• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

বনলতা সেন : বাংলা কবিতার মোনালিসা – কায়সার হক

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » অনুবাদ » বনলতা সেন : বাংলা কবিতার মোনালিসা – কায়সার হক

‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’—তাতে—অন্তত আমার কানে—পরিষ্কার ছেনালির সুর বাজে। এরপরের বিখ্যাত দৃশ্যকল্পও, পাখির বাসার মতো তার দুটি চোখ, সুমিতা চক্রবর্তী সুবিবেচনার সঙ্গেই উল্লেখ করেছেন, মোটেও অত নিরীহ কিছু নয়। পাখির নীড় অস্থায়ী ব্যাপার (অনুপ্রাস সৃষ্টির প্রয়াস), ডিম পেড়ে তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বানানো, পরে প্রকল্পের অংশীদারেরা যার যার পথ বেছে নেয়; সুতরাং এটা যৌন সম্পর্কের ধারণাকেই জোরালো করে।

পাঠ-প্রক্রিয়া পূর্ণতা পায় পুনঃপাঠের ভেতর দিয়ে। রচনা ও রচয়িতা উভয় সম্পর্কে উপলব্ধির গভীরতা লাভ ও তার প্রসারই এর উদ্দেশ্য। আমি জীবনানন্দের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাটির পুনঃপাঠের অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চাই। এর ১৮টি পঙিক্ত নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে—কেবল এই কবিতার প্রতি সম্পূর্ণ নিবেদিত অন্ততপক্ষে দুটি সংগ্রহ সংকলিত হয়েছে: একটি ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর হাতে এবং অন্যটি সৈকত হাবিবের—কিন্তু চিরকালের মতোই তা হেঁয়ালিময় রয়ে গেছে। আমার মনে হয়, আমি এই হেঁয়ালির উৎস সম্পর্কে নতুন আলোকপাত করতে পারব।
এ পর্যন্ত ‘বনলতা’র সমালোচনার ইতিবাচক সাফল্যের একটা সারাংশ টেনে আমাকে শুরু করতে দিন। প্রথমত, অন্যান্য কবিতার সঙ্গে এই কবিতার আন্তর-বৈষয়িক সম্পর্ক বেশ ভালো রকম উন্মোচিত হয়েছে। সবচেয়ে লক্ষণীয়ভাবে ‘বনলতা সেন’ ও এডগার অ্যালেন পোর ‘টু হেলেন’-এর বেশ কিছু সাদৃশ্য রয়েছে: ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’// ‘The weary, way-worn wanderer’; ‘সমুদ্র সফেন’// ‘desparate seas’; ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ // ‘thy hyacinth hair’; ‘মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য// ‘thy classic face’; দারুচিনি দ্বীপ’// ‘perfumed sea’। এরপর আবার কিটসের সনেট ‘On first Looking into Chapman’s Homer’ সূচনার বাক্যবন্ধ-এর-Much have I traveled’—জীবনানন্দের ‘অনেক ঘুরেছি আমি’-র পেছনে রয়েছে বলেই মনে হয়। এমনও মত প্রকাশ করা হয়েছে, দারুচিনি দ্বীপ হয়তো নজরুল ইসলামের ‘দারুচিনি দেশ’-এর ‘দূর দ্বীপবাসিনী’ থেকে নেওয়া।
তবে এসব নেহাতই উপরিগত সাদৃশ্য; এর সঙ্গে আমাকে যোগ করতে দিন, যাতে আবার কেউ অন্য কিছু মনে করে বসেন, তা কিন্তু জীবনানন্দকে শেক্সপিয়ার বা এলিয়টের চেয়ে বড় অনুকরণকারীতে পরিণত করেনি। লেখালেখির বিচিত্র কাজে লেখকের পড়াশোনার ভূমিকা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি। ভূমেন্দ্র গুহকে যেমন বলেছিলেন, কারও পড়াশোনার প্রভাব তার অভিজ্ঞতার ওপর প্রভাব বিস্তার করে, একে স্পষ্ট করে, নির্দিষ্ট চরিত্র দেয়; আর তিনি লেখক বা শিল্পী হলে এই নতুন আকৃতি পাওয়া অভিজ্ঞতার কথা লেখেন বা তাকে দৃশ্যমানভাবে তুলে ধরেন; এটা হচ্ছে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা ক্রিয়ার একটা ব্যাপার। পাঠের সৃজনশীল প্রয়োগের ক্ষেত্রে জীবনানন্দ, হ্যারল্ড ব্লুম যাকে বলবেন ‘শক্তিমান কবি,’ যিনি ‘চকিত মুহূর্তের জন্য,’ আমাদের বিশ্বাস করাতে সক্ষম হন যে প্রভাবের ধারা উল্টোমুখী যাত্রা করেছে, পূর্বসুরিরাই তাঁকে অনুকরণ করেছেন।
আপাতদৃষ্টিতে ‘টু হেলেন’ ও ‘বনলতা সেন’, উভয়ই নারীর সৌন্দর্যের সৃষ্টি করা মুগ্ধতারই প্রকাশ, কিন্তু সামান্য গভীরে নজর চালালেই এই মিলের চেয়ে অন্তর্গত অমিলগুলো যে ঢের বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, সেটা প্রকাশিত হবে। প্রথমটি বরং কিছুটা স্বচ্ছ নির্মাণ, যেখানে পোর পছন্দের এক নারীকে (তিনি হলেন প্রথম সংস্করণে উল্লিখিত উৎসর্গের পাত্রী বন্ধু রবার্ট স্ট্যানার্ডের মা মিসেস জেন স্ট্যানার্ড) গোটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে নারীর লাবণ্যের নিখুঁত পৌরাণিক প্রতিমূর্তি হিসেবে স্বীকৃত এক নারীর সঙ্গে দ্ব্যর্থহীনভাবে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু বনলতা সেন রহস্যময়ী, কারণ তাকে স্রেফ কোনো পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক ব্যক্তির সঙ্গে বা বিমূর্ত কিংবা বাস্তব কোনো সহজবোধ্য গুণের সঙ্গে মেলানো সম্ভব নয়।
এখানেই আমরা বনলতা সেনের ব্যাখ্যার দ্বিতীয় ও আরও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কাছে এসে পড়ি। বেশ কিছু ধারণাগত পাঠ আছে আমি আমার নিজের উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিলিয়ে সেগুলোর মূল দিকগুলোর ওপর মন্তব্য করব এবং এর সঙ্গে যোগ করব। খোদ নামটিই যেন কবির ভেতর এক ধরনের অদ্ভুত মুগ্ধতা তৈরি করেছে, কারণ এ নাম তাঁর একটি উপন্যাস ও অন্য চারটি কবিতায় স্থান পেয়েছে; পরের একটি-দুটি ভাষ্যে টিকে আছে। বলা বাহুল্য, এসব কবিতা তাদের বিখ্যাত সহোদরার চেয়ে অনেক বেশি নিচু স্তরের এবং এসব কবিতায় আবির্ভূত নারীরা তাদের বিখ্যাত সমনামির তুলনায় অনেক কম আকর্ষণীয়। তারই একটি, ‘ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন’ নারীর অকালমৃত্যু নিয়ে মোটামুটি প্রত্যক্ষ শোকই বলা চলে। অপরটি, ‘বাঙালি, পাঞ্জাবি, মারাঠি, গুজরাটি’ কলসি কাঁখে নদী থেকে জল আনতে যাওয়া এক বাঙালি বনলতাকে মাটির পাত্র থেকে মদ ঢেলে দেওয়া মধ্যপ্রাচ্যের এক নারীর সঙ্গে মেলানো হয়েছে; পাঠকের হয়তো ‘কুবলা খান’-এ কোলরিজের হাবসি দাসির কথা মনে পড়ে যাবে। ‘একটি পুরোনো কবিতা’ মৃতের জগৎ থেকে ফিরে বনলতা সেনের অবতারে পরিণত হয়েছে এমন একজনের মুখে বর্ণিত আট পঙিক্তর অদ্ভুত কবিতা। ‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’-এর দুটি ভাষ্য কথক ও বনলতা সেনের পরকালে পরস্পরকে চিনে নেওয়ার এক মুহূর্তকে নাটকীয় করে তুলেছে; তবে একটি ভাষ্যে কবিতাটি উপমহাদেশের পটভূমিতে রচিত, অন্যটিতে প্রাচীন মিসর ও অসিরিয়ায়।
বনলতা কবিতাগুলোর কোনো কোনোটার মধ্যপ্রাচ্যয়ী সংশ্লিষ্টতা হয়তো এই দৃষ্টিভঙ্গির আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে যে (সুমিতা চক্রবর্তী) বনলতা সেনের বনলতা সেন এই অঞ্চলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষয়িষ্ণু স্বতন্ত্র রোমান্টিক আভাকে মূর্ত করেছে (আলবত ওরিয়েন্টালিজমে ধন্যবাদ দিতে হয়)। যতক্ষণ আমরা এ কথা মনে রাখছি, ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক উভয় দিক থেকেই ‘বনলতা সেন’ ১০০% দক্ষিণ এশীয়, ততক্ষণ এ নিয়ে বিতর্কে যাব না। এটা আমাদের মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কাকে পাশ কাটিয়ে সাগরের দিকে নিয়ে যায়, হাসির ভেতর দারুচিনি দ্বীপ ভাসিয়ে তোলে (আমরা স্মরণ করতে পারি, দক্ষিণ ভারত দারুচিনির জন্য বিখ্যাত ছিল), তারপর আবার ফিরিয়ে আনে গ্রামীণ ও মফস্বল বাংলাদেশে। সময়ে সময়ে তা আমাদের বিম্বিসারা ও অশোকের মতো ক্ষমতাধর সম্রাট আর শ্রাবস্তী ও বিদিশার মতো কথাকাহিনির বিভিন্ন শহুরে বৈশিষ্ট্যায়িত আধুনিক বাংলা ও প্রাচীন ভারতের ভেতর আনা-নেওয়া করে।
মফস্বল নাটোরের মানুষ বনলতা সেন, কিন্তু শ্রাবস্তী ও বিদিশার সঙ্গে উপমাগত সম্পর্কের ভেতর দিয়ে তার মোহিনী শক্তির সময়হীনতা বোঝানো হয়েছে। আমার মনের ভেতর ‘নাটোর’ তাজা সংগীত ধারণ করে এবং সুমিতা চক্রবর্তী যেমন তুলে ধরেছেন, ধারণাগতভাবে একদিকে এর রয়েছে বৈষ্ণবীয় সম্পর্ক, অন্যদিকে রানি ভবানীর কল্যাণে রয়েছে সামন্তবাদী-উপনিবেশবাদী ব্যবস্থার যোগাযোগ। তার মুখখানা শ্রাবস্তীর শিল্পকর্ম: এখানে আমরা একটি উপমা দেখতে পাই, হাসি নয়, তো ভাবখানা এমন, মনে হয় যেন এই বাঙালি নারীটির সৌন্দর্য একেবারে খাঁটি নান্দনিক চিরকালীনতায় পরিণত হয়েছে, ইয়েটস-এর ‘সেইলিং ফর বাইযান্টিয়ামের’ আকাঙ্ক্ষার মতো। এই বিমনাবীকৃত নান্দনিকতা বনলতা সেনের অন্যান্য ঐতিহাসিক উপমায় পাল্টা ভারসাম্য পেয়েছে: তার চুল বিদিশার প্রাচীন রাতের মতো কালো। শ্রাবস্তীর উপমা ধ্রুপদি ও অ্যাপোলোনীয় হলে এটা সম্পূর্ণই রোমান্টিক ও দাইওনিসীয়।
আলোহীন রাতের পটভূমিতে বিছিয়ে দেওয়া এক নারীর চুলের ইমেজ, স্পষ্টভাবেই পরোক্ষে যৌন সম্পর্ক বোঝাচ্ছে। প্রাচীন ইতিহাস উল্লেখের ভেতর দিয়ে বোঝানো সময়হীনতা মানবজীবনে—জৈবিক ও সাংস্কৃতিক, উভয় ক্ষেত্রে—যৌনতার আদিম ও সর্বজনীন ভূমিকাকে জোরালো করে। আমার মনে হয়, এ দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে সঞ্জয় ভট্টাচার্য সঠিকভাবেই অসংগত সম্পর্কের বাংলা প্রতিশব্দ ‘পরকীয়া’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং সেই সঙ্গে নাটোরের বৈষ্ণবীয় প্রাসঙ্গিকতাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ছয় পঙিক্তর প্রতিটি স্তবকের শেষে মোট তিনবার বনলতা সেনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিবারই স্তবকের কার্যকর ও ধারণাগত বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে তার প্রভাব ক্লাইমেক্সের মতো। প্রথমবার আমাদের বলা হয়েছে, জীবনের নানা প্রতিকূলতায় কথককে প্রশান্তির কিছু মুহূর্ত উপহার দিয়েছে সে। তবে প্রতিকূলতা ও প্রশান্তির ভেতরের সম্পর্ককে সাধারণ কোনো বিরোধিতা বলে মনে হয় না। অন্তত পাঠকের কাছে ফেনিল সাগরের দৃশ্যকল্পের কামনার জটিল টালমাটাল অবস্থা তুলে ধরা স্পষ্ট যৌন দ্যোতনা রয়েছে। শান্তির প্রয়োজনীয় উপক্রমণিকা এটা, পরের পঙিক্ততে উল্লেখ করা সঙ্গম-উত্তর প্রশান্তির মতোই (সম্ভবত এক ধরনের সহজিয়া নির্বাণ?)।
পরবর্তী স্তবকের ক্লাইমেক্সে যে প্রশ্নটি দিয়ে বনলতা সেন কথককে সম্ভাষণ জানাচ্ছে—‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’—তাতে—অন্তত আমার কানে—পরিষ্কার ছেনালির সুর বাজে। এরপরের বিখ্যাত দৃশ্যকল্পও, পাখির বাসার মতো তার দুটি চোখ, সুমিতা চক্রবর্তী সুবিবেচনার সঙ্গেই উল্লেখ করেছেন, মোটেও অত নিরীহ কিছু নয়। পাখির নীড় অস্থায়ী ব্যাপার (অনুপ্রাস সৃষ্টির প্রয়াস), ডিম পেড়ে তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বানানো, পরে প্রকল্পের অংশীদারেরা যার যার পথ বেছে নেয়; সুতরাং এটা যৌন সম্পর্কের ধারণাকেই জোরালো করে। কথক বনলতা সেনকে জাহাজডুবির পর নাবিকের কোনো এক দারুচিনি দ্বীপের তরতাজা সবুজ জমিন দেখার মুগ্ধতার সঙ্গে আবিষ্কার করেছে, এটা এমনটি ইমেজ, যা তার প্রতি উর্বরতার দেবীর আভা আরোপ করে, যিনি আপনাআপনি উর্বরতার আভাস জোগান।
সমাপ্তির নানা ইমেজের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত সবকিছুর ওপর প্রাধান্য বিস্তারকারী মরণের আহ্বানের অনুরণনের ভেতর দিয়ে বনলতা সেনের সর্বশেষ উল্লেখ করা হয়েছে। সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া জীবনের প্রতীক হিসেবে নীড়ে ফেরা পাখির ইমেজ আগের স্তবকের পাখির নীড়ের ইমেজের কামের ইঙ্গিতের প্রতিরূপ আভাস তুলে ধরে। নদীর দেশে ফেরার ইমেজ সন্দেহাতীতভাবেই প্রায়ই নদীর সাগরে মিলে যাওয়ার ইমেজের ভেতর দিয়ে আত্মার মহাজাগতিক চেতনা ব্রাহ্মণের সঙ্গে বিলীন হওয়ার কথা তুলে ধরা ভারতীয় মরমিবাদ থেকে নেওয়া। কাম ও মরণ প্রবৃত্তি, যৌনতা ও মৃত্যু-দেবতার পাশাপাশি উল্লেখ বা এই ধারণার প্রকাশে জীবনানন্দ যে দারুণ আত্মসচেতন শিল্পী ছিলেন, সেই তথ্য আধুনিক পাঠককে বিস্মিত করবে না। দ্ব্যর্থবোধক ভাষায় ভুমেন্দ্র গুহকে তিনি বলেছিলেন, মরণ জীবনীশক্তির প্রতিরূপ, দারুণ আগ্রাসীভাবেই নিজেকে তা প্রকাশ করতে পারে। (‘মৃত্যু ঠিক জীবন—লালসার উল্টো পিঠ। মৃত্যু যথেষ্ট আগ্রাসীও হতে পারে হয়তো।’) এটা মরণ প্রবৃত্তির ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের নির্ভুল ও প্রবল প্রকাশ, যার, কৌতূহলোদ্দীপকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, নির্বাণের বুদ্ধীয় ধারণায় এক ধরনের প্রাচ্যয়ী অনুপ্রেরণা রয়েছে।
তো বনলতা সেন বাঙালি মায়েদের ভাবুক ও নিষ্ক্রিয় নারী তো নয়ই, যেমনটি তারা তাদের ছেলেদের জন্য খোঁজ করে থাকেন (আমার ধারণা, অনেকেই তাকে এভাবে ভুল বুঝেছেন), বরং উত্তর-রোমান্টিক কল্পনার ভালোবাসার জটিল ও অবদমিত নারীদেরই একজন। আর তাই কবিতা শেষ হওয়ার আগে একটি পাণ্ডুলিপির আবির্ভাব ঘটে, যেখানে তাকে স্মৃতিময় করে তুলতে হবে।
এবার সবচেয়ে বড় প্রশ্নটিতে আসা যাক: বনলতা সেনের এই পোট্রেট কিসে অনুপ্রাণিত ছিল? বাস্তব জীবনের কেউ, নাকি তাঁর পাঠের কিছু, নাকি উভয়ই? শেষ উত্তরটিই সবচেয়ে নিরাপদ বাজি অবশ্যই এবং সঠিক। সমন্বয়ের দুটি উপাদানের আগে আত্মজৈবনিক বৈশিষ্ট্যটুকুর কথা বিবেচনা কার যাক। জীবনানন্দ এমন কাউকে চিনতেন এবং তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছিলেন এবং পরে তারই বিখ্যাত দৃশ্যের মডেলে পরিণত হওয়ার কী প্রমাণ আছে আমাদের কাছে? জীবনানন্দের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত উপন্যাসটি মূলত তাঁরই ছদ্মবেশী আত্মজীবনী ধরে নিয়েই সুমিতা চক্রবর্তী ১৯৩৩ সালে রচিত উপন্যাস ‘কারু বাসনা’র প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন (কবিতাটি রচিত হয় এরপরের বছর), যেখানে কথক ২০ বছর আগে ছেলেবেলায় ভালোবেসেছিলেন এমন এক প্রতিবেশীর মেয়ে বনলতার স্মৃতিতাড়িত। পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠা স্মৃতি তাকে এমনভাবে বর্ণনা করেছে, যা কবিতার সমনামির সঙ্গে তার সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, বনলতা সেনকে চিনতেন কি না প্রশ্ন (গোপালচন্দ্র রায়ের) করা হলে অর্থপূর্ণভাবে হেসেছিলেন তিনি।
তবে অপর উপাদান—পাঠ থেকে প্রাপ্ত অনুপ্রেরণা? আমার মনে হয় এটা ভিন্ন একটি কবিতা নয় বরং রোমান্টিক যুগ-পরবর্তী প্রভাবশালী গদ্য ওয়াল্টার পেটারের দ্য রেনেসাঁ (১৮৭৩) থেকে এসেছে। এই গ্রন্থের দুটি সংক্ষিপ্ত অংশকে ক্ষয়িঞ্চু নন্দন তত্ত্বের লোকি ক্লাসিকি মনে করা যেতে পারে। একটি নিরন্তর ক্ষণস্থায়িত্ব ও অনিশ্চয়তার মাঝে অভিজ্ঞতার প্রাবল্যের তাৎপর্য তুলে ধরা উপসংহারের অন্যতম উজ্জ্বল অনুচ্ছেদ: ‘সব সময়ই এই কঠিন মানিকের মতো অগ্নিশিখার সঙ্গে জ্বলতে, এই পরমানন্দ ধরে রাখাই জীবনের সাফল্য।’ পেটারের প্রভাবের নিয়ন্ত্রণ এমনই ছিল যে যথেষ্ট পরিহাসমূলকভাবেই এমনকি জীবনানন্দের নিকট সমসাময়িক নিরদ সি. চৌধুরীর মতো গোঁড়া ভিক্টোরীয় অনুভূতির ধারক পর্যন্ত একে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
অন্য অংশটি থিওফিল গটিয়েরের প্রভাবান্বিত লেওনার্দো দ্য ভিঞ্চির হেঁয়ালিময় মাস্টারপিস মোনা লিসা বা লা গিওকান্দার অসাধারণ ইম্প্রেশনস্টিক বিবরণ, যার গদ্যের বাহন এতটাই কাব্যিক প্রাবল্যময় যে ডব্লু. বি. ইয়েটসও তাঁর অক্সফোর্ড বুক অব মডার্ন ভার্স (১৯৩৬)-এ এর একটা অংশ হুবহু তুলে নিয়েছিলেন। ‘এভাবে জলের ধারে এমন বিচিত্র উপস্থিতি,’ ক্ষীণ ক্রুর হাসির বিকারগ্রস্ত শিক্ষানবিশ অঙ্কনের ভেতর দিয়ে প্রতিফলিত সম্ভাব্য তারুণ্যময় সমীহের সংগ্রন্থন ও একটি ফরমায়েশি পোট্রেটের সিটারের আবির্ভাবের অদ্ভুত মিলের উপস্থিতির উল্লেখ করে ঘোষণা করেছেন পেটার, ‘মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে যা আকাঙ্ক্ষা করে এসেছে তারই প্রকাশ। তারই মাথার ওপর ‘জগতের অবসান হাজির হয়,’ আর চোখের পাতা কিঞ্চিত ক্লান্ত। এটা অদ্ভুত ভাবনার তিল তিল সংগ্রহ ও অদ্ভুত কল্পনা আর বিচিত্র আবেগের এমন এক সৌন্দর্য, যা দেহের অভ্যন্তর থেকেই নির্মাণ করা হয়েছে। মুহূর্তের জন্য একে সেই সব গ্রিক দেবী বা প্রাচীনকালের সুন্দরী নারীদের পাশে স্থাপন করুন, এত সৌন্দর্যে তারা কেমন অস্বস্তিতে পড়ে যাবে, যার ভেতর আত্মা সব বিষাদ নিয়ে হারিয়ে গেছে! জগতের সব ভাবনা ও অভিজ্ঞতা সেখানে খোদাই ও ছাঁচবদ্ধ হয়ে গেছে…যে পাথরের মাঝে সে বসে, তারচেয়ে প্রচীন সে; ভ্যাম্পায়ারের মতো বহুবার মারা গেছে, কবরের গুপ্তজ্ঞান লাভ করেছে… একসঙ্গে ১০ হাজার অভিজ্ঞতাকে জড়ো করা এক চিরস্থায়ী জীবনের কল্পনা, পুরোনো বিষয় এবং আধুনিক দর্শন বিশ্বাস করে মানবতার ধারণা সব ধরনের ভাবনা ও জীবনের ওপর রচিত এবং তার মাঝেই সারাংশ নির্মিত। নিশ্চিতভাবেই লেডি লিসা প্রাচীন কল্পনার মূর্ত রূপ, আধুনিক ধারণার প্রতীক হিসেবে দাঁড়াতে পারেন।’
অনুচ্ছেদের সূচনা বনলতা সেনের বাক্য গঠনের ওপর প্রভাবের প্রতি ইঙ্গিত করতে পারে, কিন্তু মোনা লিসা ও বনলতার ভেতরের অন্তর্গত সম্পর্কই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনুপুঙ্খ তুলনা অতিজ্ঞানীর ভান মনে করা হবে। আমাদের বরং পেটার পাঠের অভিজ্ঞতা কীভাবে জীবনানন্দের অনুভূতিকে আকৃতি দিয়েছে এবং তাঁর অভিজ্ঞতার সম্ভারকে পরিচিত ও ভক্তির পাত্রী এক বিশেষ নারীতে রূপদান করেছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করা উচিত। ইতিহাসের অতীত ফেমে ফিতালে হিসেবে কামুক এবং সেই সঙ্গে মৃত্যুর ওপর আধিপত্য বিস্তারকারী সত্তার জটিল রূপকে ধারণকারী মোনা লিসা বনলতারই কাছাকাছি, যেমনটা ওপরে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
পাঠক পেটারের প্রতি জীবনানন্দের সাড়ার প্রত্যক্ষ প্রমাণ চাইবেন। ১৯৩৩ সালে রচিত—এর তাৎপর্যটুকু স্পষ্ট হওয়ার কথা—তাঁর উপন্যাস ‘প্রেতিনীর রূপকথা’য় আমাদের কাছে সেই প্রমাণ রয়েছে। দুই বোনের কাহিনি রয়েছে এখানে, একজনের নাম বিনতা আর অন্যজন চারুলতা, যাদের নামের সঙ্গে, যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, বনলতার মিল রয়েছে। কথক স্পষ্টতই লেখকের ব্যক্তিসত্তা, ইংরেজিতে এমএ, জীবনানন্দের পূর্বপুরুষের মতো জাতে বৈদ্য। একপর্যায়ে পেটারের দ্য রেনেসাঁর একটা কপি নিয়ে ভ্রমণে বের হয় সে (এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, উপন্যাসে উল্লিখিত অন্যান্য বইয়ের ভেতর পোর কবিতার একটি সংস্করণ রয়েছে)।
এসব নয়। উপন্যাসের গোড়ার দিকে কথক চাকরির খোঁজে কলকাতার উদ্দেশ্যে স্টিমারে চেপে বাড়ি ছাড়ার মুহূর্তে আকাশের বুকে মেঘের দল স্বপ্ন-কল্পনার জন্ম দেয়, নায়ক মেঘমালাকে পাহাড়ের মতো ভাবে—ভারতীয় পাহাড় নয় অবশ্য, বরং গ্রিক, রোমান বা বাল্টিক চূড়া, কিংবা মুরিলোর দেশের (স্পেন) পাহাড় অথবা দ্য ভিঞ্চি আর রাফায়েলের চেতনায় প্রোথিত পাহাড়। ‘ওরা আসছে…স্মৃতি আর কল্পনার জগৎ থেকে…দ্য ভিঞ্চি বা রাফায়েলের মনে।’ নারিত্বের এক দৃশ্য রয়েছে, যা অনেকটা ‘লা গিওকোন্দা’ নিয়ে পেটারের রচনার স্মারক এবং বনলতা সেনে (এক নারীর) ইমেজ প্রত্যাশা: ‘তার দেহ নগ্ন।’
‘দীর্ঘ নগ্ন দুধের মতো শাদা শরীর, ঝাউয়ের শাখা-প্রশাখার ফাঁকে জ্যোৎস্নাহীন নক্ষত্রহীন স্তব্ধ বনের মতো অজস্র কালো চুল একজন মানুষী পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ধূপের ধবল ধোঁয়ার মতো দাঁড়ায় একা—মিলিয়ে যায়—তাদের প্রেমিকারা দেবতা না মানুষ? কী রকম মানুষ? থিসিউসের মতো না মাইকেল এঞ্জেলোর মতো? থিসিউসের মতোই’।
টিকিট পরখ করতে হাজির হওয়া এক ইউরোপীয় কর্মকর্তা এই কল্পনায় বাদ সাধে, কথক আবার যখন পশ্চিমাকাশের দিকে চোখ ফেরায়, ‘পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যার ছবি মিলিয়ে গেছে, সেই মেঘের পাহাড় নেই আর, চারদিকে সাদাসিধে বাংলার পাড়া-গাঁ’। ইন্সপেক্টর নিশ্চিতভাবেই ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতিনিধিত্ব করেন, যার আকস্মিক আবির্ভাব বাঙালি বাবুর অতিস্পর্শকাতর অ্যালব্যাট্রসের ডানা কেটে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
স্টিমার এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, ‘মনের ভেতর বিক্ষোভ জমে ওঠে কেমনতর যেন এক, মনে হয় যেন স্পেন ও গ্রিস, রেনেসাঁস, এঞ্জেলো, মুরিলো, সবই সরে গেল’ সেখানে বাংলার বিশেষ প্রাকৃতিক ও অতিপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে ভারসাম্য লাভ করেছে; আর ‘বাংলার মাঠঘাটের পথ দিয়ে অনেক শতাব্দী ঘুরিয়ে আনে আমাকে, প্রান্তর ও নিশুতির ফাঁক থেকে অসংখ্য মুখ উঁকি দেয়, কিশোরী ও পুরলক্ষ্মীদের নিরপরাধ নরম ডৌলের মুখ সব কাছে এসে বলে—‘চিনতে পার তো?’
কথকের প্রশ্নের উত্তরে তারা স্বীকার করে, তারা সবাই এখন মৃত এবং তাকে বিস্মিত করে জানায়, এক কালে তার নাম ছিল সুলক্ষণ। ‘না না, তোমার নাম যে সুলক্ষণ ছিল—নয়নপুরের মাঠে ৩০০ বছর ধরে তুমি যে একটা ঝাঁকড়া ঝুড়িওয়ালা বটগাছ হয়ে ছিলে!’
আমার ধারণা এখানে সৃজনশীল প্রক্রিয়ার একটি রূপকের অস্তিত্ব রয়েছে, যার ভেতর দিয়ে জীবনানন্দের বিশ্বসাহিত্যের ব্যাপক পাঠ ও পঠন থেকে সংশ্লেষ করা বিভিন্ন ধরনের অভিব্যক্তি ও ধারণা বিশ্বে তাঁর একান্ত বিশেষ কোনোটিকে নতুন চোখে প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম করে তুলেছে। বেশ কয়েকটি পর্যায়ে এই প্রক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, লেখক তাঁর পাঠের বিশ্বের কল্পনায় হারিয়ে গেছেন। এরপরই সেই দৃশ্য মিলিয়ে যায় এবং নিজেকে সাধারণ বাঙালি বাস্তবতার মাঝে আবিষ্কার করেন তিনি। তারপর রহস্যময় হলেও রোমাঞ্চকর জাগতিক জগতে লুকিয়ে থাকা রহস্যময় উপস্থিতি নিজেদের উন্মুক্ত করে; তিনি আবিষ্কার করেন, তাদের মাঝে নিজেরও স্থান রয়েছে তাঁর, এক দিউস লোকি, যিনি শাশ্বত বাংলা থেকে অর্জিত ইমেজারির মাধ্যমে তাদের অস্তিত্বকে প্রকাশ করতে পারেন (কখনো কখনো বিচিত্র পশ্চিমা, লেভান্তীয়, মধ্যপ্রাচ্যয়ী বা আফ্রিকান উপাদানকে মিলিয়ে)। জীবনানন্দ নিশ্চিতভাবেই পেটারের দ্য ভিঞ্চির মাস্টারপিসের সমালোচনামূলক উপলব্ধি পাঠে বদলে গিয়েছিলেন, কিন্তু অচিরেই আবার স্বস্থানে ফিরে এসেছেন, যেখানে তাঁর কল্পনা এখন বনলতা সেনকে আকার দিতে পারে, তাঁর—এবং আমাদের—একান্ত মোনা লিসা।

কায়সার হক: বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষার অন্যতম কবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। লিখেছেন লন্ডন রিভিও, ইনডেক্স অন সেন্সরশিপ ও ক্যামব্রিজ রিভিউতে। রয়েছে একাধিক অনুবাদ গ্রন্থ

অনুবাদ: শওকত হোসেন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১১

Category: অনুবাদ
Previous Post:হাসান আজিজুল হক : লেখালেখির যন্ত্রণা
Next Post:আরব বসন্ত : আরব দুনিয়ার কবিতা

Reader Interactions

Comments

  1. peekay chatter

    December 12, 2013 at 6:19 pm

    ওত্যান্তো কুরুচিকর মন্ত্যব্য

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑