• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Book । বাংলা লাইব্রেরি

Read Bengali Books Online @ FREE

  • লেখক
  • অনুবাদ
  • সেবা
  • PDF
  • Bookmarks

লেখক

অনুবাদ

সেবা

কৌতুক

লিরিক

ডিকশনারি

PDF

Bookmarks

কান্তার মরু – ১৪

লাইব্রেরি » সেবা প্রকাশনী » মাসুদ রানা সিরিজ » কান্তার মরু » কান্তার মরু – ১৪

রানা আশা করছিল বস ওকে ঢাকা ফেরত পাঠিয়ে মিশনের ইতি টানবেন। মালদিনির হেডকোয়ার্টার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মাসুদ রানা ইথিওপিয়া এসে কাজের কাজ কি করল? না, না, সে জুলেখাকে উদ্ধার করে এনেছে। এনে অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে খুশি রানা, কিন্তু টের পেল ইথিওপিয়া সরকার এটুকুতে খুশি নয়।
কাজেই বস যখন আসমারায় একটা অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবস্থা করে দিলেন এবং নতুন কাপড়-চোপড় কিনতে বললেন তখন খুব একটা আশ্চর্য হলো না রানা।
‘এখানে কি করতে হবে আমার?’
‘তুমি ঠিক জানো মালদিনি ওই জাহাজে আছে?’
‘না।’
‘আমিও না। মিশনটা এত সোজা, ঠিক যেন মেলে না, রানা। আর ওই মিসাইলগুলোর কথাই ধরো। ইথিওপিয়া নিরপেক্ষ বন্ধু রাষ্ট্র হলেও দেখবে ওগুলো ফেরত নিতে বেগ পেতে হবে। মরুভূমিতে ওগুলো কাছ থেকে দেখার সুযোগ দিল না কেন হাশমী কিছু বুঝতে পারলে?’
‘দুটো কারণ আছে, স্যার। প্র ম, সে বিদেশীদের পছন্দ করে না, এবং তার ধারণা লুকানর মত কিছু আছে ওখানে।’
‘ইথিওপিয়াকে একটা ডেলিকেট সিদ্ধান্ত নিতে হবে,’ বললেন বস। ‘ওই মিসাইলগুলোর কয়েকটার মালিক মিশর। ইসরাইলীও কিছু আছে। আরব বিশ্বের অভ্যন্তরীণ চাপে মিশরের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হবে ইথিওপিয়া। কিন্তু দু’দেশের কারও বাহুবল বৃদ্ধি পাক সেটা এরা চাইবে না। মোট কথা, মিসাইলগুলোর কি হিল্লে করবে এদের জানা নেই। কাজেই আসমারায় থাকছ তুমি। চোখ রাখছ এদের গতিবিধির ওপর।’
রানাকে আসমারায় ফেলে রেখে স্বদেশে ফিরে গেলেন বস। কাজেই বসে বসে আঙুল চুষছে রানা। কিসের জন্যে অপেক্ষা করছে জানে না বলে আরও অসহ্য লাগে। জেনারেল হাশমী
সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলেছেন ওকে; এবং জুলেখা না থাকলে কেমন যে লাগত ভেবে শিউরে ওঠে রানা। কারণ আসমারা মোটেও আকর্ষণীয় কোন শহর নয়।
মাসুদ রানার কন্ট্যাক্ট হচ্ছে বাংলাদেশ দূতাবাসের জনৈক কেরানী। রাহাত খানের বিদায়ের দশ দিন বাদে দেখা মিলল তার। লম্বা-চওড়া এক রিপোর্ট বগলদাবা করে নিয়ে এসেছে। ওটা ডিকোড করতে দু’ঘণ্টা লাগল রানার। শেষ করার পর উপলব্ধি করল, কেউ একজন মস্ত বড় এক ট্যাকটিকাল ভুল করে রেখেছিল।
নেভি শেপ মাইয়ারকে খুঁজে পেয়েছিল আটলান্টিকে, শিপিং লেনের বাইরে, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার মাঝখানে, নিরক্ষরেখার একটু ওপরে। এক ক্যারিয়ার ও চার ডেস্ট্রয়ারের একটা টাস্ক ফোর্স আক্রমণ করে ওটাকে। পাল্টা লড়াই দিয়েছে শেপ মাইয়ার। কিন্তু ওটার তিন-ইঞ্চি গান আত্মরক্ষার জন্যে অপ্রতুল ছিল, এবং সাগরে টুকরো-টুকরো হয়ে যায় জাহাজটা। ভগ্নস্তূপের মধ্যে জীবিত কাউকে খুঁজে পাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। এবং অকুস্থলে প্রচুর হাঙর দেখা গেছে, ফলে নাভাল টাস্ক ফোর্স কোন
মৃতদেহ উদ্ধার করতে পারেনি। তারমানে, কেউ বলতে পারে না মালদিনি জীবিত নাকি মৃত। পরদিন এলেন জেনারেল হাশমী। রিপোর্টের একটা কপি তিনিও পেয়েছেন। রানার ড্রিঙ্কের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে, কাউচে বসে কাজের কথা পাড়লেন ভদ্রলোক। ‘আমাদের অন্তত একজন টার্গেট জাহাজটায় ছিল না।’
‘মালদিনি? রিপোর্ট থেকে কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না।’
‘মালদিনির কথা জানি না, মিস্টার রানা। আপনারা ডানাকিল থেকে শহরে আসার পর কিছু লোকজনের নাম দেয় আমাকে জুলেখা। ওরা নাকি মালদিনির বন্ধু-বান্ধব। ইন্টেলিজেন্স আমার লাইন নয়, অল্প কয়েকজন এজেন্ট ছাড়া অন্যদের ওপর ভরসাও করি না। বিশেষ কয়েকজন রাজনীতিবিদ আর জেনারেলের ওপর গোপনে নজর রাখছে ওরা। ওই অফিসারদের একজনকে নাকি ইদানীং বিশালদেহী এক সাদা চামড়ার লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে।’
‘মালদিনির ক্যাম্পে ওরকম একজন মাত্র লোকই দেখেছি আমি,’ বলল রানা। ‘সে হচ্ছে ম্যাকলিন। সে শেপ মাইয়ারে ছিল না শিয়োর আপনি?’
‘মিশরীয় নেভী ছিনড়বভিনড়ব করে দিয়েছে জাহাজটাকে।’
‘কিইবা করবে, থ্রি ইঞ্চ গান ব্যবহার করলে আপসে ওদের জাহাজে নামা সম্ভব?’
‘কি করবেন এখন ভেবেছেন কিছু, মিস্টার রানা?’
‘সেটা ঠিক করবে আপনার সরকার, জেনারেল। মিসাইলগুলো আপনারা কিভাবে অকেজো করবেন দেখে তারপর আসমারা ছাড়তে বলা হয়েছে আমাকে।’
‘গুলি মারেন আপনার মিসাইলের!’ হঠাৎ বিস্ফোরিত হলেন হাশমী।
বিস্ফোরণের কারণটা ব্যাখ্যা করবেন ভদ্রলোক সেজন্যে অপেক্ষা করছে রানা। ওকে মোটেই সহ্য করতে পারছেন না জেনারেল। জুলেখার সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব কি এজন্যে দায়ী? যাকগে, ভাবল রানা, এ লোক ইথিওপিয়ার স্বার্থে কাজ করছে, এবং যতক্ষণ না বিসিআইয়ের সঙ্গে এর মতপার্থক্য হচ্ছে, রানা ঠোকাঠুকি করতে যাবে না।
‘মিস্টার রানা,’ বললেন হাশমী। ‘ইথিওপিয়ার কোন ঠেকা পড়েনি নিউক্লিয়ার পাওয়ার হতে চাইবে। অত হ্যাপা সামলানোর ক্ষমতা আমাদের নেই।’
‘সুযোগ এসে গেছে আপনাদের সামনে, সেটা নেবেন কিনা আপনারা বুঝবেন। আমি অবশ্য মিসাইলগুলো ফেরত চাই। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে।’
‘গত ক’দিন ধরে কানে আসছে আমরা নাকি এরইমধ্যে নিউক্লিয়ার পাওয়ার হয়ে গেছি। মিসাইল হাতে থাকলে তার টার্গেটও লাগে। মধ্যপ্রাচ্য আর ইসরাইলের যেমন টার্গেট আছে। কিন্তু আমাদের শত্রু কোথায়?’
‘কাজেই জাতিসংঘের হাতে ওগুলো তুলে দেয়াই ভাল,’ বলল রানা। ‘তারাই বুঝবে ওগুলো রেখে দেবে নাকি যার যারটা তাকে ফিরিয়ে দেবে।’
‘এ নিয়ে পরে আরও আলাপ করা যাবে,’ বললেন জেনারেল হাশমী। ‘আপনি তো আসমারায় কিছুদিন থাকছেনই।’
জেনারেল চলে গেলে দূতাবাসে গেল রানা। কেব্‌ল্‌ পাঠাল একটা মেজর জেনারেলের কাছে। জানতে চাইল ইথিওপিয়ায় মিসাইল বিশেষজ্ঞ পাঠাতে কদ্দিন লাগবে। ওঅরহেডগুলো আর্মড নয় বলেছেন জেনারেল হাশমী, কিন্তু তাঁর কথার সত্যতা যাচাই
করে দেখতে চায় রানা।
দু’রাত পরে, আসমারার এক নাইটক্লাব পার্টিতে যাওয়ার প্রস্তাাব তুলল জুলেখা। ইতোমধ্যেই এক সরকারী অফিসে যোগ দিয়েছে সে-রেকর্ড সংক্রান্ত কাজ-কর্ম তার। জেনারেল হাশমী ব্যবস্থা করে দিয়েছেন কাজটার। নাইটক্লাবে রানা বিপদের আশঙ্কা করছে না, কিন্তু তারপরও লুগার, স্টিলেটো ও খুদে গ্যাস বোমাটা সঙ্গে রাখবে ঠিক করল।
পশ্চিমা সংস্কৃতির জঘন্যতম নিদর্শন হচ্ছে এই ক্লাবটা। বিশ্রী এক রক ব্যান্ড কান ঝালাপালা করে ছেড়েছে। তার ওপর সব কিছুরই এখানে চড়া দাম। ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি গানের জন্যে রীতিমত হাহাকার উঠল মাসুদ রানার বুকের ভেতর। আধ ঘণ্টা পর জুলেখাকে নিয়ে পালাল ও।
আজ সন্ধেয় কেমন এক হিম-হিম ভাব, পাহাড়ী শহরের বৈশিষ্ট্য যেমন হয় আর কি। ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে ট্যাক্সি পাওয়া গেল না। এমনকি দারোয়ান, ফোন করে হয়তো কোন একটাকে ডাকতে পারত, সে-ও উধাও। অবশ্য ঘোড়ায় টানা এক ক্যারিজ, খালিই দেখা গেল, দাঁড়িয়ে আছে নাইট ক্লাবের সামনে। জুলেখাকে নিয়ে ওটায় চড়ে বসে চালককে নিজের অ্যাপার্টমেন্টের অবস্থান জানাল রানা। শূন্য দৃষ্টিতে চালক চেয়ে রইল ওর দিকে।
ইতালিয়ানে বলল এবার রানা।
‘সি, সিনর,’ বলল লোকটা।
জুলেখা রানার বাঁ পাশে বসেছে, চলতে শুরু করল গাড়ি। নাইটক্লাবের শোরগোলের পর অস্বাভাবিক শান্ত লাগছে রাতটাকে। রাস্তার ওপর ঘোড়ার নিয়মিত ছন্দবদ্ধ খুরের শব্দে ঘুম পাবে যে কারও। জুলেখা শরীর ঢিল করে দিয়েছে। রানা আড়ষ্ট। ছোট্ট এক রহস্যের সমাধান করতে চেষ্টা করছে ও।
ইথিওপিয়ার স্কুলগুলোয় ইংরেজি বহুল প্রচলিত দ্বিতীয় ভাষা। আসমারা কসমোপলিটন শহর। হোটেলের বেয়ারা থেকে শুরু করে সমাজের মাথা পর্যন্ত সবাই একাধিক ভাষা রপ্ত করেছে। ক্যারিজ চালক ইংরেজি জানে না ব্যাপারটা সামান্য হলেও, সতর্ক হয়ে গেল রানা। অসাবধানতার কারণে শেপ মাইয়ারে মাথায় বাড়ি পড়েছে ওর। আবারও বেলতলায় যেতে রাজি নয় রানা।
একটু পরেই, দু’নম্বর সন্দেহটা আরও জোরাল প্রমাণিত হলো। আসমারায় বসে থাকতে হচ্ছে বলে, রানা কখনও জুলেখাকে নিয়ে, কখনও একা শহরের আশপাশে ঘোরাফেরা
করেছে। তাই বলে যে এ শহরের নাড়ী-নক্ষত্র চিনে গেছে সে তা নয়। কিন্তু তারপরও সন্দেহ দানা বাঁধতে লাগল ওর মনে, ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে ওদেরকে চালক। ব্যাপারটা জানাল রানা জুলেখাকে।
স্থানীয় ভাষায় যুবতী কিছু বলল চালককে। লোকটা জবাব দিল, শরীর অর্ধেকখানি ঘুরিয়ে হাত নেড়ে কি যেন বোঝাল। জুলেখা কথা বলল ওর সঙ্গে আবার। লোকটা দ্বিতীয়বার কি এক ব্যাখ্যা দিয়ে তারপর সিধে হয়ে বসল। মন দিয়েছে গাড়ি
চালনায়।
‘ও বলছে এটা নাকি শর্টকাট,’ বলল জুলেখা।
শোল্ডার হোলস্টারে লুগারটা ঢিল করল রানা। ‘আমার বিশ্বাস হয় না,’ বলল।
রানার অবিশ্বাস লোকটার ইংরেজি জ্ঞান ফিরিয়ে দিল কিনা কে জানে। সীটে ঘুরে বসে পকেট হাতড়াচ্ছে চালক। ঠাঁই করে লুগারের বাঁট পড়ল ওর চাঁদিতে। ‘হুঁক’ করে একটা শব্দ করে জ্ঞান হারাল লোকটা, আসন থেকে পড়ে যায় আরকি। হাত থেকে খসে
ঠং করে রাস্তায় পড়েছে পিস্তলটা। ওদিকে, চালকবিহীন ত্রস্ত ঘোড়াটা তখন রীতিমত ঘোড়দৌড় লাগিয়েছে।
‘ঘাবড়িয়ো না!’ জুলেখাকে আশ্বস্ত করতে চাইল রানা।
পিস্তলটা হোলস্টারে গুঁজে দিয়ে, এক লাফে সামনে গিয়ে পড়ল রানা। লাথি মেরে সীট থেকে চালককে খসাল। তারপর লাগাম চেপে ধরে সামলাতে ব্যস্ত হলো উদ্‌ভ্রান্ত জানোয়ারটাকে।
বিপজ্জনকভাবে এপাশ-ওপাশ দুলছে ওরা। জট পাকিয়ে গেছে লাগাম দুটো। সরু রাস্তাটা দিয়ে তীরবেগে ছোটার ফাঁকে ও দুটোকে সোজা করার চেষ্টা করল রানা। রাস্তার দু’পাশে ছিটকে গেল কয়েকজন পথচারী। রানা প্রার্থনা করছে, কোন গাড়ি-টাড়ি যাতে এমুহূর্তে মুখোমুখি পড়ে না যায়। শহরের এ অংশটা সুনসান মনে হলো, রাস্তার পাশে মাঝেমধ্যে দু’একটা গাড়ি পার্ক করে রাখা। হাড় জিরজিরে ঘোড়াটা যে এমন ভেলকি দেখাবে কে
জানত। এ মুহূর্তে কেনটাকি ডার্বি জেতার ক্ষমতা প্রদর্শন করছে এই বুড়ো ঘোড়া।
রানা শেষমেষ লাগামজোড়ার জট খুলে আরেকটু চাপ বাড়াতে পারল। চাপ যাতে দু’পাশে সমান থাকে, সতর্ক রইল ও। ক্যারিজটার সেন্টার অভ গ্র্যাভিটি অনেক উঁচু। আচমকা যদি বাঁক নেয় ঘোড়াটা, গাড়ি থেকে উড়ে গিয়ে রাস্তায় পড়তে হবে ওদেরকে। ধীরে ধীরে চাপ বাড়িয়ে চলল রানা। শ্লথ হতে শুরু করেছে ঘোড়াটার গতি। অনুচ্চ স্বরে কথা বলে ওটাকে শান্ত করতে চাইছে রানা।
নিয়ন্ত্রণে প্রায় এসে গেছে গাড়ি এসময় চেঁচিয়ে উঠল জুলেখা, ‘রানা! পেছন থেকে খুব জোরে একটা গাড়ি তেড়ে আসছে।’
‘কতটা কাছে?’
‘কয়েক ব্লক দূরে, কিন্তু খুব দ্রুত কাছিয়ে আসছে।’
লাগামে ঝাঁকুনি দিল রানা। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে শরীর তুলে ফেলল ঘোড়াটা। প্রবল এক ঝটকা খেল ক্যারিজ। এবার মাটিতে খুর দাপিয়ে পাগলা ঘোড়ার মত ছুটতে চেষ্টা করল জানোয়ারটা। লাগামে ফের ঝাঁকি দিল রানা, ঘোড়াটাকে থামানোর চেষ্টায় খিল ধরে গেল কাঁধের পেশীতে। আবারও দেহ শূন্যে তুলে দিল ভীত-সন্ত্রস্ত জানোয়ারটা। একপাশে কাত হয়ে গেল ক্যারিজ।
‘লাফ দাও!’ চেঁচাল রানা।
ডান পাশে লাগাম ফেলে সামনের বাঁ দিকের চাকার ওপর দিয়ে লাফ মেরে শান বাঁধানো রাস্তায় পড়ল রানা। কয়েক গড়ান দেয়ায় ছড়ে গেল হাঁটু, ফালা ফালা হলো কোট। উঠে দাঁড়িয়ে টলমল পায়ে সুউচ্চ এক বিল্ডিঙের উদ্দেশে এগোল ও। পেছনে চেয়ে দেখল, জুলেখা দশ ফিট দূরে রাস্তা থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে।
লাগামের চাপমুক্ত ঘোড়াটা পাঁই-পাঁই ছুটছিল আবার। কিন্তু ক্যারিজ উল্টে পতন হলো বেচারার, শরীরটা চাপা পড়েছে গাড়ির নিচে। মরিয়া হয়ে শূন্যে লাথি ছুঁড়ছে, আর ডাক ছাড়ছে অবলা জানোয়ার। ওদিকে, তীব্র গতিতে তখন ছুটে আসছে পেছনের গাড়িটা রানাদের উদ্দেশে, মনে হচ্ছে যেন ভূতে পেয়েছে চালককে।
জুলেখা রানার কাছে দৌড়ে এসে কোনমতে বলল, ‘রানা, ওই যে…’
‘কোন দরজা পাও কিনা দেখো।’
নির্জন রাস্তাটা ধরে ছুটল ওরা, বিল্ডিংগুলোর মাঝে কোন ফাঁকা জায়গা পাওয়া যায় কিনা দেখছে। কিন্তু ওয়্যারহাউজ সদৃশ বাড়িগুলোর মাঝে একজন মানুষ গলার মত ফাঁক নেই। একটা সেলারের প্রবেশপথ এসময় আবিষ্কার করল ওরা। গোঁ-গোঁ শব্দ
স্পষ্টতর হচ্ছে গাড়িটার। জুলেখাকে সিঁড়ি দিয়ে ঠেলে নামিয়ে নিল রানা। রাস্তার লেভেলের নিচে এসে গেল দু’জনেই। গাড়িটার হেডলাইট আলোকিত করে তুলেছে এলাকাটা। কিঁইঁচ্‌ শব্দে তীক্ষ্ণ ব্রেক চাপা হলো এইমাত্র।
‘শব্দ কোরো না,’ ফিসফিস করে বলল রানা, নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
জুলেখা রানার বাঁ বাহুতে চাপ দিয়ে দূরে সরে গেল খানিকটা।
এবার অস্ত্র ব্যবহারের স্বাধীনতা পেল রানা।
দড়াম করে বন্ধ হলো গাড়ির একটা দরজা। তারপর আরেকটা। এবং আরও একটা। এঞ্জিন চালু আছে যদিও। তিনের কম নয় ওরা, চারজনও হতে পারে।
‘খুঁজে বের করো ওদের,’ একজন চোস্ত ইতালিয়ানে আদেশ করল।
রানার বুঝতে কষ্ট হলো না কে লোকটা। ম্যাকলিন, ওরফে ব্রুনো কন্টি। ক্যারিজ চালক পিস্তল বের করার পর থেকেই ওকে আশা করছিল রানা। চাইছিল দেখা হোক, জেনারেল হাশমী যখন বললেন ও ইথিওপিয়ায় রয়েছে, তারপর থেকেই। এবার, বাছাধন, অস্ত্র আছে আমারও হাতে, মনে মনে বলল ও।
‘ওরা ওয়াগনে নেই,’ স্থানীয় কারও গলা।
‘আশপাশে আছে, থাকতেই হবে,’ বলল ম্যাকলিন। ‘অ্যান্ড্রুকে বলো এঞ্জিন অফ করতে, শব্দ শুনতে পাচ্ছি না।’
রানার হাত ধরে টানল জুলেখা। পেছনের দরজাটা ঠেলতেই খোলা পেয়েছে ও। ওখান দিয়ে পালানোর চিন্তা করেও পরমুহূর্তে সেটা বাতিল করে দিল রানা। লোকগুলোর কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে, তারা মনে করছে রানা ও জুলেখা আহত। কাজেই রানা ঠিক করল ওদেরকে থতমত খাইয়ে দিয়ে পরিস্থিতি অনুকূলে আনার চেষ্টা করবে। আহা, জুলেখার সঙ্গেও যদি এখন একটা পিস্তল থাকত। ডানাকিলে প্রমাণ পেয়েছে, কেমন লড়াকু মেয়ে ও।
শরীর কাত করে প্যান্টের ভেতর হাত ভরল রানা। ঊরু থেকে তুলে আনল পিচ্চি গ্যাস বোমাটা। নতুন ধরনের এক নার্ভ গ্যাস ভরা আছে এটায়। জিনিসটা কয়েক ঘণ্টার জন্যে হতবিহ্বল করে রাখবে একজন মানুষকে। বিসিআই ল্যাবোরেটরী সতর্ক করে দিয়েছে ওকে, খুব শক্তিশালী লোক ছাড়া অন্যদের জন্যে জীবনহানিকরও হতে পারে বোমাটা। উপায়ান্তর নেই যখন, কি আর করা, শরীর প্রায় দু’ভাঁজ করে ধাপ বেয়ে পা টিপে টিপে
উঠতে লাগল মাসুদ রানা।
আরও কণ্ঠস্বর। গাড়ির এঞ্জিনটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। এবার একটা দরজা খোলার ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ। সটান দাঁড়িয়ে, বাঁ হাতে বোমাটা ছুঁড়ে মারল রানা, শেষ মুহূর্তে দূরত্ব মেপে নিয়েছে। ঠিক করেছে সরাসরি আক্রমণ চালাবে। গাড়িটার বাঁদিকে পড়ে বোমাটা
বিস্ফোরণ ঘটালেও, রানার দৃষ্টি ছিল হেডলাইটের আলোয় উদ্ভাসিত এলাকাটার দিকে। ওর লুগার গর্জে উঠতেই একজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এবার কে যেন, উল্টানো ক্যারিজটার আড়াল থেকে মেশিন পিস্তলের গুলি বর্ষাতে লাগল। মাথার ওপরে, পাথুরে
দেয়ালে গুলি ঠিকরে দিক বদল করায় নিচু হলো রানা।
‘বিল্ডিঙের ভেতরে যাও,’ জুলেখাকে বলল রানা।
বেজমেন্টে ত্বরিত সেঁধিয়ে পড়ল ওরা পথ খুঁজে। অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটার চারপাশে ডাঁই করে রাখা কার্ডবোর্ড কার্টন। রাস্তা থেকে আরেক পশলা গুলিবর্ষণ হলো, ঝনঝন শব্দে চুরমার হয়ে গেল কাঁচ। মাথার ওপরে, দুপ-দাপ পা ফেলার আওয়াজ।
‘পাহারাদার,’ বিড়বিড় করে জুলেখাকে বলল রানা। ‘লোকটা পুলিসে খবর দিলে হয়।’
‘না দিলেই বরং নিরাপদ আমরা,’ মৃদু স্বরে বলল যুবতী।
‘তৃতীয় বিশ্বে যা হয়। ওরা কাদের সাপোর্ট করবে কে জানে!’
এক সার সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসছে পদশব্দ। দু’পাশে গাদা করে রাখা কার্টনগুলোর পেছনে গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল রানা আর জুলেখা। বাইরে রাস্তায়, ভারী জুতো পরা পায়ের আওয়াজ উঠল। ম্যাকলিন?
কার্টনের মাঝখানের গলিটাতে দেখা হলো লোক দুটোর। দু’জনেই গুলি চালাচ্ছে। দোরগোড়ার সামান্য ভেতরদিকে দাঁড়িয়ে ম্যাকলিন। নৈশপ্রহরী রানাদের ও ম্যাকলিনের মধ্যখানে অবস্থান নিয়েছে। প্র ম গুলি করার সুযোগ পেলেও লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলো পাহারাদারের। মেশিনপিস্তলের ফায়ার ওপেন করল ম্যাকলিন। রানা দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেল প্রহরীর দেহটা ঝাঁঝরা হয়ে গেল। ফ্ল্যাশলাইট আর পিস্তল খসে পড়ল তার হাত থেকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে।
স্তব্ধ হলো ম্যাকলিনের পিস্তল। এক লাফে আইলে গিয়ে পড়ল রানা, লুগারটাকে তলপেট বরাবর তাক করে ধরে একটা গুলি করল। তারপর ডাইভ দিয়ে পড়ল মেঝেতে। আর্তনাদ ছাড়ল ম্যাকলিন। আরেক ঝাঁক গুলি উগরাল ওর মেশিন পিস্তল, তারপর স্তব্ধ হয়ে গেল। রানার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে বুলেটগুলো। অগিড়বশিখা লক্ষ্য করে আরেকবার গুলি করল রানা। এবার মেঝেতে পতনের শব্দ শুনতে পেল ম্যাকলিনের।
বাঁ হাতে লুগার নিয়ে এসে, ডান হাতে স্টিলেটো বাগিয়ে ধরে, দ্রুত আইলের মাথায় চলে এল রানা। দরজার কাছে পাওয়া গেল ম্যাকলিনকে। শ্বাস চলছে ওর, তবে ক্ষীণ।
‘জুলেখা,’ ডাকল রানা। ‘বেরিয়ে এসো।’
দরজা দিয়ে বেরিয়ে, সিঁড়ির ধাপ ভেঙে উঠে এল ওরা, পৌঁছল রাস্তায়। কৌতূহলী লোকজন দেখা গেল বিপদসীমার বাইরে, ফলে লুগারটা হাতছাড়া করল না রানা।
‘দৌড়াতে পারবে?’ জুলেখাকে শুধাল ও।
‘পারব,’ বলল যুবতী। ‘কোথাও থেকে জেনারেল হাশমীকে ফোন করা দরকার।’
আঁকাবাঁকা গলিপথের মধ্য দিয়ে ছুটছে ওরা। এক ফাঁকে লুগার ও স্টিলেটো গোপন করল রানা। অবশেষে ব্যস্ত একটা রাস্তা পেয়ে গেল ওরা। বেশ কটা বার লক্ষ করল এখানে। থেমে দাঁড়িয়ে কাপড়-চোপড় ঠিকঠাক করে নিল দু’জনে। তারপর ঢুকে পড়ল একটা বারের ভেতর।

« পূর্ববর্তী:
« কান্তার মরু – ১৩
পরবর্তী: »
কান্তার মরু – ১৫ (শেষ) »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি – জোক্স – লিরিক – রেসিপি – কামসূত্র – হেলথ – PDF

Return to top