৫১. মা

৫১
আজাদের মা ভাত খান না, বিছানায় শোন না, তবু দিন গড়িয়ে যায়, সূর্য ওঠে, সূর্য অস্ত যায়, মেলাঘরের মুক্তিযোদ্ধারা নতুন করে পরিকল্পনা আঁটতে থাকে, নতুন নতুন গেরিলারা প্রশিক্ষণ শিবির থেকে বেরিয়ে ঢুকে যেতে থাকে বাংলায়, কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গেরিলাদের আক্রমণে সারাটা টাঙ্গাইলে ময়মনসিংহে পাকিস্তানি বাহিনী মার খেতে থাকে, হেমায়েতের নেতৃত্বে দক্ষিণ বাংলায় চলে দুর্ধর্ষ গেরিলা অভিযান, মাহবুব আলমেরা ঢুকে পড়ে তেঁতুলিয়া দিয়ে, সারা বাংলাদেশের প্রতিটা সীমান্তে সেক্টর কম্যান্ডারদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনী, সেনাসদস্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, আর লক্ষাধিক মুক্তিবাহিনী জলে-ডাঙায় শানাতে থাকে আক্রমণ, বাংলার নদ-নদী বৃষ্টি বর্ষা ধানক্ষেত কাদামাটি ফাঁদ পেতে রাখে হানাদারদের জন্যে, বাংলার ফুল-ফল পাখি-পতঙ্গ আশ্রয় দেয় মুক্তিদের, বাংলার প্রতিটা ঘর দুর্গ হয়ে ওঠে, বাংলার প্রতিটা মানুষ হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা, আর যুদ্ধাহত হন খালেদ মোশাররফ, তবুও সেক্টর টু-র গেরিলা ওয়ারফেয়ার আরো গতি পেতে থাকে, আরবান গেরিলারা ঘিরে ফেলে ঢাকার চারপাশ, ওই তো গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছেন শিল্পী আজম খান, ওই তো রক্তে আগুনে ক্যানভাস রাঙাবেন বলে ক্রলিং করে অ্যাম্বুশ পাতছেন চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন, কবির কলম ফেলে রাইফেলের ট্রিগারের সঙ্গে মিতালী গড়েছেন হেলাল হাফিজ, রফিক আজাদ, আবু কায়সার, মাহবুব সাদিক৷
সারা বাংলাদেশ যুদ্ধ করছে৷ শাহাদত চৌধুরীর মাকে তাঁর এক গণিতজ্ঞ ভাই কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ‘আমাকে অঙ্কের হিসাবে বলো, এক পরিবারের কয়জন গেছে মুক্তিযুদ্ধে, ঢাকার রাস্তায় কয়টা পটকা ফোটালেই একটা প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীকে হারানো যায় না, ধরো তোমার ছয় ছেলে, কয়জন যুদ্ধে গেছে, আমার চার ছেলে, তারা তো বাসাতেই বসে আছে, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার মায়ের মুখ থেকে শুনতে চাই, আমার ছেলে যুদ্ধে গেছে৷’ তাঁকে মা তখন কিছু বলেননি; ৩০শে আগস্ট ৭১ তাঁর বাড়িতে পাকিস্তানি সৈন্যরা হানা দিয়ে তাঁর জামাতা বেলায়েতকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি আশ্রয় নেন তাঁর এই গণিতজ্ঞ ভাইয়ের বাড়িতেই৷ এবার তিনি ভাইয়ের পুরনো প্রশ্নের জবাব বুঝিয়ে দেন, ‘আপনি মুক্তিযোদ্ধার মাকে দেখতে চেয়েছিলেন, আমাকে দেখেন, আমার ছয় ছেলের তিনজনই গেছে মুক্তিযুদ্ধে, আমি অঙ্কের হিসাবে দেখি দু কোটি যুবকের এক কোটিই যোদ্ধা, বলেন, দেশ স্বাধীন হবে কি না ?’
আজাদের মা ভাত খান না, বিছানায় শোন না, ঢাকায় এক রাতে ধরা পড়ে অনেক গেরিলা, অনেক অস্ত্রশস্ত্র, কিন্তু আবারও ঢাকায় ঢুকে পড়ে গেরিলারা, রাইসুল ইসলাম আসাদের নেতৃত্বে ওই তো এগিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা বায়তুল মোকাররমে, সেনাবাহিনীর দুটো লরির মধ্যে হাইজ্যাক করা গাড়িতে বোমা পেতে রেখে একই সঙ্গে উড়িয়ে দিচ্ছে দুটো লরিই, বোমা বিস্ফোরিত হয় টিভি ভবনের ছয় তলায়, ঢাকার উত্তরে মানিক বাহিনীর তৎপরতা, আর দক্ষিণে ক্রাক প্লাটুন, ভায়াডুবি ব্রিজ ওড়াতে গিয়ে শত্রু বাহিনীর গুলি ভেদ করে মানিকের শরীর, পানি থেকে তার রক্তাক্ত গরম শরীরটাকে তোলে সহযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, মৃত্যুর আগে ঠোঁট নেড়ে কী যেন বলতে চায় মানিক, কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই ঠোঁটের স্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়, বাচ্চুর বিশ্বাস হয় না মানিক নাই, কিন্তু মানিক ততক্ষণে শহীদ, মানিক নাই, মানিকেরা থাকে না, কিন্তু যুদ্ধ এগোতে থাকে, তখন সেকেন্ড ইন কম্যান্ড বাচ্চু গ্রহণ করে নেতৃত্ব; পানির নিচে নেমে যাচ্ছে নৌ কম্যান্ডোরা, একই সময়ে চট্টগ্রাম, খুলনা, চাঁদপুর, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকায় ডুবিয়ে দেওয়া হবে জাহাজ, তিনশ নৌ কম্যান্ডো অপেক্ষা করছে কখন আকাশবাণীতে বাজবে আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম আমার যত গান, নেমে গেল যোদ্ধারা জলে, আবার অপেক্ষা পরের গানের জন্যে, আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি, জিরো আওয়ার, আঘাত করো, একসঙ্গে হঠাৎই ডুবে গেল ১০টা জাহাজ : অপারেশন জ্যাকপট, সেপ্টেম্বরে আবার পরিচালিত হয় অপারেশন জ্যাকপট-২, ধীরে ধীরে ঘেরাও হতে থাকে ঢাকা, চারদিকে ১৬ হাজার গেরিলা… সাভারের উপকন্ঠে অ্যাম্বুশ করে আছেন বাচ্চুরা, ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ, ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ফিরে আসছে আহত ব্যাঘ্রের ক্ষোভ আর ক্রোধ নিয়ে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ থেকে, তাদের আক্রমণ করতে, বাচ্চুদের সঙ্গে আজ আছে একটা কিশোর ছেলে টিটো, ও ঠিক যোদ্ধা নয়, অপারেশনে অতটুকুন ছেলের আসার কথা নয়, সে ক্যাম্পে থাকে, নানা কাজকর্মে সাহায্য করে, এ-ই তো যথেষ্ট এক কিশোরের জন্যে, ও কেন এসেছে, শুরু হয় ঘোরতর যুদ্ধ, মাথার ওপর দিয়ে শিস দিয়ে যাচ্ছে শত্রুর ছোড়া গোলাগুলি, একটা খবর জানানো দরকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটা রিজার্ভড অংশকে, টিটোকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু ও তো ছোট, ও তো যুদ্ধের নিয়মকানুন জানে না, হায় আল্লাহ, ওকে বাঁচিয়ে রাখো, ওই তো বাচ্চুর চোখের সামনে হাত তিরিশেক দূরে লুটিয়ে পড়ল টিটোর শরীর, ততক্ষণে টিটো অবশ্য তার ওপরে অর্পিত কাজটা সম্পন্ন করেছে, সঙ্গীদের জানিয়ে দিয়েছে তখনকার কর্তব্যনির্দেশ, শত্রুরা পিছিয়ে যায়, ছন্নছাড়া হয়, টিটোর রক্তাক্ত ছোট্ট শরীরটা আনা হয় ক্যাম্পে, টিটো বাঁচতে চায়, সে দেখতে চায় স্বাধীনতা, ‘আমাকে বাঁচান, আমি স্বাধীনতা দেখতে চাই’, কিন্তু টিটো মরে যায়, সাভারের মাটিতে তাকে সমাহিত করে রাখে সহযোদ্ধারা, তারপর এগোতে থাকে ঢাকার দিকে, এগিয়ে আসে মিত্রবাহিনী-মুক্তিবাহিনী…
সম্মুখসমরে ২৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য খতম করে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া আর ফতেহ চৌধুরীরা খানিক পিছিয়ে আসে বালু নদী থেকে৷ মধ্য ডিসেম্বরের এই সময়টায় বেশ কুয়াশা পড়ছে৷ ভোরের আলো ফোটবার সঙ্গে সঙ্গে তারা দেখতে পায় মেজর হায়দারকে৷ তাঁর পরনে পুরো কম্যান্ডো পোশাক৷ মেজর হায়দার বলেন: ‘এবার ফাইনাল আঘাত৷ ঢাকা দখল৷ সবাই প্রস্তুত৷’
আজাদের মাকে শুভার্থীরা পরামর্শ দেন মগবাজারের বাসা ছেড়ে দিতে, কেননা ওখানে থাকা নিরাপদ নয়, তিনি বাসাটা ভাড়া নেওয়া ছাড়েন না, নিয়মিত ভাড়া দেন, যদি আজাদ ছাড়া পায়, যদি এসে দেখে বাসায় কেউ নাই, কিন্তু তাঁরা চলে যান মালিবাগে, যাওয়ার আগে পড়শিদের ভালো করে বুঝিয়ে বলে যান, আজাদ এলে যেন তাকে তারা বলে যে মালিবাগের আগের বাসায় গেলেই হবে, ‘৭২ সাল পর্যন্ত মগবাজারের বাসার ভাড়া গুনেছেন তিনি, অবশেষে ছেড়ে দেন, এদিকে চৌধুরী সাহেবের পক্ষ থেকে কামরুজ্জামান আসতে থাকে আজাদের মায়ের কাছে, এখনও চলেন চৌধুরীর কাছে, আজাদের বাবাও তাঁর প্রথম ছেলেকে হারিয়ে মুষড়ে পড়েছেন, তিনি নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও ছেলের খোঁজ বের করতে পারেন না, আজাদের বাবার পানাসক্তি বেড়ে যায়, একেকটা রাতে তিনি ‘আজাদ আজাদ’ বলে নিজের চুল ছেঁড়েন, আজাদের ছোটমাকে অভিযুক্ত করেন নানা অভিযোগে, লোক পাঠিয়ে দেন সাফিয়া বেগমের কাছে, নানাভাবে মিনতি করেন যেন সাফিয়া বেগম তাঁর বাড়িতে ফিরে যান, কিন্তু আজাদের মা অনড়, প্রশ্নই আসে না চৌধুরীর কাছে ফিরে যাওয়ার, এ তাঁর নিজের যুদ্ধ, এ যুদ্ধে তিনি হেরে যেতে পারেন না৷
আজাদের মা ভাত খান না, বিছানায় শোন না, অপেক্ষায় থাকেন ছেলে আসবে বলে, আর খোঁজ বের করার চেষ্টা করেন ছেলের, রমনা থানায় যান, তেজগাঁও থানায় যান, এমপি হোস্টেলে যান, ছেলের খবর পাওয়া যায় না, অথচ বড় হুজুর আশ্বাস দিয়েছেন আজাদ বেঁচে আছে, সে ফিরে আসবেই৷
এই আশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকেন, দিন গুজরান করেন মহিলা৷
রুমীর কোনো খবর নাই, প্রতিদিন মগবাজারের পাগলাবাবার দরবারে যান জাহানারা ইমাম৷ সেখানে গিয়ে দেখতে পান আলতাফ মাহমুদের আত্মীয়স্বজনদের, ঝিনু মাহমুদ, মোশফেকা মাহমুদ, দেখতে পান চট্টগ্রাম দুর্নীতি দমন বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর নাজমুল হকের স্ত্রীকে, বরিশালের এডিসি আজিজুল ইসলামের স্ত্রীকে, কুমিল্লার ডিসি শামসুল হক খানের স্ত্রীকে, রাজশাহীর রেডিও ইঞ্জিনিয়ার মহসীন আলীর স্ত্রীকে, চট্টগ্রামের চিফ প্লানিং রেলওয়ে অফিসার শফি আহমেদের স্ত্রীকে, কুমিল্লার লে. ক. জাহাঙ্গীরের স্ত্রীকে, কুমিল্লার মেজর আনোয়ারুল ইসলামের স্ত্রীকে এবং এ রকম বহু৷ এদের সবারই স্বামী নিখোঁজ৷ তাঁরা পরস্পরের দুঃখের কাহিনী শোনেন৷ এদের মধ্যে থেকে জাহানারা ইমাম তাঁর নিজের ছেলেকে হারানোর শোক অনেকটা ভুলে থাকতে পারেন৷ পিএসপি আওয়াল সাহেবের স্ত্রী আসেন ছোট ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে, জাহানারা জানেন তাঁর তিন ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে, কিন্তু ভুলেও সে কথা তারা আলোচনা করেন না, উলফতের বাবা আজিজুস সামাদ ছাড়া পাওয়ার পরে তাঁর স্ত্রী তাঁকে আনেন পাগলাবাবার কাছে, কিন্তু ভুলেও জাহানারা তাঁকে শুধান না উলফত বা আশফাকুস সামাদের কথা৷
এরই মধ্যে একদিন খবর আসে, ৪ঠা সেপ্টেম্বর রাতে, ইয়াহিয়ার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগের রাতে, ঢাকায় শখানেক মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে৷ জাহানারা ইমাম ছুটে যান আজাদের মায়ের কাছে, আজাদের মা আজাদের কোনো খবর আর পাননি৷ জাহানারা ইমামের মনে এই আশঙ্কা জাগে যে, কেউ নাই, রুমী নাই, বদি নাই, বাকের নাই, জুয়েল নাই, আজাদ নাই, বাশার নাই, আলতাফ মাহমুদ নাই…
রুমীর মা অপেক্ষায় থাকেন যে রুমী ফিরে আসবে, আজাদের মা ভাত বেড়ে নিয়ে বসে থাকেন যে তাঁর ছেলে এসেই ভাত খেতে চাইবে, রুমী আসে না, আজাদ আসে না, জুয়েলের মা দিন গোনেন কবে ফিরে আসবে তার ছেলে, জুয়েল ফেরে না, বদির মা জানে না ছেলে তার কোন জেলখানায়, তার দিন যেন কাটতে চায় না, বাশারের মা ছেলেকে স্বপ্নে দেখে কেঁদে ওঠেন ঘুমের ভেতরে, জয়েন সেক্রেটারি এ আর খানের ছেলে সেকেন্দার হায়াত খান ফেরে না আর বাড়ি, তার মাও অপেক্ষা করেন, স্বামীকে মিনতি করেন আরেকটু সচেষ্ট হতে, ছেলেকে উদ্ধার করতে, তিনি এসে দেখা করেন আজাদের মায়ের সঙ্গে, মনোয়ার হোসেনের স্ত্রী দুলু রাতের বেলা বিনবিনিয়ে কাঁদে, লীনার বয়স বাড়ে একটু একটু করে মুক্তিযুদ্ধের বয়সের মতোই, আর স্বাধীনতা নিকটবর্তী হতে থাকে, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে, মুক্তিবাহিনী আর মিত্র বাহিনী দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকে ঢাকার দিকে, গভর্নর হাউসে মিটিং চলাকালে আকাশ থেকে এসে পড়ে ভারতীয় বিমানের বোমা৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *