০৫. উইসলি’র উইজার্ড হুইজেস

০৫. উইসলি’র উইজার্ড হুইজেস

ফায়ার প্লেসের সুরঙ্গের অগ্নিশিখার মাঝ দিকে হ্যারি ওর দুহাতের কনুই দুপাশে রেখে ঘুরতে ঘুরতে বেরিয়ে এল। সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসার আগে হাত দুটো বাড়িয়ে দিলে ফ্রেড ওকে ধরে ফেলল। এই প্রথম জীবনে আগুনের সুড়ঙ্গ দিয়ে চলার অভিজ্ঞতা। বেরিয়ে আসার পর দারুণ অস্থিরতা, দুর্বলতা ওকে যেন পঙ্গু করেছিল। ফ্রেড না ধরে ফেললে ওর অবস্থা খুবই কাহিল হত।

–আগুনে তোমার কিছু হয়নি তো? ফ্রেড ওর হাত ধরে নামাতে নামাতে বলল।

হ্যারি অনেক কষ্টে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল–ডাডলিকে তুমি কি দিয়েছিলে?

ফ্রেড হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, টন–টাং–টফি। জর্জ আর আমি ওটা বানিয়েছি। একজনের ওপর এটা এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে। অনেকদিন বাদে টেস্ট করার জন্য একজনকে পেলাম। পুরো গরম কালটা আমাদের টন্ টাং বানাতে লেগেছে। টেবিলের একপাশে লাল চুলওয়ালা বিল আর চার্লিকে ও এই প্রথম দেখল–মি. উইসলির দুই বড় ছেলে।

কাছে যে বসেছিল একটা হাত হ্যারির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল–কেমন আছ?

হ্যারি হাত মেলাল। চার্লি রুমানিয়াতে ড্রাগনের ওপর গবেষণা করছে। চার্লি অনেকটা ফ্রেড আর জর্জের মতো দেখতে বেঁটে খাটো ও মজবুত চেহারা। পার্সি আর রন অন্যরকম, লম্বা ছিপছিপে। মুখ দেখলেই সভ্য আর ভাল মানুষ মনে হয়। রোদের তাপে গায়ের চামড়া ট্যানড হয়ে গেছে। বলিষ্ঠ দুই হাত। একটা হাতে পোড়াদাগ। জায়গাটা শুকিয়ে গিয়ে চকচক করছে।

বিলও হ্যারির সঙ্গে হাত মেলাল। বিল হঠাৎ এসে হাজির হয়েছে। হ্যারি শুনেছে বিল, গ্রিনগটসে, উইজার্ডিং ব্যাংকে কাজ করে। এক সময় হোগার্টে হেডবয় ছিল। ওর মনে এমন একটা ধারণা ছিল ও অনেকটা পার্সির মতো দেখতে, আইন ভঙ্গ করতে ওস্তাদ আর অন্যের ওপর মাতবরি ফলাত। বিলকে দেখে ওর ধারণা পাল্টে গেল। অতি শান্ত ভাল মানুষ। দীর্ঘ চেহারা–মাথায় মেয়েদের মতো বড় বড় চুল, পনিটেল করে রাখে। সব সময়ে ঢল ঢলে পোশাক পরে থাকে। পায়ে ড্রাগনের চামড়ার বুট। কানে রিং দেখে মনে হয় রক কনসার্ট দলে গান গায়।

যখন ওরা কথা–বার্তা বলছে, ঠিক সেই সময় ওদের কানে খুব মৃদু শব্দ ভেসে এল। মি. উইসলি ঘরে হাজির হলেন। দেখে মনে হয় অসম্ভব রেগে আছেন। হ্যারি আগে কখনও এমন ক্রোধান্বিত মুখ দেখেনি।

–আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি তোমার কাণ্ডকারখানায়, তুমি মাগলদের ছেলেটাকে কি খেতে দিয়েছিলে?

–আমি কিছুই দেইনি। গাদাগাদা খাচ্ছিল। সেই সময় মেঝেতে টফিটা পড়ে থাকতে দেখে মুখে পুরে দেয়। গাদাগাদা কেক, পেস্ট্রির সঙ্গে টফি খেতে গেল কেন?

–তুমি ইচ্ছে করেই টফিটা মাটিতে ফেলেছিলে যাতে ও দেখতে পেলে খায়। তুমি জান না ও মোটা হয়ে যাবার জন্য ডায়েটে আছে।

জর্জ কৌতূহলী সুরে বলল, ড্যাডি ওর জিবটা কত লম্বা হয়েছিল?

–কম করে চার ফিট।

হ্যারি আর উইসলি দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল।

–তুমি কিন্তু খুব অন্যায় করেছ। এমনিতেই মাগলদের সঙ্গে আমাদের অনেক ভুল বোঝাবাঝির ব্যাপার আছে তার উপর…।

–মাগল বলে ওটা আমরা দিই নি। ওকে দেখেই মনে হয় মজা করা যায়। ইয়া মোটা চেহারা, দেখলেই হাসিতে দম ফেটে যায়। তাই না হ্যারি! জর্জ বলল।

–তাই মি. উইসলি। হ্যারি জোর দিয়ে বলল।

–সে কথা নয়, দাঁড়াও তোমাদের মাকে আসতে দাও।

মিসেস উইসলি কিচেনে ঢুকলেন। মহিলা একটু মোটাসোটা। মুখ দেখলেই বোঝা যায় খুব ভাল মানুষ। তবে ঘরে ঢোকার সময় মুখে একটু সন্ধিগ্ধ ভাব লক্ষ্য করল সকলেই।

–ও হ্যালো ডিয়ার হ্যারি, কেমন আছ? হাসতে হাসতে হ্যারিকে বললেন।

ফ্রেড আর জর্জের কাণ্ডকারখানা মি. উইসলি ওদের মাকে বলতে চান না। কিন্তু মিসেস উইসলির দিকে তাকিয়ে একটু থতমত হয়ে গেলেন। ঠিক দুটি মেয়ে কিচেনে ঢুকল। ওদের একজন হারমিওন গ্রেঞ্জার, রনের বন্ধু। মাথায় বড় বড় বাদামী চুল, আর সামনের দুটি দাঁত বড় বড়। অন্যজন জিন্নি, রনের সবচেয়ে ছোট বোন। দুজনেই হ্যারিকে দেখে হেসে খুশিতে উপচে পড়ল। হ্যারিও হাসতে লাগল। হ্যারি বারোতে আসার পর ওদের আপনজন হয়ে গেছে। সবাই যেন ভাই বোন।

–ব্যাপারটা আমায় খুলে বল আর্থার। মিসেস উইসলি বেশ রেগে গিয়ে বললেন।

–আরে এমন কিছু নয় মন্ত্রী, থমকে গিয়ে বললেন, মি. উইসলি।… ফ্রেড আর জর্জ একটু মজা করেছিল…।

–সত্যি করে বল এবার ওরা কি করেছিল?… উইসলির উইজার্ড হুইজেসের ব্যাপারে নয় তো? হারমিওন দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে বলল, রন, হ্যারি কোথায় ঘুমুচ্ছে? বলছো না কেন?

রন বলল–ওর ব্যাপার ওই জানে। খুব সম্ভব আমার ঘরে। গতবার তো এসে আমার ঘরেই ছিল। এবারে হয়ত সেই ব্যবস্থা হয়েছে।

–যাই ওকে ডেকে নিয়ে আসি। জর্জ বলল।

–না, তোমাদের কাউকে যেতে হবে না, হারমিওন বলল–আমি যাচ্ছি।

রন আর হারমিওন হ্যারিকে ডেকে নিয়ে এল। ও ডাডলির ব্যাপারটা জানে। মজার ব্যাপার সন্দেহ নেই।

–জোক স্টাফ! এইসব করে ফ্রেড আর জর্জ সময় কাটায়। পড়াশুনার ধার দিয়ে যায় না… বিরাট এক তালিকা করেছে জিনিসপত্র যা বানিয়েছে, হারমিওন হাসতে হাসতে বলল।

রন বলল, হেসো না। হোগার্টের যা যা বানিয়েছে সবই মারাত্মক। ছোটখাটো জিনিস বলা যায় না… ওরা হোগার্টে গিয়ে ছেলে–মেয়েদের কাছে বিক্রির তাল করছে। মানে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করবে। মা জানতে পেরে অসম্ভব রেগে গেছেন। ওইসব মারাত্মক জিনিস বানাতে মানা করেছেন। বলেছেন আমি চাই তোমরা ওগুলো পুড়িয়ে ফেল।… পড়াশুনাতে এবারে অনেক কম পেঁচা (মার্ক) পেয়েছ।

আউল হচ্ছে সাধারণ জাদুবিদ্যার স্তর। হোগার্টের ছেলে–মেয়েরা পনের বছর বয়স হলে পায়। যত ভাল তত আউল। জিনি বলল–মা ওইসব জোক–টোক একদম পছন্দ করেন না। চান ভাল পড়াশুনো করে পাস করে অনেক আউল নিয়ে ড্যাডির মতো ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ে চাকরি–বাকরি করুক, ওরা তা চায় না… সেই নিয়ে বাদ বিসম্বাদ!

ওরা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় কথাবার্তা বলছিল। সেকেন্ড ল্যান্ডিং এ ওঠার সময় ঘরের দরজা খুলে একটি ছেলে মুখ বাড়াল। চোখে তার মোষের সিঙের চশমা… আর অত্যন্ত বিচলিত মুখ।

হায় পার্সি, হ্যারি ওকে দেখে বলল।

–ও হ্যালো হ্যারি। কেমন আছ? পার্সি বলল–আমি ভাবছিলাম কারা অসময়ে গোলমাল করছে। আমি এখন অফিসের খুব জরুরি একটা কাজ করছি-একটা রিপোর্ট। হইচই-এ কাজের ব্যাঘাত হয়। বিশেষ করে লোকেরা যখন হাগুল্লা করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামে–ওঠে।

রন রেগেমেগে বলল–আমরা কোনও গোলমাল করছি না।….. দুঃখিত তোমার টপ সিক্রেট কাজের সময় বিরক্ত করার জন্য।

হ্যারি বলল, কী কাজ করছ?

–ইন্টারন্যাশনাল ম্যাজিক্যাল কো–অপারেশন সংক্রান্ত। পার্সি ভারিক্কি চালে বলল। আমরা কলড্রনের থিকনেস সম্বন্ধে স্ট্যান্ডারডাইজ করছি। মানে কলড্রনের কতটা থিকনেস হওয়া উচিত। বিদেশ থেকে যা আমদানি হয় সেই পাত্রগুলো মোটেই উপযুক্ত নয়। কোথাও স্ট্যান্ডার্ড নেই।

রন বলল–কলড্রন স্ট্যান্ডারডাইজ করলেই পৃথিবীর সবকিছু বদলে যাবে। ডেইলি প্রফেট লিখেছে কলড্রন ফুটো হয়ে যাচ্ছে। তাই না?

কথাটা শুনে পার্সির মুখটা গোলাপী হয়ে গেল–রন তুমি ব্যঙ্গ করতে পার… যদি আমরা কোনও স্টান্ডার্ড… আন্তর্জাতিকভাবে আইন না করতে পারি তাহলে আমাদের বাজারে আজেবাজে জিনিসে ভরে যাবে। বিপদের কথা নয় কি?

রন বলল–হা, হা তুমি কথাটা ঠিক বলেছ। হ্যারির সঙ্গে ও ওপরে উঠতে লাগল, পার্সি দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

রনের পিছু পিছু হ্যারি, হারমিওন জিন্নি চলল। নিচ থেকে মিসেস উইসলির গলা শুনতে পেল। তখনও জর্জ আর ফ্রেডের মারাত্মক টফির কথা বলে যাচ্ছেন।

বাড়ির ওপরের ঘরটায় যেখানে রন ঘুমোয়–হ্যারি গতবার যেমন দেখে গিয়েছিল ঠিক তেমনই আছে। শুধু দুটো বেডের জায়গায় চারটে বেড। রনের প্রিয় কিডিচ টিমের গ্রুপ ফটো এখনও দেওয়ালে সাঁটা আছে। টিমের নাম ছাড়লে ক্যাননস। জানালা দিয়ে হাওয়ায় আসা সেটা দুলছে। রনের প্রিয় ব্যাঙ এখন আর ছোটটি নেই… নাদুস নুদুস হয়েছে। ওর প্রিয় ইঁদুর স্ক্যাবার নেই। তার বদলে রয়েছে ছোট একটা লক্ষ্মী প্যাঁচা, রঙটা তার বাদামী। ওই রনের চিঠি প্রিভেট ড্রাইভে হ্যারির কাছে দিয়ে আসে। দেখল ছোট খাঁচার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। চারটে বেডের দুটোর ফাঁক দিয়ে ছোট পিগকে ধমক দিল। ওর নাম পিগওয়াইডেজন। জিন্নি আদর করে নাম রেখেছে পিগ।

বিল আর চার্লস বাড়িতে আসার জন্য ফ্রেড আর জর্জ এখন রনের ঘরে শোয়। পার্সি ওর ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয় না… কেউ থাকলে ওর নাকি কাজের ক্ষতি হয়।

হ্যারি জিন্নিকে বলল-এই, তুমি ওর নাম পিগ দিয়েছ কেন?

–কেন আবার, ইডিয়ট বলে। স্টুপিড–ইডিয়ট।

 রন বলল–মোটেই না, স্টুপিডদের নাম ওই রকম হয় না।

পিগ মনের আনন্দে ডাকছে আর ছোট খাঁচাতে দাপাদাপি করছে। রন সবসময় ওর ইঁদুরের কথা বলে। কি আর করবে ইঁদুরটাকে হারমিওনের বেড়াল ব্রুকস্যাঙ্কস খেয়ে ফেলেছে।

হ্যারি হারমিওনকে বলল, তোমার বেড়ালকে তো দেখছিনে?

ব্রুকস্যাঙ্কস গেল কোথায়?

হারমিওন বলল, বাগানে-টাগানে কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ও বেঁটে খাট ভূতেদের তাড়া করতে ভালবাসে। আগে কখনও ওদের দেখেনি তো।

হ্যারি বলল, পার্সি তাহলে ওর কাজ নিয়ে খুব খুশিতে আছে? কথাটা বলে খাটের কোণায় রনের প্রিয় পোস্টার কিডিচ টিম ছাড়লে ক্যানসে খেলোয়াড়দের দেখতে লাগল।

–খুশিতেই আছে বটে? রন তিক্তভাবে বলল। ড্যাড ওকে না নিয়ে এলে বাড়িতে ফিরতো না। ওর ওপর ওয়ালা যা বলবে তাই করবে। মি. ক্রাউচের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে–কথাও হয়েছে। শুনছি পার্সি নাকি ওর বিয়ের ব্যাপারটা অ্যানাউন্স করবে।… যে কোনও দিন।

হারমিওন বলল, হ্যারি তোমার গরমের ছুটি কেমন কাটলো? তুমি আমাদের পাঠানো ফুড পার্সেল নিশ্চয়ই পেয়েছ?

–হ্যাঁ। পাঠানোর জন্য অশেষ ধন্যবাদ। সত্যি কথা বলতে কি তোমার পাঠানো কেক খেয়ে আমি বেঁচেছি।

রন বলল–আচ্ছা তুমি কী শুনেছ। হারমিওনের দিকে তাকিয়ে কথাটা শেষ করতে পারলো না। হ্যারি জানে রন সিরিয়সের কথা জানতে চায়। জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল; কিন্তু হারমিওন বাধা দিল।

রন আর হারমিওন সিরিয়সের জাদু মন্ত্রণালয়ের আজকাবান থেকে পালানোর ব্যাপারে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। হ্যারির মতই হ্যারির গডফাদারের জীবন সম্বন্ধে ওরা সমান সজাগ। তাহলেও ছোটো মানুষ জিন্নির সামনে সিরিয়স সম্বন্ধে আলোচনা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্তু ডাম্বলডোরও জানেন, সিরিয়সের ব্যাপারটা জানেন ও বিশ্বাস করেন সিরিয়স কোনমতই অপরাধী নয়।

জিন্নি কিছুই জানে না অথচ ওদের কথা গোগ্রাসে গিলছে। হারমিওন বলল নিচে যাই–মাকে একটু সাহায্য করি।

–ঠিক বলেছ। রন বলল।

ওরা আলোচনা থামিয়ে নিচে কিচেনে গেল। দেখল মিসেস উইসলি খোশ মেজাজে ডিনারের ব্যবস্থা করছেন।

ওদের দেখে মিসেস উইসলি বললেন–টেবিলে এগারজনের জায়গা হবে না। আমরা বাগানে বসে খাব। তোমরা আমাকে একটু সাহায্য কর। মেয়েরা তোমরা সাবধানে প্লেটগুলো নিয়ে যাবে, বিল আর চার্লি টেবিল সাজাবে… বাকি তোমরা কাঁটা চামচ… মানে রন আর হ্যারির কাজ।

মিসেস উইসলি জাদুদণ্ড দিয়ে খাবার–দাবারগুলো বাগানের টেবিলে নিয়ে গেলেন। সিংকে রাখা সেদ্ধ আলুর খোসা পর্যন্ত ছাড়াতে হল না।

–উঃ ওদের নিয়ে আর পারলাম না। কোনও কাজ দিয়ে যদি নিশ্চিন্ত থাকা যায়। খাবার–দাবার নিয়ে যাবার সময় সমস্ত কিচেনেই ফেলে ছড়িয়ে একাকার করছে।

সন্দেহ নেই… ফ্রেড আর জর্জের কাণ্ড।

জাদুদণ্ড দিয়ে মিসেস উইসলি রান্নাঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা সব আবর্জনা। ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন। বললেন–সত্যি ওরা কি চায়, কি ওদের আকাক্ষা আজও বুঝতে পারলাম না। পড়াশুনা করে না, দিনরাত মাথায় জোক বক্সের চিন্তা।

মিসেস উইসলি বিরাট একটা তামার সসপ্যান এনে টেবিলে রেখে তার চারপাশে জাদুদণ্ড ঘোরাতেই একরকমের ক্রিমসস জাদুদরে মুখ থেকে বেরিয়ে এসে প্যানের মধ্যে পড়তে লাগল।

সসপ্যানটা স্টোভের উপর রাখতে রাখতে বললেন–ওরা যে কি চায় বুঝতে পারছি না। এমন যে নয়, ওদের বুদ্ধি নেই… সাহস, বুদ্ধি, নতুন নতুন জিনিস বানানোর দক্ষতা আছে। শুধু শুধু অকাজ করে সময় নষ্ট করছে। এখনও যদি ঠিকপথে না চলে তো ভবিষ্যৎ অন্ধকারে বলে দিলাম। ওরা দুজনে মিলে যা পেচা পেয়েছে, তার চেয়ে আমি অনেক বেশি পেয়েছি। একদিন না একদিন ইম্প্রপার ইউজ অফ ম্যাজিক অফিসে ধরা পড়ে যাবে।

 বক বক করতে করতে জাদুদণ্ড দিয়ে কাজ করে চলেছেন। তিন চারটে ডাণ্ডা। হঠাৎ একটা দারুণ শব্দ করে তালগোল পাকিয়ে বিরাট একটা রবারের ইঁদুর হয়ে গেল।

–উঃ আবার একটা নকল জাদুদণ্ড রেখে গেছে। চিৎকার করে উঠলেন কতবার ওদের বলব, এই রকম দুষ্টুমি করবে না। কে কার কথা শোনে।

রন আর হ্যারি রান্না ঘরে এসে বলল, এস আমরা দুজনে মিলে বিল আর চার্লিকে সাহায্য করি। ওরা কাপ–প্লেট–ডিস ইত্যাদি ড্রয়ার থেকে নিয়ে বাইরের ডাইনিং টেবিলে রাখল। মিসেস উইসলির রাগরাগ মুখ দেখে অন্য দরজা ব্যবহার করল।

বাগানে গিয়ে দেখল মজার কাণ্ড! বিল আর চার্লি ওদের জাদুদণ্ড দিয়ে দুটো ভাঙা ভাঙা টেবিল ওপরে তুলে লড়াই শুরু করিয়ে দিয়েছে। দুটো টেবিল শূন্যে উঠে পরস্পরকে পুঁততে শুরু করেছে। ফ্রেড আর জর্জ মহা খুশি, জিনি হেসে অস্থির আর হারমিওন বাগানের গাছের ধারে ঘুরছে। মনে আনন্দ আর উদ্বেগ। লড়াই করতে করতে বিলের টেবিলের চার্লির টেবিলের সঙ্গে প্রচণ্ড ধাক্কা লেগে চারটে পায়া ভেঙে মাটিতে পড়ে গেল।… ওপরের একটা খোলা জানালা থেকে পার্সি বকাঝকা করতে লাগল।

ও বলল-এই তোমরা গোলমাল থামাবে? আমাকে শান্তিতে কাজ করতে দেবে, না দেবে না? বিল বললো–পার্সি আমরা খুব দুঃখিত।… তা তোমার কলড্রনের স্ট্যান্ডার্ড তৈরির নোট কতদূর এগোল?

পার্সি বলল, তোমরা এমন হট্টগোল করছ, কাজ করতে পারছি না।

বিল আর চার্লি টেবিলের লড়াই বন্ধ করে টেবিল দুটো শূন্য থেকে ঘাসের ওপর জাদুবলে নামিয়ে আনল। একটু পর সব শান্ত হয়ে গেলে খাওয়া–দাওয়া শুরু হয়ে গেল। হ্যারি দেখল পার্সি সকলের সঙ্গে না বসে বাগানের এক কোণে বসে মি. উহসলির সঙ্গে ওর কলড্রনের গেট নিয়ে আলোচনা করছে।

পার্সি উৎসাহিত হয়ে বলছিল–আমি কাউকে কথা দিয়েছি মঙ্গলবারের মধ্যে রিপোর্ট সাবমিট করব। নির্ধারিত সময়ের আগেই। সময় বেঁধে দেবার আগেই কাজ শেষ করা ভাল। তাছাড়া এখন আমরা কিডিচ ওয়ার্ল্ডকাপ নিয়েও ব্যস্ত। সব ব্যবস্থা ঠিক সময়ে করতে হবে।

তারপর ওরা মিনিস্ট্রির অফিসারদের সম্বন্ধে আলোচনা শুরু করল।

–আমরা ডিপার্টমেন্ট অফ ম্যাজিক্যাল গেমস অ্যান্ড স্পোর্টস থেকে লাডো বেগমানের তেমন সাহায্য পাচ্ছি না। মি. উইসলি বললেন–আমার তো মনে হয় লাডো বেশ ভাল মানুষ। ও তো আমাদের খেলা দেখার জন্য ভাল টিকিট জোগাড় করে দিয়েছে। আমি অবশ্য তার ভাই অটোর একটা উপকার করেছিলাম। অটো ঘাস কাটার যন্ত্রের মাত্রাতিরিক্ত শক্তির জন্য হাতে–নাতে ধরা পড়েছিল।

–হা বেগমান ভাল লোক হতে পারে সন্দেহ নেই; কিন্তু ডিপার্টমেন্টাল হেড হল কেমন করে? মি. ক্রাউচ–সিনিয়র এবং যথেষ্ট দক্ষ অফিসার। আপনি তো জানেন বার্থ জোরকিনস একমাসেরও বেশি পাত্তা নেই। আলবেনিয়াতে ছুটিতে যাচ্ছি বলে আর ফেরেনি–পার্সি বলল।

উইসলি বলল–হ্যাঁ, সেই ব্যাপারে লাডোর কাছে খোঁজ নিচ্ছি। ও বলে বার্থা তেমন কাজকর্ম করে না। অযথা সময় নষ্ট করে।

পার্সি বলল, বার্থা একেবারে অপদার্থ। কোনও ডিপার্টমেন্টে টিকতে পারে না। আজ এখানে কাল সেখানে। তাহলেও বেগম্যানের উচিত বার্থাকে খুঁজে বের করা। মি. ক্রাউচ অবশ্য খুবই সাহায্য করছেন। শুনেছি বার্থার সঙ্গে ক্রাউচের বিশেষ বন্ধুত্ব আছে। কিন্তু বেগম্যান তামাশা করে বলেন, যাত্রাপথের মানচিত্র ভুল পড়ে আলবেনিয়ার বদলে অস্ট্রেলিয়া গেছে বার্থা। কথাটা বলে পার্সি গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। এভার ফ্লাওয়ার মদে চুমুক দিয়ে বলল, অন্য কাজকর্ম ছাড়াও আমরা ডিপার্টমেন্ট অফ ম্যাজিকেল কো–অপারেশনে বার্থার খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছি। অবশ্য অন্য ডিপার্টমেন্টের লোকজনের সাহায্য পেলে মন্দ হয় না। আপনি তো জানেন আমাদের আসন্ন ওয়ার্ল্ডকাপ অর্গানাইজ করতে বলা হয়েছে।

গলা খাকড়ি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে সে হ্যারি, রন, হারমিওনের টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল–আমি ফাদারের কথা বলছি। সেই টপ সিক্রেট মানুষটি।

রন, হ্যারি আর হারমিওন ওদের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ও চায় যে ওর কাজকর্মের বিষয়ে আমরা প্রশ্ন করি।

মাঝখানের টেবিলে মিসেস উইসলি বিলের ওর ব্যাংকের হিসেব–নিকেষের ভুল সম্বন্ধে আলোচনা করছিলেন দারুণ গণ্ডগোলের ব্যাপার তো… তা তোমার ব্যাংক কি বলে?

–মাম, ব্যাংকের লোকেরা আমি কি রকম জামা–কাপড় পরলাম তা নিয়ে মাথা ঘামায় না, যতক্ষণ না আমি ওখান থেকে সম্পদ নিয়ে আসছি, বিল ধীরে ধীরে বলল। জাদুদণ্ড দিয়ে বিলের চুল নাড়াচাড়া করে মিসেস উইসলি বললেন, মাথার চুল এতবড় কেন? আজই কাটিয়ে ফেলবে।

জিন্নি বিলের পাশে বসেছিল, বলল–ভালইতো দেখাচ্ছে মাম। এখনও প্রফেসর ডাম্বলডোরের সমকক্ষ হয়নি।

ফ্রেড বলল–বুলগেরিয়ার টিমে আছে ভিক্টর ক্রাম।

চার্লি বলল, সন্দেহ নেই, আয়ারল্যান্ড সাত নম্বর পেয়েছে। আমি চাই ইংল্যান্ড জিতুক… তবে…।

–কী সব আলোচনা করছ? হ্যারি উৎসুকতার সঙ্গে বলল।…প্রিভেট ড্রাইভে থাকার জন্য উইজার্ডিং ওয়ান্ড থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। হ্যারির সবচেয়ে প্রিয় খেলা কিডিচ। গ্রিফিন্ডর হাউজের কিডিচ টিমে সীকার হয়ে খেলেছে। প্রথম বর্ষে পড়ার সময় কিডিচে ফায়ার বোল্ট পেয়েছে। ফায়ার বোল্ট পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রেসিং ঝড়।

চার্লি গম্ভীর হয়ে বলল–ট্রানসিলভানিয়র কাছে হেরেছে কোথায় দশ আর কোথায় তিনশ নব্বই। অত্যন্ত দুঃখজনক সন্দেহ নেই। উগান্ডার কাছে ওয়েলস হেরেছে। স্কটল্যান্ড লুকসেমবার্গের কাছে কচুকাটা হয়েছে।

বাগানের অন্ধকার কাটাতে মি. উইসলি টেবিলে টেবিলে মোমবাতি জ্বেলে দিলেন। তারপর ওরা বাড়ির বানান স্ট্রবেরীব পুডিং খেল। মোমবাতির তাপে একটু গরম হাওয়া বইতে শুরু করে। মোমবাতি থেকে আসছিল লেবু ঘাস ও মধুর সুগন্ধ। প্রচুর খাওয়া–দাওয়ার পর হ্যারির মনে হল পৃথিবীটা বড় সুখের চারদিক সুন্দরতায় ভরে আছে… কত জানা, নাম না জানা ফুলের মিষ্টি গন্ধ। আর এদিকে মনের আনন্দে বাগানের ফুল ও কুক সেংকের দৌড়াদৌড়ি দেখতে লাগলো।

রন চুপ করে বসেছিল। একান্তে হ্যারিকে পেয়ে বলল–সিরিয়সের কোনও খবর পেয়েছ?

কথাটা হারমিওনের কানে গেল।

হ্যারি বলল–হ্যাঁ, দুবার পেয়েছি। মনে হয় ভালই আছেন। গতকালের আগের দিন আমি তাকে একটা চিঠি লিখেছি। আমি তোমাদের এখানে থাকতে থাকতে হয়ত তার উত্তরও পেয়ে যাব। কথাটা রনকে বলার পরই ওর মনে পড়ে গেল কি পরিপ্রেক্ষিতে ও চিঠিটা সিরিয়সকে লিখেছে। মনে হল, ওদের সেই ভয়ঙ্কর স্বপ্নের কথা বলে; কিন্তু আপাতত বলল না, ভাবল, কি হবে ওদের ছুটির কটা দিন ব্ৰিত করে। পরে এক সময় বলবে।

মিসেস উইসলি সব সময়, সব ব্যাপারে সময় দেখে চলেন। খেতে খেতে আড্ডা দিতে দিতে অনেক রাত হয়ে গেছে। শুয়ে পড়া দরকার তাই রিস্টওয়াচে সময় দেখে বললেন–কটা বেজেছে সে খেয়াল আছে? তোমরা সকলে যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। ভোরবেলা চা পাবে। হ্যারি তুমি বুকলিস্ট এনেছে? কাল আমাকে দিয়ে দেবে আমি ডায়াগন অ্যালে থেকে বই কিনে নিয়ে আসব। পরে ওয়ার্ল্ডকাপ শুরু হয়ে যাবে… তখন কেনার সময় থাকবে না। গতবার পাঁচদিন ধরে খেলা চলেছিল।

হ্যারি হাততালি দিয়ে বলল-এবারও যেন তাই হয়।

পার্সি বলল–মজাতো হবেই… ওদিকে আমার অফিসের ট্রেতে গাদা গাদা ফাঁইল জমে যাবে।

ফ্রেড বলল, পার্সি ওর মধ্যে তো কেউ ড্রাগনের বিষ্ঠা রাখতে পারে? পার্সি বলল, ওটা নরওয়ে থেকে নমুনা সার এসেছে। ওরকম কিছু নয়।

–তাই। ফ্রেড হ্যারির কানে ফিস ফিস করে বলল–আমরা পাঠিয়েছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *