1 of 2

৪.০৭ – সপ্তম পরিচ্ছেদ – দোষক্ষালনের জন্য কি?

মনিরুদ্দীন দেবেন্দ্রবিজয়কে বসিতে বলিয়া বলিলেন, “আপনার নাম দেবেন্দ্রবিজয় বাবু-একজন খুব খ্যাতনামা ডিটেক্টিভ, তাহা আমি শুনিয়াছি। মহাশয়ের সহিত পরিচয় হওয়ায় আমি খুব সুখী হইলাম। বোধ করি, মেহেদী-বাগানের খুনের তদন্তেই আপনি আমার কাছে আসিয়া থাকিবেন।”
দেবেন্দ্রবিজয় মনিরুদ্দীনকে একবারে কাজের কথা পাড়িতে দেখিয়া অত্যন্ত বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “হাঁ, আপনার অনুমান ঠিক-আমি দুই-একটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই; সন্তোষজনক উত্তর পাইলে সুখী হইব।”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “বটে, ফরিদপুরে আমার বাগানে গিয়া যাহার সহিত দেখা করিয়াছিলেন, তাহার নিকটে আপনি ত সকলই শুনিয়াছেন।”
দেবেন্দ্রবিজয় আরও বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “আপনি তাহা কিরূপে জানিতে পারিলেন?”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “আমি কাল রাত্রেই সেখানকার একখানা বড় রকম টেলিগ্রাম পাইয়াছি। আমার বাগানে যাহার সঙ্গে আপনাদের দেখা হইয়াছিল, সে সৃজান নয়-দিলজান, তাহা আপনি এখন বেশ বুঝিতে পারিয়াছেন?”
দে। হাঁ, আমার ভুল হইয়াছিল।
মনি। আপনার ন্যায় খ্যাতনামা লব্ধপ্রতিষ্ঠ ডিটেক্টিভের এমন ভুল হওয়া ঠিক নহে।
দে। উপন্যাসের ডিটেক্টিভের ভুল না হইতে পারে; আমরা সে রকমের ডিটেক্টিভ নহি-সামান্য মনুষ্যমাত্র; আমাদের পদে পদে ভ্রম হওয়াই সম্ভব।
মনি। যাক্, সে কথায় আর দরকার নাই। দিলজানই যে সেদিন রাত্রিতে সৃজানের সহিত দেখা করিতে তাহাদের বাড়ীতে গিয়াছিল, আপনি ফরিদপুরে গিয়া তাহার নিজের মুখে সে কথা শুনিয়াছেন, বোধ হয়।
দে। শুনিয়াছি।
মনি। সৃজান যে এখানে আমার বাড়ীতে আসিয়াছিল, তাহাও বোধ হয়, দিলজান আপনাকে বলিয়াছে।
দে। বলিয়াছে।
মনি। তবে আপনি সকলই ত শুনিয়াছেন, এ ছাড়া আমার নিকটে আর নূতন কথা কি পাইবেন?
দে। আপনার কাছে আপনার সম্বন্ধে, দুই-একটী কথা জানিবার জন্য আসিয়াছি।
মনি। কি, বলুন?
দে। সেদিন রাত্রে আপনি রাত এগারটার পর কোথায় গিয়াছিলেন-কি করিয়াছিলেন-কোথায় কাহার সহিত আপনার দেখা হইয়াছিল, আশা করি, আপনার কাছে তাহার সন্তোষজনক উত্তর পাইব।
মনি। ওঃ! এতক্ষণে আপনার মনের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলাম; তাহা হইলে আপনি এখন আমাকেই সৃজানের হত্যাকারী স্থির করিয়াছেন দেখিতেছি; মন্দ নয়!
দেবেন্দ্রবিজয় কোন কথা কহিলেন না। একটু অপ্রতিভভাবে অন্যদিকে মুখ ফিরাইলেন।
মনিরুদ্দীন বলিতে লাগিলেন, “মহাশয়, এ আপনার কিরূপ পরিহাস, বুঝিতে পারিলাম না। পরিহাস-প্রসঙ্গেও এ কথা বলা আপনার যুক্তি-সঙ্গত হয় নাই। আমার স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে বোধ হয়, আপনি সবিশেষ অবগত নহেন; তাহা হইলে কখনই আপনি আমার উপরে এমন একটা ভয়ানক সন্দেহ করিতে পারিতেন না। মদ্যপ, বেশ্যাসক্ত হইলেও আমি এমন পিশাচ নহি-একজন স্ত্রীলোককে খুন করিতে যাইব। আপনি যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন, মজিদ খাঁ ধৃত না হইলে আপনি কিছুতেই আমার কাছে তাহার একটিরও উত্তর পাইতেন না। কিন্তু এখন দেখিতেছি, মজিদ খাঁর জন্য বাধ্য হইয়া আমাকে আপনার এই সকল প্রশ্নের উত্তর করিতে হইবে। বেশ ভাল হইয়া বসুন, বলিতেছি।” গনির মাকে বলিলেন, “তুনি এখন যাইতে পর-তোমার এখানে থাকিবার অরার কোন প্রয়োজন নাই।”
গনির মা যেমন উঠিয়া যাইবে, দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে বলিলেন, “আমার একটু প্রয়োজন আছে। তুমি না আমায় বলিয়ছিলে, সেদিন রাত এগারটর পর মজিদ খাঁর সহিত যে স্ত্রীলোকের দেখা হইয়াছিল, সে দিলজান?”
গনির মা বলিলেন, “হাঁ, দিলজানই ত – সে নিশ্চয়ই দিলজান আর কেহ নহে?”
গনির মা বলিল,”কি মুস্কিল্! আমি যে নিজের চোখে তাকে দেখেছি। আমি কি তাকে চিনি না? সেই মুখ – সেই চোখ, তা ছাড়া সন্ধ্যার আগে, সে যেমন সেজে-গুজে এসেছিল-রাতেও ঠিক সেই কাপড়-চোপড় পরেই এসেছিল।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “মিথ্যাকথা-ঠিক চিন্তে পার নাই।”
বৃদ্ধা গনির মার ক্রোধ মস্তকে উঠিল। সে হাত মুখ নাড়িয়া বলিল, “আমি বুড়োমাগী, আমার মিথ্যাকথা-তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে-আমি মিছে কথা বল্তে গেছি! কি আমার পীর-পয়গম্বর এসেছে রে” বলিতে বলিতে ক্রোধভরে ঘরের বাহির হইয়া গেল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দিলজান ও সৃজান যমজ ভগিনী-উভয়েই একই রকম দেখিতে-তাহাতে উপরে আবার একই রকমের পোষাক-তাহাতে বৃদ্ধা গনির মার যে এরূপ ভুল হইবে, তাহার আশ্চর্য্য কি?”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “ভুল হওয়াই খুব সম্ভব। যাহা হউক, আপনি এখন আমাকে কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনারই কথা।”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “দেখুন, আমি সামান্য মনুষ্য মাত্র- প্রলোভনের দাস-প্রবৃত্তির দাস-কি জানি, কি মোহবশে সৃজানকে দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইয়াছিলাম। তাহাকে লাভ করিবার জন্য আমার হৃদয় একটা অদম্য তৃষ্ণায় পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। আপনি আমাকে অসচ্চরিত্র পরস্ত্রীলোলুপ বলিয়া ঘৃণা করিতে পারেন; কিন্তু আপনি স্থির জানিবেন, আমার কথা ছাড়িয়া দিই-অনেক সাধুপুরুষও এ প্রলোভনের হাত এড়াইতে পারে না। সেইদিন রাত্রিতে সত্যসত্যই আমি সৃজানকে লইয়া কলিকাতা ত্যাগ করিতে প্রস্তুত হইয়াছিলাম। রাত্রি এগারটার পর হইতে আমি বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগে একখানা গাড়ী লইয়া সৃজানের অপেক্ষা করিতেছিলাম। নিজের গাড়ী নহে-একখানা ভাড়াটিয়া গাড়ী ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলাম। আপনি সে প্রমাণ সেই গাড়ীর কোচম্যানের নিকটে অনায়াসে পাইবেন। তাহার নাম করিম; এই জানবাজারেই সে থাকে। রাত যখন প্রায় বারটা, তখন আমি গাড়ী ছাড়িয়া একবার চলিয়া আসি; তাড়াতাড়িতে ঘড়ীটা সঙ্গে লইতে ভুল করিয়াছিলাম। পুনরায় বাড়ীর ভিতরে গিয়া ঘড়ীটা লইয়া আসিতে হইবে, মনে করিয়া আমি গাড়ী হইতে উঠিয়া আসিলাম। বাড়ীর সম্মুখভাগে আসিতেই দেখিলাম, একটী স্ত্রীলোক দ্রুতবেগে উন্মাদিনীর মত আমার বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গেল। সেদিন ভয়ানক অন্ধকারময় রাত্রি-তাহার উপর কুয়াশায় চারিদিক্ ঢাকিয়া ফেলিয়াছিল। বাহিরে অন্ধকারের মধ্যে সে কোথায় মিশিয়া গেল, আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। বহির্দ্বারের ভিতরে একটা লণ্ঠন জ্বলিতেছিল; তাহারই আলোকে আমি কেবল একবার নিমেষমাত্র তাহার মুখ দেখিতে পাইয়াছিলাম; তাহাতেই তাহাকে আমি তখন দিলজান মনে করিয়াছিলাম। সাজসজ্জাও ঠিক দিলজানের অনুরূপ। আমি দেখিয়াই আর অগ্রসর হই নাই; সেখানেই স্তম্ভিত ভাবে দাঁড়াইয়া রহিলাম। এমন সময়ে আর একজন কে আমার পাশ দিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল। সেই স্ত্রীলোকটি যেদিকে গিয়াছিল, সেই লোকটিকেও সেইদিকে যাইতে দেখিলাম। মনে বড় সন্দেহ হইল-কে এ লোক? কেনই বা দিলজানের অনুসরণ করিতেছে? অবশ্যই ইহার ভিতরে কিছু রহস্য আছে সেটুকু দেখা দরকার। তাহারা দুইজনে যেদিকে গিয়াছিল, আমিও দ্রুতপদে সেইদিকে তখন ছুটিয়া গেলাম। নিকটবর্ত্তী সকল স্থানেই তাহাদের অনুসরণ করিতে লাগিলাম। যে অন্ধকার, নিজেকেই নিজে দেখিতে পাওয়া যায় না। অনেক চেষ্টা করিলাম, দুইজনের কাহাকেও আর দেখিতে পাইলাম না। পরিশ্রান্ত হইয়া প্রায় একঘণ্টা পরে আবার সেই গাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম। সৃজানের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। রাত্রি দুইটার পর দিলজান আমার গাড়ীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। আমি সৃজান মনে করিয়া তাহাকে ভিতরে তুলিয়া লইলাম। এদিকে গাড়ী শিয়ালদহ ষ্টেশনের দিকে চলিল। সেখানে ট্রেণে উঠিয়া আমার ভ্রম আমি বুঝিতে পারিলাম।”
দেবেন্দ্রবিজয় অত্যন্ত আগ্রহের সহিত মনিরুদ্দীনের কথা শুনিয়া যাইতেছিলেন। মনিরুদ্দীন নীরব হইলে, তিনি সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “যে লোকটিকে আপনি সেই রমণীর অনুসরণ করিতে দেখিয়াছিলেন, কে সে লোক?”
ম। কিরূপে জানিব?
দে। সে কি আপনার পরিচিতের মধ্যে কেহ নহে?
ম। পরিচিত হইলেও–তেমন অন্ধকারে তাহাকে কিরূপে চিনিতে পারিব?
দে। যদিও ঠিক না চিনিতে পারেন-তাহার আকার-প্রকারে ভাবে অমুক লোক বলিয়া আপনার মনে কোন রকম একটা ধারণা হয় নাই কি? হওয়াই খুব সম্ভব।
ম। (চিন্তিতভাবে) সে ধারণা হয় নাই কি? হওয়াই খুব সম্ভব।
দে। (ব্যগ্রভাবে) কি নাম?
ম। মুন্সী সাহেব।
দে। (চকিতে) কে, জোহিরুদ্দীন?
ম। হাঁ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *