০৮. দ্য কিডিচ ওয়ার্ল্ড কাপ

০৮. দ্য কিডিচ ওয়ার্ল্ড কাপ

অরণ্যের মধ্যে পায়েহাটা পথ ধরে যেসব জিনিসপত্র কিনেছে সেগুলো বগলদাবা করে ওরা মি. উইসলির পিছু পিছু চলল অরণ্যের শেষে কিডিচ খেলার মাঠে। ওরা ছাড়া আরও অনেক মানুষ চলেছে হাতে লণ্ঠন নিয়ে। বিচিত্র তাদের বেশভূষা, কথাবার্তা। কিন্তু যাত্রাপথ এক। তারা গান গাইছে, নাচছে… আনন্দে সাগরে ভেসে চলেছে। ওরা যেখানে তাকায় সেখানেই মানুষের ঢল। অরণ্যের আবহাওয়া বদলে গেছে, অরণ্যের শেষে পৌঁছে দেখতে পেল একটা বিরাট স্টেডিয়াম। হ্যারি সোনার দেওয়াল ঘেরা সেই বিরাট স্টেডিয়ামের ভিতরে কিছুই দেখতে পেল না, তবে এর আয়তন দেখে মনে হল তার মধ্যে কম করে দশটি ক্যাথিড্রল স্থান পেতে পারে।

উইসলি, হ্যারির উত্তেজনায়–আনন্দে ভরপুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কম করে একশ হাজার মানুষ স্টেডিয়ামে অনায়াসে বসতে পারে। মিনিস্ট্রির টাস্কফোর্স গত এক বছর ধরে এখানে লাগাতার কাজ করে চলেছে। মাগলরা এখানে সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। জানি না কেন হঠাৎ ওদের মনে হয়েছে যারা খেলা দেখতে এসেছে তাদের সঙ্গে মিশে যাওয়া উচিত। তাহলেও প্রতিটি ইঞ্চিতে আমাদের ফিট করা হয়েছে মাগল–রিপোলিং চার্মস। যখনই ওরা এখানে আসবে তখনই ওদের মনে হবে ওদের কিছু কাজ আছে এবং দ্রুত স্থান ছেড়ে চলে যাবে যাকগে ওদের ভাল হোক।… কথা বলতে বলতে ওরা স্টেডিয়ামের গেটের কাছে পৌঁছাল। ওরা আসবার আগেই ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার মানুষ। সকলেই উত্তেজনায় জোরে জোরে কথা বলে চলেছে টিকিট পাবার ভাগ্যের আশায়।

প্রাইম সিটস!…… গেটের মুখে মিনিস্ট্রির গেট–কীপার ওদের টিকিট দেখে বলল–টপবক্স! সোজা ওপরে… আর্থার যত পার তাড়াতাড়ি যাও।

স্টেডিয়ামের সিঁড়ি সুসজ্জিত। দামী পার্পল রঙের কার্পেটে মোড়া। ভিড়ের পিছু পিছু ওরা ওপরে উঠতে লাগল। সিঁড়ির ডাইনে বাঁয়ে দরজা। ওদের অনেক উপরে উঠতে বলছে। ওরা তাই শেষ পর্যন্ত উঠল। যেখানে একটা ছোট ঘরের মতো ছোট বাক্স। সেখানে বসলে গোন্ডেন গোলপোস্টের দুধারটা দেখা যায়। এক লাইনে বারটা বেগুনি–লাল রঙের চকচকে চেয়ার পাতা। হ্যারিরা উইসলির সঙ্গে প্রথম সারিতে বসে পড়ে সামনে তাকাল। জীবনে হ্যারি এর আগেও ওই রকম বৈচিত্র্যময় দৃশ্য দেখেনি। দেখা নয়… ভাবতেও পারেনি।

হাজার হাজার চেয়ার অনেকটা উঁচু পাহাড় থেকে সমতল ভূমিতে নামার মতো সাজান। প্রায় সব ভর্তি হয়ে গেছে। খেলার মাঠটা ডিম্বাকার। পিচটা মনে হয় ভেলভেট দিয়ে মোড়া। পিচের তিনদিকে তিনটি গোল হুপস। পঞ্চাশ ফিট উঁচু। হ্যারি যেখানে বসে আছে তার ডানদিকের বিপরীতে বড় ব্লাকবোর্ড। বোর্ডের লেখা পড়তে ওকে মাথা উঁচু বা নিচু করতে হয় না। একই লেভেলে। মাঝে মাঝে সেই বোর্ডে কিছু লেখা ফুটে উঠছে আবার মুছে যাচ্ছে। মনে হয় কোন এক অদৃশ্য হাত সেই লেখা মুছে দিচ্ছে।… পিচের ওপাশে একটা বিজ্ঞাপনের দিকে চোখ পড়ল।

দ্যা ব্লুবটল : একটা ঝাড়ু সব পরিবারের জন্য নিরাপদ, বিশ্বস্ত এবং অ্যান্টি বার্গলার বাজার…. মিসেস স্কোয়ার্স… সব রকমের কাজের জন্য ম্যাজিক্যাল মেস রিমুভার–ব্যথা দাগবিহীন! গ্রেডরেগস উইজার্ডওয়্যার–লন্ডন, প্যারিস, হোগসমেড…

হ্যারি বিজ্ঞাপন থেকে চোখ ফিরিয়ে ওদের সারিতে যারা বসে রয়েছে তাদের দিকে তাকাল। ওরা আসবার আগেই সেই সারিটা বলতে গেলে শূন্য ছিল। শুধু এককোণে শেষ সিটের একটা ছেড়ে বসেছিল একটি এল, পা দুটো তার এত ছোট যে সিটে বসে জমি স্পর্শ করতে পারছে না। গায়ে টোগার (প্রাচীন রোমান আলখেল্লা) মতো করে পড়া একটা তোয়ালে। মুখটা ওর হাত দিয়ে আবৃত। কিন্তু ওর কান দুটো কেমন যেন অদ্ভুত… ওইরকম কান হ্যারি খুব কমই দেখেছে।

ডব্বি? হ্যারি অস্ফুট স্বরে এলফকে দেখে বল।

এলফ ওর মুখ থেকে হাত সরাতেই হ্যারি ওর বড় বড় বাদামী চোখগুলো দেখতে পেল। নাকটা টমেটোর মতো। অবশ্যই ও ডব্বি নয়–সন্দেহ নেই, এক হাউজ-এলফ (বাসন আকৃতির বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণকারী)। হ্যারির বন্ধু ঠিক ডব্বির মতো দেখতে। হ্যারি ওকে ওর মালিক ম্যালফয় পরিবার থেকে মুক্ত করেছিল (এলফরা অনেকটা ক্রীতদাসের মতো)।

ওকে দেখে এলফ বলল–স্যার আমাকে কি ডব্বি বলে ডেকেছেন? ওর গলার স্বর তীক্ষ্ণ ও ভয় মিশ্রিত–কাঁপা কাঁপা। হ্যারির কোনও সন্দেহ নেই ও একটি মেয়ে। রন, হারমিওন ওকে মুখ ঘুরিয়ে দেখল। ডব্বির নাম অনেকবার হ্যারির মুখে শুনেছে; কিন্তু চাক্ষুস দেখেনি। রন ও হারমিওন ছাড়াও মি. উইসলি বামন আকৃতি মেয়েটির দিকে তাকালেন।

–দুঃখিত, হ্যারি বলল–অনেকটা তোমায় আমার পরিচিত ডবির মতো দেখতে তাই…।

-আমি ডব্বিকে চিনি, স্যার! ও বলল। তখনও ওর মুখ ঢাকা। যেন ওর চোখে আলো পড়েছে তার থেকে বাঁচতে চাইছে। আমার নাম উইঙ্কী স্যার আপনাকে স্যার–ওর চকচকে চোখ দুটো হ্যারির কপালের কাটা দাগের ওপর পড়ল।–আপনি নিশ্চয়ই হ্যারি পটার!

–হ্যাঁ ঠিকই ধরেছে; হ্যারি বলল।

–ডব্বি সবসময় আপনার দয়ার কথা বলে স্যার! কথা বলার সময় ও মুখ থেকে হাত সরাল। ওকে দেখে মনে হয় যেন খুবই আতংকিত।

হ্যারি বলল–ডব্বি কেমন আছে?… স্বাধীন জীবন নিশ্চয়ই ভাল লাগছে ওর?

উইঙ্কী মাথা নেড়ে বলল–ভাল আছে স্যার; সার বলে ডাকে আপনাকে, আপনার নাম বলতে সে অজ্ঞান স্যার… কিন্তু স্যার, আমার মনে হয় ডব্বিকে স্বাধীনতা দিয়ে… মানে আমি যা বুঝেছি তাতে ওর তেমন ভাল হয়নি।

-এমন কথা বলছ কেন? হ্যারি একটু আশ্চর্য হয়ে বলল–কেন কী হয়েছে। ওর?

উইঙ্কীর গলায় বেদনার সুর–স্বাধীনতা ওকে বিভ্রান্ত করেছে। ওর ধারণা অন্যরকম, ঠিক মতো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না স্যার।

হ্যারি বলল–কেন পারছে না?

উইঙ্কী জবাবটা এত চাপা গলায় বলল যে বলা মুস্কিল ও কাজ করে পারিশ্রমিক চায়।

–পারিশ্রমিক? হ্যারি অবাক হয়ে বলল–অবশ্যই, পরিশ্রম করলে পারিশ্রমিক অবশ্যই চাইতে পারে। তাতে অপরাধ কোথায়, উইঙ্কী কথাটা শুনে বেশ ভয় পেয়ে গেল। আবার হাত দিয়ে অর্ধেক মুখটা ঢাকল–আমরা তো পারিশ্রমিক চাইতে পারি

…… না না না পারি না। তাই আমি বলেছি, তুমি একটা ভদ্র দয়ালু পরিবার খুঁজে নিয়ে সেখানে কাজ কর ডব্বি। ও অবশ্য বড় বড় লোকদের কাছে যাচ্ছে তবে লোকে মনে করে আমাদের কাজের বদলে পারিশ্রমিক চাওয়া অন্যায়। উচিত নয় নিয়ম অনুসারে। এমন করলে অন্য গবলিনদের মতো ধরা পড়বে। মন্ত্রণালয়ের আইনে তাতে নেই স্যার।

উইঙ্কী বলল–স্যার আমরা ক্রীতদাস। খেতে পরতে পাই তাই ভাগ্য। এর ওপর পারিশ্রমিক? হ্যারি পটার আপনি তো জানেন আমাদের জীবন অন্ধকার। ফুর্তি–আনন্দ তো দূরের কথা! বামনক্রীতদাসরা মুখ বুজে সেবা করে যাবে। সব সময় নিচু হয়ে থাকতে হবে।

–তাহলে তোমাকে এত উঁচুতে পাঠাল কেন?

–আমি মাস্টারের সিটে বসে আছি। তিনি ব্যস্ত মানুষ… এলেই চলে যাব।

রন বলল–মেয়েটা তাহলে বাড়ির ক্রীতদাস। বাড়ির সবকিছু দেখাশুনা করে। অদ্ভূত অবস্থা এদের।

হ্যারি বলল–ডব্বির আরও বেশি ছিল।

রন ওর বয়নোকুলারটা বার করে সেটা পরীক্ষা করতে লাগল। স্টেডিয়ামের একধারটা দেখতে লাগল।

অন্যদিকে হারমিওন ভেলভেটে ঘোড়া খেলার প্রোগ্রামটা দেখতে লাগল।

–টিম ম্যাসকট দেখানোর পর খেলা শুরু হবে। হারমিওন প্রোগ্রামটা জোরে জোরে পড়তে লাগল।

–সব দেশের তাদের ম্যাকসট নিয়ে ঘোড়া দেখতে খুব ভাল লাগে। সকলেই তাদের দেশকে বড় করে দেখতে চায়। তা সে যেমনই হোক। ছোট–বড়র প্রশ্ন নেই।

আধঘণ্টার মধ্যে ওরা যে প্রায় খালি বক্সটায় বসেছিল সেটা ভরে গেল। খ্যাতনামা জাদুকরদের কাছে গিয়ে উইসলি করমর্দন করতে লাগলেন। পার্সি ওদের দেখে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছে না। বার বার উঠে উর্ধতন অফিসারদের সঙ্গে হাত মেলাতে হচ্ছে। ম্যাজিক মন্ত্রী কর্নেলিয়স ফাজ, এলে পার্সি তাকে অভ্যর্থনা করার জন্য এত বেশি নত হল যে চোখ থেকে চশমাটা খুলে মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল। পার্সি ভাঙা চশমাটা তার জাদুদণ্ড দিয়ে তৎক্ষণাৎ মেরামত করে নিল। তারপর নিজের আসনে চুপ করে বসে রইল। হ্যারির সঙ্গে ফাজের পুরনো বন্ধুর মতো হেসে হেসে কথা বলতে দেখে পার্সির একটু ঈর্ষা হল সন্দেহ নেই। ফাজ হ্যারির হাত ধরে উপস্থিত সব বড় বড় অফিসারদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন। পার্সি আরও অখুশি হল।

কাছেই বুলগেরিয়ান মিনিস্টার গম্ভীর হয়ে বসেছিলেন।

–হ্যারি পটার… নিশ্চয়ই আপনি নাম শুনেছেন। ফাজ খুব জোরে জোরে বুলগেরিয়ন মিনিস্টারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন হ্যারিকে। কথাগুলো ইংরেজিতে বললেন। মনে হয় বুলগেরিয়ান মিনিস্টার এক বর্ণও ইংরেজি জানেন না। বললেন-এ হ্যারি পটার… আপনি জানেন ওকে… ইউ নো হু ওকে মারতে পারেনি… বেঁচে গেছে।

বুলগেরিয়ান জাদুকর হ্যারি পটারের কপালের কাটা দাগের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর আঙ্গুল দেখিয়ে নিজ ভাষায় দারুণ উত্তেজিত হয়ে বকবক করতে লাগল।

–আমি ভাষাবিদ নই। বার্টি ক্রাউচ ভাষা সম্বন্ধে এক্সপার্ট। ওর সাহায্য নিতে হবে।… আহ… বাটির বাড়ির পেঁচাটা দেখছি ওর জায়গাটা দখল করে রেখেছে। যখন আসবে উঠে যাবে।… ওই তো লুসিয়াস এসে গেছে।

হ্যারি রন, হারমিওন পেছনে তাকাল। বসে আছেন ম্যালফয়, তার ছেলে ড্র্যাকো ম্যালফয় আর ডব্বি। আর এক মহিলা সম্ভবত ড্র্যাকোর মা। হ্যারি আর ড্র্যাকো ম্যালফয় হোগার্টস-এ সহপাঠী হলে ও প্রথম থেকে হ্যারির প্রতিদ্বন্দ্বি। স্লিদারিন হাউজের আবাসিক ছাত্র। ফ্যাকাশে চেহারা, লম্বা নাক উঁচল মুখ… সাদা সোনালী চুল। ড্র্যাকো অনেকটা ওর বাবা লুসিয়াস ম্যালফয়ের মতো দেখতে। ম্যালফয় এমনিতে দেখতে ভালই। ম্যালফয় ফাজকে দেখে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে বলল–ফাজ কেমন আছো? আমার মনে হয় আমার স্ত্রীর সঙ্গে তোমার পরিচয় নেই।… আমার স্ত্রী নার্সিা… আর আমার পুত্র ড্র্যাকো।

ফাজ ম্যালফয়ের স্ত্রী নার্সিসাকে বলল, ভাল আছেন তো? ও হ্যাঁ মি. অবল্যানকস–অবালনসক… মি. উনি বুলগেরিয়ান মিনিস্টার অফ ম্যাজিক। দুঃখের বিষয় আমাদের ইংরেজি একটি শব্দের মানে বুঝতে পারছেন না।… হা ওই তো আর্থার উইসলি। আপনারা তো ওকে অবশ্যই চেনেন।

হ্যারি, ম্যালফয় আর উইসলির দিকে তাকাল। হ্যারির মনে আছে তাদের ফ্লাওয়ারিশ অ্যান্ড ব্লটস বুক শপে সামনাসামনি তর্ক ও প্রায় হাতাহাতির কথা। ম্যালফয়ের ঠাণ্ডা ধূসর বর্ণের চোখ মি. উইলসির ওপর পড়ল। পড়তেই অন্যদিকে তাকালেন। উইসলিও মুখ ফেরালেন।

–হায় ঈশ্বর! আর্থার, ম্যালফয় বলল–আপনি টপ বক্স সিটের টিকেট কিনলেন কি করে? আশাকরি এই টিকেট কেনার জন্য আপনার বাড়ি বিক্রি করতে হয়নি?

ফাজ কিন্তু ওদের কথাবার্তা একেবারেই শোনেনি। ফাজ মি, উইসলিকে বললেন–জানেন, লুসিয়াস ম্যালফয় সেন্ট মাংগোস হাসপাতালে ম্যাজক্যিাল ম্যালাডিস এন্ড ইনজুরিসের জন্য অনেক অর্থ দান করেছে, জানো আর্থার? লুসিয়াস আমার গেস্ট।

মি. উইসলি শুক হাসিতে বললেন–বাঃ বেশ ভালো।

ম্যালফল এখন হারমিওনের দিকে তাকালেন। ম্যালফয় তার নিজের পিওর রক্ত সম্বন্ধে অনেক গর্ব। উনি জানেন হারমিওন পিওর ব্লডের নয়। জাদুকর ও মাগল এ দুটোর মিশ্রিত। ম্যালফয়ের কাছে মাগলরা অতি নিচ।

ড্র্যাকো তার বাবা-মার মাঝে বসতে বসতে রন, হারমিওন ও হ্যারির দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকাল।

রন বলল–বিরক্তিকর অপদার্থ! ওরা আবার খেলার মাঠের পিচের দিকে তাকাল। অল্পক্ষণ পরেই লাডো বেকম্যান টপ বক্সে এসে হাজির।

–সকলে রেডি? এসেই জিজ্ঞেস করলেন। ওর লাল গোল মুখটা বিখ্যাত, গ্রেট এডামের মতো। মন্ত্রী মহোদয় আপনার অনুমতি নিয়ে আজকের খেলা শুরু করতে পারি?

ফাজ শান্তভাবে বললেন–তুমি প্রস্তুত হলে আমরাও প্রস্তুত। লাডো ওর পকেট থেকে এক ঝটকায় ওর দণ্ডটা বার করল। নিজের গলার কাছে এনে বলল সনোরার্স! তারপর হাজার হাজার দর্শকদের সামনে ধারা বিবরণী শুরু করল। ওর গলা প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল।

ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ আপনারা আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করন। চারশত বিশ সেকেন্ডের বিশ্বকাপ কিডিচ ফাইনাল খেলার শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন।

দর্শকরা আনন্দে অধীর হয়ে চেঁচাতে লাগল, হাততালি দিল। বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার পতাকা আন্দোলিত হতে লাগল।… তারপর যে যার জাতীয় সঙ্গীত গাইতে লাগল। বিরাট ব্ল্যাকবোর্ডটা মুহূর্তের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেল। ফুটে উঠল (বার্টি বটর্স এভরি ফ্লেবার বিনস-এ রিস্ক উইথ এভরি মাউথফুল!) এখন বড় বড় অক্ষরে লেখা : বুলগেরিয়া–৩ আয়ারল্যান্ড–০।

-এখন আর বেশি কথা না বলে টিমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। বুলগেরিয়ান টিম ম্যাসকট…! ডানধারের দর্শকরা আনন্দে ফেটে পড়ল।

মি. উইসলি বললেন, জানি না ওরা সঙ্গে করে কি এনেছেন। কথাটা বলে এগিয়ে বসলেন। তারপর চশমাটা মুছতে মুছতে বললেন–ভীলা!

–সেটা আবার কী? হ্যারি জিজ্ঞেস করে।

হ্যারির প্রশ্নের সাথে সাথে সুন্দরী মেয়েরা মাঠে নেমে পড়ল। হ্যারি পেয়ে গেল ভীলার অর্থ, তার প্রশ্নের জবাব। জীবনে হ্যারি এত সুন্দরী মেয়েদের দেখেনি। ও ঠিক বুঝতে পারে না ওরা জীবন্ত নারী না অন্য কিছু… না ওরা জীবিত মানুষ হতে পারে না। ওদের দেহের চামড়া এত ঝকমক করছে কেন? গায়ে কী চাঁদের আলো পড়েছে? অথবা রেশমের মতো সোনালী চুল ওদের সারা অঙ্গে লুটোপুটি খাচ্ছে?

–তারপরই শুরু হল যন্ত্র সঙ্গীত… হ্যারি আবার নিজের জগতে ফিরে এল।

ভীলারা যন্ত্রসঙ্গীতের তালে তালে দারুণ ভঙ্গিমায় নাচতে শুরু করল। হ্যারির মন তখন সম্পূর্ণ ফাঁকা… ওর সামনে শুধু অগণিত মানুষ–ঝলমলে কিডিচের মাঠ… আর স্বর্গের পরীদের মতো ছন্দে ছন্দে নৃত্যরতা সুন্দরী মেয়ের দল ….. পৃথিবীতে যেন দুঃখ–কষ্ট কিছুই নেই… শুধুই আনন্দ!

দেখতে দেখতে ভীলাদের নৃত্য আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। অসম্পূর্ণ ভাললাগা ওর কিশোর মনোজগতে আঁকড়ে রইল। ওর মন চাইল একদল জাদুকরদের সঙ্গে বসে না থেকে ছুটে চলে যায় মাঠে…… সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে মিশে যায়… কিন্তু তা কি সম্ভব?

-এক দৃষ্টে তুমি কি দেখছ হ্যারি। অদূর থেকে হারমিওন জিজ্ঞেস করল।… হ্যারির চিন্তা–ভাবনা বাজনার তারের মতো টুং করে ছিঁড়ে গেল।

সঙ্গীত তখন থেমে গেছে। নাচ থেমে গেলেও ভীলারা দাঁড়িয়ে রয়েছে। অগণিত দর্শকরা উম্মাদের মতো চিৎকার করছে… তোমরা থাক… মাঠ ছেড়ে যেও না। আকাশ বাতাস মুখরিত… ভীলা… ভীলা–ভীলা।

হ্যারি ধীরে ধীরে হারমিওনের দিকে তাকাল। রনের একটা পা বক্সের দেওয়ালে মনে হয় এখনই মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

রনের মাথার টুপি থেকে উইসলি শ্যামরকস (আয়ারল্যান্ডের জাতীয় প্রতীক) ফেলে দিলেন।

হারমিওন হ্যারির কাছে এসে ওকে চেপে ধরে সিটে বসিয়েছিল।

বেগম্যানের গলা শোনা গেল–দয়া করে আপনারা আপনাদের জাদুদণ্ড আইরিশ টিমের জন্য তুলে ধরন।

তোলার সঙ্গে সঙ্গে যেটাকে সবুজ–স্বর্ণের ধ্রুব রশ্মি–মনে হচ্ছিল সেটা তীব্র গতিতে স্টেডিয়ামের উপরে উঠতে লাগল। সম্পূর্ণ স্টেডিয়ামকে প্রদক্ষিণ করে দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল।… তারপর দুটোই গোলপোস্টের দিকে সশব্দে ছুটে গেল। হঠাৎ আকাশে একটা রংধনুর উদয় হল–পিচের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দুটো উজ্জ্বল বলকে যুক্ত করল। জনতা হর্ষধ্বনি করে উঠল–উ–উ–উ–উ এবং আ আ–আ–আ যেন ওরা আতসবাজি দেখছে।… তারপর রংধনু একটু একটু করে মিলিয়ে গেল… দুটুকরো বল আবার একটা হয়ে গেল। বলটা বিরাট আয়ারল্যান্ডের জাতীয় প্রতীক হয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভাসতে লাগল। আকাশে শুধু নয় দর্শকদের স্ট্যান্ডের ওপরেও। মনে হয় আকাশ থেকে সোনার জলের বৃষ্টি সেই জাতীয় প্রতীক থেকে দর্শকদের গায়ে পড়ছে।

–অপূর্ব, রন চিৎকার করে উঠল।… জাতীয় প্রতীক থেকে তারপর সোনার শিলা বৃষ্টির মতো পড়তে শুরু করল প্রত্যেকটি দর্শকদের গায়ে–মাথায়। হ্যারি চারপাশে ছড়িয়ে পড়া শ্যামরকস কুড়োতে কুড়োতে বুঝতে পারলো সেই জাতীয় প্রতাঁকের অন্তরালে হাজার হাজার ছোট ঘোট দাড়িওয়ালা মানুষ। তাদের গায়ে লাল ওয়েস্ট কোট, প্রত্যেকের হাতে একটা করে ক্ষুদ্রাকার সোনা অথবা পান্নার ল্যাম্প।

লেপরেচাউনস! মি. উইসলি হাজার হাজার দর্শকদের স্বতঃস্ফূর্ত চিঙ্কারের মধ্যে বলে উঠলেন। অনেকেই তখন পাগলের মতো চেয়ারের তলায়, মাটি থেকে স্বর্ণমুদ্রা সগ্রহ করতে ব্যস্ত।… নিজেদের মধ্যে মারপিট করছে।

এই নেও–রন খুব খুব আনন্দে একমুঠো সোনার মুদ্রা হ্যারিকে হাতে দিয়ে বলল। অমনি কিউলারসের জন্য (অসীম শক্তিশালী লোক)।… এখন তুমি আমাকে ক্রিস্টমাসের হ্যাট কিনে দিতে পারবে।

গ্রেট শ্যামরক অদৃশ্য হয়ে গেল, লেপরেচার্মস গোঁত্তা খেয়ে ভীলার অপরদিকে গোত্তা খেয়ে পড়ল। ওরা খেলা দেখার জন্য এখন শান্ত হয়ে বসল।

-এবং এখন ভদ্র মহিলা ও ভদ্ৰ মহোদয়গণ সবাইকে বুলগেরিয়ান কিডিচ টিমের জন্য অভিনন্দন জানাতে অনুরোধ করছি। আমি আপনাদের দিচ্ছি ডিমিট্ৰভের কাছে।

খেলা শুরু হয়ে গেল। জোগা, লেভস্কি, ভালচানভ, জেলকভ!… ভিক্টর ক্রাম, (মাত্র সতর বছর বয়সী)… সকলেই দূর্দান্ত খেলছে। কে হারে, কে জেতে কেউ বলতে পারছে না।

বেগম্যান উচ্চস্বরে কমেন্ত্রি বক্স থেকে বলল-এবার আপনারা আইরিশ টিমকে শুভেচ্ছা জানান। কল্লোলী, রিয়ান, ট্রয়, মুলেট, মোরান, কুইগলে–আ আ আনন্দ–লিঙ্ক।

নীল জার্সি পরা সাতজন পিচের ওপর দিয়ে ছুটল। হ্যারি ওর বায়োনিকুলার ঘুরিয়ে দেখল… দেখল প্রত্যেকটি প্লেয়ারের ঝাড়ুতে লেখা ফায়ার বোল্ট। আর তাদের নাম রূপালী অক্ষরে জামার পিঠে এব্রয়ডারি করা।

এবারে ইজিপ্ট থেকে এসেছেন আমাদের রেফারি উইজার্ড আন্তর্জাতিক কিডিচ এসোসিয়েশনের প্রধান সুখ্যাত–হাসান মুস্তফা।

মুস্তাফা বেঁটে খাট মানুষ। মাথায় গোল টাক। গোঁফ অনেকটা আঙ্কেল ভার্ননের মতো। একটা হাতে বড় কাঠের বাক্স। অন্য হাতে ঝাড়ু। হ্যারি ওর অমনিওকুলার স্পিড ডায়েল নর্মাল করে দিল। দেখল মুস্তফা ঝাড়ুর ওপর বসল তারপর কাঠের বাক্সতে প্রচণ্ডভাবে কি করল। বাক্স থেকে চারটে বল তীর বেগে বেরিয়ে এল। বাঁশি বাজালেন মুস্তফা তীব্রভাবে। বেগম্যান বলল, দি ই–ই–ই–ই…র অফ। মুলার! ট্রয়! মোরান, ডিট্রিভ। মুলারকে পাস দিয়েছে।..

হ্যারি ওর অমনিকুলার নিয়ে খেলা দেখে যেতে লাগল। নানারকমভাবে নিজের খুশি মতো। এর আগে ও এ ধরনের কিডিচ খেলা দেখেনি। খেলা চলেছে… দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ খেলা।

স্কোর বোর্ডে ফ্ল্যাশ হল : বুলগেরিয়া একশ যাই; আয়ারল্যান্ড একসর।

আয়ারল্যান্ডের সাপোর্টাররা জেতার জন্য প্লেয়ারদের বাহবা ও প্রাণপণে চিৎকার করে চলল।

বেগম্যান কমেন্ট্রি বক্স থেকে বলে উঠল–আয়ারল্যান্ড জিতেছে। হঠাৎ খেলা শেষ হওয়ার জন্য ও অবাক হয়ে গেল।

ক্রাম বেঈমানি করেছে। কিন্তু আয়ারল্যান্ড জিতেছে। হে ঈশ্বর, আমি জানতাম না, আমরা কেউ আশা করিনি! হ্যারি হইচই-এর মধ্যে বলল, ওরা জানে হারানো সোজা নয়। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে হাততালি দিতে লাগল, আইরিশরা সত্যিই অনেক ভাল খেলেছে, হ্যারি বললো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *