1 of 2

১.১২. দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – ছুরি – বিষাক্ত

সভয়ে মোবারক কহিলেন, “ছুরি কোথায় পাইলেন? এই ছুরিতেই খুন –”
বাধা দিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” না, এই ছুরিতেই খুন হয় নাই। ইহার জোড়া ছুরিতে খুন হইয়াছে। লতিমন বাইজীর কছে শুনিলাম, দিলজানের এইরূপ দুইখানি ছুরি ছিল। দিলজান, সৃজান বিবির কথা কিরূপে জানিতে পারে, বলিতে পারি না। সে মনিরুদ্দীনের উপরে রাগিয়া এমন অধীর হইয়া উঠে যে, যদি মনিরুদ্দীনকে বুঝাইয়া সে নিজের কাজ উদ্ধার করিতে না পারে, তবে ছুরিতে কাজ উদ্ধার করিবে স্থির করিয়া গত বুধবার রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যায়। মনিরুদ্দীন তখন বাড়িতে ছিলেন না। সেখানে মজিদ খাঁর সঙ্গে তাহার দেখা হয়; সম্ভব -এই সকল কথা লইয়া মজিদ খাঁর সঙ্গে বচসাও হয়। সেই সময়ে রাগের মুখে দিলজান রাগভারে মজিদ খাঁকে সেই ছুরি দেখাইয়া থাকিবে। এবং যে সঙ্কল্প করিয়া সে ছুরি লইয়া ফিরিতেছে, তাহাও বলিয়া থাকিবে। হয়ত মজিদ খাঁ তখন তাহাকে প্রবোধ দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন; কিন্তু দিলজান সেখানে হইতে বাহির হইয়া আসে। রাগের বশে দিলজান হ্ঠাত্‍‌ কি একটা অনর্থ ঘটাইবে মনে করিয়া, মজিদ খাঁ সেই ছুরিখানি তাহার হাত হইতে কাড়িয়া লইবার চেষ্টায় তাহার অনুসরণ করিয়া থাকিবেন; তাহার পর হয় ত মেহেদী-বাগানে আবার উভয়ের দেখা হইয়াছে। মজিদ খাঁ সেই সময়ে দিলজানের সহিত ছুরিখানি লইয়া কাড়াকাড়ি করিয়াছেন; এবং অসাবধানবশতঃ ছুরিখানি হঠাত্‍‌ দিলজানের গলায় বিদ্ধ হওয়ায় দিলজানের মৃত্যু হইয়াছে। পাছে খুনী বলিয়া অভিযুক্ত হইতে হয়, এই ভয়ে মজিদ খাঁও সে সম্বন্ধে আর কোন উচ্চবাচ্য না করিয়া চুপ করিয়া গিয়াছেন।”
মোবারক বলিলেন, ” অনেকটা সম্ভব বটে; কিন্তু ইহা কতদূর সত্য, আমি বলিতে পারি না। মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে দিলজানের সহিত মজিদ খাঁর কি কথাবার্ত্তা হইয়াছিল, তাঁহার সঙ্গে দেখা করিয়া আপনি এখন তাহা তদন্ত করিয়া দেখুন। ইহা ভিন্ন সত্য আবিষ্কারের আর কোন উপায় দেখি না। এই ছুরি লইয়া আপনি এখন কি করিবেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “ছুরিখানি বিষাক্ত কি না , তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে। যদি এই ছুরিখানি বিষাক্ত হয়, তাহা হইলে ইহার জোড়া ছুরিখানি বিষাক্ত নিশ্চয়। এই খুনটা কোন বিষাক্ত ছুরিতেই হইয়াছে।”
হস্ত প্রসারণ করিয়া মোবারক কহিলেন, ” একবার আমি ছুরিখানি দেখিতে পারি কি?”
“অনায়াসে,” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় ছুরিখানি মোবারকের হাতে দিতে উঠিলেন। মোবারক একটু তফাতে বিছনার উপরে বসিয়া ছিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় যেমন তাঁহার দিকে এক পা অগ্রসর হইয়াছেন, সম্মুখে কুকুরটা শুইয়াছিল-একেবারে তাহার ঘাড়ের উপরে পা তুলিয়া দিয়াছেন। কুকুরটা রাগিয়া চীত্‍‌কার করিয়া তত্‍‌ক্ষণাত্‍‌ দেবেন্দ্রবিজয়ের পায়ে কামড়াইয়া দিল। দেবেন্দ্রবিজয় যেমন চমকিত ভাবে সরিয়া যাইবেন, হাত হইতে ছুরিখানি কুকুরটার উপরে পড়িয়া গেল।
মোবারক উঠিয়া তাড়াতাড়ি কুকুরটাকে সরাইয়া লইলেন। একটা চপেটাঘাতের সহিত ধমকও দিলেন। তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ” কি মহাশয়, আপনাকে কামড়াইয়াছে না কি? দেখি দেখি-”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “না-দাঁত ফুটাইতে পারে নাই, কাপড়খানা একটু ছিঁড়িয়া গিয়াছে মাত্র।”
কুকুরটা তখন মাটিতে পড়িয়া ছটা্‌ফট করিতেছে; অথচ চীত্‍‌কার করিতেও পারিতেছে না। কুকুরটাকে তদবস্থ দেখিয়া মোবারকের বড় ভয় হইল; দেখিলেন, কুকুরের গলার কাছে অল্প রক্তের দাগ; রক্ত মুছিয়া দেখিলেন, সামান্য ক্ষতচিহ্ণ। একান্ত রুষ্টভাবে বলিলেন, “নিশ্চয়ই আপনার ছুরি বিষাক্ত-কুকুরটা এমন করিতেছে কেন? কি সর্ব্বনাশ কুকুরটাকে মারিয়া ফেলিলেন-কি রকম ভদ্রলোক আপনি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনাকে যদি কাহারও কুকুর এরূপভাবে আক্রমণ করিত, সম্ভব, আপনিও এইরূপ ভদ্রতার পরিচয় দিতেন। যাহা হউক, আপনার এরূপ ক্ষতি করিয়া আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইলাম।”
মোবারক বিরক্তভাবে বলিলেন, “যথেষ্ট হইয়াছে, আর আপনার দুঃখিত হইয়া কাজ নাই; কুকুরটাকে একেবারে মারিয়া ফেলিলেন !”
কুকুরটা ক্রমশঃ অবসন্ন হইয়া আসিতে লাগিল। দেবেন্দ্রবিজয় বিশেষ মনোযোগের সহিত সেইদিকে চাহিয়া রহিলেন। মোবারক কুকুরটাকে ধরিয়া উঠাইবার চেষ্টা করিলেন। অবসন্নভাবে কুকুরটা আবার গৃহতলে লুটাইয়া পড়িল। মোবারক পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া বারংবার ক্ষতস্থান মুছাইয়া দিতে লাগিলেন। তখন আর উপায় নাই, জীবন প্রায় শেষ হইয়া আসিতেছে। কুকুরটা দুই-একবার বিকৃত মুখব্যাদনসহকারে জৃম্ভণ ত্যাগ করিল; তাহার পর কয়েকবার অন্তিম বলে উঠিয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা করিয়া পড়িয়া গেল। দুই-একবার এইরূপ করিয়া আর উঠিল না-ধীরে ধীরে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল।
একান্ত উত্তেজিতভাবে মোবারক বলিলেন, ” আপনি করলেন কি-কুকুরটাকে সত্যসত্যই মারিয়া ফেলিলেন ! আপনার মত বে-আক্কেলে লোক দুনিয়াই নাই !”
দেবেন্দ্রবিজয় ছুরিখানা কাগজে ভাল করিয়া জড়াইতে জড়াইতে বলিলেন, “অপনি আমার উপরে অন্যায় রাগ করিতেছেন; দৈবাত্‍‌ –”
বাধা দিয়া ক্রোধভরে মোবারক বলিলেন, ” আর আপনার কথায় কাজ নাই-আপনি নিজের পথ দেখুন। আপনার ছুরি ভনায়ক বিষাক্ত।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, নতুবা একটু আঘাতেই আপনার কুকুরটা মরিবে কেন? এ ছুরিখানি বিষাক্ত হওয়ায় আমি এখন বেশ বুঝিতে পারিতেছি, দিলজান যে ছুরিতে খুন হইয়াছে, তাহাও বিষাক্ত। একজোড়া ছুরির একখানিতে দিলজানের অদৃষ্টলিপি গ্রথিত ছিল, অপরখানিতে আপনার কুকুরটা মারা পড়িল।”
মোবারক পূর্ব্ববত্‍‌ ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, “বেশ, এখন আপনার পথ দেখুন-আমি আপনাকে মানে মানে বিদায় দিতেছি-ইহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট।”
দেবেন্দ্রবিজয় রাগ প্রকাশ করিলেন না। মোবারকের কথা তিনি কানে না করিয়া, আপন মনে ছুরিখানি ভাল করিয়া কাগজে জড়াইয়া, সাবধানে পকেটের মধ্যে রাখিয়া দিয়া তথা হইতে বহির্গত হইলেন। ছুরিখানি বিষাক্ত হওয়ায় তিনি মনে মনে অনেকটা পরিমাণে আনন্দানুভব করিলেন। রাস্তায় আসিয়া আপন মনে বলিলেন, “এইবার একবার মজিদ খাঁর সহিত দেখা করিতে পারিলে, এই নিবিড় খুন-রহস্যাটা অনেকটা তরল হইয়া আসিবে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *