চিত্রাঙ্গদা – ০৪

অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদা

চিত্রাঙ্গদা।       কী দেখিছ বীর।
অর্জুন।                             দেখিতেছি পুষ্পবৃন্ত
ধরি, কোমল অঙ্গুলিগুলি রচিতেছে
মালা; নিপুণতা চারুতায় দুই বোনে
মিলি, খেলা করিতেছে যেন সারাবেলা
চঞ্চল উল্লাসে, অঙ্গুলির আগে আগে।
দেখিতেছি আর ভাবিতেছি।
চিত্রাঙ্গদা।                                         কী ভাবিছ।
অর্জুন।                    ভাবিতেছি অমনি সুন্দর ক’রে ধরে,
সরসিয়া ওই রাঙা পরশের রসে,
প্রবাস দিবসগুলি গেঁথে গেঁথে প্রিয়ে
অমনি রচিবে মালা, মাথায় পরিয়া
অক্ষয় আনন্দ-হার গৃহে ফিরে যাব।
চিত্রাঙ্গদা।         এ প্রেমের গৃহ আছে?
অর্জুন।                                   গৃহ নাই?
চিত্রাঙ্গদা।                                             নাই।
গৃহে নিয়ে যাবে! বোলো না গৃহের কথা।
গৃহ চির বরষের; নিত্য যাহা তাই
গৃহে নিয়ে যেয়ো। অরণ্যের ফুল যবে
শুকাইবে, গৃহে কোথা ফেলে দিবে তারে,
অনাদরে পাষাণের মাঝে? তার চেয়ে
অরণ্যের অন্তঃপুরে নিত্য নিত্য যেথা
মরিছে অঙ্কুর, পড়িছে পল্লবরাশি,
ঝরিছে কেশর, খসিছে কুসুমদল,
ক্ষনিক জীবনগুলি ফুটিছে টুটিছে
প্রতি পলে পলে, দিনান্তে আমার খেলা
সাঙ্গ হলে ঝরিব সেথায়, কাননের
শত শত সমাপ্ত সুখের সাথে। কোনো
খেদ রহিবে না কারো মনে।
অর্জুন।                                            এই শুধু?
চিত্রাঙ্গদা।                    শুধু এই। বীরবর, তাহে দুঃখ কেন।
আলস্যের দিনে যাহা ভালো লেগেছিল,
আলস্যের দিনে তাহা ফেলো শেষ করে।
সুখেরে তাহার বেশি একদণ্ডকাল
বাঁধিয়া রাখিলে, সুখ দুঃখ হয়ে ওঠে।
যাহা আছে তাই লও, যতক্ষণ আছে
ততক্ষণ রাখো। কামনার প্রাতঃকালে
যতটুকু চেয়েছিলে, তৃপ্তির সন্ধ্যায়
তার বেশি আশা করিয়ো না।
দিন গেল।
এই মালা পরো গলে। শ্রান্ত মোর তনু
ওই তব বাহু’পরে টেনে লও বীর।
সন্ধি হোক অধরের সুখসম্মিলনে
ক্ষান্ত করি মিথ্যা অসন্তোষ। বাহুবন্ধে
এসো বন্দী করি দোঁহে দোঁহা, প্রণয়ের
সুধাময় চিরপরাজয়ে।
অর্জুন।                                       ওই শোনো
প্রিয়তমে, বনান্তের দূর লোকালয়ে
আরতির শান্তিশঙ্খ উঠিল বাজিয়া।
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *