০৫. অনেক ঘরই একেবারে ভেঙে গিয়েছে

এ-বাড়ির অনেক ঘরই একেবারে ভেঙে গিয়েছে, ছাদ নেই। তবে উপরে ওঠার সিঁড়িটা ঠিক আছে। একটা বারান্দা আর-একটা বড় হলঘর প্রায় আস্তই বলা যায়। আর দুটো ছোট ঘরের দেওয়ালে মস্ত মস্ত ফাটল। অনেক কাল আগের একটা ছবি ঝুলছে এক দেওয়ালে, বৃষ্টি পড়ে পড়ে ছবিটা এখন অস্পষ্ট। হয়তো মানুষের ছবি ছিল, এখন মনে হয় পাহাড় আর মেঘের ছবি।

বড় হলঘরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে পাতা হয়েছে কার্পেট। ইলেকট্রিক নেই। বাদশা বলেছিল, বাইরে থেকে তার টেনে এনে আলো জ্বালিয়ে দিতে পারে। কাকাবাবু বলেছেন, দরকার নেই। ইলেকট্রিকের আলোয় ভূত আসে না। তার বদলে এক পাশে জ্বলছে একটা হ্যাজাক বাতি। তার আলো বেশি দূর পৌঁছোয় না। তারপরে সব অন্ধকার। অবশ্য কয়েকটা টর্চ আছে সঙ্গে। আর আনা হয়েছে জলের বোতল, কয়েক বাক্স স্যান্ডউইচ, দুটো বড় ফ্লাস্ক ভরতি চা আর কফি। বাদশা নিজে একটা রাইফেল নিয়ে এসেছে।

সকলে মিলে বসল একদিকের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। পিছন দিক দিয়ে কেউ আসতে পারবে না, সামনের দিক থেকে যে-ই আসুক, দেখা যাবে।

বাদশা বলল, কথা বলা যাবে না কিন্তু, চুপচাপ থাকতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, কতক্ষণ চুপ করে বসে থাকব? তা কি সম্ভব? তা ছাড়া, কথা বললে দোষ কী? ভূত তো আমাদের ভয় পাবে না। আমাদেরই ভয় দেখাতে আসবে।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, ভূত মানুষকে ভয় দেখায় কেন? তাতে ভূতেদের কী লাভ?

কাকাবাবু বললেন, তা আমি জানব কী করে? আমি তো ভূতদের সাইকোলজি বুঝি না। এখন বরং জোজোর কবিতা শোনা যাক। সেই মামার কবিতাটা।

জোজো অমনি বলে উঠল :

লাভলু মামার গায়ে হলদে জামা
পটাশ করে ছিড়ল একটা বোতাম
মাংস-মুড়ি খাচ্ছে এক ধামা
আহা, আমি যদি লাভলু মামা হতাম!

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, বেশ হয়েছে। ভাল হয়েছে। কিন্তু ধামা কথাটার মানে কি কেউ বুঝছে? এখন আর তেমন ব্যবহার হয় না।

সন্তু বলল, আমি জানি, ঝুড়ির মতো একটা জিনিস। বেতের তৈরি। কিন্তু জোজো, মাংস-মুড়ি খায় কী করে?

জোজো বলল, কেন, মাংস দিয়ে মুড়ি খাসনি কখনও? দারুণ লাগে! আমার মামা তো প্রায়ই খান।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, খাওয়া ছাড়া তোমার মামা আর কী করেন?

জোজো বলল, সাঁতার কাটেন।

কাকাবাবু বললেন, সাঁতার কাটেন? সে তো খুব ভাল কথা। আর কিছু করেন না?

জোজো বলল, হ্যাঁ। সেটাই তো আসল কাজ। সাপ ধরেন।

কাকাবাবু বললেন, সাপ ধরেন মানে? কোথায় সাপ ধরেন?

জোজো বলল, সুন্দরবনে আর নর্থ বেঙ্গলে। একটা ফ্রেঞ্চ কোম্পানি লাভলু মামাকে এই কাজ দিয়েছে। অনেক টাকা দেয়।

কাকাবাবু বললেন, ওরে বাবা, সাপ ধরা তো খুব শক্ত কাজ। তোমার মামা শিখলেন কী করে?

জোজো বলল, আফ্রিকা থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন। উনি তো সাপ ধরায় এক্সপার্ট। কত দেশ থেকে ওঁকে ডাকাডাকি করে, উনি এখন আর যেতে চান না। তার কারণ, আমাদের মতো এত ভাল মাছ তো অন্য কোনও দেশে পাওয়া যায় না। ফরাসি দেশ থেকে চলে এলেন, কারণ, সে-দেশে মুড়ি পাওয়া যায় না। ওঁর প্রতিদিন মুড়ি চাইই চাই। মুড়ি দিয়েও উনি মাছ খান। তার নাম মুড়িঘণ্ট। লাভলুমামা কিন্তু সব সাপ ধরেন না। অনেক সাপ ধরে ধরেও ছেড়ে দেন। উনি শুধু ধরেন ময়াল সাপ। ফরেন কান্ট্রিতে ওই সাপেরই খুব ডিমান্ড। ময়াল সাপ কাকে বলে জানিস তো সন্তু? বাংলায় যাকে বলে পাইথন।

সন্তু বলল, জানি। সাপ মানে তো বাংলায় যাকে বলে স্নেক!

বাদশা হেসে ফেলে বলল, এটা শুনে আমার একটা গল্প মনে পড়ল। বলব?

কাকাবাবু বললেন, বলো, বলো, গল্প শুনেই তো সময় কাটাতে হবে।

বাদশা বলল, এটা ঠিক গল্প নয়। ফ্যাক্ট! স্কুলে আমাদের এক মাস্টারমশাই ছিলেন, বাংলা পড়াতেন। ওঁর বাড়ি চিটাগাং। অনেক কথারই উচ্চারণ শুনে বোঝা যেত না। একদিন উনি কবিতা পড়াচ্ছেন, তার একটা লাইন ছিল, মত্ত দাদুরি, ডাকে ডাহুকি, ফাটি যাওত ছাতিয়া। আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্যার, দাদুরি মানে কী? উনি বললেন, দাদুরি মানে জানো না? ভ্যাক, ভ্যাক! আমি তো আরও বুঝলাম না, ভ্যাক আবার কী জিনিস? স্যারের দিকে বোকার মতো চেয়ে থাকতে উনি বললেন, ভ্যাক বুঝলা না? সোজা বাংলায় যারে বলে বেং! আমি আবার অগাধ জলে, বেং-ও কখনও শুনিনি। ক্লাসের অন্য ছেলেরা হাসছে। স্যার রেগে গিয়ে বললেন, ইংরাজি না কইলে তোমরা কিছুই বুঝো না, এই তোমাগো দোষ। ওই ইংরাজিতে যারে কয় ফ্রোগ, ফ্রোগ! দাদুরি মানে ফ্রোগ।

খুব জোরে হেসে উঠলেন কাকাবাবু। সন্তুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা বেশ ভাল গল্প। তোরা সব বুঝলি তো?

সন্তু বলল, ফ্রোগ হচ্ছে ফ্রগ, তাই না?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। বেং হচ্ছে ব্যাং, আর ভ্যাক হচ্ছে ভেক, সেটাও ব্যাঙের আর-এক নাম।

সন্তু বলল, জোজোর সাপের গল্প, তারপরই এল ব্যাঙের গল্প। এর পর?

বাদশা বলল, কাকাবাবু, একটা ব্যাপার দেখুন, ব্যাং তো অতি সাধারণ প্রাণী, কিন্তু তার কত নাম! আরও একটা নাম আছে, মঞ্জুক।

কাকাবাবু বললেন, তা ঠিক। মণ্ডুক থেকে কূপমণ্ডুক। কুয়োর ব্যাং। এই কথাটা খুব ভাল। কুয়োর ব্যাং তো সারা জীবন কুয়োতেই থাকে। বাইরের জগৎ সম্পর্কে কিছু জানে না, তাই কুয়োটাকেই মনে করে পৃথিবী। অনেক মানুষও হয় এরকম।

জোজো বলল, কাকাবাবু, একটা কথা বলব? কিছু মনে করবেন না। আপনি আজকাল বড় জ্ঞান দেন। কূপমণ্ডুকের মানে না জানলে কী ক্ষতি হয়?

কাকাবাবু বললেন, কিছুই ক্ষতি হয় না। তুমিও কূপমণ্ডুক হয়েই থাকতে। আমি আজকাল বেশি জ্ঞান দিচ্ছি? ঠিক আছে, আর দেব না। অন্য গল্প হোক, তোমার আর কোনও মামা নেই?

সন্তু বলল, জোজো, কবিতা লিখতে গেলে কিন্তু অনেক কিছু জানতে হয়।

জোজো বলল, আমি এখন তোর চেয়েও ভাল বাংলা লিখতে শিখেছি। তুই শালপ্রাংশু মানে জানিস?

সন্তু বলল, জানব না কেন? শাল গাছের মতো উঁচু, কিংবা বড়।

আর বাসুকি?

সাপেদের রাজা। বিরাট লম্বা। দেবতারা যখন সমুদ্রমন্থন করেছিলেন, তখন মন্দার নামে একটা পাহাড়কে এই সাপটাকে দিয়ে বেঁধে সমুদ্রে ঘোরানো হয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন, এই রে, আবার যে জ্ঞানের কথা এসে যাচ্ছে?

বাদশা বলল, আবার সেই সাপের কথা! বাসুকি আসলে একটা মস্ত বড় পাইথন, তাই না? পাইথনের আর-একটা বাংলা নাম আছে, অজগর। ছেলেবেলায় আমরা অ-আ শিখেছি, অ-এ অজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে…

কাকাবাবু বললেন, জোজো, তোমার আর-একটা কবিতা শোনাও!

জোজো জিজ্ঞেস করল, ইংরেজি না বাংলা?

কাকাবাবু বললেন, তোমার যেটা ইচ্ছে। ইংরেজিই হোক।

জোজো বলে উঠল :

A crow cries and a crocodile smiles
Each has a choice in different styles.

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, এটা তো আরও ভাল হয়েছে।

সন্তু বলল, মডার্ন কবিতা। কাক কখনও কাঁদে না, আর কুমিরও হাসে।

বাদশা বলল, কুমিরের কান্না বলে একটা কথা আছে। কুম্ভীরাশ্রু। সেটা কিন্তু ফল্‌স কান্না। লোক দেখানো।

কাকাবাবু বললেন, এই রে, এবার বাদশা জ্ঞান দিতে শুরু করেছে। তবে, জোজোর এ-কবিতা কিন্তু সত্যি ভাল। একসঙ্গে বাংলা আর ইংরেজি দুরকম কবিতাই লিখতে পারে, এটা কম কথা নয়!

প্রশংসা শুনে জোজো বলল, এখন একটু স্যান্ডউইচ খেলে হয় না?

সন্তু বলল, এর মধ্যেই? এখনও আটটা বাজেনি।

কাকাবাবু বললেন, ইচ্ছে হচ্ছে, ও খেয়ে নিক না। এখন কিছু খাক, পরেও আবার খাবে।

গল্প করতে করতে আরও অনেকটা সময় কেটে গেল।

একসময় জোজো জিজ্ঞেস করল, এখানে বাথরুম নেই? নীচে যেতে হবে?

বাদশা বলল, না, নীচে যেতে হবে না। বারান্দার কোণে একটা বাথরুম আছে। ওদিকটা ভাঙা নয়, চিন্তা নেই। টর্চ নিয়ে যাও।

জোজো বলল, ওরে বাবা, একা যেতে পারব না। সন্তু, তুই যাবি আমার সঙ্গে?

সন্তু বলল, চল, যাচ্ছি তোর সঙ্গে!

ওরা দুজনে বেরিয়ে গেল দুটো টর্চ নিয়ে।

বারান্দাটা অনেকখানি লম্বা, তার শেষে বাথরুম। দরজা খুলে জোজো বলল, সন্তু, তুই কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা দূরে যাবি না।

সন্তু বলল, ঠিক আছে। একটু পরেই জোজো ভিতর থেকে বলল, এই সন্তু, তুই কী বলছিস?

সন্তু বলল, কিছু তো বলছি না। তুই যে আমার নাম ধরে ডাকলি? কই, আমি তো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। এই সন্তু, আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করবি না বলছি! ভাল হবে।

কী মুশকিল! তোকে ভয় দেখাব কেন? সন্তু, সন্তু! দড়াম করে দরজা খুলে গেল। জোজোর মুখোনা ভয়ে একেবারে সাদা হয়ে গিয়েছে।

সে এসে সন্তুর হাত জড়িয়ে ধরে বলল, সন্তু, বাথরুমের মধ্যে আরএকজন কেউ রয়েছে। কথা বলছে।

সন্তু বলল, আমি দেখছি।

সন্তু নিজে বাথরুমে ঢুকে টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগল। আগেকার আমলের বাথরুম। বেশ বড়। তবু টর্চের আলোয় সবটাই দেখা যায়। কেউ সেখানে লুকিয়ে বসে নেই। একটা মাত্র জানলা, তাও বন্ধ।

সন্তু বলল, কই রে, ভিতরে তো কেউ নেই।

জোজো বলল, আমি স্পষ্ট শুনেছি, আমার নাম ধরে ডাকছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, তুই বুঝি…

সন্তু বলল, ওটা তোর মনের ভুল। আগে থেকেই ভয় পেলে এরকম

হয়।

ঠিক সঙ্গে সঙ্গে বিরাট জোরে শোনা গেল, হাচ্চো! হাচ্চো।

সেই হাঁচির শব্দ শুনে সন্তু পর্যন্ত কেঁপে উঠল। শব্দটা ঠিক দরজার কাছে, অথচ কেউ নেই সেখানে।

নিজেকে সামলে নিয়ে সন্তু জিজ্ঞেস করল, কে? কেউ আছে এখানে?

এবারে শোনা গেল একটা অদ্ভুত গলায় গানের মতো, আয় আয় কাছে আয়, ভয় নেই, ভয় নেই, ভয় নেই!

সন্তুকে ছেড়ে দিয়ে জোজো মারল এক দৌড়। সন্তু বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে টর্চের আলোয় দেখল বারান্দাটা। কোনও জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। তবু গলা শোনা যাচ্ছে। তবে কি সত্যিই অশরীরী?

এবার সাধারণ মানুষের মতো গম্ভীর গলায় শোনা গেল, যত সব উটকো ঝামেলা। কেন আসে এরা? অ্যাই, তুই এখানে কী চাস?

সন্তু কোনওক্রমে বলল, কিছু না।

আর তার সাহসে কুলেল না। সেও এবার জোরে পা চালিয়ে ফিরে গেল হলঘরে। জোজো ততক্ষণে চোখ বড় বড় করে হাত-পা নেড়ে সব বলতে শুরু করেছে।

বাদশা বলল, বাথরুমে লোকের গলা শোনা যাচ্ছে? তা কী করে হয়? আজ সারা বাড়ি খুব ভাল করে সার্চ করে দেখা হয়েছে, কিছু নেই। বাইরে থেকেও কেউ আসতে পারবে না।

সন্তু বলল, আমিও তো নিজের কানেই শুনলাম।

বাদশা বলল, আমি দেখে আসছি নিজে। কাকাবাবু মিটিমিটি হাসছেন। তিনি বললেন, যাও, কিছুই দেখতে পাবে না।

ওরা ফিরে এল মিনিটদশেক পরে। তিনজনেই গলার আওয়াজ শুনেছে। কিন্তু কিছুই দেখতে পায়নি। কোথাও কারও লুকোনোর কোনও জায়গাই নেই। অশরীরী ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী কী বলছিল বলো তো?

সন্তু আর জোজো দুজনেই শুনিয়ে দিল কথাগুলো। দ্বিতীয়বার অন্য রকম কথা। দুজন মানুষ কথা বলছে নিজেদের মধ্যে।

কাকাবাবু বললেন, আয় আয় কাছে আয়, ভয় নেই, ভয় নেই, ভয় নেই, এটা তোমরা চিনতে পারলে না? গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমায় ভূতের রাজার গান। যে-গানটা গেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় নিজে। স্পেশ্যালভাবে রেকর্ড করায় গলাটা অন্যরকম শুনিয়েছে। সেই ভূতের রাজার গান এখানকার ভূতেরা শিখে নিয়েছে।

জোজো বলল, কাকাবাবু, ব্যাপারটা তা হলে কী হচ্ছে? সত্যি ভূত আছে?

কাকাবাবু কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই আবার একটা গান শোনা গেল। প্রথমে মনে হল, অনেক দূর থেকে আওয়াজটা ভেসে আসছে। তারপর খুব কাছে আর জোরে। কোনও মেয়ের গলা, কিছুটা নাকি-নাকি। আবার গানের আওয়াজটা দূরে চলে গেল।

জোজো কাকাবাবুর গা ঘেঁষে এসে বলল, ওরে বাবা, এসব কী?

কাকাবাবু বললেন, জোজো, তুমি ভূতের গান শুনতে চেয়েছিলে। তোমার ব্যাগে লিখে রেখেছিলে, এবার যাচ্ছি শিমুলতলায়/গান শুনব ভূতের গলায়। ভূতেরা সেটা পড়ে নিয়ে তোমায় গান শোনাচ্ছে।

গানটা আবার শোনা গেল বেশ কাছে। একবার ডান দিক থেকে, পরে একবার বাঁ দিকে। কথাগুলো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অনেকটা এই রকম :

ভুলভুলাইয়া ঘ্যাঙোর ঘ্যাং,
ছঁররা মাঁরি ঘুমের গাড়ি,
কঁড়কঁড়াত ফঁরফড়াত,
আঁমার বাড়ি, আঁমার বাড়ি,
যা রে ছাঁড়ি যারে ছাঁড়ি…

কাকাবাবু বললেন, ভূতের গান হিসেবে খুব সুবিধের নয়। ওগো মেয়ে, আর-একটা ভাল গান শোনাও না!

গানটা হঠাৎ থেমে গেল।

বাদশা ব্যাকুলভাবে বলল, কাকাবাবু, এসব কী হচ্ছে আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। অথচ আপনি হালকাভাবে নিচ্ছেন। আমাদের একটু বুঝিয়ে দিন প্লিজ! গানটা কোথা থেকে আসছে।

কাকাবাবু বললেন, বোঝাতে গেলে যদি জ্ঞানের কথা হয়ে যায়?

জোজো কাকাবাবুর একটা হাঁটু ধরে বলল, কাকাবাবু, আমাকে ক্ষমা করুন। তখন ওই কথাটা আমার বলা উচিত হয়নি। হঠাৎ বলে ফেলেছি!

সন্তু কড়া গলায় বলল, এই জোজো, কান ধর!

কাকাবাবু জোজোকে বুকে টেনে নিয়ে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে। বললেন, না, না, ওসব কিছু করতে হবে না। জোজোকে আমি কত ভালবাসি। ওর যা মনে এসেছে, তাই তো বলেছে। বলবে না কেন? মুশকিল হচ্ছে কী, আমি তোদের সঙ্গে বন্ধুর মতোই মিশতে চাই। কিন্তু আমার বয়স যে অনেক বেশি। তাই মাঝে মাঝে ওসব কথা বেরিয়ে আসে। মনে হয়, আমি যা জানি, তা তোদেরও জানা উচিত।

বাদশা বলল, আমাদের সেসব শুনতে ভাল লাগে। এখন কী হচ্ছে, আপনি বলুন।

কাকাবাবু বললেন, তোমার যদি দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই, তা হলে এসব কিছুই অলৌকিক বলে মনে হয় না। সহজ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যদি মানুষের কথা শোনা যায়, কিংবা গান ভেসে আসে, অথচ কাউকে চোখে দেখা যায় না, তাতেও আশ্চর্য হওয়ার কোনও কারণ নেই তো?

জোজো বলল, বাথরুমে একজন আমার নাম ধরে ডাকল, আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না, অথচ সে আমাকে দেখছে!

কাকাবাবু বললেন, না, তা নয়। মনে করো, তুমি ঘরে বসে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান শুনছ। তা বলে কি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেখানেই বসে থাকতে হবে? কত লোকই তো আলাদা আলাদা জায়গায় বসে তার গান শোনে।

বাদশা বলল, সে তো রেডিয়ো-টিভিতে, কিংবা ক্যাসেট প্লেয়ারে। আমরা অনেক খুঁজে দেখেছি, সেরকম কিছু নেই।

কাকাবাবু বললেন, নেই, কিন্তু আছে।

জোজো বলল, ফিসফাস কথা, গানটা একবার কাছে, একবার দূরে…

কাকাবাবু বললেন, এসব স্পেশ্যালভাবে রেকর্ড করা যায়। এইসব পুরনো বাড়িতে ঘুলঘুলি থাকে। স্কাইলাইট থাকে। এখনকার বাড়িতে এসব থাকে না বলে জোজোরা দেখেনি।

সন্তু বলল, আমি নর্থ ক্যালকাটায় আমার এক বন্ধুর বাড়িতে দেখেছি। এই তো এই হলঘরেও রয়েছে, অনেক উপরে, একটা-দুটো-তিনটে স্কাইলাইট।

কাকাবাবু বললেন, বারান্দাতেও ঘুলঘুলি আছে। যেখানে চড়াই পাখি আর শালিক পাখিরা বাসা করে। এই স্কাইলাইট-ঘুলঘুলিতে নিশ্চয়ই কয়েকটা ছোট ক্যাসেট প্লেয়ার লুকোনো আছে। রিমোট কন্ট্রোলে কিংবা টাইমার দিয়ে সেগুলো চালু করাও শক্ত কিছু নয়।

বাদশা খুব অবাক হয়ে বলল, ক্যাসেট প্লেয়ার লুকোনো আছে? কে রাখল? চেক করে দেখতে হবে তো!

কাকাবাবু বললেন, একটা মই পেলে আমি এখনই প্রমাণ করে দিতে পারি। তারপর একটু থেমে, একগাল হেসে বললেন, আমি কিন্তু আজ রাতেই অন্তত একটা ভূত ধরে দিতে পারি।

বাদশা দুই ভুরু তুলে বলল, ভূত ধরে দিতে পারেন? কী করে…

কাকাবাবু তার একটা আঙুল বাদশার বুকে ছুঁইয়ে বললেন, এই যে! এসব গানটান তোমারই কীর্তি। তুমি রেকর্ড-ক্যাসেটের ব্যাবসা করো, এসবের নানান কায়দাকানুনও তোমার জানা। আই অ্যাম শিয়োর, তোমার ওই লম্বা পাঞ্জাবির দুপকেটে কয়েকখানা রিমোট কন্ট্রোল আছে। সন্তু, ওর পকেট সার্চ করে দ্যাখ তো!

বাদশাও এবার হেসে ফেলে বলল, থাক, সার্চ করতে হবে না। সত্যি কাকাবাবু, আপনার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই।

কাকাবাবু বললেন, আমি সকালবেলায় তোমায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কখনও অভিনয় করেছ কিনা। তোমার ব্যবহার দেখে তখনই আমার মনে হয়েছিল, তুমি আমাদের সঙ্গে যেন অভিনয় করে চলেছ। তা চালিয়ে গিয়েছ এতক্ষণ পর্যন্ত। কী ব্যাপার বলো তো? কেন এই ভূতের নাটক করলে আমাদের নিয়ে?

বাদশা বলল, আসল ব্যাপার কী জানেন, কাল দুপুরেই এ-বাড়ির ভূতেরা ধরা পড়ে গিয়েছে।

সন্তু বলল, ভূতেরা ধরা পড়ে গিয়েছে? তার মানে?

বাদশা বলল, বুঝতেই পারছ, আসল ভূত নয়। তোমরা তো এসে পৌঁছোলে কাল সন্ধেবেলা। তার আগেই দুপুরবেলা চারটি ছেলে এসে দেখা করল আমার সঙ্গে। তাদের একটা গোপন পার্টি আছে। তারা মাঝে মাঝেই রাতে সিটিং করত এই বাড়িতে। অন্য কেউ যাতে না জানতে পারে, সেই জন্যই তারা নানারকম ভূতের খেলা দেখাত। ভয়ে আর কেউ এদিকে আসত না। কাকাবাবু যে এখানে আসছেন, তা তারা জানতে পেরে গিয়েছিল। আমার কাছে গিয়ে সব স্বীকার করে তারা বলল, রাজা রায়চৌধুরী আসছেন, ওঁর কাছে তো ভূতের জারিজুরি খাটবে না। উনি ঠিক ধরে ফেলবেন। ওঁকে মেরে ফেলতেও চাই না আমরা।

কাকাবাবু বললেন, চাইলেই বুঝি আমাকে মেরে ফেলা যায়?

বাদশা বলল, ওদের মধ্যে দুটো ছেলে আপনার ভক্ত। সেই জন্যই আপনাকে মারার চেষ্টাও করবে না। মোট কথা, কালই আমাকে ওরা বলল, এই বাড়িটা ওরা ছেড়ে দিচ্ছে। ওরা অন্য বাড়ি খুঁজে নেবে। তার বদলে ওরা কুড়ি হাজার টাকা চাঁদা চাইল। আমি কুড়ি হাজার দিইনি। তবে ভবিষ্যতে ওরা আর গোলমাল করবে না, এই শর্তে দিয়েছি দশ হাজার। এদিকে আপনাদের এখানে আসতে বলেছি। তখন তো আর খবর দেওয়ার উপায় নেই। ততক্ষণে আপনারা ট্রেনে চেপে গিয়েছেন। তাই ভাবলাম, আপনারা এখানে খাবেনদাবেন, বেড়াবেন, আর খানিকটা ভূত ধরার উত্তেজনাও হবে। তাই এসব সাজিয়েছিলাম। কিন্তু কাকাবাবুর চোখকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব।

জোজো হতাশভাবে বলল, যাঃ, তা হলে আর এবারেও ভূত দেখা হল না? কোনওদিনই কি ভূত দেখতে পাব না?

কাকাবাবু বললেন, পাবে, পাবে। যেখানে আমি থাকব না, সেখানে ভূত দেখতেও পারো। খাঁটি ভূতেরা আমার সামনে আসতে লজ্জা পায়।

জোজো বলল, তা হলে আর এখানে শুধু শুধু রাত জেগে কী হবে? বাদশাদার বাড়িতে গিয়ে নরম বিছানায় শুয়ে পড়লেই হয়।

সন্তু বলল, না, না। আমার এখানেই বেশ ভাল লাগছে। ভূত না-ই বা দেখা হল, তা হলেও সকলে মিলে বেশ গল্প করা যাবে।

বাদশা বলল, আমারও মনে হয়, রাতটা সকলে মিলে এখানে আড্ডা দিয়ে কাটালেই ভাল হবে। এখানকার লোকেরা বুঝবে, ভূতেরা আমাদের কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। আমাদের দেখে ওদেরও কিছুটা ভয় ভাঙবে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওই ভূতের গানটা কে লিখেছে?

বাদশা লাজুক মুখ করে বলল, আমি।

ওই একখানাই? না, আরও রেকর্ড করা আছে?

আরও দুখানা আছে।

তা হলে সেগুলোও চালাও। শুনে দেখি।

ঠিক আছে। তার আগে আমরা স্যান্ডউইচ আর কফি খেয়ে নিই? এখনও অনেক রাত বাকি।

বাদশা স্যান্ডউইচের প্যাকেটগুলো খুলতে খুলতে বলল, কাপে কফি ঢেলে ফেলো তো সন্তু!

এমন সময় ছাদে দুমদুম আওয়াজ হল।

কাকাবাবু বললেন, আবার মেঘ গজরাচ্ছে বুঝি?

সন্তু বলল, ঝড়-বৃষ্টি তো অনেকক্ষণ থেমে গিয়েছে।

জোজো উঠে গিয়ে একটা জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, আকাশ পরিষ্কার। আর মেঘ নেই।

আবার ছাদে দুমদুম শব্দ হল, এবার আরও জোরে। চতুর্দিক একেবারে নিস্তব্ধ। তার মধ্যে ছাদের উপরের দুমদুম শব্দ আচমকা বুক কাঁপিয়ে দেয়।