প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

১.২৬ প্রথম ঘটনাটির কথা

আগে প্রথম ঘটনাটির কথা।

সেদিন অধর সাহা যা বলেছিল শেষ পর্যন্ত তাই করে ছাড়ল। মহালয়ার দিনকয়েক আগে স্বয়ং সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের শ্রাদ্ধ চুকিয়ে ফেলল। যেমন তেমন করে নয়, রীতিমত ধুমধাম করে দানসাগর শ্রাদ্ধ। এই কাজটা আর ভরসা করে ছেলেদের জন্য ফেলে রাখল না সে।

রাজদিয়ার হেন মানুষ নেই যাকে নেমন্তন্ন করে নি অধর সাহা। শুধু রাজদিয়া কেন, আশেপাশের আট দশটা গ্রামগঞ্জের তাবৎ বাসিন্দাকে নেমন্তন্ন করে এসেছিল সে।

একজন জীবন্ত মানুষ তিন তিনটে ছেলে বেঁচে থাকতে এই মর্তলোকেই নিজের পারলৌকিক কাজ সেরে যাচ্ছে, এমন বিস্ময়কর ঘটনা রাজদিয়াতে আর কখনও ঘটে নি। নিমস্ত্রিত অনিমন্ত্রিত, চেনা-অচেনা, এই শ্রাদ্ধের খবর যার কানে গেছে সে-ই অধর সাহার বাড়ি ছুটেছে।

বিনুরাও হেমনাথের সঙ্গে গিয়ে শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন খেয়ে এসেছিল।

.

দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও মজার।

মহালয়ার ঠিক আগের দিন দুপুরবেলা রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল বিনু। স্নেহলতা এবং শিবানী ছিলেন ভেতরে। রান্না প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, বাকিটুকু দু’জনে ক্ষিপ্র হাতে সেরে ফেলছিলেন।

বিনু জানতে এসেছিল, কখন খেতে দেওয়া হবে। এর আগে ঘন্টা দুয়েকের মতো পুকুরে পড়ে ছিল, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চারদিক উথলপাথল করে তুলেছে। চোখদুটো এখন টকটকে লাল। এত পরিশ্রমের পর খিদে পেয়ে গিয়েছিল খুব।

বিনু কিছু বলবার আগেই বাগানের দিক থেকে উধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে যুগল এসে হাজির। ভেতর-বাড়ির উঠোনে এসে চাপা, উত্তেজিত গলায় সে ডাকতে লাগল, ঠাউরমা-ঠাউরমা–

বিনু চমকে ঘুরে দাঁড়াল। শিবানী এবং স্নেহলতাও বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন।

যুগলের পরনে একটা নেংটি মতে, এ ছাড়া আর কিছুই নেই। সারা গায়ে পচা ভিজে পাটের ফেঁসে লেগে আছে, দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। প্রথম দিন রাজদিয়ায় এসে বিনু দেখেছিল, পচা পাটের আঁশ ছাড়াচ্ছে যুগল। এখনও তা শেষ হয় নি।

চোখের পলকে কাছে এসে পড়ল যুগল। আগের সুরেই বলল, সব্বনাশ হইয়া গ্যাছে ঠাউরমা, সব্বনাশ হইয়া গ্যাছে–

স্নেহলতা উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, কী হয়েছে?

অরা আইসা গেছে। অখন আমি কী করি?

স্নেহলতা শুধোলেন, কারা এসেছে রে?

যুগল মুখ নামিয়ে ফিসফিস করল, টুনি বইনের জামাই আর—

আর কে?

গোপল দাস।

ভুরু কুঁচকে স্নেহলতা একটু ভেবে নিলেন। তারপর বললেন, কোন গোপাল দাস রে?

নতমুখেই যুগল বলল, উই যে ভাটির দ্যাশের। গেরামের নাম মোহনগুঞ্জ—

বুঝেছি– চোখের তারায় কৌতুক ঝিকমিকিয়ে উঠল স্নেহলতার, পাখির বাপ তো?

হ। আস্তে করে ঘাড় কাত করল যুগল।

বোঝা গেল, পাখির ব্যাপারটা জানেন স্নেহলতা। বললেন, গোপাল দাস বলছিস যে? শ্বশুরমশাই বলতে বুঝি লজ্জা লাগে?

যুগল পারলে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। সে বলল, অহনও তো হয় নাই।

কী হয় নি।

হউর।

ও–কণ্ঠস্বরে দীর্ঘ টান দিয়ে স্নেহলতা বলতে লাগলেন, পাখির সঙ্গে বিয়ে না হলে বুঝি শ্বশুর বলবি না?

হেই কী কওন যায়! বলতে বলতে হঠাৎ সেই কথাটা মনে পড়ে যেতে যুগলের মুখ অত্যন্ত করুণ আর বিপন্ন হয়ে উঠল, অখন আমি কী করি ঠাউরমা?

কেন, তোর আবার কী হল?

ওনাগো কাছে ক্যমনে গিয়া খাড়ামু?

ছোঁড়া তো লজ্জায় গেলি। পুরুষমানুষ না তুই! বলেই হাসতে শুরু করলেন স্নেহলতা। ডাকতে লাগলেন, ওগো, এদিকে একটু শুনে যাও–

হেমনাথ, অবনীমোহন উত্তরের ঘরে ছিলেন। সুধা সনীতিরা কোথায়, কে জানে। উত্তরের ঘর থেকে হেমনাথ সাড়া দিলেন, যাই–

যুগল চকিত হল, বড়কত্তায় আহে, আমি পলাই—

পালাবি কেন, দাঁড়া–

যুগল দাঁড়াল না, বাড়ির পেছন দিকে ছুট লাগাল। স্নেহলতা এবং শিবানী হাসতে লাগলেন।

বিনু খিদের কথা ভুলে গেছে। জলের মাঝমাধ্যিখানে দ্বীপের মতো টুনিদের বাড়িটা তার চোখের সামনে ভাসছিল। বার বার পাখির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। দরজার ফ্রেমে ছবির মতো পাখির দাঁড়িয়ে থাকা, স্বপ্নলোকের জলপরীর মতো আশ্বিনের টলটলে শান্ত জলে সাঁতার কেটে নৌকোয় আসা, যুগলের গান–এসব যেন দিনকয়েক আগের ব্যাপার নয়, এখন এই মুহূর্তে ঘটে চলেছে।

উত্তরের ঘর থেকে হেমনাথ এসে পড়লেন। বললেন, ডাকছ কেন?

শিবানী এবং স্নেহলতা সমানে হাসছিলেন। হাসিটা এমন প্রবল উচ্ছ্বসময় যে উত্তর দিতে পারলেন না।

চোখ কুঁচকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন হেমনাথ। তারপর বললেন, এত হাসাহাসি কেন?

এতক্ষণে নিজেকে অনেকখানি সামলে নিয়েছেন স্নেহলতা। খুব মজার গলায় বললেন, আমাদের যুগল তো মহা বিপদে পড়েছে।

কিসের বিপদ?

বিপদটা কী, স্নেহলতা বুঝিয়ে দিলেন।

সব শুনে হেমনাথ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, গোপাল দাস আর যুগলের বোনাই কোথায়?

তা তো জানি না। তাদের কোথায় যেন দেখে ছুটে এসেছিল যুগল। স্নেহলতা বললেন।

হেমনাথ বিরক্ত হলেন, লোক দুটো এল। তাদের বসানো হল কি হল না, সেদিকে হুঁশ নেই। তোমরা ঠাট্টা-তামাশা হাসাহাসি নিয়েই আছ। বলে আর দাঁড়ালেন না, বড় বড় পা ফেলে পুকুরঘাটের দিকে চলে গেলেন। খুব সম্ভব গোপাল দাসদের অভ্যর্থনা করে আনতে।

বিনু মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। সেও আর দাঁড়িয়ে থাকল না। খানিক আগে যুগল যেদিকে গেছে সেদিকে ছুট লাগাল।

যুগল গিয়েছিল বাড়ির পেছন দিকে। জায়গাটা চোখ-উদানে আর সোনালের জঙ্গলে ঝুপসি হয়ে আছে। ফাঁকে ফাঁকে পিঠক্ষীরা এবং লটকা ফলের গাছ। তাদের মাথায় গুচ্ছ গুচ্ছ বনজ ফুল ফুটে আছে। ঝাকে ঝাকে মৌমাছি আর ফড়িং ফুলের ওপর উড়ে বেড়াচ্ছে।

জঙ্গলের পর মস্ত খাল।

বাড়ির পেছন দিকে এসে এদিকে সেদিকে তাকাতেই বিনু দেখতে পেল, খালে নেমে সমানে ডুবের পর ডুব দিয়ে যাচ্ছে যুগল।

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ করে খালের পাড়ে এসে পড়ল বিনু। যুগলকে না ডেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।

এক নিশ্বাসে প্রায় শ’খানেক ডুব দিয়ে যুগল থামল। তারপর হঠাৎ কী মনে পড়ে যেতে তাড়াতাড়ি খাল থেকে উঠে এল। পাড়ে আসতেই সে অবাক, ছুটোবাবু যে, কখন আইছেন!

অনেকক্ষণ।

আমি ট্যারই পাই নাই।

বিনু হাসল, টের পাবে কী করে? যা ডুব দিচ্ছিলে!

হ। এক উয়াসে বিশ পঞ্চাশটা ডুব না দিলে ছান কইরা আরাম পাই না। যুগল হাসল। তারপর বলল, আপনে এটু খাড়ন ছুটোবাবু, আমি একখান বস্তু লইয়া আসি।

কী?

আনলেই দেখতে পাইবেন।

যুগল পলকে বাড়ির ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। একটু পর যখন সে ফিরে এল, তার হাতে একটা গন্ধসাবান।

সাবানটা দেখে ফেলেছিল বিনু। বলল, চান তো একবার করলে, আবার সাবান মাখবে?

যুগল বিনুর দিকে তাকাল। চোখাচোখি হতেই দ্রুত মুখ নামিয়ে সলজ্জ অস্ফুট গলায় বলল, ছান করার সোময় সাবানের কথা মনে আছিল না, মনে পড়তেই লইয়া আইলাম।

অন্য দিনও যুগলকে চান করতে দেখেছে বিনু। কিন্তু সে চানের সঙ্গে সাবান এবং তেলের সম্পর্ক নেই। কোনও রকমে গামছাটি কোমরে জড়িয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ঘণ্টা দেড় দুই খাল বিল তোলপাড় করে যখন ডাঙায় ওঠে তখন চোখ দুটো রক্তজবা। এই তো তার চানের নমুনা।

হঠাৎ কেন যে আজ গন্ধসাবান মাখার মতো এতখানি শৌখিন হয়ে উঠল যুগল, সেইটাই বোঝ যাচ্ছে না। বিনু সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল।

বিনুর মনোভাব বুঝতে পেরেছিল যুগল। তখনকার মতো লাজুক সুরে বলল, আইজের দিন গোন্ধসাবান মাখুম না তো কবে আর মাখুম! ছুটোবাবু বুঝমান মানুষ হইয়া বোঝেন না ক্যান? আইজ– বলতে বলতে চুপ করে গেল।

বিনু বলল, আজ কী?

আমার হউরে নি আইছে।

এতক্ষণে যুগলের শৌখিনতার কারণটা টের পাওয়া গেল। বিপুল উৎসাহে বিনু বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, আজই তো সাবান মাখার দিন।

অতএব আরও অনেকটা সময় লাগিয়ে গোটা সাবানের আধখানা গায়ে ঘষে ঘষে ক্ষইয়ে দিল যুগল। তারপর পঞ্চাশ-ষাটটা ডুব দিয়ে পাড়ে উঠল। ভাল করে গা-মাথা মুছে বলল, চলেন ছুটোবাবু, আমার ঘরে চলেন।

যুগল থাকে এ বাড়ির দক্ষিণ দিকের একটা ঘরে। দু’জনে সোজা সেখানে চলে এল।

এ ঘরে আরও অনেকবার এসেছে বিনু। যুগলের সম্পত্তি বলতে এখানে যা আছে তা হল একটা তক্তপোশ, গোলাপফুল-আঁকা একটা টিনের সুটকেস, একটা হাত-আয়না, কাঠের চিরুনি, খানকতক জামাকাপড়।

টিনের বাক্স থেকে সব চাইতে ফর্সা জামা আর ধুতি বার করল যুগল। বলল, এইগুলাই পরি ছুটোবাবু?

বিনু সায় দিলে বললে, পরো।

আরেক খান কথা–

কী?

চত্তির মাসে নীলপূজার মেলায় এক শিশরি গোন্ধত্যাল কিনছিলাম। আইজ ইট্টু মাখুম। আপনে কী ক’ন?

নিশ্চয়ই মাখবে।

টিনের বাক্সের কোণ থেকে সন্তর্পণে একটা ফুলেল তেলের শিশি বার করে আনল যুগল। চৈত্র মাসে কিনেছে, এখনও তার ছিপি খোলা হয় নি। শিশিটা আস্তই আছে।

শিশি খুলে হাতে একটু তেল নিয়ে মাথায় মাখল যুগল। তারপর হাত-আয়নাটা মুখের সামনে ধরে পরিপাটি করে টেরি কেটে আঁচড়াতে লাগল।

আঁচড়ানো-টাচড়ানো হয়ে গেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের মুখখানা কতবার যে আয়নায় দেখল যুগল তার ঠিক নেই। তারপর ডাকল, ছুটোবাবু’

বিনু উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ডাকামাত্র সাড়া দিল।

যুগল বলল, আপনেরা নি কইলকাতার মানুষ! কত কিছু দ্যাখেন, কত কিছু শোনেন, জানেন। আমরা গেরামে পইড়া থাকি, ফ্যাচন-ফুচন (ফ্যাশন-ট্যাশন) তো জানি না। দ্যাখেন দেহি, আমারে– ক্যামন লাগে। ঠিক য্যামন লাগে ত্যামন কইবেন। মন রাখা কথা কইবেন না।

অন্য সময়ের তুলনায় যুগলকে সত্যিই ভাল দেখাচ্ছিল। হবু শ্বশুরমশায়ের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য কম কান্ড তো করে নি। বিনু বলল, খুব ভাল দেখাচ্ছে।

থুতনি নুয়ে পড়ল যুগলের, সত্য কন?

সত্যি।

হউরে আমারে পছন্দ করব নি?

নিশ্চয়ই করবে।

নিশ্চিন্ত করলেন ছুটোবাবু, নিশ্চিন্ত করলেন। নিজের সাজসজ্জা সম্বন্ধে আর কোনও দুর্ভাবনাই নেই যুগলের। সে বলতে লাগল, আপনেরা কইলকাতার মানুষ, আপনেগো চৌখে যহন ভাল লাগছে তহন উই গোপাল দাসের চৌখে কি আর লাগব না? করে তো হাইলা চাষার (হেলে চাষা) কাম, ফ্যাচনের হ্যাঁয় কী বোঝে?

বিনু মাথা নাড়ল, সে তত ঠিকই।

একটু ভেবে নিয়ে যুগল এবার বলল, আরেকখান কথা ছুটোবাবু–

কী?

এই যে গোন্ধসাবান গোন্ধত্যাল মাখছি, এই হগল কথা কারোরে কইবেন না কিন্তুক। ভগমানের কিরা (দিব্যি)।

বললে কী হবে?

হগলে আমার পিছে লাগব, আলঠাইব। আমারে এক্কেরে পাগল কইরা মারব।

মনে মনে ভেবে নিল বিনু, কথাটা মিথ্যে নয়। ব্যাপারটা একবার সুধা বা সুনীতির কানে তুলে দিলে দেখতে হবে না, যুগলকে বাড়িছাড়া করে দেবে। তার চাইতেও বড় কথা, যে যুগল বিনুকে এত সম্মান দেয়, এত বিশ্বাস করে, যত্ন করে তাকে সাঁতার শিখিয়েছে, নৌকোয় চড়িয়ে দিগ্বিদিকে ঘুরিয়ে বেড়িয়েছে, জল-বাংলার পাখি-পতঙ্গ-গাছপালা-সরীসৃপ চিনিয়েছে, তার গোপন খবর ঢাক বাজিয়ে অন্যকে জানানো উচিত নয়। এতে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়।

হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় বিনু তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমি তো কাউকে বলব। কিন্তু–

দু’চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল যুগল।

বিনু বলতে লাগল, ফুলেল তেল আর সাবানের গন্ধ ঢাকবে কী করে?

যুগলকে চিন্তিত দেখাল, হেই কথা তো ভাবি নাই ছুটোবাবু–

সমস্যাটার কোনও সমাধানই যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সেই সময় স্নেহলতার গলা শোনা গেল, বিনু কোথায় রে, বিনু? অ্যাই দাদাভাই, শিগগির খেতে আয়। ভাত বাড়া হয়ে গেছে।

বিনু ছুটল। ভেতর-বাড়িতে এসে দেখল, রান্নাঘরের দাওয়ায় সারি সারি আসন পড়েছে। হেমনাথেরা খেতে বসে গেছেন। একধারে আরও দুটো পাত পড়েছে। সেখানে বসেছে দু’জন অচেনা মধ্যবয়সী লোক। দেখেই বোঝা যায় চাষী শ্রেণীর গ্রাম্য মানুষ। মুখময় কঁচাপাকা দাড়ি। পরনে ক্ষারে কাঁচা ধুতি এবং ফতুয়া। চুলে চিরুনি চালিয়েছে ঠিকই কিন্তু সেগুলো এমন দুর্বিনীত যে হেলাননা যায় নি, আকাশের দিকে খাড়া হয়ে আছে। নিশ্চয়ই যুগলের বোনাই এবং ভাবী শ্বশুর গোপাল দাস। কে বোনাই আর কে শ্বশুর তা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না।

বিনু লক্ষ করল, সুধা সুনীতি লোকদু’টিকে আড়ে আড়ে দেখছে আর ঠোঁট টিপে টিপে হাসছে। এমন কি সুরমা-স্নেহলতা-শিবানীরাও মুখ আড়াল করে হাসছে। হাসির কারণটা মোটামুটি আন্দাজ করতে পারল বিনু।

গোপাল দাসদের দিকে চোখ রেখে সুধা-সুনীতির পাশের খালি আসনটায় গিয়ে বসে পড়ল বিনু।

অবনীমোহন হেমনাথের পাশে বসেছিলেন। বললেন, কোথায় ছিলি রে? ডেকে ডেকে পাওয়া যায় না।

বিনু বলল, যুগলের ঘরে ছিলাম।

অবনীমোহন কিছু বলবার আগেই হেমনাথ বলে উঠলেন, যুগল কী করছে রে দাদাভাই?

সাজসজ্জার কথা বলেই ফেলত বিনু, এই সময় যুগলের করুণ অনুরোধ মনে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি সে বলে উঠল, বসে আছে।

চান টান করেছে?

হ্যাঁ।

হেমনাথ স্ত্রীর দিকে ফিরলেন, যুগলকেও না হয় আমাদের সঙ্গেই বসিয়ে দাও। শ্বশুর-জামাই এক আসরে বসে খাক।

স্নেহলতা বললেন, খুব ভাল কথা।

গলা চড়িয়ে হেমনাথ ডাকতে লাগলেন, যুগল-যুগল–

যুগল সহজে এল না, অনেক ডাকাডাকির পর চোখ নামিয়ে জড়সড় হয়ে সামনে এসে দাঁড়াল।– তেল এবং সাবানটা যদিও শস্তা, সেগুলোর গন্ধটা কিন্তু উগ্র। যুগল এসে দাঁড়াতেই চারদিকের বাতাস সুগন্ধে ভারী হয়ে উঠল।

প্রথমটা কেউ কোনও কথা বলতে পারল না। সবাই চোখ বড় বড় করে অবাক বিস্ময়ে যুগলের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর হেমনাথই সুর টেনে টেনে বলে উঠলেন, করেছিস কি যুগলা, আঁ! মাথায় টেরি, গায়ে ফুলহাতা জামা, নতুন কাপড়, ভুরভুরে তেল-সাবানের গন্ধ–একেবারে রাজবেশ যে রে ব্যাটা!

দুরন্ত হাসির একটা স্রোত এতক্ষণ পাথরের আড়ালে আটকে ছিল যেন, হঠাৎ আড়ালটা সরে গিয়ে চারদিক থেকে কলকল করে ফেনায়িত উচ্ছাসে বেরিয়ে এল।

সবাই হেসে হেসে গলে পড়তে লাগল। তার ভেতরেই হেমনাথের গলা আবার শোনা গেল, শ্বশুরকে দেখেই এইরকম সেজেছিস যুগলা, শ্বশুরের মেয়েকে দেখলে কী যে তুই করবি!

যুগল আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, এক দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

হেমনাথ ব্যস্ত হয়ে ডাকাডাকি করতে লাগল, যুগল–যুগল—যুগল–

যুগলের আর সাড়া পাওয়া গেল না। খুব সম্ভব বাড়ির সীমানা পেরিয়ে গেছে সে। ঠাট্টা এবং হাসাহাসি খানিক স্তিমিত হয়ে এলে হেমনাথ অচেনা লোকদুটোর দিকে ফিরে ডাকলেন, গোপাল–

দু’জনের মধ্যে যে লোকটা মোটাসোটা সে তাকাল। বোঝা গেল, এ-ই গোপাল দাস এবং হেমনাথ তাকে চেনেন।

হেমনাথ বললেন, তারপর যে কথা হচ্ছিল, যুগলের বিয়ের ব্যাপারে তুমি আমার কাছে আসতে গেলে কেন? ওর মা-বাবাই তো আছে।

বিনুর মনে হল, যুগলের বিয়ে-টিয়ে নিয়ে দু’জনের ভেতর আগেই কিছু কথা হয়েছে। ভূমিকা করে রাখা হয়েছিল, এখন তা নিয়ে বিশদ আলোচনা হবে।

গোপাল দাস বলল, যুগলের বাপের কাছে গেছিলাম। হে কইল, আপনের কাছে আইতে। আপনে যা কইবেন হেই হইব। আপনের কথার উপুর তার কুনো কথা নাই।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হেমনাথ বললেন, যুগলের সঙ্গে তোমার মেয়ের কবে বিয়ে দিতে চাও?

গোপাল দাস তৎক্ষণাৎ বলল, আপনে যেই দিন কইবেন।

হেমনাথ হাসলেন, তোমরা দেখি দু’জনেই আমার ঘাড়ে দায় চাপাতে চাও।

দ্বিতীয় লোকটি অর্থাৎ যুগলের বোনাই বলল, আপনে ছাড়া আমাগো আর আছে কে? আপনের উপুর সগল দায় দিয়া আমরা নিশ্চিন্ত।

চিন্তিত মুখে হেমনাথ বললেন, আমার কথা যদি শোন, তাড়াতাড়ি কিন্তু বিয়ে হবে না।

গোপাল দাস বললে, তরাতরির ঠেকা নাই। তভু কী মাস তরি হইব যদি কন—

হেমনাথ বললেন, সেই ফাল্গুন মাসে, ধান উঠবার পর।

এইটা হইল আশ্বিন মাস, হেইর পর কাত্তিক-অঘ্‌ঘান-পৌষ-মাঘ। মইদ্যখানে চাইরখান মোটে মাস। দেখতে দেখতে কাইটা যাইব। ফাঙ্গুন মাসে আমার আপত্তি নাই।

তিন চার মাস সময় নিলাম কেন জানো?

ক্যান?

যুগল তো বৌ নিয়ে আমার কাছেই থাকবে। নতুন বৌর জন্যে নতুন ঘরদোর তুলতে হবে। তা ছাড়া, আমার এক শ’ দেড়শ’ কানি ধানজমি আছে। মাঝখানে মোটে একটা মাস, তারপরেই ধান উঠবে। ধান ওঠার সময় আমি কোনও দিকে নজর দিতে পারব না। ধানের ঝঞ্ঝাট কাটবার পর নিশ্চিন্ত হতে হতে সেই মাঘ ফাল্গুন।

একটু নীরবতা।

তারপর হেমনাথই আবার শুরু করলেন, তোমার মেয়ের জন্যে পণ দিতে হবে তো?

গোপাল দাস এক গাল হাসল, হ, হে তো দিতেই হইব।

কিরকম পণ চাইছ?

সোজাসুজি প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে গোপাল দাস বলল, বাপ হইয়া আমি তো কইতে পারি না। তয় পাঁচজনে কয় মাইয়া আমার সোন্দরী। কথাখান ঠিক কি বেঠিক, তুমিই কও– বলে সঙ্গীর দিকে তাকাল।

যুগলের বোনাই-এর নাম ধনঞ্জয়। সে সায় দিয়ে বলল, ঠিকই।

হেমনাথ বললেন, সুন্দরী যে আগেই বুঝেছি।

গোপাল দাস বলল, আপনে দেখছেন?

না।

তয়?

রহস্যময় হেসে হেমনাথ বললেন, তোমার মেয়ে ওই ওর বাড়ি এসে আছে তো? বলে যুগলের বোনাইকে দেখিয়ে দিলেন।

গোপাল দাস ঘাড় কাত করল, হ–

খবর পাই, আমাদের যুগল ঘুরে ফিরে রোজই একবার ওখানে যায়। তোমার মেয়েকে দেখে। মাথাখানা না ঘুরে গেলে কি রোজ বাঁদরটা যেত! সে যাক, কত পণ চাও বল–

হে আপনে বিচার কইরা দিয়েন।

হেমনাথ একটু ভেবে নিয়ে বললেন, দেনা-পাওনার কথা পরে হবে। তার জন্যে আটকাবে না। তুমি বরং পৌষ মাসের শেষ দিকে একবার এস।

গোপাল দাস বলল, হেই ভাল। আমি কিন্তুক আপনের ভরসায় থাকুম বড়কত্তা–

হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার কথার নড়চড় হবে না।

দ্রুত জিভ কেটে গোপাল দাস বলল, হে তো আমি জানিই।

হেমনাথ কিছু বললেন না।

খাওয়া-দাওয়ার পর আর বসল না গোপাল দাস। মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে ধনঞ্জয়কে নিয়ে চলে গেল।

তারপরও বাকি দিনটা যুগলকে এ বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখা গেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *