জীবনযাত্রা

জীবনযাত্রা

ঠাক মশাই!

খাটের ওপর আড়াআড়ি শুয়েছিল মনীন্দ্র। চোখে চশমা, ধুতির ওপর হাতাঅলা কোরা গেঞ্জি পরা। মাথার কাছে পরিষ্কার কাঁচের হারিকেন। পোকা খাওয়া একখানা বই মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল মনীন্দ্র। ঘরের ভেতর. জনা চার পাঁচ লোক। একজন হাতাঅলা চেয়ারে বসা, বাকি কজন সার ধরে বেঞ্চে। কম্পাউন্ডার মজিদ জলচৌকিতে বসে ছোট হামানদিস্তায় কী কী সব গুঁড়ো করছিল। লঙ এলাচ আর দারুচিনির মিশ্র একটা গন্ধ হামানদিস্তা থেকে ওঠে আস্তেধীরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল ঘরের ভেতর।

বেঞ্চে বসা একজন আবার ডাকল, ঠাক মশাই!

এবার একটু নড়েচড়ে ওঠল মনীন্দ্র। কিন্তু বই থেকে চোখ ফেরাল না। বলল, ক। ইট্টু যাওন লাগে।

কই?

 মনীন্দ্র চোখ তুলে তাকাল। খানিক তাকিয়ে থেকে বলল, তোমায় বাড়ি কই?

কুমারবুক। আমি পিয়ার খার পোলা।

ও। কি অইছে?

গুটি ওঠছে।

কয়জনের?

 মার।

খালি তর মারই?

 হ। দশা খুব খারাপ। চিনোন যায় না।

 দেহাইছচ কারে?

ছেলেটি একটু থেকে থামে। মনীন্দ্রও। তারপর ছেলেটি কিছু বলার আগেই মনীন্দ্র বলল, কালা জাউল্লারে দেহাইছচ?

ছেলেটি মাথা নিচু করে বলে, মার অবস্থা খারাপ দেইক্কা ….

মনীন্দ্র বইটা মুড়ে মাথার কাছে রাখে। তারপর বিছানায় ওঠে বসে। কালা জাল্লারে আবার নে গা। আমি যামু না।

কালা জাউল্লা দুইদিন ধইরা যাইতাছে, কাম অয় না।

অইব। যা।

তারপর অন্যান্য লোকজনের দিকে তাকিয়ে মনীন্দ্র বলল, একজনের চিকিৎসা করা রুপি আমি দেহি না।

ছেলেটি তবুও কাইকুঁই করে। বাবায় কইছিল টেকা-পয়সা যা লাগে…

শুনে মনীন্দ্র এবার রেগে গেল। টেকা দিয়া মনীনরে পাওয়া যায় না। আমি যামু না। যা। ছেলেটি তবুও বসে থাকো। আড়চোখে মনীন্দ্র দেখে।

 ছেলেটির দিকে আর তাকায় না মনীন্দ্র। একবার গলা খাকারি দেয়।

তারপর কম্পাউন্ডার মজিদকে বলে, অরে যাইতে ক মইজ্জা।

মজিদ হামানদিস্তা থামিয়ে ছেলেটির দিকে তাকায়। যাও, কর্তায় একবার না করলে হেই জায়গায় আর যায় না। তুমি যাওগা।

এবার ওঠে ছেলেটি। লুঙি আর ফুলহাতা শার্ট পরা। বগল পর্যন্ত হাতা গোটানো। উদ্ধত ভঙ্গিতে বেরিয়ে যায় সে। মনীন্দ্রকে আদাবও দেয় না।

উঠোনে নেমে কম্পাউন্ডার মজিদকে গাল দিয়ে যায় ছেলেটি। মজিদের ওপর দিয়ে গালটা আসলে মনীন্দ্রকেই দিয়ে যায়। নোয়াব অইয়া গেছ হালার পো! খাড়াও পাইয়া লই তোমারে!

মজিদ শুনতে পায় না। নিবিষ্ট মনে হামানদিস্তায় কবরেজি ওষুধের মশলা বানাচ্ছে। ঘাটের কাছে বর্ষার জলে একটা কোষা নাও ছেড়ে যায়, জলে বৈঠা পড়ার শব্দ হয়, কেউ খেয়াল করে না।

মনীন্দ্র বলল, রাইত অইতাছে, যা খাইয়া আয়গা মজিদ।

হামানদিস্তা রেখে ওঠে মজিদ। খালি গা, ধড়টা বিশাল তার। দাঁড়ালে পর বিশাল আকৃতিটা চোখে পড়ে মজিদের। দাঁড়িয়ে ঘরের লোকগুলোর দিকে একবার তাকায় মজিদ। তারপর হারিকেনের স্পষ্ট আলোয় ঘরের ভেতর দীর্ঘ ছায়া ফেলে উঠোনে নেমে যায়। পুকুরের ওপারে নিবিড় আমবাগান, সেই আমবাগানে একটা রাতপাখি কঁ কঁ করে ডেকে ওঠে ঠিক তখুনি।

 মনীন্দ্র তাকিয়েছিল ওষুধের আলমারিটার দিকে। কাঁচের আলমারির ভেতর তিন রকমের ওষুধ সাজানো। এলপ্যাথি হোমিওপ্যাথি কবরেজি। মনীন্দ্র সবরকমের চিকিৎসা জানে। এমন কি ফকিরি টোটকা এসবও।

চেয়ারের বসা লোকটি মনীন্দ্রের বয়েসী। লম্বা শাদা দাড়ি মুখে, মাথায় গোল টুপি। মোবাড়ির লোক। গাঁয়ের পাঁচ মাথার এক মাথা সালতাবদ্দিন। সালতাবদ্দিন মনীন্দ্রর একেবারে হাতের লোক। মজিদ বেরিয়ে যেতেই সালতাবদ্দিন বলল, মইজ্জা কি রাইতেও বাইত যায়নি?

শুনে হাসে মনীন্দ্র। তয় খাইব কই? বাওনের লগে খাইবনি।

এ কথা শুনে বেঞ্চে বসা লোকগুলো হাসে।

 মজিদ হাজামের পোলা, ভদ্রসমাজের বাইরের লোক। ওর ভাই বেরাদররা কামলা মজুর খাটে, বুড়ো বাপ শীতকালে মুসলমানির কাজ করে বেড়ায়। মজিদকে মনীন্দ্র রেখেছে কম্পাউন্ডার হিশেবে, পাহারাদার হিশেবে। দশ বিঘের ওপর বাড়িখানা তার। বিশাল আম কাঁঠালের বাগান, বিশাল পুকুর, বাঁশঝাড়, কপাটি খেলার মাঠ। মজিদ কম্পাউন্ডার এসবের পাহারাদারও।

সালতাবদ্দিন বলল, চদরী আইবো কবে?

শুনে নড়েচড়ে ওঠল মনীন্দ্র। হাতের বইটা বন্ধ করে শাদা ফরাশ বিছানো খাটের ওপর আধশোয়া হল। আইয়া পরনের কতা। দেরি করতাছে ক্যা বুজি না। চদরী নাই আমার বহুত অসুবিধা অইতাছে। বাইষ্যাকাল। মজিদের লইয়া বাইর অইতে অয়। বাড়ি খালি থাকে। দেশ গেরাম গেছে চোর ছেচ্চরে ভইরা। কাইল পশ্চিমের ঝার থিকা ছয় সাত বাঁশ কাইট্টা লইয়া গেছে।

 মনীন্দ্রর কথায় বেঞ্চে বসা লোকগুলো একটু আহাউঁহু করে। একজন লুঙির কোঁচর থেকে কুম্ভিপাতার বিড়ি বের করে ধরায়। আরেকজন বলে, চদরী কর্তায় কইলকাত্তা গেছে দুই বচ্ছর পর। ইট্টু বেড়াইয়া খেলাইয়া আইব না।

কেউ কোন কথা বলে না।

খানিকপর বেঞ্চে বসা অল্পবয়সী একজন সালতাবদ্দিনকে বলল, লন যাই নানা। রাইত অইল।

সালতাবদ্দিন একটু নড়েচড়ে ওঠে। মনীন্দ্রর দিকে তাকায়, যাইগা মনীন্দ্র।

মনীন্দ্র বলল, আর ইট্টু বহ। পিয়ার খার বাইত গেলাম না ক্যা হুইন্না যাও।

তারপর একটু হাসে মনীন্দ্র। হাসতে হাসতে বলল, পরে তো কইবা সেকেগো লগে বনিবনা নাই মনীন্দ্রর।

শুনে সালতাবদ্দিন হাসে। কথা বলে না।

মনীন্দ্র বলল, পিয়ার খার বউ বাঁচব না। কালা জাউল্লা আবল তাবল চিকিৎসা করে। নমোর পুতেরে হিগাইলাম আমি, অহনে হেয়ই আমার থিকা বড় কেরামত। অর মরণও প্রিয়নাথের মতনই অইব। শেতলা মায়ই নিব অরে। বহুত বাইড়া গেছে নমোর পুতে। দেইখো তোমরা।

প্রিয়নাথের ব্যাপারটা সালতাবদ্দিনের জানা। মনীন্দ্রর কম্পাউন্ডার ছিল। দশ বার বছর লেগে চেপে থেকে টুকটাক ব্যবস্থাও শিখেছিল। দিনে দিনে গোপন কিছু রোগীপত্র জোগাড় হয়ে গিয়েছিল প্রিয়নাথের। সস্তা ডাক্তার, দুআনা চার আনায় ওষুধ পথ্য দেয়, নাড়ি দেখে। গোপনে গোপনে লোকজন আসা-যাওয়া করে প্রিয়নাথের কাছে। প্রিয়নাথও সুযোগ পেলেই মনীন্দ্রকে ফাঁকি দিয়ে রোগীবাড়ি যায়। কিন্তু মনীন্দ্র বড় চালাক লোক। বামুনের পৌলা। জগৎসংসারে আপন কেউ নেই। দেশ ভাগ হয়ে গেল, তবু একলা পড়ে আছে এদেশে। দশ বিঘের ওপর বাড়িখানা আগলাচ্ছে, ডাক্তারি কবিরাজি করে পয়সা কামাচ্ছে দেদার। এসব বুঝতে দেরি হয় না তার। প্রিয়নাথের বড় দোষ ছিল সুযোগ পেলেই মনীন্দ্রর কিছু বদনাম গাইত সে। সবই আসছিল মনীন্দ্রের কানে। তক্কে তক্কে ছিল মনীন্দ্র। কবে সুযোগ আসবে, কবে প্রিয়নাথকে দেখে নেবে সে। সুযোগ এসেছিল।

মাওয়ার বেলদারবাড়ি গুটিবসন্তের চিকিৎসা করতে গিয়েছিল প্রিয়নাথ। বেজায় ওঠা ওঠেছিল সেবার ওফা বেলদারের। দেখে প্রিয়নাথ গেল ভয় পেয়ে। রোগী দেখবে কি, বাড়ি ফিরতে না ফিরতে নিজেই রোগী হয়ে গেল প্রিয়নাথ। দুদিন তার কোনও খোঁজ খবর নেই। কিন্তু মনীন্দ্রর কাছে খবর হয়ে গেছে, প্রিয়নাথ চললেন।

তিনদিনের দিন প্রিয়নাথের বুড়ি মা এসে পা জড়িয়ে ধরল মনীন্দ্রর।

কত্তা, পোলাডারে বাঁচান।

 কিন্তু মনীন্দ্র গেল না। একদিনেই ওফা বেলদার আর তার ডাক্তারবাবু প্রিয়নাথ মারা গেল। মনীন্দ্র হচ্ছে গিয়ে এই এলাকার বড় গুণিন। কে বাচবে কে মরবে রোগী দেখেই বলে দিতে পারে সে। কখনও কখনও না দেখেও পারে। এমনও দেখা গেছে গুটিবসন্তে শরীর পচে গেছে রোগীর, মনীন্দ্রকে খবর দিয়েছে তখন, মনীন্দ্র গিয়ে চিকিৎসা সারিয়েছে। প্রয়োজনে মনীন্দ্র নাকি জিভ দিয়ে চেটে চেটে রোগীর শরীর থেকে বসন্ত তুলে নেয়। কাজী বাড়ির আকবরকে নাকি বাঁচিয়েছিল ওরকম চেটে চেটে। আকবর এখন মাওয়ার বাজারে মুদিমনোহারির দোকান করে।

এসব গল্প মেদিনীমণ্ডলের সবার জানা। মনীন্দ্র সম্পর্কে এরকম গল্প অনেককাল ধরে চলছে চারপাশের গ্রামে।

মজিদ ফিরে এল খানিক পর। ঘাটে নৌকা বাঁধার শব্দ পেয়েই বেঞ্চে বসা লোকগুলো ওঠে। সালতাবদ্দিন বলল, আর না মনীন্দ্র, ম্যালা রাইত অইছে। যাই।

মনীন্দ্র কোনও কথা বলে না। একে একে লোকগুলো সব অন্ধকার উঠোনে নেমে যায়। তারপর ঘাটে নৌকা ছাড়ার শব্দ, জলে বৈঠা পড়ার শব্দ।

মজিদকে দেখেই আড়মোড় ভাঙল মনীন্দ্র। খাটের তলা থেকে বইলাঅলা খড়ম দুটো বের করে পরল। তারপর মাটিতে চটর চটর শব্দ তুলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। চৌধুরী নেই, মনীন্দ্রকেই করতে হয় সব। রান্না বান্না, হাট বাজার। বামুনের পোলা, বেজাতের হাতেরটা তো আর খেতে পারে না!

রান্নাঘরে গিয়ে চুলো জ্বালায় মনীন্দ্র। চুলোর ওপর এক কড়াই দুধ থাকে সব সময়। ঘন্টায় ঘন্টায় দুধ খায় মনীন্দ্র। রাতের বেলা ভাত খায় না। ফলটা মিষ্টিটা খায়। রোগীবাড়ি থেকে ম্যালা কিছু পায় মনীন্দ্র। ফলপাকুর, মিষ্টি, মাছ। মনীন্দ্রের রান্নাঘর ভর্তি থাকে খাবারে।

আজ রাতেরবেলা মনীন্দ্র দুটো সবরিকলা নেয়, কাঁসার বড় বাটিতে একবাটি দুধ নেয়। এই তার রাতের খাবার। চৌধুরী থাকলে এসব মনীন্দ্রকে করতে হয় না। চৌধুরীই করে সব। কিন্তু মাসখানেক হল চৌধুরী গেছে কোলকাতা। ছেলেমেয়েরা সব কোলকাতায় চৌধুরীর। হিন্দুস্থান পাকিস্তান হওয়ার পর থেকেই। চৌধুরী দুবছর তিনবছর পর গিয়ে দেখা করে আসে তাদের সঙ্গে। বিষম লোভী মানুষটা। মনীন্দ্রর রক্ত সম্পর্কের কেউ না। তবুও এদেশে পড়ে আছে শুধু লোভে। মনীন্দ্র বলেছে চিতায় ওঠার আগে বাড়িটা চৌধুরীর নামে দলিল করে দিয়ে যাবে। সেই আশায়ই ছেলেমেয়ে ছেড়ে এদেশে পড়ে আছে চৌধুরী।

আজ রাতে রান্নাঘরে বসে দুধ কলা খেতে খেতে এসব কথা মনে পড়ে মনীন্দ্রের। মনে পড়ে হাসি পায়।

 পাশের ঘরে মজিদ আবার হামানদিস্তা ঠুকছে। চুক চুক চুক। চারদিকের গাছপালায় রাত্রিকাল গম্ভীর হচ্ছে। অবিরাম ডাকছে পোকামাকড়। পশ্চিমের বাঁশঝাড়ে দুতিনটে শেয়াল সুর করে ডাকে। শুনে দুধকলা খেতে খেতে মনীন্দ্রর বুকের মধ্যে কেমন একটু কষ্ট হয়। বর্ষাকালে, শেয়ালদের অভাব যাচ্ছে। গোরস্থানে গিয়ে যে মরা খাবে, উপায় নেই। চারদিকে জল। শেয়ালের ডাকে অনাহারের গন্ধ পায় মনীন্দ্র। ভারী একটা কষ্ট হয় তার। গলা দিয়ে দুধকলা নামতে চায় না।

 উঠোনের পরই ঘাট। খালিকালে ঘাটটা থাকে বেশ দূরে। বাড়ির নামার দিকে ছোট্ট গোল পুকুর। বর্ষা এসে, বর্ষায় জল ক্রমশ ফুলতে শুরু করলে ঘাটটা ক্রমশ ওপর দিকে ওঠে আসে। এখন যেমন উঠোনের সঙ্গেই ঘাট। রান্নাঘর থেকে চার কদম ফেললেই ঘাট। এবার জলের যে রকম জোর দেখা যাচ্ছে বোধ হয় মনীন্দ্রের উঠোনেই চলে আসবে বর্ষার ঢল।

বানবন্যায় ভেসে যাবে দেশ।

ঘাটের কাছে জিংলাগাছের সঙ্গে মনীন্দ্রের নাওটা বাঁধা। অন্ধকার করে জলের ওপর ভাসছে নাওটা। তার ওপর দিয়ে পাখায় পতপত শব্দ তুলে উড়ে যায় দুটো বাদুড়। কুপি হাতে নাওটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় মনীন্দ্র। অন্ধকার গাছপালার দিকে তাকিয়ে বাড়ি বন্ধ করার মন্ত্র পড়ে। তারপর ঘাটপাড় থেকে উঠোনের দিকে ওঠে আসে। হাতে কুপি, মুখে মন্ত্র। পায়ে বইলাঅলা খড়মের চটর চটর শব্দ তুলে উঠোনময় হাঁটে মনীন্দ্র। মন্ত্র পড়ে। মজিদ সেই ফাঁকে হামানদিস্তা থামিয়ে রান্নাঘরে শুতে যায়।

মজিদ ঘুমিয়ে পড়ার পরও অনেকক্ষণ জেগে থাকে মনীন্দ্র। উঠোনে পায়চারি করে। কখনো কুপিটা জ্বালিয়ে রাখে পুজোর ঘরে।

 চারদিক খোলা। ছোট্ট চৌচালা ঘর, তার মাঝমধ্যিখানে কুপি জ্বালিয়ে রেখে নিজের ঘরে ফিরে যায় মনীন্দ্র। কত কী যে মনে পড়ে তখন! সনাতনীর কথা, পাশের বাড়ির মুসলমান মেয়েগুলোর কথা, মেয়েদের মার কথা।

বিয়ের পর পরই সনাতনী জেনে গিয়েছিল পাশের বাড়ির মুসলমান বউটার সঙ্গে গোপন সম্পর্ক মনীন্দ্রর। এজন্যেই বউর ব্যাপারে উদাসীন মনীন্দ্র। স্বামীর ব্যাপারে সব জেনে শুনে কদিন খুব কাঁদল সনাতনী। তারপর এক রাতে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিল। মনীন্দ্র সে রাতে গিয়েছিল মেন্দাবাড়ি। মেন্দাবাড়ি ছিল গানের আসর। কৃষ্ণলীলা। ভারী জমজমাট আসর। সনাতনী পুড়ে মরে গেল, মনীন্দ্র টেরও পেল না। কৃষ্ণলীলায় বিভোর হয়ে রইল। রাতেরবেলা এসব কথা আজকাল প্রায়ই মনে পড়ে মনীন্দ্রর। কতকাল হয়ে গেল, পুরো ত্রিশ বছর, তবুও সনাতনীকে ভুলতে পারেনি মনীন্দ্র।

মনীন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর দরোজা বন্ধ করে মাথার কাছে হারিকেন নিয়ে শুয়ে পড়ল। হোমিওপ্যাথির বইটা মেলে ধরল চোখের ওপর।

কিন্তু পড়তে ভাল্লাগে না মনীন্দ্রর। রাতেরবেলা শরীরের ভেতর ঘুরপাক খায় অসম্ভব এক যন্ত্রণা। বয়স হয়ে গেল তিন কুড়ির কাছাকাছি, তবুও কামটা মরেনি মনীন্দ্রর। রাতেরবেলা এখন শরীর আনচান করে। যুবক বয়স থেকেই মনীন্দ্র খুব কামপ্রিয়। এখন, এই বুড়ো বয়সেও তাগড়া পুরুষের মতন সঙ্গম করতে পারে সে। এসব কবরেজি ওষুধের গুণ। সনাতনী মারা গেছে ত্রিশ বছর। মনীন্দ্র আর বিয়ে করেনি। বামুনের পোলা বিয়ে করলে অধর্ম হয়। কিন্তু শরীর কি ধর্ম অধর্ম মানে! পাশের বাড়ির বউটার সঙ্গে ভাব ছিল মনীন্দ্রর। সনাতনী মারা যাওয়ার পর সুযোগ পেলেই বউটা এসে মনীন্দ্রর সঙ্গে খাটে ওঠত। অভাবের সংসার তার, স্বামী খেতখোলা করে, তাতে সংসার চলে না। মনীন্দ্র চালটা ডালটা দেয়, নেয় কেবল শরীরটা। দিন চলে যায়।

মনীন্দ্রর বড় দোষ ছিল এক নারীতে বেশিকাল সুখ পেত না সে। পাশের বাড়ির বউটাকে একসময় আর ভালো লাগেনি তার। ততদিন বউটার বড় মেয়ে পরী বেশ ডাগরডোগর হয়ে ওঠেছে। মনীন্দ্রর চোখ পড়ল পরীর ওপর। একদিন পরীও কেমন করে যেন ওঠে এল খাটে। মনীন্দ্র ডাক্তার মানুষ। গর্ভ না হওয়ার ওষুধ খাওয়াত। ফলে পরী নির্ভয়ে মনীন্দ্রর কাছে আসত।

পরীর মা অবশ্য জেনে গিয়েছিল ব্যাপারটা চেপে থাকত। মনীন্দ্র পরীকে তার মায়ের কথা বলেছে। ফলে মা মেয়ে দুজনই দুজনার কাছে অপরাধী। দুজনেই চেপে থাকত। তিন বছর পর বিয়ে হয়ে গেল পরীর। তখন তার ছোটটা নুড়ি ধরল মা বোনের পথ। সেও রাতে বিরাতে, দিন দুপুরে যখন সুযোগ পায় মনীন্দ্রর কাছে যায়। নুড়ি একটু দুর্বল শরীরের মেয়ে ছিল। কিন্তু মনীন্দ্র অতিরিক্ত কামুক। নুড়ির বেশ কষ্ট হত, শরীর বইতে চাইত না। তবুও যেত। মনীন্দ্রর চালটা ডালটায় সংসার চলে তাদের। বাবা খেতখোলা। করে ভরপেট খাওয়াতে পারে না। কী করবে! ভাতের চেয়ে কি শরীর বড়!

 নুড়ির বিয়ের পর বাড়ির শেষ মেয়ে টুকি। টুকির তখন বয়েস খুব কম। এগার বার হবে। গাবের মুচির মতন বুক ওঠেছে। পাখির মতন চঞ্চল টুকি। চৌপরদিন মনীন্দ্রর বাড়ি পড়ে থাকে। পেয়ারা গাছে চড়ে, আমগাছে চড়ে। কথায় কথায় খিলখিল করে। হাসে। মনীন্দ্রকে ডাকে ঠাকদা বলে।

এই টুকিকেও একদিন খাটে তুলল মনীন্দ্র। টুকির বয়স কম। রক্তাক্ত হয়ে গেল। কিন্তু মেয়েমানুষ তো, ভগবান সহ্যশক্তি দিয়েছেন। একটুও কাঁদলো না টুকি। মনীন্দ্র দু পুরিয়া হোমিওপ্যাথি খাইয়ে এক আগল চালডাল দিল, আনাজপাতি দিল। তাই কাঁখে নিয়ে খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়ি চলে গেল টুকি।

 তারপর নিয়মিত।

টুকি একটু অন্যরকম মেয়ে ছিল। পরী নুড়ি কিংবা তাদের মার মতন শুধু খাওয়াটা আর শোয়াটাই বুঝত না। মনীন্দ্রকে ভালোবাসত মেয়েটা। বড় ভালোবাসত। সময়ে অসময়ে এসে সেবাযত্ন করত, আদর সোহাগ করত। ঘরটা ঝেড়ে দিত, ওষুধের আলমারিটা নেড়েচেড়ে গোছগাছ করে দিত। অসুখবিসুখ করলে দিনরাত থাকত মনীন্দ্রর কাছে। ঘরের বউর মতন। অতটুকু মেয়ে কী করে যে পারত এসব!

টুকির শরীরে অদ্ভুত একটা গন্ধ ছিল। কোনও মেয়েমানুষের গায়ে এরকম গন্ধ পায়নি মনীন্দ্র। কাঁচা পেয়ারা গাছে কুড়োল মারলে যেরকম গন্ধ ওঠে, ঐরকম গন্ধ। গন্ধটা বড় ভালো লাগত মনীন্দ্রর। বড় প্রিয় ছিল গন্ধটা।

টুকির আর একটা অভ্যেস ছিল। রাতের বেলা কখনো মনীন্দ্রর কাছে থাকলে পুরো জামা কাপড় খুলে শুত। শোয়ার ভঙ্গিটা সরীসৃপের মতন। দুহাতে মনীন্দ্রর কোমরের ওপর। একপা তুলে সারারাত পড়ে থাকত। ঘুমাবার সময় একটুও নড়াচড়া করত না।

পরপর দুবার গর্ভবতী হয়েছিল টুকি টুকির মা-বোনরা মনীন্দ্রর সঙ্গে শুয়ে কেউ গর্ভবতী হয়নি। মনীন্দ্র ওষুধবিষুধ দিত। টুকিকেও দিয়েছিল। কাজ হয়নি।

ব্যাপারটা দেখে মনীন্দ্র খুবই অবাক হয়েছিল। তার ওষুধে কাজ হয় না। আশ্চর্য ব্যাপার! পরে বুঝেছে টুকি আসলে আদিনারী। পুরুষসঙ্গেই গর্ভবতী হয়। ওষুধবিসুধে ধরে না।

সেই টুকিরও একদিন বিয়ে হয়ে গেল আজ এক বছর। পুরো একবছর। সেই বাড়ির পোলা মংলা জেদাজেদি করে বিয়ে করল টুকিকে। মংলার একটা পা ছোট, হাটে ত্যাড়া হয়ে। শরীরটা দশাসই, বুসিকালির মতন গায়ের রঙ। চৌপরদিন গাঁজা টানে। রাতে করে ডাকাতি। চোখদুটো কোড়া পাখির চোখের মতন লাল।

যখন মংলার সঙ্গে টুকির বিয়ের কথা হচ্ছে, গোপনে মনীন্দ্র একটা ভাঙানি দিয়েছিল। ঘটক ছিল কাজির পাগলার বশির মোল্লা। বশির মোল্লাকে মনীন্দ্র বলেছিল টুকির স্বভাব চরিত্র খারাপ। মনীন্দ্রর সঙ্গে সম্পর্ক আছে। বশির গিয়ে মংলাকে বলল। শুনে মংলা গেল ক্ষেপে। হোক খারাপ, এই মেয়েকেই সে বিয়ে করবে।

করলও।

তখন তো মনীন্দ্রর মাথায় বাড়ি। তার জন্যে যে আর কেউ রইল না! মংলার আগেও টুকির অনেক সম্বন্ধ এসেছে, মনীন্দ্র গোপনে ভাঙানি দিয়েছে। কারণ একটাই, টুকি চলে গেলে তার হবে কী।

 তবুও চলে গেল টুকি।

বিয়ের আগের দিন মনীন্দ্রর সঙ্গে গোপনে একবার দেখা করেছিল টুকি। অনেক কথা বলেছিল, অনেক কেঁদেছিল। শেষবারের মতোন শরীরের সুখ দিয়েছিল মনীন্দ্রকে। সেই টুকির কথা ভেবেও আজকাল রাতে ভালো ঘুম হয় না মনীন্দ্রর। শরীরটা ছটফট করে, ঘুমোলে স্বপ্ন দেখে টুকিকে। ভালো লাগে না। ওঠে বাইরে যায়। রাতেরবেলা বাইরের গাছপালায় মৃদু একটা হাওয়া থাকে, জমাট একটা অন্ধকার থাকে। মাথার ওপর দিয়ে নিশাপাখি উড়ে যায়। দূরে কোথাও একাকী কঁ কঁ করে কেঁদে ওঠে কী এক পাখি। বাঁশঝাড়ে ছুটোছুটি করে শেয়াল। উঠোনের শেষে ডাকাডাকি। সবকিছু মিলিয়ে পুরনো পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে না মনীন্দ্রর। তিনকুড়ি বয়েস হল, আর কত কাল। কোনও কোনও মধ্যরাতে আকাশে চাঁদ ওঠলে উঠোনে পায়চারি করতে করতে গুনগুনিয়ে গান গায় মনীন্দ্র, আমার এমন জনম আর কী হবে, মানুষ দেখতে এসেছিলাম ভবে।

পুবের ঘরে বুড়ো সমেদ খুক খুক করে কাশে। কদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তার। বর্ষার মুখে দিন কতক ম্যালা খাটাখাটনি গেছে। ধানিবিলের জমি দুটোয় সোনাদিঘা ধানের ফাঁকে ফাঁকে আড়ালি আর সেচি জন্মেছিল। বর্ষার আগে নিড়ানি পড়েনি বলে গোড়ায় জল পেয়ে আগাছাগুলো রাতারাতি ছেয়ে ফেলল জমি। ধানগুলো নষ্ট হয়। হাজামবাড়ির রবাকে নিয়ে দিন কয়েক ক্ষেত ডোগাল সমেদ। আড়ালি আর সেচি তুলে ফেলে দিল। ফলে ধানগাছগুলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কদিন হল থোর বেরিয়েছে, সমেদ দিনচারেক আগে দেখেছে। জলের ওপর ভেসে থাকে নধরপুষ্ট ধানচারা। বর্ষাকালীন হাওয়ায় ভারি থোর মাথায় নিয়ে দোল খায়। বড় ভালো লাগে দেখতে।

 সেদিন থেকেই একটু একটু শরীর খারাপ সমেদের। কাশিটা চাগা দিয়েছে। রাতেরবেলা ঘুসঘুসে জ্বর হয়। বরাবরই ঠাণ্ডার বাই সমেদের। বর্ষার নতুন জল, বড় তেজ তার। গা ডোবালে জ্বরজারি নির্ঘাৎ।

সমেদ কদিন বাড়ি থেকে বেরয় না। আতবী বেরুতে দেয় না। এখন তেমন কোনও কাজ নেই। তবুও কাল বিকেলে বেরিয়েছিল সমেদ। আতবী বলেছিল মনীন্দ্রর কাছে। যেতে। মনীন্দ্র বিনিমাগনা ওষধপথ্য দেয়।

কিন্তু সমেদ যায়নি। বলেছিল যাবে। যায়নি। বিলের জমি দুটো ঘুরে ফিরে দেখে বাড়ি ফিরেছে।

বাড়ি ফিরতেই আতবী ধরেছে, গ্যাছেলা?

সমেদ কাশতে কাশতে বলেছে, না।

ক্যা?

সমেদ আর কথা বলেনি।

 আতবী আবার বলেছে, কাশতে কাশতে তো মইরা যাইবা!

 শুনে খ্যাকিয়ে উঠেছে সমেদ, মরলে মরমু।

আতবী তারপর আর কোন কথা বলেনি।

মনীন্দ্রকে দুচোখে দেখতে পারে না সমেদ। কারণটা আতবী ঠিক জানে না। আঁচ করে তার ব্যাপারটা সমেদ জানে। পরী নুড়ি টুকির ব্যাপারও জানে। হাজার হোক পুরুষ তো। স্বামী হয়ে, বাপ হয়ে, ঘরের বউ মেয়েদের পরপুরুষের সঙ্গে শোয়ার কথা জেনে সেই মানুষকে দেখতে পারবে কেমন করে!

 এসব ভেবে ভেতরে ভেতরে রাগও হয় আবীর। বউমেয়েদের যে পুরুষ দুবেলা খাওয়াতে পারে না, তার অত তেজ থাকবে কেন!

মুখে বলে না কিছু। বয়স হয়ে গেছে, ঝগড়াঝাটি ভাল্লাগে না আজকাল। চেপে থাকে আতবী। সব চেপে থাকে। অবশ্য দশ বছর আগে হলে নিজেই মনীন্দ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়াত। স্বামীর জন্যে ওষুধ, আর নিজের জন্যে আনত কিছু গোপন সুখ।

কিন্তু আজ আর যাওয়া যায় না মনীন্দ্রের কাছে। বয়স হয়ে গেছে। কাম নেই।

কিন্তু মনীন্দ্রর কথা মনে হলে মনটা এখন বড় আনচান করে। বড় ভালো মানুষটা, বড় দরদী। আতবীর সংসারটা মনীন্দ্রই চালিয়েছে বারো আনা। সমেদের যা রোজগারপাতি তাতে সারাবছর এক বেলা করেও খাওয়া হত না। মনীন্দ্র চালটা ডালটা দিয়েছে, টাকাটা পয়সাটা দিয়েছে। নিয়েছে খুব কম। মেয়েগুলো বড় হওয়ার আগে আতবীকে ওঠতে হত মনীন্দ্রের খাটে। পরী নুড়ি টুকি বড় হয়ে মাকে হাছিব দিয়েছে। ক্ষতি কী! যে মানুষটা তাদের জন্য এত কিছু করেছে, তার জন্যে কিছুই তারা করবে না! পেটের চেয়ে ইজ্জত বড় হল!

সমেদকে এসব বুঝিয়ে বলা যায় না। বড় হিংসুটে মানুষ। তার সংসারের জন্যে যে এতকিছু করেছে মনীন্দ্র, সেসব সমেদ শুনতে চায়না। আতবী জোর দিয়ে কিছু বললে তেড়ে আসে মারতে। বুড়ো বয়সেও জেদ কমেনি মানুষটার। এখন পুবের ঘরে বসে কিরকম খুক খুক করে কাশছে। কেশে কেশে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। কাশি থামলেই মুখ হা করে অনেকক্ষণ ধরে শ্বাস টানবে। বুকের হাড়পাঁজরা শ্বাস টানার তালে তালে নড়বড় নড়বড় করবে। দেখলে মায়া হয়। কিন্তু আতবী কী করবে। মন্দ্রির কাছে সমেদ যাবে না। মরে যাবে। তবুও না।

.

টুকির মা, ও টুকির মা!

কোন ফাঁকে থেমে গেছে সমেদের কাশি। এখন আতবীকে ডাকছে সে।

রান্নাঘরে বসে দেয় আতবী, কী?

 আমারে ইট্টু তামুক দেও।

 দিতাছি।

তারপর আবার সব চুপচাপ।

সমেদের কাশির শব্দ না থাকলে বাড়িটা বড় নিশ্ৰুপ হয়ে যায়। চারদিকে বর্ষার জল, গাছপালা, বাড়িতে বুড়োবুড়ি দুজন মাত্র মানুষ। কথা বলার লোক নেই,শব্দ উঠবে কোত্থেকে! অনেকক্ষণ ধরে যত্ন করে তামাক সাজায় আতবী। সংসারে তেমন কোনও কাজকাম নেই। বুড়োবুড়ির সংসার, একবেলা দুটো রান্না করলে দিনমান চলে যায়। বাকি সময়টা উঠোনে বসে থাকে আতবী। হঠাৎ সমেদ ডাকে, তামাক দিতে বলে। একটা কাজ পায় আতবী। অনেকক্ষণ ধরে যত্ন করে তামাক সাজে। ফুঁ দিয়ে দিয়ে টিকা জ্বালায়। তারপর নিজে খানিক টেনে ধোঁয়া। উঠিয়ে সমেদের হাতে নিয়ে দেয়। সমেদ মনোযোগ দিয়ে তামাক টানে। টানার তালে তার বুকের হাড়পাঁজরা নড়বড় করে। দেখে বুড়ি আতবী ভেতরে ভেতরে কাপে।

মানুষটা মরে গেলে বিধবা হয়ে যাবে আতবী। ভেবে বড় কষ্ট হয়। বিধবা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরণ ভালো।

এসব ভেবে আবার সমেদকে অনুনয় করে আতবী। হুনছ, একবার যাও ঠাকুরের কাছে।

 হুঁকা নামিয়ে ঘোলা চোখে আতবীর দিকে তাকায় সমেদ। তাকিয়ে থাকে। আতবী দেখে মানুষটার চেহারায় ক্রোধ জ্বলছে। যে কোনও সময় ফেটে পড়বে। বয়স হয়েছে, ঝগড়াবিবাদ ভাল্লাগে না। আতবী আস্তে ধীরে উঠোনে নামে। মনে মনে গালাগাল দেয় সমেদকে। মরুগগা গোলামে। আমার কী!

.

দুপুরের পর কাশতে কাশতে কোষা নাও নিয়ে বেরয় সমেদ। বিলে যাবে। আতবী বসে ছিল উঠোনের কোণে। সমেদ একবার তাকাল আতবীর দিকে। কথা বলল না। আতবীও বলল না। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল ছোট্ট বৈঠা বেয়ে গাছপালার আড়ালে আস্তে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে মানুষটা। দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল আবীর। মানুষ মরে গেলে আর ফিরে আসে না। এই মানুষটা কাশতে কাশতে মরে গেলে আর কোনদিন ফিরে আসবেনা। আতবী যাবে বিধবা হয়ে।

এসব ভেবে হঠাৎই লাফিয়ে ওঠে আতবী। সমেদ বিলে গেছে, ফিরতে অনেক সময়। এই ফাঁকে মনীন্দ্রর সঙ্গে একটু দেখা করে এলে হয়। সমেদের জন্যে খাওয়ার ওষুধ আনা যাবে না। আনলেই বুঝে যাবে আতবী মনীন্দ্রর কাছে গিয়েছিল। আরেক অশান্তি দেখা দেবে। ঝগড়া বিবাদ হবে। কিন্তু মনীন্দ্রকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললে ব্যবস্থা দিয়ে দেবে মনীন্দ্র। ব্যবস্থামতন কাজ করলে কাশি সেরে যাবে সমেদের। ভেবে আতবী খুব খুশি। বাড়ির পেছন দিক দিয়ে মনীন্দ্রর সীমানায় গিয়ে দাঁড়ায়।

সমেদের বাড়ির পরই জংলামতন খানিকটা জায়গা। কানিখানেক হবে। আগাছায় ভরে আছে জায়গাটা সেখানে এখন বর্ষার জল। সমেদ কোষা নিয়ে গেছে। আতবী এখন। পার হবে কেমন করে।

জলের ধারে দাঁড়িয়ে দুএক মুহূর্ত কী ভাবে আতবী। তারপর পরনের শাড়িটা পুরোপুরি খুলে হাতে নেয়। ওপারে গিয়ে পরে নিলেই হবে। কেউ তো আর দেখছে না। তাদের বাড়িতেও কেউ নেই। মনীন্দ্রর বাড়িতেও মনীন্দ্র ছাড়া আর কেউ নেই। এই দুপুরবেলা মনীন্দ্রর কাছে কোনও রোগী আসে না। উলঙ্গ আতবীকে দেখলে মনীন্দ্রই দেখতে পারে। সে তো কতই দেখেছে। মনীন্দ্রর কাছে আর লজ্জা কী!

 আতবী জলে নামে।

ওপারে এসে শাড়ি পরতে পরতে পুরোনো দিনের কথা খুব মনে পড়ে আতবীর। কত দিন পালিয়ে মনীন্দ্রর কাছে এসেছে সে। রাতেরবেলা, দিনেরবেলা। এখন অনেককালের পুরনো স্মৃতি ভাবতে ভালো লাগে। আজও লাগল। শরীরের ভেতরটা বহুকাল পর চনমন করে উঠল আতবীর। মনীন্দ্র যদি আজও খাটে ওঠতে বলে আতবীকে।

 আস্তেধীরে উঠোন পার হয়ে মনীন্দ্রের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আতবী। দরোজা খোলা, ভেতরে খাটের ওপর শুয়ে আছে মনীন্দ্র। চোখের সামনে ধরা বই। সবকিছু উঠোন থেকেই দেখা যায়।

 দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে খুক করে একটু কাশে আতবী। শুনে চোখের ওপর থেকে বইটা সরায় সনীন্দ্র। শুয়ে থেকেই আতবীর দিকে তাকায়। হাঁটুর ওপর উঠে যাওয়া ধুতিটা টেনে নামাতে নামাতে বলে, আহ। ঘরে আহ।

আতবী কথা বলে না। ঘরে ঢোকে।

ততক্ষণে উঠে বসেছে মনীন্দ্র। আতবীকে বলল, বলো।

আতবী কোনও কথা বলেছিল না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনীন্দ্রকে দেখছিল। তিন কুড়ির ওপর বয়স মানুষটার, কিন্তু এখনো কেমন বয়সকালের পুরুষ মানুষের মতন দেখায়। স্বাস্থ্য চেহারা সব আগের মতনই আছে মনীন্দ্রর। টকটকে ফর্সা গায়ের রঙে একটুও ময়লা লাগেনি। একটাও চুল পাকেনি। ডাক্তার কবরেজ মানুষ, ওষুধবিষুধ খায়, ফলদুধ। খায়, স্বাস্থ্য ভালো থাকবে না কেন!

 মনীন্দ্র বলল, শইল ভিজা ক্যা?

আতবী মাথা নিচু করে হাসে। পানি ভাইঙা আইছি।

কী মনে কইরা আইলা?

এই কথাটা মনীন্দ্র বলে সামান্য রসিকতা করে। শুনে বুড়ো বয়সেও শরীরের ভেতর চনমন করে ওঠে আবীর। বয়সকালে এই সুরেই কথা বলত মনীন্দ্র।

আতবী বললো, টুকির বাপের খুব কাশ। কাশতে কাশতে মইরা যায়।

ওষুধ দিমু?

না। তাইলে বুইজ্যা যাইবে আমি আইছিলাম।

শুনে মনীন্দ্র একটু থামে। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, আদা তেল গরম কইরা পিডে ডইল্লা দিও।

তারপর কেউ কোনও কথা বলে না। আবার সব চুপচাপ। আতবী বসে থাকে লম্বা বেঞ্চের এক কোণে। মনীন্দ্রের বাড়িটা বড় নিঝুম হয়ে আছে। বর্ষার জলে গাছপালা রোদেলা দুপুরে বয়ে যাচ্ছে। মিহিন একটা ঝিমমারা শব্দ উঠছে চারদিকে পৃথিবীর থেকে। দুটো বয়সী মানুষ। মুখোমুখি বসে থাকে, কত কী যে মনে হয় তাদের, তবুও কেউ কোনও কথা বলে না।

এক সময় উঠে দাঁড়ায় আতবী। যাইগা।

 মনীন্দ্র বলে, তুমি এক্করে বুড়ি অইয়া গেছ।

শুনে হাসে আতবী। বয়েস কি কম অইল?

মনীন্দ্র আর কথা বলে না। আবার শুয়ে পড়ে বিছানায়। আতবী উঠোনে নেমে আস্তে ধীরে হেঁটে যায়। ভারী একটা দুঃখ হয় তার। মনীন্দ্রে বলল বুড়ি হয়ে গেছে আতবী। এজন্যে তাকে ছুঁয়েও দেখল না। বয়সকালে কাছে গেলেই আতবীর শরীর ঘাটত মনীন্দ্র। আজ তার বয়স নেই, এজন্যে মনীন্দ্র তাকে ছুঁয়েও দেখল না। ভেবে বুক ফেটে যায় আবীর। মনীন্দ্রকে দেখে বহুকাল পর কামভাবটা জেগেছিল। কিন্তু আতবীকে দেখে মনীন্দ্র তা বুঝল না। গভীর গোপন দুঃখ কিংবা অভিমানে বুক ফেটে যায়। আতবীর। চোখ ফেটে যায়। জলে নেমে ফোঁস ফোঁস করে কাঁদে আতবী। মানুষের শরীর নদীর জোয়ার ভাটা, মানুষ তা বোঝে না। হায়রে মানুষ!

.

মেন্দাবাড়ির ঘাটে নৌকা বেঁধে নাইতে নেমেছে মজিদ। জল তোলপাড় করে সাঁতার কাটছে আর গলা খুলে গান গাইছে। মনীন্দ্রর মুখে শোনা গান। আমার এমন জনম। আর কি হবে। সঠিক উচ্চারণ জানে না মজিদ, শব্দে ভুল হয়। তবুও গায়। বড় আমুদে মানুষ। মনীন্দ্রর সামনে ভয়ে বসে থাকে, আড়ালে এলেই রাজা। গান গায়, হাসে, কাঁদে। এই যেমন এখন মোবাড়ির পোলাপান সব ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছে। মজিদকে দেখলেই হৈহৈ করে ছুটে আসে সবাই, হাততালি দেয়। তাতে মজিদ বড় আমোদ পায়। জলে নেমে এখন কত রকমের যে কসরৎ দেখাচ্ছে! মাছের মতন ডুব দিয়ে বহুদূরে চলে যাচ্ছে। তাই দেখে মেন্দাবাড়ির পোলাপান বড় খুশি।

অনেকক্ষণ ডুবোডুবি করে পাড়ে ওঠে মজিদ। নৌকার আগায় বসে লাল গামছায় বিরাট শরীরটা মোছে। ছইয়ের ভেতর থেকে শুকনো লুঙি বের করে পরে। তারপর ভেজা লুঙিটা ছইয়ের ওপর মেলে দিয়ে নৌকা ছাড়ে। দুপুর গড়িয়ে গেছে, পেটের ভেতর বিষম খিদে। আজ বড় খাটাখাটরি গেছে মজিদের। মনীন্দ্রকে নিয়ে চার পাঁচটা গ্রাম ঘুরেছে। মাওয়া জশিলদিয়া কান্দিপাড়া। লগি ঠেলে হাতের ড্যানা ব্যথা হয়ে গেছে।

আর মনীন্দ্র হচ্ছে অদ্ভুত মানুষ। রোগীবাড়ি ঢুকলে বেরুতে চায় না। পান খাবে, গালগল্প করবে। দুনিয়ার মেয়েমানুষের সঙ্গে খাতির মনীন্দ্রের। লোকটা বোধহয় বশীকরণ মন্ত্রও জানে। এতটা বয়েস হল, তবুও মেয়েমানুষের দোষটা গেল না। দেখলেই কুত্তার মতন ছোঁক ছোঁক করে।

মনীন্দ্রের অবশ্য এই একটাই দোষ। এমনিতেই মানুষটা ভালো, দিলদরিয়া আমুদে। গ্রামের সব উৎসব আনন্দে মনীন্দ্রই খরচাপাতি করে বেশি। পয়লা বৈশাখে, গলুইয়ার দিন যে তার বাড়ি যাবে, তাকেই ভরপেট মিষ্টি খাওয়াবে। যাত্রাথিয়েটারেও বেশি চাঁদা দেয় মনীন্দ্র। রাত জেগে পোলাপানের সঙ্গে নাটকও করেছে গেল বছর। মেদিনী মণ্ডলের এমন কোনও মানুষ নেই যার কাছে টাকা না পায় মনীন্দ্রে। সমেদের সংসারটাই তো চলেছে মনীন্দ্রর ওপর দিয়ে। তিন মেয়ের বিয়ে দিল সমেদ, সব মনীন্দ্রর টাকায়।

 কিন্তু রসটা আদায় করে নিয়েছে মনীন্দ্র। মেয়েগুলোর রাখেনি কিছু। মজিদ সব জানে। টুকির তো বিয়েই বন্ধ করে রেখেছিল মনীন্দ্র। কিছু তুকতাকও জানে সে। টুকির বিয়ে হয় না বিয়ে হয় না। দিন যায়। টুকির সম্বন্ধ আসে, ভেঙ্গে যায়। সব মনীন্দ্রর কারসাজি।

টুকির বিয়ে হয়ে গেলে তখন কে নিয়ে শোবে কী করে মনীন্দ্র।

কিন্তু একটা কথা ভেবে মজিদ বড় ভয় পায় আজকাল। টুকির যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, মংলা, দামলার সর্দার বাড়ির পোলা। সর্দাররা ডাকাতের বংশ। মংলা যদি জানতে পারে টুকি মনীন্দ্রর সঙ্গে শুত, তাহলে পয়লা টুকিকে তারপর মনীন্দ্রকে কচুকাটা করবে। আল্লারে কী যে হবে তাহলে!

মজিদ আর ভাবতে পারে না। বুকের ভেতর বর্ষার দামাল বাতাস ঢুকে যায়।

.

বাড়ি এসে মজিদ খুব অবাক। বুড়ো বাপ মা, জোয়ান ভাই দুটো হাত-পা ছাড়িয়ে বসে আছে। ঘাটে নৌকা বাঁধতে দৃশ্যটা দেখে মজিদ। টের পায় ঘরে দানাপানি নাই। মেজাজটা বিগড়ে যায় তার। বর্ষাকালটা এরকমই যায় তাদের। ভাই দুটোর কাজকাম থাকে না। বুড়ো বাপের তো শীতকাল ছাড়া কখনোই কাজকাম নেই। সারা বছর অবসর। শীতকালে তবু যাহোক দু চারটে কামকাজ পায় এখনো। বুড়োমানুষ, চোখে ভালো দেখে না। লোকেরা মুসলমানির কাজকাম আজকাল তাকে দিয়ে করতে ভয় পায়। কান্দিপাড়ার আফাজদ্দি খনকারের ছোট পোলাটার মুসলমানি করাল গেলবার। ঘা শুকোয় না পোলাটার। একমাস দেড়মাস সময় নিল। খনকার তাই নিয়ে ম্যালা গালাগাল করেছিল বাপটাকে।

 বাপটা নিজেও আজকাল আর সাহস পায় না। বয়স হয়েছে হাত পা কাঁপে। এক চোখে ছানি পড়েছে। তাছাড়া কাজিরপাগলায় সরকারি ডাক্তারখানা হয়েছে, লোকে আজকাল সেখানেই যায়। এসব ভাবলে মজিদের বড় মন খারাপ হয়। মজিদ খুবই সরলসোজা মানুষ। কোন ঝুটঝামেলায় সে নেই। পছন্দও করে না। মজিদ কখনও আগামীকালের কথা ভাবে না, গতকালের কথা ভাবে না। সে আছে আজকের দিনটি নিয়ে। মনীন্দ্রর বাড়ি কাজ করে যা পায় বাড়ি এসে বুড়োবুড়ির হাতে তুলে দেয়। তাছাড়া যখন যা হাতের কাছে পায়, মনীন্দ্রের বাড়ির চালটা ডালটা, আনাজটা চুরি নিয়ে আসে। সংসারে জন্যে এত যে করছে, তারপরও দুবেলা ঠিকঠাক মতন আহার না জুটলে মন খারাপ হবে না!

ঘাটে নৌকা বেঁধে উঠোনে ওঠতেই প্রথমে জ্বলজ্বলে চোখে মজিদের দিকে তাকাল বুড়ো মা বাবা, তারপর আবালের মতন ড্যাবড্যাবা চোখে জোয়ান ভাই দুটো। মজিদ ভেবেছিল একটু রাগারাগি করবে, বলবে, আমি কত টানুম তগো। টানতে টানতে মইরা যামু। আমারে তরা মইরা যাইতে কচ!

কিন্তু মুখগুলো দেখে কীরকম মায়া লাগে বলা হয় না।

মজিদ আবার নৌকায় চড়ে। রবাকে ডেকে বলে, বিয়ালে যাইচ।

কেমন করে যাবে রবা তা জানে। কোনও কথা বলে না। খুশিতে চারজন মানুষের চোখ এখন ঝলসাচ্ছে মজিদ বুঝতে পারে। রাতের বেলা গরমাগরম ভাত খাবে। রবা হয়তো এখন পুঁটি-টেংরাও যোগাড় করে ফেলবে কিছু।

মজিদের একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

.

বিকেলবেলা ধরাছি খেলা হয় ঠাকুরবাড়ি। বর্ষাকাল, মাঠঘাট সব জলের তলায়। গ্রামের ছেলেপান সব ধরাছি খেলার মাঠ পেয়ে ঠাকুরবাড়ি ভিড় করে। মনীন্দ্রও উৎসাহ দেয় তাদের। হাতাঅলা চেয়ার নিয়ে বসে খেলা দেখা। কত মানুষজন, কত নাও, কত কোষা! হল্লাচেল্লা। মজিদ এই বিকেলবেলাটা ঘরের কাজকাম করে কাটায়। উঠোন ঝাড়ু দেয়, ওষুধের আলমারি গুছিয়ে রাখে আর চোরা চোখে রান্নাঘরের বাড়তি জিনিসপত্র দেখে। কোনটা সরালে মনীন্দ্র টের পাবে, কোনটা সরালে পাবে না। ঠিক তখনি রান্নাঘরের পেছনদিককার জলে টাবুরটুবুর শব্দ হয়।

মজিদ বুঝতে পারে রবা এসেছে। কোনও কথা বলে না সে। দূরে গাছপালার আড়ালে ধরাছি খেলার মাঠটা একবার তাকিয়ে দেখে। খেলা খুব জমে গেছে। এখন এদিকে ভুলেও কেউ আসবে না। মজিদ আস্তেধীরে রান্নাঘরের পেছন দিকে যায়। সেখানে হাজার রকমের আগাছা জলের ওপর ভেসে আছে।

প্রথমে রবাকে চোখে পড়ে না মজিদের। কালো শরীরটা আগাছার জঙ্গলে ডুবিয়ে বসে আছে। দেখলে মনে হয় নিজেও আগাছা হয়ে গেছে রবা।

মজিদকে দেখে ঝোপের ভেতর থেকে গলা বের করে রবা। মজিদ কোনও কথা বলে না। আস্তে করে ডান হাতটা রবার দিকে বাড়িয়ে দেয়। রবা মাটির বিরাট একটা হাঁড়ি ঝোপের ভেতর থেকে টেনে বের করে মজিদের হাতে দেয়। মজিদ সাবধানে চারদিকে চায়।

তারপর রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে।

ঠাকুরের চাল থাকে কাঠের মাঝারি ধরনের একটা পিপায়। প্রায় ভর্তিই থাকে পিপা। আজও ছিল। মজিদ ঘরে ঢুকে দ্রুত আধ হাঁড়ি চাল ভরে রবার হাতে নিয়ে দেয়। দেখে রবা ভারি খুশি। দাঁত কেলিয়ে একটু হাসে। তারপর হাঁড়িটা জলের ওপর দিয়ে ঠেলে আস্তেধীরে মিলিয়ে যায়। রান্নাঘরের পেছনে মজিদ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। বুক কাপিয়ে ভারি দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার।

.

ভোররাতে ঘুম ভাঙে মনীন্দ্রের। জেগে প্রথমে বুঝতেই পারে না জেগে আছে না ঘুমিয়ে। আজকাল প্রায়ই এরকম হয়। রাতের বেলা হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙার পর অনেকক্ষণ বুঝতেই পারে না ঘুমিয়ে আছে না জেগে। কেন যে এরকম হচ্ছে। বয়স! মৃত্যুর কথা মনে হয় মনীন্দ্রের। তিন কুড়ির ওপর বয়স হল, আর কতকাল, আর কতকাল বেচে থাকবে মনীন্দ্র! মানুষ কতকাল বাচে। আয়ুর সুতো কতটা লম্বা মানুষের! ঘুম ভাঙার পর আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না মনীন্দ্রর। রান্নাঘরে শুয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে মজিদ। চারদিকের পৃথিবীতে কোনও শব্দ নেই। এই সময় জীবজগতের বেশির ভাগ প্রাণীই ঘুমোয়। ঘুমোয় গাছপালা। জেগে থাকে কীটপতঙ্গ, রাতচরা পাখি, ঝিঁঝি পোকা। যাদের বিষয়কর্মের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর প্রচুর ব্যবধান।

মনীন্দ্র তারপর বিছানা ছাড়ে।

সারারাত মাথার কাছে হারিকেন জ্বলে। ঘরের ভেতর নিবু নিবু হারিকেনের পাতলা আলোটা আছে। সেই আলোয় সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো লাগে।

 দরোজা খুলে বাইরে যায় মনীন্দ্র। বাইরে তখন শেষরাতের মিহিন জ্যোৎস্না পড়ে আছে। গাছপালার দীর্ঘ ছায়া পড়ে আছে। তুলতুলে একটা বাতাস আছে, বাতাসটা টুকির হাতের মতো মায়াময়। বেরোতেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। শরীরটা কেঁপে ওঠে মনীন্দ্রের। মনীন্দ্র খানিক আনমনা হয়ে থাকে। খেয়াল করে শোনে চারদিকের গাছপালায় ঝোপঝাড়ে ডাকছে ঝিঁঝি পোকা। দূরে কোথায় ডাকছে কী একটা পাখি। কি পাখি! শেষ রাতে ডাকে!

 মনীন্দ্র খেয়াল করে পাখির ডাকটা শোনে। কু কু করে থেকে থেকে ডাকছে। কুপাখি। পাখিটা চিনতে পেরেই চমকে চমকে ওঠে মনীন্দ্র। শরীরটা শীতকালের জলে নেমে যাওয়ার মতন বারকয়েক কেঁপে ওঠে তার। এই পাখিটা অশুভ। মানুষকে মৃত্যুর ডাক দিয়ে যায়। বুকটা তারপর কাঁপতে থাকে মনীন্দ্রের। সনাতনীর কথা মনে পড়ে। সনাতনী মারা গেছে ত্রিশ বছর। স্বামীর ভালোবাসা পায়নি, সেই দুঃখে কচি বয়সে গায়ে আগুন দিল। সনাতনীর জন্যে আজকাল যখন তখন কীরকম একটা দুঃখ হয় মনীন্দ্রের। নিজেকে বড় অপরাধী লাগে, বড় পাপী মনে হয়।

বইলাঅলা খড়মে চটর চটর শব্দ করে উঠোনে নামে মনীন্দ্র। খালি গা, গলায় পৈতে। দূরে কুপাখিটা তখনো ডাকছে। মিহিন জ্যোৎস্না আর গাছপালার অন্ধকারে তুলতুলে বাতাস সেই ডাক ছড়িয়ে দিচ্ছে দিকবিদিকে। এ ডাক মৃত্যুর ডাক। কার মরণডাক ডাকে পাখি!

মনীন্দ্র ডান হাতে পৈতেটা চেপে ধরে বিড় বিড় করে কৃষ্ণ নাম জপে। তারপর আস্তে ধীরে হেঁটে যায় পুজোর ঘরের দিকে।

 চারদিক খোলা চৌচালা ঘর। কিন্তু ঘরের মাঝখানে সাদা শাড়ি পরে কে অমন করে দাঁড়িয়ে আছে! চমকে ওঠে মনীন্দ্র। সনাতনী! চিৎকার করে সনাতনীকে ডাকতে যায় মনীন্দ্র। তার আগেই বুঝতে পারে ঘরের পেছন দিককার কলাঝোপের ওপর জ্যোৎস্না পড়ে মানুষের অবয়ব ধরেছে। সেই ছায়াটা এসে পড়েছে পুজোঘরের মাঝখানে।

আগে ভুল দৃশ্য দেখলে হাসত মনীন্দ্র। আজ হাসি পায় না। বুকের ভেতরটা কাঁপে। সনাতনীকেই যেন দেখল সে। কলাগাছের পাতার ভেতর কীরকম যেন মিলিয়ে গেল। সনাতনী কি তাকে ডাকতে এসেছিল?

ভয় করে মনীন্দ্রর। তিন কুড়ির ওপর বয়েস হল, আর কতকাল!

রান্নাঘরে তখনও নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে মজিদ। দূরে মোরগের বাগ, কোড়লের বাগ। আস্তে ধীরে জাগছে পৃথিবী, জীবজন্তু, গাছপালা। কুপাখিটা আর ডাকে না। মিহিন জ্যোৎস্না গুটিয়ে নিয়েছে চাঁদ। গাছপালা থেকে অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে। আর একটি দিন শুরু হল। কিন্তু মনীন্দ্রের আজ ভাল্লাগে না। মনটা কু ডাক ডাকে।

.

দুপুর থেকেই সাঙ্গাত নিয়ে বসেছে মানুষটা। সাঙ্গাতরা গাঁজা ডলছে আর কল্কিতে ভরছে, মানুষটা হরদম টেনে যাচ্ছে। একফাঁকে ডেকে ভাত খাইয়ে দিয়েছে টুকি। মংলা কী উঠতে চায়! টুকি হাত ধরে গাঁজা টেনে এনেছে, ভাত খাইয়া লও। তার বাদে যত ইচ্ছা গাঁজা টাইন্নো। মংলা তবু উঠতে চায় না দেখে তার সাঙ্গাত নশা একটু ঠেলা দিয়ে জড়ানো গলায় বলেছে, যাও ওস্তাদ, বাত খাইয়া আহ। বউ আদর কইরা ডাকতাছে!

টুকির সংসারে আরো দুজন মানুষ আছে। শ্বশুর শাশুড়ি। তারা ধাইধা গেছে মেয়ের বাড়ি বেড়াতে। কদিন পর ফিরবে তার ঠিক নেই। শাশুড়ি বাড়ি থাকলে মানুষটা বাড়ির ভেতর বসে এরকম রাতদিন গাঁজা টানতে পারত না। শাশুড়ি ঝাড়ু নিয়ে যেত পেটাতে।

টুকি অতটা পারে না। মংলা বদরাগী মানুষ। লেংড়াখোঁড়া মানুষরা একটু বদরাগীই হয়। তাছাড়া টুকির এখন শরীর ভারি, আট মাস চলছে। আগে হলে বাচ্চা মেয়ের মতন জোর করতে পারত। এখন পেটের ভারে চলাচল ধীর হয়েছে টুকির। লাফঝাঁপ বন্ধ হয়েছে। তবু মংলাকে হাত ধরে টেনে নিয়েছে ভাত খেতে।

খাওয়া শেষ করে মংলা আবার বসেছে গাঁজার আড্ডায়। চোখ দুটো এখন কোড়াপাখির চোখের মতন লাল দেখাচ্ছে তার। টুকি পাটাতন ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখেছে। তারপর পাটাতনের ওপর হোগলা বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে। আজকাল যখন তখন ঘুম পায় টুকির। ক্ষণে ক্ষণে অবশ হয়ে আসে শরীর। বিলকুমড়োর মতন পেটটা বেজায় ভারি, বইতে কষ্ট হয়।

টুকির কী হবে, ছেলে না মেয়ে! একটা ছেলের ভারি শখ টুকির। মনীন্দ্রের মতন টুকটুকে ফর্সা, বড় বড় চোখ, দামাল প্রকৃতির একটা ছেলে যদি টুকির হত!

হবে না। টুকির পেটে তো এখন মনীন্দ্ররটা নয়, মংলারটা। ছেলে হোক মেয়ে হোক মংলার মতনই হবে দেখতে। ভূষিকালো, নাক থ্যাবরা। আবার লেংড়াখোঁড়া না হয়! এই ভয়ে দিনরাত সিঁটিয়ে থাকে টুকি। ছেলে বা মেয়ে যাই হোক মংলার মতন লেংড়া খোঁড়া যদি হয়, এই ভয়ে কেবল ঘুম পায় টুকির।

.

বিকেলের দিকে মংলার ডাকে ঘুম ভাঙে টুকির। ওড বউ, বেইল গেল।

টুকি ধড়ফড় করে উঠে বসে! অনেকক্ষণ ঘুমোবার ফলে চোখ দুটো ফুলে গেছে। তবু খেয়াল করে মংলাকে দেখে। কালো শরীরে কালো রঙেরই পিরান পরেছে, কোমরে লাল গামছা বাঁধা। দেখেই টুকি বোঝে সাঙ্গাত নিয়ে মংলা কোথাও বেরুচ্ছে।

 টুকি জিজ্ঞেস করে, কই যাইতাছ?

মংলা বলল, মেদিনীমোণ্ডল যামু।

নিজ গ্রামের নাম শুনে টুকি একটু চমকায়। তারপর খুশি হয়ে বলল, আমারে নিবা? ইট্টু বেড়াইয়া আইতাম!

মংলা বিড়ি টানতে টানতে বলল, না, তরে অহন কোনহানে লইয়া যাওন ঠিক অইব না। আছার ওছার খাইলে প্যাড নষ্ট অইয়া যাইব।

আছার খামু না।

তুই জানস আছার খাবি না!

টুকি এবার থেমে যায়। জানে এখন আর কোনও কথা বললেই রেগে যাবে মংলা। মনীন্দ্রের ব্যাপারটা টের পেয়েছে মংলা। একদিন টুকিকে জিজ্ঞেসও করেছিল; ঠাকুরের লগে তর বলে খাতির আছিল!

কে কইছে?

আমার লগে মিছা কথা কবি না।

 টুকি তখন উপায় না দেখে ফোঁস ফোঁস করে কেঁদেছে। কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, আমারে তুমি অবিশ্বাস কর?

মংলা আর কোনও কথা বলেনি। কিন্তু মংলার কথা না বলার মানে টুকি বুঝতে পেরেছে।

 ঠাকুরকে একদিন দেখে নেবে মংলা। সুযোগ পেলেই দেখে নেবে।

সেই থেকে ভয়ে ভয়ে আছে টুকি। মংলা আজ মেদিনীমণ্ডল যাচ্ছে শুনে বুকের ভেতরটা হঠাৎ কাঁপতে শুরু করেছে তার। মনীন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে না তো মংলা! শুনে টুকি কেমন একটু রসিকতা করে, কেঐর গলা কাডতে যাইতেছনি। শুনে খ্যাক খ্যাক করে হাসে মংলা, কামই তো মাইনষের গলা কাডন!

নশা তখন উঠোনে দাঁড়িয়ে ডাকে, নাও আইছে ওস্তাদ। লও বাইর অই।

.

বাঁশঝাড়ের ভেতর ছিপ নাওটা ঢুকিয়ে সাবধানে তিনজন মানুষ নামে। জলে কাদায় মৃদু শব্দ হয়। শব্দ বাঁচিয়ে আস্তেধীরে এগোয় তারা। পচা বাশপাতায় মশার রাজত্ব। অবিরাম ভ্যানভ্যান শব্দ করছে তারা। ঝাঁক বেঁধে মানুষগুলোকে কামড়ায়। মানুষগুলো পরোয়া করে না, শব্দ করে না। তাদের তিনজনের হাতে তিনটে রামদা জ্যোৎস্নায় বিদ্যুতের মতন চমকায়।

পায়ের কাছ দিয়ে সড়সড় করে পিছলে যায় গিরিগিটি কিংবা রক্তচোষা। তিনজন মানুষ একত্রে থামে। এখান থেকে মনীন্দ্রর ঘর উঠোন সব স্পষ্ট দেখা যায়। দুএকদিন আগে পূর্ণিমা হয়ে গেছে। চাঁদের আলো এখনও ম্লান হয়নি। চরাচর ধুয়ে যাচ্ছে জ্যোত্সায়। বাঁশঝাড়ের অন্ধকার ভেঙে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে চারদিকে। তবু ঘুপটি মতন একটা জায়গা খুঁজে বসে তিনজন। মনীন্দ্রর ঘরের দিকে চোখ রেখে বসে থাকে।

কোমর থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করল মংলা। রামদাটা রাখল পায়ের কাছে। তারপর দুই সাঙ্গাতকে দুটো দিয়ে নিজেও সাবধানে ধরাল। টানতে লাগল।

 মনীন্দ্রর ঘরে জনা চার পাঁচ লোক বসে আছে। মনীন্দ্র বিছানার ওপর শোয়া। কান পাতলে দু একটা টুকরোটাকরা কথার শব্দও পাওয়া যায়।

মংলা উদগ্রীব হয়ে কথা শোনে।

দূরে কোথায় তখন কী একটা পাখি ডেকে ওঠে। ঝিঁঝির ডাক তো আছেই। আর আছে। জ্যোৎস্না, চাপিলা মাছের মতন চকচকে জ্যোত্সা। বর্ষার ফলে বাঁশঝাড়ের ভেতর শোল গজার কিংবা ইঁদুরলোভী বোয়াল ঘাই দিয়ে যায়। মংলার তিনজন এসবের কিছুই খেয়াল করে না। চোরাস্রোতের মতো বয়ে যায় সময়।

মনীন্দ্রের ঘরের লোকগুলো ওঠে অনেক রাত করে। ঘাট থেকে একে একে ছেড়ে যায় অনেকগুলো নাও। মনীন্দ্র উঠে একবার বাইরে আসে। বাঁশঝাড়ের কাছে বসে, জল বিয়োগ করে যায়। মংলারা অন্ধকার হয়ে বসে থাকে। মনীন্দ্র দেখে না। চেঁচিয়ে মজিদকে বলে, যা তাড়াতাড়ি খাইয়া আয়গা মজিদ।

তারপর ঘরে গিয়ে ঢোকে।

তারও কিছু পর নাও ছাড়ে মজিদ। দূরে তার বৈঠার শব্দ মিলিয়ে যেতেই তিনজন মানুষ গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। নিঃশব্দে বাঁশঝাড় থেকে বেরোয়। জ্যোত্সায় হাতের রামদা চকচক করে তাদের।

আজ সারাদিন মনটা বড় খারাপ গেছে মনীন্দ্রের। ভোররাতে কুপাখির ডাকে ঘুম ভেঙেছে। তারপর পুজোর ঘরে কলাপাতা দেখল সনাতনী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই থেকে মনটা বড় কু ডাক ডাকছে। আজ কোনও রোগীবাড়ি যায়নি মনীন্দ্র। সারাদিন শুয়ে থেকেছে ঘরে। বিকেলবেলা পোলাপান এসেছে ধরাছি খেলতে, মনীন্দ্র দেখতেও যায়নি। সন্ধ্যের পর নিয়মিত আড্ডা দিতে এসেছে গ্রামের লোকজন। মনীন্দ্র বড় একটা কথা বলেনি। শুয়ে শুয়ে বই পড়েছে। দুএকজন জিজ্ঞেস করেছে, কত্তার কি শইল খারাপ?

মনীন্দ্র জবাব দেয়নি। আড্ডায় মজা ছিল না দেখে খানিক আগে বেরিয়ে গেছে সবাই। মজিদও গেছে খেতে। এখন এত বড় বাড়িটায় মনীন্দ্র একলা। রাত হয়েছে বেশ। একটু একটু ভয় করে মনীন্দ্রের। মজিদটা যে আজ কেন এত দেরি করছে ফিরতে।

হোমিওপ্যাথির বইটা চোখের ওপর খুলে শুয়ে থাকে মনীন্দ্র। মাথায় এক বর্ণও ঢোকে না। অকারণে বুকটা বার দুই কাঁপে।

 ঠিক তখনই মৃদু পায়ের শব্দ হয় ঘরের ভেতর। চমকে চোখ তুলে তাকায় মনীন্দ্র। দেখে তিনজন মানুষ, হাতে চকচকে রামদা তাদের, মুখে কালো কাপড় বাঁধা। দেখেই বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা দ্রুত লাফিয়ে ওঠে, মুখ দিয়ে গলা দিয়ে কোনও শব্দ বেরোয় না মনীন্দ্ররে। আনমনে ওঠে বসতে চায় সে, পারে না। তার আগেই ঘাড় বরাবর রামদা এসে পড়ে। ওক করে সামান্য একটু শব্দ করে মনীন্দ্র। তারপর বিছানার ওপরই হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

ঠিক তখুনি মনীন্দ্রর বাড়ির পূর্বকোণের বিশাল দেবদারু গাছে বসে প্রাচীন কোড়লপাখিটা কুউক কুউক করে বাগ দিয়ে ওঠে। পাশের বাড়ির বুড়ি আতবী স্বামীর বুকে আদা তেল মালিশ করতে করতে টের পায় নিজের বুকেও মৃদু একটা ব্যথা হচ্ছে। তার। দূর দামলায় একা ঘরে শুয়ে ঘুমের ভেতর কেঁদে ওঠে টুকি। মজিদ গান গাইতে গাইতে ফিরে আসছিল, আমার এমুন জনম আরকি হবে, মানুষ দেখতে এসেছিলাম ভবে। হঠাই গলা আটকে যায় মজিদের। কেউ ঠিকঠাক বোঝে না এসবের কী অর্থ। হায়রে মানুষ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *