দুই, বড়জোর তিন মিনিট বিশ্রাম নিল রানা। সময়টুকু যদিও ঢের লম্বা মনে হলো ওর কাছে। হাতঘড়ি বলছে দশটা পঁয়ত্রিশ। কিন্তু এখন নটা পঁয়ত্রিশ কিংবা এগারোটা পঁয়ত্রিশ হওয়াও বিচিত্র নয়। টাইম জোনের পরিবর্তন শুধুমাত্র আন্দাজের ওপর ধারণা করছে রানা।
সুইচটা খুঁজে পেয়ে জ্বালল ও। খুব সাবধানে, বোসানস লকার ত্যাগের আগে মাথায় এঁটে বসানো হ্যাটটা খুলল। একটুকরো ক্যানভাসে হাত দুটো মুছে নিয়ে চুলে আঙুল বুলাল রানা। কোণার দিকগুলো সামান্য ভিজে হলেও চাঁদিটা শুকনো খটখটে। হ্যাটখানা দুমড়ে মুচড়ে ভেজা জায়গাগুলো ঢাকার চেষ্টা করল ও।
ফাউল-ওয়েদার জ্যাকেট শরীরচ্যুত হলো এরপর। ওটাকে ক্যানভাসে ফেলে দিয়ে গা শুকোতে লাগল রানা। আন্ডারশর্টস ওর ভিজে জবজব করছে। কাজেই খুলে ফেলে নিংড়ে নিতে হলো। শরীর ভেজা নয়, শুকনো; নিশ্চিত হয়ে, ক্যানভাসের ছোট টুকরো দুটো আর জ্যাকেটটা গুটিয়ে গোল করে নিল রানা। এবার ক্যানভাসের বড় খণ্ডটার ভেতর ওগুলো ভরে বান্ডিলটা বয়ে নিয়ে গেল বোসানস লকারের ও মাথায়। আরও কিছু গিয়ার ও ক্যানভাসের পেছনে একটা বিনে গুঁজে দিল ওটা।
ক্যাঁচ করে হঠাৎ একটা শব্দ হলো। হাতের কাছে এক মেটাল পাইপ পেয়ে তুলে নিয়ে পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল রানা। নিচের লেভেলে চলে যাওয়া স্কাট্লটা খুলে যাচ্ছে। লাফ দেয়ার জন্যে ঝুঁকেছে এমনিসময় মেঘবরণ দীঘল চুল ও কালো কুচকুচে একজোড়া চোখ দেখতে পেল।
‘রানা?’ জেন এসেক্সের কণ্ঠস্বর।
‘আরেকটু হলেই মরতে।’
‘ওই গর্তে অপেক্ষা করতে করতে পাগল হওয়ার দশা। মেসেজ পাঠাতে পেরেছ?’
জানাল রানা। ডেকের যেখানটায় পানি ইঞ্চি দুয়েক ছিটকে উঠছে সে জায়গাটা নির্দেশ করল ও। ‘এসো না,’ বলল। ‘নিচে পানির ছাপ না পেলে প্রমাণ হবে জেলখানা থেকে বেরোইনি আমরা। মইয়ের কাছ থেকে এক মিনিট একটু দূরে থাকো।’
তখনও নগড়ব, জুতো-মোজা, খাকি ট্রাউজার, পরিচ্ছনড়ব শার্ট ও ভেজা শর্টস জড় করল রানা। ঝুঁকে পড়ে স্কাট্ল দিয়ে ছেড়ে দিল ওগুলো নিচের ডেকে। তারপর মুখ রাখল নিচে, জেনকে যাতে দেখতে পারে।
‘একটা কাপড় লাগবে পা মোছার জন্যে।’
জেনকে মইয়ে না দেখতে পাওয়া অবধি অপেক্ষা করল রানা, এবার হ্যাচের ওপর বসে সতর্কতার সঙ্গে পা দুলিয়ে নামিয়ে দিল স্কাট্লে। মোটা, রুক্ষ কাপড় দিয়ে জেন পা মুছে দিচ্ছে টের পেল। ‘হয়েছে,’ বলল জেন।
মই বেয়ে ত্বরিত নেমে গেল রানা, স্কাট্লটা টেনে পেছনে বন্ধ করে, হুইল ঘুরিয়ে দিল। ডেকে পৌঁছে জেনের দিকে চাইল ও। রানার পাশে দাঁড়িয়ে যুবতী, হাতে ডেনিম শর্টস। ‘এটা ছাড়া আর কিছু পেলাম না।’
‘চলো,’ আদেশ করল রানা। ‘খাঁচায় ফিরে যাই।’
প্যান্ট পরে নিল ও, কিন্তু মাথা ঘামাল না অন্যান্য কাপড়-চোপড় নিয়ে। ভেজা শর্টস পরেনি জেন। জেলখানায় ফিরে ব্ল্যাঙ্কেটে পোশাকগুলো ছুঁড়ে দিল ওরা। রানা ওয়্যার ডোর চেপে ধরে যথাস্থানে ওটাকে টেনে ফেরানোর চেষ্টা করছে, ওদিকে ব্ল্যাঙ্কেট হাতড়ে কব্জার পিনগুলো কুড়িয়ে নিল জেন। দশ মিনিট লেগে গেল ওগুলোকে জায়গা মত বসাতে।
আফটার বাল্কহেডের গায়ে হাত বুলিয়ে আঙুল নোংরা করল রানা। পিনে আর কব্জায় নোংরা মাখাচ্ছে ও, ইতোমধ্যে ক্যামেরা জুড়ে ফেলল জেন।
ঠিক পঁচিশ মিনিট বাদে এল ওরা। ব্ল্যাঙ্কেটে তখন পাশাপাশি শুয়ে রানা ও জেন। স্কাট্ল খুলে যেতে সশস্ত্র এক নাবিক প্রবেশ করল কারাগারে।
‘আমাকে সামলাতে দাও,’ ফিসফিস করে বলল জেন। দ্বিমত করল না রানা।
‘ওরা এখানেই আছে,’ বলল সেইলর ম্যাকলিনকে। ‘বললাম না তোমাকে…’
‘জাহাজ কি ডুবছে?’ হঠাৎ তীক্ষ্ন চিৎকার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল জেন, আঁকড়ে ধরেছে তারের জাল। ‘রানা, আমরা ডুবে যাচ্ছি!’
‘বাজে কথা ছাড়ো,’ ধমকে উঠল ম্যাকলিন।
তার ধরে টানাটানি লাগিয়ে দিল জেন। ‘আমাকে এখান থেকে বেরোতে দাও!’ বলে উঠল ও। ওর আক্রমণের ফলে রীতিমত কাঁপুনি উঠে গেছে দরজাটার। ‘আমি এভাবে ডুবে মরতে চাই না, বাঁচার একটা সুযোগ চাই।’
‘চোপ!’ কড়া ধাতানি দিল ম্যাকলিন।
‘ওকে ধমকাচ্ছ কেন?’ কঠোর কণ্ঠে জবাব চাইল রানা।
‘তোমার খুব লাগছে বুঝি?’ বিদ্রূপ ঝরল ম্যাকলিনের কণ্ঠে।
‘আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও,’ হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত
চেঁচাচ্ছে জেন, দু’চোখে বান ডেকে এনেছে। ‘তুমি যা বলবে তাই করব। দোহাই লাগে, বাঁচাও আমাকে।’
‘কেন, আজ সন্ধেবেলা বেরোওনি তুমি?’
‘কি বলছ আবোল তাবোল,’ বলল জেন, ফোঁপানির জোর আরও বাড়ল।
‘থামবে তুমি?’ গর্জে উঠল ম্যাকলিন। ‘নাকি পেটে গুলি করতে বলব?’ এবার রানার দিকে চাইল। ‘কতক্ষণ ধরে চলছে এই ন্যাকামি?’
‘সেই সন্ধে থেকে। সাগর যখন থেকে ফুঁসে উঠল। মেস স্টুয়ার্ডকে দিয়ে মিস জেনের জন্যে এক শট হুইস্কি পাঠাও না কেন?’
‘পাগল নাকি? ডেকের অবস্থা জানা আছে তোমার?’
‘কি করে জানব?’
‘তা বটে।’ কম্পার্টমেন্টের চারধারে নজর বুলাল ও। গার্ডের উদ্দেশে বলল, ‘ক্যাপ্টেনকে বললাম এরা এখানে আছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। প্রেমিকা ঘুমের ঘোরে ব্যথা পাওয়ায় মাথা খারাপ হয়ে গেছে বুড়োর।’
রানা বা জেন বেরতে পেরেছিল ম্যাকলিন তা বিশ্বাস করে না। স্বস্তির শ্বাস গোপন করল রানা।
ম্যাকলিন সঙ্গীকে নিয়ে চলে গেলে রানার কাছ ঘেঁষে এল জেন। ওকে হাসতে দেখে ভ্রূ কোঁচকাল রানা। ‘চালিয়ে যাও। ওরা হয়তো কান পেতে আছে।’
আরও মিনিট চারেক অভিনয় পর্ব চলল জেনের। রানা মুগ্ধ হয়ে গেল ওর পারফরমেন্স দেখে।
‘মেরী এন্ডারসনের কথা কি যেন বলল লোকটা?’ যুবতী জিজ্ঞেস করল শেষমেষ।
খোলাসা করে পুরোটা জানাল ওকে মাসুদ রানা।
পরদিন রেড সি-তে আটকা পড়ে গেল ওরা। শেপ মাইয়ারের পাশে এসে ঠেকেছে এক আরবী সমুদ্রগামী জাহাজ। ফরোয়ার্ড কার্গো বুম স্থানীয় জাহাজটিতে চালান করে দিল মিসাইলগুলো। কার্গো নেটে করে ডাউতে তুলে দেয়া হলো রানা ও জেনকে, নরওয়েজিয়ান নাবিকরা কভার করল পেছন থেকে, এবং সামনে থেকে রাইফেল তাক করে ধরল ডাউয়ের আরব আগন্তুকরা। মিস্টার ম্যাকলিন সঙ্গ দিল রানাদের।
কাঠের রেইলে হেলান দিয়ে শেপ মাইয়ারকে সরে যেতে দেখল রানা। প্র মে, শুধুমাত্র ওটার পোর্ট রানিং লাইট দেখতে পেল; তারপর বড় হলো ফাঁকটা, দেখা দিল স্টার্নের সাদা রেঞ্জ লাইট।
পেছন থেকে এসময় আরবী ভাষায় আদেশ জারি হলো। বুঝতে পেরেছে তার লক্ষণ দেখাল না রানা।
‘তোমার প্যাসেজ মানি কাজে লাগল,’ বলল ম্যাকলিন।
‘মালদিনি?’
‘হ্যাঁ। তুমিও যাচ্ছ তাঁর কাছে।’
ম্যাকলিনের আদেশে, নিচের ডেকে নিয়ে গিয়ে কেবিনে বন্দী করা হলো রানা ও জেনকে। শেষ যে জিনিসটা দেখতে পেল রানা সেটা হচ্ছে তেকোণা এক পাল, উঠে যাচ্ছে ওপরদিকে। জাহাজের চলনভঙ্গি নিশ্চিত করল মাটির ঢিবির ফাঁকফোকর দিয়ে ইথিওপিয়ান কোস্টলাইনের উদ্দেশে পথ করে নিয়ে এগোচ্ছে ওটা।
দেয়াল ভেদ করে টুকরো-টাকরা কথোপকথন যা কানে এল, তাতে নিশ্চিত হলো রানা ওর অনুমান নির্ভুল-আসাবের উত্তরে এবং মাসাওয়ার দক্ষিণে কোথাও রয়েছে ওরা। নোঙর ফেলল জাহাজ। এক দঙ্গল লোক উঠে এল জাহাজে, ডেকের ওপর দিয়ে ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাক্স। প্যাকিং কেস খোলার শব্দ বেশ কবার পেল রানা।
‘মিসাইলগুলো কতখানি নিরাপদ?’ ফিসফিস করে জেনকে জিজ্ঞেস করল ও।
‘জানি না। আমাকে বলা হয়েছে মালদিনি ওঅরহেডের জন্যে ডিটোনেটর চুরি করেনি, এবং আমার জানা আছে ফুয়েল নেই ওগুলোর মধ্যে।’
শব্দের সঙ্গে রানার অনুমানের সাযুজ্য থাকলে বলতে হবে, রবার্তো মালদিনি রীতিমত সুদক্ষ এক সংগঠনের কর্ণধার। লোকে মিসাইল বলতে দু’তিন ভাগে বিভক্ত, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সিলিণ্ডারসদৃশ মৃত্যু-এঞ্জিন মনে করলেও, আসলে অসংখ্য খুদে খুদে যন্ত্রাংশ জুড়ে তৈরি করা হয় জিনিসটাকে। সুযোগ্য মিসাইল এক্সপার্টের তত্ত্বাবধানে যে কোন বড়সড় ওঅর্ক-ক্রু এক রাতে কমপক্ষে গোটা তিনেক মিসাইল খুলে আলাদা করতে পারে। আওয়াজ বলছে, মাথার ওপর দলে-বলে যথেষ্ট ভারী এ জাহাজের ক্রুরা।
গুমোট হয়ে উঠছে μমেই কেবিনের ভেতরটা। ইথিওপিয়ার ইরিট্রিয়ান উপকূল দুনিয়ার অন্যতম উত্তপ্ত এলাকা, তাও সূর্য এখনও মাথার ওপর চড়াও হয়নি। একটু পরে কেবিনের দরজা খুলে গেল। এক রাশান মেশিন পিস্তল হাতে ম্যাকলিনকে দেখা গেল দোরগোড়ায়। পেছনে রাইফেলধারী দুই নাবিক। তৃতীয় নাবিক বয়ে এনেছে একগাদা কাপড়-চোপড়।
‘কোথায় যাচ্ছ জানতে তুমি, মিস্টার রানা,’ বলল ম্যাকলিন। ‘তোমার বুট আমার পায়ে লাগলে ওগুলো আর ফেরত পেতে না। মরুভূমিতে হোঁচট খেতে খেতে মরতে।’
‘আমার ডাফ্ল ব্যাগ থেকে পুরো ডেজার্ট কিট বের করেছ বুঝি?’
‘না। শুধু বুটজোড়া আর কিছু ভারী ভারী মোজা। মিস জেনের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। এছাড়া বাকি কাপড়গুলো স্থানীয় আরবী পোশাক।’
পোশাক বহনকারীর উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল ও। কাঠের ডেকে ঝপাৎ করে ফেলে দিল লোকটা ওগুলো। ম্যাকলিনের দ্বিতীয় নডে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল সে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল ম্যাকলিন পেছনে হেঁটে, মেশিন পিস্তল অকম্প হাতে তাক করে রাখল বন্দীদের দিকে।
‘কাপড় পাল্টে নাও,’ আদেশ করল চলে যাওয়ার আগে। ‘সিংহ কিংবা হায়েনার পেটে গেলেও বুট আর ঘড়ি দেখে তোমার লাশ চিনতে পারব আশা করছি।’ দুম করে দরজা লাগিয়ে তালা মেরে দিল ও।
খানিক বাদে ফিরে এসে রানা ও জেনকে তীরে নামার আদেশ দিল ম্যাকলিন। ইতোমধ্যে কাপড় পাল্টে ফেলেছে ওরা। ঢলঢলে আরবী আলখাল−ায়, এই গরমের দেশে বরং স্বচ্ছন্দ বোধ করছে রানা। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ যেহেতু মুসলমান, বোরখায় মুখ ঢেকে রাখতে পরামর্শ দিয়েছে ও জেনকে। হ্যাট পরে নিয়ে, জেনকে সঙ্গে করে টপসাইডে চলে এল রানা। ছোট্ট উপসাগরের ঘন নীল পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সূর্য তার সমস্ত তাপ নিয়ে। পশ্চিমে, বিস্তৃত ওয়েইল্যান্ড পড়ে রয়েছে রানাদের সামনে। দড়ির মই বেয়ে ছোট্ট এক বোটে নেমে, ত্বরিত চালান হয়ে গেল ওরা তীরে।
জেন ইতিউতি চেয়ে রিসিভ করতে আসা ট্রাক খুঁজছে। কিন্তু কোথাও নাম-গন্ধ নেই তার।
‘হাঁটছি আমরা,’ ম্যাকলিন ঘোষণা করল।
দু’মাইল হেঁটে ইনল্যান্ডের ভেতর ঢুকে পড়ল ওরা। দু’বার রাস্তা অতিμম করল, বালি ও পাথরের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া ট্র্যাকে ট্রাকের চাকার গভীর দাগ আবিষ্কার করল। রাস্তায় পড়ামাত্র মিছিল থামিয়ে দিচ্ছে ম্যাকলিন, বিনকিউলার নিয়ে লোক চলে যাচ্ছে সামনে গাড়ি-ঘোড়া আসে কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে।
বেশিরভাগ অঞ্চলে ধু-ধু বালি, তবে মরুভূমির এখানে সেখানে পাথরে ঘেরাও ছোটখাটো পাহাড় ও অ্যারোয়ো দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় রাস্তাটা ছেড়ে আসার অনেকক্ষণ পরে উত্তরমুখো হলো দলটা। প্রবেশ করল অসংখ্য ছোট ক্যানিয়নের একটিতে। এখানে
এক উট-বহরের সঙ্গে মিলিত হলো ওরা।
পাথরের আড়ালে লুকানো ছিল পঁচাত্তরটার মত উট। চালক রয়েছে মনে হলো প্রত্যেকটার। লোকগুলো জগাখিচুড়ি ভাষায় হৈহট্টে গাল বাধিয়ে দিল। আরবী ভাষাটা শুধু চিনতে পারল রানা। আরবী ঘেঁষা সোমালী আঞ্চলিক ভাষাও বলছে কেউ কেউ। নেতা গোছের লোকগুলোকে খুঁজে নিতে বেগ পেতে হয় না। পোশাক ভিনড়ব, পাথরের ছায়ায় হ্যাট বিহীন তারা। হালকা বাদামী গায়ের রং তাদের, উচ্চতা মাঝারি, উঁচু, পাকানো চুল। ব্রেসলেট ও কানের দুলের প্রতি বিশেষ ঝোঁক দেখা গেল এদের। ঝট করে মনে পড়ে গেল রানার বিসিআইয়ের সাবধানবাণী-ডানাকিল গোত্র, মরুভূমির নামানুসারে যাদের নাম-বড় নিষ্ঠুর, ভয়ঙ্কর জাতি। প্রথম শত্রুনিধনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কান ফুটো করে এরা, ব্রেসলেটগুলো হলো যোদ্ধারা কতজন প্রতিপক্ষ হত্যা করেছে তার সাক্ষ্য।
এক শক্তসমর্থ, ধূসরচুলো ডানাকিল এগিয়ে এল পাথরস্তূপের আড়াল থেকে। ‘এ হচ্ছে সাচ্চি,’ ইতালিয়ানে বলল ম্যাকলিন। ‘নাম আসলে সাচ্চি না, কিন্তু উচ্চারণ করতে দাঁত ভেঙে যায় তাই এ নামে ডাকা।’
ডানাকিল লোকটা ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ম্যাকলিনের মুখের দিকে। বাঁ হাত দুলিয়ে অস্ত্র নামিয়ে রাখতে ইঙ্গিত করল ম্যাকলিনকে। বিশালদেহী নাবিক প্রতিবাদ করতে মুখ খুলে, আবার কি ভেবে চুপ মেরে গেল। ডানাকিল এবার রানাদের উদ্দেশে ঘুরে তাকাল। ‘রানা’, আঙুল-ইশারায় বলল। ‘জেন।’ যুবতীর দিকে চাইল।
সায় জানাল মাসুদ রানা।
ওর ইতালিয়ান সাবলীল নয়। তবে খারাপও নয়। ‘আমি তোমাদের ক্যারাভানের কমান্ডার। তিন ক্যারাভানে যাব। হাঁটতে হবে। প্রশ্ন?’
‘কদ্দূর?’ জানতে চাইল রানা।
‘কয়েক দিন। উটেরা পানি আর মালপত্র নিয়ে যাচ্ছে জেনারেল মালদিনির জন্যে। নারী-পুরুষ সবাই হাঁটবে। এই মরুভূমিতে আমার লোকজন আর মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু নেই। ডানাকিল ছাড়া কেউ পানি পাবে না। বোঝা গেছে?’
মাথা ঝাঁকাল রানা। এসময় কথা বলে উঠল ম্যাকলিন। ‘সাচ্চি, এ বড় ডেঞ্জারাস লোক। মানুষ খুন করতে হাত কাঁপে না…’
‘তোমার কি ধারণা আমার কাঁপে?’ বাহুর ব্রেসলেটগুলো স্পর্শ করল সাচ্চি। তারপর ঘুরে হাঁটা দিল।
চোদ্দটা ব্রেসলেট, গুণতে ভুল হয়ে না থাকলে, পরে রয়েছে লোকটা। স্থানীয় রেকর্ড কিনা কে জানে, ভাবল রানা।
সকাল গড়ালে পর, দলের তিন ভাগের এক ভাগ একটা ক্যারাভান গঠন করে বিদায় নিল। মনে মনে ওদের সংগঠনের তারিফ করল রানা। ডানাকিল উপজাতি অত্যন্ত সুশৃক্মখল ও কর্মঠ। উট ও চালকদের দ্রুত সারিবদ্ধ করল ওরা, বন্দী ও বাড়তি লোকদের মাঝে রেখে, রওনা দিল। ওদের চোখ আশপাশের গ্রামাঞ্চল ঝাঁট দিয়ে যাচ্ছে, যদিও অ্যারোয়োর ঘেরাওয়ের মধ্যে এখনও রয়ে গেছে তারা।
উটচালকরা পর্যন্ত সামরিক শৃক্মখলা বজায় রাখছে। নেতারা যেখানেই জায়গা নিক না কেন আপত্তি করছে না ওরা। বন্দীদের প্রতি পাহারাদাররা চেঁচামেচি করছে না কিংবা চাবুক আছড়াচ্ছে না। তার বদলে শান্ত গলায় আদেশ করছে, চট করে পালিত হচ্ছে
সে আদেশ। বন্দীরা রানাকে কৌতূহলী করে তুলল।
এদের কারও কারও কোমরে শিকল, যদিও ভারী লোহা অপসারণ করা হয়েছে। মহিলা আছে বেশ কিছু, বেশিরভাগের গায়ের রংই কালো কুচকুচে।
‘এরা কি ক্রিতদাসী নাকি?’ মৃদু কণ্ঠে শুধাল জেন।
‘হ্যাঁ।’
‘ইস, আমি যদি ওদের মতন হতে পারতাম,’ ছেলেমানুষী কণ্ঠে বলল জেন।
‘পারবে না।’ বলল রানা।
‘কেন?’
‘কারণ তুমি একজন পেশাদার এজেন্ট। আমার মনে হয় না কোন গোত্রপতির উপপতড়বী হওয়ার কপাল নিয়ে জন্মেছ তুমি। মালদিনি জানতে চায় আমরা কতটা জানি। লোকটা সম্ভবত ভয়ানক নিষ্ঠুর। ওকে মজাতে পারবে না তুমি।’
‘ধন্যবাদ,’ বলল জেন। ‘আমাকে ভালই আশ্বস্ত করলে তুমি।’
‘চুপ করবে তোমরা?’ খেঁকিয়ে উঠল হঠাৎ ম্যাকলিন।
‘তুমি উটের খুরের নিচে মাথাটা পাতবে?’ পাল্টা বলল জেন।
মেয়েটির দুঃসাহস দেখে অবাক হয়ে গেল রানা। ওদিকে, তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে ম্যাকলিন। ওর কর্কশ হুঙ্কারে এলাকার প্রতিটা উট আঁতকে উঠল। এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে, বোল্ডারে রানার পাশে বসে থাকা জেনের উদ্দেশে ঘুসি ছুঁড়ল লোকটা। ওর
বাহু খপ করে ধরে ফেলল রানা, দেহের ওজন সামনে ছুঁড়ে দিয়ে, মোচড় মারল কাঁধ ও নিতম্বে-চিতপাত হয়ে ভূতলশায়ী হলো ম্যাকলিন।
ক’জন ডানাকিল দৌড়ে এল এদিকে। ম্যাকলিনকে ধুলোয় গড়াতে দেখে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠল কেউ কেউ। কথার তুবড়ি ছুটতে বোঝা গেল, যারা দেখেনি তাদেরকে ঘটনার বয়ান দিচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শীরা।
ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়িয়েছে ইতোমধ্যে ম্যাকলিন। ‘তুমি বাঁচবে না, রানা,’ চাপা কণ্ঠে বলল।
ঘিরে থাকা জনতার মাঝে সাচ্চিকে লক্ষ করল রানা। ডানাকিলদের মতলবটা কি অনুমান করার চেষ্টা করল। ওরা কি বাধা দেবে, নাকি উৎসাহ? রানার হাতে ম্যাকলিন মারা পড়লে তখন কি হবে?
ম্যাকলিন লোকটা ইয়া লম্বা, ছ’ফিট তিন নিদেনপক্ষে, বাড়তি চল্লিশ পাউন্ড বহন করছে দেহে। বিদঘুটে ভঙ্গিতে দু’হাত শূন্যে তুলে রানার দিকে এগিয়ে এল । কয়েক পা হেঁটেই হঠাৎ তেড়েফুঁড়ে এল লোকটা। একপাশে সরে গেল রানা, জায়গা পরিবর্তনের সময় ডান পা তুলে কষে লাথি ঝাড়ল। ঢোলা আলখাল্লার কারণে মারটা জুতসই হলো না, নইলে ওই লাথি খেয়ে যে-কারও দু’ভাঁজ হয়ে যাওয়ার কথা। কাপড়ে জড়িয়ে গিয়ে, ম্যাকলিনের সোলার প্লেক্সাসে অপেক্ষাকৃত দুর্বল লাথি হানল রানার পা। ‘হুঁক’ শব্দ করে তাল হারিয়ে সামনে হোঁচট খেল লোকটা।
মাটিতে ডিগবাজি খেয়ে এক গড়ান দিয়ে উঠল রানা, চোখা পাথরের খোঁচায় পিঠে ছুরি বিঁধল যেন। সটান লাফিয়ে উঠে টলমল পায়ে পিছু হটে গেল ও। অনুভব করল পিঠে ধাক্কা দিয়ে বেষ্টনী থেকে লড়াইয়ের ময়দানে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে ওকে।
ক্রুদ্ধ লোকটা ধেয়ে এল আবারও। ওর ডান হাতটা বাম কনুই দিয়ে ঠেকাল রানা, শরীর বাঁকিয়ে পাঞ্চটার আংশিক ফিরিয়ে দিল, তারপর দুম করে বাঁ হাত চালিয়ে দিল প্রতিপক্ষের চোখ লক্ষ্য করে। অস্ফুট আর্তধ্বনি করে মাথা ঝাড়া দিল লোকটা। বাঁ হাত
ঘুরিয়ে রানার পাঁজরে সর্বশক্তিতে আঘাত হানল।
দম বন্ধ করা যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল রানার দেহে।
আক্রমণ করল ফের ক্ষিপ্ত ম্যাকলিন। দু’হাত সমানে চলছে। রানা ওর বাহুর নিচে ডুব মেরে, বুকে মাথা রেখে পিস্টনের মত দ্রুতবেগে হাত চালাতে লাগল পাঁজর ও তলপেট বরাবর। প্রকাণ্ড দুটো মুঠো পিঠে তাল ঠুকছে টের পেল। ক’ইঞ্চি পিছে সরে, ডান কনুই দিয়ে বাঁ হাতের হুক ঠেকাল রানা। নিজের বাঁ হাত ঝেড়ে দিল বিপক্ষের চিবুকে। তড়াক করে সিধে হয়ে গেলেও ধরাশায়ী হতে রাজি হলো না লোকটা। এবার সমস্ত ওজন ব্যবহার করে, ম্যাকলিনের হৃৎপিণ্ডের ঠিক নিচে, ডান হাতের নিরেট এক হুক ঝাড়ল রানা। ছিটকে রুক্ষ মাটিতে চিত হয়ে পড়ে গেল নাবিক।
‘বেশ্যার বাচ্চাটাকে খুন করে ফেলো!’ আরবী ভাষায় পেছন থেকে বলে উঠল কে একজন।
আস্তে আস্তে গড়ান দিয়ে এক হাঁটুতে ভর রেখে বসল ম্যাকলিন। ওর চিবুকের নিচে ভারী ডেজার্ট বুট দাবানর জন্যে এগিয়ে গেল রানা। বেল্টের মেশিন পিস্তলের বাঁটে হাত ফেলল লোকটা। লাথিটা মারার আগেই গুলি করে বসবে, আশঙ্কা করল রানা।
বাদামী পোশাকধারী এক লোক ঝলসে উঠল রানার বাঁ দিক থেকে। রাইফেলের বাঁটের বাড়ি খেয়ে মেশিন পিস্তল খসে পড়ল ম্যাকলিনের হাত থেকে। এবার শূন্যে উঠে গেল রাইফেলটা, তারপর নেমে এল বাঁট, সজোরে ম্যাকলিনের বুকে আঘাত হেনে
ওকে শুইয়ে দিল মাটিতে।
‘থামো!’ হুকুম করল সাচ্চি, রাইফেল ঘুরিয়ে তাক করল ধরাশায়ী ম্যাকলিনের উদ্দেশে।
পেছন থেকে একজোড়া শক্তিশালী হাত চেপে ধরল রানাকে, বজ্র আঁটুনিতে দু’বাহু এক করে দিয়েছে। বাধা দেয়ার চেষ্টা করল না ও।
‘ও…’ বলতে চাইল ম্যাকলিন।
‘আমি দেখেছি,’ বলল সাচ্চি, ‘আমার লোকেরাও দেখেছে।’ রাইফেলের নল দিয়ে খোঁচা দিল লোকটাকে। ‘ওঠো। তুমি পরের ক্যারাভানের সাথে যাবে।’
উঠে দাঁড়াল ম্যাকলিন, তুলে নিল মেশিন পিস্তল। ডানাকিল উপজাতি তখনও ঘিরে আছে ওকে। ওদের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ম্যাকলিন, তারপর রানাকে বিদ্বেষের এক ঝলকে ভস্ম করে দিয়ে হোলস্টারে ভরল অস্ত্রটা। চার ডানাকিল সঙ্গ দিল আড়ষ্ট ভঙ্গিতে হেঁটে-যাওয়া ম্যাকলিনকে।
মাথা নাড়ল সাচ্চি। মুক্ত করে দেয়া হলো রানার বাহু। রাইফেলের নল দেখিয়ে বোল্ডারটা ইঙ্গিত করল ও। জেন তখনও বসে ওখানে। বিস্ফারিত দু’চোখ। রানা পাশে গিয়ে বসল ওর।
‘ম্যাকলিনকে খুন করলে না কেন?’ জবাব চাইল সাচ্চি।
‘ভাবলাম তোমার পছন্দ হবে না।’
‘রানা, আমি জানি আমার সাথে তুমি লাগতে আসবে না।’
সুনিশ্চিত শোনাল লোকটার কথাগুলো, আপত্তি করল না রানা।
মাঝ বিকেলে রওনা হলো দ্বিতীয় কাফেলা। সে রাতে অ্যারোয়োতে ঘুমাল ওরা। দু’বার ঘুম ভেঙে যেতে রানা দেখতে পেল পাহারা দিচ্ছে উপজাতীয় লোকগুলো।
পরদিন পশ্চিম যাত্রা করল ওরা।
Leave a Reply