০২.১ অধ্যক্ষ প্রচার – দ্বিতীয় অধিকরণ (অধ্যায় ১-১১)

অধ্যক্ষ প্রচার – দ্বিতীয় অধিকরণ

প্রথম অধ্যায়
১৯শ প্রকরণ-জনপদনিবেশ

পূর্ব্ব হইতেই স্থিত (অৰ্থাৎ পুরাতন) এবং নূতন জনপদের নিবেশ করিতে হইলে, পরদেশ (অর্থাৎ শত্রুরাজার বা অন্যরাজার দেশ) হইতে জনসমূহ আনাইয়া, ও স্বদেশের যে অংশে জনবাহুল্য আছে সে অংশ হইতে জনসমূহ সরাইয়া আনিয়া, (রাজা) তাহা করিবেন।

(রাজা) এমন গ্ৰাম নিবেশ করিবেন যাহাতে শূদ্রজাতীয় কৃষকই বেশীর ভাগ থাকিবে, যাহাতে কমপক্ষে একশত ও অনুৰ্দ্ধ পাঁচশত ঘর (গৃহস্থের কল) থাকিবে, যাহার সীমা হইতে গ্রামান্তরের সীমা পৰ্য্যন্ত এক ক্রোশ বা দুই ক্রোশ ব্যবধান থাকিবে, এবং যাহা (প্রয়োজন হইলে) অন্যান্য গ্রামসম্বন্ধে পরস্পরের রক্ষাবিষয়ে সাহায্যকারণক্ষম হইবে। নদী, শৈল (শিলাকুট), বন, গৃষ্টি-নামক ওষধিবৃক্ষ, দরী (গৰ্ত্ত), সেতুবন্ধ (আবদ্ধ জলাশয়াদি), শাল্মলী বৃক্ষ, শমীবৃক্ষ ও ক্ষীরবৃক্ষ দ্বারা এই প্রকার গ্রামের সীমান্ত নির্দ্দিষ্ট করিতে হইবে, অর্থাৎ এই সমস্ত বস্তুর স্থাপন দ্বারা গ্রামের সীমা নির্দ্দিষ্ট করিতে হইবে।

(রাজা) উক্তপ্রকার আটশত গ্রাম মধ্যে স্থানীয়-নামক (পরবর্তী সময়ে নিগমাপারনামধেয় স্থান) নগর বা মহাগ্রাম-বিশেষ, চারিশত গ্ৰামমধ্যে দ্রোণমুখনামক উপনগর-বিশেষ, দুইশত গ্ৰামমধ্যে কার্বটিক (পাঠান্তরে খার্বটিক) নামক ক্ষুদ্র নগরবিশেষ এবং দশখানি সেই প্রকার গ্রাম সংগৃহীত বা একত্রিত করিয়া সংগ্রহণ-নামক (পরবত্তী সময়ে মহাদ্রাঙ্গাপরপর্য্যায়) বড়, গ্রাম-বিশৈষ স্থাপন করিবেন। (ইহাদ্বারা এইরূপ জানা গেল যে, প্ৰাচীন ভারতে গ্রাম সৰ্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র জনপদাংশ এবং তদপেক্ষায় বৃহত্তর জনপদ।াংশগুলির যথাক্রমে নাম হইবে-সংগ্রহণ, কার্বটিক (বা খার্বটিক), দ্রোণমুখ ও স্থানীয়।

(রাজা জনপদের) সীমান্তে জনপদের (প্রবেশ ও নিৰ্গমের) দ্বারভূত আন্তপালদুর্গ স্থাপিত করিবেন এবং সেগুলি অন্তপাল-নামক অধ্যক্ষ দ্বারাই অধিষ্ঠিত থাকিবে। এই অন্তপাল-দুর্গসমূহের অন্তরাল প্রদেশগুলিকে বাগুরিক (মৃগবন্ধনজীবী ব্যাধ), শবর, পুলিন্দ, চণ্ডাল ও (অন্যান্য) অরণ্যচর জাতিরাই রক্ষা করিবে, অর্থাৎ রাজা বা তৎপক্ষে তাঁহার অন্তপাল এই সমস্ত জাতির মনুষ্যদ্বারাই সেই সব প্রদেশ রক্ষা করিবেন।

 (জনপদনিবেশ-বিষয়ে রাজা) ঋত্বিক, আচাৰ্য্য, পুরোহিত ও শ্রোত্রিয় (বেদাধ্যায়ী) ব্ৰাহ্মণদিগকে সর্বপ্রকার দণ্ড ও কর হইতে রহিত করিয়া এবং উপযুক্ত পুত্রপৌত্ৰাদি উত্তরাধিকারীদিগেরও ভোগ্য-বিষয় (অর্থাৎ বংশানুক্রমে ভোগ্য করিয়া দিয়া) ব্রহ্মদেয়-নামক ভূমি দান করিবেন। (পরবর্ত্তীকালেও রাজারা সর্বত্র তাম্রপট্ট-প্রণয়ন দ্বারা এইরূপ ভূমি দান করিয়াছেন।)

(তিনি) অধ্যক্ষ ও সংখ্যায়ক–(গণনাকাৰ্য্যে বা হিসাবরক্ষায় ব্যাপৃত পুরুষ) গণকে এবং (দশগ্ৰামী প্রভৃতির অধিকারী) গোপ, (জনপদ ও নগর চতুর্ভাগের অধিকারী) স্থানিক, অনীকস্থ (হস্তিশিক্ষায় নিপুণ পুরুষ), চিকিৎসক, অশ্বদমক (অশ্বশিক্ষায় অভিজ্ঞ পুরুষ) ও জঙ্ঘা করিক (সংবাদাদি বহন করিয়া দূরদেশে গতাগতজীবী পুরুষ)-গণকেও (দণ্ড ও কর রহিত করিয়া) ভূমিদান করিবেন; কিন্তু, ভূমির প্রতিগ্রহকারীরা এই ভূমি সম্বন্ধে বিক্রয় ও আধান (বন্ধক রাখা) কাৰ্য্য করিতে পারিবেন না (অর্থাৎ তাঁহারা কেবল এই রাজপ্রদত্ত ভূমি ভোগ করিতে পারিবেন)।

যাহারা ভূমির জন্য রাজকরাদি দিতেছে, তাহাদিগকে রাজা কৃতক্ষেত্র, অর্থাৎ যে ক্ষেত্রকে ফসলোৎপাদনের উপযোগী করা হইয়াছে সে ক্ষেত্র, এক পুরুষমাত্রের ভোগ্য করিয়া দিবেন। যে-সব ক্ষেত্র অকৃত, অর্থাৎ যাহা অপ্রহত (খিল) ক্ষেত্র, সেগুলিকে যে কৃষকেরা ফসলের উপযোগী করিবে, তাহাদের নিকট হইতে সেগুলি রাজা আর ফিরাইয়া লইবেন না। (অর্থাৎ সে ক্ষেত্রগুলির স্বামিত্র কৃষকে পৰ্য্যবসিত হইবে)।

“যে কৃষকের ক্ষেত্র কর্ষণ না করিয়া (তাহা ফেলিয়া রাখিবে), তাহাদিগের নিকট হইতে সে সব ক্ষেত্র ছিনাইয়া লইয়া তাহা অন্য (ক্ষেত্র তৈয়ারকারী) কৃষকদিগকে (রাজা) দিবেন। অথবা, (অন্য কৃষক না পাওয়া গেলে) গ্রামের ভূতকের (ভূতিভোগী কৰ্ম্মকরেরা, মতান্তরে, গ্ৰামাধিকারী রাজ-পুরুষেরা) ও বৈদেহকের (বণিকগণ) সেই সব ক্ষেত্র কর্ষণ করিবে। (আগে স্বীকার করিয়া পরে) যদি কেহ ক্ষেত্র কর্ষণ না করে, তাহা হইলে তজ্জন্য যে ক্ষতি হইবে, তাহাকে তাহা পূরণ করিয়া দিতে হইবে। (কৃষিকাৰ্য্যের সুবিধার জন্য রাজা অনুপায় অবস্থায়) কৃষকদিগকে (বীজ)। ধান্য, পশু ও হিরণ্য (নগদ টাকা) দিয়া অনুগৃহীত বা উপকৃত করিবেন। (তাহারাও অর্থাৎ কৃষকেরাও) পরে সে-সব দ্রব্য নিজ সুবিধামত রাজাকে ফিরাইয়া দিবে।

যদ্দ্বারা রাজকোষ (উত্তরকালে) বদ্ধিত হইতে পারে, (রাজা) তাহাদিগকে (কৃষকজনদিগকে) তেমন অনুগ্রহ (যথা, স্বল্পকালস্থায়ী করাদি হইতে মুক্তি, বা বীজাদি দােনরূপ উপকার) ও পরিহার (সম্পূর্ণ করমুক্তি) দেওয়ার ব্যবস্থা করিবেন। রাজকোষ-ক্ষয়কারী অনুগ্রহ ও পরিহার (তিনি) বর্জন করিবেন। কারণ, রাজা অল্পকোষযুক্ত হইলে (রাজকোষ পূরণ করিবার উদ্দেশ্যে নব নব করাদি বসাইয়া) পুরবাসী ও জনপদবাসী দিগকে গ্ৰাস করিতে পারেন (অর্থাৎ তাহাদিগকে পীড়িত করিতে পারেন)। নূতন জনপদ বা কুলাদির নিবেশকালে, অথবা, উচিত অবস্থার প্রাপ্তিতে, (তিনি) পরিহার দিবার ব্যবস্থা করিবেন। যাহাদের পরিহারভোগের সময় অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে, তাহাদিগকে (তিনি) পিতার ন্যায় অনুগ্রহদানে উপকার করিবেন।

(তিনি) আকার, কৰ্ম্মান্ত (শিল্পকারখানা), দ্রব্যবন (দারুচন্দনাদি মূল্যবান বৃক্ষাদির বন) হস্তিবন, ব্রজপ্রচার (গোহাঁধ্যক্ষপ্রকারণে উক্ত গবাদির জন্য বিবীতাদি স্থাপন) ও বণিকপথ-প্রচার (অর্থাৎ বিদেশ হইতে আমদানী মাল ও স্বদেশ হইতে রপ্তানী মালের যাতায়াতের জন্য রাস্তা নিৰ্ম্মাণ) এবং জলপথ, স্থলপথ ও পত্তন (ক্রয়বিক্রয়ের উপযোগী হাটবাজার, বা নৌমাত্রগম্য পুর’পট্টন’-পাঠে শকট, অশ্ব ও নৌদ্বারা গম্য পুর) নিবেশিত করিবেন।

(তিনি কৃষিকাৰ্য্যের সুবিধার জন্য) নিত্যজলবিশিষ্ট (অর্থাৎ নদ্যাদি হইতে আনীত জলবিশিষ্ট), অথবা, (বর্ষা সময়ে) কৃত্রিম উপায়ে আনীত জলবিশিষ্ট (জলাশয়াদিরূপ।) সেতুবন্ধ নিৰ্ম্মাণ করাইবেন। অথবা, অন্য লোকেরা সেতুবন্ধ রচনায় প্রবৃত্ত হইলে তাহাদিগকে (তিনি জলাশয়নিৰ্ম্মণার্থ) ভূমি, (জলপ্রবেশ ও জলনির্গমের জন্য) পথ, ও (সারদারু প্রভৃতির জন্য) বৃক্ষরূপ উপকরণসমূহ দিয়া অনুগ্রহ করিবেন। পুণ্যস্থান (দেবগৃহাদি) ও আরাম (বাগানবাড়ী) নিৰ্ম্মাণ করার জন্যও (তিনি তেমন অনুগ্রহ করিবেন)। সকলে একত্র মিলিত হইয়া সেতুবন্ধ রচনা করিতে গেলে, যে ব্যক্তি তাহাতে নিজ কৰ্ম্মাংশ সম্পাদন করিতে অনিচ্ছক হইবে, তাহার পরিবর্তে তাঁহার নিজ কৰ্ম্মকর ও বলীবৰ্দেরা সেই কাজ করিবে (অর্থাৎ রাজা তাহার পরিবর্তে তাঁহার কৰ্ম্মকর্যাদি দ্বারা কাজ করাইয়া লাইবেন)। এইরূপ ব্যক্তিকে (সেতুবন্ধের) ব্যয়কাৰ্য্যে অংশভাক হইতে হইবে; কিন্তু, (সেতুবন্ধের ফলে উদিত আয়ের বা লাভের) অংশ সে পাইবে না।

সেতুবন্ধসমূহে উৎপাদ্যমান মৎস্য, প্লব (কারণ্ডব নামক জলচর পক্ষী) ও হরিত পণ্য (শাক-শবাজী দ্রব্য)-সমূহে রাজারই স্বামিত্র বা অধিকার থাকিবে, অর্থাৎ সভূয়-সেতুকারীরা উৎপন্ন দ্রব্যের ভাগ পাইবে না। (নিবেশিত জনপদে) যে সব দাসজন বা আহিত (বন্ধকীভুত) জন, বা (লোকের) পুত্ৰাদি-বান্ধবের স্ব-স্বামীর আজ্ঞা উল্লঙ্ঘন করিবে, (রাজা) তাহাদিগকে বিনয় বা উচিত শিক্ষা গ্রহণ করাইবেন, অর্থাৎ তিনি তাহাদিগকে বিনীত রাখিবেন। বালক, বৃদ্ধ ও ব্যাধিগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত লোকেরা যদি অনাথ (বা প্রভু শূন্য) হয়, তাহা হইলে রাজা তাহাদিগকে ভরণ করিবেন। এবং কোন অপ্রজাতা অর্থাৎ বন্ধ্যা রমণী, এবং প্রজাতা (অপত্যবতী) রমণীর পুত্রেরা যদি অনাথ বা প্রভু শূন্য হয়, তাহা হইলে রাজা তাহাদিগকেও ভরণ করিবেন।

গ্রামবুদ্ধগণ, ব্যবহারপ্রাপ্তির বয়স পৰ্য্যন্ত (অর্থাৎ সাবালকত্র প্ৰাপ্তির বয়স পৰ্য্যন্ত) বালকের সম্পত্তি বাড়াইতে থাকিবেন (“বৰ্জয়েয়ুঃ’ পাঠ ধরিলে, সেই সম্পত্তি নিজের ভোগ করিবেন না-ইহাই ব্যাখ্যা) এবং (নিত্যই দেবোত্তর সম্পত্তিও বাড়াইতে থাকিবেন (অথবা, “বৰ্জয়েয়ুঃ’ পাঠ ধরিলে, তাহা নিজভোগে আনিবেন না-ইহাই ব্যাখ্যা)।

যে ব্যক্তি ভরণ করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও, নিজের পুত্র-কন্যা ও স্ত্রী, পিতা ও মাতা, অপ্ৰাপ্তব্যবহার (অর্থাৎ নাবালক) ভ্ৰাতা এবং অবিবাহিতা ও বিধবা ভগিনীদিগকে ভরণ করিবে না, তাহার উপর ১২ পণ দণ্ড প্রদত্ত হইবে; কিন্তু, পুত্ৰাদি যদি কোনও কারণে পতিত হইয়া থাকে, তাহা হইলে অভরণকারী গৃহপতির দণ্ড হইবে না। তবে মাতা যদি পতিতও হয়েন, তাহা হইলে তিনি সৰ্ব্বদা গৃহস্বামীর ভরণীয়া থাকিবেন।

পুত্রদের ও স্ত্রীর জীবনোপায়-ব্যবস্থা না করিয়া, কেহ যদি প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাস গ্রহণ করে এবং নিজের স্ত্রীকেও সন্ন্যাসগ্রহণে প্রযোজিত করে, তাহা হইলে তাহাকে প্রথম সাহস দণ্ড ভোগ করিতে হইবে। যাহার মৈথুনশক্তি সম্পূর্ণভাবে লোপ পাইয়াছে এমন ব্যক্তিই সরকারী ধৰ্ম্মস্থ (প্ৰাড বিবাকাদি)-গণের অনুমতি লইয়া প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাস গ্রহণ করিতে পারিবে, অন্যথা, তাহাকে কারাগুহে আবদ্ধ হইতে হইবে।

বানপ্রস্থজনের অতিরিক্ত কোন প্রব্রজিত বা সন্ন্যাসী, (রাজা ও রাজ্যের) কল্যাণার্থ রচিত সজেঘর অতিরিক্ত কোন (দুৰ্জাত) সজঘ, অথবা একত্রিত হইয়া প্রজাহিতার্থ অনুকুল কাৰ্য্যকারী দলের অতিরিক্ত অন্য (রাজদ্রোহ্যাদির আচরণার্থ) কোন সংবিতে বা প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ সংহত দল, রাজার জনপদে উপনিবেশ লাভ করিতে পারিবে না।

কিন্তু, সেখানে (জনপদে) বিহারার্থ অর্থাৎ চিত্তবিনোদনার্থ উপবন ও (নাট্য-) শালা থাকিবে না। (তাহা না থাকিলেই), নট, নৰ্ত্তক, গায়ক, বাদক, বাগজীবন (কথাবর্ণনায় পঢ়ি লোক) ও কুশীলবেরা (নানারূপ ক্রীড়াদ্বারা অভিনয়কারীরা) (জনপদবাসীদিগের) নিজ নিজ কৰ্ম্মে বিন্ন-বিধান করিতে পারিবে না। কারণ, গ্রামগুলিতে নাট্যাদি প্রদৰ্শনের প্ৰেক্ষাগৃহাদিরূপ আশ্রয় না থাকিলে এবং সেখানকার পুরুষের ক্ষেত্রকাৰ্য্যে সর্বদা ব্যাপৃত থাকিলে, (সেখানে) কোষ, বিষ্টি (কৰ্ম্মকর কৰ্ম্ম), (দাক প্রভৃতি) দ্রব্য, ধান্য ও (গুড্যাদি) রসেব বৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা থাকিবে।

রাজা দেখিবেন, যেন তাঁহার দেশ বা জনপদ পর্যচক্র (শক্রসেন) ও আটাবীপালদিগের অত্যাচারগ্রস্ত এবং ব্যাধি ও দুভিক্ষ-প্রপীড়িত না হয়, এবং তিনি যে-সব ক্রীডাতে ধনব্যয় বেশী হওয়ার সম্ভাবনা তাহা নিবারিত করিবেন। ১।৷

দণ্ড, বিষ্টি ও করারূপ পীড়াদ্বারা (কৃষকগণের) কৃষিকাৰ্য্য উপহত বা নষ্ট হইলে, (তিনি) সেই কৃষিকাৰ্য্য রক্ষা করিবেন, এবং চোর, ব্যাল (হিংস্রজন্তু), বিষপ্রয়োগ ও ব্যাধিদ্বারা উপহত পশুব্রজও রক্ষা করিবেন। ২।৷

(তিনি) রাজবল্লভ (অর্থাৎ তৎপ্রিয়), (রাজকরাদির সংগ্রহকারী) কৰ্ম্মচারী, চোর, অন্তপাল ও (ব্যাঘ্রাদি) পশুসংঘদ্বারা পীড়িত হওয়ায় ক্ষীয়মাণ বণিকৃপথ শোধিত রাখিবেন (অর্থাৎ এই সব বিপত্তি হইতে বণিকপথ মুক্ত রাখিবেন)। ৩।৷

এই প্রকারে, রাজা পূর্ব্বকৃত দ্রব্যবন, হস্তিবন, সেতুবন্ধ ও আকরসমূহ রক্ষা করিবেন এবং নূতন নূতন (দ্রব্যবনাদি) নিৰ্ম্মাণ করাইবেন।৷ ৪।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে জনপদনিবেশ-নামক প্রথম অধ্যায় (আদি হইতে ২২ অধ্যায়।) সমাপ্ত।

.

দ্বিতীয় অধ্যায়
২০শ প্রকরণ
-ভূমিচ্ছিন্দ্রবিধান বা কর্ষণের অযোগ্য ভূমির ব্যবস্থা

যে ভূমি কর্ষণের অযোগ্য তাহাতে (গোমহিষাদি) পশুর জন্য বিবীত বা তৃণজলাদিযুক্ত গোচরণক্ষেত্র (রাজা) নিৰ্ম্মাণ করাইবেন। (সেই সব অরুন্য ভূমিতে রাজা) এক গোরুত বা গধূতি পরিমাণ (প্রায় ৪ ক্রোশ পরিমিত) ব্রহ্মারণ্য (বেদাধ্যয়নোপযোগী অরণ্য) ও সোমারণ্য (সোমযাগের অনুষ্ঠানোপযোগী অরণ্য) ব্ৰাহ্মণদিগকে দিবেন; এবং সেই সব স্থানে (বৃক্ষাদি৷) স্থাবর ও (মুগাদি) জঙ্গমগণের প্রতি অভয়ও প্রদিষ্ট বা দত্ত থাকিবে। সেইরূপ তিনি তপস্বিজনের জন্য (অরুন্য ভূমিতে) তপোবন দান করিবেন। রাজার (মৃগয়াদি) বিহার জন্য তিনি (অরুন্য ভূমিতে) এমন মৃগবন নিবেশিত করাইবেন, যাহা গোরুত পরিমিত ও একদ্বারবিশিষ্ট হইবে (অর্থাৎ প্রবেশ ও নিৰ্গমজন্য যাহাতে একটি পথ থাকিবে) এবং যাহা চতুর্দিকে পরিখাদ্বারা রক্ষিত থাকিবে, যাহাতে স্বাদু ফল, গুল্ম ও পুস্পগুচ্ছ থাকিবে, যাহা কণ্টকময় দ্রুমশুন্য ও অগভীর জলাশয়যুক্ত থাকিবে, যেখানে মৃগ ও চতুষ্পদ জন্তুরা দান্ত অর্থাৎ মানুষের পরিচয়ে বিশ্বস্ত, যেখানে ব্যাল (হিংস্র) জন্তুদিগের নখ ও দন্ত ভগ্ন, এবং যেখানে মৃগয়ার যোগ্য হস্তী, হস্তিনী ও করিপোতগণ থাকিবে।

প্রত্যন্ত ভূমিতে (জনপদসীমান্তে), বা যোগ্য ভূমি হইলে (অন্যত্রও), (তিনি) অনা মৃগবন নিবেশিত করাইবেন, যাহাতে (উপদ্রুত হইয়া) সকল প্রকার পশুই আশ্রয় লইতে প্লারে।

কুপাধ্যক্ষ প্রকরণে (এই অধিকরণের। ১৭শ অধ্যায়ে)। উক্ত (দারু-বেণু বন্ধ প্রভৃতি) দ্রব্যসমূহের এক একটির জন্য এক একটি বন নিবেশিত করাইবেন।

(তিনি) দ্রব্যবন সম্বন্ধীয় কৰ্ম্মান্ত বা কারখানা এবং দ্রব্যবনে উপজীবিকা লাভ করিবার উপযোগী আটবিকদিগকে (নিবেশিত করাইবেন)।

(রাজা) নিজের জনপদপ্রান্তে আটবিকজন দ্বারা রক্ষিত হস্তিবনা নিবেশিত করাইবেন। হস্তিবনের অধ্যক্ষ, নাগবনপাল পুরুষগণ দ্বারা পর্বতে, নদী (-কুলে), (বড়) সরোবর (সমীপে) ও অনুপ বা জলময় প্রদেশে অবস্থিত নাগবন রক্ষা করিবেন; কিন্তু, (নাগবানপালের) সেই সব নাগবনের সীমা এব ইহাতে প্রবেশ ও নিৰ্গমের পথ জানিয়া রাখিবে। (নাগবানপালের) হস্তিঘাত (শবরাদিকে) হত্যা করিতে পারিবে। স্বয়ং মৃত হস্তীর দন্তযুগল আহরণকারী (বনেচরদিগকে) ৪ষ্ট পণ পারিতোষিক দেওয়া যাইতে পারে।

নাগবানপালেরা, হস্তিপক (মাহুত), পাদপাশিক (হস্তীর পদে পাশবন্ধনকুশল জন), সীমাবিৎ বা সীমারক্ষক পুরুষ, (অন্যান্য) বনচর ও পরিকস্মিক বা হস্তীর পরিচর্য্যায় নিপুণ পুরুষদিগকে সঙ্গে লইয়া, হস্তীর মূত্র ও বিষ্ঠার গন্ধে আচ্ছন্ন হইয়া, ভল্লাতকী বা অরুন্ধর বৃক্ষের শাখাদ্বারা লুক্কায়িত থাকিয়া, পাঁচসাতটি হস্তিবশকারিণী হস্তিণীসহ এদিক-ওদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া, (হস্তীর) শয্যা, অবস্থান, পদচিহ্ন লণ্ড বা বিষ্ঠা, (নদী প্রভৃতির) কুলপাত প্রদেশসমূহ লক্ষ্য করিয়া, হস্তিযুথের সঞ্চারসীমা পরিজ্ঞাত হইবে।

(তাহারা) কোন হস্তী যুথচর, কোনটি একচর (যে হস্তী একাকীই চরণ করে —দলের সঙ্গে নহে), কোনটি যুথচ্যুত, কোনটি যুথপতি, কোনটি ক্রুরপ্রকৃতি, কোনটি মত্ত, কোনটি পোত বা অল্পবয়স্ক ও কোনটি বন্ধ হইতে মুক্ত-এই সব তত্ত্ব নিবন্ধপুস্তক বা হস্তিশাস্ত্রপাঠে পরিজ্ঞাত লক্ষণ হইতে জানিবে।

আনীকান্থ বা হস্তিশিক্ষায় সুচতুর প্রাজ্ঞ জনদিগের কথা প্রমাণরূপে ধরিয়া, (তাহারা) যাহাদের প্রশস্ত লক্ষণ ও আচরণ দৃষ্ট হয়, তেমন হস্তিসমূহকে ধরিবে। কারণ, রাজাদিগের বিজয়লাভে হস্তীই প্রধান সাধন। যে-হেতু প্রকাণ্ড শরীরধারী ও প্রাণহরণ-কৰ্ম্মে পটু হস্তীরাই শত্রুর সেনা-বৃহ, দুর্গ ও স্কন্ধাবার (সেনানিবেশ বা রাজধানীর) ধ্বংস-সাধনে সমর্থ হয়।

হস্তিসমূহের মধ্যে কলিঙ্গ ও অঙ্গ দেশের হস্তী এবং পূর্ব্বদেশীয় ও চেদি এবং করুশ দেশে উৎপন্ন হস্তাই উত্তম শ্রেণীর হস্তী। দশার্ণ ও অপুরান্ত ব্য পশ্চিমদেশের হস্তী মধ্যম শ্রেণীর হস্তী ॥ ১।

সুরাষ্ট্র ও পঞ্চনদ (“পাঞ্চজনা’ পাঠও দৃষ্ট হয়-‘পঞ্চজনদেশীয় ইহাই অর্থ) দেশের হস্তীকে অধম শ্রেণীর হস্তী বলিয়া ধরা হয়। কিন্তু, এই সব (তিন শ্রেণীর) হস্তীরই বীৰ্য্য, বেগ ও তেজঃ (শিক্ষা–) কৰ্ম্মদ্বারা বাড়াইয়া কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে ভূমিচ্ছিদ্রবিধান-নামক দ্বিতীয় অধ্যায় (আদি হইতে ২৩ অধ্যায়) সমাপ্ত।

.

তৃতীয় অধ্যায়
২১শ প্রকরণ-দুৰ্গবিধান

(রাজা) চতুর্দিকেই জনপদের প্রান্তভাগে, দৈবকৃত অর্থাৎ স্বাভাবিক বিষমস্থলভূত, যুদ্ধের উপযোগী দুর্গ করাইবেন। এই দুর্গ চারি প্রকারের হইতে পারে–(১) ঔদক দুৰ্গ, (২) পার্বত দুৰ্গ, (৩) ধান্ধন দুর্গ ও (8) বন দুৰ্গ। তন্মধ্যে ঔদক দুৰ্গ আবার দুই প্রকারের হইতে পারে; যে দুর্গের চারিদিকেই (নদী প্রভৃতির) জল ইহাকে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে-ইহা প্রথম প্রকার এবং যে দুর্গের স্থলভাগ চতুদিকে নিম্ন বা গভীর জলাশয়াদিদ্বারা অবরুদ্ধ বা বেষ্টিত-ইহা দ্বিতীয় প্রকার। পাৰ্ব্বত দুৰ্গও দুই প্রকার হইতে পারে;-যে দুর্গ পৰ্বত-প্রস্তরময়,-ইহা এক প্রকার এবং যে দুর্গ স্বাভাবিক-গুহাত্মক-ইহা দ্বিতীয় প্রকার। ধন্বন দুৰ্গও দুই প্রকার হইতে পারে;-যে দুর্গ জল ও তৃণরহিত–ইহা এক প্রকার এবং যে দুর্গ উষর বা বালুকাদিযুক্ত স্থানবিশেষ-ইহা দ্বিতীয় প্রকার। বনদুৰ্গও দুই প্রকার হইতে পারে, যে দুৰ্গ চতুর্দিকে পঙ্কযুক্ত জল থাকায় গতিবৈক্লব্য ঘটায়-ইহা এক প্রকার এবং যে দুৰ্গ ঘন স্বল্পদ্রুমবিশিষ্ট হওয়ায় দুস্তপ্রবেশ্য-ইহা দ্বিতীয় প্রকার। এই সব দুর্গের মধ্যে, নদীদুর্গ ও পর্বতদুর্গ (বিপদকালে) জনপদের রক্ষাস্থান হইতে পারে এবং ধাম্বনদুর্গ ও বনদূর্গ আটবিকদিগের (রক্ষা) স্থান হইতে পারে; অথবা, আপদের সময়ে ইহা (রাজা) অপসরণের বা পলাইয়া যাইবার আশ্বয়স্থান হইতে পারে।

জনপদের মধ্যপ্রদেশে রাজা স্থানীয় (আট শত গ্রাম-মধ্যস্থ নগরবিশেষ) নিবেশিত করাইবেন। এই স্থানীয় নগর রাজার সমুদয় অর্থাৎ রাজকোষে প্রবেশ্য ধনরাশির স্থান (এই প্রসঙ্গে আধুনিক Collectorate স্মরণীয় হইতে পারে) বলিয়া গণ্য। ইহাকে বাস্তুবিদ্যায় অভিজ্ঞ জনের নির্দ্দিষ্ট দেশে, কিংবা কোন কোন নদীর সঙ্গমস্থলে, অথবা, সদানীর কোন হ্রদ, সরোবর বা (পদ্মাকরাদি) তাড়াগের অঙ্গদেশে নিবেশিত করিতে হইবে; বাস্তুস্থিতিবশতঃ ইহা বৃত্ত বা গোলাকার, দীর্ঘাকার বা চতুরাশ্র অর্থাৎ চৌকির হইতে পারে; ইহার চতুস্পার্শে জলপ্রবাহ বহিতে থাকা আবশ্যক; ইহা এক প্রকার পত্তন বলিয়া বিবেচিত হইবে, অর্থাৎ ইহা চতুর্দিক হইতে উৎপন্ন পণ্যসমূহের সংগ্রহ ও ক্রয়বিক্রয়ের কেন্দ্র হইবে, এবং ইহা স্থলপথ ও জলপথের সহিত যুক্ত থাকিবে।

 (রাজা এই স্থানীয়ের) চতুদিকে তিনটি পরিখা বা খাত পরস্পরের মধ্যে এক দণ্ড অর্থাৎ ৪ হস্তপরিমিত ভূমি (২য় অধিকরণে ২য় অধ্যায় দ্রষ্টব্য) ব্যবধান রাখিয়া নিৰ্ম্মাণ করাইবেন। এই তিনটি পরিখা ক্রমান্বয়ে চতুর্দশ দণ্ড (অর্থাৎ ৫৬ হস্ত), দ্বাদশ দণ্ড (অর্থাৎ ৪৮ হস্ত) ও দশ দণ্ড (অর্থাৎ ৪০ হস্ত) বিস্তারযুক্ত অর্থাৎ চওড়া থাকিবে; ইহাদের গভীরতা বা নিম্নতা বিস্তারের পরিমাণ হইতে একপাদ (একচতুর্থাংশ) কম বা বিস্তারের অৰ্দ্ধপরিমিত থাকিবে, অথবা ইহারা বিস্তারের একতৃতীয়াংশ পরিমাণে গভীর থাকিবো; মূল বা তলদেশে ইহারা চতুরাশ্র বা সম্যক বন্ধ থাকিবে এবং পাষাণ দ্বারা রচিত থাকিবে; অথবা, ইহাদের পার্শ্বগুলি পাষাণ বা ইষ্টক দ্বারা আবদ্ধ থাকিবে; ইহার নীচে জলোদয়দেশ পৰ্য্যন্ত খাত হইবে, অথবা, (নদী প্রভৃতি হইতে) আগন্তুক জলদ্বারা পূর্ণ থাকিবে; ইহাদের জলনিৰ্গমনের পথও থাকিবে; এবং এগুলিতে পদ্ম ও নক্ৰাদি জলচর জীবও থাকিবে।

(রাজা) খাত হইতে উদ্ধৃত মৃত্তিকা দ্বারা বিপ্র বা মৃচ্চয় নিৰ্ম্মাণ করাইবেন। ইহা পরিখা হইতে চারি দণ্ড অর্থাৎ ১৬ হস্ত ব্যবধানে থাকিবে। ইহার উচ্ছায় বা উচ্চতা ছয় দণ্ড বা ২৪ হস্তপরিমিত থাকিবে; ইহা (নীচে) দৃঢ়ভাবে সংরুদ্ধ থাকিবে (অর্থাৎ যেন মৃত্তিক গলিয়া না পড়ে); উচ্চতার দ্বিগুণ ইহার বিষ্কম্ভ বা বিস্তার থাকিবে। ইহার তিন প্রকার ভেদ হইতে পারে, যথা (১) উৰ্দ্ধচয় বপ্র অৰ্থাৎ যে বিপ্র নীচের দিকে স্থূল বা মোটা ও উপর দিকে কৃশাকার, (২) মঞ্চপৃষ্ঠ বপ্র অৰ্থাৎ ষে বিপ্র নীচে ও উপরে সমানভাবে বিপুল, এবং (৩) কুম্ভকুক্ষিক ব্যপ্র অর্থাৎ যে ব্যপ্র নীচে ও উপরে কৃশ, কিন্তু, মধ্যস্থলে কুম্ভের ন্যায়। স্কুল। এই বিপ্র হস্তী ও গো-দ্বারা ক্ষুন্ন বা প্রহত করাইয়া দৃঢ় করিতে•হইবে ঐবং ইহাকে কণ্টকী গুল্ম ও বিষলতা প্রতানযুক্ত করিতে হইবে। (বপ্র নিৰ্ম্মাণের পরও যদি) মৃত্তিক অবশিষ্ট থাকে। তদ্দ্বারা (তিনি) বাস্তুগৰ্ভসমূহ পূরিত করাইবেন।

রাজা বগ্রেপ্রার উপর প্রাকার নিৰ্ম্মাণ করাইবেন। ইহার উৎসেধ বা উচ্চতা ইহার নিজের বিষ্কম্ভ বা বিস্তারের দ্বিগুণ হইবে; ইহা ইষ্টক-নিৰ্ম্মিত হইবে এবং ইহার উৎসোধের মান বার হস্তের উৰ্দ্ধে (১৩-১৫ হস্ত ইত্যাদি) বিষম সংখ্যক, অথবা, (১৪-১৬ হস্ত ইত্যাদি) সমসংখ্যক হস্তপরিমিত হইতে পারে; কিন্তু, ২৪ হস্তপরিমিত উচ্চতাই ইহার অবধি অর্থাৎ ২৪ হস্তের অধিক ইহার উচ্চতা থাকিবে না। অথবা, (তিনি) এই প্ৰাকার (ইষ্টকময় না করাইয়া) শৈল বা শিলাময় করাইবেন; এবং (ইহার বিস্তার এতটা পরিমাণে থাকিবে যেন।) ইহার উপর একখানি রথে চড়িয়া একটি রখী, গতাগতি করিতে পারে; ইহার অগ্রভাগ তালবৃক্ষের মূলের প্রতিকৃতি, মুরজ বা মৃদঙ্গর প্রতিকৃতি ও কপিশীর্ষের প্রতিকৃতি দ্বারা সমন্বিত থাকিবে; অথবা, ইহা বিপুল শিলাদ্বারা বদ্ধ থাকিবে। ইহাকে কখনও কাষ্ঠনিৰ্ম্মিত করিতে হইবে না; কারণ, ইহাতে অগ্নি সতত সন্নিহিত থাকিয়া বাস করে।

(প্ৰাকারের উপর) অট্টালিক নিৰ্ম্মাণ করাইবেন,-ইহা বিস্তারের অনুরূপ চতুরাশ্র হইবে অর্থাৎ ইহার আয়াম ও উৎসেধ (উচ্চতা) বিস্তারের সমপরিমিত থাকিবে; এবং ইহার উচ্চতার অনুরূপ মাপে ইহাতে এমন সোপান থাকিবে যাহা সরাইয়া নেওয়া চলে। এইরূপ আটালক একে অন্য হইতে ত্রিশ দণ্ড (বা ১২০ হাত) ব্যবধানে থাকিবে।

এইরূপ দুইটি অট্টালকের মধ্যে (তিনি) এমন প্রতোলী বা রথ্যা (পথ) নিৰ্ম্মাণ করাইবেন, যাহা হৰ্ম্ম্যের (ধবলগৃহের) দ্বিতলযুক্ত থাকিবে এবং যাহার দৈর্ঘ্য বিস্তারের দেড় গুণ হইবে।

অট্টালিক ও প্রতোলীর মধ্যে (তিনি) ইন্দ্রকোশ-নামক এক আসন প্রস্তুত করাইবেন। ইহা তিন জন ধানুষ্ক বা ধনুর্ধারী পুরুষের অবস্থান-বিষয়ে পৰ্য্যাপ্ত হওয়া চাই এবং ইহা এমন একটি কাষ্ঠফলকযুক্ত থাকিবে, যাহাতে (ধানুষ্কদিগকে) লুক্কায়িত রাখিবার সাধনবিশিষ্ট ছিদ্রসকল থাকিবে, অর্থাৎ যাহার পৃষ্ঠভাগে ধানুষ্কের লুক্কায়িত থাকিয়া ছিদ্রদ্বারা সম্মুখের আগন্তুকদিগকে দেখিয়া বাণাদি নিক্ষেপ করিতে পারিবে।

প্রাকারের সঙ্গে সঙ্গে, (অটুলক, প্রতোলী ও ইন্দ্রকোশের) অন্তরালে দুই হওঁ বিস্তারুমুক্ত এবং (প্ৰাকারের) পার্থে ইহার চতুগুণ আয়াম বা দৈর্ঘ্যযুক্ত অর্থাৎ আট হাত পরিমিত (“অষ্টহস্তায়তং” পাঠটি পুনরুক্ত বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে) এক একটি দেবপথ–নামক (গুপ্ত) পথ (তিনি) নিৰ্ম্মাণ করাইবেন।

এক দণ্ড বা চারি হাত, অথবা, দুই দণ্ড বা আট হাত বিস্তৃত চাৰ্য্যা বা সঞ্চারণপথ (তিনি) নিৰ্ম্মাণ করাইবেন এবং (তিনি) বাহির হইতে দর্শনের অতীত প্রদেশে, প্রথাবিতিক অর্থাৎ বাহির হইতে শক্রপ্ৰেক্ষিপ্ত বাণাদির গোচর হইতে রক্ষা পাইবার জন্য কৃত ক্ষুদ্র আবরণ বা প্ৰাচীর (?) বা পথবিশেষ, এবং নিস্কুহ দ্বার অর্থাৎ প্রাকারের বহিভূত প্রতিপক্ষের সর্বকাৰ্য্য দর্শনের উপযোগী কোটরের বিবর। নিৰ্ম্মাণ করাইবেন।

 (পরিখার) বহির্ভাগে (তিনি দুৰ্গমধ্যে প্রবেশের) পথ নিম্নলিখিত বস্তুদ্বারা ছন্ন রাখিবার ব্যবস্থা করাইবেন-জানুভঞ্জনী-নামক যন্ত্বকীল-বিশেষ) অর্থাৎ যে কীল মাটিতে জানু পৰ্য্যন্ত উচ্চ করিয়া প্রোথিত রাখিলে আগন্তুকদিগের জানুপ্রদেশে তাড়ন সম্ভাবিত), ত্ৰিশূলসমূহ, কূপ, কুট (লৌহশিলাকাবিশেষ), অবপাত (তৃণাদি দ্বারা আচ্ছাদিত গৰ্ত্ত), কণ্টকপ্রতিসর (লৌহনিৰ্ম্মিত কণ্টকদ্বারা আচিত জালবিশেষ), আহিপূষ্ঠ ও তালপত্রের আকারে আকারিত ত্রিকোটিবিশিষ্ট লৌহযন্ত্রবিশেষ, কুকুরের দন্তসদৃশ লৌহকীলবিশেষ, অর্গল বা লৌহদণ্ড, উপন্ধন্দন (স্বলন সহায়ক কাষ্ঠবিশেষ), পাদুকা (একপাদমাত্র সংপাতে পৰ্যাপ্ত পঙ্কপূরিত গৰ্ত্ত), অম্বরীষ (ভ্ৰাষ্ট্রযন্ত্ব-অৰ্থাৎ অগ্নিযুক্ত সংতপ্ত ভৰ্জনপত্র-সংবলিত গৰ্ত্ত) ও উপাদান (দূষিত জলপূৰ্ণ কুপুষ্করিণী)।

প্ৰাকারের উভয় ভাগে দেড় দণ্ডপরিমিত (অর্থাৎ ৬ হস্তপরিমিত) মণ্ডপ নিৰ্ম্মাণ করিয়া, প্রতোলীর আধারভূত ছয়টি তোরণাস্তম্ভ-যুক্ত দ্বার (তিনি) নিবেশিত করাইবেন। এই দ্বার চতুরাশ্র বা চতুষ্কোণাকার হইবে এবং ইহার বিস্তার পঞ্চ দণ্ড (কুড়ি হাত) হইতে ক্রমশঃ বাড়াইয়া অষ্ট দণ্ড (বত্রিশ হাত) পৰ্য্যন্ত হইতে পারিবে। (কাহারও মতে) ইহার বিস্তার দুই দণ্ড (বা চারি হাত) পরিমিতও হইতে পারে। অথবা, ইহা দৈর্ঘ্যে ইহার আশ্রিত বিস্তারের মান অপেক্ষায় এক ষষ্ঠাংশ বা এক অষ্টমাংশ অধিক হইতে পারে।

(স্তম্ভের) উৎসেধ বা উচ্চতা নীচের তলদেশ হইতে পঞ্চদশ হস্ত হইতে এক এক হস্ত বাড়াইয়া অষ্টাদশ হস্তপরিমিত হইতে পারিবে।

স্তম্ভের পরিক্ষেপ বা পরিধি ইহার লম্বতার এক ষষ্ঠাংশ হওয়া চাই; ইহার (পরিক্ষেপ-মানের) দ্বিগুণ অংশ অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশ (মুক্তিকার নীচি।) নিখাত থাকিবে এবং ইহার চুলিকা বা স্তম্ভ-শিখার মান হইবে (পরিক্ষেপের) এক চতুর্থাংশ।

প্রতোলীর তিন তলের মধ্যে প্রথম তলটিকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করিয়া, সেই ভাগগুলিতে একটি শালা, একটি ব্যাপী, ও একটি সীমাংগৃহ প্রস্তুত করাইতে হইবে। (শালাপ্ৰান্তে) ইহার দশমাংশবিস্তার-যুক্ত দুইটি প্রতিমঞ্চ (মঞ্চপ্রতিকৃতি সন্নিবেশ-বিশেষ) মত্ত বারণযুক্ত (অর্থাৎ মত্ত নাগাকৃতি নিযুহি বা ভিত্তিস্থ কীলকবিশেষ-যুক্ত করাইয়া) নিৰ্ম্মাণ করাইতে হইবে। (শালা ও সীমাগুহের) অন্তরালে আণি বা ক্ষুদ্র দ্বার নিবেশিত হইবে (মণ্ডপের কোণকেও আণি বলা হয়।)। দুৰ্ম্ম্য বা উপরিতলের চন্দ্রশালা-নামক গৃহ, প্রথম তলের উৎসেধ বা উচ্চতার অৰ্দ্ধপরিমাণ উৎসোধযুক্ত থাকিবে এবং ইহাতে স্থণা বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্তম্ভ আবদ্ধ থাকিবে? (“আণিহর্ম্যং’-এইরূপ সমস্ত পাঠ থাকিলে, “সীমাংগৃহ’। অর্থ হইবে)। উত্তমাগার অর্থাৎ তৃতীয় তলটি দেড় দণ্ডপরিমিত হইবে (একবাস্তু তিন দণ্ডপরিমিত; অতএব, ইহা অৰ্দ্ধবাস্তুক হইবে অর্থাৎ ইহার পরিমাণ দেড় দণ্ড অর্থাৎ ছয় হস্ত হইবে)। অথবা, ইহা (পঞ্চ দণ্ড চতুরাশ্র দ্বারের) এক তৃতীয়াংশ পরিমাণ হইবে। (এই উত্তমাগারটির) পার্শ্বগুলি ইষ্টকাবদ্ধ থাকিবে; ইহার বাম দিকে প্রদক্ষিণভাবে আগমনের উপযোগী সোপান থাকিবে; এবং অপর দিকে (অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে) ভিত্তিতে প্রোথিত গঢ় সোপান থাকিবে।

তোরণের শিরোদেশ দুই হস্তপরিমিত হইবে। তিন বা পাঁচ ভাগযুক্ত দুইটি কবাট থাকিবে। (কিবাটদ্রয় বন্ধ করিবার জন্য) দুই দুইটি পরিঘ বা অৰ্গল থাকিবে। কবাটের ইন্দ্রকীল বা প্রধান কীলকটি এক অরত্বি বা এক হস্ত (= ২৪ অঙ্গুলি পরিমাণ)-পরিমিত হইবে। (কবাটের মধ্যে) একটি পঞ্চ হস্তপরিমিত আণিদ্বার বা ক্ষুদ্র দ্বারবিশেষ থাকিবে। সমগ্র দ্বারটি এত বড় হইবে, যেন ইহার ভিতর দিয়া চারিটি হস্তী একসঙ্গে প্রবেশ করিতে পারে। (চারিটি গজার্গিল থাকিবে-ইহা হইতে লক্ষণা দ্বারা উক্তরূপ অনুবাদ করা হইয়াছে)।

(দ্বার-) সন্নিবেশের অৰ্দ্ধমানযুক্ত (অর্থাৎ আড়াই দণ্ড উৎসেধযুক্ত) এবং দ্বারের সমান বিস্তারযুক্ত হস্তিনখ-নামক ক্রমনিয় মৃত্তিকাকুট (দুর্গ হইতে অবতরণার্থ) স্থাপিত থাকিবে। (দুর্গের) সংক্রম বা সঞ্চারণপথ স্থির বা দৃঢ়ভাবে (দারুপ্রভৃতি দ্বারা) নিৰ্ম্মিত থাকিবে, কিংবা নিরুদক স্থানে ইহা মুক্তিকানিৰ্ম্মিভও হইতে পারে।

(রাজা) প্ৰাকারের তুল্য মানবিশিষ্ট মুখ বা নিঃসরণমার্গ পরিকল্পনা করিয়া, ইহার এক তৃতীয়াংশ গোধার মুখারুতি করিয়া একটি গোপুর বা নগরদ্বার নিৰ্ম্মাণ করাইবেন। প্রাকার-মধ্যে বাপী নিৰ্ম্মাণ করিয়া পুষ্করিণীদ্বার-নামক বাপীর দ্বারা নিৰ্ম্মাণ করাইবেন। পূর্বোক্ত আন্তর বা অবকাশ ও আণি বা ক্ষুদ্র দ্বারের পরিমাণ হইতে দেড়গুণ পরিমাণবিশিষ্ট চতুঃশাল নিৰ্ম্মাণ করিয়া, ইহাতে কুমারীপুর-নামক দ্বার স্থাপিত করিবেন। দ্বিতল মুণ্ডহৰ্ম্ম্য (সম্ভবতঃ শৃঙ্গ রহিত হৰ্ম্ম্য) নিৰ্ম্মাণ করিয়া ইহাতে মুণ্ডকদ্বার-নামক দ্বার স্থাপিত করিবেন। অথবা, নিজ ভূমি ও দ্রব্যসম্পৎ বুঝিয়া (তিনি) যথোক্ত দ্বারগুলির ষে কোনটি নিৰ্ম্মাণ করাইতে পারেন। (তিনি) স্ববিস্তারমানের তৃতীয়াংশাধিক দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট ভাণ্ড বা উৎপন্ন দ্রব্যাদির বাহনোপযোগী কুল্য বা পয়ঃপ্রণালী নিবেশিত করাইবেন।

এই সব কুল্যাতে পাষাণ, কুদাল, কুঠার, কাণ্ড (বাণ), কল্পনা (গজোপকরণাদি), মুহূষ্ঠি বা লৌহমুখ দারুময় গদাবিশেষ (ভুণ্ডণ্ডী পাঠেও শাস্ত্রবিশেষ), মুদগর, দণ্ড, চক্র, যন্ত্র ও শতন্ত্রি (আয়ুধবিশেষ) এবং লৌহকারের শিল্পীসাধ্য দ্রব্যসমূহ, শূল, বোধনকারী অগ্রবিশিষ্ট বেণু, উষ্টিগ্রীবাকৃতি শস্ত্রবিশেষ ও যে-সব আয়ুধে শক্রদাহের জন্য অগ্নি সংযুক্ত থাকে। সেই প্রকার আয়ুধসমূহ নিবেশিত রাখা হইবে; এবং কুপ্যাধ্যক্ষ-প্রকরণে যে-সব বস্তুর বিধান করা হইয়াছে, সে-সব বস্তুও সেখানে (তিনি) নিবেশিত করাইবেন ॥ ১-২।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার নামক দ্বিতীয় অধিকরণে দুর্গবিধাননামক তৃতীয় অধ্যায় (আদি হইতে ২৪ অধ্যায়।) সমাপ্ত।

.

চতুর্থ অধ্যায়
২২শ প্রকরণ–দুর্গনিবেশ

(দুর্গের) বাস্তুবিভাগ। এইভাবে করিতে হইবে, যথা-ইহাতে তিনটি রাজমাৰ্গ পূর্ব্ব-পশ্চিমে আয়ত, ও তিনটি রাজমার্গ উত্তর-দক্ষিণে আয়ত থাকিবে। এই বাস্তু-বিভাগ দ্বাদশ দ্বারযুক্ত হইবে (প্রত্যেক রাজপথের দুইটি প্রান্তে দুইটি করিয়া দ্বার হইলে, উক্ত ছয়টি রাজমার্গের মোট বারটি দ্বার হইবে) এবং ইহাতে (বাস্তুশাস্ত্রের বিস্তারানুরূপ) উচিত জলপথ, ভূমিপথ ও (গূঢ়-সুরঙ্গাদিময়), গুপ্ত পথ থাকিবে।

(ইহাতে) চারি দণ্ড-পরিমিত বিস্তারযুক্ত রথ্যাসমূহ (বিশিখানামক পথ) থাকিবে। রাজমাৰ্গ, দ্রোণমুখে যাওয়ার পথ, স্থানীয়ে যাওয়ার পথ, রাষ্ট্র বা জনপদে যাওয়ার পথ ও বিবীতে যাওয়ার পথ এবং সংযোনীয়ে (ক্রয়বিক্রয়ব্যবহারের প্রধান স্থান অর্থাৎ বড় বড় বাজারে) যাওয়ার পথ, বৃহপথ (শত্ৰুসমাগমে সৈন্য বাহির করিয়া নেওয়ার পথ), শ্মশানে যাওয়ার পথ ও গ্রামে প্রবেশের পথগুলি আট দণ্ডপরিমিত বিস্তারযুক্ত হইবে। সেতুপথ ও বনপথ চারি দণ্ডপরিমিত বিস্তারযুক্ত হইবে। হস্তিপথ ও ক্ষেত্রপথ দ্বিদণ্ডপরিমিত বিস্তারযুক্ত হইবে। রথপথ পাঁচ অরতিপরিমিত, (গোমহিষাদি–) পশুপথ চারি অরস্ট্রিপরিমিত এবং (মেষাদি-) ক্ষুদ্র পশুপথ ও মনুষ্যপথ দুই অরস্ট্রিপরিমিত বিস্তারযুক্ত হইবে।

(ব্রাহ্মণাদি) চারি বর্ণের উপজীবিকার উপযোগী অত্যুত্তম বাস্তুতে রাজনিবেশ বা রাজবাড়ী স্থাপিত করিতে হইবে। বাস্তুহৃদয় দেশ অর্থাৎ বাস্তুর মধ্যদেশ হইতে উত্তরদিন্বত্তী নবমভাগে (নিশান্ত প্রণিধি প্রকরণে) উক্ত বিধানানুসারে পূর্ব্বমুখী বা উত্তরমুখী অন্তঃপুর নিৰ্ম্মাণ করাইতে হইবে। ইহার (রাজনিবেশের) পূর্বোত্তর ভাগে আচাৰ্য্য ও পুরোহিতের এবং (তীহাদের) যজ্ঞ ও জলের স্থান থাকিবে, এবং মন্ত্রিগণও সেখানে বাস করিবেন। (ইহার) পূর্ব্ব-দক্ষিণভাগে মহানস (রন্ধনশালা), হস্তিশালা ও কোষাগার থাকিবে। তাহার পর, পূর্ব্বদিকে গন্ধপণ্য, মাল্যপণ্য, ধান্যপণ্য, ও (ঘৃতাদি) রসপণ্যের (দোকান-গৃহ থাকিবে), এবং প্রধান কারু বা শিল্পীরা ও ক্ষত্ৰিয়ের বাস করিবে। দক্ষিণ-পূর্ব্বদিকে ভাণ্ডাগার, অক্ষাপটল (গাণনিকদিগের দলিল ও নিবন্ধপুস্তকাদি রাখিবার স্থান) ও কৰ্ম্মনিষদ্যা (সুবৰ্ণরাজতান্দির শিল্পকৰ্ম্মের আপণ বা ক্রয়বিক্রয়ার্থ বস্তুশালা) থাকিবে। দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগে কুপ্যগৃহ ও আয়ুধাগার থাকিবে। তাহার পর, দক্ষিণ দিকে নগর-ব্যবহারিক, ধান্যব্যবহারিক, কাৰ্ম্মান্তিক (খনিপ্রভৃতির কৰ্ম্মান্তে অধিকৃত পুরুষ) ও বলাধ্যক্ষ (সেনাধ্যক্ষ) এবং পক্কান্নপণ্যবিক্রয়ী, সুরাপণ্যবিক্রয়ী, ও মাংসপিণ্যবিক্রয়ী এবং পাজীব (বেশ্যা), তালাবাচর (তালে তালে নৃত্যকারী নটবিশেষ) ও বৈশ্যেরা থাকিবে। পশ্চিম-দক্ষিণ ভাগে খাঁর বা গর্দভ ও উষ্টদিগের গুপ্তিস্থান বা বাঁধিয়া রাখার স্থান ও (ইহাদের ক্রয়-বিক্রয়সম্বন্ধী) কৰ্ম্মের স্থান থাকিবে। পশ্চিমউত্তর ভাগে যান বা শকটাদির শালা ও রথশালা থাকিবে। তাহার পর, পশ্চিমদিকে উর্ণাকারু (পশমী দ্রব্যের শিল্পী), সুত্রকারু (কাপাস সূত্রের তন্তুবায়), বেণুকারু (বেতের শিল্পী), চৰ্ম্মকারু (চামড়ার শিল্পী), বৰ্ম্মকারু (কবচাদি-নিৰ্ম্মাতা) ও শস্ত্রাবরণকারু এবং শূদ্রেরা বাস করিবে। উত্তর-পশ্চিমভাগে পণ্যগৃহ (রাজকীয় পণ্যবস্তুর ঘর) ও ভৈষজ্যগৃহ থাকিবো। উত্তর-পূর্ব্বভাগে কোষ এবং গো ও অশ্ব থাকিবে। তাহার পর, উত্তর দিকে নগরদেবতা ও রাজকুলের দেবতা, লৌহকার ও মণিকার এবং ব্রাহ্মণের বাস করিবে। বাস্তুচ্ছিদ্রের অবকাশসমূহে (বাস্তুর অন্তরালের অবশিষ্ট স্থানসমূহে) শ্রেণী (রাজকাদি বর্গ) ও প্রবাহণিকেরা বা স্কন্ধবাহ শিবিকাদি বাহীরা থাকিবে।

পুরমধ্যে অপরাজিতা (দুর্গা), অপ্রতিহত (বিষ্ণু?), জয়ন্ত ও বৈজয়ন্তের (ইন্দ্রের) কোষ্ঠক (অন্তগুহ), এবং শিব, বৈশ্রবণ (কুবের), অশ্বিনীকুমারদ্রয়, শ্ৰী বা লক্ষ্মী ও মন্দির-দেবতার (দুর্গার নামবিশেষ) গৃহ থাকিবে। পূর্বোক্ত কোষ্ঠক ও আলয়সমূহে তৎ তৎ দেশে প্রচলিত বাস্তুদেবতাসমূহ স্থাপিত করিতে হইবে। পুরের চারি দিকে উত্তরাদিক্রমে ব্ৰাহ্মস্থার (ব্রহ্মের কিংবা ব্রহ্মার সম্বন্ধীয় দ্বার), ঐন্দ্রদ্বার (ইন্দ্রসম্বন্ধীয় দ্বার), যাম্যদ্বার (যমসম্বন্ধীয় দ্বার) ও সৈনাপত্যদ্বার (সেনাপতি বা কাত্তিকেয়সম্বন্ধীয় দ্বার) সন্নিবিষ্ট থাকিবে। পরিখার বাহিরে ধনুঃশত বা দণ্ডশত ব্যবধান-যুক্ত চৈত্য, পুণ্যস্থান, বন ও সেতুবন্ধ স্থাপন করিতে হইবে; এবং দিগনুসারে (স্ব-স্ব) দিগদেবতা স্থাপিত হইবেন।

(পুরের) উত্তরে বা পূর্বে শ্মশানবাট অবস্থিত থাকিবে, এবং দক্ষিণে উত্তমবর্ণের (ব্রাহ্মণের) শ্মশানবাট থাকিবে। এই বাটের ব্যবহার সম্বন্ধে অতিক্রম ঘটিলে (অপরাধীর প্রতি) প্রথম সাহস দণ্ড বিহিত হইবে।

পাষণ্ড (কাপালিকাদি বিধাৰ্ম্মিসম্প্রদায়)-ভুক্ত লোক ও চণ্ডালদিগের বাসস্থান শ্মশানসমীপে সন্নিবিষ্ট থাকিবে।

কুটুম্বীদিগের (বা সাধারণ গৃহপতিদিগের) কৰ্ম্মান্ত (কারখানা) ও ক্ষেত্রের পরিমাণানুসারে তাহাদের (ভূমি–) সীমা স্থাপন করিতে হইবে। কৰ্ম্মান্তক্ষেত্রসমূহে তাহাদিগকে পুষ্পবাট (ফুলের বাগান), ফলবাট (ফলের বাগান), ষণ্ড (পদ্মাদির সংঘাত) ও (শাকাদির) কেদারভূমি এবং ধান্য ও (অন্যান্য) গণ্য রাজপুরুষদিগের অনুজ্ঞা বা অনুমতি লইয়া স্থাপন করিতে হইবে এবং দশকুলপরিমিত ভূমিবাটের প্রয়োজনে এক একটি কূপও স্থাপন করিতে হইবে (মধ্যম হলদ্রয়দ্বারা কর্ষণীয় ভূমিখণ্ডকে একটি ‘কুল’ বলা হয়; মতান্তরে, দশটি গরুদ্বারা কৃষ্য ভূমিকেও ‘কুল’ বলা হয়)।

অনেক বর্ষ পৰ্য্যন্ত উপভোগের যোগ্য সর্বপ্রকার স্নেহ (তৈলাদি), ধান্য (গুড়াদি), ক্ষার, লবণ, ভৈষজ্য, শুষ্ক শাক, যবস (ঘাসাদি), বল্পর (শুষ্ক মাংস); তৃণ, কাঠ (ইন্ধন), লোহ, চৰ্ম্ম, অঙ্গার (কয়লা), স্নায়ু, বিষ, বিষাণ (শৃঙ্গ), বেণু১ বঙ্কল, সারদারু (মজবুত কাষ্ঠাদি), প্রহরণ (অস্ত্ৰাদি), আবরণ (কবচ), ও প্রস্তরসমূহ (পুরমধ্যে) নিচিত বা সংগৃহীত রাখিতে হইবে। এই সব দ্রব্য নূতন পাইলে, তদ্দ্বারা পুরাতনগুলিকে শোধিত করিতে হইবে, অর্থাৎ নৃতন দ্রব্য পাইলে পুরাতন দ্রব্য খরচ করিয়া তৎস্থলে নূতন দ্রব্য নিচিত রাখিতে হইবে।

(পুরমধ্যে) হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিক সেনাকে অনেক মুখ্য বা প্রধানদিগের অধীন করিয়া রাখিতে হইবে। কারণ, বল বা সেনা বহুমুখ্যের অধীন হইলে, পরস্পরের ভয়াবশতঃ শত্রুর উপজাপে পতিত হইতে পারে না (সেনা এক নায়কের অধীন হইলে, সেই নায়ক লোভদিবশতঃ, অন্য নায়কের অভাবে, শক্রর উপজাপে পতিত হইয়া স্বসেনাকে শত্রুর ভেদ্য করিয়া তুলিতে পারেন)।

ইহা দ্বারা অন্তপালদিগেরও দুগসংস্কার ব্যাখ্যাত হইল, বুঝিতে হইবে। (। পুরমধ্যে রাজা কখনও) বাহিরিকদিগকে (অর্থাৎ কিতব, বঞ্চক, নট, নৰ্ত্তকাদিকে) বসাইবেন না, কারণ, তাহারা পুরের ও রাষ্ট্র বা জনপদের উপঘাতক বা কাৰ্য্যনাশক। (যদি বসাইতেই হয়, তাহা হইলে তিনি তাহাদিগকে) জনপদের সীমাদেশে বসাইবেন এবং অন্য সকলের ন্যায় তাহাদিগকেও কর দিতে বাধ্য করাইবেন। ১।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষ প্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে দুৰ্গনিবেশ নামক চতুর্থ অধ্যায় (আদি হইতে ২৫ অধ্যায়) সমাপ্ত।

.

পঞ্চম অধ্যায়
২৩শ প্রকরণ-সন্নিধাতার নিচয়কৰ্ম্ম

সন্নিধাতা (যে উচ্চপদবিক “রাজপুরুষ রাজকোষাদির সম্যগতভাবে নিধানকারী, অর্থাৎ যিনি সে সমস্তের সংগ্রহ ও রক্ষণকাৰ্য্যে ব্যাপৃত) কোষাগৃহ (সুবৰ্ণরত্নাদির নিচয়স্থান), পণ্যগৃহ (রাজকীয় পণ্য বা বিক্ৰেয় দ্রব্যাদির নিচয়স্থান), কোষ্ঠাগার (ধ্যান্যাদি খাদ্যদ্রব্যের নিচয়স্থান), কুপ্যগৃহ (সারদারু প্রভৃতি দ্রব্যের নিচয়স্থান), আয়ুস্থাগার (অন্ত্রশস্ত্রাদির নিচয়স্থান) ও বন্ধনাগার (কারাগুহ) নিৰ্ম্মাণ করাইবেন।

(সম্প্রতি কোষগুহের নিৰ্ম্মাণপ্রকার বলা হইতেছে, যথা-) (সন্নিধাত) চতুরাশ্র (চৌকোণ) একটি ব্যাপী খনন করাইবেন এবং (দেখিবেন যেন) ইহাতে কোন জল ও ক্লেদাদি স্নেহ দ্রব্য না থাকে। এই ব্যাপীর উভয় দিকে ইহার পাশ্বও মূলদেশ বড় বড় শিলাদ্বারা আবদ্ধ করাইয়া তন্মধ্যে একটি ভূমিগৃহ (অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ গৃহ) নিৰ্ম্মাণ করাইবেন। এই ভূমিগৃহ সারদারুময় পঞ্জীরযুক্ত হইবে; ইহার ভূমির অনুরূপ, ইহাতে তিনটি তল থাকিবে; ইহাতে অনেক প্রকার (কোষ্ঠাদির) বিধান থাকিবে; ইহার দেশ (উপরিতল), স্থান (মধ্যম তল ও তল (অধস্তন তল) কুট্টিম (অর্থাৎ দৃঢ়ভাবে উপল ও ইষ্টকাদি দ্বারা নিবন্ধ) থাকিবে; ইহাতে মাত্র একটি দ্বার যুক্ত থাকিবে; ইহার সোপান যন্ত্রযুক্ত (অর্থাৎ যথাসময়ে নিবেশন ও অপসারণের উপযোগী) থাকিবে; এবং দেবতার প্রতিমা “ইহার পিন্ধান বা আচ্ছাদন থাকিবে। (তিনি) এই ভূমিগৃহের উপরিভাগে এক কোষগৃহ নিৰ্ম্মাণ করাইবেন। এই কোষগৃহ বাহিরে ও ভিতরে অর্গলযুক্ত থাকিবে; ইহা প্রগ্ৰীব অর্থাৎ মুখশালা বা বারান্দা-ঘর কিংবা বাতায়নযুক্ত থাকিবে; ইহা ইষ্টকনিৰ্ম্মিত হইবে; ইহা ভাণ্ডবাহিনী অৰ্থাৎ ভাণ্ডপূর্ণ নদীদ্বারা পরিবৃত থাকিবে (কেহ কেহ ভাণ্ডবাহিনীকে দ্রব্যের আধারশালারূপে ব্যাখ্যা করেন)। অথবা, তিনি (কোষগৃহতুল্য) এক প্ৰাসাদ জনপদান্তে অভিত্যক্ত পুরুষদ্বারা (অর্থাৎ যাহারা বাধাদণ্ডে দণ্ডিত হইয়া সমাজত্যক্ত হইয়াছে তাহাদের সাহায্যে) নিৰ্ম্মাণ করাইবেন, যেন ইহা স্থায়ী নিধি বা কোশযুক্ত থাকায়, আপৎকালে সেই নিধি উপযোগে আসিতে পারে।

(তিনি) পাকা ইষ্টকদ্বারা নিৰ্ম্মিত স্তম্ভযুক্ত, চতুঃশাল (অর্থাৎ চতুর্দিকে অন্যোন্যসম্মুখীন শালাযুক্ত), একদ্বারবিশিষ্ট, অনেক কোষ্ঠ ও ভূমিকাযুক্ত ও উভয় পার্থে খোলা স্তম্ভশোভিত অপসার বা অলিন্দযুক্ত পণ্যগৃহ ও কোষ্ঠাগার নিৰ্ম্মাণ করাইবেন। (তিনি) দীর্ঘ ও বহুশালাযুক্ত ও কক্ষ্যদ্বারা আবৃত প্রাচীরযুক্ত কুপ্যগৃহ ভিতরে নির্মাণ করাইবেন। (তিনি) ভূমিগৃহযুক্ত কুপ্যগুহকেই আয়ুস্থাগাররূপে নিৰ্মাণ করাইবেন। এবং (তুিনি) দুৰ্ঘস্থ (ব্যবহার নির্ণয়কারী প্রধান বিচারপুরুষ) ও (অন্যান্য) মহামাত্রগণের (বিচারে দণ্ডনীয় লোকদের জন্য) পৃথক পৃথক বন্ধনাগার। নিৰ্ম্মাণ করাইবেন। এই বন্ধনাগারে বাসকারী স্ত্রী ও পুরুষগণের জন্য বিভিন্ন স্থান থাকিবে, এবং অপসার (অর্থাৎ অলিন্দ) হইতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত কক্ষ্যাগুলি সুরক্ষিত থাকিবে।

এই সব (কোষগৃহাদির) জন্য, শালা, খাত (পরিখা) ও উদপানের (কুপের) ন্যায়, স্নানগৃহ, অগ্নিত্ৰাণ, বিষত্রাণ (১ম অধিকরণের প্রণিধিপ্রকরণোক্ত বিধি দ্রষ্টব্য) মার্জার ও নকুলের ব্যবস্থা ও অন্যান্য আরক্ষা (রক্ষিপুরুষ দ্বারা রক্ষার ব্যবস্থা করাইবেন, এবং এই সব ব্যবস্থা তৎ তাৎ স্থানের নিজ নিজ দেবতার পূজাবিধান-সহকারে নিম্পন্ন করাইবেন।

কোষ্ঠাগারে বৃষ্টির পরিমাণ মাপার জন্য এক অরত্নিপরিমিত মুখবিশিষ্ট একটি কুণ্ড (গৰ্ত্ত) স্থাপিত করিতে হইবে।

(সন্নিধাতা) তৎ তৎ দ্রব্যসমূহের ব্যবহারীদিগের বংশে উৎপন্ন করণ বা কৰ্ম্মকরদিগের সহায়তা লইয়া, পুরাতন ও নূতন অবস্থা বিবেচনা করিয়া, রত্নদ্রব্য, (চন্দনাদি) সারদ্রব্য, (বস্ত্ৰাদি) ফন্তুদ্রব্য, বা (দারুচৰ্ম্মাদি) কুপ্যদ্রব্যসমূহ সংগ্রহ করিবেন। যদি কেহ (রাজকোষে) রত্নাদিবিষয়ে নকল রত্ন দিয়া বা দেওয়াইয়া বঞ্চনা করে, তাহা হইলে তাহার উপর উত্তম সাহস দণ্ড প্রযুক্ত হইবে। সারদ্রব্য সম্বন্ধে এইরূপ বঞ্চনায় তাহার উপর মধ্যম সাহস দণ্ড প্রযুক্ত হইবে, এবং ফন্তু দ্রব্য ও কুপ্যদ্রব্য সম্বন্ধে এইরূপ বঞ্চনায় তাহার উপর সেই দ্রব্য (অর্থাৎ তজজাতীয় একটি দ্রব্যপ্রদানরূপ দণ্ড) ও ইহার মূল্যের সমান অর্থদণ্ড প্রযুক্ত হইবে।

রূপদৰ্শক দ্বারা (অর্থাৎ মুদ্রা।পরীক্ষক দ্বারা) হিরণ্যের (অর্থাৎ প্রচলিত মুদ্রার) শুদ্ধতা পরিজ্ঞাত হইয়া, (সন্নিধাতা) তাহা (রাজকোষের জন্য) প্রতিগ্রহ করিবেন; অশুদ্ধ (অর্থাৎ কুট বলিয়। নির্ণীত) হইলে সেই মূদ্র তিনি ছেদন করিয়া ফেলিবেন (যেন অন্যে তাহা আর ব্যবহার করিতে না পারে)। (কুটহিরণ্য) যে আহরণ করিবে (অর্থাৎ আনিবে), তাহার উপর প্রথম সাহস দণ্ড প্রযুক্ত হইবে।

(তিনি রাজকোষের জন্য) শুদ্ধ, পূর্ণ (ওজনে পুরাপুরি) ও নূতন ধান্যের পরিগ্রহ করিবেন। ইহার অন্যথা বিধান হইলে, (দাতা বা গ্রহীতা রাজপুরুষকে) মূল দেয় ধান্যের দিগুণ দণ্ড দিতে হইবে। ইহা দ্বারা পণ্য, কুপ্য ও আয়ুধ প্রতিগ্রহের নিয়মও ব্যাখ্যাত হইল, বুঝিতে হইবে।

সর্বপ্রকার অধিকরণে অর্থাৎ শাসনবিভাগে কাৰ্য্যকারী যুক্ত (প্রধান অধিকারী), উপযুক্ত (তৎসহায়ক অধিকারী; মতান্তরে, যুক্তগণের উপরিতন কৰ্ম্মচারী) ও তৎপুরুষেরা, (অন্যান্য নিম্ন অধিকারীরা) যদি (দ্রব্যাদি) অপহরণ করে, তাহা হইলে তাহাদের যথাক্রমে এক পণ, দুই পণ ও চারি পণ দণ্ড হইবে, এবং প্রথম অপরাধের পরে বার বার অপহরণ করিলে, তাহাদের উপর ক্রমশঃ প্রথম, মধ্যম ও উত্তম সাহস দণ্ড, (এমন কি, বন্ধদণ্ডও প্রযুক্ত হইতে পারে।)।

কোষাধিষ্ঠিত পুরুষ যদি রাজকোষের অবচ্ছেদ বা ঘাটতি ঘটায়, তাহা হইলে তাহার উপর বন্ধদণ্ড প্রযুক্ত হইবে। তাঁহার (নিম্নস্থ) ব্যাপৃত পুরুষেরা বা পরিচারকেরা যদি সেই অপরাধ করে, তাহা হইলে তাহাদের অর্থদণ্ড প্রযুক্ত হইবে। যদি কোষাবচ্ছেদ রূপ অপরাধ সুষ্ঠুভাবে না জানা যায়, তবে তাহাদিগের উপর কেবল নিন্দাপূর্ব্বক ভর্ৎসনা প্রয়োগ করিলেই চলিবে। চোরেরা যদি সাহসপূর্ব্বক (সন্ধিচ্ছেদাদি দ্বারা রাজার) কোষাদি অপহরণ করে, তাহা হইলে তাহাদিগের উপর বিচিত্র (কষ্টবহুল) বন্ধদণ্ড প্রদত্ত হইবে।

অতএব, সন্নিধাতাকে বিশ্বস্ত পুরুষদিগের সহায়তায় অধিষ্ঠিত থাকিয়া, (কোষাদির) নিচয়কৰ্ম্ম বা সংগ্রহকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিতে হইবে।

(সন্নিধাতা) বাহ! (অর্থাৎ জনপদ হইতে উখিত) ও আভ্যন্তর (অর্থাৎ নগর হইতে উখিত) আয় জানিয়া রাখিবেন; তাঁহাকে একশত বৎসরের অতীত আয় সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিলেও তিনি যেন না ঠেকেন, অর্থাৎ বিনা কষ্টে যেন তাহা বলিতে পারেন; এবং তিনি ব্যয়িত অর্থের অবশিষ্ট অর্থও যেন দেখাইতে সমর্থ হয়েন।৷ ১।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষ প্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে সন্নিধাতার নিচয়কৰ্ম্ম-নামক পঞ্চম অধ্যায় (আদি হইতে ২৬ অধ্যায়।) সমাপ্ত।

.

ষষ্ঠ অধ্যায়
২৪শ প্রকরণ-সমাহৰ্ত্তার সমুদয়প্রবৰ্ত্তন

সমাহৰ্ত্ত (উৎপন্ন আয়ের সমাহরণকারী প্রধান রাজপুরুষ) দুৰ্গ, রাষ্ট্ব, খনি, সেতু, বন, ব্রজ ও বণিকৃপথ পৰ্য্যবেক্ষণ করিবেন (অর্থাৎ এই সাত বিষয় হইতে ধনোৎপত্তিসম্বন্ধে বিবেচনা করিবেন)।

নিম্নলিখিত দ্বাবিংশ উপায় হইতে যে ধনাগম হয়, তাহার নাম দুর্গ শব্দদ্বারা অভিহিত হইয়াছে, যথা—(১) শুদ্ধ, (২) দণ্ড বা জরিমানার অর্থ, (৩) পৌতব (তুল-মানপরিচ্ছেদ), (৪) নাগরিক (বা নগরাধ্যক্ষ)। প্রকরণ হইতে লব্ধ ধন, (৫) লক্ষণাধ্যক্ষ (পাটােয়ায়ী বা কানুনগোর কার্য্যদ্বারা ক্ষেত্রারামাদির লক্ষণ বা সীমানির্দেশ হইতে প্ৰাপ্ত), (৬) মুদ্রাধ্যক্ষ, (৭) সুরাধ্যক্ষ, (৮) সুনাধ্যক্ষ (প্ৰাণিবধের অধ্যক্ষ), (৯) সূত্ৰাধ্যক্ষ, (১০) তৈলবিক্রেতা, (১১) ঘৃতবিক্রেতা, (১২) ক্ষারবিক্রেতা (অর্থাৎ গুড়াদি-বিক্রয়ী), (১৩) সৌবণিক (রাজনিযুক্ত সুবৰ্ণাধিকারী), (১৪) পণ্যসংস্থা (বা পণ্যশালা), (১৫) বেশ্যাধ্যক্ষ (গণিকাধ্যক্ষপ্রকরণ দ্রষ্টব্য), (১৬) দূত (জুয়া খেলা), (১৭) বাস্তুক (গৃহাদি-নিৰ্ম্মাত), (১৮-১৯) কারু ও শিল্পিগণ (অর্থাৎ স্কুল ও সুন্ম শিল্পকারসমূহ), (২০) দেবতাধ্যক্ষ (দেবালয় নিরীক্ষক) ও (২১-২২) দ্বার ও বাহিরিকের আদেয় ধন (অর্থাৎ পুরদ্বারে ও পুরের বাহিরের নটনৰ্ত্তকাদি হইতে আদেয় অর্থ)।

নিম্নলিখিত ত্রয়োদশটি উপায় হইতে যে ধনাগম হয়, তাহার নাম রাষ্টশব্দদ্বারা বলা হইয়াছে, যথা-(১) সীতাধ্যক্ষ (অর্থাৎ কৃষির নিরীক্ষক), (২) ভাগ (ধান্যাদির ষড়ভাগ), (৩) বলি (উপহার বা যাচিত ধন), (৪) করা (ফল ও বৃক্ষাদিসমৃদ্ধ রাজদেয় ধন), (৫) বণিক (বণিকদিগের দেয় ধন), (৬) নদীপাল (নদীর ঘাটরক্ষক দ্বারা প্ৰাপ্য ধন), (৭) তর (নদীপ্রভৃতির খেয়ালব্ধ ধন), (৮) নাবাধ্যক্ষ (৯) পট্টন বা পত্তন (নদীতীরস্থ ছোট ছোট পুর বা নগর), (১০) বিবীতাধ্যক্ষ, (১১) বর্তনী (অন্তপালান্দিলব্ধ পথ করা) (১২) রজ্জু(বিষয়পতিদ্বারা জরিপ বিভাগের প্রাপ্য) ও (১৩) চোররজজু (পরবর্তী কালের চৌরোদ্ধরণিক নামক চৌকিদারী খাজানা)। নিম্নলিখিত দ্বাদশ উপায় হইতে যে ধনাগম হয়, তাহার নাম খনি-শব্দ দ্বারা বলা হইয়াছে, যথা-(১) সুবৰ্ণ, (২) রাজত বা রৌপ্য, (৩) বাজ বা হীরক (৪) (মরকত প্রভৃতি) মণি, (৫) মুক্তা, (৬) প্রবাল, (৭) শঙ্খ, (৮) লৌহ (লোহা বা সুবর্ণ ও রজত ভিন্ন অন্যান্য ধাতু), (2) লবণ, (১০) ভূমিধাতু, (১১) প্রস্তরধাতু ও (১২) রসধাতু (খনিজ তৈলাদি)।

নিম্নলিখিত পাচটি (মতান্তরে ছয়টি) উপায় হইতে যে ধনাগম হয়, তাহার নাম সেতু শব্দদ্বারা বাচ্য, যথা—(১) পুষ্পবাট (ফুলের বাগ), (২) ফলবাট (ফলের বাগ), (৩) ষণ্ড (তাল-গুবাক-নারিকেল-কদলী প্রভৃতি), (৪) কেদার (ধান্যাদির ক্ষেত্র) ও (৫) মূল্যবাপ (অৰ্থাৎ আর্দ্রক-হরিদ্রাদির ক্ষেত্র)। (এই স্থলে পুষ্প, ফল ও বাট—এইরূপ পদচ্ছেদ করিয়া ‘বাট’ শব্দদ্বারা ইক্ষু প্রভৃতির বাট গৃহীত হইয়াছে, এইজন্যই মতান্তরে উপায়গুলির সংখ্যা ছয় হইতে পারে)।

নিম্নলিখিত চারিটি উপায় হইতে যে ধনাগম হয়, তাহার নাম বন-শব্দদ্বারা অভিহিত হইয়াছে, যথা-(১) বেষ্টনাবদ্ধ পশুবন (গবয়াদি পশুর বন), (২) মৃগবন (হরিণাদির বন), (৩) দ্রব্যবন (শাককাষ্ঠাদির বন) ও (৪) হস্তিবন।। নিম্নলিখিত আটটি উপায় হইতে যে ধনাগম হয়, তাহার নাম ব্রজ-শব্দদ্বারা লক্ষিত হইয়াছে, যথা-(১) গো, (২) মহিষ, (৩) আজ বা ছাগ, (৪) অবিক বা মেষ, (৫) খাঁর বা গর্দভ, (৬) উষ্ট, (৭) অশ্ব ও (৮) অশ্বতর (বেসর বা খচ্চর)।

নিম্নলিখিত দুইটি উপায় হইতে যে ধনাগম হয়, তাহার নাম বণিকপথশব্দদ্বারা। কথিত হইয়াছে, যথা—(১) স্থলপথ ও (২) জলপথ।

উক্ত উপায়গুলির নাম আয়শারীর, অর্থাৎ এইগুলিই রাজার ধনাগমস্থান।

নিম্নলিখিত সাতটি ধনাগমের উপায়কে আয়ের মুখ বা প্রধান স্থান বলিয়া বিভক্ত করা হইতেছে, যথা-(১) মূল (অর্থাৎ ধান্যফলাদির বিক্রয়লব্ধ ধন), (২) ভাগ (ধান্যাদির ষড়ভাগ), (৩) ব্যাজী (পুনরায় দ্রব্য মাপিলে কম না হয় তজন্য যে বিংশতিভাগ বেশী আদায় করা হয়, অর্থাৎ শতকরা পাচভাগ হিসাবে–তৃতীয় অধিকরণে ১৩শ অধ্যায় দ্রষ্টব্য), (৪) পরিঘ (খেয়া ও অন্যান্য ভাড়া?), (৫) ক্লপ্ত (নির্দ্দিষ্ট করা), (৬) রূপিক (লবণাধ্যক্ষ দ্বারা লবণ

বিক্রয়ী হইতে আটভাগ গ্রহণ) ও (৭) অত্যয় (অর্থাৎ ধৰ্ম্মস্থীয় ও কণ্টকশোধনাদি প্রকরণে বর্ণিত দণ্ডের বা জরিমানার ধন।

উক্ত সাতটি উপায়ে লব্ধ প্রধান আয়ের পারিভাষিক নাম আয়মুখ।

নিম্নলিখিত প্রকারের ব্যয়কে ব্যয়শরীর বলিয়া নির্দেশ করা হইতেছে, যথা-(১) দেবপূজার্থ ব্যয়, (২) পিতৃপূজার্থ (শ্ৰাদ্ধাদির) জন্য ব্যয়, (৩) দানার্থ (ব্রাহ্মণাদিকে পৰ্ব্ব প্রভৃতি দিনে দীয়মান) ব্যয়, (৪) স্বস্তিবাচন নিমিত্তক (অর্থাৎ শান্তি ও পুষ্টির জন্য পুরোহিত্যাদিকে দীয়মান) ব্যয়, (৫) অন্তঃপুরের ব্যয় (অর্থাৎ দেবী ও রাজপুত্ৰাদির জন্য কৰ্ত্তব্য ব্যয়), (৬) মহানসের বা রাজরন্ধনশালার ব্যয়, (৭) দূত-প্ৰাবৰ্ত্তিম অর্থাৎ দূত প্রবৰ্ত্তনের খরচ, (৮) কোষ্ঠাগারের ব্যয় (অর্থাৎ তন্নিৰ্ম্মাণাদি-জন্য খরচ), (৯) আয়ুধাগার, (১০) পণ্যগৃহ, (১১) কুপ্যগুহ, (১২) কৰ্ম্মান্ত (নানারূপ কারখানা) ও (১৩) বিষ্টি (বা হঠাৎ করণীয় কৰ্ম্মের জন্য কৰ্ম্মকর খরচ সম্বন্ধীয়) ব্যয়, এবং (১৪) পত্তি, ১ে৫) অশ্ব, (১৬) রথ ও (১৭) হস্তি-সংগ্রহের খরচ, (১৮) গোমণ্ডল (গো-মহিষাদি রক্ষণের খরচ), (১৯) পশুবাটী, (২০) মৃগবাটী, (২১) পক্ষিবাটি ও (২২) ব্যালবাট জন্য (ব্যাভ্রাদি হিংস্র জন্তুদিগের রক্ষণস্থান-জন্য) খরচ, (২৩) কাষ্ঠবাট ও (২৪) তৃণবাট রক্ষণাদির খরচ।

উক্ত ব্যয়গুলির সমষ্টিগত নাম ব্যয়শরীর।

রাজার রাজ্যাভিষেক হইতে গণিত বর্ষ, মাস, পক্ষ ও দিবস-এই চারিটি বুদ্ষ্টে-সংজ্ঞায় অভিহিত হইয়া থাকে (অর্থাৎ রাজসরকারের নিবন্ধপুস্তকে হিসাব লেখার সময়ে অমুক রাজার অমুক বর্ষে, অমুক মাসে, অমুক পক্ষে ও অমুক দিবসে-ইহা ঘটিয়াছিল ইত্যাদিরূপ লিপিবদ্ধ করিতে হইবে)। এই রাজবর্ষের গণনায় বর্ষা, হেমন্ত ও গ্রীষ্ম-এইরূপে তিনভাগে কালকে বিভক্ত করা হয় (অর্থাৎ প্রত্যেক ভাগের চারি মাসে আটটি করিয়া পক্ষ গণনা করা হয়)। (এই প্রতি বিভাগের আট পক্ষের মধ্যে)। তৃতীয় ও সপ্তম পক্ষে এক এক দিন করিয়া কম ধরা হয়। অর্থাৎ ইহাতে চতুর্দশ দিন থাকে, আর অবশিষ্ট পক্ষগুলিতে পূর্ণ (পঞ্চদশ) দিন থাকে। তদন্তিরিক্ত এক মাস অধিক গণনাও হইবে (অর্থাৎ সৌরমাসাতিরিক্ত চান্দ্রমাস-হিসাবে গণনা করিলে প্রতিমাসে দুই এক দিন করিয়া কম হইয়া গিয়া প্রথম আড়াই বৎসর পরেই গড়হিসাবে বার মাস স্থলে তের মাস হয়-এই অতিরিক্ত মাসকেই অধিমাস বা মলমাস বলা হয়)। রাজদরবারের ব্যবহারার্থ এইরূপ ভাবেই কাল-গণনা করিতে হয়।

সমাহৰ্ত্তাকে (১) করণীয়, (২) সিদ্ধ, (৩) শেষ, (৪) আয়, (৫) ব্যয় ও (৬) নীবী-এই ছয়টি বিষয়ের ব্যবস্থা করিতে হইবে।

তন্মধ্যে করণীয় ছয় প্রকার, যথা-(১) সংস্থান (অর্থাৎ কোন স্থান হইতে কত আয় স্থিত আছে, তাহ), (২) প্রচার (অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন স্থানের সর্ব প্রকার বিভাগীয় কাৰ্য্যের জ্ঞান), (৩) শরীরাবস্থান (অর্থাৎ পুত্র ও জনপদগুলি আয়ব্যয়-শরীরের নিশ্চয়), (৪) আদান (অর্থাৎ ঠিক সময়ে ধান্য ও হিরণ্যাদির আদায়করণ), (৫) সর্বসমুদায়পিণ্ড (অর্থাৎ প্রতি গ্রাম ও প্রতি নগর হিসাবে সৰ্ব্ব প্রকার সমুদয়ের বা উৎপন্ন ধনাদির সংগ্রহ ও ইহার জ্ঞান) ও (৬) সঞ্জাত (অর্থাৎ সর্ব প্রকার উপায়দ্বারা প্ৰাপ্ত ধনের পরিমাণ জানিয়া রাখা)। (এই সব কাৰ্য্য সমাহৰ্ত্তার অবশ্যকৰ্ত্তব্য বলিয়াই ইহার করণীয় সংজ্ঞা।)

সিদ্ধ ছয় প্রকার, যথা—(১) কোষাপিত অর্থাৎ রাজকোষে যাহা অৰ্পিত বা জমা দেওয়া হইয়াছে, (২) রাজহার (অর্থাৎ রাজা নিজকাৰ্য্যের জন্য সমাহৰ্ত্তার নিকট হইতে যাহা লইয়াছেন) ও (৩) পুরব্যয় (অর্থাৎ নগরে শালাপ্রভৃতি নিৰ্ম্মাণাৰ্থ ব্যয়িত ধন)। এই তিন প্রকার ধনের নাম প্রবিষ্ট শব্দদ্বারা সংজ্ঞিত হয়। (৪) পরম সংবৎসরানুবৃত্ত অর্থাৎ অতীত বর্সের খরচের পরও যাহা অনুবৃত্ত বা জোররূপে আগত ধন, (৫) শাসনমুক্ত অর্থাৎ যে সম্পত্তি রাজশাসনদ্বারা করামুক্ত ও (৬) মুখাজপ্ত, অর্থাৎ যাহা রাজার মুখের কথায় প্রদন্তু হইয়াছে। শেষের তিন প্রকার ধন বা সম্পত্তি আপাতনীয়-শব্দদ্বারা সংজ্ঞিত হয়। উক্ত তিন প্রকার প্রবিষ্ট ও তিন প্রকার আপাতনীয়-এই ছয়টিই সিদ্ধ শব্দদ্বারা সংজ্ঞিত হয়।

শেষ ছয় প্রকার হইতে পারে, যথা-(১) সিদ্ধিপ্রকৰ্ম্মযোগ অর্থাৎ সিদ্ধ বা প্ৰাপ্ত (ধান্যাদি) বস্তুর স্বায়ন্ত্ৰীকরণে প্রবৃত্তি (অর্থাৎ অদত্ত করাদির আদায়-জন্য এইরূপ প্রবৃত্তি) ও (২) দণ্ডশেষ (অর্থাৎ দণ্ড বা সৈন্যের উপযোগে বিহিত খরচ হইতে অবশিষ্ট ধন; মতান্তরে, দণ্ড বা জরিমানার অনাদায়-অংশ)। এই দুইটির সংজ্ঞা-আহরণীয় (অর্থাৎ ইহা অল্পায়াসে সংগৃহীত হইতে পারে।)। (৩) (রাজার প্ৰিয়জন দ্বারা) বলপূর্ব্বক অপ্রদত্ত ধন-যাহার নাম প্রতিস্তব্ধ ধন, (৪) অবস্থষ্ট ধন অর্থাৎ যে দেয় ধন পুরমুখ্যাদি জনেরা স্বেচ্ছায় দেয় না। শেষোক্ত দুইটির সংজ্ঞা প্রশোধ্য (অর্থাৎ প্রযত্নসাধ্য ধন)। (৫) আসার (অর্থাৎ নিম্বফলতায় ব্যয়িত ধন) ও (৬) আল্পসার (অর্থাৎ যে ধন অধিক পরিমাণে ব্যয়িত হইলেও স্বল্প ফল প্রসব করে)। এই ছয়টি শেষ-শব্দবাচক।

আয় তিন প্রকার, যথা,–(১) বৰ্ত্তমান, (২) পর্য্যুসিত ও (৩) অন্যজাত। তন্মধ্যে যে আয় প্রতি দিন হয়, অর্থাৎ নিত্য আয়, তাহার নাম বর্তমান আয়। যে আয় পূর্ব্ব বৎসরেই হওয়া উচিত ছিল তাহা যদি বৰ্ত্তমান বৎসরে গৃহীত হয়, এবং ভূতপূৰ্ব অধ্যাক্ষের সময়েই গ্রহণযোগ্য যে আয় বৰ্ত্তমান সময়ে পরিজ্ঞাত হয় (অথবা, যাহ পর বা শত্রুর দেশ হইতে আগত আয়) তাহার নাম পর্য্যুসিত আয়। আবার (১) যে আয় বিস্মৃত ছিল, কিন্তু, সম্প্রতি অভিজ্ঞাত হইল, (২) যে আয় (অপরাধী) আযুক্ত (বা অধিকারী) পুরুষ হইতে দণ্ডরূপে গৃহীত হয়, (৩) পার্শ্বনামক আয়, অর্থাৎ নির্দ্দিষ্ট আয়ের অতিরিক্ত (বক্র পন্থাবলম্বনে) প্ৰাপ্ত (অথবা, নিজের প্রভুত্বের প্রভাবে প্ৰাপ্ত যে আয়), (৪) পারিহীণিক আয় অর্থাৎ কোন ক্ষতিপূরণার্থ গৃহীত যে আয়, (৫) ঔপায়নিক আয় অর্থাৎ উপায়ন বা উপঢৌকনরূপে গৃহীত যে আয়, (৬) ডমর বা কোন প্রকার বিপ্লবের সময়ে (শক্রসেনা প্রভৃতি হইতে) আহৃত ধনরূপ আয়, (৭) অপুত্রক আয় অর্থাৎ কাহারও দায়ভাগী পুত্ৰাদি না থাকায়, রাজগামী সেই দায় হইতে প্ৰাপ্ত আয় ও (৮) নিধি হইতে লব্ধ আয়-এই আয়গুলি অন্যজাত আয় বলিয়া সংজ্ঞিত হয়। অন্য আর এক প্রকার আয়ের কথা বলা হইতেছে যাহার নাম ব্যয়-প্রত্যায় আয়, যথা-(১) বিক্ষেপশেষ অর্থাৎ কোনও গুরুতর কাৰ্য্যের জন্য নির্দ্দিষ্ট ব্যয় হইতে অবশিষ্ট ধন, (২) ব্যাধিতশেষ অর্থাৎ রোগীদিগের খরচ-জন্য রক্ষিত ধনের ব্যয়িতাবশিষ্ট অংশ ও (৩) অন্তরারম্ভশেষ অর্থাৎ রাজপুরে দুর্গ প্রাসাদদি নিৰ্ম্মণার্থ রক্ষিত ধনের ব্যয়িতাবশিষ্ট অংশ। আরও (পাঁচ) প্রকার আয়ের কথা বলা হইতেছে, যথা-(১) (ক্রীত) পণ্যের বিক্রয়সময়ে মূল্যবৃদ্ধি হইলে তাহা হইতে উৎপন্ন অতিরিক্ত আয়, (২) উপজা অৰ্থাৎ প্রতিসিদ্ধ দ্রব্যাদির বিক্রয় হইতে উপজাত আয়, (৩) মান ও উন্মানের বিশেষের বা ন্যানাধিক্যের দরুন প্ৰাপ্ত আয়, (৪) ব্যাজী বা ফাও-নেওয়ার আয়, অর্থাৎ পুনর্বার দ্রব্য মাপিবার সময়ে উন্নতার আশঙ্কায় বিংশতিভাগ আগেই বাড়াইয়া নেওয়ার জন্য উৎপন্ন আয় ও (৫) ক্রয়কারীদিগের মধ্যে ক্রয়কালে সংঘর্ষ বা মূল্য বাড়াইবার স্পৰ্দ্ধাবশতঃ উৎপন্ন অতিরিক্ত আয়। (উক্ত সর্ব প্রকার আয়ই আয়-শব্দবাচ্য।)

ব্যয় নিরূপণে বলা হইতেছে যে, ব্যয়ও চারি প্রকারের হইতে পারে, যথা-(১) নিত্য, (২) নিত্যোৎপাদিক, (৩) লাভ ও (৪) লাভোৎপাদিক। যে ব্যয় প্রতি দিনই হইয়া থাকে তাহার নাম নিত্যব্যয়। যে ব্যয় পাক্ষিক, মাসিক ও বাৎসরিক লাভের জন্য করা হইয়া থাকে। সেই ব্যয়ের (পারিভাষিক) নাম লাভ। নিৰ্দ্ধারিত নিত্যব্যয় ও লাভব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে যে যে ব্যয় অতিরিক্ত করা হয় তাহাদিগের নাম যথাক্রমে নিত্যাৎপাদিক ও লাভোৎপাদিক ব্যয়।

আয় ও ব্যয়ের সম্যক গণনাদ্বারা নিশ্চিত, অথচ সর্ব প্রকার ব্যয় সঙ্কলন করার পর উখিত দ্রব্য বা ধনের সংজ্ঞা নীবী। এই নীবী ও দুই প্রকার হইতে পারে, যথা-প্ৰাপ্ত অর্থাৎ যাহা রাজকোষে জমা দেওয়া হইয়াছে এবং অনুবৃত্ত অর্থাৎ যাহা জমা করার জন্য প্রেরিত হইয়াছে।

প্ৰাজ্ঞ (সমাহৰ্ত্তা)। উক্ত প্রকারে (রাজকোষের জন্য) সমুদয় বা ধনোৎ পত্তির ব্যবস্থা করিবেন এবং (তিনি) আয়ের বৃদ্ধি ও ব্যয়ের হ্রাস প্রদৰ্শন করিবেন অর্থাৎ যাহাতে রাজার আয় বাড়ে ও ব্যয় কম হয়, সে দিকে যত্নবান থাকিবেন। (প্রয়োজন হইলে, তিনি) ইহার বৈপরীত্যও ঘটাইতে পারেন (অর্থাৎ অধিক ফলপ্ৰাপ্তির আশায় আয়ত্ত্বাস ও ব্যয়বৃদ্ধিরও ব্যবস্থা করিতে পারেন)। ১।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে সমাহৰ্ত্তার সমুদয়প্রস্থাপন-নামক ষষ্ঠ অধ্যায় (আদি হইতে ২৭ অধ্যায়) সমাপ্ত।

.

সপ্তম অধ্যায়
২৫শ প্রকরণ-অক্ষপটলে গাণনিকদিগের অধিকার

অধ্যক্ষ বা মহাগাণনিক এমন একটি অক্ষাপটল (গাণনিকগণের কৰ্ম্মানুষ্ঠানযোগ্য স্থান) নিৰ্ম্মাণ করাইবেন যাহা পূর্ব্ব বা উত্তরদিকের অভিমুখ থাকিবে। ইহা অনেক উপস্থান বা ছোট ছোট কক্ষ্যাতে বিভক্ত থাকিবে, এবং ইহাতে (আয়ব্যয়ের) নিবন্ধপুস্তক (খাতপত্র) রাখিবার স্থানও ব্যবস্থিত থাকিবে (পরবর্ত্তীকালে এই অধ্যক্ষ পুস্তপাল-নামে পরিচিত হইত, এবং তাঁহার অন্য নাম মহাক্ষপটলিক বলিয়াও পাওয়া গিয়াছে)।

(দলিল দস্তাবেজ তৈয়ার করা ও রাখার জন্য নির্দ্দিষ্ট) এই দপ্তরে (এই অধ্যক্ষ)। নিম্নলিখিত বিষয়গুলিকে নিবন্ধপুস্তকে লিপিবদ্ধ করাইবেন, যথা— (১) (রাজ্যশাসনতন্ত্রভুক্ত) সৰ্ব্ব প্রকার অধিকরণ বা বিভাগের সংখ্যা, তাহাদের প্রচার বা কৰ্ত্তব্যসম্বন্ধীয় নিয়মকানুyন, ও সেগুলির সঞ্জাত বা উৎপন্ন আয়ের ইয়ত্তা; (২) রাজকৰ্ম্মান্ত বা খনিজ দ্রব্যাদির কারখানাসমূহের দ্রব্যবিনিয়োগসম্বন্ধে বৃদ্ধি বা সুদ বা লাভ, ক্ষয় (নাশ ও ক্ষতি), ব্যয়, প্রযাম (অপ্ৰাপ্তি বা অভাবের সময়ে দ্রব্যের ক্রয়াদর বা চাহিদা), ব্যাজী (গত অধ্যায়ে দ্রষ্টব্য), যোগ (দ্রব্য ও অপদ্রব্যের মিশ্রণ), স্থান (দ্রব্যের উৎপত্তি-স্থান), বেতন (কৰ্ম্মকরদিগের ভূতি) ও বিষ্টির (বলকারিত কৰ্ম্মের জন্য নিযুক্ত কৰ্ম্মকরদিগের) প্রমাণ বা ইয়ত্ত; (৩) রত্ন (মরকতাদি), সার, ফন্তু (অসার) ও কুপ্য পদার্থের অর্ঘ্য বা মূল্য, প্রত্যেকটির বর্ণক বা রঙ, মান বা তোল, উন্মান বা উচ্চতা ও প্রশস্ততার মাপ ও ইহাদের দ্বারা তৈরী ভাণ্ড বা মাল; (৪) দেশ, গ্ৰাম, জাতি, কুল ও সংঘের ধৰ্ম্ম, (দায়ভাগাদি) ব্যবহার, চারিত্র বা সমুদাচারের স্বরূপ (সংস্থান শব্দকে ভিন্ন করিয়া ধরিলে ইহার অর্থ পূর্ব্বস্থিত বা দেশের রীতিনীতি হইতে পারে); (৫) রাজোপজীবী পুরুষদিগের প্রগ্রহ বা পূজা সৎকারাদির রকম, প্রদেশ বা বাসস্থান, ভোগ বা উপায়নপ্রভৃতি, পরিহার বা কারমুক্তি, ভক্ত (অশ্বগজাদির জন্য খোরাকি) ও তাঁহাদের বেতনপ্ৰাপ্তি; (৬) রাজা স্বয়ং তাহার পত্নীগণ ও রাজপুত্রেরা কি কি রত্ন ও ভূমি লাভ করিয়াছেন তাহ; (৭) রাজপ্রভৃতির নিত্য দেয় ধনের অতিরিক্ত ধন, উৎসবাদিতে খরচ করার জন্য বিশেষভাবে প্ৰাপ্ত ধন ও ব্যাধি প্রভৃতি প্রশমনার্থ প্ৰাপ্ত ধনলাভ কতখানি তাহা; এবং (৮) মিত্র ও অমিত্ররাজগণের প্রতি (যথাক্রমে) সন্ধি করিয়া প্রদীয়মান ধন ও যুদ্ধ করিয়া আদীয়মান ধনের পরিমাণ। এই সমস্ত বিষয় (অক্ষাপটলের) নিবন্ধপুস্তকে বা রেজিষ্টারে (গণনাধ্যক্ষ) লিপিবদ্ধ করাইবেন।

তদনন্তর সর্ব প্রকার অধিকরণের (কৰ্ম্মবিভাগের অধ্যক্ষাদি কৰ্ম্মকরগণের) করণীয়, সিদ্ধ, শেষ, আয়, ব্যয় ও নীবী (এই অধিকরণের ষষ্ঠ অধ্যায় দ্রষ্টব্য), তাহাদিগের উপস্থান বা কৰ্ম্মকরণে উপস্থিতিকাল, প্রচার (ব্যাপার বা কাৰ্য্যপদ্ধতি), ও চরিত্র (আচার) সম্বন্ধীয় স্বরূপ (তিনি অর্থাৎ প্রধান গাণনিক) নিবন্ধপুস্তকে লিখাইয়া (অথবা, নিবন্ধপুস্তকে লিখিত ব্যবস্থানুসারে) নিৰ্দ্ধারণ করিয়া দিবেন। তিনি উত্তম, মধ্যম ও অধম কৰ্ম্মসমূহের সম্পাদন-জন্য ইহার অনুরূপ অধ্যক্ষ নিযুক্ত করিবেন এবং এককৰ্ম্ম সাধনের যোগ্য অনেক পুরুষ পাইলে তিনি তাহাকেই অধ্যক্ষ করিবেন—যিনি কৰ্ম্মনৈপুণ্য ও অন্যান্য গুণসম্ভারের পরিচয় দিয়াছেন এবং (যাঁহার কোন অপরাধ ঘটিলে) তাহাকে দণ্ড দিয়া রাজ (নিজেও) অনুতপ্ত হইবেন না। (অর্থাৎ যেন তেমন অধ্যক্ষ ব্ৰাহ্মণ বা রাজার আত্মীয়স্বজন না হয়েন এবং তাঁহাদের অপরাধের জন্য তাহাদিগকে শাস্তি দিতে হইলে তাহার মনে অনুতাপ না আসে)।

(এইরূপ ভাবে নিযুক্ত অধ্যাক্ষের কোন প্রকার অপচার বা কৰ্ম্মদোষ প্রমাণিত হইলে) ভঁহার যাঁহারা সহগ্ৰাহী বা সহাপহরণকারী, যাঁহারা তাহার প্রতিভূ বা জামিন ছিলেন তাহারা, যাঁহারা তাঁহার অধীনস্থ কৰ্ম্মচারী তাহারা, তাঁহার পুত্র, ভ্রাতা, ভাৰ্য্যা, কন্যা ও তাঁহার নিজ ভৃত্যের (অধ্যাক্ষের দোষে রাজসরকারের) কৰ্ম্মচ্ছেদজনিত ক্ষতি পূরণ করিয়া দিবেন।

তিন শুত চুয়ান্ন (৩৫৪) দিনরাত্ৰি (দিবস) ধরিয়া (রাজসরকারের) কৰ্ম্মসংবৎসর গণনা করিতে হইবে। এই কৰ্ম্মসংবৎসর আষাঢ় মাসের পূর্ণিমায় সমাপ্ত বলিয়া ধৃত হইবে এবং এইরূপ কালগণনা করিয়া যাহার যাহা (বেতনাদি) প্ৰাপ্য হইবে তাহা (পূরা হইলে) পূর্ণ করিয়া, অথবা, (নিয়োগটি অন্তরালসময়ে ঘটিলে) কম করিয়া দিতে হইবে। অধিমাসাক (অর্থাৎ প্রতিমাসে কে কতখানি কাৰ্য্য করিয়াছে ইহার) গণনা কোন কারণ বা কেরাণীদ্বারা অধিষ্ঠিত থাকিবে (অর্থাৎ সেই কারণই তাহা গণনা করিয়া দিবে।)। এই স্থলে অধিমাসকশব্দ দ্বারা মলমাস লক্ষিত হইয়া থাকিলে, তজ্জন্য অতিরিক্ত দিবসে কৃত কৰ্ম্মের হিসাবও এই কারণ হইতেই জানিয়া লইতে হইবে-এইরূপ ব্যাখ্যা করা যায়)। (অধ্যক্ষ)। অপসৰ্প বা গুপ্তচরদ্বারা (কৰ্ম্মচারীদিগের) প্রচার বা কাৰ্য্যাবলীদ অবেক্ষণ করাইবেন। তৎতৎকাৰ্য্যে নিযুক্ত কোন অধ্যক্ষপ্রচার, চরিত্র ও সংস্থানের (পূর্ব্বস্থিতির) বিষয় (অপসৰ্পযোগে) না জানিলে, সেই অজ্ঞানবশতঃ তিনি রাজার সমুদয় ৰা, ধনোৎপত্তির হানি ঘটাইয়া দিবেন; এবং (তিনি) উত্থান বা কৰ্ম্মোদ্যম ও ক্লেশ সহিতে না পারিয়া নিজের অলসতার দরুন; শব্দাদি ইন্দ্ৰিয়বিষয়ে প্রমাদে পতিত হইবার দরুন; নিন্দ, অধৰ্ম্ম ও অনার্থের আশঙ্কায় ভীরু হওয়ায় সেই ভয়ের দরুন; কাৰ্য্যার্থিগণের প্রতি অনুগ্রহ দেখাইবার জন্য কাম বা কামচারিতার দরুন; কাহারও প্রতি হিংসাবুদ্ধিতে প্রণোদিত হইয়া কোপের দরুন; নিজের বিদ্যা, দ্রব্য (ধনসম্পত্তি) ও রাজবল্লভাদিগের আশ্রয়ের উপর নির্ভর করিয়া দৰ্পের দরুন; এবং তুলান্তর, মানান্তর ও গণিকান্তরের (অন্য প্রকার গণনার) ছলনা করিয়া লোভের দরুনও (রাজ-সমৃদয়ের ক্ষতি সাধন করিতে পারেন)। সুতরাং গণনাধ্যক্ষের অজ্ঞান, আলস্য, প্রমাদ, ভয়, কাম, কোপ, দৰ্প ও লোভ—এই আট প্রকার দোষ সমৃদয়ের হানি ঘটাইতে পারে। মানবেরা অর্থাৎ আচাৰ্য মনুর শিষ্যেরা এই মত পোষণ করেন যে, উক্ত আট প্রকার দোষের যথাক্রমে যে কয়টি দোষের দরুন রাজকোষের যতখানি হানি হইবে, সেই দোষীসংখ্যার উপরও একগুণ অধিক অর্থদণ্ড (অপরাধী গাণনিককে) দিতে হইবে (যথা, দুই কারণে ৫ টাকার ক্ষতি হইলে ৫ × (২+১) = ১৫ টাকা দণ্ড হইবে)। (কেহ কেহ এমনও ব্যাখ্যা করেন যে, একাদিগুণ অধিক দণ্ড হইবে, অর্থাৎ একটি দোষে ক্ষতির সমান দণ্ড, দুইটি দোষে দ্বিগুণ, তিনটি দোষের ত্ৰিগুণ ইত্যাদি।) পরাশরের অর্থাৎ আচাৰ্য্য পরাশরের শিষ্যেরা মনে করেন যে, সর্ব প্রকার অপরাধেই ক্ষতির আটগুণ দণ্ড হইবে। বাৰ্হস্পত্য বা আচাৰ্য্য বৃহস্পতির শিষ্যগণের মতে সব অপরাধেই দশগুণ, দণ্ড হইবে। ঔশনস বা শুক্রাচাৰ্য্যের শিষ্যগণ মনে করেন যে, সব অপরাধেই বিশগুণ দণ্ড হওয়া উচিত। (কিন্তু,) কৌটিল্যের মতে অপরাধের (গুরুত্র ও লঘুত্র) পৰ্য্যালোচনা করিয়া দণ্ড দিতে হইবে।

(প্রধান গণনাধ্যক্ষের কাৰ্য্যালয়ে) গণনাকাৰ্য্যসমূহ অৰ্থাৎ তৎপ্রদর্শনকারী কৰ্ম্মচারীরা, (হিসাব লইয়া) আষাঢ়-পূর্ণিমার দিনে উপস্থিত হইবে। সরকারী মুদ্রা বা শিলমোহর যুক্ত পুস্তভাণ্ড বা নিবন্ধপুস্তকের পেটিকা ও নীবী (অর্থাৎ ব্যয়িত ধনের অবশিষ্ট ধন)-সহকারে তাহারা যখন সেখানে আসিবে, তখন (হিসাব বুঝাইয়া না দেওয়া পৰ্য্যন্ত) তাহারা পরস্পরের সহিত কোন আলাপ করিতে পারিবে না-এইরূপ ব্যবস্থা (গণনাধ্যক্ষ) করাইবেন। তাঁহাদের নিকট হইতে আয়, ব্যয় ও নীবীর পরিমাণ শুনিয়া (তিনি) তাহাদের নিকট হইতে নীবী বুঝিয়া লইবেন। লিখিত আয়ের পরিমাণ হইতে, নিবন্ধপুস্তকে বিস্তৃত বৰ্ণনানুসারে, নীবী বাবদ যে ধন বাড়িবে বলিয়া প্রতিপন্ন হয়, এবং ব্যয়ের পরিমাণ হইতেও যে ধন কমিয়া যায় বলিয়া দুষ্ট হয়, সেই ধনের আটগুণ ধন সেই (হিসাবপ্রদর্শক) অধ্যক্ষকে (প্রধান গণনাধ্যক্ষ) (দণ্ডরূপে) দেওয়াইবেন। (অর্থাৎ সেই অধ্যক্ষ হইতে তাহা গ্রহণ করিবেন।)। ইহার বিপৰ্য্যয় বা বৈপরীত্য ঘটিলে, বদ্ধিতাংশ সেই অধ্যক্ষই (পুরস্কারস্বরূপ) পাইবেন।

যে অধ্যাক্ষেরা নির্দ্দিষ্ট সময়ে (হিসাব লইয়া) উপস্থিত হইবেন না, অথবা, (উপস্থিত হইলেও) পুস্ত (নিবন্ধপুস্তক) ও নীবী না লইয়া উপস্থিত হইবেন, তাহাদিগকে দেয়াংশের দশগুণ দণ্ড দিতে হইবে। কাৰ্ম্মিক বা বড় কৰ্ম্মচারী উপস্থিত হইলেও, কারণিক বা ছোট কৰ্ম্মচারী যদি হিসাব মিলাইয়া না লয়েন, তাহা হইলে তাঁহাকে প্রথম সাহস দণ্ড দিতে হইবে। ইহার বিপরীত ঘটিলে অর্থাৎ কাৰ্ম্মিকের দোষ হইলে, সেই কাস্মিককে ইহার দ্বিগুণ দণ্ড দিতে হইবে।

রাজার মহামাত্রগণ তাঁহাদের প্রচার বা বিভাগীয় কায্যের প্রয়োজনানুরূপ সমগ্র হিসাব পরস্পরের অনুকুল করিয়া শুদ্ধভাবে (লোকদিগকে) শুনাইবেন বা জানাইবেন। (তাহাদিগের মধ্যে)। কেহ বিসংবাদী বা মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন হইলে, তাহার উপর উত্তম সাহস দণ্ড প্রযুক্ত হইবে।

যে (অধ্যক্ষ) নির্দ্দিষ্ট দিবসে (উপহৰ্ত্তব্য ধনাদি দ্রব্যের) হিসাব উপস্থাপিত করিতে পারেন না, তাঁহাকে (ইহার হিসাব-জন্য)। আরও এক মাস সময় দেওয়া যাইতে পারে। এক মাস অতীত হইয়া গেলে, তার পরও হিসাব না দেখাইতে পারিলে, তাহার প্রতি প্রতিমাসে ২০০ পণ দণ্ড বিহিত হইবে। যে অধ্যাক্ষের অল্প পরিমিত নীলীর হিসাব বাকি থাকে, তাঁহাকে নির্দ্দিষ্ট দিনের পরও পাঁচ দিনের সময় দেওয়া যাইতে পারে, তৎপর তাহার উপরও দণ্ডের ব্যবস্থা করিতে হইবে।

যে অধ্যক্ষ নির্দ্দিষ্ট দিবসে (নীবীরূপ) কোশসহকারে হিসাব বুঝাইয়া দিতে উপস্থিত হইবেন, তাঁহাকে (প্রধান গণনাধ্যক্ষ)। ধৰ্ম্ম, ব্যবহার, চরিত্র, সংস্থান (পূৰ্বস্থিতি), সঙ্কলন (হিসাব রচনা), নির্বাৰ্ত্তন (কাৰ্য্যনিষ্পত্তি), অনুমান (অর্থাৎ এক কাৰ্য্যদ্বারা অন্য কাৰ্য্যের অনুমান) ও চার বা গূঢ়পুরুষদিগের প্রয়োগদ্বারা পরীক্ষা করিবেন।

এক দিন, পাঁচ দিন, এক পক্ষ, এক মাস, চারি মাস ও সংবৎসর-এইরূপ কাল বিভাগ করিয়া (আয়, ব্যয় ও নীবীর) হিসাব-রাখিতে হইবে (অর্থাৎ হিসাব-নিকাশ এমনভাবে প্রস্তুত করিতে হইবে যাহাতে রাজসরকারের প্রতিদিনের, প্রতি পাঁচ দিনের, প্রত্যেক পক্ষের, প্রত্যেক চাতুর্মান্তের ও প্রত্যেক বৎসরের আয়, ব্যয় ও নীবীর পরিমাণ তৎক্ষণাৎ জানা যাইতে পারে।)। আয়ের হিসাব লিখিবার সময়ে, বুদ্ষ্টে (রাজবর্ষাদি—এই অধিকরণের ষষ্ঠ অধ্যায় দ্রষ্টব্য), দেশ, কাল, মুখ (আয়মুখ ও আয়শারীর), উৎপত্তি (আয় হইতে উৎপন্ন বৃদ্ধিপ্রভৃতি), অনুবৃত্তি (পুনঃ পুনঃ আগাম), প্রমাণ বা পরিমাণ, দায়ক (করাদির দাতা), দাপক (যে রাজপুরুষ করাদি দেওয়ান তিনি), নিবন্ধক (নিবন্ধপুস্তকের লেখক) ও প্রতিগ্রাহক (আদায়কারী)-এই সমস্ত বিষয়েরও উল্লেখ রহিল। কি না। তাহার পরীক্ষা করা আবশ্যক। ব্যয়ের হিসাব লিখিবার সময়ে, বুদৃষ্ট, দেশ, কাল, মুখ (ব্যয়মুখ ও ব্যয়শরীর), লাভ (পূৰ্ব্বাধ্যায় দ্রষ্টব্য) কারণ (ব্যয়ের কারণ), দেয় বস্তুর নাম, যোগ (দ্রব্য ও অপদ্রব্যের মিশ্রণ), পরিমাণ, আজ্ঞাপক (ব্যয়ের জন্য আজ্ঞাকারী), উদ্ধারক (রাজকোষ হইতে ধনাদির আনেতা), নিধাতুক (ভাণ্ডাগারিক) ও প্রতিগ্রাহক (ব্যয়ের গ্রহণকারী)-এই সব বিষয়েরও উল্লেখ আছে কি না তাহা পরীক্ষা করা দরকার। (আবার) নীবীর হিসাব লিখিবার সময়েও বুদৃষ্ট, দেশ, কাল, মুখ, অনুবর্তন, রূপ (স্বরূপ), লক্ষণ (দ্রব্যের চিহ্ন), পরিমাণ, নিক্ষেপভাজন (যে পাত্রে দ্রব্য জমা রাখা হইবে তাহ) ও গোপায়ক (দ্রব্যের রক্ষক)-এই সব বিষয়েরও উল্লেখ আছে কি না। তাহা পরীক্ষা করা উচিত। (অর্থাৎ আয়, ব্যয় ও নীবীর হিসাবে তৎ তৎ বিষয়ের উল্লেখ আছে কি না, তাহা মিলাইয়া হিসাব পরীক্ষা করিতে হইবে)।

যে কারণিক রাজার ধনাদিবিষয়ে নিবন্ধপুস্তকে হিসাব না লিখিবে, অৰ্থবা, (রাজার) আজ্ঞা উল্লঙ্ঘন করিবে, অথবা, নিবন্ধস্থ নিয়মের অতিক্রম করিয়া অন্য প্রকারে আয় ও ব্যয়ের কল্পনা করিবে, তাহার উপর প্রথম সাহস দণ্ড বিহিত হইবে।

যে (কৰ্ম্মচারী লেখক) কোন বস্তুসম্বন্ধে ক্রম পরিত্যাগপূর্ব্বক বা উলটপালটভাবে, বা অন্যের বোধবিরুদ্ধভাবে, বা পুনরুক্তভাবে হিসাব (অন্যায়ারূপে) লিখিবে, তাহার দণ্ড হইবে দ্বাদশ পণ।

যে ব্যক্তি নীবীসম্বন্ধে এইরূপ ভুল করিয়া লিখিবে, তাহার দণ্ড পূৰ্ব্ব দণ্ডের দ্বিগুণ অর্থাৎ ২৪ পণ হইবে; যে ব্যক্তি স্বয়ং নীবী গ্ৰাস করিবে, তাহার সেই দণ্ডের আটগুণ অর্থাৎ ৯৬ পণ দণ্ড হইবে।; এবং যে ব্যক্তি নীবী (অন্যকে দিয়া) নাশ করিবে, তাহার সেই দণ্ডের পাঁচগুণ অর্থাৎ ৬০ পণ দণ্ড হইবে এবং তাহাকে নাশিত দ্রব্য পুনরায় দিতে হইবে। (নীবী-সম্বন্ধে কোন কৰ্ম্মচারী) মিথ্যা কথা বলিলে তাহার উপর স্তেয়দণ্ড অর্থাৎ চুরি করার অপরাধে প্রযুজ্যমান দণ্ড বিহিত হইবে। হিসাব-সম্পৰ্কীয় কোন বিষয়ে পূর্বে অস্বীকার করিয়া পরে স্বীকার করিলে, অপরাধীকে স্তেয়দণ্ডের দ্বিগুণ দণ্ড ভোগ করিতে হইবে, এবং পূর্বে ভুলিয়া গিয়া পরে চিন্তাপূর্ব্বক স্থির করিলেও তাহাকে স্তেয়দণ্ডের দ্বিগুণ দণ্ড ভোগ করিতে হইবে।

রাজা, (অধ্যাক্ষের) অপরাধ অল্প হইলে তাহা সহ্য করিবেন; এবং তাঁহাদ্বারা অল্প আয়ও যদি বদ্ধিত হয়, তাহা হইলে (তিনি) তদুপরি তুষ্ট হইবেন। এবং (তিনি) তাহার মহোপকারী অধ্যক্ষকে সর্ব প্রকার সৎকার দ্বারা সম্মানিত করিবেন। ১।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে গাণনিক্যাধিকার নামক সপ্তম অধ্যায় (আদি হইতে ২৮ অধ্যায়।) সমাপ্ত।

.

অষ্টম অধ্যায়
২৬শ প্রকরণ-যুক্ত বা অধিকারী দ্বারা অপহৃত সমুয়ের প্রত্যানয়ন

(তন্ত্র ও আবাপের) সৰ্ব্ব কার্স্যই কোশের উপর নির্ভর করে। সেইজন্য (বুজা) সৰ্ব্ব কাৰ্য্যের পূর্বে “কোশ পৰ্যবেক্ষণ করিবেন (অর্থাৎ যাহাতে কোশবৃদ্ধি ঘটে এবং কৌশক্ষয় না ঘটে, তিনি সেদিকে চিন্তা করিবেন)।

কোশবৃদ্ধি নিম্নলিখিত উপায়ে সম্ভবপর হয়, যথা-(১) প্রচারসমৃদ্ধি, অর্থাৎ রাজ্যের এলাকা বাড়াইয়া লওয়া; (২) চরিত্রানুগ্রহ, অর্থাৎ দেশ, জাতি, কুল প্রভৃতির আচার-ব্যবহার রক্ষা করিয়া চলা; (৩) চোরগ্রহ, অর্থাৎ চাের-দম্ব্যর অত্যাচার নিবারণার্থ তাহাদিগের গ্রেপ্তার; (৪) যুক্ত প্রতিষেধ, অর্থাৎ যাহাতে যুক্তেরা বা অধিকারী পুরুষেরা ধনাপহরণ এবং প্রজাপীড়ন হইতে নিবারিত থাকে তাহার চেষ্টা করা; (৫) শান্তসম্পৎ, অর্থাৎ সর্ব প্রকার শস্যের উৎপাদন বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া; (৬) পণ্যবাহুল্য, অর্থাৎ বিক্ৰেয় পণ্যের বহুল পরিমাণে উৎপাদন; (৭) উপসৰ্গ-প্রমোক্ষ, অর্থাৎ অগ্নিপ্রভৃতি উপদ্রব হইতে দেশ ও নিজের রক্ষাকৰ্ম্ম; (৮) পরিহার্যক্ষয়, অর্থাৎ করমুক্তির হ্রাস, বা কাহারও কবুদান মাপ না করা; ও (o)। হিরণ্যোপায়ন, অর্থাৎ প্রজা হইতে নগদ টাকা উপায়ন বা উপঢৌকনরূপে গ্রহণ করা। এই নয়টি বিষয় কোশবৃদ্ধির হেতু।

নিম্নলিখিত আটটি উপায় কোশক্ষয়ের হেতু বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে, যথা-(১) প্রতিবন্ধ, (২) প্রয়োগ, (৩) ব্যবহার, (৪) অবস্তার, (৫) পরিহাপণ, (৬) উপভোগ, (৭) পরিবর্তন ও (৮) অপহার।

প্রতিবন্ধ তিন প্রকার হইতে পারে, যথা—(১) যে রাজগ্ৰাহ করাদি সিদ্ধ হইয়াছে, অর্থাৎ যাহার আদায় করার সময় আসিয়াছে, তাহার অসাধন বা আদায়ের উপায় নিৰ্দ্ধারণ না করা; বা, (২) সেই সিদ্ধ করাদি উৎপন্ন হইলেও তাহা স্বহস্তে না আনা; বা, (৩) আবার তাহা স্বহস্তেপ্ৰাপিত হইলেও নিবন্ধপুস্তকে লিখাইয়া রাজভাণ্ডারে প্রবেশ না করান। এই প্রতিবন্ধ-দোষে (কোশক্ষয় ঘটিলে অপরাধী অধিকারীকে) ক্ষয়াংশের দশগুণ দণ্ড দিতে হইবে।

রাজকোশে প্রবেশ্য দ্রব্যসমূহ বৃদ্ধি বা সুদের জন্য প্রয়োগ করার নাম প্রয়োগ (অর্থাৎ অধিকারী যদি এমন দ্রব্য সুদে লাগাইয়া সুদটা স্বয়ং ভোগ করে, তাহা হইলেই ইহা এ স্থলে যথার্থ প্রয়োগ নামে কথিত হইবে)। রাজপণ্য দ্বারা ব্যবহার বা ক্রয়বিক্রয়ারূপ ব্যবহার করার নাম ব্যবহার (অর্থাৎ এইরূপ ব্যাপার করিয়া অধিকারী কিছু অর্থ উপাৰ্জন করিয়াও লইতে পারেন)। এই দুইটির (প্রয়োগ ও ব্যবহারের) দোষে (কোশক্ষয় ঘটিলে অপরাধী অধিকারীকে) তাহার লব্ধ ফল বা মুনাফার দিগুণ দণ্ড দিতে হইবে।

অবস্তার দুই প্রকার হইতে পারে, যথা-(১) করাদি গ্রহণেরু নির্দ্দিষ্ট কাল প্ৰাপ্ত হইলেও, (উৎকোচাদির লোভে যদি অধিকারী) ইহাকে অপ্ৰাপ্ত বলিয়া ধাৰ্য্য করিয়া লয়েন, অথবা, (২) অপ্ৰাপ্ত কালকে (দ্বেষবশত:) প্ৰাপ্ত বলিয়া ধাৰ্য্য করিয়া লয়েন। এই অবস্তার-দোষে (কোশক্ষয় ঘটিলে অপরাধী অধিকারীকে) ক্ষয়াংশের পাঁচগুণ দণ্ড দিতে হইবে।

(যদি কোনও যুক্তপুরুষ) (১) নিয়ত বা নিৰ্দ্ধারিত আয় কমাইয়া দেন, অথবা, (২) নিয়ত বা নিৰ্দ্ধারিত ব্যয় বাড়াইয়া ফেলেন, তাহা হইলে এই উভয়প্রকার দোষের নাম পরিহাপণ হয়। এই পরিহাপণ-দোষে (কোশক্ষয় ঘটিলে অপরাধী অধিকারীকে) ক্ষতির চতুগুণ দণ্ড দিতে হইবে।

(রত্ন, সার, ফন্তু ও কুপ্য) এই সমস্ত রাজ্যদ্রব্য যদি কোন যুক্তপুরুষ স্বয়ং উপভোগ করেন, বা অন্যদ্বারা সেগুলি উপভোগ করান, তাহা হইলে এই দুই প্রকার দোষকে উপভোগ বলা যায়। এই সমস্ত দ্রব্যের উপভোগসম্বন্ধে এইরূপ দণ্ডের ব্যবস্থা আছে-রত্নের উপভোগে বিধদণ্ড, সারদ্রব্যের উপভোগে মধ্যম সাহস দণ্ড, এবং ফন্তুদ্রব্য ও কুপ্যদ্রব্যের উপভোগে অপরাধী যুক্তপুরুষকে সেই উপভুক্ত দ্রব্য ফিরাইয়া দিবার এবং তৎপরিমাণ মূল্যও দিতে তাঁহাকে বাধ্য করিবার দণ্ড দিতে হইবে।

সেইরূপ অন্য কোন দ্রব্য বদল দিয়া রাজেন্দ্রব্য স্বয়ং গ্রহণ করার নাম পরিবর্তন। এই দোষে উপভোগাদোষেরই দণ্ড অপরাধীর উপর বিহিত হইবে। সিদ্ধ বা প্ৰাপ্ত আয় (যদি কোন যুক্তপুরুষ) নিবন্ধপুস্তকে আরোপিত না করেন, কিংবা নিবন্ধ অর্থাৎ পুস্তকে আরোপিত ব্যয় (নির্দ্দিষ্ট ব্যক্তিকে) না দেন, এবং হস্তগত নীবী “পাওয়া যায় নাই’ বলিয়া অপলাপ করেন, তাহা হইলে এই তিন প্রকার দোষের নাম অপহার হইবে। এই অপহার-দোষে অপরাধী যুক্তপুরুষ বা অধিকারীকে ক্ষয়াংশের বারগুণ দণ্ড দিতে হইবে।

যুক্তগণের পক্ষে চল্লিশ প্রকারের (রাজ্যদ্রব্যাদি) হরণের উপায় হইতে পারে, যথা-(১) যাহা (অর্থাৎ ধান্যাদি) পূর্বে আদায় করা হইয়াছে, কিন্তু, তাহা পরে (হিসাবপুস্তকে) প্রবেশিত হইয়াছে (অর্থাৎ মধ্যবৰ্ত্তী সময়ে তাহা যুক্ত দ্বারা উপভুক্ত হইয়া থাকিবে); (২) যাহা পরে প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহা পূর্বে আদায় করা হইয়াছে বলিয়া লিখিত হইয়াছে; (৩) যাহা (করাদি) গ্রহণ করিতে হইবে, তাহা (ঘুষ খাইয়া) আদায় করা হয় না; (৪) যাহা (ব্রাহ্মণাদি হইতে) গ্রহণ করা উচিত নহে, তাহা (বলপূর্ব্বক) আদায় করা; (৫), যাহা প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহা পাওয়া যায় নাই বলা, বা পুস্তকে তদ্রুপ লিখিয়া রাখা; (৬) যাহা পাওয়া যায় নাই, তাহা প্ৰাপ্ত হইয়াছে বলিয়া দেওয়া বা তদ্রুপ নিবন্ধপুস্তকে লিখিয়া রাখা; (৭) অল্প (করাদি) আদায় করিয়া বেশী লিখিয়া রাখা; (৮) বেশী (করাদি) আদায় করিয়া অল্প পাওয়া গিয়াছে বলিয়া লিখিয়া রাখা; (৯) এক বস্তু (যেমন, গম,) প্ৰাপ্ত হইয়াছে, কিন্তু, অপর বস্তু (যেমন, জোয়ার) প্ৰাপ্ত হইয়াছে বলিয়া লিখিয়া রাখা; (১০) এক ব্যক্তির নিকট হইতে প্ৰাপ্ত বস্তুকে অপর ব্যক্তির নিকট হইতে প্ৰাপ্ত বলিয়া নির্দেশ করা; (১১) (রাজাদির আজ্ঞাতে) যাহা (সুবর্ণাদি) অন্যকে দেওয়া উচিত, তাহা না দেওয়া, এবং যাহা দেওয়া উচিত নহে তাহা দেওয়া; (১২) যাহা কোন বিশিষ্ট কালে (যেমন, যজ্ঞাদিসময়ে) দিতে হইবে তাহা তখন না দেওয়া, এবং বিশিষ্ট কালে যাহা দিতে হইবে তাহা অকালে দেওয়া; (১৩) অল্প ধনাদি (যেমন, ৫০ টাকা) দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু বেশী টাকা (যেমন, ১০০ টাকা) দেওয়া হইয়াছে বলিয়া লিখিয়া রাখা; (১৪) বেশী ধন দিয়া অল্প ধন নিবন্ধপুস্তকে লিখিয়া রাখা (অর্থাৎ যেমন, ১০০ টাকা রাজকোশ হইতে লইয়া ৮০ টাকা গ্রাহককে দিয়া যুক্তপুরুষ নিজে ২০ টাকা অপহরণ করিয়াছেন।); (১৫) এক বস্তু দিতে হইবে (এইরূপ আজ্ঞা পাইয়াও), অন্য বস্তু দেওয়া হইয়াছে বলিয়া লিখিয়া রাখা; (১৬) একজনকে যাহা দেওয়া হইয়াছে, তাহা অপরজনের নামে নিবদ্ধ করা হইয়াছে; (১৭) যাহা উসুল করা হইয়াছে, তাহা জমা দেওয়া হয় নাই; (১৮) যাহা উসুল করা হয় নাই, তাহা জমা করা হইয়াছে; (১৯) যে সব কুপ্য দ্রব্য (বস্থাদি) ক্রয় করা হইয়াছে, কিন্তু, যাহার মূল্য দেওয়া হয় নাই, তাহার মূল্য দেওয়া হইয়াছে বলিয়া (নিবন্ধে) প্রবিষ্ট করা হইয়াছে; (২০) যে বস্তুর মূল্য দেওয়া হইয়াছে, তাহার মূল্য দেওয়া হয় নাই বলিয়া (নিবন্ধে) লিখিত হইয়াছে; (২১) বহু লোক হইতে একত্র-গ্ৰাহ (পিণ্ডকরাদি), বিক্ষিপ্ত ভাবে নামে নামে গৃহীত বলিয়া (নিবন্ধপুস্তকে) লিখিত; (২২) যাহা বিক্ষিপ্তভাবে অর্থাৎ পৃথক পৃথক লইতে হইবে তাহা সংক্ষিপ্তভাবে অর্থাৎ একত্র মিলাইয়া গ্রহণ করা হইয়াছে বলিয়া লিখিত; (২৩) মহামূল্য বস্তুকে অল্প মূল্য বস্তু লইয়া পরিবর্তন করা বা বদল লংওয়া; (২৪) অল্প মূল্য বস্তুকে মহামূল্য বস্তু লইয়া পরিবর্তন করা; (২৫) বস্তুর নির্দ্দিষ্ট মূল্য বাড়াইয়া দেওয়া; (২৬) বা, সেই মূল্য কমাইয়া দেওয়া; (২৭) (কৰ্ম্মকরদিগের) কৰ্ম্মদিনের সংখ্যা বাড়াইয়া লেখা; (২৮) অথবা, সেই দিনসংখ্যা কমাইয়া লেখা; (২৯) সংবৎসরের মাস-সংখ্যা গণনায় বৈষম্য বিধান করিয়া, লেখা (যেমন, যে বৎসর অধিমাসরহিত তাহাকেও অধিমাসযুক্ত বলিয়া ধরিয়া লওয়া); (৩০) অথবা, মাসের দিন-সংখ্যার গণনায় বৈষম্য বিধান করিয়া লেখা (যেমন, যে মাস কম দিনে পূর্ণ হইবে না, তাহাকেও কম দিনবিশিষ্ট বলিয়া ধরিয়া লওয়া); (৩১) (কৰ্ম্মক্ষেত্রে) উপস্থিত কৰ্ম্মকরগণের সংখ্যায় বৈষম্য ঘটান (অর্থাৎ কৰ্ম্মকর সংখ্যা বেশী ধরিয়া, অধিক ধূত নামের জন্য তাহাদের উক্ত বেতন নিজে অপহরণ করা); (৩২) এক আয়মুখ হইতে উৎপন্ন ধনাদি অন্য আয়মুখ হইতে উৎপন্ন বলিয়া বৈষম্য ঘটান; (৩৩) ব্ৰাহ্মণাদি ধাৰ্ম্মিক জনের প্রতি (রাজাজ্ঞায় প্রদেয় ধন হইতে কিঞ্চিৎ অপহরণ করা; (৩৪) কোন কাৰ্য্যের সম্পাদনবিষয়ে বৈষম্য ঘটান (যেমন, অন্য ব্ৰাহ্মণেরাই কেবল নদী প্রভৃতি বিনামূল্যে পার হইয়াছে এইরূপ মিথ্যা কথনদ্বারা তরদেয় ধন স্বয়ং অপহরণ করা); (৩৫) পিণ্ড বা একসঙ্গে আদায়যোগ্য ধনাদিসম্বন্ধে (উৎকোচাদি লইয়া কাহাকেও বাদ দিয়া ধন গ্রহণরপ) বৈষম্য ঘটান; (৩৬) ব্ৰাহ্মণাদি বর্ণবিষয়ক আয় সম্বন্ধে, অথবা, (সুবর্ণাদির) বর্ণসম্বন্ধে, বৈষম্য উৎপাদন করা; (৩৭) (দ্রব্যের) নিয়তমূল্যে বৈষম্য ঘটাইয়া (লাভের অংশ স্বয়ং গ্রহণরূপ) অপহরণ; (৩৮) মানের অর্থাৎ তুলাদণ্ডাদির বৈষম্য ঘটান (যেমন, কৃমি মান দিয়া দ্রব্য মাপিয়া দেওয়া ও বেশী মান দিয়া দ্রব্য মাপিয়া লওয়া ইত্যাদি); (৩৯) ওজন করাইতে বৈষম্য উৎপাদন করা ও (৪০) ভাজন বা পাত্র সম্বন্ধীয় বৈষম্য ঘটান (যেমন, উপযুক্ত পাত্রসহযোগে ঘৃতাদি দ্রব্য না মাপিয়া ছোট পাত্রদ্বারা তাহা মাপা)।

(যুক্তকর্তৃক রাজধান) অপহরণের এই (চল্লিশ প্রকার) উপায়গুলি নিৰ্দ্ধারিত হইল।

উক্ত হরণোপায়সম্বন্ধে কোন যুক্তের উপর (হরণে,) সন্দেহ উপস্থিত হইলে, (রাজা) উপযুক্ত অর্থাৎ সেই যুক্তের উপরিস্থ অধিকারী, নিধায়ক অর্থাৎ রাজধানরক্ষক, নিবন্ধক (নিবন্ধপুস্তকের লেখক), প্রতিগ্রহীতা, দায়ক (করাদির দানকারী), দাপক (যে রাজপুরুষ করাদির আদায়কারী), মন্ত্রী (রাজার তৎতদবিভাগীয় ধী সচিব) ও সেই মন্ত্রীর কৰ্ম্মকরদিগের প্রত্যেককে (ভিন্ন ভাবে) জিজ্ঞাসাবাদ করিবেন (অর্থাৎ অপরাধী যুক্তের দোষসম্বন্ধে তদন্ত বসাইবেন)। তাহারা অর্থাৎ এই সাক্ষীরা মিথ্যা কথা বলিলে, তাহাদিগের প্রতি (অভিযুক্ত) যুক্তৈর বা অধিকারীর সমান দণ্ড বিহিত ইহবে। এবং (রাজা) সব এলাকায় এইরূপ ঘোষণা করাইবেন—“অমুক অধিকারী পুরুষদ্বারা যাহারা উপহত বা পীড়িত হইয়াছে, তাহারা (উপস্থিত হইয়।) আবেদন করুক।” যে ব্যক্তি (যুক্তকৰ্ত্তক অপহরণের) প্রজ্ঞাপন করিবে, তাহাকে, যতখানি ধনাদি তাহার উপহত হইয়াছে তাত খানি ধনাদি (অপর ধী যুক্ত হইতে লইয়া) দেওয়াইতে হইবে। কোন যুক্তের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উপস্থাপিত হইলে, সে যদি সে-সব অস্বীকার করে এবং ইহার একটি মাত্র অভিযোগ (সাক্ষিপ্রভৃতি দ্বারা) প্রমাণিত হওয়ায় সেই যুক্ত পরাজিত হয়, তবে তাহাকে সব অভিযোগেই দোষী সাব্যস্ত করা হইবে; এবং তজন্য তাহাকে সব অভিযোগের জন্যই যথাভাগ দণ্ড দিতে হইবে। অনেক অভিযোগের নির্ণয়ে বৈষম্য উপস্থিত হইলে (অর্থাৎ কতক অভিযোগ সত্য বলিয়া স্বীকৃত হইলে, আর কতক অভিযোগ অসত্য বলিয়া অস্বীকৃত হইলে), অপরাধীকে সেই বিপ্রতিপন্ন সব অভিযোগসম্বন্ধে সাক্ষিপ্রশ্নাদির অবসর দিতে হইবে।

(প্রজ্ঞাপিত) অর্থাপহরণ বড় বড় রকমের হইলে, যদি (সাক্ষিপ্রভৃতি দ্বারা) অল্প ধনসম্বন্ধীয় অপহরণও যুক্তের বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়, তাহা হইলে তাহাকে সর্বপ্রকার অপহরণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হইবে, এবং তজজন্য তাহাকে সব অপরাধের অনুরূপ যথাভাগ দণ্ড বহন করিতে হইবে।

যুক্তদ্দ্বারা সংঘটিত প্রতিঘাত বা অর্থপহরণ সম্বন্ধে কোন সূচক (গুপ্তভাবে সংবাদের সূচনাকারী) কৃতাবস্থা বা (প্ৰাড বিবাক কর্তৃক) কৃতাহবান হইয়া, যদি সে সুচিত অৰ্থ বা বিষয় প্রমাণিত করিয়া দিতে পারে, তাহা হইলে সে (অপহৃত ধনের) ষষ্ঠাংশ লাভ করিবে, এবং যদি সেই সূচনাদায়ক ব্যক্তি (সেই যুক্তের) ভূত্য হয়, তাহা হইলে সে দ্বাদশাংশ পাইবে। অনেক প্রকার দ্রব্য সম্বন্ধে অভিযোগ হইলেও, যদি (সূচক) অল্প দ্রব্য সম্বন্ধে অভিযোগ প্রমাণিত করিতে পারে, তাহা হইলে প্রমাণিত অংশ হইতেও সে (উক্তরূপ ষষ্ঠ) ভাগ লাভ করিবে। সূচক অভিযোগ প্রমাণিত করিতে না পারিলে, তাহাকে শারীরিক দণ্ড, অথবা, নগদ অর্থদণ্ড ভোগ করিতে হইবে, এবং (সরকার-পক্ষ হইতে) সে কখনও কোন অনুগ্রহ পাইবে না।

(সুচকের সুচিত) অভিযোগ সিদ্ধ হইয়া গেলে, (সূচক) সেই বাদ বা মোকদ্দমার বিরাম ঘটাইতে পারে এবং নিজেকে সেই অভিযোগের বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া লইতে পারে [ ভট্টস্বামীর টীকার মতে “সুচিত অর্থের সংসিদ্ধি ঘটিলে, সূচকের (সূচকত্ররূপ) অপবাদ অন্যের উপর চাপাইয়া দিতে হইবে এবং সূচক তখন নিজে সেখানে উপস্থিত ছিল না-এইরূপ রটাইয়া দিবে”—এইরূপ ব্যাখ্যাও হইতে পারে। ]। অভিযোগের বিষয়ীভূত যুক্তের উপজপে (অৰ্থাৎ উৎকোচাদি গ্রহণের দোষে) পতিত হইয়া (মিথ্যা বচনে প্রবৃত্ত হইলে) সূচককে বধদণ্ড প্ৰাপ্ত হইতে হইবে ॥ ১।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে যুক্তদ্দ্বারা অপহৃত সমূদয়ের প্রত্যানয়ন-নামক অষ্টম অধ্যায় (আদি হইতে ২৯ অধ্যায়) সমাপ্ত।

.

নবম অধ্যায়
২৭শ প্রকরণ-উপযুক্তগণের পরীক্ষা

(এই প্রকরণে যুক্ত-নামক অধিকারীদিগের উৰ্দ্ধতন অধিকারী যাঁহারা, তাঁহারাই উপযুক্ত-নামে কথিত এবং তাঁহারাই সম্ভবতঃ পরবর্ত্তীকালের গুপ্তসাম্রাজ্যের যুগে উপরিক-নামে পরিচিত হইতেন।) (প্রথম অধিকরণের ৫ম প্রকরণে উক্ত) অমাত্যসম্পদযুক্ত সর্ব প্রকার অধ্যক্ষদিগকে (যুক্ত ও উপযুক্তনামক অধিকারী:দিগকে) তাঁহাদের কৰ্ম্মশক্তি বুঝিয়া সৰ্ব্ব কৰ্ম্মে নিযুক্ত করা উচিত। মানুষের চিত্ত স্বভাবতঃ অব্যবস্থিত হইয়া পড়ে, এই জন্য (রাজা) অধ্যক্ষগণকে তৎতৎকাৰ্য্যে নিযুক্ত করিয়া তাহাদের দোষগবেষণারূপ পরীক্ষা করাইবেন। কারণ, কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইলে মানুষ (স্বভাবতঃ সুশীল হইলেও) বিকারগ্রস্ত হইয়া পড়ে, তাই মানুষকে অশ্বের সমান ধৰ্ম্মবিশিষ্ট বলা যায় (অর্থাৎ রথ বহনাদি কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইবার পূর্বে শান্ত বলিয়া প্রতিভাত অশ্বগণ তৎকাৰ্য্যে নিয়োজিত হইলে কখনও যেমন বিকারপ্রাপ্ত হয়, মানুষও তেমনি কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইলে বিকারপ্রাপ্ত হয়-সুতরাং তাহাদের চরিত্রের পরীক্ষা বাঞ্ছনীয়)।

সেই কারণে, (রাজা) এই অধ্যক্ষগণসম্বন্ধে, কৰ্ত্ত (অধিকারী পুরুষ), করণ (নিম্নবৰ্ত্তী কৰ্ম্মকরগণ, অথবা কাৰ্য্যের অনুষ্ঠানোপায়), দেশ, কাল, কাৰ্য্য, প্রক্ষেপ (কাৰ্য্যের জন্য ব্যবস্থিত মূলধনাদি) ও উদয় (ধনীলাভ)-এই সব বিষয়ে সব তথ্য জানিবেন। তাঁহারা (অধ্যাক্ষেরা) প্রভুর আজ্ঞানুসারে (সৰ্ব্বদা) অসংহত হইয়া (অর্থাৎ পরস্পর একসঙ্গে জটলা না করিয়া) ও পরস্পর অবিরোধী থাকিয়া কাৰ্য্য করিবেন; কারণ, তাহারা পরস্পর সংহত বা মিলিত হইলে (রাজার কৰ্ম্মফল) ভক্ষণ (অর্থাৎ অপহরণ) করিতে পারেন, এবং পরস্পর বিগ্রহ বা বিরোধ করিলে (কৰ্ম্মফল) নষ্ট করিতে পারেন। আপদের প্রতীকার ব্যতীত অন্য কোন কাজই তাঁহারা স্বামী বা রাজাকে না জানাইয়া আরম্ভ করিবেন না। কোনও কাৰ্য্যে তাঁহাদের (অধ্যক্ষদিগের) কোনরূপ প্রমাদ ঘটিলে, (রাজা) তাঁহাদের উপর অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা করিবেন, এবং এই দণ্ড তাহাদিগের দৈনিক বেতনের ও কৰ্ম্মনাশজনিত ক্ষতির দ্বিগুণ পরিমাণ হইবে (মতান্তরে, “তাঁহাদের দৈনিক বেতনের জন্য যাহা খরচ হয়, তাহার দ্বিগুণ”-এইরূপ ব্যাখ্যাও প্রদত্ত হইয়া থাকে)।

এই অধ্যক্ষগণমধ্যে যিনি রাজার আদিষ্টরূপ রাজকাৰ্য্য সম্পাদনা করিবেন, অথবা, তাহা হইতেও অধিকতর বিশেষভাবে তাহা সম্পাদন করিবেন, তিনি রাজার নিকট হইতে পদোন্নতি ও সৎকার লাভ করিবেন।

প্ৰাচীন আচাৰ্য্যদিগের (অথবা, কৌটিল্যের নিজ গুরুর) মতে, যে উপযুক্ত (বা অধ্যক্ষ)। অল্প ধন উপাৰ্জন করিয়া বেশী ব্যয় করেন, তিনি (রাজার্থ) ভক্ষণ করেন (অর্থাৎ তিনি রাজা ও প্রজার অর্থে জীবিকা চালান) এবং যিনি ইহার বিপরীতভাবে চলেন অর্থাৎ বেশী ধন উপাৰ্জন করিয়া অল্প ব্যয় করেন, কিংবা আয়ের অনুসরূপ ব্যয় করেন। তিনি (রাজার্থ)। ‘ভক্ষণ করেন। না। কিন্তু, কৌটিলা স্বয়ং এই মত পোষণ করেন না,-তিনি মনে করেন যে, গুপ্তচরদ্বারাই (উপযুক্তদিগের) অর্থবিষয়ক দুষ্টতা ও অদুষ্টতা জানিয়া লইতে হইবে।

যে উপযুক্ত রাজার সমুদয় বা ধনোৎপত্তির নৃত্যুনতা বিধান করেন, তিনি রাজার্থ ভক্ষণ করেন। তিনি যদি আজ্ঞান প্রভৃতি দোষে এই জপ ধনহানি ঘটান, তাহা হইলে (রাজা) তাহাকে তাঁহার অপরাধানুরূপ সেই ক্ষতি যথাগুণ (অর্থাৎ দ্বিগুণ, ত্ৰিগুণ বা অধিক গুণ) পূরণ করিয়া দিতে বাধ্য করাইবেন।

যে উপযুক্ত (প্রজা হইতে নিয়ত আয়ের অপেক্ষায়) দ্বিগুণ আয় উত্থাপন করেন, তিনি নিশ্চিতই জনপদ বা জনপদবাসী দিগকে ভক্ষণ করেন (অর্থাৎ অত্যধিক আয় উদ্ভাবন করিয়া প্রজাদিগের পীড়ন করেন)। তিনি যদি উদ্ভাবিত সমস্ত রাজার্থ (রাজ-সরকারে) আনিয়া দেন, তাহা হইলে তাঁহার অপরাধ অল্প ভাবিয়া তাহাকে (ভবিষ্যতে প্রজাপীড়নপূর্ব্বক যেন বেশী অর্থ আদায় না করা হয়, এই বলিয়া) প্রতিষেধ করিয়া দেওয়া উচিত; কিন্তু, অপরাধ গুরুতর হইলে, তাঁহার উপর তদনুরূপ দণ্ড বিধান করিতে হইবে।

যে উপযুক্ত ব্যয়-জন্য নিয়ত অর্থ, (ব্যয় না করিয়া) আয়ে পরিণত করিয়া দেখান, তিনি রাজপুরুষ বা কৰ্ম্মকরদিগকে ও রাজকাৰ্য্য ভক্ষণ করেন (অর্থাৎ কৰ্ম্ম না করাইয়া লোকের ও রাজকাৰ্য্যের নাশ বিধান করেন)। কোন কাৰ্য্যের জন্য কৰ্ম্ম-দিবসের সংখ্যা, সেই কাৰ্য্যের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এবং কৰ্ম্মকর পুরুষদিগকে দেয় বেতন তিনি যদি অপহরণ করেন, তাহা হইলে তাঁহাকে যথাপরাধ দণ্ড ভোগ করিতে হইবে (অর্থাৎ কৰ্ম্ম নাশিত হওয়ায় রাজার যাহা ক্ষতি হইবে তাঁহাকে তাহা পূরণ করিয়া দিতে হইবে)।

সেই কারণে, যে উপযুক্ত বা অধ্যক্ষ রাজার যে অধিকরণে (কাৰ্যবিভাগে শাসনকাৰ্য্যে নিযুক্ত আছেন, তিনি সেই) বিভাগের কৰ্ম্মের যথাস্থিতি, ইহার আয় ও ব্যয়, এই সব বিষয় বিস্তৃত ও সংক্ষিপ্তভাবে (রাজাকে) নিবেদন করিবেন।

যে উপযুক্ত বা অধ্যাক্ষেরা মূলহরী, তাদাত্বিক ও কদৰ্য্য তাঁহাদিগকে রাজা (মূলহরণাদিরূপ) কাৰ্য্য করিতে নিষেধ করিবেন (অথবা, তাহাদিগকে স্বনিয়োগ হইতে পদত্যাগ করাইবেন)।

যিনি পিতৃপৈতামহ সম্পত্তি অন্যায়পূর্ব্বক ভক্ষণ করেন। তাঁহাকে মূলহর বলা হয়। যিনি যাহাই প্রত্যহ লাভ করেন তাহাই ভক্ষণ করিয়া ফেলেন, তাঁহাকে তাদাত্বিক বলা হয়। (আর), যিনি নিজের ভূত্যদিগকে ও নিজকে পীড়িত করিয়া অৰ্থ বাড়ান, তাঁহাকে কদৰ্য্য বলা হয়। এই প্রকার উপযুক্ত যদি (বন্ধুবান্ধবপ্রভৃতি) পক্ষবলে বলীয়ান থাকেন, তাহা হইলে (তাহাদিগের কোপনিষেধের জন্য)। তাহার উপর অর্থদণ্ড প্রয়োগ করিয়া, তাহার ধন গ্রহণ করা উচিত নহে। ইহার বিপৰ্য্যয়ে (অর্থাৎ তাঁহার নিজপক্ষীয় বন্ধুবান্ধব না। থাকিলে) তাঁহার সূর্বস্ব কাড়িয়া লওয়া উচিত।

যে কদৰ্য্য (উপযুক্ত) মহান অর্থলাভে অবস্থিত থাকিয়, সেই অর্থের সন্নিধান, অবনিধান বা অবস্রাবণ ঘটান, অর্থাৎ তিনি যদি সেই অর্থ নিজ বাড়ীতে ভূমিগৰ্ত্তে বা অন্যস্থানে গূঢ়ভাবে স্থাপন করিয়া রাখেন, অথবা, পৌরজনপদদিগের নিকট রক্ষার্থ তাহা (গোপনে) রাখিয়া দেন, অথবা শক্রির দেশে (কাহারও নিকট) পাঠাইয়া সেখানে জমা করিয়া রাখেন, তাহা হইলে সত্রি-নামক গূঢ়পুরুষ, তাঁহার (সেই কদৰ্য্য উপযুক্তের) মন্ত্রী (মন্ত্রণাদাতা), মিত্র, ভূত্য ও বান্ধবপক্ষ ও তাঁহার দ্রব্যসমূহের আগমন (আয়) ও গমন (ব্যয়)-সম্বন্ধে সব বিষয় উপলব্ধি করবে।

যে কদৰ্য (উপযুক্ত) রাজার শত্রুর দেশে (দ্রব্যাদির) সঞ্চারণ করিবেন, সত্ৰী (গূঢ়পুরুষ) তাহার সহিত মিল দিয়া (অর্থাৎ তাহার মিত্র বা ভৃত্য সাজিয়া) তাহার অভিসন্ধির গুপ্ত রহস্য জানিয়া লইবে। তাহার অভিসন্ধি এইভাবে জানা গেলে পর, (রাজা) শক্রদেশ হইতে প্রেরিত কোন শাসন বা লেখ্য প্ৰাপ্তির ছল করিয়া তাহাকে বধ করাইবেন (অর্থাৎ কুষ্টভাবে এমন লেখ্য প্রস্তুত করান হইবে, যেন শত্রুরাজা সেই কদৰ্য্যকে লিখিতেছেন যে, তাহার প্রেরিত ধন তিনি পাইয়াছেন এবং অবশিষ্ট কিস্তি তিনি যেন শীঘ্ব পঠাইয়া দেন।–এবং সেই লেখ্য রাজা তাহার নিজ হস্তগত করিয়া প্রখ্যাপন করিবেন)।

সেই জন্য, (সমস্ত বিভাগের) অধ্যক্ষগণ (রাজার ধনসম্বন্ধ) কাৰ্য্যকলাপ সংখ্যায়ক (গাণনিক বা আয়-ব্যয়ের হিসাব-রক্ষক), লেখক, রূপদৰ্শক (ধাতুময় মুদ্রার পরীক্ষক), নীবীগ্রাহক (আয়-ব্যয়ের অবশিষ্ট নীবীগ্রহণে অধিকৃত পুরুষ) ও উত্তরাধ্যক্ষ (অর্থাৎ রাজকৰ্ম্মচারীদিগের কাৰ্য্যনিরীক্ষণকারী প্রধান অধিকারী)-এই সমস্ত কৰ্ম্মচারীর সহিত একত্রে মিলিত হইয়া সম্পাদন করিবেন। উক্ত উত্তরাধ্যক্ষগণ, (, অত্যন্ত তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন হইয়াও বৃদ্ধ হওয়ায়) হস্তী, অশ্ব ও রথে আরোহণ করিয়া স্ব স্ব কাৰ্য্য সম্পাদনা করিবেন। তাঁহাদের (উত্তরাধ্যক্ষগণের) শিষ্যেরা কৰ্ম্মকৌশল ও শৌচযুক্ত হইয়া উক্ত সংখ্যায়ক প্রভৃতির (কাৰ্য্যপ্রবৃত্তি পরীক্ষার জন্য) গুপ্তচরের কাৰ্য্য করিবে।

সর্ব প্রকার অধিকরণ (যুক্ত ও উপযুক্তগণের কার্য্যস্থান) রাজা এমনভাবে স্থাপন করিবেন যেন ইহাতে অনেক মুখ্য বা প্রধান কৰ্ম্মচারী থাকিবেন (অর্থাৎ তাঁহাদের সংখ্যা বেশী থাকিলে পরস্পরের ভয়ে রাজার্থের অপহরণ সম্ভবপর হইবে না) এবং ইহাতে কৰ্ম্মচারীরা নিত্য বা চিরস্থিত থাকিবে না (অর্থাৎ তাহারা যেন এক কাৰ্য্য হইতে কাৰ্য্যান্তরে বদলী হইতে পারে, কারণ, বেশী দিন এক কাৰ্য্যে নিযুক্ত থাকিলে তাহারা নিজ নিজ দোষ লুকাইয়া চলিবার উপায় উদ্ভাবন করিতে পারিবে এবং সেইজন্য রাজার্থ অপহৃত হইবার সম্ভাবনা থাকিবে)।

কোন ব্যক্তির জিহ্বাতলে স্থিত মধু বা বিষ যেমন (অল্প হইলেও) সে ইহার আস্বাদন করিবে না বলিলেও আস্বাদন না করিয়া থাকিতে পারে না, তেমন রাজার অর্থ-বিষয়ে ব্যাপৃত কৰ্ম্মচারীও স্বল্প হইলেও রাজার্থ আম্বাদন (ভোগ) না করিয়া থাকিতে পারে না।৷ ১।৷

মৎস্যসকল জলের মধ্যে চলাচল করার সময়ে জল পান কৱিলেও যেমন তাহা অন্যের জানা সম্ভবপর নয়, তেমন রাজার অর্থকাৰ্য্যৱ্যাপারে নিযুক্ত যুক্তগণও (কাৰ্য্যকালে) ধন অপহরণ করিলে তাঁহা (রাজার পক্ষেও) জানা সম্ভবপর নহে। ২।৷

এমন কি, আকাশে উডায়মান পক্ষিসমূহের গতিও জানা যাইতে পারে, তথাপি কাৰ্য সম্পাদন করার সময়ে গুপ্তভাবে কাৰ্য্যকারী যুক্তিগণের গতি জানা যায় না। (অর্থাৎ তাহাদের অপহরণ দুর্বোধ্য হইয়া পড়ে) ॥ ৩ ॥

(অতএব) রাজা, যে সব কৰ্ম্মচারীরা অপহৃত ধনদ্বারা সমৃদ্ধ হইয়াছে তাহাদিগের নিকট হইতে সেই ধন কাড়িয়া লইবেন এবং তাহাদিগকে কৰ্ম্মসম্বন্ধে বিপৰ্য্যন্ত করিবেন (অর্থাৎ উচ্চ কৰ্ম্ম হইতে নীচ কৰ্ম্মে নিযুক্ত করিবেন), যাহাতে তাহারা (আর) রাজার্থ ভক্ষণ করিতে না পারে এবং ভক্ষিত অর্থও উগড়াইয়া দিতে পারে।৷ ৪।৷

(যে-সব অর্থচর কৰ্ম্মচারীরা) রাজার্থ ভক্ষণ (অর্থাৎ অপহরণ) করে না, বরং ন্যায়তঃ ইহার বৃদ্ধি করিয়া থাকে, রাজার প্রিয় ও হিতকাৰ্য্যে রত, সেই সব কৰ্ম্মচারীদিগকে (তিনি) নিত্যাধিকারে (অর্থাৎ স্থির অধিকারে) নিযুক্ত রাখিবেন।৷ ৫।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে উপযুক্তপরীক্ষা-নামক নবম অধ্যায় (আদি হইতে ৩০ অধ্যায়।) সমাপ্ত।

.

দশম অধ্যায়
২৮শ প্রকরণ-শাসন বা রাজলেখের বিধান

পত্ৰাপিত বিষয়ের নামই শাসন বলিয়া (আচাৰ্য্যগণ) বলিয়া থাকেন। রাজার (কাৰ্য্যনির্বাহের জন্য শাসন বা লেখ্যোর উপরই নির্ভর করিয়া থাকেন) কারণ, (যাড গুণ্যের মধ্যে বিশেষত:) সন্ধি ও বিগ্রহবিষয়ক সব কাৰ্য্যেই শাসনমূলক বিবেচিত হয় (অর্থাৎ সন্ধি ও বিগ্রহাদি কাৰ্য্য লেখ্য দ্বারাই সম্পাদিত হইয়া থাকে)।

এই কারণে, এমন ব্যক্তি (শাসনের) লেখক (নিযুক্ত) হইবেন যিনি অমাত্যগুণসম্পদবিশিষ্ট, যিনি সৰ্ব্ব প্রকার (বর্ণ ও আশ্রমের) আচার বিষয়ে অভিজ্ঞ, যিনি শীঘ্ব বাক্যরচনায় নিপুণ, যিনি সুন্দর হস্তাক্ষর দ্বারা লিপি লিখিতে জানেন, এবং ধিনি (সুস্পষ্টভাবে) লেখ-পঠনেও সমর্থ। এবস্তৃত লেখক রাজাদ্বারা উক্ত সন্দেশ (বাচিক বার্তা) অব্যগ্রচিত্তে শ্ববণ করিয়া এমনভাবে লেখ রচনা করিবেন যেন লেখের অর্থ নিশ্চিত বা সুবিবেচিত বলিয়া বুঝা যায়, এবং সেই লেখ যদি কোন রাজার সম্বন্ধে রচিত হয়, তাহা হইলে তাহাতে সেই রাজার দেশ, ঐশ্বৰ্য্য, বংশ ও নামের সসম্মান নিদ্দেশ থাকিবে, এবং ইহা অনীশ্বর বা অপ্রভু (অমাত্যাদি–) সম্বন্ধে রচিত হইয়া থাকিলে, তাহাতে তাঁহার দেশ ও নামের উপচার বা সন্মানসূচক নিদ্দেশ থাকিবে।

(লেখককে) রাজকাৰ্য্যবিষয়ে যাঁহার সম্বন্ধে লেখা রচনা করিতে হইবে তাহার জাতি (ব্রাহ্মণত্বাদি), কুল (বংশ), স্থান (সান্ধিবিগ্রহিকাদি অধিকার), বয়স, শাস্ত্রজ্ঞান, কৰ্ম্ম (বৃত্তি), ঋদ্ধি (ধনসম্পত্তি), শীল (সদাচার), দেশ (নিবাস-স্থান), কাল ও বিবাহসম্বন্ধ উত্তমরূপে পৰ্য্যালোচনা করিয়া, এবং সেই পুরুষের (উত্তম, মধ্যম বা অধম পদের) অনুরূপভাবে, সেই লেখা রচনা করিতে হইবে ॥ ১।৷

প্রত্যেক লেখ বা শাসনের ছয়টি গুণ থাকা আবশ্যক, যথা-(১) অর্থক্রম, (২) সম্বন্ধ, (৩) পরিপূর্ণতা, (৪) মাধুৰ্য্য, (৫) ঔদার্ঘ্য ও (৬) স্পষ্টত্র।

তন্মধ্যে, (১) অর্থক্রমরূপ লেখাগুণের লক্ষণ এইরূপ :-যথার্থভাবে বিষয়ের ক্রমরক্ষা, অর্থাৎ প্রধান অর্থের বা বিষয়ের সন্নিবেশ সর্ব প্রথমে করা (অর্থাৎ তৎপর অপ্রধান বিষয়ের নিরূপণ)।

প্রস্তুত বা প্রকৃত বিষয়ের উপরোধ বা বাধা না ঘটে, এমনভাবে পরবর্তী বিষয়ের নিরূপণ লেখের শেষপৰ্য্যন্ত চালাইয়া যাওয়ার নাম (২) সন্মন্ধ।

(৩) পরিপূর্ণতাগুণ এই ভাবে সিদ্ধ হয় :-(। লেখরচনায়) অর্গ, পদ ও অক্ষরসমূহের ন্যানত বা অতিরিক্ততা না থাকা; হেতু (উপপত্তি), উদাহরণ (শাস্বীয় সামঞ্জস্যাদির কথন) ও দষ্টান্ত (লৌকিক নিদর্শন) দ্বারা বিষয়ের নিরূপণ; এবং পদব্যবহারে অশিথিলতা অর্থাৎ যেখানে একটি বাক্য প্রয়োগ করা উচিত, সেখানে কেবলমাত্র একটি পদদ্বারা অর্থ প্রকাশের চেষ্টা না করা।

যাহাতে সুগম ও সুন্দর অর্থ প্রতিপাদিত হইতে পারে এমন শব্দপ্রয়োগের নাম (৪) মাধুৰ্য্য। অগ্ৰাম্য (গ্ৰাম্যতাদোষ-বিবৰ্জিত) শব্দের প্রয়োগের নাম (৫) ঔদাৰ্য্য। সুপ্রসিদ্ধ শব্দের প্রয়োগের নাম (৬) স্পষ্টত্র।

অকারাদি বর্ণের সংখ্যা ত্ৰিষষ্টি (৬৩)-অর্থাৎ হ্রস্ব, দীর্ঘ ও পুতি ভেদে স্বরবর্ণের সংখ্যা ২২, ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে স্পর্শবর্ণের ২৫, আন্তঃস্থ বর্ণের গু, অনুসঙ্গার, বিসর্গ, জিহ্বামূলীয় ও উপন্ধানীয়ের ৪, উষ্মবর্ণের। ৪ ও যমপেক্ষরের ৪,–মোট ৬৩)।

বর্ণসংঘাত বা বর্ণের সমবায়ের নাম পদ। এই পদ চারি প্রকার যথা,-নাম, আখ্যাত, উপসর্গ ও নিপাত। তন্মধ্যে যে পদ সত্ত্ববাচী অর্থাৎ জাতি, গুণ ও দ্রব্যাবাচক, তাহার নাম নাম। যে পদ ক্রিয়াবাচক এবং যাহা (স্ট্রীপুংসাদি–) লিঙ্গবিশেষশূন্য, তাহার নাম আখ্যাত। যে ‘প্র’-প্রভৃতি শব্দ ক্রিয়ার বিশেষ অর্থ দ্যোতনা করে, তাহাদের নাম উপসর্গ। ‘চ’-প্রভৃতি অব্যয় শব্দের নাম নিপাত। যে পদসমূহ দ্বারা পূর্ণ বা নিরাকাজক্ষ অর্থ বুদ্ধিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই পদসমূহের নাম বাক্য। পরবর্তী পদের অর্থ অনুসরণ করিয়া, কমপক্ষে একটি ও বেশীপক্ষে তিনটি পদ লইয়া বর্গ (সমাস; মতান্তরে, বিরাম বা অবসান) বিহিত হইতে পারে। কোন লেখের পরিসমাপ্তি সূচনার জন্য, ‘ইতি’-শব্দ (অর্থাৎ যদি লেখে আর কিছু বলিবার অবশিষ্ট না থাকে) থাকিবে, অথবা, (অর্থাৎ কিছু আরও গোপনীয় বিষয় বলিবার থাকিলে) ইহার (অর্থাৎ লেখহরের) মুখ হইতে অবশিষ্টাংশ শ্রোতব্য-এইরূপ উক্তি থাকিবে।

নিম্নলিখিত ত্রয়োদশ প্রকারে লেখাজাত বিষয় প্রবত্তিত হইতে পারে, যথা(১) নিন্দা, (২) প্রশংসা, (৩) পৃচ্ছা, (৪) আখ্যান, (৫) অর্থনা, (৬) প্রত্যাখ্যান, (৭) উপালম্ভ, (৮) প্রতিষেধ, (৯) চোদনা, (১০) সান্তু, (১১) অভ্যর্বপত্তি, (১২) ভর্ৎসনা, ও (১৩) অনুনয় ॥ ২-৩।৷

তন্মধ্যে, কাহারও বংশ, শরীর ও কাৰ্য্যসম্বন্ধে দোষের কথা বলার নাম নিন্দ এবং এই তিন বিষয়ে গুণের কথা বলার নাম প্রশংসা। “এই কাৰ্য্য কিরূপে করা যায়”—এইরূপ জিজ্ঞাসার নাম পৃচ্ছ। “ইহা এইরূপে করিতে হইবে।”-এইরূপ উত্তর দেওয়ার নাম আখ্যান। “ইহা (অর্থাৎ কোশদণ্ডাদি) দেও”—এইরূপ যাচনার নাম অর্থনা। (যাচনাকারীকে) “ইহা দিব না।” এইরূপ নিষেধ করার নাম প্রত্যাখ্যান। “এই কাৰ্য্য আপনার অনুরূপ (যোগ্য) কাৰ্য্য নহে”-এইরূপ বলার নাম উপালম্ভ। “এইরূপ কাৰ্য্য করিও না”-এইরূপ উপদেশ করার নাম প্রতিষেধ। “ইহা করা চাই”-এইরূপ প্রেরণার নাম চোদনা। “আমিও যে, তুমিও সে, যে দ্রব্য আমার, সে দ্রব্য তোমার”-এইরূপে অনুকৃলিত করার নাম সাস্তু। কাহারও ব্যাসন বা বিপত্তির সময়ে সাহায্য প্রদানের নাম অভ্যর্বপত্তি। কাহারও আয়তি বা ভবিষ্যৎকাল দোষযুক্ত বলিয়া (অর্থাৎ ভবিষ্যৎ ভাল হইবে না বলিয়া) ভয় প্রদৰ্শন করার নাম ভর্ৎসনা। অনুনয় বা অনুরোধ তিন প্রকারের হইতে পারে, যথা(১) অর্থকরণনিমিত্তক (অর্থাৎ যে অন্যনয়। অবশ্যকরণীয় কাৰ্য্য-সম্পাদনের নিমিত্ত করা হয়), (২) অতিক্রমনিমিত্তক (অর্থাৎ যে অনুনয় কাহারও নিজের মতানুসারে। কাৰ্য্য না করায়, তদীয় কোপপ্রশমনার্থ করা হয়) ও (৩) পুরুষা দিব্যাসননিমিত্তক (অর্থাৎ যে অনুনয় কাহারও তৃত্যাদির ব্যাসন বা বিপত্তির অনুরোধে করা হয়)।

শাসন বা রাজলেখা আট প্রকার হইতে পারে, যথা-(১) প্রজ্ঞাপনা, (২) আজ্ঞা, (৩) পরিদান, (৪) পরীহার, (৫) নিসৃষ্টি, (৬) প্ৰাবৃত্তিক, (৭) প্রতিলেখ ও (৮) সর্বত্রগ।৷ ৪।৷

এই প্রজ্ঞাপনা-নামক শাসন বিবিধ প্রকার বলিয়া উপদিষ্ট হয়। ইহা এক প্রকার (দৃষ্টিদোষ অমাত্যাদির প্রতি) আবেদন, যথা—“এই (রাজানুচর) দ্বারা এইরূপভাবে (রাজা) বিজ্ঞাপিত হইয়াছেন।” (“এই মহামাত্র একটি নিধি প্ৰাপ্ত হইয়া তাহা আত্মসাৎ করিয়াছেন” ইত্যাদি); এবং (রাজাও) এইরূপ বলিয়াছেন–“যদি এই বৃত্তান্ত সত্য হইয়া থাকে, তাহা হইলে ইহা (নিধিগত ধনাদি) ফিরাইয়া দিউন”। “আপনার দ্বারা ক্রিয়মাণ কল্যাণ-কৰ্ম্মের কথা (রাজান্তিকে) বলা হইয়াছে।” (“বরকার’-স্থলে পরকারী পাঠও কোন কোন পুস্তকে দৃষ্ট হয়পরকার = শত্রুর কাৰ্য্য, এইরূপ ব্যাখ্যা হইতে পারে)। ৫।৷

যে লেখাপত্রে কাহারও প্রতি, বিশেষতঃ রাজভৃত্যদিগের প্রতি, রাজার নিগ্রহ বা অনুগ্রহররূপ আজ্ঞা নিবিষ্ট আছে, তাহাকে অজ্ঞা বলা হয়। ৬।৷

যে লেখেতে (সম্বোধ্য ব্যক্তির) যথোচিত গুণদ্বারা সংযুক্ত পূজা বা সৎকার প্রদৰ্শিত হয়, তাহার নাম পরিদান লেখা। ইহা দুই প্রকারের হইতে পারে(সম্বোধ্য ব্যক্তির) কোন (বন্ধুমারণাদি-জনিত) মনোব্যথা উপস্থিত হইলে আশ্বাস প্রদানরূপ এবং (অন্য কোনও ঘটনাতে) পরিরক্ষণরূপ দিয়াভাব প্রকাশ। এইরূপ লেখদ্বারা সম্বোধ্য ব্যক্তিকে রাজার অনুকূল করিয়া রাখা (অর্থাৎ তাহার উপগ্রহ) সম্ভবপর হয়। ৭।৷

যে লেখেতে (ব্রাহ্মণাদি) জাতিবিশেষ, নগরবিশেষ, গ্রামবিশেষ ও দেশবিশেষ-সম্বন্ধে রাজার নির্দেশানুসারে করাদির অগ্রহণরূপ অনুগ্রহ নিবিষ্ট থাকে, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি তাহাকে পরীহরি-নামক লেখ বলিয়া বুঝিয়া লইবেন।৷ ৮।৷

তাহার নাম নিসৃষ্টি লেখ যাহাতে কোন কাৰ্য্যাকরণসম্বন্ধে বা কোন কাৰ্য্যকথনসম্বন্ধে নিসৃষ্টি বা কোন আপ্ত পুরুষের প্রমাণ্যের আখ্যান স্থাপিত হুয় (অর্থাৎ “আমার বিশ্বাসী অমুক ব্যক্তির ক্রিয়া আমারই ক্রিয়া, অমুকেৰু বচন আমারই বচন’-এইরূপ উক্তি থাকে)। এই নিসৃষ্টিলেখ দুই প্রকার-বাচিক (বচনপ্ৰামাণ্যসম্বন্ধী) ও নৈসৃষ্টিক (ক্রিয়া-প্ৰামাণ্যসম্বন্ধী)। ৯।৷

শাসনসম্বন্ধে সেইরূপ শাসনের নামই প্ৰাবৃত্তিক যাহাতে দৈবী ও মানুষী এবং তত্ত্বগত প্রবৃত্তি নিবিষ্ট থাকে। (অর্থাৎ ষাহাতে অনাবৃষ্টিপ্রভৃতি অশুভ দৈবফল ও সুভিক্ষাপ্রভৃতি শুভ দৈবফলসংযুক্ত সমাচার এবং চৌরাদি ও বন্ধু প্রভৃতি দ্বারা সংঘটিত প্রতিকূল বা অনুকুল কাৰ্য্যসংযুক্ত সমাচার এবং তত্ত্বসংযুক্ত বা বাস্তব সমাচার লিপিবদ্ধ আছে)। এইরূপ প্রবৃত্তি শুভ ও অশুভাত্মক বলিয়া দ্বিবিধ হইতে পারে। ১০।৷

প্রতিলেখ বা উত্তরপ্রদায়ী লেখা রচনা করিতে হইলে (লেখককে অন্য হইতে প্ৰাপ্ত) লেখ যথাতথ্যভাবে স্বয়ং পড়িয়া ও বুঝিয়া, পরে (রাজার নিকট আবার) ইহা পড়িয়া তাহাকে শুনাইয়া, রাজার বচনানুসারে উত্তর রচনা করিতে হইবে।।১১।।

যে লেখাপত্রে রাজা পথিকদিগের জন্য তাহাদের রক্ষা, ও (অন্য প্রকার) উপকার বিষয়ে (দুর্গাপালাদি) ঈশ্বরজনকে (অর্থাৎ প্রভুত্রশালী ব্যক্তিদিগকে) ও (সমাহৰ্ত্ত-প্রভৃতি) অধিকারিজনকে আদেশ করেন, সেই লেখাপত্রের নাম সর্বত্রগ লেখ, কারণ, ইহা পথে, দেশে ও (রাষ্ট্বপ্রভৃতি) অন্য সব স্থানে প্রচারিত হইয়া থাকে ॥ ১২।

(সন্ধিবিগ্রহাদি কাৰ্য্য শাসনমূলক হইয়া থাকে এবং সেগুলি উপায়চতুষ্টয়সাপেক্ষ, সুতরাং শাসনলেখককে উপায়গুলিতে বুৎপত্তিমান থাকিতে হইবে, এই জন্য সম্প্রতি উপায়চতুষ্টয়ও কথঞ্চিৎ নিরূপিত হইতেছে। উপায় চারি প্রকার, যথা-(১) সাম, (২) উপপ্রদান, (৩) ভেদ ও (৪) দণ্ড।

তন্মধ্যে সাম পঞ্চবিধ-(১) গুণসংকীৰ্ত্তন, (২) সম্বন্ধোপাখ্যান, (৩) পরস্পরোপকারসন্দর্শন, (৪) আয়তিপ্রদৰ্শন ও (৫) আত্মোপানিধান।

এই পাঁচটির মধ্যে প্রথমতঃ গুণসংকীৰ্ত্তনের লক্ষণ প্রদত্ত হইতেছে। যে সামপ্রয়োগে (শক্রনরপতি বা অন্য কাহারও) কুল, শরীর, কৰ্ম্ম, স্বভাব, শাস্ত্রসংস্কার ও (হস্ত্যশ্বাদি) দ্রব্যাদির গুণের (‘গুণাগুণগ্রহণং” পাঠেও তদ্রুপ ব্যাখ্যা) স্বরূপাখ্যান করিয়া প্রশংসা (প্লাঘাত্মক বচন) বা স্তুতি (অবিদ্যমান গুণেরও কীৰ্ত্তন) করা হয়, তাহার নাম গুণসং যে সামপ্রয়োগে কাহারও জ্ঞাতিসম্বন্ধ (সমান কুলে জন্মসম্বন্ধ), যৌনসম্বন্ধ (বিবাহজনিত সম্বন্ধ), মৌখসম্বন্ধ (অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা হইতে উৎপন্ন সম্বন্ধ), শ্ৰেীবসম্বন্ধ (যাজ্যযাজকরূপ সম্বন্ধ-যজ্ঞের এক পাত্রবিশেষের নাম শ্ৰীর), কুলসম্বন্ধ (কুলপরম্পরায় আগত সম্বন্ধ), হৃদয়সম্বন্ধ (নিজ মনের সম্বন্ধ) ও মিত্রসম্বন্ধের (উপকারসস্তুত সম্বন্ধের) উল্লেখ করা হয়, তাহার নাম সম্বন্ধোপাখ্যান।

যে সামপ্রয়োগে স্বপক্ষ ও পরপক্ষের দ্বারা কৃত উপকারের সংকীৰ্ত্তন থাকে তাহাকে পরম্পরোপকারসঙ্গদর্শন বলা হয়।

“এই কাৰ্য্য এইরূপে করা হইলে আমাদের উভয়ের এইরূপ (শুভ) ফল হইবে।”-এই প্রকার আশা উৎপাদনা করিয়া যে সামপ্রয়োগ বিহিত হয়, তাহার নাম আয়তি প্রদৰ্শন।

“আমিও যাহা আপনিও তাহা, অর্থাৎ আমরা উভয়ে অভিন্ন, যাহা আমার দ্রব্য তাহা আপনি নিজের কাৰ্য্যে (যথেচ্ছভাবে) প্রয়োগ করিতে পারেন’–এইরূপ আত্মসমৰ্পণ্যসূচক উক্তিদ্বারা যে সামপ্রয়োগ বিহিত হয়, তাহাকে আত্মোপানিধান বলা হয়।

(ভূমিপ্রভৃতিরূপ) অর্থদ্বারা উপকার করার নাম উপপ্রদান। ইহার ভেদ দুই প্রকার, যথা-(১) (শত্রুর মনে) শঙ্কার উৎপাদন ও (২) নিভৎসন অর্থাৎ “অপকার করিব’ বলিয়া ধমক দেওয়া।

দণ্ড তিন প্রকার, যথা-(১) ব্যাপাদন বা হত্যা, (২) বন্ধন-তাড়নাদিরূপ পীড়া দেওয়া, ও (৩) অর্থের অপহরণ।

অকান্তি, ব্যাঘাত, পুনরুক্ত, অপশব্দ ও সংপ্লব-এই (পাঁচটি) লেখের দোষ।

তন্মধ্যে, কোন লেখ যদি কালিম্রক্ষিত পত্রে লিখিত হয়, অথবা, ইহার অক্ষরগুলি অসুন্দর, বা বিষম (অর্থাৎ স্থল-সূক্ষ্ম বা ছোট-বড়) বা বিরাগযুক্ত (অর্থাৎ জলপ্ৰায় মসীতে লিখিত) হয়, তাহা হইলে ইহা অকান্তি-নামক দোষদুষ্ট বলিয়া গৃহীত হয়।

পূৰ্ববৰ্ত্তী অর্থের দ্বারা পরবর্তী অর্থের বিরোধ হইলে, ইহাকে ব্যাঘাত দোষ বলা হয়।

বিনা বিশেষে উক্ত বিষয়ের দ্বিতীয়বার উচ্চারণের নাম পুনরুক্ত দোষ।

(স্ত্রীপুংসাদি) লিঙ্গ, (একবচনাদি) বচন, (ভূতাদি) কাল ও (কৰ্ম্মাদি) কারকের অন্যথা প্রয়োগের নাম অপশব্দ দোষ।

(লেখে) যেখানে বর্গ বা বিরাম রাখা আবশ্যক নয়, সেখানে বিরাম রক্ষা করা এবং যেখানে বিরাম রাখা আবশ্যক, সেখানে বিরাম না রাখা এবং উক্ত (অর্থক্রমাদি) লেখাগুণসমূহের বৈপরীত্য ঘটান হয়, তাহা সংপ্লব-নামক দোষ বলিয়া পরিগণিত।

সর্বশাস্ত্র (উত্তমরূপে) জানিয়াও (শাস্ত্রের) প্রয়োগ উপলব্ধি করিয়া কৌটিল্য রাজার প্রয়োজনে শাসন-রচনার বিধি উপদেশ করিয়াছেন। ১৩।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে শাসনাধিকারনামক দশম অধ্যায় (আদি হইতে ৩১ অধ্যায়।) সমাপ্ত।

.

একাদশ অধ্যায়
২৯শ প্রকরণ-কোশে প্রবেশযোগ্য রত্নাদির পরীক্ষা

কোশাধ্যক্ষ কোশে রক্ষণার্থ কোশ-প্রবেশযোগ্য (মণিমুক্তাদি) রত্ন, (চন্দনাদি) সার, (পটাদি) ফন্তু, ও (সারদারু প্রভৃতি ও যন্ত্রায়ুধ প্রভৃতি) কুপ্যদ্রব্যসমূহ তৎ তৎ দ্রব্যে জাত বা তৎ-সম্বন্ধ ব্যবহারে ব্যাপৃত, করণপুরুষগণের সহিত যুক্ত হইয়া (অর্থাৎ তাহাদের মতামত লইয়া) গ্রহণ করিবেন।

প্রথমতঃ মৌক্তিক বা মুক্তার পরীক্ষণ অভিহিত হইতেছে–মৌক্তিকের (দশটি) উৎপত্তি-ক্ষেত্র আছে এবং ইহাদের নামানুসারে মৌক্তিকের নাম হইয়া থাকে, যথা—(১) তাম্পেৰ্ণিক (অর্থাৎ পাণ্ড্য দেশের তাম্রাপণী নদীতে সমুদ্রসঙ্গমস্থানে উৎপন্ন), (২) পাণ্ড্যাকবাটিক (পাণ্ড্য দেশের মলয়কোটি নামক পৰ্বতে উৎপন্ন), (৩) পশিক্য (পাশিক্য নদীতে উৎপন্ন); (৪) কৌলেয় (অর্থাৎ সিংহল দ্বীপে ময়ুরগ্রামের কুলা নামী নদীতে উৎপন্ন), (৫) চাৰ্ণেয় (অর্থাৎ কেরল দেশের চুর্ণানামী নদীতে উৎপন্ন), (৬) মাহেন্দ্র (অর্থাৎ মহেন্দ্র পৰ্ব্বতের নিকটবৰ্ত্তী সমূদ্রে উৎপন্ন), (৭) কার্দমিক (অর্থাৎ পারসীকের কৰ্দমানামী নদীতে উৎপন্ন), (৮) স্রৌতসীয় (অর্থাৎ বর্বর সাগরের কুলে স্রোতসী নদীতে উৎপন্ন), (ন) হ্রদীয় (অর্থাৎ বর্বর সাগরের কুলে শ্ৰীঘণ্টনামক হ্রদে উৎপন্ন), ও (১০) হৈমন্বত (অর্থাৎ হিমালয়ে উৎপন্ন)।

মৌক্তিকের তিনটি যোনি বা জন্মস্থান হইতে পারে, যথা—(১) শঙ্খ, (২) শুক্তি ও (৩) প্রকীৰ্ণক বা বিবিধ (অর্থাৎ হস্তীর কুম্ভ, সৰ্পের মস্তক প্রভৃতি ও অন্যান্য সাধন হইতে প্ৰাপ্ত)।

মৌক্তিকের ত্রয়োদশ দোষ বলা হইতেছে, যথা-(১) মসূরক (মসূরের আকারবিশিষ্ট), (২) ত্রিপুটক (ত্রিকোণাকৃতি), (৩) কুৰ্ম্মক (কুৰ্ম্মকৃতি) (৪) অৰ্দ্ধচন্দ্রক (অৰ্দ্ধচন্দ্ৰাকার), (৫) কাণ্ডুকিত (কঙ্কুক বা ছালযুক্ত) (৬) যমক (যুগারুতি), (৭) কৰ্ত্তক (কাটা বা ছিন্ন), (৮) খরক (খরখরা) (৯) সিকথক (মোমের মত বিন্দুযুক্ত), (১০) কামণ্ডলুক (কমণ্ডলুর আকার বিশিষ্ট), (১১) শ্যাব (কপিশবর্ণ), (১২) নীল (নীলবর্ণ) ও (১৩) দুবি (অস্থানে বিদ্ধ)। এই প্রকার মৌক্তিক অপ্রশস্ত বলিয়া জ্ঞাত।

মৌক্তিকের আটটি গুণ নির্দ্দিষ্ট হইতেছে, যথা-(১) স্থূল (মোটা), (২) বৃত্ত (গোলাকার), (৩) তলরহিত (অর্থাৎ যাহা মন্থণ স্থানে অবস্থান করিতে পারে না), (৪) দীপ্তিযুক্ত, (৫) শ্বেত, (৬) গুরু (ভারী), (৭) স্নিগ্ধ (চাকচিক্যযুক্ত) ও (৮) যথাস্থানে বিদ্ধ। এই প্রকার মৌক্তিক প্রশস্ত বলিয়া ধৃত হয়।

ষষ্টি বা মুক্তার লহরীর প্রভেদ পাঁচ প্রকার, যথা-(১) শীর্ষক (যে মালার, মধ্যস্থলে একটি বড় মুক্ত এবং উভয় পার্থে সমানাকৃতি ছোট ছোট মুক্ত গ্রথিত থাকে), (২) উপশীর্ষক (যে মালার মধ্যস্থলে একটি বড় মুক্ত ও উভয় পার্থে সমানাকার ছোট ছোট মুক্ত একটি করিয়া থাকে এবং এইরূপ তিনটি তিনটি ভাগ করিয়া পূর্ণ মালা গ্রথিত হয়), (৩) প্রকাণ্ডক (যে মালার মধ্যস্থলে একটি বড় মুক্ত এবং উভয় পার্থে সমানাকার ছোট মুক্ত দুইটি করিয়া থাকে এবং এইরূপ পাঁচটি পাঁচটি ভাগ করিয়া পূর্ণ মালা গ্রথিত হয়), (৪) অবঘাটক (যে মালার মধ্যস্থলে একটি বড় মুক্ত এবং উভয় পার্থে সমানাকৃতি ক্লশ, কৃশতার মুক্ত ইত্যাদি ক্রমে মালাটি গ্রথিত হয়) ও (৫) তরলপ্রতিবন্ধ (যে মালায় সব সমানাকৃতি মুক্ত গ্রথিত থাকে)।

উক্ত প্রত্যেক প্রকারের ব্যষ্টি বা লহরীর সংখ্যা যদি ১০০৮ থাকে, তাহা হইলে তদ্দ্বারা রচিত ভূষণের নাম ইন্দ্রচ্ছন্দ। যষ্টির সংখ্যা ইহার অৰ্দ্ধ অর্থাৎ ৫.০৪ থাকিলে, ভূষণের নাম বিজয়চ্ছন্দ। ১০০ যষ্টি-সমন্বিত ভূষণের নাম দেবঢচ্ছন্দ। ইহাতে ৬৪ যষ্টি থাকিলে ইহার নাম হয় অৰ্দ্ধহার। ইহাতে ৫৪ যষ্টি থাকিলে ইহার নাম রশ্মিকলাপ। ইহাতে ৩২ যষ্টি থাকিলে ইহার নাম গুচ্ছ। ইহাতে ২৭ যষ্টি থাকিলে ইহার নাম নক্ষত্রমালা। ইহাতে ২৪ বষ্টি থাকিলে ইহার নাম অৰ্দ্ধগুচ্ছ। ইহাতে ২০ যষ্টি থাকিলে ইহার নাম মাণবিক। ইহাতে যষ্টিসংখ্যা ইহার অৰ্দ্ধ হইলে অর্থাৎ ইহাতে ১ “যষ্টি থাকিলে ইহার নাম অৰ্দ্ধমাণবিক।

উক্ত ইন্দ্রচ্ছন্দ প্রভৃতির মধ্যস্থলে মণি সংলগ্ন থাকিলে, ইহাদের নাম ইন্দ্রচ্ছন্দমাণবিক প্রভৃতি হইবে (সেইরূপ, বিজয়চ্ছন্দ-মাণবিক, দেবচ্ছন্দ-মাণবিক, অৰ্দ্ধহারমাণবিক ইত্যাদি নাম হয়)। কেবল মাত্র শীর্ষক-নামক যষ্টিদ্বারা নিৰ্ম্মিত হইলে ইন্দ্রচ্ছন্দ প্রভৃতি-নামক মৌক্তিক ভূষণের নাম হইবে শুদ্ধহার (অর্থাৎ তখন ইহার নাম হইবে ইন্দ্রচ্ছন্দ-শীর্ষক-শুদ্ধহার ইত্যাদি; তথা, বিজয়চ্ছন্দ-শীর্ষক-শুদ্ধহার ইত্যাদি)। শীর্ষকের ন্যায়। কেবল মাত্র উপশীর্ষক, প্রকাণ্ডক, অবঘাটক ও তরলপ্রতিবন্ধ-নামক যষ্টিদ্বারা নিৰ্ম্মিত হইলেও ইন্দ্রচ্ছন্দ প্রভৃতি-নামক ভূষণের পূর্ব্ববৎ নামকরণ হইবে (যথা-ইন্দ্রচ্ছন্দোপশীর্ষক-শুদ্ধহার, ইন্দ্রচ্ছন্দ-প্রকাণ্ডক-শুদ্ধহার, ইন্দ্রচ্ছন্দাবঘাটক-শুদ্ধহার, ইন্দ্রচ্ছন্দ-তরল প্রতিবন্ধ-শুদ্ধহার ইত্যাদি; তথা, বিজয়চ্ছন্দোপশীর্ষক-শুদ্ধহার, ইত্যাদি)। অৰ্দ্ধমাণবিক-নামক (দশ ব্যষ্টিসমন্বিত) মৌক্তিক ভূষণটিতে যদি (মরকতাদি) মণি মধ্যবৰ্ত্ত থাকে, এবং যদি ইহাতে তিনটি স্বর্ণফলক (বা সোনাদানা) বা পাঁচটি স্বর্ণফলক লগ্ন থাকে, তাহা হইলে ইহার নাম ফলকহার হইবে। কেবল শুদ্ধ (অর্থাৎ অন্য মণিবিহীন) একাবলী হইলে অর্থাৎ ইহাতে এক লহরী মুক্ত থাকিলে সেই মালাকে সূত্র বলা হয়। সেই একাবলী মুক্তামোলাতে মণি সংলগ্ন হইলে ইহার নাম যষ্টি হয়। হেমগুলিকা ও মণিগুলিকা গুন্ধিত থাকিলে, সেই বিচিত্র যষ্টির নাম হইবে রত্নাবলী। যে মালা ক্রমে স্বর্ণগুলিকা, (তৎপর) মণিগুলিকা ও (তৎপর) মুক্তাগুলিকা দ্বারা রচিত হয় তাহার নাম অপবৰ্ত্তক। কেবল সুবর্ণগুলিকার সহিত কোন মৌক্তিক মালা গ্রথিত হইলে, ইহার নাম সোপানক হইবে। আবার ইহার মধ্যে যদি মণিও গ্রথিত হয়, তাহা হইলে ইহার নাম মণিসোপানক হইবে।

উক্ত নিরূপণ দ্বারা মস্তক, হস্ত, পদ ও কটিদেশের উপযোগী মৌক্তিক সর বা লহরী ও সরসমূহের প্রকারভেদও ব্যাখ্যাত হইল বলিয়া বুঝিতে হইবে। (এই পৰ্য্যন্ত মৌক্তিকপ্রকরণ বলা হইল।)

মণির আকরভূমির নামানুসারে ইহা ত্ৰিবিধ হইতে পারে, যথা-(১) কৌট (মলয় সাগরের নিকটবৰ্ত্তী কোটি-নামক স্থানে উৎপন্ন), (২) মালেয়ক (মলয়দেশের কর্ণািবন্যাখ্য পর্বতমালাতে উৎপন্ন) ও (৩) পারসমুদ্রক (সমুদ্রপারে সিংহুল প্রভৃতি দ্বীপে উৎপন্ন)।

(জাতিতেদে) মণি পাঁচ প্রকার হইতে পারে, যথা-(১) সৌগন্ধিক (অর্থাৎ তন্নামক ঈষৎ-নীলাভাযুক্ত রক্তবর্ণ উৎপলের ন্যায় রঙ-যুক্ত), (২) পদ্মরাগ (পদ্মের রঙবিশিষ্ট), (৩) অনবদ্যারাগা (কুকুমবৰ্ণ) (৪) পারিজাতপুষ্পক (পারিজাত কুসুমের রঙ-যুক্ত) ও (৫) বালসুৰ্য্যক (উদীয়মান সুৰ্য্যের মত)।

বৈদূৰ্য্য আট প্রকার হইতে পারে, যথা-(১) উৎপলবৰ্ণ (লাল কমলের বর্ণবিশিষ্ট), (২) শিরীযপুষ্পক (শিরীষ পুষ্পের বর্ণবিশিষ্ট), (৩) উদক বর্ণ (জলের মত স্বচ্ছবর্ণ), (৪) বংশীরাগ (বেণুপত্রের রঙ বিশিষ্ট), (৫) শুকপত্রবৰ্ণ (শুকপক্ষীর পক্ষের মত বর্ণবিশিষ্ট), (৬) পুন্যরাগ (হরিদ্রার বর্ণবিশিষ্ট), (৭) গোমূত্রক (গোমূত্রের সমান বর্ণযুক্ত) ও (৮) গোমেদক (গোরোচনার সমান বর্ণ বিশিষ্ট)।

ইন্দ্রনীল-জাতীয় মণি আট প্রকার হইতে পারে, যথা—(১) নীলাব্রলীয় (শ্বেত হইলেও নীলধারায় তরঙ্গিত বলিয়া উপলক্ষিত, (২) ইন্দ্রনীল (ময়ূরবাহের বর্ণবিশিষ্ট), (৩) কলায়পুষ্পক (কলায় পুষ্পের রঙ যুক্ত), (৪) মহানীল (ভ্বমরবর্ণ), (৫) জাম্ববাভা (জন্তু ফলের বর্ণযুক্ত), (৬) জীমূতপ্রভ (মেঘবর্ণ), (৭) নন্দক (অন্তঃশ্বেত, কিন্তু, বহিনীলবর্ণ ও (৮) স্ববন্মধ্য (জলপ্রবাহের রশ্মিবিশিষ্ট)।

স্ফটিক-জাতীয় মণি চারি প্রকার হইতে পারে, যথা-(১) শুদ্ধস্ফটিক (অত্যন্ত শুক্লবৰ্ণ), (২) মূলাটবর্ণ (তক্রবর্ণ), (৩) শীতবৃষ্টি (চন্দ্রকান্ত = যে মণি চন্দ্রকিরণস্পর্শে দ্রবযুক্ত হয়) ও (৪) সূৰ্য্যকান্ত (যে মণি সূৰ্য্যকারসম্পর্কে অগ্নি বমন করে)। এইগুলিই মণিভেদ।

মণিসমূহের গুণ এইরূপ-(১) ছয় কোণবিশিষ্ট, (২) চারি কোণবিশিষ্ট, (৩) গোলাকার, (৪) তীব্ররাগ (গভীর বর্ণবিশিষ্ট), (৫) সংস্থানযুক্ত (অর্থাৎ ভূষণে সন্নিবেশিত হওয়ার উপযুক্ত অবয়ববিশিষ্ট), (৬) নিৰ্ম্মল, (৭) মন্থণ, (৮) গুরু (ভারী), (৯) আচ্চিত্মান (দীপ্তিমান), (১০) অন্তর্গতপ্রভ (মধ্যে চঞ্চল-প্রভাযুক্ত) ও (১১) প্রভানুলেপী (যাহা নিজ প্রভাদ্বারা নিকটস্থ বস্তুকে প্রভাযুক্ত করে)।

মণিসমূহের দোষ এইরূপ-(১) মন্দরাগ (হালকা রঙ বিশিষ্ট), (২) মন্দপ্রভ (দু্যতিহীন), (৩) সশর্কর (অর্থাৎ খরখরা বা ছোট ছোট দানাযুক্ত), (৪) পুস্পচ্ছিদ্র (যাহাতে ছোট ছোট বিন্দুরূপ ছিদ্র আছে), (৫) খণ্ডু (কাটা), (৬) দুবিদ্ধ (অস্থানে বিদ্ধ) ও (৭) লেখাকীর্ণ (দাগী বা রেখাযুক্ত),

অবান্তর-জাতীয় মণির প্রকার-ভেদ বলা হইতেছে, যথা-(১) বিমলক (শ্বেত-হরিত), (২) সম্ভক (নীল), (৩) অঞ্জনমূলক (নীল-কাল), (৪) পিত্তক (গো-পিত্তের রঙবিশিষ্ট), (৫) সুলভক (শ্বেতবর্ণ), (৬) লোহিত্যক্ষ (পৰ্য্যন্তে লাল ও মধ্যে কাল), (৭) মৃগাশ্মক (শ্বেত-কৃষ্ণ), (৮) জ্যোতীরসক (শ্বেত-রক্ত), (৯) মৈলেয়ক (হিঙ্গুলকের রঙ বিশিষ্ট), (১০) আহিচ্ছত্রক (অহিচ্ছত্র দেশে উৎপন্ন, অথবা, অহিচ্ছত্র বা ব্যাঙের ছাতার রঙবিশিষ্ট), (১১) কূপ (যাহাতে ছোট ছোট বিন্দু উঠিয়াছে অর্থাৎ যাহা শৰ্করিল), (১২) প্রতিকূৰ্প (দাগী), (১৩) সুগন্ধিকূৰ্প (মুদগবর্ণ), (১৪) ক্ষীরপক (দুগ্ধবর্ণ), (১৫) শুক্তিচুৰ্ণক (নানা বর্ণে মিলিত বা চিত্রিত, (১৬) শিলা প্রবালক (শিলা প্রবালের বর্ণযুক্ত), (১৭) পুলক (মধ্যে কৃষ্ণবর্ণ) ও (১৮) শুক্রপুলক (মধ্যে শুক্লবৰ্ণ)। অবান্তরজাতীয় মণি উক্তরূপ অষ্টাদশ প্রকারের হইতে পারে।

অবশিষ্ট প্রকারের মণিসমূহকে কাচমণি (অর্থাৎ কাচের মত নিকৃষ্ট মণি) বলা হয়।

বজ্র বা হীরকের উৎপত্তিস্থানের নামানুসারে ইহা ছয় প্রকার হইতে পারে, যথা-(১) সভারাষ্ট্রক (বিদর্ভদেশে সভারাষ্ট্র-নামক স্থানে উৎপন্ন), (২) মধ্যমরাষ্ট্রক (কোসলদেশে মধ্যমরাষ্ট্র নামক স্থানে উৎপন্ন), (৩) কান্তীররাষ্ট্রক (কাস্তীররাষ্ট্রে উৎপন্ন; ‘কাশ্মীররাষ্ট্বক’ পাঠ থাকিলে কাশ্মীররাষ্ট্রে উৎপন্ন), (৪) শ্ৰীকটনক (শ্ৰীকটন-নামক পর্বতে উৎপন্ন), (৫) মণিমন্তক (উত্তরাপথে মণিমন্তক-নামক পর্বতে উৎপন্ন) ও (৬) ইন্দ্রবানক (কলিঙ্গদেশের ইন্দ্রবাননামক স্থানে উৎপন্ন)।

খনি, জলপ্রবাহ ও (গজদন্তের মূলপ্রদেশ-প্রভৃতি) বিবিধ স্থানে হীরক উৎপন্ন হয়।

হীরকের বর্ণ বা রঙ বলা হইতেছে, যথা—(১) মার্জারাক্ষক (অর্থাৎ বিড়ালের নেত্রের সমান বর্ণবিশিষ্ট), (২) শিরীষপুষ্পক (শিরীষ পুষ্পের সমান বর্ণবিশিষ্ট), (৩) গোমূত্রক (গোমূত্রের সমান বর্ণযুক্ত), (৪) গোমোদক (গোরোচনার সমান বর্ণ), (৫) শুদ্ধস্ফটিক (স্ফটিকের মত শ্বেতবর্ণ), (৬) মূলাটীপুষ্পকবৰ্ণ (মূলাটী ফুলের রঙবিশিষ্ট) এবং (৭) উক্ত মণিবর্ণসমূহের অন্যতমবৰ্ণবিশিষ্ট।

স্কুল (মোটা), স্নিগ্ধ (চকচকে), গুরু (ভারী), প্রহারসহ (অর্থাৎ কোন কঠিন বস্তু দ্বারা প্রহৃত হইলেওঁ অভেদ্য), সমকোটিক (সমান কোণবিশিষ্ট), ভাজনলেখি (কাংস্যাদি পাত্রে লেখাদির উৎপাদক), তাকুভ্ৰামি (তকু নামক সূত্রকৰ্ত্তনযন্ত্রের মত ভ্বমণশীল) ও ভ্রাজিষ্ণু (অতিদীপ্তিমান) হীরক প্রশস্ত (উত্তম) বলিয়া গণ্য।

যে হীরক কোণশূন্য, নিরশ্রি (অর্থাৎ তীক্ষ কোণরিহিত) ও একপার্থে অধিক নিঃস্থত, তাহা অপ্রশস্ত। (অধম) বলিয়া জ্ঞাত হয়;

প্রবালের উৎপত্তি স্থান দুইটি, যথা-(১) আলকান্দক (মেচ্ছদেশের অলকান্দ-নামক সমুদ্রবৰ্ত্তী স্থানে উৎপন্ন) ও (২) বৈবণিক (যবনদ্বীপে বিবৰ্ণ-নামক সমুদ্রের একদেশে উৎপন্ন)। ইহার বর্ণও দুই প্রকার, যথা-(১) রক্ত (লাল) ও (২) পদ্মরাগ (লাল পদ্মের সমান বর্ণ)। কিন্তু, যে প্রবাল করাট বা কুসুম্ভপুষ্পের বর্ণযুক্ত (মতান্তরে, কৃমিজন্ধি-ব্যাখ্যা) ও যে প্রবাল গৰ্ভিণিকা (অর্থাৎ স্থূলমধ্য) তাহা অনুপাদেয় বলিয়া ত্যাজ্য। (এই পৰ্য্যন্ত রত্নপরীক্ষা নিরূপিত হইল)।

(সারদ্রব্যের মধ্যে সর্বাগ্রে চন্দন নিরূপিত হইতেছে)। চন্দনের উৎপত্তিস্থান ষোড়শ, ইহার বর্ণ নয়। প্রকার, ইহার গন্ধ ছয় প্রকার ও ইহার গুণ একাদশ প্রকার বলিয়া বর্ণিত হইবে, যথা—সাতনদেশে উৎপন্ন চন্দনের বর্ণ লাল ও ইহার গন্ধ (নিবসিক্ত) ভূমির সমান গন্ধবিশিষ্ট। গোশীর্ষদেশে উৎপন্ন চন্দনের বৰ্ণ কাল-তাম্র এবং ইহার গন্ধ মৎস্যের গন্ধের মত। হরিচন্দন বা হরিদেশে উৎপন্ন চন্দনের বর্ণ শুক পক্ষীর পাখার ন্যায় বর্ণবিশিষ্ট ও ইহা আম্রগন্ধযুক্ত। তাৰ্ণস (তৃণসী নামী নদীর কূলে জাত) চন্দনও হরিচন্দনের মত শুকপত্রবৰ্ণ ও আম্রগন্ধি। গ্রামেরুদেশে উৎপন্ন চন্দনের বর্ণ লাল হয়, রক্ত-কালও হয় এবং ইহার গন্ধ বস্ত বা ছাগের মূত্রের ন্যায় গন্ধবিশিষ্ট। দেবসভা-নামক স্থানে উৎপন্ন চন্দনের বর্ণ লাল ও ইহার গন্ধ পদ্মের গন্ধের মত। জাবক দেশে উৎপন্ন চন্দনও রক্তবর্ণ ও পদ্মগন্ধি। জোঙ্গদেশে উৎপন্ন চন্দন রক্তবর্ণ ও রক্ত-কাল বর্ণ, ও স্নিগ্ধ (চকচকে)। (ইহা সম্ভবতঃ পদ্মগন্ধি বলিয়া গৃহীত হইবে।)। তুরূপদেশে উৎপন্ন চন্দনও জোঙ্গক চন্দনের বর্ণাদিবিশিষ্ট। মালা-নামক স্থানে উৎপন্ন চন্দন পাণ্ডু-রক্তবর্ণ (ও সম্ভবতঃ পদ্মগন্ধি)। কুচন্দন-নামক চন্দন কাল বর্ণবিশিষ্ট ও গোমূত্রের সমানগন্ধি (কোন কোন ব্যাখ্যাকার ‘গোমূত্র’ শব্দের অর্থ “নীলোৎপল’ ধরিয়াছেন)। কালপর্বত-নামক দেশে উৎপন্ন চন্দন রূক্ষ, অগুরুর মত কালবৰ্ণ, অথবা রক্তবর্ণ, অথবা রক্ত-কালবৰ্ণ। কোশকারপর্বতে উৎপন্ন চন্দন কালবৰ্ণ, অথবা কৃষ্ণ-কাৰ্বরবর্ণ। শীতোদকদেশে উৎপন্ন চন্দন পদ্মরূর্ণ, অথবা কাল ও স্নিগ্ধ। নাগপর্বতদেশে উৎপন্ন চন্দন রূক্ষ (খরখরো), অথবা শৈবালের বর্ণবিশিষ্ট। শাকিলদেশে উৎপন্ন চন্দন কপিলবৰ্ণ (পীল ও লাল বর্ণে মিলিত)। (কালপর্বত হইতে শাকিলদেশ পৰ্য্যন্ত দেশসমূহে উৎপন্ন চন্দন সম্ভবতঃ গোমুত্রগন্ধি)।

চন্দনে নিম্নবৰ্ত্তী একাদশ গুণ থাকিতে পারে, যথা-(১) লঘু (হালকা), (২) স্নিগ্ধ (মসৃণ), (৩) অখ্যান (যাহা বিলম্বে শুষ্ক হয়), (৪) সপিস্নেহলোপী (অর্থাৎ যাহা ঘৃতের মত মসৃণভাবে শরীর লিপ্ত করে), (৫) গন্ধমুখ (গন্ধবিষয়ে মনোরম), (৬) ত্রগনুসারি (যাহা শরীরের চৰ্ম্মে প্রবেশ করিয়া সুখদায়ক), (৭) অনুষণ (যাহা সূক্ষ্মতাবশতঃ পরিস্ফুট। নহে), (৮) আবিরাগি (অর্থাৎ যাহা শরীরে মাখিলেও বর্ণ ও গন্ধ ত্যাগ করে না), (৯) উষ্ণসহ। (যাহা উষ্ণতা সহ করিতে পারে), (১০) দাহগ্ৰাহী (শরীরের সন্তাপ হরণে সমর্থ) ও (১১) সুখস্পৰ্শন (যাহা স্পর্শ করিতেও সুখকর)।

(সম্প্রতি অগুরু সম্বন্ধে বলা হইতেছে)–জোঙ্গক (কামরূপ দেশের জোঙ্গ-নামক স্থানে উৎপন্ন) অগুরু কৃষ্ণবর্ণ, কাল-কাৰ্বরবৰ্ণ, অথবা মণ্ডলচিত্রবৰ্ণ (অর্থাৎ কৃষ্ণ ও শ্বেত বিন্দুযুক্ত)। (কামরূপ দেশের) দোঙ্গ-নামক স্থানে উৎপন্ন অগুরু শ্যামবর্ণ। সমূদ্রপারে (অর্থাৎ সিংহলাদি দ্বীপে) উৎপন্ন অগুরু নানাবর্ণবিশিষ্ট। উক্ত অগুরু উশীরের বা নবমালিকার গন্ধযুক্ত হইতে পারে।

অগুরুর নিম্নবণিতরূপ (আটটি) গুণ থাকিতে পারে, যথা-(১) গুরু (ভারী), (২) স্নিগ্ধ (মসৃণ), (৩) মনোহর গন্ধবিশিষ্ট, (৪) নিৰ্ছরি (অর্থাৎ যাহার গন্ধ বহুদূর পর্য্যন্ত প্রস্থত হয়), (৫) অগ্নিসহ (যাহা অগ্নিসংযোগেও তাড়াতাড়ি দগ্ধ হয় না), (৬) অসংপ্লুতপূম (ব্যাহার ধূম সংপ্লব বা ব্যাকুলত ঘটায় না), (৭) সমগন্ধ (যাহা দাহের আদি, মধ্য ও অস্তে সমান গন্ধযুক্ত থাকে) ও (৮) বিমাদসহ। (যাহা বস্ত্রাদিদ্বারা বিমন্দিত হইলেও স্বগন্ধ ত্যাগ করে না।)

(তৈলপর্ণিক-নামক চন্দনবিশেষ বা গন্ধদ্রব্যবিশেষের নিরূপণ করা হইতেছে।) (কামরূপ দেশের)। “অশোক গ্রামে উৎপন্ন তৈলপাণিকের বর্ণ মাংসের বর্ণের মত এবং ইহা পদ্মগন্ধি (ভট্টস্বামী ব্যাখ্যা করেন যে, ইহা হরিণমাংসের পেশীর মত বৰ্ণবিশিষ্ট)। জোঙ্গ-নামক স্থানে উৎপন্ন তৈলপাণিকের বর্ণ রক্ত-পীত এবং ইহার গন্ধ উৎপল বা গোমৃত্রের গন্ধের মত। গ্রামেরুদ্দেশে উৎপন্ন তৈলপাণিক স্নিগ্ধ (মসৃণ) ও গোমূত্রগন্ধি হয়। (ইহার বর্ণ সম্ভবতঃ জোিঙ্গক তৈলপিণিকের মত রক্ত-পীত)। সুবর্ণকুড্য-নামক দেশে উৎপন্ন তৈলপাণিক রূক্ত-পীতবর্ণ ও মাতুলুঙ্গের (রুচকের) গন্ধবিশিষ্ট। পূৰ্ণকদ্বীপে উৎপন্ন তৈলপাণিক পদ্মগন্ধি বা নবনীতগন্ধি হইতে পারে, (সম্ভবতঃ ইহার বর্ণও রক্ত-পীত)। (উক্ত দেশগুলির অবস্থান কামরূপ প্রদেশে আছে বলিয়া খ্যাত হয়)। ভদ্রািত্রীয়-নামক চন্দনবিশেষ দুই প্রকার–(১) (কামরূপের) লৌহিত্য নদের পরবর্তী দেশে উৎপন্ন ভদ্রশীয় জাতি বা যুথিকা পুষ্পের বর্ণবিশিষ্ট। (২) কামরূপের) আন্তরবতী-নাম্নী নদীর তীরে উৎপন্ন ভদ্রশ্বণীয় উদ্গীরবর্ণ। এই উভয় প্রকার ভদ্রাহীয়ের গন্ধ কুণ্ঠ-নামক ঔষধের গান্ধসদৃশ।

কালেয়ক-নামক দারুবিশেষ দুই প্রকার–(১) যে কালেয়ক স্বৰ্ণভূমিতে (ব্রহ্মদেশে; মতান্তরে, সুমাত্রাদেশে) জন্মে তাহা স্নিগ্ধ (মন্ত্বণ) ও পীতবর্ণ। (২) যে কালেয়ক উত্তরপর্বতে (হিমালয়ে) উৎপন্ন হয় তাহা রক্ত-পীতবর্ণ। এই পৰ্য্যন্ত সারন্দ্রব্য-সমূহ নিরূপিত হইল।

শেষোক্ত তিন প্রকার দ্রব্যের অর্থাৎ তৈলপাণিক, ভদ্রশ্বয় ও কালেয়কের গুণ এইরূপ, যথা—ইহারা পেষণ, কৃথন (পাকিকরণ) ও অগ্নিতে ধূপন সহা করিতে পারে। (অর্থাৎ ইহাদের গন্ধ তখনও সমান থাকে); ইহারা (দ্রব্যান্তরের সহিত মিশ্রণে ও কালান্তরেও) বিকার রহিত (অর্থাৎ বর্ণাদি ত্যাগ করে না।) এবং ইহারা অন্যান্য গন্ধদ্রব্যের সহিত যোগ বা মিশ্রণের আনুকূল্য করিয়া থাকে। আরও বলা হইতেছে যে, চন্দন ও অগুরুর যত প্রকার গুণ বর্ণিত হইয়াছে ইহার তদগুণবিশিষ্ট হইয়া থাকে।

(ফল্গুদ্রব্যসমহের মধ্যে প্রথমতঃ চৰ্ম্মের নিরূপণ করা হইতেছে।)। চৰ্ম্ম (১) কান্তনবদেশে উৎপন্ন ও প্ৰৈয়দেশে উৎপন্ন এবং এই উভয় চৰ্ম্মই ঔত্তরপর্বতক (অর্থাৎ হিমালয় পৰ্ব্বতে উৎপন্ন) বলিয়া খ্যাত (সুতরাং কান্তনব ও প্রৈয়দেশ হিমালয় পৰ্ব্বতের একদেশ বলিয়া পরিজ্ঞাত)। কান্তনবচৰ্ম্ম ময়ূরের গ্রীবার সমান বর্ণ। প্ৰৈয়কচৰ্ম্ম নীল-পীত, শ্বেত এবং রেখা ও বিন্দু দ্বারা চিত্রিতও হইতে পারে। এই উভয় প্রকারের চৰ্ম্মই আট অঙ্গুলি-পরিমিত আয়ামযুক্ত।

বিষী ও মহাবিসী-নামে পরিচিত চৰ্ম্ম দ্বাদশাগ্রামে। (হিমালয় প্রদেশস্থ দ্বাদশম্লেচ্ছগ্রাম-নামক স্থানে) উৎপন্ন হয়। তন্মধ্যে যে চৰ্ম্মের কোন বর্ণবিশেষ সুস্পষ্ট প্রতিভাসিত হয় না। (অর্থাৎ যাহা বহুবর্ণের প্রতিভাসনবশতঃ অনিৰ্দ্ধারিতবর্ণ) এবং যাহা লোমযুক্ত ও চিত্র তাহার নাম বিসী। যে চৰ্ম্ম পরুষ (খরস্পর্শ) ও প্ৰায় ধবলবৰ্ণ তাহার নাম মহাবিসী। এই উভয় প্রকারের চৰ্ম্মই দ্বাদশ আঙ্গুলি-পরিমিত আয়ামবিশিষ্ট। 0

আরোহাজ (অর্থাৎ আরোহ-নামক হিমালয় প্রদেশে উৎপন্ন) চৰ্ম্ম পাঁচ প্রকার হইতে পারে, যথা-(১) শ্যামিকা, (২) কালিকা, (৩) কদলী, (৪) চন্দ্ৰোত্তর ও (৫) শাকুলা। তন্মধ্যে যে চৰ্ম্ম কপিলবৰ্ণ বা বিন্দুদ্ধারা চিত্রিত তাহার নাম শুষ্ঠামিকা। যে চৰ্ম্ম কপিলবৰ্ণ বা কপোতবর্ণ তাহার নাম কালিকা। উক্ত দুই প্রকারের চৰ্ম্মই আট অঙ্গুলি-পরিমিত আয়ামযুক্ত। কদলী-নামে পরিচিত চৰ্ম্ম খারস্পর্শ ও একহস্ত আয়ত হয়। এই কদলী চৰ্ম্মই যদি চন্দ্ৰাকার মণ্ডলদ্বারা চিত্রিত হয়, তাহা হইলে ইহার নাম চন্দ্ৰোত্তর হইয়া থাকে। শাকুলা-নামক চৰ্ম্ম কদলী চৰ্ম্মের এক-তৃতীয়াংশ পরিমিত আয়ামবিশিষ্ট (অর্থাৎ আট অঙ্গুলিপরিমিত আয়ামযুক্ত; মতাম্বরে, কদলীর তিনগুণ আয়ামবিশিষ্ট); ইহা কোঠনামক রোগবিশেষে শরীরে উৎপন্ন গোলাকার মণ্ডলের ন্যায় মণ্ডলদ্বারা চিত্রিত ও স্বভাবসঞ্জাত গোলাকার গ্রন্থিযুক্ত আজিনবৎ (মৃগাচৰ্ম্মের মত)। চিত্রিতও থাকে।

বাহ্লব-নামক (হিমালয়ের) এক প্রদেশবিশেষে উৎপন্ন চৰ্ম্ম তিন প্রকার হইয়া থাকে, যথা—(১) সামুর, (২) চীনসী ও (৩) সামুলী। (তন্মধ্যে) সামূত্র চৰ্ম্ম ছয়ত্ৰিশ অঙ্গুলি-পরিমিত আয়ামবিশিষ্ট ও ইহার বর্ণ অঞ্জনবৎ কাল। চীনসী চৰ্ম্ম লাল-কাল বা পাণ্ডু-কাল হইয়া থাকে। সামুলী চৰ্ম্ম গোধূমের বর্ণবিশিষ্ট (শেষোক্ত দুই প্রকার চৰ্ম্মের আয়াম ছয়ত্ৰিশ অঙ্গুলি)।

উদ্র-নামক (জলচর) জন্তুর চৰ্ম্ম তিন প্রকার হইয়া থাকে, যথা-(১) সাতিনা, (২) নলতুলা ও (৩) বৃত্তপুচ্ছ। সাতিনা চৰ্ম্ম কৃষ্ণবর্ণ। নলতুলা চৰ্ম্ম নলতুলের (অর্থাৎ নলতৃণের তুলার মত শ্বেত) বর্ণবিশিষ্ট। এবং বৃত্তপুচ্ছ চৰ্ম্ম কপিল–“ বর্ণ। এই পৰ্য্যন্ত চৰ্ম্মের বিবিধ জাতির নিরূপণ করা হইল।

চৰ্ম্মের মধ্যে যাহা মৃদু (মোলায়েম), স্নিগ্ধ (চকচকে) ও বহুলোমবিশিষ্ট তাহাই শ্রেষ্ঠ বলিয়া বুঝিতে হইবে।

অবি বা মেষের লোম হইতে উৎপাদিত (কম্বলাদি) দ্রব্য শ্বেত, সম্পূর্ণ লাল ও আংশিক লাল হইয়া থাকে। আবিক (বস্ত্ৰাদি) (১) খচিত (অর্থাৎ সুচিবানকৰ্ম্মদ্বারা নিম্পাদিত), (২) বানচিত্র (বানকৰ্ম্মম্বারা যাহাতে বৈচিত্ৰ্য সাধিত হইয়াছে), (৩) খণ্ড-সংঘাত্য (অর্থাৎ বুনট-করা বহু বহু খণ্ড একত্রিত করিয়া নিম্পাদিত) ও (৪) তন্তুবিচ্ছিন্ন (অর্থাৎ যাহাতে বুননসময়ে কতক তন্তু ছাড়িয়া দিয়া জালীর মত করা হইয়াছে)।

আবিক (বস্ত্ৰাদি) সাধারণতঃ দশবিধ হইতে পারে, যথা—(১) কম্বল, (২) কেচপক (‘কৌচপক’ পাঠও দৃষ্ট হয়, ইহা জঙ্গলে গোপালকের শিরস্ত্রাণ হিসাবে ব্যবহার করিয়া থাকে), (৩) কলমিতিকা(‘কুলমিতিকা’ পাঠও দুষ্ট হয়; ইহা হাতির উপরে দেওয়ার আস্তরণ বা ঝুল, অথবা হাতির উপরে রক্ষিত অম্বারীর নীচে বিছাইবার আস্তরণবিশেষ), (৪) সৌমিতিকা (ইহা একপ্রকার কৃষ্ণবৰ্ণ কলমিতিক-বিশেষ এবং ইহাও গজপৰ্য্যাণের উপর বিছাইবার আস্তরণ), (৫) তুরগান্তরণ (ঘোড়ার পিঠে বিছাইবার আস্তরণ), (৬) বর্ণক (রঙ্গীন কম্বল), (৭) তলিচ্ছক (‘তলিত্থক’ পাঠও দৃষ্ট হয়; ইহাও বিছানায় বিছাইবার কম্বলবিশেষ), (৮) বারবাণ (কম্বলনিৰ্ম্মিত গাত্রে পরিধানোপযোগী কফুকাদি), (৯) পরিস্তোম (ইহাও এক প্রকার কম্বল-নিৰ্ম্মাণবৈচিত্র্যবশতঃ? যাহা বিস্তৃত্যুবৎ অবিভাসিত হয়; মতান্তরে, কুথ বা গালিচাবিশেষ) ও (১০ত) সমন্তভদ্রক (সন্নাহপাট্রবিশেষ; মতান্তরে, হস্তি-প্রভৃতির জঘনত্ৰাণ)।

যে আবিক পিচ্ছিল (শ্রীক্ষ বা চিকন) ও আর্দ্রবৎ প্রতীয়মান এবং যাহা সূক্ষ্ম ও মৃদু-সেই প্রকার আবিক শ্রেষ্ঠ।

আট খণ্ড জোড়া দিয়া নিৰ্ম্মিত কৃষ্ণবর্ণের কম্বলভেদের নাম ভিঙ্গিসী, ইহা বৃষ্টিরোধের সাধক। অপসারক-নামক কম্বলও বর্ষবারণ, কিন্তু, ইহা খণ্ড কাপড় জোড়া দিয়া নিৰ্ম্মিত হয় না, একখণ্ড কাপড় হইতেই নিৰ্ম্মিত হয়। এই দুই প্রকার কম্বলবিশেষ নেপাল দেশজাত।

মৃগরোম হইতে উৎপন্ন কাপড় ছয় প্রকার হইতে পারে, যথা-(১) সম্পূটিকা (জভঘাত্ৰাণ বা জাজিঘয়াবিশেষ), (২) চতুরশ্রিকা (চৌকোণ কম্বলবিশেষ, ইহাতে দশা বা পাড় থাকে না এবং ইহার কোণগুলি নয় অঙ্গুলি-পরিমিত চিহ্নযুক্ত থাকে,), (৩) লম্বর (প্রচ্ছাদনার্থ ব্যবহৃত পট্টবিশেষ), (৪) কটবানক (মোটা সূত্রদ্বারা নিৰ্ম্মিত বস্ত্রবিশেষ), (৫) প্ৰাবরক (চাদর বিশেষ) ও (৬) সন্তলিকা (আস্তরণবিশেষ)।

দুকুল বা ক্ষৌমবস্ত্র (সিদ্ধ-কাপড়) তিন প্রকার বাঙ্গক, পৌণ্ডক N সৌবর্ণকুড্যক। তন্মধ্যে বঙ্গদেশে উৎপন্ন দুকূল শ্বেতবর্ণ ও স্নিগ্ধ (মসৃণ) হয়; পুণ্ড দেশে (উত্তরবঙ্গে) উৎপন্ন দুকুল শ্যামবর্ণ ও মণির মত স্নিগ্ধ হয়; এবং (ব্রহ্মদেশের বা সুমাত্রা-দ্বীপের) সুবর্ণকুড্য-নামক স্থানে উৎপন্ন দুকুল সুৰ্য্যের দু্যতির মত বৰ্ণবিশিষ্ট হয়। উক্ত দুকুলগুলির বান বা বুনন সম্বন্ধে বলা হইতেছে; যথা—দুকুল (১) মণিমিগ্ধোদকবান হইতে পারে (অর্থাৎ এই প্রকার দুকুলের ত গুপ্রভৃতি জলে ভিজাইয়া, পরে মণিবন্ধদ্বারা সেগুলি ঘর্ষণ করিয়া তন্দ্বারা ইহা বুনট করিতে হয়), (২) চতুরাশ্রবান হইতে পারে (অর্থাৎ যে দুকূল তানায় শু বানে এক প্রকার সূত্রদ্বারাই প্রস্তুত হয়), এবং (৩) ব্যামিশ্রবান হইতে পারে (অর্থাৎ যে দুকুল কার্পাস তন্তুর সহিত কৌশেয়ক তন্তু প্রভৃতি মিশাইয়া তৈয়ার করা হয়; অথবা, যাহা ভিন্ন ভিন্ন বর্ণবিশিষ্ট সূত্রদ্বারা তৈয়ার করা হয়)।

এই দুকুলগুলির মধ্যে যাহা একাংশুক, অর্থাৎ তানা ও বানে এক প্রকার তন্তুদ্বারা নিৰ্ম্মিত (তাহাই সূক্ষ্মতাবশতঃ প্রশস্ত)। আবার, দুকুল অদ্ব্যৰ্দ্ধাংশুকও হইতে পারে অর্থাৎ যাহার তানায় দুই সুত্র এবং বানে একসূত্র থাকে; অথবা, যাহার তানায় একসূত্র ও বানে দুই সুত্র থাকে, এবং দ্ব্যাংশুক, ত্র্যাংশুক ও চতুরংশুকও হইতে পারে (অর্থাৎ যে দুকুল তানায় ও বানে দুই, তিন ও চারিটি সূত্রদ্বারা নিৰ্ম্মিত হয়-সুতরাং শেষোক্ত তিন প্রকার দুকুল উত্তরোত্তর স্থূল হইবে)।

ইহাদ্বারা কাশী দেশে ও পুণ্ড, দেশে উৎপন্ন ক্ষৌমও (রেশমী বস্তুও) ব্যাখ্যাত হইল। (অর্থাৎ সেগুলিও একাংশুকাদি হইতে পারে)।

পত্ৰোৰ্ণ বা ধৌতকৌশোয় তিন দেশে উৎপন্ন হয়, যথা (১) মাগধিক (মগধদেশে জাত), (২) পৌণ্ডিকা (পুণ্ড দেশে জাত) ও (৩) সৌবর্ণকুভ্যাকা (সুবর্ণকুড্যদেশে জাত) (বৃক্ষপত্রে কৃমির লালা হইতে উর্ণা উৎপন্ন হয়)। এই পত্রোর্ণার উৎপত্তিস্থান চারি প্রকার বৃক্ষ যথা-(১) নাগবৃক্ষ, (২) লিকুচ, (৩) বকুল ও (৪) বট। নাগবৃক্ষে জাত পত্রোর্ণ পীতবর্ণ, লিকুচবৃক্ষে জাত পত্রোর্ণ গোধূমাবর্ণ, বকুলবৃক্ষে জাত পত্রোর্ণা শ্বেতবর্ণ ও অবশিষ্টটি অর্থাৎ বটবৃক্ষে জাত পত্রোর্ণা নবনীতবর্ণ হইয়া থাকে।

উক্ত পত্রোর্ণাসমূহ-মধ্যে সৌবর্ণকুড্যক পত্রোর্ণা শ্রেষ্ঠ। পত্রোর্ণার বর্ণনাদ্বারা অন্য কৌশোয় (রেশম) বস্ত্র ও চীনদেশে উৎপন্ন চীনপট্টও ব্যাখ্যাত হইল (অর্থাৎ ইহাদেরও যোনি ও বর্ণ পত্ৰোৰ্ণার সমান বুঝিতে হইবে)।

কাপাসিক বা কাপাসিশস্ত্রজাত বস্ত্ৰাদি নিম্নবণিত সাত দেশে উৎপন্ন হইলে শ্ৰেষ্ঠ বলিয়া গণনীয়, যথা—(১) মাধুর— (মধুরা পাণ্ড্যদেশের রাজধানী; অথবা, বিখ্যাত মথুরা-নগরীতে উৎপন্ন), (২) অপরান্তক (অপরান্ত বা কোঙ্কণাদেশে উৎপন্ন), (৩) কালিঙ্গক (কলিঙ্গদেশে উৎপন্ন), (৪) কাশিক (কাশীদেশে উৎপন্ন), (৫) বাঙ্গক (বঙ্গদেশে উৎপন্ন), (৬) বাৎসক (বৎসদেশে বা কৌশাম্বীদেশে উৎপন্ন) ও (৭) মাহিষক (কুন্তলদেশের রাজধানী মাহিষ্মতীতে; মতান্তরে, মহীশূরে উৎপন্ন)।

(মুক্তাপ্রভৃতি হইতে মুরম্ভ করিয়া কার্প্যাসিক পৰ্য্যন্ত) যত প্রকার রত্নদ্রব্যাদি পূর্ব্ব উক্ত হইয়াছে তদাতিরিক্ত অন্যান্য রত্বেরও প্রমাণ, মূল্য, লক্ষণ, জাতি, রূপ, নিধান (রক্ষণপ্রকার), এবং নবকৰ্ম্ম (অর্থাৎ আকরজাত দ্রব্যাদি হইলে ইহাদের শোধন, বোধন ও ঘর্ষণাদি কৰ্ম্ম), তথা পুরাতন বস্তুর প্রতিসংস্কার (অর্থাৎ নবীকরণ), কৰ্ম্মগুহা (অর্থাৎ রত্নাদির রঞ্জনঘৰ্ম্মণাদি কৰ্ম্মরহস্য), উপস্কার (রত্নাদি কৰ্ম্মের উপযোগী শাণাদি উপকরণ দ্রব্য), দেশ ও কালানুসারে ইহাদের উপভোগ ও (দ্রব্যাদির) নাশকারী (মূর্ষিকাদি) হিংস্র প্ৰাণীর প্রতীকার-সম্বন্ধে সব বিষয় (কোশাধ্যক্ষকে) জানিতে হইবে ॥ ১-২ ॥

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষ প্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে কোশে প্রবেশ্য রত্নপরীক্ষা-নামক একাদশ অধ্যায় (আদি হইতে ৩২ অধ্যায়) সমাপ্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *