রহস্যভেদী – ০২

যখনকার কথা বলছি, ঢাকুরিয়া অঞ্চলে তখনো আধুনিকতার হাওয়া লাগেনি, লেক তো দূরের কথা, সেখানে তখন ছিল ঘন বনজঙ্গল ও ধানক্ষেত। রেল লাইনের ধার দিয়ে দু-একটা পাকা বাড়ি দেখা যেত মাত্র।
ঢাকুরিয়া স্টেশনের কাছেই মধুসূদন সরকারের প্রকাণ্ড চারমহলা বাড়ি। বাড়ির সামনের দিকে একটি চমৎকার ফুলের বাগান। নানা জাতীয় ফুলগাছ সংগ্রহ করে বাগানটিকে তিনি সাজিয়েছেন। বাগানটি তাঁর অতি প্রিয়। কাজকর্মের অবকাশে সকাল-সন্ধ্যায় যে সময়টুকু তিনি অবসর পান, ওই বাগানেই ঘুরে ঘুরে বেড়ান।
বাগানটা যেন তাঁর কাছে একটা নেশার বস্তুর মতই হয়ে উঠেছিল। চিরদিনই তিনি অতি প্রত্যুষে শয্যাত্যাগ করেন, বাগানের মধ্যে খালি গায়ে চটিপায়ে পায়চারি করেন সূর্য ভাল করে না ওঠা পর্যন্ত। সেদিন সকালের দিকে শীতটা যেন বেশ একটু চেপেই পড়েছে। ভোরবেলা একটা হালকা কমলালেবু রংয়ের দামী শাল গায়ে জড়িয়ে মধুসূদন বাগানের মধ্যে একাকী পায়চারি করছেন, এমন সময় সলিলের সঙ্গে কিরীটী এসে বাগানের মধ্যে প্রবেশ করল।
কিরীটী এর আগেও দশ-বারোবার সলিলদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে এবং মধুসূদনবাবুর সঙ্গে যথেষ্ট পরিচয়ও আছে। কিরীটী মধুসূদনবাবুকে কাকাবাবু বলে ডাকে।
ওদের দেখে মধুসূদনবাবু বললেন, এই যে! তোমরা এত সকালে কোথা থেকে?
কিরীটী জবাব দিল, সলিল কাল আমার ওখানে ছিল কাকাবাবু, সলিলকে আসতে দিইনি, আজ সকালে একসঙ্গে আসব বলে। আপনার শরীর ভাল তো কাকাবাবু?
হ্যাঁ বাবা, বুড়ো হাড় কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে যে কটা দিন চালানো যায়। তারপর তোমার শরীর ভাল তো?
হ্যাঁ কাকাবাবু।
তোমাদের পরীক্ষাও তো এসে গেল, না?
হ্যাঁ, আর মাস তিনেক বাকী আছে।
বাবা, কিরীটী বলছিল তোমার হারানো দলিলটা ও খুঁজে বের করে দেবে। বললে সলিল।
মধুসূদন পুত্রের কথায় চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকালেন।
কিরীটী ধীরভাবে বললে, খুঁজে বের করে দেবো এমন কথা আমি বলিনি, তবে চেষ্টা করব, অবিশ্যি কাকাবাবু আপনার যদি তাতে কোন আপত্তি না থাকে।
কিরীটীর কথা শুনে মধুসূদন খানিকক্ষণ গুম হয়ে রইলেন, তারপর মৃদুস্বরে বললেন, বেশ তো, চেষ্টা করে দেখ।
কিন্তু চেষ্টা করতে হলে যে আপনার সাহায্যই সর্বপ্রথম আমার প্রয়োজন কাকাবাবু!
সাহায্য?
হ্যাঁ।
কি ভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি বল?
আমি যে দলিলটার খোঁজবার ভার নিয়েছি, সে কথা আপনি ও সলিল ছাড়া ঘুণাক্ষরেও কেউ জানতে পারবে না। আর আমি যা বলল আপনাকে তা করতে হবে।
মধুসূদন আবার খানিকক্ষণ কি যেন ভাবলেন, মনে মনে বেশ কৌতূহলীই হয়ে উঠেছিলেন তিনি কিরীটীর কথাবার্তায়। মৃদুস্বরে বললেন, বেশ, তাই হবে।
বাইরে ততক্ষণে রোদ উঠে গেছে।
কিরীটী বললে, চলুন কাকাবাবু ঘরে চলুন, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে।
সকলে বাড়ির দিকে অগ্রসর হল।
আগেই বলেছি, বাড়িটা চারমহলা, দোতলা। প্রথম মহলে মধুসূদনের ব্যবসা সংক্রান্ত দশ-বারোজন কর্মচারী ও ম্যানেজার বনবিহারীবাবু থাকেন। দ্বিতীয় মহল ব্যবসায়ের জিনিসপত্রের গুদাম হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তৃতীয় মহলে দাস-দাসীরা থাকে ও বাইরের লোকেরা আহারাদি করে। চতুর্থ মহলই প্রকৃতপক্ষে অন্দরমহল।
অন্দরমহলে ওপরের দক্ষিণের দুটো ঘরে মধুসূদনবাবু থাকেন–একটা তার বসবার ঘর, অন্যটা শয়নকক্ষ। অন্য দুটির একটিতে থাকে সলিল, আর একটি পূজার ঘর হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
নীচের একটি ঘরে খাওয়াদাওয়া হয়, একটিতে পিসীমা সলিলের তিনটি বোনকে নিয়ে থাকেন, একটিতে থাকেন সলিলের কাকা বিপিনবাবু, অন্যদিতে অতিথি-অভ্যগত এলে থাকে।
কিরীটী বললে, যে ঘরে সিন্দুকটা ছিল সেই ঘরটা সর্বপ্রথমে দেখতে চাই।
মধুসূদন বললেন, তুমি সলিলের সঙ্গে গিয়ে ঘরটা দেখ, ততক্ষণে আমি ম্যানেজারের সঙ্গে কয়েকটা কথা সেরে আসি। এই বলে তিনি চলে গেলেন।
সলিলের সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী মধুসূদনের শয়নকক্ষে এসে প্রবেশ করল। ঘর খালি, মা অনেকক্ষণ উঠে গেছেন, হয়তো পূজার ঘরে ব্যস্ত।
বেশ বড় আকারের ঘরখানি, দক্ষিণ-পূব খোলা। কিরীটী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ব্যলকনির ঠিক পাশ দিয়েই একটা নারিকেল গাছ উঠে গেছে। ব্যালকনির থেকে হাত বাড়িয়ে অনায়াসেই নারিকেল গাছটা ধরা যায়। তবে তাতে বিপদের সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই তা নয়। হাত ফসকে যাওয়ার খুব সম্ভাবনা আছে। ঘরটা একেবারে বারান্দার শেষপ্রান্তে। তা ছাড়া ঐ ঘরের সংলগ্নই ছাদে যাওয়ার দরজা। ঘরের মধ্যে আসবাবপত্রের তেমন বাহুল্য নেই। দুটি সিংগল বেড পাশাপাশি, নিভাঁজ শয্যা বিছানো। মধুসূদন যে খাটে শয়ন করেন তার এক পাশে একটি শ্বেতপাথরের গোল টেবিলের ওপরে রক্ষিত ফোন। এক পাশে একটা আয়না বসানো কাপড়ের আলমারি এবং আলমারির ঠিক পাশেই মানুষ-প্রমাণ উঁচু মজবুত লোহার সিন্দুক। সিন্দুকের গায়ে বেশ বড় একখানি জার্মান তালা ঝুলছে। সিন্দুকের ঠিক পাশেই একটি টুলের ওপরে জলের কুঁজো; তার মাথায় বসানো একটি কারুকার্যখচিত শ্বেতপাথরের গ্লাস।
ঘরের দেওয়ালে টাঙানো মুখোমুখি পূব-পশ্চিমে দুখানি বড় অয়েল-পেনটিং–মধুসূদনের মা ও বাবার। ফটোটি ঠিক সিন্দুকের ওপরেই টাঙানো।
ছেলেবেলায় কিরীটীর ছবি আঁকার দিকে খুব ঝোঁক ছিল। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছবি দুটিকে খুঁটিয়ে শিল্পীর মন নিয়ে দেখতে লাগল। ফটো দুটির গায়ে ঝুল পড়েছে সামান্য। বেশ কিছুদিন যে ঝাড়াপোঁছা হয়নি তা বুঝতে কষ্ট হয় না।
সলিল প্রশ্ন করলে, অমন করে কি দেখছিস কিরীটী?
বিলিতী ফ্রেম বলেই মনে হয়। তোর ঠাকুর্দার ফটোটা ঠিক দেওয়ালের সঙ্গে সেট করা হয়নি–একটু যেন বাঁয়ে হেলে আছে। কিরীটী জবাব দেয়। এমন সময় মধুসূদন এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।
কি দেখছ? প্রশ্ন করলেন মধুসূদনবাবু।
আপনার বাবার অয়েলপেনটিংটা দেখছিলাম। বেশ সুন্দর। শিল্পীর হাত চমৎকার, যেন একটা প্রাণের সাড়া পাওয়া যায় তুলির প্রতিটি টানে।
হ্যাঁ, একজন ইটালিয়ান শিল্পীর আঁকা। তোমার চা-পর্ব এখনও হয়নি নিশ্চয়ই। চল আমার বসবার ঘরে; ওখানে বসে চা-পান করতে করতে তোমার যা আলোচ্য আছে তা আলোচনা করা যাবে।
চলুন।
সকলে এসে পাশের ঘরে প্রবেশ করলেন
সুদৃশ্য ট্রেতে করে ভৃত্য চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে এল। একটি ছোট গোল টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম নামিয়ে দিয়ে সে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
সলিল উঠে চা ঢালতে লাগল।
কিরীটী একটু অন্যমনস্ক হয় পড়েছিল; সে ভাবছিল ওয়েলপেনটিংটার কথা। কোথায় কোন্‌ মাটির তলায় একটা সন্দেহের বীজ যেন অঙ্কূরোদ্গমের সম্ভাবনায় ওপরের দিকে ঠেলে উঠতে চাইছে।