কালোদৈত্য এবং পোড়োবাড়ির ভূত

ভুতুড়ে লাশ

০১. কালোদৈত্য এবং পোড়োবাড়ির ভূত

মুন লেক দেখে ফেরার পথে সাংঘাতিক ঝড়ের মুখে পড়েছিলাম। বরমডিহি ডাকবাংলোর চৌকিদার পই পই করে বলেছিল, সূর্যাস্তের আগেই যেন ফিরে আসি। কারণ বছরের এই সময়টা এ মুলুকে অচানক কালা দেওপাহাড়ের ওপর থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার পাল্লায় পড়লে নাকি বাঁচার আশা থাকে না। মানুষ তো তুচ্ছ, বাঘের মতো বিরাট জানোয়ারকেও নাকি সেই কালা দেও অর্থাৎ কিনা কালো দৈত্য দুহাতে তুলে এমন আছাড় মারে যে তার হাড়গোড় মাংস দলা পাকিয়ে যায়।

চৌকিদার আরও বলেছিল, চাপা গুডগুড শব্দ শুনলেই যেন আমরা মাটিতে শুয়ে পড়ি। ওই শব্দটা কালো দৈত্যের আসবার সংকেত।

শব্দটা আমি শুনেছিলাম। কিন্তু আমার বৃদ্ধ বন্ধু প্রকৃতিবিদ কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তখন একটা প্রজাপতিকে তাড়া করেছেন। তার হাতে প্রজাপতি ধরা জাল। ওঁকে শব্দটার কথা বলেছিলামও। কিন্তু উনি গ্রাহ্য করেননি।

প্রজাপতিটা জঙ্গলের ভেতর নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর শুনতে পেয়েছিলাম, উনি বিড়বিড় করে বলছেন, দোরাইতিস্ আপোলিনাস! এই তুর্কি ঘোড়সওয়ার এখানে এনেছিল কারা? আশ্চর্য তো!

ব্যস্তভাবে বলেছিলাম, তুর্কি ঘোড়সওয়ার নয় কর্নেল! ওই শুনুন কালো দৈত্য গর্জন করছে। আমাদের এখনই মাটিতে শুয়ে পড়া উচিত।

তারপরই দেখলাম কর্নেলের টুপি এবং প্রজাপতি ধরা জাল উড়ে চলে গেল। ওঁর টাক বেরিয়ে পড়ল। আর আচম্বিতে প্রচণ্ড হাওয়ার ঝাঁপটানি প্রথমে আমাকে মাটিতে শুইয়ে দিল। তারপর কর্নেলকেও উপুড় হয়ে পড়তে দেখলাম। ভাগ্যিস, জায়গাটা ছিল মোটামুটি ফাঁকা এবং রাস্তার দুধারে বড় বড় পাথরের চাই পড়েছিল।  সেগুলো একেকটা নিশ্চয় একশোটা হাতির মতো ওজনদার। তাই কালো দৈত্য সেগুলোকে নড়াতে পারছিল না। মুহূর্তে গাঢ় অন্ধকার ঢেকে ফেলল আমাদের। আর সেই ভয়ঙ্কর শোঁ-শোঁ শনশন শব্দ যেন সত্যিই দৈত্যের শ্বাসপ্রশ্বাস। সেই সঙ্গে চোখ ঝলসানো বিদ্যুতের ঝিলিক। কানে তালা ধরে যাচ্ছিল মুহুর্মুহু বজ্র গর্জনে। এক পলকের জন্য বিদ্যুতের তীব্র আলোয় দেখলাম একটা বিশাল গাছ আমাদের ওপর দিয়ে উড়ে গেল। তখন বাঁচার আশা ছেড়েই দিলাম।

কতক্ষণ কালো দৈত্য হামলা চালিয়েছিল জানি না। চোখ বন্ধ করে খুদে গুল্ম আঁকড়ে ধরেছিলাম হয়তো আত্মরক্ষার সহজাত প্রবণতায়। এক স্যা কালো দৈত্যের পাঁয়তারা যদি বা থামল, শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি সে ঠাণ্ডা হিম তীক্ষ্ণ সুচ। তারপর কর্নেলের সাড়া পেলাম। জয়ন্ত! উঠে পড়ো।

হামাগুড়ি দিয়ে পাথুরে মাটিতে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। তখন কর্নেল আমদ হাত ধরে ওঠালেন। বললেন, কুইক! শর্টকাটে বাংলোয় ফেরা দরকার। তখনও বিদ্যতের ঝিলিক এবং বজ্র গর্জনের বিরাম নেই, যদিও ঝড়টা থেমেছে। বৃষ্টিটা কিন্তু বেড়েই যাচ্ছিল। এবড়ো খেবড়ো রাস্তার বাঁদিকে পাথরগুলোর ফাঁকে কর্নেলকে অনুসরণ করলাম। এদিকটায় উঁচু গাছপালা তত নেই। ঝোপঝাড় আর নানা সাইজের পাথর পড়ে আছে। মনে হচ্ছিল, বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদের এ তল্লাট যেন নখদর্পণে। কিন্তু তার সাদা দাড়ি কোথায় গেল? দাড়ির জায়গায় চাপ-চাপ কাদা!

দুজনেরই ভিজে জবুথবু অবস্থা। কিছু দূর চলার পর একটা পিচ রাস্তায়। পৌঁছুলাম। এটাই তা হলে সেই বরমডিহি-জাহানাবাদ রোড। রাস্তার দুদিকে উঁচু গাছ। তীব্র বিদ্যুতের ঝিলিক সামান্য দূরে এবং একটা গাছের মাথায় বিকট শব্দে বাজ পড়ল। গাছটা দাউ দাউ জ্বলে উঠল। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলাম, কর্নেল! আমাদের কোনও পাথরের আড়ালে বসে পড়া উচিত। বৃষ্টি থামলে বরং–

আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, ওই একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। আমার সঙ্গ ছেড়ো না!

বিদ্যুতের ছটায় খানিকটা দূরে উঁচু জায়গার ওপর একটা দোতলা বাড়ি দেখতে পেলাম। বাড়িটা পুরনো এবং জরাজীর্ণ। এক সময় সেই বাড়ির বারান্দায় যখন উঠলাম, তখন ধড়ে প্রাণ এল। কিন্তু সেই তীক্ষ্ণ বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছিলাম না। বারান্দাটা ছোট। কর্নেল দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকতে থাকলেন, কে আছে বাড়িতে? শিগগির দরজা খুলুন।

আমি তখনও হাঁপাচ্ছি। হাঁসফাস করে বললাম, পোড়োবাড়ি মনে হচ্ছে।

কর্নেল বললেন, না। দোতলায় বন্ধ জানালার ফাঁকে আলো দেখেছি। বলে আবার দরজায় শব্দ করতে থাকলেন।

বললাম, হিন্দিতে বলুন। বাড়ির লোকেরা হয়তো বাংলা বোঝে না।

আমাকে অবাক করে কর্নেল বললেন, বিদ্যুতের ছটায় নেমপ্লেট পড়েছি। এস. এল. মুখার্জি, এম. এ. বি-এল লেখা আছে।

কোথায় নেমপ্লেট?

ওই দেউড়ির গায়ে। বলে কর্নেল এতক্ষণে পকেট থেকে খুদে টচ বের। করে জ্বললেন।

সেই আলোয় দেখলাম বারান্দার নীচে একপাশে সত্যিই একটা দেউড়ি এবং তার গায়ে মার্বেলের ফলক আঁটা। লেখা আছে সন্ধ্যানীড়। তার তলায় ওই নাম। বাড়ির মালিক তাহলে একজন আইনজীবী। কিন্তু বাড়িটার এমন জরাজীর্ণ দশা কেন?

কর্নেল এবার দরজায় জোরালো ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে বললেন, দরজা না খুললে ভেঙে ফেলব বলে দিচ্ছি। শিগগির দরজা খুলুন। আমরা ডাকাত নহ, ভদ্রলোক।

এতক্ষণে দরজার ফাটল দিয়ে আলো দেখা গেল। তারপর দরজা খুলে। গেল। একজন প্রৌঢ় শক্তসমর্থ গড়নের লোক লণ্ঠন তুলে বলল, আপনারা কোথা থেকে আসছেন স্যার?

লোকটার চেহারা পোশাক এবং কণ্ঠস্বরে বুঝলাম এ বাড়ির সম্ভবত পুরাতন ভৃত্য। কর্নেল প্রায় তাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলেন। আমিও ঢুকলাম। লোকটা একটু হকচকিয়ে গেল। কর্নেল এবার একটু হেসে বললেন, বাইরের অবস্থা দেখেও কি এ কথা জিজ্ঞেস করতে আছে? দেখতে পাচ্ছ তো, আমরা কী বিচ্ছিরি ভিজেছি। যাই হোক, বৃষ্টিটা থামলেই আমরা চলে যাব।

লোকটা ধাতস্থ হল যেন। বলল, তা বসুন আজ্ঞে! আমি কর্তাবাবুর কাছে গিয়ে বসি। ওনার শরীর হঠাৎ অসুস্থ। বাড়িতে আর কেউ নেই যে আপনাদের একটু যত্নআত্তি করবো। বাড়তি একটা আলোও নেই যে—

থাক। তুমি তোমার কামশাইয়ের কাছে যাও। বৃষ্টি থামলে আমি তোমাকে ডাকব। তখন এসে দরজা বন্ধ করবে। কী নাম তোমার?

আজ্ঞে ভোলা স্যার!

তোমার কর্তামশাই কি এস. এল. মুখার্জি?

আজ্ঞে। বলে লোকটা হন্তদন্ত ভেতরের দরজা দিয়ে ঢুকে গেল। তারপর তার পায়ের শব্দ ক্রমশ ওপরদিকে মিলিয়ে গেল। সিঁড়িটা দরজার কাছাকাছি। আছে। কিংবা এ বাড়িতে সব শব্দই বিভ্রান্তিকর যেন। ততক্ষণে ঘরের ভেতরটা দেখে নিয়েছি। কয়েকটা আলমারি, একপাশে একটা খালি তক্তাপোস আর একটা টেবিল ঘিরে চারটে নড়বড়ে চেয়ার। দুটো চেয়ারে আমরা বসেছি। বুঝলাম, আইনজীবী ভদ্রলোকের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। তিনি বৃদ্ধ এবং অসুস্থ। আর কোর্টে যাতায়াতের সামর্থ নেই। আলমারিগুলো প্রায় শূন্য। আইনজীবীদের ঘরের দৃশ্য আমার দেখা আছে। অজস্র আলমারিতে ঠাসবন্দি আইনের বই এবং নথি ভর্তি থাকে। কিন্তু এই মুখার্জিমশাই বিদেশে বিভুয়ে এমন দুরবস্থায় পড়েছেন যে ওঁকে শেষ পর্যন্ত আইনের বই বেচে খেতে হয়েছে। উনি নিশ্চয় কর্নেলের মতো চিরকুমার। তাই কর্নেলের প্রিয় পরিচারক ষষ্ঠীচরণের মতো এই ভোলাই তাঁর দেখাশোনা রান্নাবান্না কাজকর্ম করে।

কর্নেল যেন আমার মনের কথা আঁচ করেই হঠাৎ বললেন, এই ভদ্রলোক অ্যাডভোকেট ছিলেন। কিন্তু যদি ভাবো, পয়সা কামাতে পারেননি ভুল করবে। কারণ এত বড় একটা দোতলা বাড়ি করা সহজ কথা নয়। অথচ বাড়িটার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ভাড়া দিতেও পারতেন। দেননি। বাড়িটার ॥ অবস্থা– বলে উনি ছাদের দিকে টর্চের আলো ফেললেন। টালিগুলো ফাঁক হয় আছে। কড়িবর্গার অবস্থা শোচনীয়। যে-কোনও সময় ছাদ ধসে পড়তেই পারে।

শিউরে উঠলাম। এসব অলক্ষুণে কথা বলবেন না। কালা দেওয়ের গান থেকে সদ্য প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরেছি।

সেই মুহূর্তে ঝুরঝুর করে কোথায় বালি খসে পড়ল। কানের ভুল কি না কে জানে, মনে হল, ভোলার পায়ের শব্দ হল মাথার ওপর। বললাম, কর্নেল। এখানে আশ্রয় নেওয়ার চেয়ে দেখছি বৃষ্টিতে ভেজা নিরাপদ ছিল।

কর্নেল টর্চ নিভিয়ে বললেন, ওপরের ঘরে হাঁটাচলা করছে কেউ।

ভোলা ছাড়া আর কে?

কর্নেল চুপ করে থাকলেন। বাইরের দরজা দিয়ে বিদ্যুতের মুহুর্মুহু আলোয় জোর বৃষ্টি দেখতে পাচ্ছিলাম। প্যান্টশার্ট ভিজে চবচবে এবং এখন ঘরের ভেতরে ওম পাব কী, বড্ড শীত করছিল। একটু পরে আবার ঝুরঝুর করে কিছু ঝরে পড়ল ছাদ থেকে। চমকে উঠে বললাম, কর্নেল! এ ঘরে বসে থাকা বিপজ্জনক মনে হচ্ছে।

কর্নেলই বললেন, আর কোন ঘরে গিয়ে বসবে ভাবছ? ভেতরে তো আরও ঘর আছে। ভোলাকে ডাকুন।

আমার কথা শেষ হতেই ছাদে চাপা শব্দ হল এবং আবার একরাশ চুন সুরকি ঝরে পড়ল। এবার আমাদের সামনেই টেবিলের ওপর। ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়ালাম।

কর্নেল টর্চ ফেলে ছাদটা দেখে বললেন, হু। ওপরের ঘরে কেউ হাঁটাচলা করলেই এই অবস্থা হয়। টর্চের আলো তিনি টেবিলে এবং টেবিল থেকে মেঝেয় ফেললেন। দেখছ? কত গুড়ো চুনসুরকি ঝরে পড়ে সারাক্ষণ অথচ ভোলা মেঝে পরিষ্কার করে না।

কর্নেল! চলুন, ভেতরে যাই। দেখি কোনও নিরাপদ জায়গা আছে কি না।

হুঁ। থাকা তো উচিত।

তাহলে চলুন না! আমার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে।

জয়ন্ত! অস্বস্তি আমারও হচ্ছে। চলো!

বলে কর্নেল ভেতরের দরজা দিয়ে ঢুকলেন। ওঁর হাতে টর্চ জ্বলছিল। ওঁকে অনুসরণ করে গিয়ে দেখি, একটা বারান্দা এবং তার নীচে উঠোন জঙ্গল হয়ে আছে। বারান্দার শেষদিকে সিঁড়ি। সিঁড়ির কাছে পৌঁছে এক পলকের জন্য বিদ্যুতের আলো এবং বৃষ্টির মধ্যে আবছা একটা মূর্তি দেখতে পেলাম। বললাম, কে?

কর্নেল বললেন, কোথায় কে?

উঠোনের জঙ্গলে কাকে যেন দেখলাম। শিগগির আলো ফেলুন।

টর্চের আলোয় কাউকে দেখা গেল না। কর্নেল একটু হেসে বললেন, তুমি অকারণে ভয় পাচ্ছ জয়ন্ত!

আমার মনে এতক্ষণে সন্দেহ জাগল, এই বাড়িটা কোনও পোড়ো এবং ভুতুড়ে বাড়ি নয় তো? ভোলা কি মানুষ? ওর চেহারা যেন কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছিল না?

চাপা ভয়টা তাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু থেকেই গেল। সিঁড়িতে যখন কর্নেলের পিছনে উঠছি; তখন প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে, কেউ ঠাণ্ডাহিম হাতে আমার গলা টিপে ধরবে, কিংবা সিঁড়িটাই বেঙে পড়বে।

ওপরের জীর্ণ রেলিংঘেরা বারান্দায় পৌঁছে কর্নেল ডাকলেন, ভোলা!

একটা ঘরের দরজা খুলে গেল এবং আলো দেখতে পেলাম। ভোলা সাড়া দিল। বিষ্টি তো এখনও পড়ছে স্যার! বিষ্টির মধ্যে চলে যাবেন কেন?

কর্নেল বললেন, তোমার কর্তামশাইয়ের সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।

ভোলা আস্তে বলল, তা আসুন। কিন্তু উনি ঘুমোচ্ছেন। ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি।

কর্নেলের সঙ্গে সেই ঘরে ঢুকলাম। দেখলাম, একটা তক্তাপোসে নোংরা। বিছানায় একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। তার গায়ে নোংরা ছেঁড়া একটা চাঁদর চাপানো। ঘরের ভেতর আর কোনও আসবাব নেই। দেয়ালের তাকে অনেকগুলো শিশিবোতল কৌটো এইসব জিনিস। ভোলার লণ্ঠনটার অবস্থাও শোচনীয়। লণ্ঠনটা যেন অতিকষ্টে সামান্য একটু আলো ওগরাচ্ছে।

কর্নেল বললেন, তোমার কর্তামশাইয়ের চিকিৎসা করছেন কে?

আজ্ঞে বরমডিহি সরকারি হাসপাতালের এক ডাক্তার।

অসুখটা কি?

ধরা যাচ্ছে না। কর্তামশাইয়ের তেমন টাকাকড়িও নেই যে ভাল ডাক্তার দেখাবেন!

ওঁর কোনও আত্মীয়স্বজন নেই?

কলকাতায় আছে। এনার ছোট ভাই। কিন্তু দাদার সঙ্গে বনিবনা নেই।

এই সময় হঠাৎ কোথায় একটা চাপা শব্দ এবং আবছা গোঙানি শোনা গেল। কর্নেল এবং আমি দুজনেই চমকে উঠেছিলাম। কর্নেল বললেন, ও কিসের শব্দ?

ভোলা গম্ভীর মুখে বলল, আজ্ঞে, ভয় পাবেন না। এ বাড়িতে এরকম অনেক শব্দ হয়।

বলো কী!

হ্যাঁ স্যার। প্রথম প্রথম আমি ভয় পেতাম। আর গেরাজ্জি করি না।

তুমি কি ভূতপ্রেতের কথা বলছ?

ভোলা গলার ভেতর বলল, রাতবিরেতে ওসব কথা থাক স্যার! আপনি নীচে গিয়ে বসুন। বিষ্টি কমে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।

কর্নেল টর্চ জ্বেলে অসুস্থ আইনজীবীকে দেখতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভো তক্ষুনি আলোর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আলো ফেলবেন না স্যার! এক্ষুনি চো আলো লাগলে হুলুস্থুল বাধাকেন। সামলাতে পারব না। দয়া করে আপনারা নি গয়ে বসুন। বিষ্টি ছাড়লে চলে যাবেন।

কর্নেলের সঙ্গে নিচের সেই ঘরে যখন ফিরে গেলাম, তখন আমি আতঙ্কে প্রায় হতবুদ্ধি। বললাম, কর্নেল! বৃষ্টি কমেছে। চলুন, কেটে পড়ি। এ বাড়ির হালচাল গোলমেলে মনে হচ্ছে।

কর্নেল একটা চেয়ারে বসে বললেন, আর মিনিট পনের অপেক্ষা করা যাক। প্রায় এক কিলোমিটার আমাদের হাঁটতে হবে।পথে কোনও যানবাহনের আশা নেই। বসো?

বসলাম চেয়ার টেনে। কিন্তু চেয়ারটা এবার কেমন বিচ্ছিরি শব্দ করল। কর্নেল টর্চের আলোয় ঘড়ি দেখে বললেন, মোটে সাড়ে ছটা। অক্টোবরে সাড়ে ছটা মানে অবশ্য সন্ধ্যা। কিন্তু এখানে আবহাওয়ার দরুন মনে হচ্ছে নিশুতি রাত।

একটু পরে টুপ টুপ করে শব্দ হতে থাকল। শব্দটা টেবিলের ওপর। বললাম, কর্নেল! দোতলার ছাদের নিশ্চয় ফাটাফুটি অবস্থা। সেই জল চুঁইয়ে নিচের ঘরে পড়ছে।

কর্নেল টর্চ জ্বাললেন টেবিলের ওপর। অমনি আতঙ্কে গলা শুকিয়ে গেল। ছাদ থেকে চুঁইয়ে টুপ টুপ করে টেবিলে যা পড়ছে তা জল নয়। গাঢ় লাল রক্ত।

হ্যাঁ, তাজা রক্ত। কর্নেলের টর্চের আলো ছাদে পৌঁছুল। টালির ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে রক্তবিন্দু। টেবিলে থকথক করছে রক্ত। থরথর করে কেঁপে উঠলাম। অজানা ত্রাসে। এ এক বিভীষিকা। কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বললেন, এস তো দেখি!

আবার সিঁড়ি বেয়ে দুরুদুরু বুকে ওপরে গেলাম। কর্নেল ডাকলেন, ভোলা! ভোলা! কিন্তু কোনও সাড়া এল না।

সেই ঘরের দরজায় গিয়ে কর্নেল টর্চ জ্বাললেন। দরজা খোলা এবং ভেতরের তত্তাপোসে নোংরা বিছানায় কেউ নেই। বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলাম। কর্নেল সেই ঘরের ভেতর ঢুকে বললেন, আমরা যে ঘরে ছিলাম, সেটা ওই পারে ঘরের নিচে। বলে পাশের ঘরের দরজা ঠেললেন।

ভেজানো দরজা খুলে গেল। তারপর কর্নেলের টর্চের আলোয় দেখলাম, একটা লোক রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেয় পড়ে আছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য! দেখা মাত্র চোখ বন্ধ করলাম। এ নিশ্চয় কোনও ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখছি!

কর্নেল দেখে নিয়েই বললেন, কুইক জয়ন্ত! ভিজতে ভিজতেই বাংলোয় ফিরতে হবে। তারপর ব্যস্তভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

কাঁপতে কাঁপতে বললাম, অ্যাডভোকেট ভদ্রলোককে ভোলা মার্ডার করেছে!

না। একজন মধ্যবয়সী লোককে জবাই করা হয়েছে।

আর কোনও কথা বলার মতো মনের অবস্থা ছিল না। বৃষ্টি কমেছে কিন্তু তখনও ক্রমাগত বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছিল। রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, জায়গাটা চিনতে পারছি। এটাকে একসময় বলা হত বাঙালিটোলা। বাড়িগুলো একটা করে বাগানবাড়ির মতো। দূরে-দূরে ছড়ানো। আজকাল এসব বাড়ির মালিকেরা কলকাতায় চলে গেছেন। কেয়ারটেকার থাকে। বাঙালিরা বেড়াতে এলে এগুলো কেয়ারটেকারই ভাড়া দেয়। কিন্তু ওই সন্ধ্যানীড় নামে বাড়িটা–

কর্নেল হঠাৎ চুপ করলেন। হন্তদন্ত হাঁটতে থাকলেন।

ডাকবাংলোয় পৌঁছুলে আমাদের দেখে চৌকিদার রামভরসা হিন্দিতে বলল, হায় রাম! আপনারা ঠিকই কালা দেওয়ের পাল্লায় পড়েছিলেন। তবে রামজির কৃপায় যে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পেরেছেন, এই যথেষ্ট।

জলদি কফি! বলে কর্নেল বাথরুমে ঢুকলেন পোশাক বদলাতে। একটু পরে বেরিয়ে এসে বললেন, আমি আসছি। তুমি পোশাক বদলে ফেলো ডার্লিং!

কোথায় যাচ্ছেন?

কেয়ারটেকারের অফিসে টেলিফোন আছে। এখনই থানায় ব্যাপারটা জানানো দরকার।

আমার মাথা এবং প্যান্টশার্ট কাদায় মাখামাখি। বাথরুমে ঢুকে ঝটপট স্নান করে নিলাম। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ব্যালকনিতে বেতের চেয়ারে বসলাম। এতক্ষণে শরীর-মন তাজা। সেই হানাবাড়ির দৃশ্যগুলি খুঁটিয়ে স্মরণ করছিলাম। যা দেখেছি, তার কোনও মাথামুণ্ডু খুঁজে পাওয়া যায় না।

এতক্ষণে কর্নেল ফিরলেন। রামভরসা কফির ট্রে রেখে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, থানায় কি জানিয়ে দিলেন ব্যাপারটা?

হুঁ। বলে কর্নেল কফিতে চুমুক দিলেন।

পুলিশ কী বলল?

সন্ধ্যানীড় নাকি একটা পোড়ো বাড়ি। বাড়িটা নিয়ে অ্যাডভোকেট শচীন্দ্রলাল মুখার্জি এবং তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই তরুণকুমার মুখার্জির মধ্যে বহু বছর ধরে মামলা চলছে। তাই বাড়িটার ওই অবস্থা। ওঁরা কলকাতায় থাকেন। অসুখে ভুগে কেয়ারটেকার কবে মারা গেছে। তার নাম ভোলা ছিল কি না পুলিশ জানে না।

তাহলে ঘটনাটা রহস্যময়। বরং বলা চলে রহস্যময় হত্যাকাণ্ড।

হ্যাঁ। তবে আমরা হঠাৎ ওখানে গিয়ে পড়ায় হত্যাকারীরা একটা নাটকীয় দৃশ্য তৈরি করেছিল।

ঠিক বলেছেন। সেই ভোলা ব্যাটালের চেহারা মনে পড়ছে। কেমন ষণ্ডামার্কা।

লোকটা কিন্তু বাঙালি।

আমরা কিছুক্ষণ এইসব আলোচনা চালিয়ে গেলাম। তারপর কর্নেল সেই পলাতক প্রজাপতিটি নিয়ে হাহুতাশ শুরু করলেন। প্রজাতির লাতিন নাম দোরাতিস আপোলিনাস। এই প্রজাতির প্রজাপতি এই অঞ্চলে আবিষ্কার করে সত্যিই আমি বিস্মিত হয়েছি জয়ন্ত! এরা মধ্যএশিয়া–বিশেষ করে তুর্কিভাষী এলাকার বাসিন্দা। সম্ভবত মধ্যযুগে কোনও প্রজাপতিপ্রিয় তুর্কি সুলতান এ ওদের এনে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কলকাতা ফিরে বইপত্তর ঘাঁটতে হবে।

আমার মাথায় সন্ধ্যানীড়ের হত্যাকাণ্ড। রক্তারক্তি অবস্থা। প্রকৃতিবিদের বকবক কানে নিচ্ছিলাম না। বেশ কিছুক্ষণ পরে রামভরসা এসে কর্নেলকে সেলাম দিল। স্যার! আপনার টেলিফোন!

কর্নেল হন্তদন্ত নিচে চলে গেলেন।

যখন ফিরলেন, তখন মুখ একেবারে গম্ভীর। ধপাস করে বসে চোখ বুজে টাকে হাত বুলোতে শুরু করলেন। জিজ্ঞেস করলাম, কার ফোন?

কর্নেল চোখ বুজে টাকে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, পুলিশ সন্ধ্যানীড়ে জিপ নিয়ে গিয়েছিল। তন্নতন্ন খুঁজে কোনও ডেডবডি পায়নি। ওপরের ঘরের মেঝেয় এবং নীচের ঘরের টেবিলে এক ফোঁটা রক্তও নেই। সিলিঙের সেই টালিটা অবশ্য ভাঙা দেখেছে। পুলিশের মতে সেটা স্বাভাবিক। পুলিশ অকারণ হয়রানির জন্য আমাকে হুমকি দিল।

রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠলাম, কর্নেল! আমরা পোড়োবাড়িতে নির্ঘাত ভূতের পাল্লায় পড়েছিলাম!…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *