বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর পাশে রবীন্দ্রনাথের যে মৃত্যুবোধ, তা সম্পূর্ণ বিপরীত। এ কথা উল্লেখ করে ডিমক ‘বিদায়-রীতি’ কবিতাটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেনঃ
‘হায় গো রানী, বিদায়বাণী/এমনি করে শোনে?/ছি ছি, ওই যে হাসিখানি/কাঁপছে আঁখিকোণে!/এতই বারে বারে কি রে/মিথ্যা বিদায় নিয়েছি রে,/ভাবছ তুমি মনে মনে/লোকটি নয় যাবার-/দ্বারের কাছে ঘুরে ঘুরে/ফিরে আসবে আবার।/···একটুখানি মোহ তবু/মনের মধ্যে রাখো,/মিথ্যাটারে একেবারেই/জবাব দিয়ো নাকো!/ভ্রমক্রমে ক্ষণেক-তরে/এনো গো জল আঁখির ’পরে/আকুল স্বরে যখন কব/‘সময় হলো যাবার’।/তখন নাহয় হেসো, যখন/ফিরে আসব আবার।
স্মরণযোগ্য, জীবননান্দ ও রবীন্দ্রনাথ উভয়েই উল্লিখিত কবিতাদ্বয় লিখেছিলেন তাঁদের বয়স যখন ৩৯-৪০।

জীবনানন্দের ‘ক্লান্তিকর ও পীড়িত’ আত্মার পাশে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মৃত্যু প্রশান্ত, এমনকি তাতে হাসিঠাট্টাও রয়েছে। জীবন মানে এক গভীর বেদনার অন্তহীন সাগর, তা মোটেই নয়। জীবনকে তিনি দেখেন একটি চক্রের ভেতর ঘূর্ণনরত অস্তিত্ব হিসেবে। এই চক্রাবর্তে রয়েছে জীবন, মৃত্যু ও জীবন। সেই চক্র অনুসারে জীবনের পর মৃত্যু যেমন অনিবার্য, তেমনি মৃত্যুর পর জীবনের পুনঃপ্রত্যাবর্তনও পূর্ব নির্ধারিত। তিনি স্থির-নিশ্চিত, প্রত্যাবর্তন তার হবেই। কারণ, ‘মৃত্যু প্রকৃতির অংশ এবং প্রকৃতি নিয়মবদ্ধ।’ কবিতা দুটির সরল পাঠ থেকেও বোঝা যায় জীবনানন্দের চোখে মৃত্যু যেখানে সহিংস ও বিশৃঙ্খল, সেখানে রবীন্দ্রনাথের কাছে মৃত্যু শান্তিময় ও নিয়মবদ্ধ। ডিমক অবশ্য মনে করেন, মৃত্যু বিষয়ে এই বিপরীতবোধ-একদিকে বিশৃঙ্খলা, অন্যদিকে নিয়মবদ্ধতা-কবিতা দুটির মুখ্য প্রভেদ নয়। বস্তুত কবিতা দুটির ভেতর আপাত অমিল সত্ত্বেও তাদের বক্তব্যের অন্তর্গত ঐক্য রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ কেউই মৃত্যুর অমোঘতায় বিশ্বাসী নন। অর্থাৎ মৃত্যুই জীবনের শেষ কথা নয়। জীবনানন্দের কাছে মৃত্যু ও জীবন একে অপরের অন্তর্বর্তী; রবীন্দ্রনাথের কাছে জীবন ও মৃত্যু একে অপরের অনুবর্তী। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রভেদ, ডিমকের ভাষ্যে, সময় তথা মহাকাল নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের কাছে সময় প্রকাশিত হয় মৃদুমন্দ ও রাজকীয় ছন্দে, একবার সে উত্থিত হয়, আবার সে মিলিয়ে যায় সমুদ্রগর্ভে। উদাহরণত ডিমক রবীন্দ্রনাথের বলাকা কাব্যের ‘শাহজাহান’ কবিতার কথা বলেছেনঃ
‘এ কথা জানিতে তুমি, ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান,/কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধনমান।/চিরন্তন হয়ে থাক সম্রাটের ছিল এ সাধনা।/রাজশক্তি বজ্র সুকঠিন/সন্ধ্যারক্তরাগসম তন্দ্রাতলে হয় হোক লীন,/কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস/নিত্য-উচ্ছ্বসিত হয়ে সকরুণ করুক আকাশ/এই তবে মনে ছিল আশ।/হীরামুক্তা মাণিক্যের ঘটা/যেন শূন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনুচ্ছটা/যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক।/শুধু থাক কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল/এ তাজমহল।’

রবীন্দ্রনাথের কাছে সময় বা কাল অলীক বা ধরাছোঁয়ার বাইরে ধোঁয়াটে কোনো ব্যাপার নয়, সে বাস্তব ও প্রামাণিক। ‘কিন্তু জীবনানন্দের চোখে কাল বা সময়ের স্বতন্ত্র কোনো অর্থ নেই।’ জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় অনায়াসে এককাল থেকে অন্যকালে গমনে সক্ষম, এমনকি হাজার বছর ধরে পরিব্রাজনেও সক্ষম।

গতকাল বা বর্তমানের এ মুহূর্ত, অথবা নিঃসীম আগামীকাল, সময়ের এসব প্রকাশ তাঁর কাছে সবই সমার্থক। ‘তাদের শুধু ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন রূপ বা আকার রয়েছে। ইঁদুর ও পেঁচার মতো, তারাও আসলে অভিন্ন, সমার্থক।’

ভিন্ন ভিন্ন পথে অগ্রসর হলেও ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটি বিষয়ে বৃদ্ধদেব বসু ও অধ্যাপক এডওয়ার্ড ডিমক কার্যত অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। তাঁদের দুজনেরই বক্তব্য, এ কবিতা শুধু ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’র বিবরণ নয়, অথবা মৃত্যুর হাতে নির্বিকার আত্মসমর্পণের যুক্তিজাল নয়। বরং এতে রয়েছে জীবনের সপক্ষে উচ্চারণ। এ উচ্চারণকে বুদ্ধদেব বলেছেন ‘জীবনের জয়ধ্বনি’, অন্যদিকে ডিমক তাঁর নাম দিয়েছেন ‘জীবনের প্যারাডক্স’। প্যারাডক্স, কারণ আপাতভাবে মনে হয় জীবনানন্দের সুরটি হতাশার, কিন্তু জীবন ও মৃত্যুর ভেতর যদি ভেদচিহ্ন তুলে নিই, জীবন ও মৃত্যুকে পরস্পরের সম্পূরক বলে উপলবব্ধি করি, তাহলে সে সুর ছাপিয়ে আরও গভীর এক সদর্থক অর্থ ধরা পড়ে। কবিকে একই সঙ্গে পেঁচা ও ইঁদুর, অর্থাৎ জীবন ও মৃত্যুর আধার বলে ডিমকের যে নির্দেশনা, তা হয়তো আপাতভাবে ‘আশাবাদ’ বলে অনুমিত হয় না। কিন্তু জীবনানন্দ নিজেই তো বলেছেন, কবি ও কবিতার কাজ মুগুরভাজা আশাবাদ ব্যক্ত করা নয়। কবি তাঁর হৃদয়ের কল্পনার ও কল্পনার ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তার ভিত্তিতে যে মানস চৈতন্যে পৌঁছান, আপাত নিরাশবাদী হলেও তা এত উজ্জ্বল ও আন্তরিক যে তাকে আশাবাদ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এ কথা জীবনানন্দের নিজের। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র এই কবির আরও অনেক কবিতাতেই এই প্যারাডক্স লক্ষণীয়। এমনকি আমাদের বহু পঠিত ‘বনলতা সেন’-এও কি আমরা পুনঃপুন এক বিষণ্ন ও অন্ধকারময় অভিজ্ঞতা ধ্বনি পাই না? অথচ সেই কবিতা শেষ হয় এই কথায়, ‘থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন,’ তখন এই প্রগাঢ় বাক্যমণ্ডলীতে যে সুর শুনি তা প্রত্যাখ্যানের নয়, গ্রহণের। বাইরে যদিও অন্ধকার, অন্তর্গত চৈতন্যে তখন এক উজ্জ্বল আলো। যাকে প্রথমে হতাশা ও পতন বলে ভ্রম হয়, তা-ই কবিতার শেষ পাদে এসে পরিণত হয় আশা ও উত্তরণে। ঠিক যেমন আট বছর আগের একদিন কবিতায়।
অধ্যাপক এডওয়ার্ড ডিমক জীবনানন্দের কবিতার সেই ধনাত্মক সুরটি ধরিয়ে দিলেন, তাঁকে ধন্যবাদ।
১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮, নিউইয়র্ক

হাসান ফেরদৌস
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৪, ২০০৮

Category: ফোক গানTag: হাসান ফেরদৌস
Previous Post:আমাদের পকেটে তখন কবিতা থাকত – শহীদ কাদরী
Next Post:পথহারা

Reader Interactions

Comments

  1. রাকিব

    February 13, 2020 at 7:44 pm

    চাপের মাংস কাকে বলে?

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑