• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

দৈব-সংযোগ – ইফতেখার আমিন

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » গল্প » দৈব-সংযোগ – ইফতেখার আমিন

অনেকক্ষণ ধরে কাশির মতো আওয়াজ করছিল ইঞ্জিন, হঠাৎ হঠাৎ থেমে পড়ার হুমকি দিচ্ছিল গাড়ি। কিন্তু এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। লন্ডন ছাড়ার আগে পরিচিত মেকানিক দিয়ে ইঞ্জিন থরো চেক-আপ করিয়ে নিয়েছিলাম। তার পরও…শেষবারের মতো আরও দুটো ঝাঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি। আমরা তখন একটা খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছি।
ইয়া আল্লা! মনে মনে বললাম, এই বুনো কান্ট্রিসাইডে ফেঁসে না যাই! মানুষ বাস করে এমন কোথাও পৌঁছাতে সাহায্য করো।
মেহের আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। চেহারা ফ্যাকাসে। সন্ধ্যার ঠিক আগে, চেনাজানা পরিবেশ থেকে বহু দূরের এ রকম অজায়গায় ফেঁসে যাওয়ার ফল কত ভয়াবহ হতে পারে, তা আন্দাজ করতে পেরে ঘাবড়ে গেছে। আমি তাকালাম না ওর দিকে। মুখ নিচু করে অহেতুক এক্সিলারেটর চাপতে লাগলাম। নিজের উৎকণ্ঠা প্রকাশ হয়ে পড়বে বলে তাকাতে চাই না।
চরম অসহায় বোধ করছি আমি। অনেক চেষ্টার পরও ইঞ্জিন সাড়া না দেওয়ায় হাল ছেড়ে দিলাম। একেবারে বন্ধই হয়ে গেছে। একটু পর ইগনিশন অফ করে হ্যান্ডব্রেক টানলাম।
‘নামো,’ বলে বেরিয়ে এলাম গাড়ি থেকে।
অসহায় দৃষ্টিতে সামনে তাকালাম। মরা সাপের মতো নেতিয়ে আছে সেইন্ট অ্যালবানস, হার্টফোর্ডশায়ারের গ্রাম্য, পাহাড়ি রাস্তা। এঁকেবেঁকে নেমে গেছে নিচের উপত্যকার দিকে।
হেমন্তের অপরূপ সন্ধ্যা নামছে পাহাড়ে। দেখার মতো দৃশ্য। কিন্তু আমার প্রকৃতির রূপ-সুধা পান করার সময়-সুযোগ, কোনোটাই নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে আঁধার নামবে, তার আগেই রাত কাটানোর মতো একটা আশ্রয় খুঁজে পাওয়া না গেলে মহা বিপদে পড়ে যাব। একা হলে এত ভাবতাম না, কিন্তু আমার স্ত্রী আছে সঙ্গে…অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে। ও এসে দাঁড়াল আমার পাশে।
উপত্যকায় সরু সরু কয়েকটা লেন দেখতে পাচ্ছি, তার দু পাশে গড়ে উঠেছে একটা ছোট গ্রাম। গাড়ি থেকে টুরিস্ট ম্যাপটা বের করে বিছালাম বনেটের ওপর। আঙুলের মাথা দিয়ে টোকা মারলাম এক জায়গায়। ‘এখানটায় আছি আমরা।’
‘একটা হ্যামলেট দেখা যায়,’ আঙুল দিয়ে গ্রামটা দেখাল মেহের।
‘হ্যাঁ।’ গাছপালার ফাঁক দিয়ে গির্জার বেলফ্রাই দেখতে পেলাম। তার পাশে একটা গোলাঘরের ছাদ। গ্রামটার দিকে সন্দেহের চোখে তাকালাম। ‘ওই পর্যন্ত…মনে হয় ইঞ্জিন ছাড়াই যেতে পারব।’
‘তাই চলো,’ ভীত শোনাল ওর কণ্ঠ। ‘দেরি করা ঠিক হচ্ছে না।’
গাড়িতে উঠলাম আবার। গিয়ার নিউট্রাল করে হ্যান্ডব্রেক রিলিজ করে দিলাম। ঢাল বেয়ে ধীরগতিতে গড়াতে শুরু করল আমার টয়োটা সেডান, গতি বাড়ছে ক্রমে। অস্বাভাবিক নীরবতার মাঝে নাক নিচু করে দূরের গ্রাম লক্ষ্য করে ছুটে চলেছি আমরা মসৃণ গতিতে।
একটু পর গ্রামের কাছে এসে আপনাআপনি থেমে গেল গাড়ি। ডজন দু-এক বাড়ি নিয়ে গ্রামটা। নামলাম আমরা। অন্ধকার আরও ঘনিয়ে এসেছে।
গ্রামের রাস্তা ফাঁকা। গোলাঘরের সামনে ধুলোর মধ্যে একটা নিঃসঙ্গ মুরগি খাবার খুঁটছে। কারও দেখা না পেয়ে সামনের বাড়িঘরের বন্ধ দরজার একটায় নক করব কি না ভাবছি, এই সময় এক লোকের ওপর চোখ পড়ল। পরনে লম্বা আলখাল্লা, কোমরে কোমরবন্ধ এবং মাথায় চওড়া হ্যাট। গ্রামের পাদ্রি বা ওই ধরনের কিছু হবে হয়তো। দূর দিয়ে গ্রামের দিকে যাচ্ছে। আমাদের দেখতে পায়নি।
‘ফাদার!’
আমার চড়া গলার ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। চোখ কোঁচকাল, সম্ভবত বিদেশি বুঝতে পেরে। মেহেরকে দেখল কয়েকবার, তারপর এগিয়ে এল চাউনিতে সন্দেহ আর প্রশ্ন নিয়ে।
‘আমাদের গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে, ফাদার। অচেনা জায়গা…বিপদে পড়ে গেছি।’
আমাকে পাত্তা দিল না লোকটা। ভালো করে তাকালই না। বারবার মেহেরকে দেখছে। একটু পর যেন দয়া করে গাড়িটা দেখল। ইশারায় বোঝাল, ‘সুন্দর গাড়ি!’
আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম। মেহের বিড়বিড় করে বলল, ‘বোবা নাকি?’
‘আপনি এই গির্জার…?’
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চেয়ে থাকল সে। হাত-পা নেড়ে তাকে নিজেদের সমস্যা বোঝাতে চেষ্টা করলাম। বুঝল সে, মাথা ঝাঁকিয়ে গোঁ-গোঁ করল। নিশ্চিত হলাম লোকটা বোবা। আমাদের অপেক্ষা করার সংকেত দিয়ে গ্রামের দিকে চলল সে। ঘরবাড়ির আড়ালে চলে গেল। মিনিট পাঁচেক পর বিশালদেহী এক লোককে নিয়ে ফিরল। আগন্তুকের পরনে নীল ক্যানভাস ট্রাউজার্স ও শার্ট। পায়ে শত তালি মারা জুতো। চেহারা-সুরতে কৃষক মনে হয়। পাদ্রির সাথে পা টেনে টেনে, ধুলোয় চারদিকে অন্ধকার করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল সে।
তাকে আমার গাড়ি দেখিয়ে ইশারা-ইঙ্গিতে সমস্যা বোঝাল পাদ্রি। কথার মধ্যে বারবার মেহেরকে দেখাচ্ছে। মাথা নাড়ছে ঘন ঘন। বোঝা গেল সে বলতে চাইছে, আমি সুন্দরী বউ নিয়ে বিপদে পড়েছি। আমাকে সাহায্য করা জরুরি। আগন্তুক বুঝল। কয়েকবার মাথা ঝাঁকিয়ে পা টেনে টেনে চোখের আড়ালে চলে গেল। আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছি গাড়ির পাশে। পাদ্রি একটু পরপর মেহেরের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বিব্রত হাসি হাসছে। মেহের গাড়ির বনেটে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
অপেক্ষা ছাড়া কিছু করার নেই। আমি মাঝেমধ্যে পাদ্রির দিকে ফিরে হাসি, হাত কচলাই, মাথা ঝাঁকাই। দেখাদেখি সে-ও তাই করে। একটু পর কি খেয়াল হতে শূন্যে হাত দিয়ে একটা বড় বৃত্ত আঁকল লোকটা। দু হাতের তালু চিৎ করে সম্ভবত ‘কোথায়?’ বলতে চাইল।
আমি বুঝতে না পেরে চেয়ে থাকলাম। লোকটা কিছু ভাবল, তারপর পকেট থেকে একটা চাবি বের করে ধুলোর মধ্যে ইংরেজিতে লিখল,কান্ট্রি?
আমি তার নিচে বড় করে বাংলাদেশ লিখে দিলাম।
পাদ্রি পড়ে ভদ্রতা করে হাসল একটু। ভাব দেখে বোঝা গেল বাংলাদেশ চেনে না। এ রকম অভিজ্ঞতা আগেও দু-একবার হয়েছে। দেশের নাম বললে কেউ কেউ চেয়ে থাকে।
আমি ওসব নিয়ে মাইন্ড করি না। বীরের দেশের একজন বীরযোদ্ধার সন্তান বলে গর্ব করি বরং।
তার উপযুক্ত কারণও আছে। আমার বাবা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। ক্যাপ্টেন রাশেদ আহমেদ। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার জবাব দিতে গিয়ে পিলখানায় শহীদ হন তিনি।
ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের প্রথম শহীদ অফিসার।
বাবার কথা অল্প অল্প মনে পড়ে। ভাসা ভাসা। কারণ তখন আমার বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। ছোট ভাই রনির জন্ম হয়নি। কিন্তু ওই এক কারণে তাঁর প্রসঙ্গ উঠলে আজও আমার বুক গর্বে ফুলে ওঠে।
আমি অনেক বছর হলো লন্ডনে আছি মা আর একমাত্র ভাই রনিকে নিয়ে। ওখানে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা আছে আমার। মোটামুটি ভালোই চলে।
আমার স্ত্রী মেহের আরেক লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশি পরিবারের মেয়ে। আমাদের বিয়ের বয়স তিন মাস। তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হয়েছে, হানিমুনের সুযোগ ছিল না। তাই কথা ছিল এবারের হেমন্তে পুরো এক মাস হানিমুন করব আমরা এবং সেই ফাঁকে এ দেশের যতটা সম্ভব ঘুরে দেখব। সেই অনুযায়ী মা ও রনির ওপর ব্যবসার ভার ছেড়ে দিন দশেক হলো লন্ডন ছেড়েছি আমরা। তারপর সেইন্ট অ্যালবানসের এই…।
খরর খরর শব্দে ঘুরে দেখি দুটো বার্নের মাঝখানের সরু গলি দিয়ে একটা দাদার আমলের ট্রাক্টর আসছে। চালাচ্ছে সেই লোকটা। ট্রাক্টরের নাচনের সাথে তাল রেখে হাস্যকর ভঙ্গিতে ঝাঁকি খাচ্ছে সে সেকেন্ডে সেকেন্ডে।
আমাদের সামনে এসে থামল ওটা। দড়ি দিয়ে গাড়িটাকে ট্রাক্টরের টোয়িং হুকের সাথে কষে বাঁধা হলো। পাদ্রির ইঙ্গিতে গাড়িতে উঠলাম আমরা। চলতে শুরু করল ট্রাক্টর। পাদ্রি আমাদের পাশে পাশে হেঁটে চলল। গ্রামের রাস্তার শেষ মাথার একটা কোর্ট ইয়ার্ডে থামল ট্রাক্টর। ততক্ষণে প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক। সামনে ‘গ্যারেজ’ লেখা একটা বোর্ড দেখলাম। শাটার বন্ধ।
পাদ্রি তার হাতঘড়ি দেখিয়ে ইশারা করল, কাল সকাল সাতটায় গ্যারেজ খুলবে। আমার স্ত্রীর মুখ শুকিয়ে উঠল আবার। ফিসফিস করে বলল, ‘রাতে কোথায় থাকব?’
আমি পাদ্রির দিকে ফিরে দুই হাত জোড় করে তার ওপর মাথা রেখে ঘুমানোর ভঙ্গি করলাম। সংকেত বুঝল লোকটা। সঙ্গীকে বোঝাল। সে মাথা দুলিয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বলল কিছু। ওর মধ্যে কয়েকবার ‘কান’ শব্দটা উচ্চারিত হলো। পাদ্রি মাথা ঝাঁকাল। তারপর আমাদের ট্রাক্টরেরপেছনের ধাপে উঠে দাঁড়াতে ইঙ্গিত করল। তাই করলাম। ড্রাইভারের সিটেরপেছনটা শক্ত করে ধরে দাঁড়ালাম আমি আর মেহের। পাদ্রি হেসে হাত নাড়ল। আমরাও নাড়লাম। ট্রাক্টর চলতে শুরু করল নাচতে নাচতে।
আমার এক হাতে ছোট একটা কেস। রাতের জন্য প্রয়োজনীয় টুকিটাকি আছে ওতে। আরেক হাতে শক্ত করে সিট ধরে আছি। আস্ত একটা উজবুকের মতো লাগছে নিজেকে। মেহের দু হাতে গায়ের জোরে ধরে রেখেছে সিট। ভয়ে, বিরক্তিতে কেঁদে ফেলার অবস্থা। চালক কিছুক্ষণ পর একটা ছোট পাহাড়ি ঝরনা পার হলো, তারপর একটা ছোট পাহাড়ে উঠতে লাগল। ওটার চূড়ার সামান্য আগে ডান দিকে বাঁক নিয়ে একটা খামারবাড়ির কোর্ট ইয়ার্ডে ঢুকে পড়ল ট্রাক্টর।
আমাদের নামতে বলে বাড়ির ভেতরে গেল সে। একটু পর মাঝ বয়সী, অ্যাপ্রন পরা ছোটখাটো এক মহিলাকে নিয়ে ফিরল। বয়স পঞ্চাশের মতো। আমাদের দেখে মাথা ঝাঁকাল মহিলা। কৃষক সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের তার সঙ্গে যেতে ইশারা করে ট্রাক্টরে উঠে বসল। খরর খরর শব্দে চলতে শুরু করল ওটা। মহিলা হাসিমুখে মেহেরের হাত ধরল, টেনে নিয়ে চলল বাড়ির ভেতরে। আমি ভেতরে ঢোকার আগে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। এ ধরনের খামার এ দেশে আগেও দেখেছি।
গরু, ঘোড়া, বাদামি মুরগি, অনেক কিছুর ফার্মিং করে এরা। তবে আধুনিকতার কোনো কারবার নেই এখানে। সবই সেকেলে পদ্ধতিতে হয়।
অন্ধকারের মধ্যে ধারেকাছেই কোথাও একটা ছন্দোবদ্ধ, ভারী ধুপ্ধুপ্ আওয়াজ উঠছে। কুড়ালের কোপের মতো। কেউ কাঠ কাটছে। আসন্ন শীতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে হয়তো।
মহিলা নিজেকে মিসেস কান বলে পরিচয় দিল। অল্পক্ষণেই বোঝা গেল বেশ হাসিখুশি সে। গল্পবাজ। পাখির মতো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ প্রকৃতির। কথার তালে ঘন ঘন মাথা নাড়ে। গোলগাল, আপেলের মতো থুতনি। চুল পেছনে টানটান করে বাঁধা।
সৃষ্টিকর্তাকে মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালাম এমন একটা আশ্রয় জুটিয়ে দেওয়ার জন্য। মিসেস কান বলল, আমরা ইচ্ছে করলে ওপরে গিয়ে থাকার রুমটা দেখে আসতে পারি। হাতমুখ ওয়াশ করতে পারি। আমি যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না। মেহের ওর হ্যান্ড গ্রিপ নিয়ে গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে গেল।
আমি একটা খোলা জানালার কাছে দাঁড়ালাম। ওটা দিয়ে বাড়িরপেছনের উঠোন দেখা যায়। একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ি দেখা যাচ্ছে উঠোনে, এ ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলাম না। তবে আমি নিশ্চিত যে কাঠ কাটার শব্দ ওদিকে থেকেই আসছে।
আমার স্ত্রী দশ মিনিট পর ফিরল হাত-মুখ ইচ্ছেমতো ধুয়ে একদম তরতাজা হয়ে। কাছে এসে হাসল। ‘ওফ্, একটা চিন্তা গেল। রুমটা চমৎকার!’
কর্ত্রীর আমন্ত্রণে এবার কিচেনে গিয়ে বসলাম আমরা। বোঝা গেল এটাই এ সংসারের কেন্দ্রস্থল। আধা ঘণ্টা নানান বিষয়ে গল্প হলো। জানা গেল, মহিলা আন্তর্জাতিক রেডক্রসে নার্সের চাকরি করত। বিয়ে হয়েছে প্রায় ত্রিশ বছর, কিন্তু ছেলেমেয়ে নেই। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে রান্না সারল মিসেস কান। ঘ্রাণে জিভে পানি এসে গেল আমাদের। ডিনার সার্ভ করা হলো। গাঢ়, সুস্বাদু ভেজিটেবল সুপ দিয়ে শুরু করলাম আমরা। খেয়াল করলাম, কাঠ কাটার শব্দ থেমে গেছে।
তারপর এক মিনিটও হয়নি, কিচেনের পেছন দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল গৃহকর্তা—মিস্টার কান। ডিনার করতে এসেছে। আমি উঠলাম তার সাথে হাত মেলাতে। মিসেস কান হড়বড় করে আমাদের উপস্থিতির কারণ ব্যাখ্যা করল। কিন্তু মানুষটার মধ্যে বিন্দুমাত্র আগ্রহও দেখা গেল না আমাদের ব্যাপারে। তাকালই না বলতে গেলে। বিব্রত হয়ে বসে পড়লাম। দেখলাম তাকে।
দৈর্ঘ্যে সাড়ে ছয় ফুটের কম না সে। ষাটের কাছাকাছি বয়স। দু হাতের পাঞ্জা ফুল সাইজ থালার মতো চওড়া। পাথরের মতো শক্ত হাত। তার হাঁটা ঠিক স্বভাবিকভাবে পা ফেলা নয়। অনেক কষ্টে পা টেনে টেনে হাঁটে। যে কেউ ভালো করে তাকালেই বুঝবে লোকটার শক্তি যেমন আসুরিক, বুদ্ধি তেমনই ধীর। মাথায় ক্রু-কাট্ চুল। কান ছোট, কোঁকড়ানো। চাউনিও শিশুর মতো সরল, ফাঁপা। তার পাশে মিসেস কানকে লাগল নেংটি ইঁদুরের মতো।
হাত না ধুয়েই খেতে বসে গেল মিস্টার কান। মিসেসও ব্যস্ত হয়ে পড়ল পরিবেশন করতে। ইশারায় আমাদেরও চালিয়ে যেতে বলল। খেতে খেতে মিস্টার কানের ভোজন দেখলাম। কোনো দিকে নজর নেই, গপাগপ্ গিলছে রাক্ষসের মতো।
চুপ করে থাকতে কেমন যেন লাগছে, তাই অভদ্রতা হবে জেনেও মেহেরকে বললাম, ‘এখানে যদি গাড়ি ঠিক না হয়, তাহলে সকালেই আমি কাছের বড় শহরে যাব।’
‘কত দূরে সেটা?’ বলল ও।
‘ষাট কিলোমিটারের মতো।’
একটু পর আর কেউ বলল, ‘নেহি নেহি! পাচাস (পঞ্চাশ) কিলোমিটার।’
অবাক হয়ে গৃহকর্তার দিকে তাকালাম। কিন্তু তার কোনো দিকে খেয়াল নেই। সাহায্যের আশায় মিসেসের দিকে ফিরলাম। লাজুক হাসল মহিলা।
‘মিস্টার কান…হিন্দি?’
মাথা নাড়ল মহিলা। ‘উর্দু।’
এবার বুঝলাম পদবিটা তাহলে ‘খান’ হবে। কান নয়। কিন্তু খান সাহেব আর একটা কথাও বলল না। একমনে খেয়ে চলেছে।
পরে যদিও আমার প্রতিটা প্রশ্নের জবাবই দিয়েছে সে, তবে তাৎক্ষণিকভাবে নয়। অনেক দেরিতে। কারণ আমার প্রশ্ন আর খানের জবাবের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল বিস্তর। তার চিন্তা বা স্মৃতির গাড়ি চলতে চায় না। তাই আমার প্রশ্নের জবাব দিতে স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে দেরি হয়েছে।
যা জানলাম তা এ রকম: তার নাম সিকান্দার খান। পাঞ্জাবি। পাকিস্তান আর্মির সাধারণ সৈনিক ছিল। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে গোলযোগপূর্ণ পূর্ব পাকিস্তানে বদলি করা হয় তাকে।
‘সেখানে কোথায় পোস্টিং ছিল আপনার?’
দীর্ঘ বিরতি। ‘ঢাকায়।’
‘ঢাকার কোথায় ছিল আপনার ক্যাম্প?’
‘…শাবাগ (শাহবাগ)।’
‘তারপর? অ্যাকশনে যাননি?’
‘জরুর! পঁচিশ তারিখ রাতেই অ্যাকশনে যাই।’
‘কোথায়?’
‘কেয়া নাম থা…,’ অনেকক্ষণ মাথা চুলকাল সিকান্দার খান। ‘পিলখানামে।’ মাথা ঝাঁকাল ঘন ঘন। ‘হাঁ, পিলখানামে। ইপিআরকা…। ’
আমার মুখের ভেতরটা টকটক পানিতে ভরে উঠল। কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। টের পাচ্ছি রক্ত গরম হয়ে উঠতে শুরু করেছে। মেহেরের চেহারাও বদলে গেছে। হাঁ করে আমাদের কথা শুনছে। একটু আগের নিশ্চিন্ত, হাসি হাসি ভাবটা উধাও হয়ে গেছে চেহারা থেকে। পিলখানা শব্দের সঙ্গে যে আমাদের নাড়ির যোগ আছে, সে কথা ও ভালোই জানে। গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে গল্পে আগ্রহ হারিয়ে একবার আমাকে দেখছে, একবার সিকান্দার খানকে দেখছে।
‘মানুষ মেরেছেন?’
‘হাঁ! এক আফসারকো মারা সাবসে আগে (সবার আগে এক অফিসারকে মেরেছি)।’
আমি তাকিয়ে থাকলাম।
‘পিস্তল উঠানেকা কোশিশ কার রাহা থা…গোলি মার দি (পিস্তল তোলার চেষ্টা করছিল। গুলি করে দিয়েছি)!’
‘তার নাম…বলতে পারেন?’
একটু ভাবল সে। মাথা নাড়ল। ‘সুবেদার মেজরকা অর্ডার থা…।’
‘চেষ্টা করে দেখুন না মনে পড়ে কি না!’
খাওয়া শেষ করে উঠল খান। আমার আকুলতা দেখে কী বুঝল কে জানে! বলল, ‘চেষ্টা করে দেখি। মনে পড়লে জানাব আপনাকে।’
লোকটা বেরিয়ে যেতে গল্পের বাকি অংশ মিসেস খানের মুখে শুনলাম। ১৬ ডিসেম্বরের পর পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের তত্ত্বাবধানে পর্যায়ক্রমে মুক্তি দেওয়া হয় তাদের। সিকান্দার খানের জাহাজ যখন করাচি বন্দরে পৌঁছায়, তখন ম্যালেরিয়া জ্বরে শোচনীয় অবস্থা তার।
ইন্ডিয়ান জাহাজের ক্যাপ্টেন বেগতিক দেখে তাকে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের হাতে তুলে দেয়। সংস্থাটির করাচি মিশনে অনেক বিদেশি নার্স ছিল তখন। তাদের একজন ছিল ব্রিটিশ, মিস জেনিফার হার্ট ওরফে আজকের মিসেস খান। তার ওপর সিকান্দার খানের শশ্রূষার ভার পড়ে। দিনের পর দিন দৈত্যাকার মানুষটার সেবা করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই তার প্রেমে পড়ে যায় জেনিফার।

রাতে আমার ঘুম হয়নি। মেহেরেরও হয়নি। সকালে মিসেস খান জানাল, আমার গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে। কারবুরেটরে ময়লা জমে যাওয়ায় সমস্যা হয়েছিল। আর কিছু না। পেছনের উঠোন থেকে কাঠ কাটার ধুপ্ধাপ্ শব্দ আসছে। একবার ভাবলাম, খানকে জিজ্ঞেস করি নামটা মনে পড়েছে কি না।
পরক্ষণে অজানা ভয়ে কুঁকড়ে উঠলাম।
থাক না অজানা! ক্ষতি কী?
নাশতা খেয়ে আমাদের থাকা-খাওয়ার খরচ বাবদ মিসেস খানের হাতে একটা পাঁচ পাউন্ডের নোট ধরিয়ে দিলাম। গাড়ি মেরামত বাবদ দিলাম এক পাউন্ড।
একটু পর রওনা হয়ে গেলাম আমরা। সবে রাস্তায় উঠেছি, এমন সময় একটা চিৎকার শুনে গাড়ি থামালাম। চেয়ে দেখি সিকান্দার খান মাথার ওপর কুড়াল ঘোরাতে ঘোরাতে ছুটে আসছে। এমনভাবে ঘোরাচ্ছে যেন ওটা ম্যাচের কাঠি। চোয়াল ঝুলে পড়ল আমার। লোকটা আমাদের আক্রমণ করতে আসছে! কিন্তু কাছে আসতে দেখা গেল হাসছে মাথামোটা। আবিষ্কারের আনন্দে চেহারা ঝিলিক মারছে।
‘ইয়াদ আয়া! উসকা নাম ইয়াদ আয়া (তার নাম মনে পড়েছে)!’ বারবার বলতে লাগল সে।
ঢোক গিললাম অজান্তে। ‘কী নাম?’
‘ক্যাপ্টেন থা ও আদমি…ক্যাপ্টেন রাশেদ আহমেদ!’

বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১১, ২০১১

Category: গল্প
Previous Post:দখিন হাওয়ার দক্ষিণ বারান্দায়… – আনিসুল হক
Next Post:বই চুরি – রবের্তো বোলাইয়োঁ

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑