০২. শঠে শাট্যং সমাচরেৎ – দ্বিতীয় খণ্ড

দ্বিতীয় খণ্ড – শঠে শাট্যং সমাচরেৎ

প্রথম পরিচ্ছেদ
সন্ধানে

রেবতী যতই কেন বুদ্ধিমতী হউন না, জুমেলিয়ার প্রতারণ-জলে ছিন্ন করা তাহার সাধ্যাতীত। যে লোক সংবাদ আনিয়াছিল, সে পাহারাওয়াল-পুলিশের লোক—বিশেষতঃ সেখানকার থানার ও রামকৃষ্ণ বাবুর তাঁবের; তাহাকে রেবতী কি প্রকারে সন্দেহ করিবেন? যদি সন্দেহের কিছু পাকিত, শচীন্দ্র পূৰ্ব্বেই চুটিয়া আসিয়া তাহাকে প্রকৃত সংবাদ জানাইত; কিন্তু তাহা না করিয়া সেই শচীন্দ্রই যখন তাঁহাকে যাইবার জন্য পত্র লিথিয়াছে, তখন আর রেবতীর অবিশ্বাসের
কারণ কোথায়?
আরও একটা বিশেষ চিন্ত দেবেন্দ্রবিজয়ের মস্তষ্ক একেবারে অস্থির করিয়া তুলিল; শচীন্দ্র এখনও ফিরিল না কেন, জুমেলিয়া কি প্রকারে তাহার প্রত্যাগমনে বাধা ঘটাইল?
পত্ৰখানি—যাহা শচীন্দ্রের লিখিত বলিয়া স্থিরীকৃত, সম্পূর্ণরূপে জাল; অবিকল শচীন্দ্রের হস্তলিপি, বেবতী তাহাতে সহজেই প্রবঞ্চিত হইয়াছেন। যাহাতে সামান্তমাত্র সন্দেহের সম্ভাবনা না থাকে, এইজন্য ষড়যন্ত্রকারীরা শচীন্দ্রের প্রস্থানের পর আরও একঘণ্টা সময় অপেক্ষা করিয়া, শচীন্দ্রের নামে জাল পত্র লিখিয়া আনিয়া রেবতীর হস্তে অর্পণ করিয়া থাকিবে।
কি ভয়ানক জটিল চাতুরী! এখন—এমন –সময়ে—এই বিপৎকালে দেবেন্দ্রবিজয় অপেক্ষা করিয়া থাকা ভিন্ন আর কি করিবেন? গায়ের জোরে রাস্তার ছুটিয়া বাহির হইলেই বা কি হইবে – কি উপকার দর্শিবে? কাহাকে উপায় জিজ্ঞাসিবেন? দেবেন্দ্রবিজয় অপেক্ষা আর কে এ
সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞাত আছে?
কাজেই তখন তাঁহাকে অপেক্ষা করিতে এবং কি করিবেন, তাহাই ভাবিয়া ঠিক করিয়া লইতে হইল।
দেবেন্দ্রবিজয় ভাবিতে লাগিলেন, “অসম্ভব। শচীন্দ্রকে জুমেলিয়া এই দিনের বেলায় কখনই নিজের করায়ত্ত করিতে সক্ষম হয় নাই, অন্ত কোন কৌশলে তাকে মিথ্যানুসরণে দুরে ফেলেছে; তাই সে এখনও ফিরে নাই; পিশাচী জুমেলিয়া সহজে স্বকাৰ্য্য সমাধা করেছে; আপাততঃ কোন সুবিধার অপেক্ষায় থাকা আমার কর্তব্য।”
কিয়ৎক্ষণ পরে শ্ৰীশচন্দ্র ৩৫নং পাহারাওয়ালাকে সমভিব্যাহারে লইয়া উপস্থিত হইল।
দেবেন্দ্রবিজয় সেই পাহারাওয়ালাকে “তুমি এইখানে বস; এখনই আমি আসছি, বলিয়৷ শ্ৰীশচন্দ্রকে লইয়া কক্ষান্তরে গমন করিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, “শ্ৰীশ, কি বুঝলে?”
“এ সে লোক নয়।”
“আমিও তা জানি।”
“এর নাম আবদুল।”
“তুমি একে চেন কি ?”
“ভাল রকম চিনি, ছেলেবেলা থেকে ওকে দেখে আসছি।”
“চেষ্টা করলে তোমার উপরে কিছু চালাকি চালাতে পারে কি?”
“না।“
* * * * *
দেবেন্দ্রবিজয় বৈঠকখানাগৃহে তখনই ফিরিলেন। পাহারাওয়ালাকে জিজ্ঞাসিলেন, “আবদুল, আড়াইঘণ্টা পূৰ্ব্বে তুমি কোথায় ছিলে?”
পাহারাওয়ালা বলিল, “বাড়ীতে মশাই।”
“কোথায় তোমার বাড়ী?”
“এই রাজার বাগানে ৷”
“আজ কোন জিনিষ তুমি হারিয়েছ?”
“ই মহাশয়, আমার চাপ্‌রাসখানা।”
“কখন—কেমন ক’রে হারালে?”
“তখন আমি ঘুমুচ্ছিলেম, একজন লোক এসে আমার স্ত্রীর নিকটে চাপ্‌রাসখানা চায়, তাতে আমার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞাসা করে, কোন চাপ্‌রাস?”
“যেখানা পাহরাওয়ালা সাহেব মেরামত করতে দিবে বলেছিল।”
“তিনি এখন ঘুমাচ্ছেন’, আমার স্ত্রী তাকে বলে।”
“তাতে সে বলে ‘আজ আমার হাত খালি আছে, চাপ্‌রাসথান ঠিকঠাক ক’রে ফেলব; এর পর পেরে উঠব না; আজ সন্ধ্যার পরেই অনেক কাজ আসবে; চাপ্‌রাস কি—একমাস আমি আর কোন কাজ হাতে করতে পারব না; যদি পার, খুঁজে বের করে এনে দাও, ছ’ঘণ্টার মধ্যে আমি ঠিক ক’রে দিয়ে যাব।’ আমার স্ত্রী তাকে তখন আমার চাপ্‌রাস খানা বের ক’রে দেয়।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “ইহার মধ্যে তুমি কোন লোককে তোমার চাপ্‌রাস মেরামতের কথা বলেছিলে?”
পাহারাওয়ালা! হাঁ। এ বড় মজার কথা দেখছি।
দেবেন্দ্র। কি রকম?
পা। তার পর যখন আমার ঘুম ভাঙে, আমার স্ত্রী আমাকে সকল কথাই বললে। কিছুদিন হ’ল, আমি নীলু মিস্ত্রীকে আমার চাপ্‌রাসটা পালিস করে দিতে বলেছিলেম, তাতে ভাবলেম, নীলু মিস্ত্রীই চাপ্‌রাসখানা নিয়ে গেছে।
দে। ভাল, তার পর?
পা। আমি তখনই নীলু মিস্ত্রীর কাছে যাই, সে আমার কথা শুনে একেবারে আশ্চৰ্য্য হ’য়ে গেল; চাপরাসের কথা সে কিছুই জানে না।
দে। যে লোকটা তোমার স্ত্রীর কাছ থেকে চাপ্‌রাসখানা নিয়ে গিয়ে ছিল, তার চেহারা কেমন—তোমার স্ত্রী সে বিষয়ে কিছু বলতে পারে?
পা। তাই ত বলছি মশাই, বড়ই মজার কথা! আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সে যে চেহারার কথা বললে, তাতে নীলু মিস্ত্রীকেই বেশ বুঝায়।
দে। তুমি এখন কি বুঝছ?
পা। বুঝব আর কি? আমি দশ বৎসর নীলু মিস্ত্রীকে দেখে আসছি, সে খুব ভাল লোক; সে যেকালে কালীর দোহাই দিয়ে, ধৰ্ম্মের দোহাই দিয়ে বললে, সে আমার চাপ্‌রাসের কথা কিছুই জানে না, তাতে তার কথা আমি কি ক’রে অবিশ্বাস করি?
দে। তোমার স্ত্রীর নিকট হ’তে চাপ্‌রাসখানা কেউ ফাকি দিয়ে নিয়েছে ব’লে বোধ হয় কি?
পা। হাঁ, তাই এখন আমার বেশ বোধ হচ্ছে।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
শচীন্দ্রের প্রবেশ

দেবেন্দ্রবিজয় তখনই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার নিমিত্ত বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন; বুঝিলেন, শচীন্দ্রের অপেক্ষায় আর বিলম্ব করা শ্রেয়ঃ নহে। যখন তিনি আবশ্যক মত ছদ্মবেশ পরিধান করিয়া গমনোদ্যত হইয়াছেন, বহির্দ্বারে বানাৎ করিয়া কি একটা শব্দ হইল; কে যেন সজোরে দ্বার উন্মুক্ত করিয়া ফেলিল—তৎপরে অতিদ্রুত পদশব্দ। দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, সে পদশব্দ শচীন্দ্রের। তখন শচীন্দ্র অতিদ্রুত সোপানারোহণ করিতেছে। দেবেন্দ্রবিজয় তাহার দুই হস্ত ধরিয়া টানিয়া লইয়া শয়নকক্ষে প্রবিষ্ট হইলেন; জিজ্ঞাসিলেন, “শচীন্দ্র, ব্যাপার কি! কি হয়েছিল তোমার?”
শচীন্দ্র। এতক্ষণ আমি অজ্ঞান হ’য়ে পড়েছিলাম; একটা লোক পিছন দিক থেকে আমায় লাঠী মারে।
দেবেন্দ্র। কখন, কোথায়?
শ। পদ্মপুকুরের বড় রাস্তা ছেড়ে যেমন জেলে-পাড়ার ভিতর ঢুকেছি।
দে। কোথায় লাঠী মেরেছে?
শ। মাথার উপরে। ,
দে। কে মেরেছে, জান?
শ। আমি তাকে দেখি নি, তখুন সেখানে যারা ছিল, তাদের মুখে শুনলেম, একজন মুসলমান।
দে। সে পালিয়েছে?
শ। হাঁ।
দে। কোথায় লাঠী মেরেছে দেখি, মাথা ফেটে যায় নাই ত?
শ। না, উপরকার একটু চামড়া কেটে গিয়ে খানিকট রক্ত বেরিয়ে গেছে। আঘাত সাঙ্ঘাতিক নয়—ব্রজেন্দ্র ডাক্তারের ডিস্পেন্সারীর সম্মুখে অজ্ঞান হ’য়ে পড়ি; ডাক্তার-বাবু তখন তথায় ছিলেন। আমাকে তখনই তার ডিস্পেন্সারীতে তুলে নিয়ে গিয়ে যেখানটা কেটে গিয়েছিল, সেখানটায় ঔষধ দিয়ে রক্ত বন্ধ ক’রে দিয়েছেন। ষা’ই হ’ক, মামী-মা’র জন্যই আমার সন্ধান নিতে যাওয়া —মামী-মা কোথায়? .
দে। নাই—বাড়ীতে নাই!
শ। সে কি!
দে। ষড়যন্ত্রকারীরা আবার লোক পাঠিয়েছিল; তোমার নাম জাল ক’রে একখানা পত্র লিখে পাঠায়।
শ। তবে মামী-মা কি আবার জুমেলিয়ার হাতে পড়েছে?
দে। জুমেলিয়া ভিন্ন কে আর এমন সাহস করবে? কার সাহস হবে? কে আর দেবেন্দ্রের উপর এমন চাতুরীর খেলা খেলতে পারে? আমি এখনই চললেম।
শ। কোথায়?
দে। রাজার বাগানে নীলু মিস্ত্রীর বাড়ীতে।
শ। সেখানে কেন, মামা-বাবু? কি হয়েছে—আমায় সব কথা ভেঙে বলুন।
দে। আবদুল পাহারাওয়ালার চাপ্‌রাস চুরি গেছে। নীলু মিস্ত্রীকে সে চাপ্‌রাস পালিস করতে দিব বলেছিল; তার অজ্ঞাতে তার স্ত্রীর কাছ থেকে নীলু মিস্ত্রী সে চাপ্‌রাস চেয়ে নিয়ে যায়; এখন অস্বীকার করছে—এখন আমাকে—
দেবেন্দ্রবিজয়ের কথা সমাপ্ত হইবার পূৰ্ব্বে সদর দরজায় আবার একটা উচ্চ শব্দে আঘাত হইল; তৎক্ষণাৎ ছুটিয়া আসিয়া শ্ৰীশচন্দ্র একখানি পত্র হস্তে সেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল, পত্ৰখানি সে দেবেন্দ্র বিজয়ের হাতে দিল।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ
জুমেলিয়ার দ্বিতীয় পত্র

দেবেন্দ্রবিজয় তখনই সেই পত্র পাঠ করিলেন;–
“দেবেন্দ্রবিজয়!
তোমার স্ত্রী এখন আমার হাতে পড়িয়াছে ৷ আমি তাহাকে ছাড়িয়া দিতে পারি কি না, তাহ এখন তোমার উপর নির্ভর করিতেছে। সে এখন আমার কোন ঔষধ—কোন দ্রব্যগুণে অচেতন হইয়া আছে; যদি যথাসময়ে ঠিক সেই ঔষধের কাটান ঔষধ দেওয়া যায়, তাহ হইলে তোমার স্ত্রীর কোন ক্ষতি হইবে না। তার জীবন ও মৃত্যু তোমার হাতে; তুমি জান—তুমি বলিতে পার, সে বাচিবে কি মরিবে।
যদি এখন আমি তাহাকে তাহার সেই অজ্ঞান অবস্থায় তোমার হাতে দিই; কোন ডাক্তার, কোন কবিরাজ, যত নামজাদা ভাল চিকিৎসক হউক না কেন, কেহই রক্ষা করিতে পরিবে না। সকলেই তাহাকে মৃত বলিয়াই বিবেচনা করিবে—কিন্তু সে জীবিত আছে।
তোমার নিকটে আমার এক প্রস্তাব আছে; আমি জানি, তোমার কথা তুমি ঠিক বজায় রাখিয়া থাক ও রাখিতে পার। প্রস্তাব কি—পরে জানিতে পারিবে; আমার প্রাণের ভিতরে এখন আশা ও নৈরাপ্ত উভয়ে মিলিয়া বড়ই উৎপাত করিতেছে।
অন্তরাত্রি ঠিক এগারটার পর বালিগঞ্জের বাগান-বাড়ীতে সাক্ষাৎ করিবে; লাহিড়ীদের বাগান, বাগানের পশ্চিম প্রান্তে যে কাঠের ঘর আছে, সেইখানে সাক্ষাৎ করিবে। আসিবার সময়ে সঙ্গে কোন অস্ত্রশস্ত্ৰ আনিয়ো না; আমার সঙ্গে দেখা হইলে বিনাবাক্যব্যয়ে আমার অনুসরণ করিবে; যেখানে আমি তোমাকে লইয়া যাইব, তোমাকে যাইতে হইবে; ইচ্ছা আছে, তোমার পত্নীকে মুক্তি দিবার জন্য একটা সুপরামর্শ ও সন্ধি স্থির করিব।
যদি তুমি অপর কাহাকেও সঙ্গে লইয়া এস, আমার সহিত সাক্ষাৎ হইবে না—আমাকে দেখিতে পাইবে না; যদি তুমি আমাকে গ্রেপ্তার করিতে কি আমার কোন ক্ষতি করিতে চেষ্টা কর, তোমার স্ত্রী অসহায় অবস্থায় অতিশয় যন্ত্রণা • পাইরা দন্ধিয়া দন্ধিয়া মরিবে; কেহই তাহাকে বাঁচাইতে পারিবে না; ইতোমধ্যে যদি তুমি আমাকে হত্যা কর, তোমার স্ত্রীর মৃত্যু অনিবাৰ্য্য হইয়া উঠিবে—তুমি আমাকে জান।
যেখানে যখন সাক্ষাৎ করিতে লিখিলাম, আমি ঠিক সেই সময়ে তোমার সহিত একা আসিয়া দেখা করিব। তোমার নিকটে আমি যে প্রস্তাব করিব, তাহাতে যদি তুমি অসম্মত হও, শেষ ফল কি ঘটে, জানিতে পারিবে। আমি তোমার প্রতিজ্ঞা করিয়া বলিতেছি, তোমার কোন বিষয়ে কিছুমাত্র অনিষ্ট ঘটিবে না। তুমি একাকী আসিয়ে, আশঙ্কা করিবার কোন কারণ নাই। আমার যাহা অনুরোধ, তোমার নিকটে বলা হইলে, তাহাতে তুমি সন্মত হও বা না হও, স্বচ্ছন্দে তোমার নিজের বাড়ীতে তুমি ফিরিবে। যতক্ষণ না তুমি বাড়ীতে ফিরিয়া যাও, ততক্ষণ জুমেলিয়া তোমার প্রতি শক্ৰতাচরণ করিবে না। তুমি গৃহে উপস্থিত হইলে—যেমন এখন আছ—তোমার যেমন অবস্থা হইতে তোমাকে আমি ডাকিতেছি, যতক্ষণ ঠিক তেমন অবস্থায় না ফিরিবে, ততক্ষণ জুমেলিয়া চুপ করিয়া থাকিবে—তোমার কোন অনিষ্ট করিবে না। এমন কি অপর কোন শক্র কর্তৃক যদি তোমার একটি কেশের অপচয় ঘটিবার কোন সম্ভাবনা দেখে, জুমেলিয়া প্রাণপণে তাহাও হইতে দিবে না।
তুমিই এখনও তোমার পত্নীর জীবন রক্ষা করিতে পার; কি প্রকারে পার, তাহা এখন বলিব না; রাত এগারটার পর দেখা করিলে বলিব।
স্মরণ থাকে যেন, তোমার স্ত্রী এখন বাইশ হাত জলে পড়িয়াছে।
তুমি আমাকে জান—
জুমেল।”

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ
****

পত্রপাঠ সমাপ্তে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখমণ্ডল বিবর্ণ হইয়া গেল—মলিন মুখ আরও মলিন হইয়া পড়িল; শ্রীশচন্দ্রকে দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, “শ্রীশ, এ পত্র তুমি কোথায় পাইলে?
শ্ৰীশ। বাড়ীর সামনে।
দেবেন্দ্র। কে দিয়েছে?
শ্ৰী। একটা ছোড়া।
দে। সে কোথায় পাইল, জিজ্ঞাসা করেছিলে?
শ্ৰী। ই, সে বললে, একটা বুড়ী এসে তার হাতে পত্ৰখানা দিয়ে আমাদের বাড়ী দেখিয়ে দেয়; বুড়ী তাকে একটা চকচকে টাকা দিয়ে গেছে।
দে। আচ্ছ, এখন তুমি যাও।
শ্ৰীশচন্দ্র প্রস্থান করিল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “পত্ৰখানি পড়িয়া দেখ।”
শচীন্দ্র মনে মনে পত্ৰখানি আগাগোড়া পড়িয়া লইল। তৎপরে জিজ্ঞাসিল, “মামা-বাবু, আপনি কি তবে সেখানে যাবেন?”
“হাঁ, যাইতে হইবে বৈকি।”
“যাইয়া কি করিবেন?”
“না যাইয়াই বা করিব কি?”
“যাইয়াই বা করিবেন কি?”
“জুমেলিয়া পত্রে সত্যকথাই লিখেছে।”
“এ সত্য, তার অন্তান্ত সত্যের ন্যায়।”
“আমার বিশ্বাস, এবার সে পত্রে সত্যকথাই লিখেছে।”
“তবে আপনি যাইবেন?”
“হাঁ।”
“সে না প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, আপনাকে হত্যা করিবে?”
“হাঁ, তা? আমি জানি—মনে আছে।”
“শুধু আপনাকে নয়, মামী-মাকে, শ্ৰীশকে আর আমাকে ৷”
“হাঁ।”
“মামা-বাবু, এ আবার জুমেলিয়ার নূতন ফাঁদ; এ ফাঁদে মামী-মাকে আর আপনাকে সে আগে ফেলিতে চায়।”
“এ কথা আমি বিশ্বাস করি।”
“তথাপি আপনি যাইবেন?”
“তথাপি আমি যাইব।”
“আমাকে সঙ্গে লইবেন না?”
“না।”
“কেন?”
“তাহা হইলে আমার অভিপ্রায় পুর্ণ করিতে পারিব না।”
“সে অভিপ্রায় কি?”
“সময়ে সব জানিতে পারিবে, এখন এই যথেষ্ট; তবে এইটুকু জানিয়া রাখ, ডাকিনী আমাকে ডাকে নাই নিজের মৃত্যুকে ডাকিয়াছে—তার দিন ফুরাইয়াছে।”
“মামা-বাবু, আপনি তার প্রস্তাবে সম্মত হবেন?”
“কি তার প্রস্তাব, আগে জানি; তার পর সে বিষয়ের মীমাংসা হবে।”
“আমি এখন কি করিব?”
“কিছুই না।”
“বড় শক্ত কাজ!”
“তা আমি জানি; থাম—বলছি।”
“বলুন।”
“সন্ধ্যার একঘণ্টা পরে, তুমি ভিক্ষুকের বেশে ঐ বাগানের ভিতরে যাবে; যে কাঠের ঘরের কথা পত্রে আছে, সেই ঘরের কাছে কোন গাছের আড়ালে লুকাইয়া থাকিবে; দেখিবে, কে কি করে, কে কোথায় যায়। খুব সাবধান, কেউ যেন তোমায় দেখিতে না পায়। আমি রাত এগারটার সময় যাইব।”
“নিরস্ত্র অবস্থায় যাবেন কি?”
“অস্ত্রছাড়া তোমার মামা-বাবু কখনও বাড়ীর বাহির হন নাই— হবেনও না। আমি জুমেলিয়ার অনুসরণ করিব, তুমিও অলক্ষ্যে আমার অনুসরণ করিবে। কিন্তু দেখিয়ো—খুব সাবধান, যেন তোমাকে তখন সে দেখিতে না পায়। আমি যাইবার সময়ে পকেটে করিয়া কতকগুলি ধান লইয়া যাইব, যে পথে যাইব, সেই পথে আমি সেগুলি ছড়াইতে ছড়াইতে যাইব; সেগুলি ফেলিবার সময়ে বড় একটা শব্দ হ’বার সম্ভাবনা নাই; তুমি সেই ধানগুলির অনুসরণ করবে, তাহ হইলে আমার অনুসরণ করা হবে।”
“বেশ—বেশ।”
“জুমেলিয়া বড় সতর্ক—বড়ই চতুর; সে নিজের পথ আগে ভাল রকম পরিষ্কার না রেখে এ পথে পা দেয় নাই; আগে সে বুঝেছে, তার বিপদের কোন সম্ভাবনা নাই, তার পর আমাকে ডাকিয়ে পাঠিয়েছে। সে জানে, একবার আমার হাতে পড়িলে তাহার নিস্তার নাই; একবিন্দু দয়াও সে অামার কাছে আশা করিতে পারিবে না। তোমার এখন কাজ হইতেছে, তুমি দেখিবে, সে আত্মরক্ষার জন্য কিরূপ বন্দোবস্ত করিয়াছে; কে এখন তার সহযোগী হইয়াছে। আমার কথামত ধান দেখিয়া আমার সন্ধান লইবে; যখন সন্ধান পাইবে—যেখানে আমি থাকিব, জানিতে পরিবে, তখন তথায় অপেক্ষণ করিবে; যতক্ষণ না আমি তোমাকে ইঙ্গিতে জানাই, ততক্ষণ অপেক্ষা করিবে।”
“কিরূপে ইঙ্গিত করিবেন?”
“যখন উপর্যুপরি দুইবার পিস্তলের আওয়াজ হইবে, তখনই তুমি আমার নিকটে উপস্থিত হইবে। যতক্ষণ পৰ্য্যন্ত তুমি পিস্তলের শব্দ শুনিতে না পাও, ততক্ষণ তোমাকে আর কিছু করিতে হইবে না, কেবল অপেক্ষায় থাকিবে।”
“বেশ, আমি আপনার আদেশমতই কাজ করিব।”
“শচী! আমাদের জীবনের এ বড় সহজ উদ্যম নয়; এ উদ্যম বিফল হ’লে আমাদের মৃত্যু অনিবাৰ্য্য। এ পর্য্যন্ত আমরা যত ভয়ঙ্কর কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি, সে সকলের অপেক্ষা এখন বেশি পরিশ্রম— বেশি বুদ্ধি—বেশি কৌশল আবশ্যক করে। তোমার মামী-মার জীবন ত এখন সঙ্কটাপন্ন; এমন কি আমার প্রাণও আজিকার রাত্রির কাৰ্য্যের উপর নির্ভর করিতেছে; প্রাণনাশের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। অথচ স্বেচ্ছায় সে কাৰ্য্য আমাদিগকে যে প্রকারে হউক, মাথা পাতিয়া লইতে হইবে। আর শচী, যদি সে নারী-দানবী আমাকে পরাস্ত করে—আমার প্রাণনাশ করে, তুমি রহিলে, তুমি প্রাণপণে চেষ্টা পাইবে; তোমার হাতে তখন আমার সকল কৰ্ত্তব্য অর্পিত হইবে। যাও শচী, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। যাও শচী, আমার কথাগুলি যেন বেশ স্মরণ থাকে; সেগুলি যেন ঠিক পালন করিতে পার, আর যদি তোমায় আমায় আর এ জীবনে সাক্ষাৎ না ঘটে, ভাল —সুৰ্ব্বশক্তিমান পরমেশ্বর আছেন, তিনি তোমায় রক্ষা করিবেন—তিনি তোমার সহায় হইবেন—তিনি তোমার মঙ্গল করিবেন—যাও, শচী।”
শচীন্দ্র স্নানমুখে—আর কোন কথা না বলিয়া—নয়নপ্রান্তের অশ্ররেখা মুছিয়া স্থান ত্যাগ করিল।

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সাক্ষাতে

সেই দিবস রাত্রি সাড়ে দশটার পর দেবেন্দ্রবিজয় বাটী হইতে বাহির হইলেন। লাহিড়ীদের উদ্যানে উপস্থিত হইতে প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টা অতিবাহিত হইল। এগারটা বাজিতে আর বেশি বিলম্ব নাই। দেবেন্দ্রবিজয় উদ্যানের পশ্চিম-প্রান্তের নির্দিষ্ট ঘরের সান্নিধ্যে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। কেহই তথায় নাই।
স্থানটি সম্পূর্ণরূপে নির্জন এবং নীরব। কেবল কদাচিৎমাত্র ভগ্নবিশ্রাম কোন বিহঙ্গের পক্ষস্পন্দনশব্দ—কোথায় ক্বচিৎ শুষ্কপত্রপাতশব্দ– অতি দুরস্থ কুক্কুররব। বায়ু বহিতেছিল—দেহস্নিগ্ধকর, অতিমন্দ নিঃশব্দবায়ুমাত্র। যামিনী মধুর, পূর্ণেন্দুবিভাসিত, একান্ত শব্দমাত্রবিহীনা। মাধবী ঘামিনীর পরিষ্কৃত সুনীলগগনে স্নিগ্ধকিরণময় সুধাংশু নীরবে, ধীরে ধীরে নীলাঙ্গরসঞ্চারী ক্ষুদ্র শ্বেতাম্বুদখণ্ডগুলি উত্তীর্ণ হইতেছিল।
বৃক্ষমূলপার্শ্বে শচীন্দ্র লুকাইয়া ছিল; দেবেন্দ্রবিজয়ের তীক্ষ্ণদৃষ্টি সৰ্ব্বাগ্রে সেইদিকে পড়িল—শচীন্দ্রও তাহার মাতুল মহাশয়কে দেখিল। উভদে উভয়কে দেখিলেন, কেহ কোন কথা কহিলেন না, আবশ্যক বোধ করিলেন না।
কিয়ৎক্ষণপরে—ঠিক যখন রাত্রি এগারটা, দেবেন্দবিজয় জ্যোংস্নালোকে কিয়দ্দূরে এক রমণীমূৰ্ত্তি দেখিতে পাইলেন। সে মূর্তি তাঁহার দিকে অতি দ্রুতগতিতে আসিতেছে। দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, সে মূৰ্ত্তি আর কাহারও নহে—সেই পিশাচী জুমেলিয়ার।

জুমেলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে দুর হইতে দেখিবামাত্র জিজ্ঞাসিল, “এই যে দেবেন্দ্ৰ! এসেছ তুমি?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “হাঁ, এসেছি আমি।”
জুমেলিয়া। মনে কিছুমাত্র ভয় হয় নাই?
দে। না, কাহাকে ভয় করিব?
জু। কেন, আমাকে?
দে। তোমাকে? না।
জু। তোমার মনে কি এখন কোন ভয় হইতেছে না?
দে। না।
জু। তোমার নিজের কথা বলছি না; অন্ত কাহারও জন্য তোমার ভয় হ’তে পারে হয়েছে কি?
দে। জুমেলা, আমি তোমাকে ভয় করি না।
জু। সঙ্গে কোন অস্ত্র আছে কি?
দে। তুমি যে নিষেধ করিয়াছ।
জু। ঠিক উত্তর হইল না।
দে ৷ হইতে পারে।
জু। তুমি কি সশস্ত্র?
দে। তুমি?
জু। হাঁ।
দে। তবে আমাকেও তাহাই জানিবে।
জু। কই, তা হ’লে তুমি আমার কথামত কাজ কর নাই।
দে। তোমার কথামত আমি তোমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছি—অস্ত্র থাক বা না থাক, তোমার সে কথায় এখন প্রয়োজন কি? যখন আমার হাতে কোন অস্ত্র দেখিবে, তখন জিজ্ঞাসা করিয়ো।
জু। তুমি সঙ্গে অস্ত্ৰ আনিয়াছ কেন?
দে। আবশ্যক হইলে তাহার সদ্ব্যবহার হইবে বলিয়া।
জু। নিৰ্ব্বোধ!
দে। নির্ববুদ্ধিতা আমার কি দেখিলে?
জু। আমি কি পূৰ্ব্বে তোমায় বলি নাই—যদি তুমি আমার আদেশ মত কাৰ্য্য না কর, তোমার স্ত্রী মরিবে?
দে। হাঁ, বলেছিলে।
জু। তবে কেন তোমার এ মতিভ্রম হইল? আমি যদি এখন এখান হইতে চলিয়া যাই—তুমি আমার কি করিবে?
দে। মনে করিলেই এখন আর যাইতে পার না।
জু। কি করিবে?
দে! এক পা সরিলে তোমাকে আমি হত্যা করিব।
জু! নিৰ্ব্বোধ, আবার?
দে। আবার কি?
জু। তোমায় নিতান্ত মতিছন্ন ধরিয়াছে দেখিতেছি—আমাকে হত্য করিলে তুমি তোমার প্রিয়তম স্ত্রীকে হত্যা করিবে, স্মরণ আছে?
দে। তথাপি আমি তোমাকে হত্যা করিব।

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বনভূমিতে

“কর, তোমার পদতলে—তোমার নিকটস্থ গুপ্ত অসির সম্মুখে এই বুক পাতিয়া দিতেছি; কোন অস্ত্র শাণিত কবিয়া আনিয়াছ—জুমেলিয়ার বুকে বসাইয়া দাও। নির্দয় দেবেন–নিষ্ঠুর দেবেন্‌! সুন্দর বক্ষ অস্ত্রে বিদ্ধ করিতে, একজন স্ত্রীলোকের বক্ষ অস্ত্রদীর্ণ করিতে যদি তুমি কিছুমাত্র কাতর না হও, তাহাতে যদি তোমার আনন্দ হয়—কর পার কর—এই তোমার সম্মুখে বুক পাতিয়া দিলাম!”
এই বলিয়া জুমেলিয়া বক্ষের বসন ও কাঞ্চলী খুলিয়া দুরে ফেলিয়া দিল। জানু পাতিয়া বসিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের সমক্ষে সেই স্নিগ্ধ শশাঙ্ককরে কামদেবের লীলাক্ষেত্রতুল্য পীনোন্নত বক্ষ পাতিয়া দিল।
পাঠক! একবার ভাবিয়া দেখুন, এ দৃশ্য কতদূর কল্পনাতীত! মাথার উপরে নীলানন্ত নিৰ্ম্মল গগনে থাকিয়া শশী অনন্তকিরণপ্লাবনে জগৎ ভাসাইয়া সুধাহাসি হাসিতেছিল; কাছে—দুরে—এখানে— ওখানে থাকিয়া নক্ষত্রগুলা ঝিকমিক্‌ করিয়া জলিতেছিল। বৃক্ষাবলীর অগ্রভাগারূঢ়পত্রগুলি ধীরে সমীরে হেলিতে-ফুলিতেছিল; নিম্নে—পার্শ্বে— পশ্চাতে—দুরে—অতিদূরে অনন্ত নিস্তব্ধতা; সেই ঘোর নীরবতার মধ্যে শশিকিরণে আভূমিপ্রণত শুামলতা নীরবে চলিতেছিল; নীরবে জ্ঞতা গুলুমধ্যে শ্বেত, পীত, লোহিত ফুল্লফুলদল বিকসিত ছিল। সেই নির্জন, নীরব উদ্যানমধ্যে দেবেন্দ্রবিজয় দণ্ডায়মান; তাঁহার সম্মুখে— দৃষ্টিতলে অদ্ধবিবস্ত্রভাবে জুমেলিয়া চন্দ্রকরোজ্জল অনাচ্ছাদিত পীনোন্নত পীবর বক্ষ পাতিয়া বসিয়া।
দেবেন্দ্রবিজয় বিচলিত হইলেন, বারেক সৰ্ব্বাঙ্গ কঁপিয়া উঠিল; প্রত্যেক ধমনীর শোণিত-প্রবাহে যেন একটা অনুভূতপূৰ্ব্ব বৈদ্যুতিক প্রবাহ মিশিয়া সৰ্ব্বাঙ্গে অতি দ্রুতবেগে সঞ্চালিত হইতে লাগিল। কি বলিবেন,-স্থির করিতে না পারিয়া দেবেন্দ্রবিজর নীরবে রহিলেন।

জুমেলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে নীরবে এবং কিছু বা স্তম্ভিতভাবে থাকিতে দেখিয়া কহিল, “কি দেবেন, নীরব কেন? অস্ত্র বাহির কর; হাত ওঠে না কেন? ওঃ! যতদুর তোমাকে আমি নিষ্ঠুর মনে করেছিলাম, এখন বুঝিতে পারিতেছি, ততদুর তুমি নও; তবে অস্ত্র সঙ্গে আনিয়াছ কেন?”
“সময়ে আবশ্যক হইলে সদ্ব্যবহার-করিব বলিয়া।”
“বেশ, আপততঃ তোমার নিকটে যে-কোন অস্ত্র আছে, আমার হাতে দিতে পার?”
“না।”
“তবে তোমার নিকটে আমার কোন প্রস্তাব নাই; তোমার সঙ্গে তবে আমার সন্ধি হইল না।”
“ক্ষতি কি?”
“তবে কি দেবেন, তুমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতাচরণ করিবে?”
“না, আমার কার্য্যসিদ্ধ করিতে আসিয়াছি।”
দেবেন্দ্রবিজয় এই কথাগুলি স্থির ও গম্ভীরস্বরে বলিলেন। এ স্থৈর্য্য, এ গাম্ভীৰ্য্য ঝটিকাপূৰ্ব্বে প্রকৃতি যেমন স্থির ও গম্ভীরভাব ধারণ করে, তদনুরূপ।
জুমেলিয়া ইহা বিশদরূপে বুঝিতে পারিয়া মনে মনে অত্যন্ত অস্থির হইতে লাগিল; তাহার মনের ভাব তখন বাহিরে কিছু প্রকাশ পাইল না।

জুমেলিয়া বলিল, “থাম, আর এক কথা, এখন তুমি আমার কাছে একটা প্রতিজ্ঞা করিবে?”
“কি, বল?”
“তুমি আজ তোমার অস্ত্র ব্যবহার করিবে না?”
“যদি না করিতে হয়—করিব না।”
“কি জন্য তুমি অস্ত্র ব্যবহার করিবে, স্থির করিয়াছ?”
“তোমার পত্রে যে সকল কথা স্থিরীকৃত আছে, সেই সকলের মধ্যে যদি একটার ও কোন ব্যতিক্রম ঘটে।”
“এই জন্য?”
“হাঁ, আরও কারণ আছে।”
“কি, বল।”
“যদি আমার স্ত্রীর জীবনরক্ষার্থে অবশ্যক হয়।”
“আবশ্যক হইবে না, আমি বলিতেছি—কোন আবশ্যক হইবে না, তোমার অস্ত্র ব্যবহারে তোমার স্ত্রীর জীবনরক্ষার্থে তুমি কোন ফল পাইবে না।”
“তা হ’লে অস্ত্র ব্যবহার করিব না।”
“নিশ্চয়?”
“নিশ্চয়।”

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ
ভিক্ষুক-বেশী

জুমেলিয়া। দেবেন, কেহ তোমার সঙ্গে এসেছে?
দেবেন্দ্র। না, তোমার কথামত কাজই করা হয়েছে।
জু। শচীন্দ্র এ সকল বিষয়ের কিছু জানে না?
দে। তুমি ত জান সে শয্যাশায়ী হয়েছে।
জু। হঁ, জানি।
দে। তবে জিজ্ঞাসা করিতেছ, কেন?
জু। তুমি যে এখানে একাকী আসিয়াছ, এ কথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না।
দে। অবিশ্বাসের কারণ কি আছে? আমি একাকী আসিয়াছি।
জু। দেবেন, তুমি যতই সতর্ক হও—যতই বুদ্ধিমান হও, কিছুতেই জুমেলিয়াকে ছাপাইয়া উঠিতে পরিবে না; আমি চক্ষের নিমেষে তোমায় খুন করিতে পারি।
দে। পার যদি, করিতেছ না কেন? আমার প্রতি এত দয়া প্রকাশের হেতু কি?
জু। আপাততঃ আমার সে ইচ্ছা নাই, আমিও প্রস্তুত নহি।
দে। জুমেলিয়া, অনৰ্থক বিলম্বে তোমার অনর্থ ঘটিবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ৷
জু। [ সহাস্তে ] মাইরি!
দে। শোন—মিথ্যা আমরা সময় নষ্ট করিতেছি, তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাইবে বলিয়া পত্র লিখিয়াছিলে না?
জু। হাঁ।
দে। কোথায়?
জু। এমন কোথাও নয়; এই ঘে– [অঙ্গুলি নির্দেশে] দোতলা বাড়ীখানা দেখিতে পাইতেছ, উহার মধ্যে—ঐখানে তোমার রেবতী আছে। দেখিবে?
দে। চল, দেখিব।
জু। আর একটা প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে।
দে। কি, বল?
জু। আমার বিনানুমতিতে এমন কি তুমি তোমার স্ত্রীকে স্পর্শও করিতে পারিবে না;
দে। তাহাই হইবে, সম্মত হ’লেম, চল।
জু। যথেষ্ট।
দে। তবে চল।
জু। এস।

* * * * *

দেবেন্দ্রবিজয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া উদ্যানভূমি অতিক্রম করিয়া জুমেলিয়া ক্রমশঃ সেই অট্টালিকাভিমুখে চলিল।
সে অট্টালিকা উদ্যানের বাহিরে নয়, উদ্যানমধ্যে—পুৰ্ব্বপ্রান্তে; বহুদিন মেরামত না ঘটায় অনেক স্থলে জীর্ণ ও ভগ্নোমুখ—অনেক স্থানে বালি খসিয়া ইট বাহির হইয়া পড়িয়াছে—কোন কোন স্থান ইট খসিয়া একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে।

দেবেন্দ্রবিজয় ও জুমেলিয়া যখন ক্রমশঃ সেই অট্টালিকাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন, তখন ভিক্ষুকবেশী শচীন্দ্র বৃক্ষান্তরাল হইতে বাহির হইল; কোন পথে তাঁহারা কোন দিক্ দিয়া যাইতেছেন, তাহ স্থিরদৃষ্টিতে দেখিতে লাগিল; এইরূপে প্রায় পাঁচ মিনিট কাটিল। শচীন্দ্র সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিল।
যখন শচীন্দ্র সেইদিকে যাইবার জন্য একপদ সম্মুখে অগ্রসর হইয়াছে, আর এক ব্যক্তিকে সে সেইদিকে আসিতে দেখিল; তখনই তাড়াতাড়ি নিজের ছিন্ন শতগ্রন্থিযুক্ত উত্তরীয় বৃক্ষতলে পাতিয়া শয়ন করিল; কৃত্রিম নিদ্রার ভানে চক্ষু নিমীলিত করিয়া নাসিকা-স্বর আরম্ভ করিয়া সেই নীরব উদ্যানের নিদ্রিত পক্ষিবৃন্দকে ক্ষণেকের জন্য অত্যন্ত চমকিত ও মুখরিত করিয়া তুলিল।
সে লোকটা অতি শীঘ্রই শচীন্দ্রের নিকটে আসিল; আসিয়া সজোরে তাহার স্কন্ধে একটা সোহাগের চপেটাঘাত করিল।
শচীন্দ্র নিমীলিত নেত্রে পার্শ্বপরিবর্তন করিল। আবার সেই চপেটাঘাত। নিমীলিতনেত্রেই ভিক্ষুক বেশী শচীন্দ্র বলিল, “কে বাবা তুমি, পথ দেখ না, বাবা।”
সোহাগের সেই চপেটাঘাতের শব্দটা পূৰ্ব্বাপেক্ষ এবার কিঞ্চিৎ পরিমাণে উচ্চে উঠিল। শচীন্দ্র বলিল, “কে বাবা, পাহারাওয়ালাজী নাকি? বাবা, গাছতলায় পড়ে একপাশে ঘুমাচ্ছি, তা’ তোমার কোমল প্রাণে বুঝি আর সইল না? আদর ক’রে যে গুরুগম্ভীর চপেটাঘাতগুলি আরম্ভ ক’রে দিয়েছ, তা আমার অপরাধটা দেখলে কি?”
আগন্তুক বলিল, “আরে না, আমি পাহারাওয়াল নই।”
শচীন্দ্র বলিল, “কে বাবা, তবে তুমি? উপদেবতা নাকি? কেন বাবা গরীব মানুষ একপাশে পড়ে আছি, ঘাটাও কেন, বাবা? ভদ্রলোকের ঘুমটা ভেঙে দিয়ে তোমার কি এমন চতুৰ্ব্বৰ্গ লাভ হবে?”
আগন্তুক বলিল, “আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাস করতে এসেছি।”
শচীন্দ্র বলিল, “আমাকে জিজ্ঞাসা কেন? আমার চেয়ে মাথায় বড়, ভারিক্কেদরের তালগাছ রয়েছে, কিছু জিজ্ঞাসা করবার থাকে, তাকে কর গে; এখান থেকে পথ দেখ না, চাঁদ ”
আগন্তুক। আমি এদিকে এসে পথটা ঠাওর করতে পারছি না; যদি তুমি বলে দাও, বড় উপকার হয়।
শচীন্দ্র ৷ পথ দেখ; সিধে লোক-সিধে পথ দেখ।
আ। আমি পদ্মপুকুরের দিকে যাব; কোন পথ জান কি?
শ। কি, শ্বেতপদ্মের না নীলপদ্মের? আবার কি রামরাজা এই ঘোর কলিতে দুর্গোৎসব আরম্ভ করেছে না কি?
আ। আমাকে পদ্মপুকুরের পথটা ব’লে দাও; আমি তোমাকে একটা পয়সা দিচ্ছি।
শ। কেন বাপু, এতদিনের পর দাতাকর্ণের নামটা আজ হঠাৎ লোপ করবে?
আ। পাগল না কি তুমি?
শ। পাঁচজনে মিলে আমাকে তাই করেছে, দাদা; আর খোঁয়াড়ি ধরলে পাগল ত পাগল, সকল দিকেই গোল লেগে যায়। তবে চললেম মশাই, নমস্কার; ব্রাহ্মণ হও যদি—প্রণাম।
আ। কোথায় যাচ্ছ, তুমি?
শ। আর কোথায় যাব, শুঁড়ি-মামার সন্দর্শনে।
শচীন্দ্র তথা হইতে প্রস্থান করিলে অপর দিক দিয়া আগন্তুক চলিয় গেল।

* * * * *

কিয়ৎপরে আবার উভয়ের উদ্যানের অপর পার্শ্বে সাক্ষাৎ ঘটিল।
আগন্তুক জিজ্ঞাসা করিল, “কই, শুড়ি-মামার কাছে গেলে না?
শচীন্দ্র সবিস্ময়ে বলিল, “তাই ত হে কৰ্ত্তা, আবার যে তুমি! আবার ঘুরেফিরে তোমারই কাছে এসে পড়েছি যে, নিশ্চয়ই পৃথিবী বেটী গোলাকার; নইলে ঘুরতে ঘুরতে ঠিক তোমার কাছে আবার এসে উপস্থিত হ’ব কেন? আসি মশাই, নমস্কার; ব্রাহ্মণ হও যদি—প্রণাম।”
উদ্যান হইতে বহির্গমনের পথ ধরির শচীন্দ্র তথা হইতে প্রস্থান করিল। আগন্তুক অতি তীব্রভৃষ্টিতে—যতক্ষণ তাহাকে দেখিতে পাওয়ার গেল—দেখিতে লাগিল। না, এ লোককে ভয় করার কোন কারণ নাই; মাতাল—আধ-পাগল; যাক, আগে ভেবেছিলাম, বুঝি গোয়েন্দার কোন চর-টর হবে।” এই বলিয়া যে পথ দিয়া দেবেন্দ্রবিজয় ও জুমেলিয়া গমন করিয়াছিল, সেই পথে গমন করিতে লাগিল—
লোকটা জুমেলিয়ার চর।
———– ———
তখন ভিক্ষুক-বেশী শচীন্দ্র বেশীদূরে যায় নাই। যতক্ষণ না আগন্তক একেবারে দৃষ্টিপথ অতিক্রম করিল, ততক্ষণ শচীন্দ্র নিকটস্থ একটি বৃক্ষপার্শ্বে লুকাইয়া রহিল; তাহার পর সুবিধা মত গুপ্তস্থান হইতে বাহির হইল; যে পথ দিয়া আগন্তুক চলিয়া গিয়াছিল, সেই পথ ধরিয়া চলিল।
শচীন্দ্রের গমনকালে বারংবার হস্তস্থিত ঘষ্টি হস্তচু্যত হইয়া ভূতলে পড়িয়া যাইতে লাগিল; বারংবার সে তাহা ভূতল হইতে প্রসন্নচিত্তে হাস্তমুখে তুলিয়া লইতে লাগিল।
এ হাসির কারণ বুঝিয়াছেন কি? দেবেন্দ্রবিজয় যে সকল ধান ছড়াইয়া নিশান করিয়া গিয়াছিলেন, ‘শচীন্দ্র এক্ষণে যষ্টি উঠাইবার ছলে, সেই সকল ধান দেখিয়া গন্তব্যপথ ধরিয়া চলিয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *