মাঝখানে রেলের একটা হাঙ্গামা হয়ে গেল। এই নিয়ে তোলপাড় হয়ে গেছে—আমি স্ট্রংলি কয়েকজনকে ধরেছি।
হেলাল রাখি? আমার শরীরটা ভাল লাগছে না।
সে কি! কি হয়েছে? আপনি এত কাজ করেন শরীর খারাপ হবারই কথা। ভাবী আছে ভাবীকে দিন। ভাবীর সঙ্গে কথা বলি।
তোমার ভাবী একটু ব্যস্ত আছেন। বলেই খায়ের সাহেব টেলিফোনের লাইন কেটে দিলেন। তিনি বসেছেন জানালার পাশে। ট্রেনের চাকায় ঝুম ঝুম শব্দ হচ্ছে। জানালার ও পাশের বন জঙ্গল ঘরবাড়ি দ্রুত সরে যাচ্ছে। দেখতে ভাল লাগছে। সবচে ভাল লাগছে অনেক দূরের বাড়িঘরের হারিকেন বা কূপীর আলো। ছোটবেলায় এইসব আলো দেখতে ভয় ভয় লাগতো। তাকে কে যেন বলেছিল ঐগুলা জ্বীনের চোখ। জ্বীন কখনো তাকিয়ে থাকে, কখনো চোখ বন্ধ করে। এই জন্যেই দূরের আলো কখনো দেখা যায় কখনো দেখা যায় না।
খায়ের সাহেবের মনে হল ট্রেনে করে তিনি উল্টা যাত্রা শুরু করেছেন। ট্রেন অতি দ্রুত তাকে শৈশবে নিয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় তাদের বাড়িতে একজন লজিং মাস্টার থাকতেন। নাম আক্কাস। আক্কাস স্যার তাকে অংক আর ইংরেজি শেখাতেন। অংক এবং ইংরেজির বাইরে আরেকটা জিনিস শেখাতেন। তিনি সেই শিক্ষার নাম দিয়েছিলেন সত্য শিক্ষা।
মিথ্যা কথা মানুষ কি জন্যে বলে জানিস?
জি না।
মিথ্যা কথা বলতে আরাম এই জন্যে মানুষ মিথ্যা কথা বলে। সত্যি কথা বলতে বেআরাম।
বেআরাম কেন?
জানি না কেন। আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি। মিথ্যা কথা হুট করে মুখ দিয়ে বের হয়। সত্যিটা বের হয় না। আজিব ব্যাপার।
তাদের এই লজিং স্যার পরে স্কুলেই চাকরি পান। সত্যি কথা বলার বদঅভ্যাসের কারণে তার চাকরি চলে যায়। সেবার স্কুলের উন্নয়নের জন্যে একশো বস্তা গম বরাদ্দ হয়েছিল। হেডমাস্টার সাহেব নিজে দশ বস্তা রেখে অন্য সব শিক্ষকদের দুই বস্তা করে দিলেন। স্কুল কমিটির সেক্রেটারি পেলেন পাঁচ বস্তা। গভর্নিং বডির মেম্বাররা তিন বস্তা করে। একজন শুধু গম নিলেন না, তার নাম আক্কাস মাস্টার। তিনি শুধু যে গম নিলেন না, তা-না জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে চিঠি দিয়ে বিস্তারিত জানালেন। তদন্ত হল। তদন্তে প্রমাণিত হল আক্কাস আলি স্কুলের শিক্ষকদের সম্মান নষ্ট করার জন্যে এই কাজ করেছেন। নিজে সাধু সেজে অন্যদের চোর বানাতে চেয়েছেন।
আক্কাস মাস্টারের শুধু যে চাকরি গেল তা-না, অন্যদের নামে বিশেষ করে স্কুল কমিটির সেক্রেটারি রজব মিয়ার নামে মিথ্যা অভিযোগ আনার শাস্তিও হল। আক্কাস মাস্টারকে কানে ধরে রজব মিয়ার বাড়ির সামনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হল। তার পাঞ্জাবীর বুকে সেফটি পিন দিয়ে একটা কাগজ লাগিয়ে দেয়া হল। সেখানে লেখা–
আমি চোর
আক্কাস মাস্টার কাঁদছিল। তাকে কাঁদতে দেখে বালক খায়েরের হঠাৎ খুব কান্না পেয়ে গেল। সে ছুটে নিজের ঘরে ঢুকে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। তার বাবা এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, বাবা কি হইছে? কান্দ কেন? সে কিছুই বলে না শুধু কাঁদে। তার মা তখন বললেন, আক্কাস মাস্টার কানে ধইরা কানতেছে এইটা দেইখা তোমার পুলা কানতেছে।
খায়েরের বাবা অতি বিস্মিত হয়ে বললেন, আমার পুলার অন্তরে এত মায়া? এত মায়া আমার পুলার অন্তরে! তিনি তৎক্ষণাৎ হাত তুলে দোয়া করলেন, হে আল্লাহপাক আমার ছেলের অন্তরের এই মায়া যেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকে। আমিন।
খায়েরের যখন আট বৎসর বয়স তখন তার বাবা মারা যান। আজ তার বয়স ৫৯-এর কিছু বেশি। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর আজ তার বাবার কথা মনে পড়ল এবং চোখে পানি এসে পড়ল। তাঁর পরহেজগার বাবার প্রার্থনা আল্লাহপাক শোনেন নি। শৈশবের মায়ার কিছুমাত্র তার মধ্যে নেই। তিনি এই সমাজে অতি দুষ্ট মানুষ হিসেবে পরিচিতি।
ট্রেন থেমে পড়েছে। স্টেশন ছাড়াই থেমেছে। দুদিকে শালবন। নিঝুম এক জায়গা। জানা গেছে ইনজিনে কি এক ঝামেলা হয়েছে। ড্রাইভার ইনজিন সারাবার চেষ্টা করছে। কিছু যাত্রী ট্রেন থেকে নেমে চিন্তিত মুখে হাঁটাহাঁটি করছে। অনেকে ভীড় করেছে ইনজিনের পাশে।
মাওলানার স্ত্রীর অবস্থা ভাল না। প্লেসেন্টা এখনো বের হয়নি। অস্বাভাবিক রক্তপাত হচ্ছে। এই মহিলাকে অতি দ্রুত হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন। জঙ্গলে ট্রেন থেমে থাকলে গুরুতর সমস্যা হবে। মাওলানা সমস্যার ব্যাপারটা ধরতে পারছেন না। পুত্র লাভ উপলক্ষে তিনি শোকরানা নামাজ শেষ করেছেন। আনন্দিত মুখে বার বার তার কামরায় উঁকি দিচ্ছেন। বাচ্চা কোলে নিয়ে সাজেদা বেগম বসে আছেন। সমস্যার জটিলতা তিনি বুঝতে পারছেন। একটু পর পর তিনি চিত্রাকে বলছেন, বৌমা খোঁজ নাও ট্রেন কখন ছাড়বে। কামরায় আশহাব আছে। সে ক্ষণে ক্ষণে মার কাছ থেকে ধমক খাচ্ছে—তুই তো গাধা ডাক্তার। কিছু করতে পারছিস না এটা কেমন কথা। তুই কি নকল করে পাস করেছিস যে কিছু জানিস না। গাধার গাধা। তোর বাপ ছিল গাধা। তুইও গাধা!
এমন কঠিন সময়ে মাওলানা উঁকি দিল এবং সবগুলি দাঁত বের করে জিজ্ঞেস করল, খালাম্মা ছেলে কি আমার মতো হয়েছে?
সাজেদা বললেন, ছেলের গালে ছাগলা দাড়ি নাই। ছেলে তোমার মতো হয় নাই। ছেলে কার মতো হয়েছে এই চিন্তা বাদ দাও। তোমার বৌকে বাঁচাবার চেষ্টা কর।
মাওলানা বললেন, কঠিন দোয়ার মধ্যে আছি খালাম্মা। দেখবেন কিছুক্ষণের মধ্যে ইনজিন ঠিক হবে ইনশাল্লাহ। আমরা একটানে ময়মনসিংহ পৌঁছে যাব।
সাজেদা বললেন, আল্লাহপাক কি ইনজিন ঠিক করার জন্যে ফেরেশতা পাঠায়েছেন?
মাওলানা বললেন, এই ধরনের কথা বলবেন না খালাম্মা। বিরাট পাপ হবে। এইসব খোদা নারাজি কথা।
খোদা তোমার আমার মতো না। এত্ত সহজে তিনি নারাজ হন না। তুমি আমার সামনে থেকে যাও। তুমি হচ্ছ রামছাগল। ট্রেন থেকে নেমে দেখ কাঁঠাল গাছ পও কি-না। যদি পাও পাতা ছিঁড়ে পাতা খাও। ড্রাইভার সাহেব বলেছেন, ইনজিনের মূল পিস্টন ভেঙে গেছে। উদ্ধারকারী ইনজিন না এলে কিছু করা যাবে না। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। রশীদ উদ্দিন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলেন। তাঁর সামনে আশহাব চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে।
রশীদ উদ্দিন বললেন, মাওলানার স্ত্রীর অবস্থা কি? সে কি চার-পাঁচ ঘণ্টা সারভাইভ করবে?
আশহাব বলল না, আমাদের হাতে বড় জোর চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় আছে।
রশীদ উদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন।
আশহাব বলল, স্যার কোথায় যান।
রশীদ উদ্দিন জবাব দিলেন না।
আবুল খায়ের সাহেব সেলুন কারের সোফায় গা এলিয়ে বসে ছিলেন। হঠাৎ তিনি নড়ে চড়ে বসলেন। তাঁর কামরায় বৃদ্ধ যে মানুষটা ঢুকছে তার চেহারা অবিকল আক্কাস মাস্টারের মতো। অথচ আক্কাস মাস্টার চার বছর আগে মারা গেছেন। তিনি নিজে তার জানাজায় উপস্থিত ছিলেন।
সেই লুঙ্গি পরা মানুষ। মাথায় মাফলার। আক্কাস মাস্টারেরও একই ব্যাপার ছিল। লুঙ্গি, শীত-গ্রীষ্মে মাফলার। খায়ের সাহেব উঠে দাঁড়াবেন নাকি বসেই থাকবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি এক ধরনের অস্বস্থির মধ্যে পড়ে গেলেন।
আমার নাম রশীদ উদ্দিন। আমি আপনার কাছে একটি আবেদন নিয়ে এসেছি।
খায়ের সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কি আবেদন
রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনার সামনে বসে বলি। আমাকে দুই মিনিট সময় যদি দেন।
বসুন।
রশীদ উদ্দিন বললেন, ট্রেনের একজন যাত্রী মহা বিপদে পড়েছে। তার একটি সন্তান হয়েছে। এখন শুনতে পাচ্ছি প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে। তাকে অতি দ্রুত কোনো একটা হাসপাতালে ভর্তি করানো দরকার। আপনি যদি ব্যবস্থা করে দেন তাহলে মেয়েটি বেঁচে যায়।
খায়ের সাহেব বললেন, আমি কি ভাবে ব্যবস্থা করব? ইনজিন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। কখন ঠিক হবে তার নেই ঠিক।
রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনি অতি ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আপনার পক্ষে এই অবস্থাতেও ব্যবস্থা করা সম্ভব।
খায়ের সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, আপনি একটা ভুল করছেন— মন্ত্রীদের হাতে আলাদিনের চেরাগ থাকে না। চেরাগ ঘসে তারা দৈত্য আনতে পারে না। যদি চেরাগ থাকতো আমি চেরাগের দৈত্যকে বলতাম সে ম্যাজিক কার্পেটে করে রোগী সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথে নিয়ে চিকিৎসা করাতে।
রশীদ উদ্দিন সহজ গলায় বললেন, স্যার আপনার কাছে ম্যাজিক কার্পেট আছে।
আপনি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন?
জি-না। আমি অংকের শিক্ষক। অংকের শিক্ষকরা রসিকতা বুঝতেও পারে না। করতেও পারে না।
রশীদ উদ্দিন দ্বিতীয়বার চমকালেন। আক্কাস মাস্টারও অংকের শিক্ষক ছিলেন। খায়ের সাহেব বললেন, আপনার রোগীর প্রতি আমি যথেষ্ট সিমপ্যাথি বোধ করছি কিন্তু বুঝতেই পারছেন আমার কিছু করার নেই।
রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনি টেলিফোন করেই একটা হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে পারেন। দশ মিনিটে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার চলে আসবে। মহিলার জীবন রক্ষা হবে। আমি কি আমাদের পবিত্র গ্রন্থ থেকে একটা আয়াত বলব?
খায়ের সাহেব চুপ করে রইলেন। রশীদ উদ্দিন বললেন, আল্লাহপাক বলছেন, যে একটি জীবন রক্ষা করে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকেই রক্ষা করে আর যে একটি জীবন নষ্ট করে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকেই ধ্বংস করে।
খায়ের সাহেব পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বললেন, আপনি এমন ভাবে কথা বলছেন যেন আমি ঢাকায় আমার বাড়ির ছাদে তিনটা হেলিকপ্টার রেখে দিয়েছি। টেলিফোন করব আর উড়ে চলে আসবে।
তার মানে কিছু করতে পারছেন না?
না।
দু-এক জায়গায় টেলিফোন করে দেখেন কাজ হতেও তো পারে। সিচুয়েশনটা চিন্তা করুন বনের মধ্যে ট্রেন আটকে আছে। একজন মৃত্যুপথযাত্রী। ট্রেনের এক যাত্রী মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি ঘটনা শুনে মর্মাহত হলেন। নানান ঝামেলা করে হেলিকপ্টার আনালেন। রোগী ঢাকা পাঠানো হল। হেলিকপ্টার যখন উড়তে শুরু করবে তখন ট্রেনের শত শত যাত্রী চিৎকার করে বলবে—আবুল খায়ের খান, জিন্দাবাদ। তারা মন থেকে বলবে। তাদেরকে ভাড়া করে আনতে হয়নি। নিজের পকেট থেকে একটা পয়সা খরচ না করেও আপনি স্বতস্ফূর্ত জিন্দাবাদ ধ্বনি শুনবেন।
আবুল খায়ের বললেন, আপনি কি বিদায় হবেন?
রশীদ উদ্দিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আপনাকে কুৎসিত একটা গালি দিতে ইচ্ছা করছে। যে গালি শুনলে আপনার পিত্তি জ্বলে যাবে এ রকম গালি। তা না দিয়ে একটা ভদ্র গালি দিচ্ছি। হাজার হলেও আপনি মন্ত্রী মানুষ—তুই গু খা। ফ্রেস গু না, তিন দিনের বাসি গু। যার উপর নীল রঙের মোটা মোটা মাছি ভোঁ ভোঁ করে উড়ছে। মন্ত্রীকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে রশীদ উদ্দিন বের হয়ে গেলেন।
এতক্ষণ খায়ের সাহেব সিগারেট হাতে বসেছিলেন এখন সিগারেট ধরালেন। তার ভুরু কুচকে আছে। টেবিলে রাখা টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। ধরবেন না, ধরবেন না করেও তিনি টেলিফোন ধরলেন। তাঁর স্ত্রী টেলিফোন করেছে।
সুরমা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, হ্যালো। হ্যালো।
হুঁ।
এতবড় একটা ঘটনা। তুমি আমাকে কিছুই জানাও নি। আমি খবরটা শোনার পরেই জঙ্গলের মধ্যে দুই রাকাত শুকরানা নামাজ পড়েছি। একটা ছাগল সদকা মানত করেছি। ময়মনসিংহ পৌঁছেই ছাগল দিয়ে দিব।
ভাল।
এই শোনো রেলমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনি নিজেই টেলিফোন করেছিলেন। আমরা জঙ্গলে পড়ে আছি শুনে উনি হতভম্ব। যাই হোক ব্যবস্থা করেছেন। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে।
খায়ের সাহেব বললেন, কি ভাবে?
তোমাদের ট্রেন আটকে বসে আছে না?
হ্যাঁ। ইনজিন নষ্ট।
ইনজিন নষ্ট তোমাকে কে বলেছে? ইনজিন ঠিকই আছে। রেলমন্ত্রীর নির্দেশে ট্রেন আটকা। আমাদেরকে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে এক বগির একটা ট্রেন তোমাদের কাছে যাবে। আমরা সেলুনে উঠব তারপর ট্রেন ছাড়বে।
ও আচ্ছা।
তোমার কথাবার্তায় প্রাণ নেই কেন বল তো? এদিকে আমরা খুব হৈ চৈ করছি। জঙ্গলের মধ্যেই কনসার্ট। কি যে মজা হয়েছে। যমুনা এবং যমুনার স্বামী সাম্বা নাচ নেচেছে। ওরা যে সাম্বা নাচতে জানে আমার ধারণাই ছিল না। সেলুন কারে পৌঁছানোর পর ঐ নাচটা আবার করতে বলব।
আচ্ছা।
আমি আর কি ঠিক করেছি জান, এক রাতে জঙ্গলে প্রোগ্রাম করব। তোমার সব বন্ধু-বান্ধবরা থাকবে। জোছনা রাত। রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু হবে। ঐ যে উনার বিখ্যাত গান—আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে।
হুঁ।
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চিত্রা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। চোখের সামনে একটা মেয়ে মরে যাচ্ছে এই দৃশ্যটা সে নিতেই পারছে না। মাওলানার স্ত্রী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তার ছেলের দিকে। ছেলেও ড্যাব ড্যাব করে মাকে দেখছে। কি অদ্ভুত এবং কি করুণ এক দৃশ্য। এই দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করা মুশকিল। চিত্রা বের হয়ে চলে এসেছে।
বাথরুমের পাশের ঘরের দরজা খুলল। একজন ভদ্রমহিলা এসে চিত্রার পাশে দাঁড়ালেন। চিত্রাকে চমকে দিয়ে তার পিঠে হাত রাখলেন। নরম গলায় বললেন, মাগো! আমি খবর পেয়েছি মেয়েটা মারা যাচ্ছে। কেঁদে কি আর মৃত্যু ফেরানো যায়।
চিত্রা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, মৃত্যু ফেরাবার জন্যে কাঁদছিনা। কষ্টে কাঁদছি। এক ঘণ্টা সময় হাতে পেলেও মৃত্যু ফেরানো যেত।
মহিলা বললেন, মা আমি ব্যবস্থা করছি। একটা হেলিকপ্টার আনার ব্যবস্থা করছি। এই জায়গার ঠিক লোকেশন দরকার। রেলের কাউকে খবর দিয়ে আনতে পারবে? যার মাধ্যমে ঠিক ঠিক লোকেশনটা আমি জানতে পারি?
হতভম্ব চিত্রা বলল, আপনি কিভাবে হেলিকপ্টার আনবেন? আপনার পরিচয় জানতে পারি?
মহিলা বললেন, আমার একটাই পরিচয়। আমি একজন দুঃখী মা। ছেলের ডেডবডি নিয়ে গ্রামে যাচ্ছি। আমার একটাই ছেলে। ছেলের বাবা মারা গেছেন দশ বছর আগে। সময় নষ্ট করে লাভ নেই তুমি রেলের কোনো একজনকে ডাক।
ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার রওনা হয়েছে। দুজন মাত্র যেতে পারবে। রোগীর সঙ্গে যাচ্ছে তার ছেলে এবং আশহাবের মা সাজেদা বেগম। তিনি চিত্রাকে ডেকে কঠিন ভঙ্গিতে বলেছেন—বৌমা আমার ছেলেকে তোমার হাতে রেখে গেলাম। চোখে চোখে রাখবে। সুযোগ পেলেই যেন চুকচুক করে কিছু না খায়। এতদিন আমি দেখেছি। এখন তুমি বাড়ির বৌ তুমি দেখবে।
রশীদ উদ্দিন পাশেই ছিলেন। তিনি চমকে উঠে বললেন, তোমরা এই ফাঁকে বিয়েও করে ফেলেছ। আশ্চর্য তো!
সাজেদা বিরক্ত হয়ে বললেন, আশ্চর্য হবার কি আছে? বয়স হয়েছে বিয়ে করবে না? ধেং ধেং করে প্রেম করে বেড়াবে? কৃষ্ণ লীলা আমার পছন্দ না। আমি প্রেম করার বিপক্ষে। প্রেম যদি করতেই হয়—বিয়ের পরে করা উচিত। সবচে ভাল হয় না করলে।
রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনার কথাবার্তা আমার অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে। আপনার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হওয়া অতীব জরুরি।
সাজেদা আঁচল তুলে ঘোমটা দিতে দিতে চিত্রাকে বললেন, বৌমা। বুড়াটাকে আমার সামনে থেকে যেতে বলো। বেলাজ বুড়া।
মন্ত্রী সাহেবের আত্মীয়স্বজন চলে এসেছেন। তারা সেলুন কারে উঠেছেন।
ট্রেনের ইনজিন ঠিক হয়ে গেছে। এক্ষুনি ট্রেন ছাড়বে। যাত্রীরা হেলিকপ্টারের চারদিকে ভীড় করে আছে বলে ট্রেন ছাড়া যাচ্ছে না।
হেলিকপ্টারের পাখা ঘুরতে শুরু করেছে। যাত্রীরা বিকট শ্লোগান দিল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবুল খায়ের! জিন্দাবাদ। তারা ধরেই নিয়েছে এই কাজটা মন্ত্রী সাহেব থাকাতেই সম্ভব হয়েছে।
সুরমা তার বোন এবং ভগ্নিপতির সঙ্গে হাত-পা নাড়িয়ে গল্প করছেন— তোর দুলাভাইয়ের মানুষের প্রতি মমতাটা কি রকম দেখলি। চিনে না, জানে
একজনের জন্যে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করেছে। তার যত মমতা পাবলিকের জন্যে নিজের ফ্যামিলির দিকে সে ফিরেও তাকায় না।
যমুনা বলল, আপা তুমি দুলাভাইকে একটা বক্সিং দাও।
সুরমা বললেন, আমি পারব না। তুই দিয়ে আয়।
যমুনা উঠে গেল। খায়ের সাহেবের পেটে খোঁচা দিয়ে বলল, দুলাভাই! আপনি এত ভাল কেন?
কিছুক্ষণের গল্প শেষ। পাঠকদের সামান্য কৌতূহল থাকতে পারে চিত্রা এবং আশহাবের কি হল। ওরা কি বিয়ে করেছে? না-কি যে যার পথে গিয়েছে। অংকবিদ রশীদ উদ্দিনেরই বা কি হল?
রশীদ উদ্দিনের কি হল বলতে পারছি না। উনি পোটলা পুটলি নিয়ে ভুল এক স্টেশনে নেমে পড়েছেন। তার পিছনে পিছনে কি মনে করে জানি মাওলানাও নেমে পড়েছেন।
চিত্রা সাজেদা বেগমের কামরায় ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে যাতে কেউ ঢুকতে না পারে। গভীর রাতে বাতি-টাতি নিভিয়ে সে ফিস ফিস করে লিলিকে টেলিফোন করল—
এই লিলি হ্যালো। একটা গোপন কথা শুনবি?
অবশ্যই শুনব।
আমি একজনের প্রেমে পড়েছি।
বলিস কি?
অনেকক্ষণ তাকে দেখতে পাচ্ছি না, দুঃখে-কষ্টে আমার মন ভেঙে যাচ্ছে।
লোকটা কে?
ডাক্তার। আশহাব নাম।
উনি কোথায়?
আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
লিলি বলল, গাধামী করবি না। এক্ষুনি দরজা খুলে তাকে ভেতরে ডেকে নে।
কি অজুহাতে ডাকব?
যে কোনো অজুহাতে ডাকবি। মেয়েদের অজুহাতের অভাব আছে না-কি?
চিত্রা দরজা খুলে বলল, আমার ক্ষিধে লেগেছে। খাব। খাবারগুলি গরম করে আনার ব্যবস্থা করো তো। চিত্রা মানুষটাকে তুমি তুমি করে বলছেতার মোটেও খারাপ লাগছে না। তার মাথায় একটা দুষ্টামিও ঢুকেছে। সে ঠিক করেছে খাবার সময় আশহাবকে চমকে দিয়ে বলবে, আমি হা করছি আমাকে খাইয়ে দাও।
ট্রেন অন্ধকারে ছুটে চলছে। সেলুন কারে গান হচ্ছে—আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে। ট্রেনের যাত্রা কি জোছনা স্নাত কোনো অলৌকিক বনের দিকে?
Leave a Reply