• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Book । বাংলা লাইব্রেরি

Read Bengali Books Online @ FREE

  • লেখক
  • অনুবাদ
  • সেবা
  • PDF
  • Bookmarks

লেখক

অনুবাদ

সেবা

কৌতুক

লিরিক

ডিকশনারি

PDF

Bookmarks

জাত গোক্ষুর – ০৫

লাইব্রেরি » সেবা প্রকাশনী » মাসুদ রানা সিরিজ » জাত গোক্ষুর » জাত গোক্ষুর – ০৫

গেটের দিকে শেষ পঞ্চাশ গজ ধীরগতিতে গাড়ি চালাল ওরা। গেটে দাঁড়ানো লোকটা কঠিন চোখে ল্যান্ড রোভারের দিকে তাকিয়ে আছে। পরনের খাকি ইউনিফর্ম ঘামে ভেজা, কাঁধ থেকে ঝুলছে একটা অটোমেটিক রাইফেল। ওটা নামাল সে, বাগিয়ে ধরে অ্যাকশনের জন্যে তৈরি করল নিজেকে।

‘এই লোককে বোকা বানিয়ে ভেতরে ঢুকতে না পারলে অসুবিধে আছে,’ তারানা ও বাকারাকে বলল রানা। ‘কাজেই কেউ মাথা গরম কোরো না।’

তারানা মাথা ঝাঁকাল।

‘ঠিক আছে,’ বলল বাকারা। সে-ও অস্ত্র লুকাবার জন্যে বুশ জ্যাকেট পরেছে। রানার কাছে অস্ত্র বলতে ওয়ালথার আর ছুরি। কিন্তু বাকারা রীতিমত আগেড়বয়াস্ত্রের একটা গুদাম। তার কাছে এক জোড়া ল্যুগার ছাড়াও রয়েছে একটা স্টার্লিং পয়েন্ট থ্রী-এইট পিপিএল অটোমেটিক রিভলভার, থ্রোয়িং নাইফ ও গ্যারট। এত কিছুর দরকার ছিল? রানার এই প্রশ্ন শুনে সগর্বে উত্তর দিয়েছে সে, ‘ভাববেন না এ-সব আত্মরক্ষার জন্যে। নিজেকে বাঁচাবার জন্যে খালি হাতই যথেষ্ট মনে করি। এগুলো আসলে কুকুর-বিড়াল মারার যন্ত্র। আবু ইসহাক ইমাম সালেহ আমাদের পরবর্তী নেতা হতেন, ইহুদিরা মারকাসকে দিয়ে তাঁকে হত্যা করেছে। কাজেই মারকাস আর তার সঙ্গী-সাথীদের কুকুর-বিড়ালের মত গুলি করে মারব আমি।’

বাকারার রাগটা কোথায়, রানা বোঝে। তাই আর কথা বাড়ায়নি।

গার্ডের কাছ থেকে দশ ফুট দূরে থামল ল্যান্ড রোভার। হুইলের পিছনে রানা, গলা চড়িয়ে ইংরেজিতে বলল, ‘হ্যালো, দেয়ার!’

অত্যন্ত সাবধানে হেঁটে এসে রানার জানালার পাশে দাঁড়াল গার্ড। চেহারা দেখেই বোঝা যায় নীচ প্রকৃতির লোক, হাত ও মুখে শুকনো ক্ষতর কোন অভাব নেই। রানার হাসির উত্তরে হাসল না। ‘এখানে কি দরকার আপনাদের?’ কর্কশ গলায় প্রশ্ন করল, সন্দেহভরা চোখে গাড়ির ভেতর তাকাচ্ছে। ‘জানেন না, বিনা অনুমতিতে প্রাইভেট প্রপার্টিতে ঢোকা অপরাধ?’

‘দূর ব্যাটা!’ হেসে উঠল রানা। ‘তুই একটা ছাগল। আরে গাধা, আমরা তো আকার্ডিয়া মারকাসের বন্ধু।’

রানার মুখটা খুঁটিয়ে দেখল সে। ‘আমি আগে কখনও আপনাকে দেখিনি। আপনাদের পরিচয় বলেন।’

নিজেদের বানানো নামগুলো গড়গড় করে মুখস্থ বলে গেল রানা। ‘কাবুল থেকে আসছি,’ হাসিমুখে বলল। ‘আমরা “ইউনিকর্ন ক্লাব”-এর সদস্য।’ ইউনিকর্ন ক্লাব একটা আন্তর্জাতিক সংগঠন, মারকাসের প্রতিদ্বন্দ্বী ড্রাগ ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত। রিয়ো থেকে কাবুল, কোথায় না এদের শিকড় ছড়িয়ে আছে। রানা এজেন্সির রিয়ো শাখার কাছে খবর আছে, কিছু দিন থেকে এই ক্লাবটাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে মারকাস।

‘ইউনিকর্ন ক্লাবের সদস্য হলে,’ গার্ড জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে কেন এসেছেন আপনারা?’

‘মারকাস আমাদেরকে দাওয়াত দিয়েছে,’ বলল রানা। ‘তুই ব্যাটা বজ্জাত,’ এখন আর হাসছে না, চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে, ‘আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে চাস? মারকাসকে বলে আমি তোর বারোটা বাজাব।’

লোকটা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল রানার দিকে। ‘প্ল্যানটেশনে মিস্টার মারকাস নেই। তিনি ব্যবসার কাজে বিদেশে গেছেন।’

‘বলেও ছিল যে বিদেশে যেতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদেরকে চসেসা গনজালেসের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’ রানা মারকাসের বিশ্বস্ত ডান বা বাম হাতের নামও জানে, এই ব্যাপারটা গার্ডকে প্রভাবিত করল। চিবুক চুলকে কি যেন চিন্তা করল সে, তারপর বলল, ‘ঠিক আছে, এখানে অপেক্ষা করুন।’

গেটের দিকে ফিরে যাচ্ছে গার্ড, তার প্রতিটি নড়াচড়া তীক্ষ্নদৃষ্টিতে পরীক্ষা করছে ওরা তিনজন। ছোট একটা ছাদের নিচে ঢুকল সে, টেবিল থেকে ওয়াকি-টকি তুলল। ছাদ মানে বেড়ার চাল, দেয়াল বলে কিছু নেই, কয়েকটা বাঁশের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে ছাদটা। ওয়াকি-টকিতে দু’মিনিট কথা বলল সে। আরও এক মিনিট শুনল। তারপর সেটা টেবিলে রেখে ল্যান্ড রোভারের পাশে ফিরে এল। ‘আপনারা ভেতরে ঢুকতে পারেন। বাড়ির ঠিক সামনের জায়গাটায় গাড়ি থামাবেন। আপনাদের সঙ্গে বাইরে দেখা করা হবে।’

‘বেশ,’ বলল রানা।

তার দিয়ে তৈরি গেট খুলে দিল গার্ড। রাইফেলটা কাঁধে না ঝুলিয়ে এখনও হাতে রেখেছে সে, লক্ষ করল রানা। ইঙ্গিতে গেটের ভেতর ওদেরকে ঢুকতে বলল লোকটা।

গাড়ি ছেড়ে দিয়ে তারানা ও বাকারাকে বলল রানা, ‘শুরু হলো কিন্তু!’

ল্যান্ড রোভার ভেতরে ঢুকতেই ওদের পিছনে গেট বন্ধ হয়ে গেল। গেটে তালা দেয়া হচ্ছে দেখে সেদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল বাকারা। মেটো পথ, তবে কাঁকর ছড়ানো। ড্রাইভওয়েটা সুন্দর। খানিক পর পর পাতাবাহারে ঢাকা খিলান আকৃতির তোরণ। লনে মর্মর পাথরের দেবদেবীদের নগড়ব মূর্তি, কাঠের বেঞ্চ। দালানটার সামনে ফাঁকা জায়গা, বেশ চওড়া, এখানেই ল্যান্ড রোভার দাঁড় করানো হলো। গাড়ি থেকে নামছে ওরা, দালানের ভেতর থেকে চারজন লোককে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। রানা গাড়ি থামিয়েছে ওদের আর গেটে দাঁড়ানো গার্ডের মাঝখানে।

ওদের সামনে যে-চারজন লোক এসে দাঁড়াল তারা প্রত্যেকে সভ্যজগতের জন্যে অভিশাপ, বুঝতে অসুবিধে হয় না, নিরীহ মানুষ খোদ শয়তানের চেয়েও বেশি ভয় পায় এদেরকে। একজনকে রানা চেনে, বিসিআই কমপিউটরে তার ছবি ও রেকর্ড আছে। তিনজন বয়সে তরুণ, হাবভাব আর চেহারা-সুরত বলে দিচ্ছে এরা একই বৃন্তের ফুল। চারজনের মধ্যে একজন ব্রাজিলিয়ান, বাকি তিনজন গ্রীক। একজন আবার হিপ্পি, হাতে ইস্পাতের বালা, চুল কাঁধ ছাড়িয়ে নেমে এসেছে প্রায় কোমর পর্যন্ত। এদের পরনে শার্ট ও ট্রাউজার। সুট পরে আছে শুধু একজন; লম্বা-চওড়া কাঠামো, মুখটা প্রকাণ্ড, ছোট করে ছাঁটা মাথার চুলে একটু পাক ধরেছে। একে চিনতে পেরেছে রানা-চসেসা গনজালেস, জেল পলাতক ব্যাংক-ডাকাত; নিরাপত্তার অভাব হেতু এথেন্স থেকে পালিয়ে মারকাসের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। অপর তিনজন গনজালেসের বডিগার্ড। তিনজনই তারা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সম্ভাব্য সব দিক থেকে ওদেরকে কাভার দিচ্ছে। নিজেদের ও গেটের গার্ডের মাঝখানে ল্যান্ড রোভারকে রাখতে পারায় রানা খুশি। গেট থেকে ওদের দূরত্ব প্রায় ত্রিশ গজ।

‘মিস্টার গনজালেস?’ কাঁচাপাকা মাথার দিকে তাকাল রানা।

‘দ্যাট ইজ কারেক্ট,’ পরিষ্কার ইংরেজিতে জবাব দিল গনজালেস। ‘মিস্টার আকার্ডিয়া মারকাসের সঙ্গে দেখা করতে চান, ব্যাপারটা কি?’

বাকারা আর হিপ্পি পরস্পরের ওজন নিচ্ছে। ব্রাজিলিয়ান কোমর থেকে পিস্তল ড্র করার অজুহাত খুঁজছে, আক্ষরিক অর্থেই নিশপিশ করছে তার ডান হাতের মধ্যমাটা। গম্ভীর চেহারার তৃতীয় গার্ড তারানার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না।

‘তিনি আমাদেরকে এখানে দাওয়াত দিয়েছেন,’ স্বাভাবিক, শান্ত ভঙ্গিতে বলল রানা। ‘আমরা তাঁকে আনকাট হেরোইনের একটা চালান অফার করেছিলাম। আমাদের দু’জন ডিলার হঠাৎ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ায় চালানটা নিতে পারছিল না। ব্যাপারটা আপনাকে নিশ্চয় জানিয়েছেন মারকাস।’

রানার দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল গনজালেস। ‘না,’ বলল সে। ‘আপনি আফগান। ইউনিকর্ন ক্লাবে কোন আফগান সদস্য আছে, এ আমার জানা নেই।’

‘জানার কোন শেষ নেই, তাই বলে জানার চেষ্টাটাকে বৃ া মনে করবেন না,’ বলল রানা। ‘এখানে আমরা তিনজনই আফগান, তবে একা শুধু আমিই ইউনিকর্ন ক্লাবের সদস্য।’

‘আপনার সঙ্গিনী বোরকা পরেননি কেন?’

‘কারণ এখানে তালেবানরা নেই।’

‘কিন্তু আপনাদের পাগড়ি কোথায়?’

রানার বদলে জবাবটা দিল তারানা, ‘পাগড়ি ফেলে দেয়া হয়েছে, আপনার চুলের মত।’

চোখ সরু করে তারানার দিকে তাকাল গনজালেস। তার হাসিটা ক্ষণস্থায়ী ও কর্কশ। ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং,’ মন্তব্য করল সে, তারানা আর বাকারাকে পালা করে দেখছে। ‘বেশ। মানে, হ্যাঁ, ব্যবসা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমাদের রোদ থেকে সরে যাওয়া উচিত, তাই না?’

‘আইডিয়াটা ভাল,’ বলল রানা। ওর ইচ্ছা ভেতরে ঢোকার পর যেভাবেই হোক গনজালেসকে বাকি লোকগুলোর কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরাতে হবে।

কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে গড়াতে শুরু করল। অকস্মাৎ বাড়ির ভেতর থেকে আরেকজন লোক বেরিয়ে এল। রানা আর তার চোখ এক হলো, মুহূর্তে পরস্পরকে চিনতে পারল ওরা। লোকটা কোলোসস ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কোম্পানির কার্লোস মোলাডো।

‘কি ঘটছে এখানে?’ গনজালেসকে প্রশ্ন করল সে। ‘এই লোকটা তো আমাদের শহরের অফিসেও ঢুকেছিল,’ রানার দিকে একটা হাত তুলে দেখাল। ‘ওর পিছনে একজন লোককে পাঠিয়েছিলাম, ফেরেনি সে।’

রানার দিকে স্থির গনজালেসের চোখ সরু হয়ে যাচ্ছে। হিপ্পি তার কোমর থেকে রিভলভারটা টেনে নিল।

‘অ্যাঁ! তাই নাকি!’ বিড়বিড় করল গনজালেস। রানা, তারানা ও বাকারা, পালা করে তিনজনকেই দেখছে সে। ‘আসলে তোমরা কে?’

মোলাডোর দিকে তাকিয়ে ছিল রানা, চোখ ফেরাল গনজালেসের দিকে। একজন বাদে বাকি কেউ অস্ত্র বের করেনি।

‘নিজের সম্পর্কে যা বলেছি, আমি তাই। আমরা সবাই তাই। এখন বলো, ব্যবসা হবে, নাকি হবে না?’

‘বৈধ ইমপোর্টার সেজে কোলোসস-এ কেন গিয়েছিল ও?’ জিজ্ঞেস করল মোলাডো। ‘ও কি এখনও বলছে যে জাপানি ক্যামেরা চায়?’

‘না,’ ধীরে ধীরে বলল গনজালেস। ‘ঠিক তা বলছে না। আপনি ভেতরে আসতে পারেন, মিস্টার…’

‘শেখ মাসুদ,’ বলল রানা।

‘মিস্টার মাসুদ। তবে প্রথমে আমরা চেক করে দেখব আপনাদের কাছে অস্ত্র আছে কিনা।’

চোখের কোণ দিয়ে রানা দেখতে পাচ্ছে কঠিন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল বাকারা। নিরস্ত্র হতে রাজি নয় সে, রানাও তারই পক্ষে। লোকগুলো ওদের অস্ত্র নিয়ে নিলে একজনও ওরা এখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না। বাকারার দিকে তাকাল রানা, ধরে নিল ওর দৃষ্টি দেখে যা বোঝার বুঝে নেবে সে। ‘ঠিক আছে, মিস্টার মোলাডো,’ বলল ও, হাত বাড়াল ওয়ালথারটা বের করার জন্যে।

‘উঁহুঁ,’ মোলাডো হাত তুলে বাধা দিল। ‘ওটা আমি বের করে নিচ্ছি, মিস্টার মাসুদ।’

রানা ঠিক এটাই চাইছিল, পিস্তলটা বের করে নেয়ার জন্যে মোলাডো এগিয়ে আসবে। জ্যাকেটের ভেতর হাত গলাচ্ছে সে, ঠিক এমনি সময়ে এক হাতে তার গলাটা পেঁচিয়ে ধরল রানা। হিপ্পিটা রানার মাথায় পিস্তল তাক করল, কিন্তু বাকারা ল্যুগার বের করছে দেখে সেদিকে ঘুরে গেল পিস্তলের মাজল। একটাই গুলি হলো, বসে পড়ায় বাকারাকে লাগল না। পরমুহূর্তে বাকারার হাতেও গর্জে উঠল ল্যুগার। একটা খিলানের গায়ে ছিটকে পড়ল হিপ্পি, মাটিতে পড়ার আগেই মারা গেছে।

পরবর্তী ঘটনাগুলো চোখের পলকে এত দ্রুত ঘটে গেল, মনে হলো সব একসঙ্গে ঘটছে। চিৎকার করে বাকারাকে গুলি করতে নিষেধ করল রানা, কিন্তু ইতিমধ্যে দেরি হয়ে গেছে। একবার শুরু করার পর বাকারা যেন নিজেকে আর সামলাতে সক্ষম নয়। ব্রাজিলিয়ান ও বয়স্ক গ্রীক গার্ড, ওদের সঙ্গে তারানাও, অস্ত্র বের করছে। মোলাডো ঘুরে গিয়ে দালানের দিকে ছুটল, বাকারার বুলেট গুঁড়িয়ে দিল তার শিরদাঁড়া। আহত পশুর মত কাতরে উঠল মোলাডো, দড়াম করে আছাড় খেলো কাঁকর ছড়ানো ড্রাইভওয়েতে।

‘অস্ত্র ফেলো, তা না হলে গনজালেস মারা যাবে,’ বাকি দুই বডিগার্ডকে বলল রানা, একহাতের ছুরি গনজালেসের গলায় ধরা। ওদের পিছনের গেট থেকে গার্ডের উত্তেজিত চিৎকার ভেসে আসতে শুনল ও।

ব্রাজিলিয়ান ছোকরা স্থির হয়ে গেল, কিন্তু বয়স্ক বডিগার্ডের হাতে বেরিয়ে আসা পিস্তল গর্জে উঠল। ল্যান্ড রোভারের পাশে দাঁড়িয়ে পার্স থেকে বেলজিয়ান রিভলভার বের করছে তারানা। বডিগার্ডের বুলেট বাকারার বুকে লাগল। চরকির মত আধ পাক ঘুরে গাড়ির গায়ে ধাক্কা খেলো বাকারা।

লক্ষ্যস্থির করে একটাই গুলি করল তারানা। বয়স্ক বডিগার্ড একহাতে তলপেট খামচে ধরে কুঁজো হয়ে গেল, চিৎকার করছে। কাত হয়ে ঢলে পড়ার আগে তার হাতে আরও দু’বার গর্জে উঠল পিস্তলটা, তবে শুধু ধুলোই উড়ল, কাউকে লাগল না।

এ-সব দেখে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল গনজালেস। রানার মনোযোগ অন্যদিকে, বুঝতে পেরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছুরি ধরা ওর হাতটা নিজের গলা থেকে সরিয়ে দিল, একই সঙ্গে পিছন দিকে পা ছুঁড়ে লাথি মারল রানার হাঁটুর নিচে। ব্যথা পেল রানা, ঢিল পড়ল অপর হাতেও। এই সুযোগে ওর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছে গনজালেস, ওর ছুরি ধরা হাত গায়ের জোরে মোচড়াতে চাইছে। ছুরিটা খসে পড়ল। গাড়ির পাশে আছাড় খেলো গনজালেস রানাকে সঙ্গে নিয়ে।

এ-সব দেখে স্থির ব্রাজিলিয়ান আর স্থির থাকতে পারল না, ডাইভ দিয়ে মাটিতে পড়ার সময় অস্ত্রটা বের করে ফেলল। তারানা গুলি করল, কিন্তু লাগল না। পাল্টা গুলি করে তারানার কাঁধের পাশে ল্যান্ড রোভারে একটা ফুটো তৈরি করল সে। তারানার বিপদ দেখে গনজালেসকে ঠেলে সরিয়ে দিল রানা, পিছনের মাটি হাতড়ে ছুরিটা তুলল, তুলেই কব্জিতে প্রচণ্ড এক ঝাঁকি খাইয়ে ছুঁড়ে দিল ব্রাজিলিয়ান ছোকরার দিকে। ছোকরা আবার তারানার দিকে লক্ষ্যস্থির করছে, এই সময় তার বুকে আঘাত করল ছুরিটা। চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল, পিস্তল গর্জে উঠে দু’জনের মাঝখানে খানিকটা ধুলো ওড়াল। ছুরির হাতল ধরে ঢলে পড়ল সে।

গনজালেস ক্রল করে এগিয়ে এসে চোখে আঙুল ঢোকাবার চেষ্টা করছে, এই সময় রানা শুনতে পেল ওদের পিছনে গেট খুলে যাচ্ছে। ওর ঘুসি খেয়ে ফুঁপিয়ে উঠল গনজালেস, চোয়ালের হাড় ভেঙে গেছে। রানার অপর হাত তার নাকটাও ভেঙে দিল। হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে আরও মার খাওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেল সে।

‘সাবধান!’ বাকারার ক্ষীণ কণ্ঠ শুনতে পেল ওরা। ঘুরতেই রানা দেখল, গুলিটা তাকে খুন করেনি। টলমল পায়ে সিধে হচ্ছে সে, তাকিয়ে আছে গেটের দিকে।

‘শুয়ে পড়ো!’ তারানাকে নির্দেশ দিল রানা, ল্যান্ড রোভারের পাশে এবং ওর খুব কাছাকাছি রয়েছে সে।

গার্ড গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে সাবমেশিনগানটা ওদের দিকে তাক করল। দাঁড়াতে পারল বাকারা, হাতের ল্যুগার গার্ডের দিকে তুলছে, কিন্তু গার্ডই তাকে আগে পেয়ে গেল। প্রথম এক ঝাঁক বুলেট বাকারার পায়ের পিছনে ধুলো ওড়াল। পরবর্তী ঝাঁকটা ঝাঁঝরা করে দিল তার বুক।

শরীরটাকে গড়িয়ে দিয়ে ল্যান্ড রোভারের তলায় ঢুকে পড়ল রানা, হাতে বেরিয়ে আসা পিস্তল তুলে অপেক্ষা করছে গার্ড কখন ওর দৃষ্টিপথে বেরিয়ে আসবে।

তারানা ক্রল করে সরে আসছে, ছুটে এসে তার দিকে সাবমেশিনগান তাক করল গার্ড। ল্যান্ড রোভারের তলা থেকে পর পর দুটো গুলি করল রানা তার বুকে। গার্ড পড়ে গেল, সেই সঙ্গে অকস্মাৎ প্রায় ভৌতিক একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো গোটা প্ল্যানটেশনে।

গাড়ির তলা থেকে বেরিয়ে এসে তারানাকে সিধে হতে সাহায্য করল রানা, দু’জনেই ধুলো মেখে প্রায় সাদা হয়ে গেছে। গনজালেস নড়ছে দেখে কয়েকটা চড় কষল রানা, তারপর পিস্তল দিয়ে হালকা একটা বাড়ি মারল দাঁতে। ‘বলো, বাড়ির ভেতর ডাফু সালজুনাসকে ক’জন গার্ড পাহারা দিচ্ছে?’

উত্তর দিতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো গনজালেস, ইঙ্গিতে দেখাল তার চোয়াল ভেঙে গেছে। পিস্তল দিয়ে ওই ভাঙা চোয়ালেই বাড়ি মারল রানা। ‘ক’জন?’

দুর্বল একটা হাত তুলে দুটো আঙুল দেখাল গনজালেস। তারানার দিকে ফিরে রানা বলল, ‘এখান থেকে নড়বে না। সাবধান, একে পালাতে দিয়ো না।’

কথা না বলে মাথা ঝাঁকাল তারানা। সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে।

খিলানের নিচে দিয়ে দালানের ভেতর ঢুকল রানা। সদর দরজা হাঁ-হাঁ করছে। হলরূমে ঢুকতে যাবে, একটুর জন্যে লোকটার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো না। দু’জনেই থমকাল, তারপর পিছাল, গুলিও করল প্রায় একসঙ্গে। রানার পিস্তল সামনের দিকে তাক করাই ছিল, কিন্তু লোকটার পিস্তল ছিল শরীরের পাশে ঝুলে থাকা হাতে, এইটুকু পার্থক্যের কারণে রানার গায়ে তার বুলেট লাগল না, আর রানার বুলেট তার খুলি উড়িয়ে দিল।

লাশ টপকে হলরূম পার হয়ে করিডরে বেরুল রানা। প্রবল একটা তাগাদা অনুভব করছে। পৌঁছাতে দেরি করলে সালজুনাসকে জীবিত অবস্থায় পাবে না। তবে এমনও হতে পারে যে এরইমধ্যে তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে।

করিডরের দু’পাশে বেডরূম, সবগুলোর দরজা খোলা। শুধু শেষ কামরাটা বন্ধ। সেটার সামনে দাঁড়াতে ছোট্ট, অস্পষ্ট একটা শব্দ বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। কয়েক পা পিছিয়ে এসে ছুটল, লাথি মারল দরজায়। তবে কবাট ভাঙতে আরও তিনটে লাথি মারতে হলো। ভাঙা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল রানা।

হাড্ডিসার, কুৎসিত এক লোক ডাফু সালজুনাসের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিলিওনেয়ার ব্যবসায়ীকে একটা চেয়ারে বসিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। কুৎসিত হাড্ডিসারের হাতের পিস্তল তাঁর কপালে ঠেকে আছে, একটা আঙুল ট্রিগারে পেঁচানো। দরজার কবাট ভেঙে পড়ার মুহূর্তে বন করে ঘুরে রানার দিকে ফিরল সে। গুলি করল চোখের পলকে, কিন্তু লক্ষ্যস্থির না করেই, ফলে রানার পাশে দরজার চৌকাঠে লাগল প্রথম বুলেটটা। রানার পিস্তলও গর্জে উঠেছে। ওর গুলিটা হাড্ডিসারের বুকে লাগল। তারপরও গুলি করতে যাচ্ছে সে। রানার দ্বিতীয় গুলি তার কপালে গর্ত তৈরি করল।

পিস্তলটা কোমরে গুঁজে রাখছে রানা, নেশাগ্রস্ত মাতালের মত ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন গ্রীক শিপিং ম্যাগনেট। ‘ডাফু সালজুনাস?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘হ্যাঁ, আমি ডাফু সালজুনাস,’ মৃদু কণ্ঠে বললেন তিনি।

‘আপনি…?’

‘আমরা আপনাকে মুক্ত করতে এসেছি, মিস্টার সালজুনাস।’

ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়ছেন ভদ্রলোক। ‘ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ওই লোকটা আমাকে…’

‘জানি।’ রানা তাঁর বাঁধন খুলে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল। ‘সুস্থ বোধ করছেন তো? একটু হাঁটতে পারবেন?’

মাথা ঝাঁকালেন ভদ্রলোক। ‘আমি ঠিক আছি।’ তারপর গ্রীক ভাষায় বিড়বিড় করে কি যেন বললেন। রানার দিকে তাকিয়ে হাসতে চেষ্টা করলেন। ‘বিশ্বাসই হচ্ছে না যে বিপদটা সত্যিই কেটে গেছে।’

‘বলুন অর্ধেকটা কেটেছে।’

সালজুনাস কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, বাড়ির বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে এল। রানার মনে পড়ল, বাইরে তারানার সঙ্গে গনজালেসকে রেখে এসেছে। ঘুরে ছুটল ও। হলরূম থেকে চেঁচিয়ে ডাকল, ‘তারানা!’

একটু পরই তার গলা পাওয়া গেল, ‘আমি ঠিক আছি!’

দালানের ঠিক বাইরে দেখা হলো ওদের, তারানা তার পিস্তল পার্সে ভরে রাখছে।

‘ঘটলটা কি?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘গনজালেসের অকাল মৃত্যু।’

‘তুমি ওকে খুন করেছ?’ জানতে চাইল রানা, গলায় প্রায় অবিশ্বাসের সুর।

‘ভাঙা নাক আর চোয়াল নিয়ে লোকটা ড্রাগস বেচা কোটি কোটি ডলারের লোভ দেখিয়ে বলল, আমাকে বিয়ে করবে। আমি উত্তর না দেয়ায় অকথ্য ভাষায় গাল দিল-আমি বেশ্যা, আরও কত কি। সহ্য করতে পারলাম না, তাই আগেভাগেই নরকে পাঠিয়ে দিয়েছি।’

তারানাকে নিয়ে ডাফু সালজুনাসের কামরায় ফিরে এলো রানা। তারানার পরিচয় দিয়ে বলল, ‘তারানা আজিজ, প্যালেস্টাইন ইন্টেলিজেন্স।’

চোখ কুঁচকে তারানাকে দেখলেন সালজুনাস। ‘ওদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সবাই সমর্থন করে, কিন্তু প্রায় কেউই সাহায্যের হাত বাড়ায় না-তাদের মধ্যে আমিও একজন। আশা করি ভুলটা সংশোধন করার সুযোগ পাব। কিন্তু আপনি, ইয়ংম্যান?’

‘মাসুদ রানা, একজন বাংলাদেশী,’ এটুকু বলে চুপ করে গেল রানা, দেখতে চাইছে ভদ্রলোক কিছু মনে করতে পারেন কিনা।

ভুরু জোড়া আরও একটু কোঁচকালেন ভদ্রলোক। ‘বাংলাদেশ সরকার আমাকে মুক্ত করার জন্যে লোক পাঠিয়েছে শুধু এই কারণে যে আমি ওখানে কিছু টাকা বিনিয়োগ করতে চেয়েছিলাম? নাহ্‌, এ বিশ্বাস করার মত নয়…’

‘আসল কারণ তা নয়ও,’ বলল রানা। ‘জুলহাস কায়সার নামে আমার এক গ্রীক জার্নালিস্ট বন্ধুকে আকার্ডিয়া মারকাস খুন করেছে, আমি তার প্রতিশোধ নিতে মাঠে নেমেছি।’ এরপর সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করল কায়সার কেন খুন হলো, পি.আই.বি-র কি উদ্দেশ্য।

দেয়াল ছেড়ে এতক্ষণে সিধে হয়ে দাঁড়ালেন ডাফু সালজুনাস। ‘আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, জানি না এই ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারব কিনা। মি. রানা, মুক্ত একজন মানুষ হিসেবে প্রথমেই আমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই।’ এরই মধ্যে তিনি তাঁর কর্তৃত্ব ফলাবার স্বভাবটা ফিরে পেয়েছেন, ধনকুবেররা যেমনটি ফলিয়ে থাকেন। ‘তারপর আমি দেখছি মারকাসকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হয়।’

‘মিস্টার সালজুনাস,’ ধীরে ধীরে বলল রানা, ‘আপনার বিপদ আসলে কাটেনি এখনও। ব্যাপারটা আমাদের হাতে ছেড়ে দিন। আপনি কর্তৃপক্ষের সাহায্য নিয়ে সমস্যার সমাধান করতে গেলে কয়েক মাস সময় লেগে যাবে। যা করার খুব দ্রুত আমরা সরাসরি করতে চাই।’

‘কি করে বুঝব আপনি যা বলছেন সব সত্যি?’ বিলিওনেয়ার ব্যবসায়ী ভদ্রলোক সংশয়ে ভুগছেন।

‘আপনাকে বোধহয় একটা তথ্য এখন দেয়া দরকার,’ বলল রানা। ‘সাউল শিপিং লাইন্সের নাম শুনেছেন কখনও?’

‘রোজই শুনছি। কেন?’

‘ওদের বোর্ড অভ ডিরেক্টরসের চেয়ারম্যানের নামটা আপনার জানা আছে?’

‘কেন থাকবে না। তাঁর নাম মাসুদ রানা। কিন্তু এসব প্রশ্ন…’

‘আমার নামটা কি?’

হাঁ করে চেয়ে রইলেন সালজুনাস কয়েক সেকেন্ড। ‘মাসুদ রানা! আপনিই কি সেই…তাই তো, আরে! কয়েকটা মীটিঙে দেখেছি আপনাকে। হ্যাঁ, আপনাকেই তো!’

মাথা ঝাঁকাল রানা। তারপর বলল, ‘আমার ওই পরিচয়টা বড় কথা নয়। আমি বলতে চাইছি সংশয় প্রকাশ করার চেয়ে ঝটপট আমাদের কথা বিশ্বাস করে নিলেই আপনি নিজের উপকার করবেন। আর যাই হোক, আপনাকে মুক্ত করার জন্যে নিজেদের প্রাণের ওপর ঝুঁকি নিয়েছি আমরা। বাইরে গেলে দেখতে পাবেন আমাদের একজন সঙ্গী মারাও গেছে,’ একটু তিক্ত শোনাল রানার শেষ বাক্যটা।

আকস্মিক ক্লান্তিতে ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের কাঁধ দুটো ঝুলে পড়ল। ‘আপনি ঠিক বলেছেন। প্লীজ, আমাকে মাফ করুন। আসলে আমার ওপর দিয়ে প্রচণ্ড ধকল গেছে…’

‘আর মারকাসকে একা শায়েস্তা করার কথাটাও ভুলে যান,’ বলল রানা। ‘ব্যাপারটা প্র্যাকটিক্যাল নয়। নিজের চারপাশে লোকটা সারাক্ষণ একটা আর্মি মোতায়েন রেখেছে।’

মুখটা বেলুনের মত ফোলালেন সালজুনাস, তারপর সশব্দে বাতাস ছাড়লেন। ‘ঠিক আছে, মিস্টার রানা, ঠিক আছে। আপনারা যা বলবেন তাই হবে। তবে যদি দেখি আপনাদের মেথড কাজ করছে না, তখন কিন্তু কাজটায় আমার মত করে আমিও হাত লাগাব।’

রানা হাসল। ‘ফেয়ার এনাফ। এবার আমার কিছু প্রশেড়বর জবাব দিন। আপনাকে এথেন্স থেকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল?’

ঘরের একমাত্র চেয়ারটায় আবার বসলেন গ্রীক শিপিং ম্যাগনেট। ‘আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না আকার্ডিয়া মারকাস কি রকম চালাক লোক। নিজেকে আমি নিরীহ বলে দাবি করি না, তবে ওর মত ভয়ঙ্কর লোক জীবনে আমি দেখিনি। কিভাবে কি ঘটল শুনুন তাহলে…’

কমপিউটর-নিয়ন্ত্রিত আন্ডারওয়াটার অয়েল ট্যাংকারের একটা বহর তৈরি করার আইডিয়া নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন ডাফু সালজুনাস। কিভাবে যেন ব্যাপারটা জানতে পেরে তাঁকে সাহায্য করার প্রস্তাব দেয় আকার্ডিয়া মারকাস। প্রথমে সালজুনাস দেখা করতে রাজি হননি। কিন্তু কয়েকটা চিঠিতে ইন্টারেস্টিং কিছু আইডিয়া দেখতে পেয়ে এথেন্স পেন্টহাউসে তাকে ডেকে পাঠালেন। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক আলাপ করলেন তিনি। মারকাস তাঁকে জানাল, ‘আমার আর আপনার প্ল্যান একই। আপনি শুধু আমাকে অনুমতি দিন, শিপিং ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসে আপনার নামটা অমর করে দিই।’ উত্তরে সালজুনাস বললেন, ‘কিন্তু, মিস্টার মারকাস, প্রথমে অত্যন্ত জটিল কিছু এঞ্জিনিয়ারিং সমস্যার সমাধান দরকার হবে।’

মারকাস জানাল, তার হাতে দু’জন প্রতিভাবান এঞ্জিনিয়ার আছে, তারা এই কাজ করতে পারবে। আলাপের এই পর্যায়ে সালজুনাস সন্দেহ করেন মারকাসের অমায়িক ও মার্জিত আচরণের তলায় কি যেন একটা লুকিয়ে আছে, এমন একটা কিছু যা পছন্দ করতে পারছেন না। মিছে সন্দেহ ভেবে ব্যাপারটা ভুলে থাকার চেষ্টা করেন তিনি।

রানা জানতে চাইল, ‘এঞ্জিনিয়ার দু’জনকে আপনার সামনে এনেছিল সে?’

‘ও, হ্যাঁ। তাদের ইনভেনটিভ ব্রেন থেকেও ইম্যাজিনেটিভ সব আইডিয়া বেরুতে দেখে আমি তো রীতিমত মুগ্ধ। বিশ্বাস হলো, ওরা পারবে। ঠিক এই পর্যায়ে, মিস্টার রানা, অসতর্ক হয়ে পড়ি আমি। পেন্টহাউসে একটা প্রাইভেট মীটিং-এর জন্যে অনুরোধ জানাল মারকাস। মীটিংটায় শুধু আমার পার্সোন্যাল সেক্রেটারী গিলি ক্ল্যাসিকস আর একজন এইড উপস্থিত ছিল। মারকাস দু’জন লোককে সঙ্গে করে আনল। তাদেরকে আগে আমি দেখিনি।’

‘ব্যাপারটা তাহলে তখনই ঘটল?’ জানতে চাইল তারানা।

হঠাৎ করেই মারকাস পার্সোন্যাল সেক্রেটারী ও এইডকে ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে বলে। তাদের পিছু নিয়ে তার একজন সঙ্গীও কামরা ছেড়ে বেরিয়ে যায়। একটু পরই দুটো গুলির শব্দ ভেসে এল। পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে এভাবেই খুন করা হয় সালজুনাসের পার্সোন্যাল সেক্রেটারী আর এইডকে। মারকাসের অপর সঙ্গী সালজুনাসকে ঘুসি মেরে প্রায় অজ্ঞান করে ফেলে। টেনে-হিঁচড়ে পাশের কামরায় নিয়ে এসে এইড দু’জনের রক্তাক্ত লাশ দেখতে বাধ্য করে। গিলি ক্ল্যাসিকস-এর মাথার অর্ধেক উড়ে গিয়েছিল। সালজুনাসকে বলা হলো, তাদের কথামত কাজ না করলে তাঁর অবস্থাও এরকম হবে।

‘তারপর কি ঘটল?’ জিজ্ঞেস করল তারানা।

পরদিন ওরা এক লোককে নিয়ে এল-অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি-লোকটা হুবহু গিলি ক্ল্যাসিকসের মত দেখতে। লোকটার আচার-ব্যবহার, হাবভাব, বাচনভঙ্গি, দাঁড়ানো বা বসা, এমন কি হাত নাড়ার বৈশিষ্ট্য-সব গিলি ক্ল্যাসিকসের সঙ্গে মেলে। মারকাস গর্ব করে বলল, লোকটাকে ভাগ্যগুণে খুঁজে পেয়েছে সে। দু’জনের চেহারায় বেশ কিছু অমিলও ছিল, সে-সব প্লাস্টিক সার্জারির সাহায্যে দূর করা হয়েছে। বাকি সব-আচার-আচরণ, বাচনভঙ্গি ইত্যাদি? সাত মাসের কঠোর ট্রেনিং এই অসম্ভবকে সম্ভব করিয়েছে। গিলি ক্ল্যাসিকসের ওপর এক বছর ধরে নজর রাখছিল ওরা। তার প্রতিটি নড়াচড়া, কথাবার্তা, স্বভাব ও অভ্যাস নোট করা হয়েছে। যখনই সুযোগ পাওয়া গেছে ভিডিও ক্যামেরায় বন্দী করা হয়েছে তার মুভমেন্ট।

রানা জানতে চাইল, ‘ওরা আপনার সেক্রেটারীর নকল তৈরি করল, কিন্তু আপনারটা করল না কেন?’

সালজুনাস জানালেন, তাঁর ডুপি−কেট তৈরি করার কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ, সমাজে তিনি চলাফেরা করতেন না, মেলামেশা করতেন বাছাই করা অল্প ক’জন ব্যবসায়ী বন্ধুর সঙ্গে। এমনকি তাঁর কর্মচারীরাও অনেকে তাঁকে কখনও দেখেনি।

সালজুনাসকে না জানিয়ে রেকর্ড করা তাঁর কণ্ঠস্বরের কয়েকটা টেপ বাজিয়ে শোনানো হলো। মারকাস মাথায় একটা পিস্তল চেপে ধরে বলল, এখুনি তাঁকে খুন করতে পারে সে, দীর্ঘদিন এই ঘটনা কেউ জানতেও পারবে না। তবে ঝামেলা না করলে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হবে। আরও রেকর্ডিং এবং চিঠি লেখানোর জন্যে তাঁকে ওদের প্রয়োজন। এরপর একটা প্রাইভেট প্লেনে তুলে এই জঙ্গলের ভেতর নিয়ে আসা হয় তাঁকে।

‘মারকাস তার প্ল্যান সম্পর্কে কিছু বলেনি আপনাকে?’

বলেনি মানে! সগর্বে, সদম্ভে ঘোষণা করেছে মারকাস, ডাফু সালজুনাসের নামে গ্রীস সরকারকে উৎখাত করবে সে। সামরিক বাহিনীতে সালজুনাসের যত বন্ধু আছে তাদের সঙ্গে নকল গিলি ক্ল্যাসিকসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে সাহায্য ও সমর্থন চাওয়া হবে। সালজুনাস নিভৃতচারী, প্রায় কারও সঙ্গেই সশরীরে দেখা করেন না, এ-কথা সবাই জানে, কাজেই তাঁর সেক্রেটারীর মাধ্যমে সাহায্য ও সমর্থনের প্রস্তাব পেলে কেউ এতটুকু বিস্মিত হবে না। তারপরও কেউ যদি তাঁর সঙ্গে সামনাসামনি বসে কথা বলতে চায়, প্লেনে করে এথেন্সে নিয়ে যাওয়া হবে তাঁকে, লুকানো পিস্তলের সামনে বসে শিখিয়ে দেয়া কথা মুখস্থ বলে যাবেন তিনি।

সালজুনাসকে তাঁর সইও নকল করে দেখানো হয়। কোনটা নকল, কোনটা আসল, সালজুনাস নিজেই ধরতে পারেননি। তাঁকে বলা হয়, জালিয়াত লোকটাকে দিয়ে তাঁর বিভিনড়ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা হবে। এই টাকা খরচ করা হবে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বর্তমান সরকারকে উৎখাতের কাজে।

মারকাসের প্ল্যান তিন ভাগে ভাগ করা। প্রথমে সে বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতায় বসাবে সালজুনাসের প্রতি অনুগত সামরিক অফিসারদের। তারা যে শুধু বন্ধু বলে আনুগত্য দান করবে, তা নয়; তাছাড়া বেশিরভাগই তারা সালজুনাসের বন্ধু নয়ও-মারকাস তাদেরকে সালজুনাসের নামে ক্ষমতা, সম্পদ ও গৌরব-এর লোভ দেখিয়ে দলে টানবে।

প্ল্যানের দ্বিতীয় অংশে এই সব জেনারেল ও কর্নেলদের বলা হবে তারা যেন দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার স্বার্থে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। সেই নির্বাচনে সালজুনাস দাঁড়াবেন, এবং সামরিক জান্তার সমর্থন ও দেশবাসীর নিরঙ্কুষ ভোট পেয়ে তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন।

প্ল্যানের তৃতীয় পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট সালজুনাস পিস্তলের মুখে আকার্ডিয়া মারকাসকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দান করবেন। তখন সরকারী মিডিয়াতে প্রচার করা হবে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ইত্যাদি দেশহিতকর কাজগুলোর পিছনে আসলে আকার্ডিয়া মারকাসেরই সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল-সে-ই বর্তমান গ্রীসের রক্ষাকর্তা। তারপরের অংশটুকু আর বলেনি তাঁকে মারকাস, তিনি নিজেই বুঝে নিয়েছেন-একটা মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হবেন প্রেসিডেন্ট ডাফু সালজুনাস। সংবিধান অনুসারে ভাইস প্রেসিডেন্ট মারকাস হবে প্রেসিডেন্ট।

‘কি ভয়ংকর! সত্যি অবিশ্বাস্য!’ মাথা নেড়ে বলল তারানা।

‘মারকাসের মত লোক যদি গ্রীসে ক্ষমতায় আসে,’ সালজুনাস বললেন, ‘দেশের সমস্ত সম্পদ লুঠ হয়ে যাবে। মাত্র কয়েক বছর পর দেখা যাবে তার অত্যাচারে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ।’

‘আপনি নিশ্চিত থাকুন,’ তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলল রানা, সেরকম কিছু ঘটতে দেয়া হবে না। তারানা ওদের নেতা হত্যার বদলা নেবে, আমি নেব বন্ধু হত্যার প্রতিশোধ। আপনি শুধু আমাদের সঙ্গে থাকুন।’

‘এই লোককে দমন করার জন্যে সম্ভাব্য সব কিছু করব আমি,’ বললেন সালজুনাস। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, চৌকো চিবুক ঠেলে দিলেন সামনের দিকে। ‘এই লোক এমনকি আমার পরিবারকেও দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। সে গর্ব করে আমাকে বলেছে, আমার ভগড়বীপতি জেনারেল অ্যালেক্সিস ভালটোনা বিশ্বাস করেন এই কুৎসিত ষড়যন্ত্রটা আমিই পাকিয়েছি, এবং আমি চাওয়ায় তিনি আমাকে সমর্থন করতেও রাজি হয়েছেন। লোকটা কত্তো বড় শয়তান, ভাবতে পারেন! হ্যাঁ, অবশ্যই আপনাদের সঙ্গে আছি আমি। বলুন, প্রথমে কি করব আমরা?’

‘প্রথমে আমরা এথেন্সে যাব,’ বলল রানা। ‘ওখানেই আকার্ডিয়া মারকাসের ব্যবস্থা করা হবে।’

« পূর্ববর্তী:
« জাত গোক্ষুর – ০৪
পরবর্তী: »
জাত গোক্ষুর – ০৬ »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি – জোক্স – লিরিক – রেসিপি – কামসূত্র – হেলথ – PDF

Return to top