• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় – জন্মশতবার্ষিক স্মরণ

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » প্রবন্ধ » মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় – জন্মশতবার্ষিক স্মরণ

আবদুল মান্নান সৈয়দ

১· ···লেখা থেকে লেখককে বিচ্ছিন্ন করা যায় না।

-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘শারদীয়া সাহিত্যে ছোটগল্প’, পরিচয়, ফাল্গুন ১৩৫৪

২· বিদ্রোহীদের জয় তখনই হয়ে গেছে কিন্তু। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকেও নতুন জানলা খুলতে হয়েছে। ঐতিহাসিক সে জয়। সাহিত্যে শ্রেণীবিচার উঠে গেল, অন্তত বিষয়ারোপের দিক থেকে, ‘ছোটলোকেরা’ তখন সাহিত্যে ঢুকে পড়েছে। আর তাদের বার করে কে? হয়তো একটু বিকারের ঘোরেই ঢুকেছে, হয়তো সে অধিকার-ঘোষণা কিঞ্চিৎ বেশি ভাববিলাসী অস্বাস্থ্যের দিকেই ঝুঁকেছে, ব্যক্তিগত সম্বন্ধ নির্ণয়ের সামাজিক যুগে যেটা স্বাভাবিকও বটে। কিন্তু ঘোষণাটা লাভই হয়ে রইল।

-বিষ্ণু দে, ‘গল্পে-উপন্যাসে সাবালক বাংলা’, পরিচয়, শারদীয়া সংখ্যা ১৩৫৪

কল্যাণীয়াসু,

এসো, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে তোমার সঙ্গে একটু গল্প করা যাক।

এই লেখার ওপরে যে-উদ্ধৃতি দুটো দেখছ, সেগুলো পরিচয় পত্রিকার ১৯৪৬-৪৭ সংখ্যা থেকে উদ্ধৃত। পরিচয় ততদিনে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছেড়ে দিয়েছেন, পত্রিকাটি তখন তাঁর বিশ্বাসবৃত্তের একেবারে বিরোধী বলয়ের বন্ধুদের হাতে, কমিউনিস্টদের হাতে। বিষ্ণু দে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকায় ফের লিখেছেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুতা ছিল, বিষ্ণু দে-র কবিতার বই চোরাবালির দীর্ঘ অসামান্য প্রবেশক লিখেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ। পরিচয় পত্রিকা যখন কমিউনিস্টদের হাতে এল, তখনও বিষ্ণু দে থেকে গেলেন, কেননা ততদিনে বিষ্ণু দে-র মধ্যে বাম আভিমুখ্য দেখা দিয়েছে। কিন্তু বিষ্ণু দের একটি লেখা নিয়ে-এখানে উৎকলিত ‘গল্পে-উপন্যাসে সাবালক বাংলা’ নামের চমৎকার প্রবন্ধটি নিয়ে এমন তর্ক শুরু হলো, যে, তিনি পরিচয়-এর সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়লেন, এবং তাঁর নেতৃত্বে একটি পত্রিকা প্রকাশ করলেন সাহিত্যপত্র নামে। বিষ্ণু দের শিষ্যরা-যাঁদের পরিহাসান্বিত নাম ছিল ‘বৈষ্ণব’-তাঁরা বিভিন্ন সময়ে এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বিষ্ণু দের ওই প্রবন্ধ নিয়ে, এবং নীহার দাশগুপ্তের প্রবন্ধ ‘শারদীয়া সাহিত্যে ছোটগল্প’ (যার মধ্যে খোঁচা ছিল বিষ্ণু দে-র পূর্বোক্ত প্রবন্ধের মন্তব্য নিয়ে) নিয়ে পরিচয়-এর কয়েক সংখ্যায় জল ঘোলা হয়ে উঠল। তাতে অংশ নিলেন ফের বিষ্ণু দে, নীহার দাশগুপ্ত, অনিলকুমার সিংহ-এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং, যাঁর গল্প-উপন্যাস ছিল ওইসব রচনার একটি আলোচিত বিষয়।

‘গল্পে-উপন্যাসে সাবালক বাংলা’ প্রবন্ধে বিষ্ণু দে কিন্তু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচুর প্রশংসাই করেছিলেন। উৎকলন করা যাক তিনটি অংশঃ

১· ‘···মানিকবাবুর অস্থির কৌতূহল, জীবনের নানা স্তরের তথ্যজ্ঞান থেকে থেকে তাঁর গভীর ও সংবেদ্য অন্তর্দৃষ্টির ঝলকানি, সেটাই আমাকে শ্রদ্ধানত করে।’

২· ‘মানিকবাবুর বা অচিন্ত্যবাবুর বই পড়তে পড়তেও মনে হয় দেশ-বিদেশের গল্পকারের কথা। পদ্মানদীর মাঝি, সহরতলী, পুতুলনাচের ইতিকথা ইত্যাদি উপন্যাসে ও নানা গল্পে মানিকবাবুর যে চমকপ্রদ দক্ষতায় আমরা মুগ্ধ হয়েছি, সে কৃতিত্ব আজ সংহত দৃষ্টিতে সেই নবসম্ভাবনায় ঐশ্বর্যবান, যেখানে জীবনের ব্যাপ্তিতে লেখা হয়ে ওঠে নৈর্বক্তিক, মহৎ।’

৩· ‘চিহ্ন পড়ে মানিকবাবুর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায় বহুগুণ। কলাকৌশলে যে তাঁর পরীক্ষার বিশ্রাম নেই, তার প্রমাণ চিহ্ন। এই সিনেমাশোভন বহু ব্যক্তির জীবনে অবলম্বিত একটি কাহিনী এই রকম সামাজিক রূপ পায়নি ভার্জিনিয়া উলফে বা হেনরি গ্রীনের চলন্ত গল্পে। তার কারণ অবশ্যই মানিকবাবুর সামাজিক অবহিতি এবং বাস্তব ঘটনার সুযোগ।’
নীহার দাশগুপ্তের ‘শারদীয়া সাহিত্যে ছোটগল্প’ প্রবন্ধে (পরিচয়, অগ্রহায়ণ ১৩৫৪), বিষ্ণু দের প্রত্যুত্তরে (পৌষ ১৩৫৪), নীহার দাশগুপ্তের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় (পরিচয়, মাঘ ১৩৫৪), অনিলকুমার সিংহের প্রতিক্রিয়ার (পরিচয়, মাঘ ১৩৫৪) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প-উপন্যাসের প্রসঙ্গ ও বিশ্লেষণ এসেছিল। সবার শেষে কলম ধরেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। নীহার দাশগুপ্ত ও নতুন সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক অনিলকুমার সিংহ তো বটেই, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিষ্ণু দেকে চূড়ান্ত আক্রমণ করেছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটিমাত্র যুক্তি বা উক্তি উদ্ধৃত করে দিই, ‘বিষ্ণুবাবুর মার্কসিস্ট জ্ঞান যে কতদূর অপরিচ্ছন্ন তার আরেক প্রমাণ লেখা থেকে লেখককে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার যুক্তির মধ্যে পাই।’

তুমি আর আমি এখন রবীন্দ্রনাথে নিমজ্জিত। তাতে কী! রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন ‘কবিরে পাবে না তাহার জীবনচরিত্রে’, তাতে কি পুরো আস্থা স্থাপন করা যায়, বলো? রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর জীবন সমান্তরালে মিলিয়ে দেখতেই হয়। অন্তত আমার রবীন্দ্রবিচার সব সময়ই রবীন্দ্রজীবনের সঙ্গে সাযুজ্যের সন্ধানে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-যে ওই-প্রতিক্রিয়াস্মাত বলব না প্রতিক্রিয়াক্রুদ্ধ বলব?-প্রবন্ধে বারবার বলছেন, ‘লেখা থেকে লেখককে বিচ্ছিন্ন করা যায় না।’ তাকে আমি মাথা পেতে স্বীকার করে নিই। বিষ্ণু দেকে মানিক বলেছেন তাঁর চিঠির ‘অকারণ তিক্ততা ও অসংযম সীমা ছাড়িয়ে গেছে’, সেটা বরং মানিকের পত্রেই ঘটেছে; কিন্তু তাঁর পত্রে অসামান্য বিশ্লেষণের শক্তিতে মুগ্ধ হতেই হয়।

সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে শোনো, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিমানুষটি কেমন এবং তারপর তাঁর সাহিত্যকর্মের সঙ্গে মিলিয়ে নাও। আমি বিক্ষিপ্ত দু-চারটি প্রসঙ্গে বলি এখানে।

২·
বছর ২৬ বয়সে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গশ্রী পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক পদের জন্য একটি দরখাস্ত পাঠিয়েছিলেন। সেখানে সাতটি পয়েন্টে তিনি তাঁর গুণপনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেই চাকরির আবেদনপত্রের শেষ অনুচ্ছেদটি ছিল এরকমঃ ‘পরিশেষে নিবেদন এই, আমি অবগত আছি শ্রী পরিমল গোস্বামী এই পদটির জন্য আবেদন করিবেন। আমার চেয়েও তাঁহার চাকুরির প্রয়োজন বেশি। মহাশয় যদি ইতিমধ্যে তাঁহার সম্বন্ধে অনুকূল বিবেচনা করিয়া থাকেন তবে অনুগ্রহপূর্বক আমার এই আবেদন প্রত্যাহার করা হইল বলিয়া ধরিয়া লইবেন। কারণ, শ্রী পরিমল গোস্বামী মহাশয়ের সহিত আমি প্রতিযোগিতা করিতে ইচ্ছুক নহি।’

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসাধারণ বিশ্লেষণক্ষমতার কথা কে না জানে! আমার আম্মা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বউ গল্পগ্রন্থটি পড়ে তাঁর বিভিন্ন বৃত্তির মানুষের স্ত্রীদের মনোবিশ্লেষণী ক্ষমতায় বি্নিত হয়ে গিয়েছিলেন। কেবল গল্প-উপন্যাসে নয়, মানিক তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আবহতত্ত্ববিদ সুধাংশুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর ৩২/৩৩ বছর বয়সে যে-চিঠি লিখেছিলেন তাও দশটি বিশ্লেষণী পয়েন্টে বিভাজিত। এবং তাঁর নামস্বভাবী স্পষ্টতায় রচিত। ওই ৩২/৩৩ বছর বয়সেই (মনে রেখোঃ মানিক বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৮ বছর-১৯০৮-৫৬ঃ এই তাঁর আয়ুষ্কাল) লিখেছেন তিনি, ‘কলেজে পড়িবার সময় আমি স্থির করিয়াছিলাম, সাহিত্যক্ষেত্রে বড় হইব। আমি তাহা প্রতিপালন করিয়াছি।’ ওই চিঠিতে লিখেছেন, ‘চিঠিতে নেকামিপূর্ণ মন রাখা কথা লিখিয়া দশজনের কাছে আপনার নিন্দা করা কোনোদিন আমার দ্বারা হইয়া উঠে নাই। আপনার সম্বন্ধে আমার কোনো নালিশ থাকিলে সোজাসুজি আপনাকেই জানাইয়াছি।’ দীর্ঘ পত্রটির প্রথম পয়েন্টটিতেই বড় ভাইকে লিখছেন সরাসরি, ‘···আপনার জন্যই আমাদের সংসারে অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে এবং ভাইয়েরা কেহই জীবনে উন্নতি করিতে পারে নাই। আমি আপনাকে দায়ী করিতেছি না, কিন্তু আপনিই ইহার প্রধান কারণ।’ ১২ পৃষ্ঠার দীর্ঘ পত্রটির শেষ দিকে লেখা আছে, ‘বহুদিনের চিন্তা ও বিশ্লেষণের পর আমি যাহা সত্য বলিয়া জানিয়াছি তাহাই আপনাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছি মাত্র।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমগ্র সাহিত্যই এমনই ঘোষণা দিচ্ছেঃ বহুদিনের চিন্তা ও বিশ্লেষণের পর আমি যা সত্য বলে জেনেছি, তাই আপনাদের বলবার চেষ্টা করেছি মাত্র। মানিক তাঁর জননী (১৯৩৫) থেকে মাশুল (১৯৫৬) উপন্যাস পর্যন্ত, অতসীমামী (১৯৩৫) থেকে স্বনির্বাচিত গল্প (১৯৫৬) পর্যন্ত জীবৎকালে প্রকাশিত তাবৎ গ্রন্থে এবং রচিত-কিন্তু-অপ্রকাশিত-অগ্রন্থিত অগণন রচনায় এই সততা, সাহস, সত্যসন্ধিৎসা, ভাবনা-বেদনা ও বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণের এক অপরূপ আলেখ্যমঞ্জরী রেখে গেছেন আমাদের জন্যে।

‘লেখক হচ্ছে কলম-পেষা মজুর’, মনে করতেন মানিক। জীবনানন্দের মতোই তিনি মনে করতেন, ‘পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি।’ মানিক অল্পকালই চাকরি করেছেন, প্রেস ও প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠানও করেছেন কিছুকাল-কোনোটাই তাঁর ধাতে পোষায়নি। চাকরি, ব্যবসা-এসব করবার জন্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্ন হয়নি।
মানিকের স্পষ্টবাদিতার নমুনা দ্যাখো। এক পত্রিকা দফতরে চাকরি করেছেন কিছুকাল। সেখানে একটি মাসিক সাহিত্যসভা হতো। পত্রিকার মালিকেরও শখ ছিল লেখালেখির। একবার মানিক সেই সাহিত্যসভায় উপস্থিত ছিলেন। পত্রিকার মালিক-লেখক তাঁর একটি লেখা পড়লেন। সেই লেখা সম্পর্কে মানিকের বলবার পালা যখন এল, তখন তিনি সরাসরি জানিয়ে দিলেন তাঁর অপছন্দের কথা।

একবার এক মিছিলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখা গেল। তাঁর চেনা এক ভদ্রলোক তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, মিছিলটা কিসের? মানিক বললেন, তা তিনি জানেন না। মিছিল মানে প্রতিবাদ। প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করছেন মানিক, সে যে-কোনো প্রতিবাদই হোক। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হিশেব-কষা বুদ্ধিজীবী-বিবৃতিজীবী ছিলেন না।

নতুন সাহিত্য-সম্পাদক অনিলকুমার সিংহ একটি ঘটনার কথা জানিয়েছেন, ‘একবার শারদীয় স্বাধীনতা-র গল্পের টাকা পেতে অনেক বিলম্ব হচ্ছিল। পরে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ জানালেন তাঁরাই নাকি টাকাটা নিজেদের তহবিল থেকে তুলে পার্টি তহবিলে দিয়ে দিয়েছেন। খবরটা শুনে মানিকবাবু রীতিমতো বিচলিত হলেন। বললেন, এ কেমন কথা! আমার টাকা আমি দান করব। স্বাধীনতা-কর্তৃপক্ষকে আমার টাকা দান করার এখতিয়ার কে দিয়েছে?’ এরকম স্বাধীনচেতা মানুষকে পার্টি কি পছন্দ করবে? করেওনি।

এ-ই হচ্ছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে মানিকের ১২টি বই প্রকাশিত হলেও একটিও তিনি পাঠাননি রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যের জন্যে। অমন-যে ‘নির্জনতম কবি’ জীবনানন্দ দাশ, তিনিও রবীন্দ্রনাথকে কবিতাগ্রন্থ পাঠিয়ে তাঁর মতামতের জন্যে কাতর অনুরোধ করেছেন; অমন-যে রবীন্দ্রদ্রোহী বুদ্ধদেব বসু, তিনিও রবীন্দ্রনাথকে বই পাঠিয়েছেন মতামতের জন্যে; এমনকি ঠোঁট-কাটা সমর সেন, সবাইকে যিনি বিদ্রূপবাণে বিদ্ধ করেন, তিনিও রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে লেখেন, ‘আমার কবিতার বইয়ের এক কপি আপনার ঠিকানায় পাঠিয়েছি। আপনার কেমন লেগেছে জানতে পারলে বাধিত হবো।’

‘প্রতিভা’ নামে এক অসাধারণ প্রবন্ধে মানিক জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘প্রতিভা···দক্ষতা অর্জনের বিশেষ ক্ষমতা। আর কিছুই নয়।’ দিবারাত্রির পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ওই দক্ষতা এমনভাবে অর্জন করেছিলেন, যা অসাধারণ প্রতিভাবানের পক্ষেই সম্ভব।

অনন্যসাধারণ এই কথক এক বিশুদ্ধ বিশ্বাসে লিখেছিলেন, ‘···বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার অভাব খানিকটা মিটিয়েছি নিশ্চয়।’ কিন্তু সাব-ডেপুটি কালেক্টর পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিজীবনে অভাব মেটেনি। লুম্বিনি পার্ক মানসিক হাসপাতালে যেতে হয়েছে। মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে শোচনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে।

৩·
হ্যাঁ, তুমি তাঁর জীবনের এসব টুকরো তথ্যপঞ্জি থেকে এতক্ষণে ঠিকই ধরতে পেরেছ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ফ্রয়েডিজম বা কমিউনিজম কোনোটা নিয়েই ব্যবসা করতে পারেননি। কেননা আজকালকার ফিকিরচাঁদদের সঙ্গে তাঁকে মেলানো যাবে না। কোত্থেকে পেয়েছেন এই আশ্চর্য চারিত্রবল? সে কি তাঁর পিতার কাছ থেকে যিনি তাঁর দরিদ্রতম সন্তানের সঙ্গে থাকাটাই শ্রেয় জ্ঞান করেছেন? অথবা প্রকৃতির এক আশ্চর্য উ্নীলন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্যাখো, অনামিকা, আজ মনে হয় সবই এক দৈব সংঘটন। আমি তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র। সে কতকাল আগের ঘটনা। এক গ্রন্থভুক কিশোরের হাতে এসে পড়েছিল বাংলা সাহিত্যের সেরা সব বই-কবিতার, ছোটগল্পের এবং তারই মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসাধারণ সেই উপন্যাস, পুতুলনাচের ইতিকথা। যা পড়ে বলে উঠেছিলামঃ আশ্চর্য, আশ্চর্য, আশ্চর্য, আশ্চর্য, আশ্চর্য, আশ্চর্য, আশ্চর্য! হ্যাঁ, পর-পর সাতবার বলেছিলাম। সে বি্নয় এখনো যায়নি।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি-কোনো উপন্যাসে আছে এক ব্যক্তির স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে, সেদিনই সে গেছে সিনেমা দেখতে। আশ্চর্য না? কিন্তু কোথাও আশ্চর্য মনে হয় না। পুতুলনাচের ইতিকথার মতি আর কুমুদের কথা মনে আছে তোমার? সেই ভেসে-যাওয়া যুগল নারী-পুরুষ? মানিক বলেছিলেন, হয়তো তাদের কথা বলবেন আর কোথাও। কিন্তু লেখেননি আর-কখনো। ইতিকথার পরের কথা নামে যে উপন্যাস লিখলেন মানিক, সে এক আলাদা পার্বত্য অভিযান। আসলে জীবনে তো এই-ই হয়। জীবনে কত মানুষের সঙ্গে দেখা হলো তোমার-আমার, এই জীবনে ও পৃথিবীতে আর হয়তো কখনো দেখব না তাদের। উপন্যাস জীবনের নিকটতম শিল্পরূপ। সেখানে এ রকম রূপায়ণ তো ঘটবেই। কিন্তু মানিকের আগে দেখিয়েছে কে?

‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পও পড়েছিলাম আগে। সেও এক আবিষ্কার। মানিক নিজেই ‘অতসীমামী’র মতো গল্প দিবারাত্রির কাব্য নামে উপন্যাসকে ‘রোমান্সে-ঠাসা’ বলেছেন, বলেছেন রোমান্টিক। উত্তরকালে মানিক পুতুলনাচের ইতিকথার একটি ভাষ্য প্রণয়ন করেছেন। মানিকের এসব আত্মমূল্যায়ন আমরা স্বীকার করি না। সৃষ্টিকর্ম শিল্পীকে ছাড়িয়ে চলে যায়। আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনের একটির পর একটি স্তর অতিক্রম করেছেন। নজরুল ইসলামের মতো জীবনের উপান্ত পর্বে শ্যামা-মাতার আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁর রচনায় তার কোনো প্রতিবিম্বন দেখা যেত। একটি কথা বলা যায়ঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সন্ধানের শেষ ছিল না কোনো-যেমন ছিল না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, যেমন ছিল না কাজী নজরুল ইসলামের। রবীন্দ্রনাথের ৮১ বছর বয়সে মৃত্যু- আমাদের বিবেচনায়-অকালমৃত্যু; কাজী নজরুল ইসলামের ৪৪ বছর বয়সে নিস্তব্ধতা ও অকালস্তব্ধতা; মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৪৮ বছর বয়সে অকালপ্রয়াণ একটি সচলতার অবসান।

১৯২৮-৫৬-এই ২৮ বছর তো মানিকের প্রকাশ্য সাহিত্যযাত্রা। এর মধ্যে ১৯৪৪ সালে মানিক কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ একটি পরিষ্কার বিভাজনরেখা ১৯২৮-৪৪-এই ১৬ বছর এবং ১৯৪৪-৫৬-এই ১২ বছর। অথবা হিসেবটা এভাবে করা যায়-১৫ বছর যোগ ১৩ বছর। প্রথম ১৬ বছরকে অস্বীকার করব, না শেষ ১২ বছরকে অমান্য করব? ফ্রয়েডী পিরিয়ড বা কমিউনিস্ট যুগ-দুইকেই আমরা সমান গুরুত্ব দিতে চাই। মহৎ একজন লেখকের প্রতিটি দৃক্‌কোণ মহত্ত্বপূর্ণ। যিনি ‘সব সময় সর্বত্র জীবনকে দর্শন করার বিরামহীন শ্রম’ চালানোয় প্রতীত ছিলেন, তাঁকে আনুপূর্ব বুঝে নিতে হবে। নজরুল ইসলামেরও এ রকম পরিষ্কার দুটি এলাকাঃ কবিতার যুগ এবং সংগীতের যুগ-বিশের দশকে কবিতায় উত্থাপন করেছেন নিজেকে, তিরিশের দশকে সংগীতে নিমজ্জিত। কিন্তু পরম্পরা থাকেই। যতই বাস্তবতার গুণগান করুন মানিক, তিনি তাঁর অন্তর্গত প্রবণতাকে কখনোই রোধ করতে পারেননি। মানিকের প্রিয় কবি ছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য, এতই প্রিয় যে নিজের সন্তানের নামও রেখেছিলেন ওই নামে, প্রিয় ছিলেন নজরুল ইসলামও, নিজেও কবিতা লিখেছেন, কিন্তু তাঁর গদ্যের কবিতাশক্তি প্রবলতর। উদাহরণঃ দিবারাত্রির কাব্য কিংবা ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের সেই পরমাশ্চর্য উপসংহার-‘হয়তো ওই চাঁদ আর এই পৃথিবীর ইতিহাস আছে। কিন্তু যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখুু ও পাঁচী পৃথিবীতে আসিয়াছিল এবং যে অন্ধকার তাহারা সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক, পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনোদিন পাইবেও না।’ রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা (যার সংলাপের পর সংলাপ কবিতার পর কবিতা তোমার মুখস্থ এবং তোমার আশ্চর্য মধুকণ্ঠে শুনিয়ে আমাকে আনন্দ আর বেদনা উপহার দাও) আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্যর মধ্যে প্রকাশকালের ব্যবধান মাত্র কয়েক বছরের। দুটি উপন্যাসই কবিত্বের পরাকাষ্ঠা-কিন্তু রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসটি মনে হয় কবির রচনা আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসটি মনে হয় কথাশিল্পীর সৃজন। এইখানে এই দুই লেখকশিল্পীর মৌলিক ব্যবধি-যুগান্তরের ব্যবধি।

৪·
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমবয়সী কবি বুদ্ধদেব বসু মানিকের অকালমৃত্যুর পরে মানিক-বিষয়ে একটি মূল্যায়নধর্মী প্রবন্ধ লিখেছিলেন। মানিক একসময় ‘কবিতাভবনে’ও যেতেন। ‘কবিতাভবন’ প্রকাশিত গল্পগ্রন্থিকায় তাঁর একটি গল্পও বেরিয়েছিল। ১৯৪৪ সালে মানিক কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। এদিকে বুদ্ধদেব বসু প্রগতিবাদী শিবিরে অল্পকালের জন্যে সন্নিহিত হলেও পরে বিরুদ্ধবাদী হয়ে ওঠেন। অশোক মিত্রের আত্মজীবনী থেকে মনে হয়, ১৯৪৬ সাল বা তার কাছাকাছি সময়ে মানিক বুদ্ধদেবের সংস্পর্শ ছেড়েছিলেন। একথা মনে না-হয়ে পারা যায় না, বুদ্ধদেবের আত্যতিক কমিউনিজম বিরোধিতার কারণ কী। রুশ বিপ্লবের বিশাল ঘটনাকে কী করে অস্বীকার করলেন তিনি, বুদ্ধদেবের মতো গ্রহিষ্ণু মানুষ? কিন্তু বুদ্ধদেবের অন্য একটি মন্তব্যও মনে হয়।

জীবনানন্দ দাশকে বুদ্ধদেব বলেছিলেন ‘নির্জনতম কবি’। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যে ‘নির্জনতম’ অভিধাটি বোধহয় আরো প্রযোজ্য। মানিকের কোনো বন্ধুবান্ধবের নাম আমরা জানি না। সুবোধ রায় নামে জীবনানন্দের শেষদিককার এক বন্ধুর কথা জানি আমরা, যাঁর সঙ্গে কবি হাঁটতে বেরোতেন। সুবোধ রায় জীবনানন্দের মৃত্যুর পরে তাঁর সম্পর্কে দুটি ্নৃতিচারণ রচনা করেছিলেন। কলকাতায় আশির দশকের প্রথমদিকে কেউ-একজন বলেছিলেন আমাকে, চিম্মোহন সেহানবীশের কাছে মানিক-সম্পৃক্ত অনেক-কিছু জানা যেতে পারে। কলকাতার বইমেলায় একবার চিম্মোহন সেহানবীশ-নীহাররঞ্জন রায়কে দেখেছিলাম। এগিয়ে গিয়ে কথা বলা হয়নি। প্রসঙ্গ, কলকাতার সাহিত্যিক পরিবেশের কথাও তোমাকে একটু বলতে পারি। মানিককে তাঁর অগ্রজ লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র যেমন উৎসাহিত করেছিলেন, তেমনি মানিকও পরবর্তী সমরেশ বসুকে একটি গল্প পরিচয় পত্রিকা থেকে ফেরৎ দিয়ে সমরেশকে উৎকৃষ্টতর গল্প লেখার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন-সমরেশ সানন্দে সে-কথা নিজেই জানিয়েছেন।

বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার, বিষ্ণু দে-তিরিশের অনেক শ্রেষ্ঠ কবিই মানিককে সহৃদয়তায় গ্রহণ করেছিলেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-সম্পাদিত পরিচয় বা সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত পূর্বাশা পত্রিকায় মানিক উপস্থিত থেকেছেন লেখক হিসেবে। তাঁর অসুস্থতার সময় তারাশঙ্কর যথাসাধ্য করেছেন।

হ্যাঁ, সেটা বলছি। তার আগে আরো একটু বলতে হবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় প্রতীক, রূপক, সংকেত ঢের আছে; কিন্তু মানুষটি ছিলেন ছলচাতুরীহীন, নিষ্কপট, খোলাখুলি। আর এক ‘কেন?’ জিজ্ঞাসায় বিদ্ধ। ওই জিজ্ঞাসা, যার মানে জানবার ইচ্ছা, সেটা ছাড়া তুমি এগোতেই পারবে না। তারাশঙ্কর তাঁর অসুস্থতার সময় সহায়তা করেছেন, কিন্তু কেন? স্ত্রীর সন্তান হয়েই মৃত্যুবরণ করল, স্ত্রী খুশি, তাঁরও তো সন্তান, কিন্তু সন্তান হারানোর শোক বা আনন্দ কোনোটাই মানিককে স্পর্শ করছে না, তিনি প্রশ্ন করছেন-জননী তার সন্তানের মৃত্যুতে আনন্দিত হবে কেন? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অন্তঃসন্ধানী, যেমন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল বা জীবনানন্দ। তাই চিম্মোহন সেহানবীশরা বুঝতে পারেননি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার আক্নিকতার রহস্য। আর যে-রাহস্যিকতার কথা মানিক-বিশ্লেষকেরা এড়িয়ে যান, তা তাঁর শ্যামা-মাতার প্রতি নির্ভরতা। একটি কথা মনে রেখোঃ একজন লেখক যে-সব অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে পার হলেন, আলোচনা-সমালোচনায় তার কোনোটিকেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না, অন্তত তাতে তাঁকে সম্পূর্ণাঙ্গ জানা হবে না। যেমন রবীন্দ্রনাথের আস্তিকতাকে তোমরা একটু আড়াল করতে চাও। তা করলে কিন্তু তোমার রবীন্দ্রবিচার পূর্ণতা পাবে না।

মানিক যখন যেটা ধরেছেন, দৃঢ়বদ্ধ থেকেছেন তার মধ্যে। তাঁর স্ত্রী কমলা বন্দ্যোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘আমার শ্বশুরমশাই টালিগঞ্জের বিরাট বাড়িটা বিক্রি করে টাকাটা ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দেন। এক-একজন আট-ন হাজার টাকা পান। সেই টাকাটা আমি চোখেও দেখলাম না, সব পার্টিকেই দিয়েছিলেন। আমাকে জানাননি।’ অনামিকা, এই হচ্ছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বিখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে মানিকের দুর্দিনে তারাশঙ্কর কী যেন কাজ দিয়েছিলেন, তারাশঙ্করের এক চিঠিতে পড়েছি, সুভাষ সেটি সম্পন্ন করেননি। মানিকের মৃত্যুর পরে সুভাষ একটি কবিতা লিখেছিলেন বড় দুঃখ করে। বরং পরবর্তী কথাশিল্পী নরেন্দ্রনাথ মিত্র মানিক সম্পর্কে একটি মূল্যবান ব্যক্তিগত সারণিক রচনা করেন। আরেকজন কথাশিল্পী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় মানিক সম্পর্কে প্রথম গ্রন্থ নিতাই বসুর রচনাকে উৎসাহিত করেছিলেন। কবিতা লিখেছিলেন মঙ্গলাচরণ। রাম বসু কবিতাগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন। বামাবর্তের কবিদের আরো কেউ কেউ শ্রদ্ধার্ঘ রচনা করেছিলেন।
পরিচয় পত্রিকার মালিক বেঁচে থাকতেই তারাশঙ্করকে বেশি মূল্য দেওয়া হয়েছিল। এত সহজ এই বিচার? তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে আমার কাছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কেই মহত্তম মনে হয়। কেন?-মানিকের নিজের বিবরণ অনুযায়ী তিনি বাস্তবতার দাবি মিটিয়েছেন সেজন্যে নয়। তিনি বহির্বাস্তবতা আর অন্তর্বাস্তবতাকে মিলিয়ে দিয়েছেন, সেজন্যে। বাস্তবের অন্তরালশায়ী রাহস্যিকতাকেও ধারণ করেছেনে, সেজন্যে। অবাকই লাগে ভাবতেঃ পঞ্চাশের দশকের সেরা একজন কথাশিল্পী শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বারবার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছেন তাঁর প্রিয় ঔপন্যাসিক। কিন্তু তার কুবেরের বিষয়-আশয় মানিকের পুতুলনাচের ইতিকথার পরবর্তী পদক্ষেপ।

মানিকের পূর্বধারা আছে বঙ্কিমচন্দ্রে-রবীন্দ্রনাথে-শরৎচন্দ্রে, আর উত্তরধারা প্রবাহিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী-রমেশচন্দ্র সেনের মধ্য দিয়ে।

তোমাকে লেখা এই চিঠিতে সবশেষে আসি মানিকের অন্তশ্চারিত্রের আরেকটু বিশ্লেষণে। মানিক জানিয়েছেন, ‘যে বলবে ঐতিহ্য বলে কিছু নেই-তাকে আমি অসভ্য অমানুষ বলব, তাকে আমি ধিক্কার দেবো।’ আবার একই সঙ্গে বলছেন, ‘ঐতিহ্য সম্পর্কে অন্ধ অনুরাগ বিপজ্জনক।’ এই চিঠির উপরে বিষ্ণু দের লেখাটি লক্ষ্য করো। বিষ্ণু দে বলছেন, ‘ছোটলোকেরা তখন সাহিত্যে ঢুকে পড়েছে আর তাদের বার করে কে?’ কল্লোল যুগের লেখকদের কথা বলেছেন এখানে বিষ্ণু দে। মানিক নিজেই কল্লোল যুগ সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রকাশ করেছেন, তাঁর নিজের সমগ্র সাহিত্যকর্মে ছোটলোকদেরই বিস্তার; আবার, তাঁর নিজের সৃষ্টিতে কল্লোলের সীমাবদ্ধতাও তিনি নির্দেশ করেছেন। মানিককে খুঁজতে হবে তাঁর এই নির্দেশিত পথে, যেখানে ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুনের বিবাহ নিষ্পন্ন হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর বিষ্ণু দে দুজনার মধ্যে যত দ্বন্দ্বই হোক-মানিকের জন্যেই অবশ্য, বিষ্ণু দে মানিক সম্পর্কে কোনো কটূক্তি করেননি-মানিক আর বিষ্ণু দে একই দুর্ভাগ্যের অংশীদার। কমিউনিস্ট মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও বাম-ঘেঁষা বিষ্ণু দেকে তাঁদের গোষ্ঠী যেমন বুঝতে পারেননি, তে্নি অন্যরাও তাঁদের গ্রহণ করেননি। দুজনার মহত্ত্বের পরিমাপের জনেই অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।

তোমরা কি দেখে যেতে পারবে? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই এই প্রশ্ন তুলে, চিঠি শেষ করে, একটু সবুজ রঙ খুঁজছি। এখন, নিসর্গের কাছে শুশ্রূষা চাই। পাখি-পতঙ্গের কাছে। তোমরা খোঁজো মানুষের মধ্যে। তোমার
শিল্পী

৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৫

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।

Category: প্রবন্ধ
Previous Post:প্রলয়-সুন্দর – নজরুলঃ জন্মদিনের শ্রদ্ধা
Next Post:মিষ্টি দইয়ের পানীয়

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑