• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

লিমনের জন্য জীবনানন্দ দাশ কামরাঙা নিয়ে এসেছিলেন – শওকত চৌধুরী

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » গল্প » লিমনের জন্য জীবনানন্দ দাশ কামরাঙা নিয়ে এসেছিলেন – শওকত চৌধুরী

হাসপাতালের বেডে লিমনের সবেমাত্র ঘুম ভেঙেছে। ঘুম ভেঙেই সে দেখতে পেল তার সামনে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। ভদ্রলোকটি দেখতে তাদের কলেজের অধ্যক্ষ স্যারের মতো।
অধ্যক্ষ স্যার এখন একদৃষ্টিতে লিমনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখ বিষণ্ন।
‘কেমন আছিস লিমন?’
লিমন কোনো উত্তর করতে পারল না। তার বুকে হঠাৎ একটা ধাক্কার মতো লাগল। অধ্যক্ষ স্যার তো কখনো কাউকে তুই করে বলেন না! তিনি তাকে তুই করে বলছেন কেন? অবশ্য অধ্যক্ষ স্যার একেবারে কাউকে তুই করে বলেন না কথাটা সঠিক নয়। তিনি রাশভারী গোছের লোক হলেও বেণুকে মাঝে মধ্যে তুই করে বলতেন। বেণু ক্লাসের সবচেয়ে চুপচাপ স্বভাবের ছাত্রী। হঠাৎ একদিন তার শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ল। অধ্যক্ষ স্যার ফলের ঝুড়ি হাতে তাকে দেখতে গেলেন হাসপাতালে।
‘কেমন আছিস রে মা?’
বেণুর যেন বিস্ময়ের শেষ থাকল না।
‘ভালো আছি স্যার। কিন্তু আপনি আমাকে দেখতে এসেছেন এটা আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না!’
বেণুর কথা শুনে অধ্যক্ষ স্যারের চোখে পানি জমে গেল। তিনি জামার হাতায় চোখ মুছলেন।
‘বলে কী মেয়ে? আমার মায়ের অসুখ হয়েছে, আমি দেখতে আসব না?’
আজ অধ্যক্ষ স্যারকে অন্য দিনের তুলনায় বেশিই রাশভারী লাগছে। তিনি তাঁর রাশভারী স্বভাবের গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আমাকে চিনতে পারছিস না তুই? দেখ তোর জন্য অনেক ফল এনেছি। তোদের এই দিকে ভালো কমলালেবু পেলাম না। তাই কামরাঙা নিয়ে এসেছি। আধাপাকা কামরাঙার সঙ্গে কাঁচা মরিচ-কাসুন্দির মাখানি—অমৃত! কী বলিস, অমৃত না?’
লিমন বুঝতে পারছে না সে কোনো স্বপ্ন দেখছে কি না। অধ্যক্ষ স্যার তার জন্য কামরাঙা নিয়ে আসবেন, কামরাঙার সঙ্গে কাঁচা মরিচ-কাসুন্দি মাখানির কথা বলবেন, এটা নিশ্চয় একটা স্বপ্ন!
অ্যানিওয়ে, ‘তুই কি কমলালেবু কবিতাটি কখনো পড়েছিস?’
লিমন কোনো কথা বলল না।
‘কবির প্রাণ দেহ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরও তিনি পৃথিবীতে আবারও আসতে চাইছেন একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে কোনো এক মুমূর্ষু রোগীর বিছানার কাছে। পড়িসনি?’
লিমন আবারও কোনো কথা বলল না।
‘কমলালেবু পেলে ভালো হতো, কী বলিস? আচ্ছা তুই কি আমাদের ওপর অভিমান করেছিস? কথা বলছিস না কেন?’
লিমন আবারও কোনো কথা বলল না। সে ব্যাপারটা স্বপ্ন কি না বোঝার চেষ্টা করছে।
‘কিছু মনে করিস না বাবা। আমি এসেছি তোর কপালে একটু হাত রাখতে। রাখব?’
বলতে বলতে অধ্যক্ষ স্যারের গলাটা যেন কেঁপে উঠল।
লিমন এবার নিশ্চিত হয়ে গেল, তার সামনে যেটা ঘটছে, এটা কোনো বাস্তবতা নয়। এটা একটা নিছক স্বপ্ন। অধ্যক্ষ স্যার কখনো কারও কপালে হাত দিয়ে দেখবেন, এটা হতে পারে না। তা ছাড়া লিমন না গরুর বাছুর আনতে পুরোনো জমাদ্দারহাট সেতুর ওখানে গিয়েছিল? সে হাসপাতালের বেডে আসবে কেমন করে? তার তো গরুর বাছুর নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা, হাসপাতালে নয়। এটা নিশ্চয় একটা স্বপ্ন! অন্য সবকিছুর মতো স্বপ্নেরও এক চেইন থাকে। একটা স্বপ্নের পর আরেকটা স্বপ্ন। একটু আগেও সে একটা স্বপ্ন দেখছিল। অদ্ভুত ধরনের স্বপ্ন। সে দেখছিল, কয়েকজন কালো স্কার্ফ পরা লোক তাকে জমাদ্দারহাট সেতু থেকে জামার কলার ধরে টেনে রাস্তার পাশে নিয়ে যাচ্ছে এবং লোকগুলোর একজন তাকে বলছে, ‘এই হারামজাদা, ক্রসফায়ারে পড়তে না চাইলে বল তুই সন্ত্রাসী কি না?’
এ রকম ভয়ংকর স্বপ্নের কোনো অর্থ হয়? অর্থ না হলেও স্বপ্ন তার নিজের গতিতেই চলে। তাকে কেউ থামাতে পারে না।
লোকটি আবারও বলল, ‘কথা বলছিস না কেন? তুই কি সন্ত্রাসী?’
লিমন কোনো কথা বলতে পারল না। অজানা এক কারণে তার কণ্ঠ শুকিয়ে গেল। লিমনের শুধু কণ্ঠই শুকিয়ে গেল না, তার হাত-পা কাঁপতে শুরু করল।
‘এই সন্ত্রাসীর বাচ্চা, তোর নাম কী? নাম বল?’
এবার লিমন কাঁদতে শুরু করল।
‘আমার নাম লিমন, স্যার।’
‘লিটন?’
‘লিমন, স্যার!’
লোকটি ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন আবারও করল।
‘তুই কি সন্ত্রাসী?’
‘স্যার, আমি সন্ত্রাসী হব কেন? আমি কলেজে পড়ি। সামনে আমার ইন্টার পরীক্ষা। আমি ছাত্র।’
‘ঠিক করে বল, তুই কে?’
‘স্যার, বিশ্বাস করেন, আমি একজন ছাত্র। এই যে আমার মোবাইল, এখানে আমার কলেজের অধ্যক্ষ স্যারের নম্বর আছে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে দেখেন। জিজ্ঞেস করেন, আমি ছাত্র কি না?’
‘তুই কি সোয়ান্সিকে চিনিস?’
‘সোয়ান্সি কে, স্যার?’
‘চিনিস না?’
‘চিনি না, স্যার!’
লোকগুলোর ভেতর অন্য একজন চিৎকার করে উঠল।
‘তুই সোয়ান্সিকে চিনিস! ইয়ু আর অ্যা মেম্বার ওফ সোয়ান্সি! ইউ রাসকেল লায়িং।’
বলতে বলতে লোকটি তার একটা পায়ে বন্দুকের নল ঠেকাল।
লিমন যেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, ওখানে একটা বড় বড় পাতার কলাগাছ। লিমন দেখল, লোকটি তাকে পায়ে গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি, তার একটা পা দিয়ে লিমনের ডান হাতটি মাটির সঙ্গে চেপে ধরে আছে। শুধু তা-ই নয়, লিমন আরও দেখতে পেল, অন্য একজন স্কার্ফ পরা লোক তার পরনের লুঙ্গিটা পর্যন্ত খুলে ফেলছে! লুঙ্গিটা খুলে তার গুলিবিদ্ধ পায়ের রক্ত মুছে দিচ্ছে। কী অদ্ভুত! এটা নিশ্চয় স্বপ্ন! স্বপ্নেই কেবল এমন অদ্ভুত দৃশ্যের সম্ভব! স্বপ্ন ছাড়া কেউ কখনো কারও পরনের লুঙ্গি খুলে গুলিবিদ্ধ পায়ের রক্ত মোছে না!
লিমনের আর কিছু মনে নেই। সে আস্তে আস্তে শরীর ছেড়ে ঢলে পড়ল মাটিতে। কী এক বিচিত্র কারণে ঢলে পড়ার আগে লিমন একবার চোখ খুলে আকাশের দিকে তাকাল। বিকেলের আকাশ! তেজ কমে আসা রোদে কয়েকটা পাখি হাঁ হাঁ করে উড়ছে আকাশে। পাখিগুলো অনেক ওপর দিয়ে উড়ছে বলে হয়তো মানুষেরা পাখিগুলোকে চিনতে পারছে না। কিন্তু লিমন পাখিগুলোকে ঠিকই চিনতে পারছে। মৃত্যুর আগে মানুষের সব দৃষ্টিশক্তি ও মনোযোগ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। তখন তারা নিষ্পলক কোনো একজন বিশেষ মানুষ বা বস্তুর দিকে তাকিয়ে থাকে। লিমন তার সেই কেন্দ্রীভূত দৃষ্টিশক্তি ও মনোযোগ দিয়ে বুঝতে পারল, এগুলো কোনো সাধারণ পাখি নয়। এগুলো আসলে বাজ!
অধ্যক্ষ স্যার লিমনের কপালে হাত রাখলেন। হাত রাখতে রাখতে হঠাৎ তিনি কথার প্রসঙ্গ বদল করলেন। এখনকার প্রসঙ্গের নাম, ‘শিক্ষা সফর’।
‘এবার আমরা ভালো একটা জায়গায় যাব, লিমন। এবারের ট্যুর হবে ১০ দিনের। আইডিয়াটা কেমন, বলো তো?’
লিমনের চোখজোড়া আনন্দে চকচক করে উঠল। গতবার সে শিক্ষা সফরে যেতে পারেনি। পারেনি টাকার কারণে। বড় ভাই কুমিল্লার একটা এনজিওতে কাজ করেন। বলেছেন, এই মুহূর্তে তিনি কিছুতেই টাকা দিতে পারবেন না। লিমন দৌড় দিয়ে তার টিউশনির বাড়িওয়ালার কাছে গেল। একমাত্র টিউশনির বাড়িওয়ালাই তাকে টাকা ধার দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।
টিউশনির বাড়িওয়ালা বললেন, ‘কত লাগবে?’
‘হাজার খানেক।’
‘এত টাকা কই পাব? ২০০ দিতে পারি। ২০০ টাকায় চলবে?’
লিমন রাগে-অপমানে টিউশনির বাড়িওয়ালার মুখের দিকে তাকাতে পারল না।
‘কী, চলবে?’
লিমন মুখে হাসি টেনে বলল, ‘টাকা লাগবে না। এমনি আপনার সঙ্গে মজা করছিলাম। কিছু মনে করবেন না।’
শেষ ভরসা হয়ে থাকল বন্ধু সজল। কিন্তু কথায় আছে, ‘মিসফরচুন নেভার কামস অ্যালোন।’ সজলকে বলামাত্রই সে বলল, ‘তুই উল্টা আমাকে ৫০০ টাকা দিবি।’
‘আমি কেন তোকে ৫০০ টাকা দেব?’
‘দিবি, কারণ আমার ছোট বোন নিপা হঠাৎ পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছে। ওকে এখন পঙ্গু হাসপাতালে নিতে হবে।’
লিমন মুখ নিচু করে বাড়ি ফিরল। বাড়ি ফেরার পর মা বললেন, ‘কী, টাকা পাস নাই কোথাও?’
লিমন কোনো উত্তর করল না।
‘এক কাজ কর, আমার একটা সোনার চুড়ি আছে। বাজারে গিয়ে দেখ, কততে বিক্রি হয়!’
লিমন মায়ের চুড়ি নিল না। বরং মায়ের কাঁধে মাথা রেখে কিছুক্ষণ পাখিদের মতো মুখ ঘষল। কেন ঘষল কে জানে। এই অনটনের জীবন তার ভালো লাগে না বলেই কি?
অধ্যক্ষ স্যার বললেন, ‘এইবার আমরা কোথায় যাচ্ছি বলতে পারবি?’
লিমন চকচক চোখ নিয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকল।
‘না।’
‘ক্লু দেব?’
‘দেন।’
‘এই জায়গাটাকে আমাদের একজন বিখ্যাত লেখক দারুচিনি দ্বীপ বলেছেন। এখন বলতে পারবি?’
লিমন মাথা ঝাঁকায়। সে পারবে। কিন্তু এই জায়গাটা তো অনেক দূরে। এত দূরে যাওয়া নিশ্চয় একটা খরচের ব্যাপার! এত খরচ কলেজ কর্তৃপক্ষ কি দিতে পারবে?
লিমনের মনে ঘুরপাক খাওয়া এই প্রশ্নগুলোকে বুঝে নিয়ে সমাধান দিতে এগিয়ে এলেন অধ্যক্ষ স্যার। তিনি তাঁর মুখটিকে লিমনের কানের কাছে নামিয়ে আনলেন।
‘একটা ঘটনা আছে লিমন। বিশেষ ঘটনা। মিন্টু মিনারেল ওয়াটারের একটা স্পন্সর পাওয়া গেছে। ওরা ১০০ ছেলেমেয়ের একটা ট্যুর স্পন্সর করবে। ওদের লাভ হচ্ছে, কলেজের এতগুলো ছেলেমেয়ের কাছে ওদের প্রডাক্টের পাবলিসিটি। বুঝতে পারছিস?’
লিমন কোনো কথা বলল না। এ যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো ঘটনা।
অধ্যক্ষ স্যার আগের চেয়ে আরও অধিকতর ফিস ফিস গলায় বললেন, ‘বিশেষ ঘটনাটা শুধু তোকে বললাম, তুই কাউকে বলিস না। কারণ কথাবার্তা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। ফাইনাল হয়নি।’
লিমন মাথা ঝাঁকায়, ‘জি, কাউকে বলব না।’
‘আমরা অবশ্য শুধু টিচারদের গেস্টকেই অ্যালাউ করব। ছাত্রদের গেস্ট অ্যালাউড না। কিন্তু তোর বিষয়টা ভিন্ন। তুই তোর মা-বাবা দুজনকে গেস্ট হিসেবে নিয়ে যেতে পারবি। ব্যবস্থা আমি করব।’
দূর সমুদ্রের একটা গর্জন যেন লিমনের বুকে এসে আছড়ে লাগল। সে তার বাবা-মাকে নিয়ে সমুদ্রের পাড়ে হাঁটছে, পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কী সে আছে?
‘শুধু তা-ই নয়, লিমন তোর জন্য একটা স্পেশাল রুম বরাদ্দ থাকবে। সব ছাত্রছাত্রীকেই রুম শেয়ার করতে হবে, শুধুমাত্র তোকে ছাড়া। তুই থাকবি তোর বাবা-মায়ের সঙ্গে। ডিলাক্স রুমে। হোটেল কর্তৃপক্ষকে আরও বলা থাকবে, তোর জন্য একটা স্পেশাল চেয়ারেরও ব্যবস্থা যেন করে। যাতে তুই ক্র্যাচে ভর দিয়ে না দাঁড়িয়ে স্পেশাল চেয়ারে বসে সমুদ্র দেখতে পারিস! টোটাল ব্যাপারটা কেমন হবে বল তো?’
মুহূর্তের মধ্যে লিমনের মনে প্রশ্ন জেগে উঠল, কেন সে স্পেশাল চেয়ারে বসে সমুদ্র দেখবে? স্বপ্নের মাঝে তার পায়ে যে গুলিটি করা হয়েছে, তার জন্য কি সত্যি সত্যি তার একটা পা কেটে ফেলতে হয়েছে?
লিমন হাত বাড়িয়ে বারবার তার কেটে ফেলা পা-টিকে স্পর্শ করার চেষ্টা করল।
লিমনের চোখ গড়িয়ে পানি নামছে।
অধ্যক্ষ স্যারের গলা আরও খানিকটা রাশভারী হয়ে গেল। রাশভারীর কারণেই কি না তিনি তুই থেকে তুমিতে ফিরে গেলেন।
‘লিমন?’
‘জি স্যার।’
‘তোমাকে কিছু কথা বলব। মনোযোগ দিয়ে শুনবে।’
‘জি স্যার।’
‘স্টিফেন হকিংকে চেনো?’
‘জি স্যার।’
‘পৃথিবী বিখ্যাত ফিজিসিস্ট। এই লোকটি এমএনডিকে সঙ্গী করে যুগ যুগ ধরে বসবাস করছেন। এমএনডি কি জানো?’
‘জি না।’
‘মোটর নিউরন ডিজিজেস। নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারের গ্রুপ, যেটা নির্দিষ্টভাবে মোটর নিউরনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর এর কারণে হকিং ঠিকমতো মাথা তুলতে পারেন না, কথা বলতে পারেন না, এমনকি ঠিকমতো নিঃশ্বাসও নিতে পারেন না। কিন্তু তাতে বিশ্ববিজ্ঞানের কি কোনো ক্ষতিসাধিত হয়েছে? এ ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম-এর মতো তিনি কী অসামান্য বই লিখেছেন! লিখেছেন না?’
লিমন কোনো কথা বলল না। তার মনে হলো, সে একটা ঘোরের ভেতর থেকে কথাগুলো শুনছে। আর যে লোক কথাগুলো বলছেন, তিনি অনেক দূর থেকে বসে কথাগুলো বলছেন।
‘আমি জানি, তুমি গান-বাজনা পছন্দ করো। কী, করো না?’
‘করি।’
‘টনি আইওমি হচ্ছেন বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ড ব্ল্যাক সাবাথের বিশ্ববিখ্যাত গিটারিস্ট। অনেকে তাঁকে গিটার-গুরু বলেন। ভক্তরা কেউ কেউ তাঁকে জিমি হ্যান্ড্রিক্সের সঙ্গেও তুলনা করেন। মজার ব্যাপার হলো, তাঁর ডান হাতের দুটো আঙুল কাটা। একটা শিট মেটাল কারখানায় তিনি কাজ করতেন। সেখানে একটা অ্যাকসিডেন্টে তাঁর ডান হাতের মধ্যমা ও অনামিকা দুটো আঙুলেরই মাথা কাটা যায়। এই দুটো আঙুল গিটার বাজানোর জন্য যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তুমি কি বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছো?’
‘জি, পারছি।’
‘টনি আইওমি আঙুলের মাথায় প্লাস্টিকের ক্যাপ পরলেন। আর বাঁ হাতে গিটারটিকে তুলে নিয়ে পৃথিবীর গিটার-গুরু বনে গেলেন। যাহোক, তুমি কি জিপসি জ্যাজ গিটারিস্ট জাঙ্গো রেইনহাডটের নাম শুনেছ?’
‘জি, না।’
‘তবে তাঁর গল্প শোনো। ভেরি ইন্টারেস্টিং।’
অধ্যক্ষ স্যার লিমনকে জাঙ্গো রেইনহাডটের গল্প শোনাতে পারলেন না। তার আগেই বিষণ্ন একটা ঘোরের ভেতর লিমনের ঠোঁটগুলো নড়ে উঠল।
‘স্যার, আপনি তো সবার কথাই বললেন, কিন্তু জীবনানন্দের কথা বললেন না? জীবনানন্দ তো এই বরিশালেরই কবি। তিনি হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথ হেঁটেছেন। স্যার, আমি হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথ হাঁটতে চাই। আমি আর কিছু চাই না, স্যার! আমি শুধু হাঁটতে চাই!’
লিমনের চোখ গড়িয়ে পানি নামছে। অধ্যক্ষ স্যার মাথা নিচু করে বসে আছেন। তিনি কিছুতেই মাথা তুলতে পারছেন না। আর এমন সময় একজন নার্স এলেন। তিনি বললেন, ‘স্যার দয়া করে আপনি বাইরে যাবেন। পেশেন্টের ফলোআপ আছে।’
অধ্যক্ষ স্যার রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছেন। হাঁটতে হাঁটতে তাঁর একসময় মনে হলো, তিনি যদি বরিশাল থেকে হেঁটে ঢাকার সরকারপ্রধানের বাড়ি পর্যন্ত চলে যান, বিষয়টি কেমন হবে? সরকারপ্রধান নিশ্চয় তাঁকে বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না, বা দিলেও খুব বিরক্ত হয়ে বলবেন, ‘কী চান এখানে?’
অধ্যক্ষ স্যার তখন কী বলবেন?
অধ্যক্ষ স্যার আজ ১৩ দিন ধরে একটানা হাঁটছেন। হাঁটতে হাঁটতে তাঁর পা ফুলে গেছে। কয়েক জায়গায় পায়ের থোড় ও পাতা ফেটে গেছে। ফাটা থোড় ও পাতা থেকে গল গল করে রক্ত পড়ছে।
অধ্যক্ষ স্যার এই ফাটা থোড় ও পাতা নিয়ে বেশিদূর যেতে পারলেন না। শাহেব বিতান নামের একটা বইয়ের দোকানের সামনে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। শাহেব বিতানের মালিক শাহেব উদ্দিন খুব অমায়িক ও দয়ালু লোক। তিনি অধ্যক্ষ স্যারকে তাঁর দোকানের ভেতর ঘরে নিয়ে সেবাযত্নের চেষ্টা করলেন।
শাহেব উদ্দিন সাহেব অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আপনি কে? আপনাকে চেনা চেনা লাগছে!’
অধ্যক্ষ স্যার কোনো উত্তর করলেন না।
‘আপনার শরীরে অনেক জ্বর। পা থেকেও রক্ত পড়ছে।’
‘রক্ত পড়বে কেন জনাব? আগে তো আমি অনেক অনেক দিন ধরে হাঁটতাম, রক্ত পড়ত না। একবার সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগর পর্যন্ত হেঁটে গেছি। রক্ত আসেনি তো!’
‘আপনি কি এখন অনেক দিন ধরে হাঁটছেন?’
‘হুম।’
‘কত দিন?’
‘হাজার বছর ধরে!’
শাহেব উদ্দিন সাহেবের বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। তিনি এই লোকটাকে এখনো চিনতে পারছেন না?
‘স্যার, আর কেউ চিনতে পারুক আর না পারুক আমি আপনাকে চিনতে পারছি। আপনার শরীরটা কিঞ্চিত ভগ্ন হয়েছে, এ জন্য লোকজন আপনাকে চিনতে পারছে না। আপনি কবি জীবনানন্দ দাশ। আপনি বলেছিলেন, “আবার আসিব ফিরে”। আপনি আবারও ফিরে এসেছেন!’

অধ্যক্ষ স্যার কোনো কথা বলতে পারলেন না। তাঁর এখন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কেন কে জানে। তাঁর জীবনের আয়ু কি শেষ হয়ে এসেছে?
‘স্যার, আপনি হেঁটে হেঁটে কোথায় যাচ্ছেন?’
‘সরকারপ্রধানের বাড়ি।’
‘বরিশাল থেকে ঢাকায়?’
‘জি, কিন্তু জনাব আমার অবস্থা খুব ভালো বলে মনে হচ্ছে না। যদি আমি সরকারপ্রধানের বাড়িতে আর যেতে না পারি, আপনার এখানেই আমার মৃত্যু হয়, আপনি দয়া করে সরকারপ্রধানকে আমার পক্ষ থেকে একটা কথা বলবেন?’
‘কী কথা?’
‘বলবেন, আমি তাঁকে বিরক্ত করতে আসিনি। লিমন তো আর হাঁটতে পারবে না। ওর পা নেই। আমার পা আছে, তাই বরিশাল থেকে ঢাকায় হেঁটে আসার পাগলামিটুকু করতে পারলাম। কবিরা অনেক রকম পাগলামি-টাগলামি করে, তাঁকে বলবেন এটাও একটা পাগলামি, বেশি কিছু না। পারবেন না?’
বাইরে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে। পথঘাটে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। শাহেব বিতানের পেছনের ঘরে খাটের ওপর কবি জীবনানন্দ দাশ নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছেন। এই রকম ঘুম তাঁর চোখে আরও একদিন এসেছিল ট্রাম দুর্ঘটনার পরে, শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ২৬, ২০১১

Category: গল্প
Previous Post:উত্তরে – কাইয়ুম চৌধুরী
Next Post:নিউইয়র্কে আর্ট ট্রাভেলার – মঈনুস সুলতান

Reader Interactions

Comments

  1. রিফাত

    September 10, 2013 at 11:42 am

    ‘স্যার, আপনি তো সবার কথাই বললেন, কিন্তু জীবনানন্দের কথা বললেন না? জীবনানন্দ তো এই বরিশালেরই কবি। তিনি হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথ হেঁটেছেন। স্যার, আমি হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথ হাঁটতে চাই। আমি আর কিছু চাই না, স্যার! আমি শুধু হাঁটতে চাই!’

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑