প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

১.৩৮ ভবতোষ চলে গেছেন

বেশ কিছুক্ষণ হল, ভবতোষ চলে গেছেন। তারপরও স্নেহলতারা উঠলেন না, পুবের ঘরেই বসে থাকলেন। তাদের মধ্যে ভবতোষের কথাই হতে লাগল।

ভবতোষের সংসারের কথা ভেবে সবাই দুঃখিত, বিষণ্ণ, ব্যথিত। তিনটে তো মোটে মানুষ ভবতোষ, তার স্ত্রী এবং ঝিনুক। তিনজনে আজ তিন জায়গায়। একজন ঢাকায়, আর দু’জন রাজদিয়ার দুই প্রান্তে। সংসারটা তিন টুকরো হয়ে তিন দিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ কোনও অভাব ছিল না, সুখের সব উপকরণ ছিল হাতের কাছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সামান্য বনিবনা থাকলে ওরা কত সুখীই না হতে পারত।

দেখতে দেখতে হেমন্তের রাত গাঢ় হয়ে উঠল। ক’দিন আগে ছিল অমাবস্যা। আকাশের প্রান্তে যে এক ফালি ক্ষীণায়ু চাঁদ উঠেছে, জল-বাংলার এই অংশটিকে তা আলোকিত করে তুলতে পারে নি। তার ওপর আছে গুড়ো গুড়ো হিমের রেণু। ফলে গাছপালা, আকাশ, দূরের ধানখেত-সমস্ত কিছুই ঝাঁপসা, অস্পষ্ট, কুহেলিবিহীন। বিচিত্র মায়াবরণের মতো এই রাত রাজদিয়াকে ঢেকে রেখেছে।

ভবতোষ যাবার পর কতক্ষণ কেটেছে, কে জানে। হঠাৎ বাইরের উঠোনে হেমনাথের গলা পাওয়া গেল, কোথায় রে বিনুদাদা, ঝিনুকদিদি–

কমলাঘাটের গঞ্জ থেকে রাতদুপুরে ফেরার কথা ছিল হেমনাথের। দেখা গেল, অনেক আগেই ফিরে এসেছেন। স্নেহলতারা হেরিকেন নিয়ে ব্যস্তভাবে বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে এলেন।

হেমনাথ একাই আসেন নি, যুগলকেও তার পেছনে দেখা গল। সকালবেলা তাকে সঙ্গে নিয়ে কমলাঘাট গিয়েছিলেন হেমনাথ।

কেউ কিছু বলবার আগেই লাফ দিয়ে বারান্দা থেকে উঠোনে নামল ঝিনুক। ছুটতে ছুটতে কাছে এসে হেমনাথকে জড়িয়ে ধরল, দাদু দাদু, একটা কথা শুনেছ?

দুহাত দিয়ে সস্নেহে ঝিনুককে কোলে তুলে নিলেন হেমনাথ, কী কথা রে দিদিভাই?

ঝিনুক হেসে হেসে রহস্যের গলায় বলল, কী কথা তুমিই বল না?

আমি কেমন করে বলব? আমি কি অন্তর্যামী? তবে ঝিনুকদিদি যখন এত খুশি তখন নিশ্চয়ই কথাটা খুব ভাল–

হুঁ। ঝিনুক বলতে লাগল, তোমাকে বলতে হবে, কী কথা–

বলতেই হবে?

হ্যাঁ।

মুখখানা গম্ভীর করে চোখ কুঁচকে কত না ভাবনার ভান করলেন হেমনাথ। তারপর বললেন, এইবার বুঝতে পেরেছি–

সাগ্রহে ঝিনুক জিজ্ঞেস করে, কী?

তোর দিদা আরেক বার নিকের ব্যবস্থা করেছে। তাই না রে? বলে আড়ে আড়ে স্ত্রীর দিকে তাকলেন হেমনাথ।

লক্ষ্যভেদ ঠিকমতোই হয়েছিল। স্নেহলতা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলেন, আহা হা, বুড়ো বয়সে রস একেবারে উথলে উঠেছে। মুখে কিছু আর আটাকায় না।

হেমনাথ রগড়ের গলায় বললেন, তোমার দিকে তাকালে রস না উথলে যে পারে না সখী। চেহারাখানা এই বয়সেও যা ডাঁটো রেখেছ।

স্নেহলতা ধমকে উঠলেন, থাম, আর ফাজলামো করতে হবে না।

হেমনাথ হাসতে লাগলেন। তিনি কি একাই, অবনীমোহন-সুরমা-শিবানী সুধা-সুনীতি সবাই ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল।

হেমনাথের রসিকতা বুঝবার মতো বয়স নয় ঝিনুকের। সে বলে উঠল, পারলে না দাদু বলতে, পারলে না–

ঝিনুকের দিকে ফিরে হেমনাথ বললেন, পারলাম না, না? দিদুর নিকের কথাটা তা হলে ঠিক নয়?

না।

তবে কি– আগের মতো ভাবনার অভিনয় করে হঠাৎ সকৌতুকে হেমনাথ বলে উঠলেন, সুধা সুনীতি আমাকে তালাক দিয়ে আর কারোর সঙ্গে ঝুলে পড়তে চাইছে? এবার ঠিক হয়েছে, না রে ঝিনুকদিদি? কথাটা শেষ হল কি হল না, তার আগেই সুধা সুনীতি চেঁচামেচি জুড়ে দিল, খুব খারাপ হয়ে যাবে দাদু, খুব খারাপ হয়ে যাবে–

যে কারণেই হোক মনটা খুব ভাল ছিল, এর তার পেছনে লেগে মজা করতে লাগলেন হেমনাথ।

এদিকে ঝিনুক অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। সে বলতে লাগল, তোমার একটা কথাও ঠিক হচ্ছে না।

মুখখানা করুণ করুণ করে হেমনাথ বললেন, একটাও হচ্ছে না?

না। ঝিনুক জোর জোর মাথা নাড়ল, তুমি তো পারলে না, আমিই বলে দিচ্ছি- মনের কথাটা না বলা পর্যন্ত স্বস্তি হচ্ছিল না ঝিনুকের।

সব শুনব, তার আগে ঘরে চল—

ঝিনুককে কোলে নিয়েই ঘরে এলেন হেমনাথ। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে স্নেহলতারাও ভেতরে ঢুকলেন। যুগল বারান্দায় উঠে খুঁটিতে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

কোল থেকে ঝিনুককে নামিয়ে হেমনাথ বললেন, কী বলবি বল—

ঝিনুক এক নিশ্বাসে বলে গেল, জানো দাদু, জানো–বিনুদাদারা আর কলকাতায় যাবে না, আমাদের এখানেই থাকবে। আনন্দে, উত্তেজনায় তার চোখ মুখ ঝকমক করতে লাগল।

তাই নাকি?

হুঁ। তুমি ওদের জিজ্ঞেস করে দেখ না–

এই সময় অবনীমোহন বলে উঠলেন, ঝিনুক ঠিকই বলেছে মামাবাবু। আমরা আর কলকাতায় ফিরছি না।

এই কথাটা আগেও আরও দু’একবার বলেছিলেন অবনীমোহন। এই দেশ, পূর্ব বাংলার এই শ্যামল সজল ভূখন্ড তার ভাল লেগেছে। এখান থেকে তিনি আর যাবেন না, স্থায়ীভাবে রাজদিয়াতেই তার থাকার ইচ্ছে–মাঝে মাঝে এরকম ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু সে সব নেহাতই কথাচ্ছলে বলা। হেমনাথ তেমন গুরুত্ব দেন নি। কিন্তু অবনীমোহন যে সুরে আজ বললেন সেটা খুব হালকা নয়। স্থির চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেমনাথ বললেন, তুমি কি এ ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেছ?

অবনীমোহন মাথা নাড়লেন, আজ্ঞে হ্যাঁ মামাবাবু।

তোমরা এখানে থাকবে, সে তো খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু–

কী?

একটু চুপ করে রইলেন হেমনাথ। তারপর বললেন, কিছু মনে করো না, একটা কথা জিজ্ঞেস করি–

অবনীমোহন উগ্রীব হলেন।

হঠাৎ ইস্টবেঙ্গলে থাকা ঠিক করলে কেন?

অবনীমোহন যা উত্তর দিলেন সংক্ষেপে এই রকম। তিনি পশ্চিম বাংলার মানুষ, আদি সাকিন বীরভূম জেলায় অর্থাৎ রাঢ়ে। তবে চাকরি বাকরি এবং ব্যবসা ট্যবসার খাতিরে তিন পুরুষ কলকাতাতেই আছেন, দেশের সঙ্গে যোগসূত্র একরকম নেই বললেই হয়। ন’মাসে ছ’মাসে এক আধবার যাওয়া হয় কিনা সন্দেহ। যত ক্ষীণই হোক, রাঢ়বঙ্গের সঙ্গে তবু কিছু সম্পর্ক আছে।

অবনীমোহন পূর্ব বাংলার মেয়ে বিয়ে করেছেন, কিন্তু ওই পর্যন্তই। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে তাকে পদ্মা-মেঘনা পাড়ি দিতে হয় নি। কেননা সুরমার বাবা চিরকাল কলকাতাতেই কাটিয়েছেন, অবনীমোহনের বিয়েও হয়েছিল কলকাতায়।

বিয়ের পর অনেক বার, প্রায় প্রতি বছরই হেমনাথ তাদের পূর্ব বাংলা দেখে যেতে লিখেছেন। আসি আসি করেও জীবনের অর্ধ শতাব্দী কেটে গেছে। এতকাল পর এখানে এসে মুগ্ধ হয়ে গেছেন অবনীমোহন–মুগ্ধ, বিস্মিত, চমৎকৃত। বাংলাদেশের এমন একটা স্নিগ্ধ মনোরম রূপ যে থাকতে পারে কোনও দিন তিনি তা কল্পনাও করেন নি।

রাঢ়ে যে বাংলাদেশ রূঢ় কর্কশ কঠিন, সেই বাংলাই এখানে সুজলা সুফলা, ঐশ্বর্যময়ী। শস্যে-স্বর্ণে আর অনন্ত সম্ভাবনায় তার ভান্ডার এখানে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। কড়ি আর কোমলে মেশা বাংলার কত না রূপ! তার বহুরূপিণী মৃত্তিকার অর্ধেকেরও বেশি পড়েছে এই পূর্ব বাংলায়।

অবনীমোহনের দুর্ভাগ্য, এতকাল তিনি এখানে আসেন নি। যখন এসেই পড়েছেন তখন জল বাংলাকে তার আপন মহিমায় চিনতে চেষ্টা করবেন। ছেলেমেয়েরা যাতে গোটা দেশেকে চিনতে পারে সে জন্য কিছুকাল তাদের এখানে থাকা দরকার। পূর্ব-বাংলাকে না চিনলে অখণ্ড বাংলাদেশকে চেনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

॥ প্রথম পর্ব সমাপ্ত ॥

2 Comments
Collapse Comments

পরের পর্বের কাজ কবে শুরু করবে?

Bangla Library (Administrator) April 8, 2020 at 5:43 pm

হ্যাঁ, শুরু হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *