• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

আরেক জীবন – সেলিম হোসেন

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » গল্প » আরেক জীবন – সেলিম হোসেন

সন্ধ্যার এই সময়টা কেমন স্তব্ধ হয়ে আছে বলে মনে হয় অলির। প্রকৃতি যেন তার মতোই সব রকম প্রস্তুতি শেষ করে চূড়ান্ত কোনো নাটকীয়তার জন্য উন্মুখ হয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তা না হলে এই দিনে এই রকম টিপটিপে ‘পাইন্না ম্যাগ’ হওয়ার কথা নয়। গতকালও এই সময় আকাশে ছিল ‘মির কাদিইম্যা গরুর শিঙের মথন’ চাঁদ। আধখোলা গ্যারেজের গেটে ড্রাইভাররা কয়েকজন রাস্তার পাহারাদার আর সামনের বাড়ির দারোয়ান মিলে জটলা করে পেঁয়াজু আর ঘুগনি ডলে সরষের তেল দিয়ে মুড়িমাখা খাচ্ছে, সেখান থেকে বলাবলি শোনা যায়, কোথায় নাকি ‘সিগন্যাল পরসে’। সেই জন্যই বুঝি ভালো করে ঝমঝমিয়ে হয়ও না, আবার থামেও না, কেমন গুমোট হয়ে ‘থম দইরা’ আছে।
রোজ সন্ধ্যায় খালি পেটে ‘ওলট কম্বল’-এর শরবত খায় ড্রাইভার মোতালেব আর সরিপ মিয়া, আজ শরবতের বালতি নিয়ে লোকটা আসেনি বলে গজগজ করছে ওরা। হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল—আমি অল্প বস্যে…; কদিন ধরে বাসায় ঢুকতে-বেরোতে এটুকুই রোজ গায় সামনের বাসার ইমরান। কেন যেন বিরক্ত লাগে না ওই একই কথা বারবার শুনতে, শেষ দিকে আবার গলাটা একটু কাঁপায়।
বৃষ্টি, রাস্তায় গাড়ির শব্দ, রিকশার টুংটাং, লোকজনের কথাবার্তা, পাশের বাড়ির দোতলার পাগলাটে মহিলার চেঁচামেচি—কিছুই অলির অস্থির মনকে স্পর্শ করতে পারছে না। গেট থেকে ওদের ডাকেও সাড়া না দিয়ে সিঁড়ির ভাঁজের নিচে নিজের কুঠুরিতেই বসে আছে অলি, মুড়িভর্তা উপাদেয় ঠেকে নাই। কিন্তু তাই বলে চুপ করে নেই সে, অনবরত নড়ছে, উত্তেজনায় টগবগ করছে, খাঁচার পাখির মতো সারাক্ষণ ছটফট করছে। জান্তব এক আদিম অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রেখেছে তাকে। এক ধ্যানে চার তলার রুকিয়ার কথা ভাবছে।
রুকিয়া—আহা, কী মিষ্টি মায়াভরা নাম! শুনেই মুগ্ধ হয়েছিল অলি, একদম ‘ফিদা’। প্রথমবার ওকে দেখে—যেন তার স্বপ্নের রাজকন্যার মতো পরম আরাধ্য কোনো লেহাজ রমণী কিংবা যেন আকাশ থেকে হঠাৎ নেমে আসা এক পরি—কেমন ধক্ করে উঠেছিল বুকটা, একঝলক রক্ত তোলপাড় শুরু করেছিল; নামটা শুনেও তেমনি ভীষণ অবাক এবং ভারি পছন্দ হয়েছে। সাদাসিধা বেশে মিষ্টি চেহারা আর পরিচ্ছন্ন ছিপছিপে শরীরের লাবণ্যময় চলাফেরা তাকে দিয়েছে এক অভিজাত গাম্ভীর্য, একই সঙ্গে যেন করেছে রহস্যময়ী। মোটকথা, ওকে দেখার পর থেকেই অলির মাথায় যেই ‘ঠাডা’ পড়া শুরু, তুচ্ছ নামটাও খুব দারুণ কিছু মনে হওয়া থেকে সেই মুগ্ধতা একটা সামগ্রিক রূপ পায়, যেন এক পারস্পরিক বোঝাপড়ার দিকে এগিয়ে যায়।
এবং ওরা দুজন মিলে সেই বোঝাপড়াটা চূড়ান্ত করতে পেরেছে।
রাত বাড়ছে।
হাতের লাঠিটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে রেখে গামছা দিয়ে ঝেড়ে ওর চৌকিটায় বসল অলি। সিঁড়ির নিচে একেবারে ভেতর দিকে কেরোসিন স্টোভ নেভানো, আজ ভাত রাঁধে নাই সে। দুপুরে খেয়েছে মাষকলাইয়ের ডাল, পাটশাক আর ফাইসা মাছ; তবে খেতে লেগেছে টাটকিনি, সামনের ডান দিকে মোড়ের বিল্ডিংয়ের কেয়ারটেকার খালেকুর পাঠিয়েছিল। ওর কুমড়াফুলের বড়া হয় দারুণ। প্রায়ই ওরা খাবার ভাগাভাগি করে।
পাম্পমেশিনটার দিকে তাকাল। নষ্ট হয়ে পড়ে আছে সেটা। খুলেটুলে দেখেছে, কিছু করা যায় নাই। সেক্রেটারি সাহেবকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছে অলি, মোটরে গোলমাল, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি লাগবে। স্পেয়ার পাম্পটা আপাতত চলছে, তবে আসলটা সারাতে হবে শিগগির। এসএসসি পাস করার পর—আসলে, পাস করেছে কি না জানে না সে, পরীক্ষা দিয়েছিল ঠিকই; কিন্তু তার আর কোনো হদিস স্কুলে পাওয়া যায় নাই। তাকে বলা হয়েছিল বোর্ডে যোগাযোগ করতে, ওর কৃষক পিতার পক্ষে সেটা আর হয়ে ওঠে নাই; হয়তো এমনিতেও বেশি দূর গড়াত না ওর লেখাপড়ার চাকা, সে জন্য কেউ আর উৎসাহ দেখায় নাই, ওই জটিলতায় পড়ে সেখানেই যতি টানতে হলো—যা হোক, যখন সে রেজাল্টের গোলমালে কলেজে ভর্তি হতে পারল না, ওই সময়টাতে মেকানিকের কিছু কাজ শিখেছিল। সেই বিদ্যা কাজে লাগিয়ে মাঝেমধ্যে ছোটখাটো কিছু জিনিস ‘টুকটাক’ সারিয়ে ফেলে। এই পাম্পটা এর আগে আরও বার দুয়েক সারিয়েছে সে, এবারও চেষ্টা করেছিল, হয় নাই। রেঞ্চটা চোখে পড়ল পাশে পড়ে আছে, পাম্পের শক্ত নাটবল্টু খুলতে গেলে লাগে। কেউ নিয়ে যেতে পারে…, এক মুহূর্ত ভেবে ওইটা নিয়ে নিচতলারই অফিসরুমে উকিল সাহেবের পিয়ন-কাম কাজের ছেলে লোকমানকে রাখতে দিয়ে এল, পরে নেওয়ার কথা বলে। পুরো নিচতলায় ওই একটাই ঘর, বাকি খোলা জায়গায় আটটা গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। শেষ মাথায় মাঝ বরাবর সিঁড়ি, তার নিচে তিন দিক ঘেরা অলির ডেরা এবং টয়লেট।
একদম অ্যাটাচ্ড, তবে জায়গাটা একেবারেই খোলা হওয়ার কারণে পাবলিক টয়লেট হয়ে গেছে, ড্রাইভার-পিয়ন-আগন্তুক এমনকি মাঝেমধ্যে হঠাৎ দু-একটা ফেরিওয়ালা কিংবা ভিখারিও এটা ব্যবহার করতে বায়না ধরে। কিন্তু দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করা যায় না, ‘হুঁম্ম্হ্, আম্হ্হ্’ পদ্ধতিতে ভেতরে বাইরে শব্দ করতে হয়। ঢাকার সব টয়লেটই বুঝি এ রকম! এখানে আসার আগে কিছুদিন একটা ‘অফিসার্স মেসের ম্যানেজার’ হিসেবে কাজ করেছে সে, সেটা ছিল বেড়িবাঁধের সঙ্গে ‘টং ঝুপড়ি অন বাম্বু ক্যাসল’। সেখানে সবার জন্য ছিল একটাই পায়খানা, ছালার দরজা এবং প্রবেশের জন্য একই রকম ‘খাঁকারি’ ব্যবস্থা।
তবু ঢাকা শহর! এখানে কোনো রকমে কিছুদিন থেকে যেতে পারলেই মেলে সোনার হরিণ! হয়তো অলিও পারত ভালো কোনো কাজ জুটিয়ে নিতে, কিন্তু সেই প্রলোভন ছেড়ে চলেছে সে, তা-ও আবার পালিয়ে।
বলে-কয়ে যেতে হলে অনেক হাঙ্গামা, ও তো শুধু দারোয়ান নয়, কেয়ারটেকারও বটে। যাবতীয় বিল-টিলও তাকেই গিয়ে দিয়ে আসতে হয়। সমিতির সেক্রেটারি সাহেব ভালো মানুষ হলেও আর একজন না পাওয়া পর্যন্ত যেতে দিতেন না, আর এমন মিষ্টি করে কথা বলেন—তাঁর কথা কেউ ফেলতেও পারে না। তা ছাড়া একটা নতুন আপৎ জুটেছে—রুকিয়ার আগের স্বামী। চারতলা থেকে নিচে এমনিতে কমই নামে রুকিয়া, সেই দিন কী কাজে নেমে হঠাৎ তার ছেড়ে আসা স্বামীকে এই দিকেই নাকি কোথায় দেখেছে সে। তার পর থেকেই ভয়ে অস্থির, তাই পালানোর সিদ্ধান্তটাও দ্রুতই নিতে হয়েছে। এবং গোপনীয়তাও বেড়ে গেছে দ্বিগুণ।
রুকিয়াকে দেখে অলি বুঝতেই পারে নাই যে ওর বিয়ে হয়েছিল, পরে শোনে মায়ের বাড়িতে রেখে আসা একটা বাচ্চাও আছে। অবশ্য তাতে তার আকর্ষণ একটুও হেরফের হয় নাই। শুধু কষ্ট পেয়েছে ওর স্বামীর অত্যাচারের কথা শুনে, চুক্তিমতো যৌতুক দিয়েও নিস্তার পায় নাই লম্পট স্বামীর হাত থেকে, দাবির আর শেষ নাই। আগের দুটো বউ আছে তার, একজন মারা গেছে অত্যাচারে। সে জন্য থানা-পুলিশ পর্যন্ত হয়েছিল। এখন যারা আছে, তাদেরও বেদম পেটায়, কারণ সে খুব ‘রাগী পুরুষ’। তাকে ছেড়ে দেওয়াটা—যেটা ঘটেছিল কোনো একদিনের ঝগড়া-মারপিটের পর স্থানীয় লোকজনের তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপে, অনিবন্ধিত বিয়ের অনানুষ্ঠানিক ছাড়াছাড়ি নাকি মেনে নিতে পারে নাই সেই স্বামী, হুমকি দিয়েছে সহজে ছাড়বে না বলে। সে জন্যই দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়কে ধরে এখানে পালিয়ে এসেছে। তাতেও দেখা যাচ্ছে কাজ হয় নাই।
সাত তলায় আবার একটা নতুন ভাড়াটে এসেছে। লিফ্ট নাই, ওপরে উঠতে কষ্ট হয় বলে বেশি দিন ওখানে কেউ থাকে না। ব্যাচেলর পাওয়া যায়, কিন্তু অন্য ফ্ল্যাটমালিকদের আপত্তির কারণে কম ভাড়া হলেও ফ্যামিলিকেই দিতে হয়। এবার যারা এসেছে, তাদের কাজের লোকের নাম লালু। ছোকরা বয়সী সেই লোকটা একটু আজব ধরনের। বলে, ওদের বাসায় নাকি সবাই কাজ করে। কেউ অফিসে যায়, কেউ কলেজে, আর ও বাজারসদাই কিংবা ঘরের কাজটাজ করে, তাই বলে সে চাকর নাকি! ওকে লালু বললেও রাগ করে, লাল মিয়া ডাকতে বলে। চলাফেরা ফিটফাট। ব্যাপারটায় সবাই বেশ মজা পেতে লাগল।
সেদিন ওকে ধরল দোতলার নতুন ড্রাইভার হারুন, ধৈর্য ধরে যাতে তার কথাটা শোনে সে জন্য তোয়াজ করে বলল, আপনের নাম লাল মিয়া না?
হ।
ভোটের কাড আছে?
হ।
কাডে নাম ঠিক কইরা লেখছে?
হ, ক্যা?
যুদি ভুল কইরা সোনা মিয়া লেইখা ফালাইত, মনে করেন লেখসে, তখনে ঠিক করনের লেইগা অগো কাছে গিয়া কী কইবেন?
শিদা গিয়া অগোরে কমু—সবই ত ঠিক আছে, খালি কমু…আর তখনই হঠাৎ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে রেগেমেগে ওদের হো হো হাসির মধ্যে হনহন করে সেখান থেকে পালাল লালু।
এই রকম একটা চুটকি আগেও শুনেছে অলি, খালেকুরকে এসএমএস পাঠিয়েছিল তার বান্ধবী সুমি। ওরা দুইজনে অনেক ‘খাচ্চর’ কথা বলে। কিন্তু যা হোক, সত্যসত্যই ওই নামের কাউকে এইভাবে নাজেহাল করা যায়—সেটা লালুর নাম শোনার পরও অলির মাথায় আসে নাই। ‘ড্যারাইবর হারুনে আসলেই একটা গিরিঙ্গি,’ ভাবল অলি, ‘হালায় বহুত চালু মাল, অর কাছে কিছু শিখনের আছে।’
একদিন মোবাইল ফোনে কাকে যেন কোথায় নামিয়ে দিয়ে আসার নির্দেশ পেয়ে ফোন রেখে বলে, রাস্তায় বিষ্যুদবারের জ্যামের কতা কয়া আগেই বাড়ি মাইরা রাখলাম, যাতে দেরি অইলে কিছু কইতে না পারে। এর মইদ্দে কুলসুমের লগে এট্টু দেহা কইরা আইতে পারুম।
কুলসুম কে?
আছে আছে!
বাড়ি মাইরা রাখলেন মাইনি?
বুজেন নাই? শোনেন, একটা ঘটনা কই। এক লোকের একটা বান্দর আছিল। লোকটা একদিন একটা ধান্দা বাইর করল। বান্দরটারে মাইনষের মাথার উপ্রে বসায়া দিলে সে মাথার উকুন সব খায়া শ্যাষ কইরা ফালায়, তখন ওই লোক বান্দর আলারে দুই-চাইরটা পয়সা দেয়। এমনে ভালই চলতাছিল। হঠাৎ একসময় বান্দরটা বানরামি শুরু করল, উকুন মাইরা শ্যাষ কইরাই চুল টাইনা দেয় এক থাপ্পড়, নাইলে কানের পাশে একটা খামচি। মাইনষে ডরাইতে শুরু করল, লোকটার ব্যবসা যায় যায়। তখন সে করল কি, ওগো গেরামে এক গ্যানি লোক আছিল, তার কাছে গেল। সেই গ্যানি লোক বুদ্ধি দিল কারইর মাথায় বহানের আগে বান্দরটারে কইসা একটা কঞ্চির বাড়ি দিয়া লইতে। আল্লার কি কাম, হের পর থেইকা আর বানরামি নাই, হেহ্ হেহ্ হে…।
হারুনের সঙ্গে অলিও মজা পেয়ে হাসতে লাগল দুলে দুলে। কিন্তু তারপর খামাখাই সেই জ্ঞানী লোকটির বিপদের কথা মনে হলো তার, ‘হালার গ্যানি অহনের ত ভ্যাজাল কম না!’ ভাবল অলি, ‘কত রকম মাইনষের কাছে কত রঙ্গের পরীক্ষা দিতে হয়!’
তবে ওর সব কথাই যে মজা লাগে তা নয়। যেমন, সে বিয়ে করে নাই শুনে বুদ্ধি দিয়েছে—বিয়া যুদি করতেই হয়, করবা; তয় সব সময় ধমকের উপ্রে রাকবা। খবরদার, বউরে কুনু সময় বনদু বানাইবা না। নারীজাতির কাছে হালকা হইসো কি তুমি শ্যাষ।
ওই কথার ওপরে কেউ কেউ হ হ করে ভোট দিল বিজ্ঞের মতন, তার মানে ওরাও একমত এ ব্যাপারে। শুনে একটু দোটানায় পড়ে গেল অলি, সে তো আসলে বিশেষ একজন বন্ধুই চায়; ভাবল, ‘নাওইলে রং-তামশা কার লগে! ’
একজন মন্তব্য করল, বেশি টাইট দিলে আবার বউ থাকব না।
হারুনের তবু ‘ঘাড় ত্যাড়া’ জবাব, যাইগ্গা, বউ যায় যাইগ্গা, তাও তোমার ইজ্জইতটা ত থাকল।
তিন তলার পুরোনো ড্রাইভার সরিপ ‘কতার মইদ্দে বাম হাত’ দিল, দামড়ি যায়ে, চামড়ি না যায়ে; হাহ্ হাহ্, গরু গেলেও চামড়াটা যুদি রাখন যায়!
তার ‘প্যাঁচাল’ গায়ে মাখে না হারুন, গাল বাঁকা করে তার মতামত জাহির করেই চলে। তারপর কথায় কথায় হঠাৎ তার এখানে আসার কারণটা বলে সে, শোধ নিতে এসেছে। নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে হেসে বলে, একজনের সঙ্গে কিছু লেনদেন বাকি আছে, হিসাব চুকাতে হবে।
শুনে সরিপ বলে উঠল, তর মথন জাউরা পোলারে আবর চিটিং করে ক্যাঠা! তারপর হালকা করার জন্য ওদের দিকে চেয়ে চোখ টিপে বলল, কাউঠার মতন কামুর দিয়া দরছে, আর ছারে না। ঠিক্ই বিছরায়া বাইর কইরা পিছে পিছে আইছে!
এই ঢাকাইয়া কুট্টি ‘সরিপ’ মিয়া আর এক চিজ। কাউকে তোয়াক্কা করে না সে, কোনো ব্যাপারে দ্বিমত থাকলে মুখের ওপর ঠাস ঠাস বলে দেয়। তার গাড়িতে কোনো দাগ নাই, ঝকঝকে ইঞ্জিনে শব্দ নাই, কিন্তু বেতন অন্য সবার চেয়ে দেড়গুণ বেশি। কারণ হিসেবে বলে, সবাই নাকি জানে যে সে চুরি করে না, বলে—‘বিয়া বহনের আগেই সব কথা বাইঙ্গা লইবা, নাইলে সারা জীবন বাত খাইবা বাতারের—গুণ গাইবা লাঙ্গের।’ অর্থাৎ তার ধারণা, বেতন বেশি দিলেই আর কেউ চুরি করত না। গাড়ির ছোটখাটো সমস্যা নিজেই ঠিক করে নেয়, ও নাকি সব জানে, বলে—‘গারির গোয়াদ্যা ডুইকা মুখ দিয়া বাইরয়া গেছি, আমারে আবর হিগাইব কুন হালা?’ ওর বাপও নাকি গাড়ি চালাত, আর দাদা ঘোড়ার গাড়ি।
কিন্তু এখানে একধরনের সূক্ষ্ম নৈতিক পরাজয় টের পায় হারুন, যেটা সে মেনে নিতে পারে না, নিজের কাল্পনিক ‘ব্যাডা একখান’—ভাবমূর্তি ধরে রাখার জন্য বলে, ঐ গঠনা না থাকলে এই—’র পুলার চাকরি আমি করি? ঠ্যাং বাইঙ্গা তোমার মতন লুলা বানায়া দিমুরে অলি, তারপর আমার শান্তি।

নিজের কাটা পায়ের দিকে তাকাল অলি, লুঙ্গির ওপর দিয়ে হাঁটুতে যেখান থেকে পা আর নাই—সেখানটায় হাত বুলাল। এগারো বছর বয়সে বাড়ি থেকে হেঁটে স্কুলে যাওয়ার পথে সাভারের বড় রাস্তা পার হতে গিয়ে ট্রাকের ধাক্কা খেয়ে পেছনের মাইক্রোর নিচে পড়ে অলি, ঠিকমতো চিকিৎসা পেলে হয়তো কেটে বাদ দিতে হতো না তার বাঁ পা। তারপর থেকে প্রথমে সে দুই বগলে ক্রাচ ব্যবহার করত, পরে একটা, এখন শুধু লাঠি ভর দিয়ে হাঁটে। কেউ তাকে ল্যাংড়া-খোঁড়া বললে এখন আর কিছু লাগে না অলির, গা-সওয়া হয়ে গেছে।
রাত বাড়ছে। রোজ এগারোটায় গেট বন্ধ হয়। নামেই বন্ধ, পাঁচ তলার মাস্তান ছেলেটা তো বারোটার আগে ঢোকেই না; আবার মাঝেমধ্যে হঠাৎ একটা-দেড়টার সময় কোনো গাড়ি এসে হর্ন দেয়। আজ একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, বৃষ্টির জন্য একটু পরেই মনে হয় কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। যা-হোক, প্রথমে কথা ছিল এগারোটার পর নামবে রুকিয়া, কিন্তু কিছুক্ষণ আগে সুযোগ পেয়ে ইন্টারকমে ফিসফিস করে বলেছে, হয়তো আগেই বের হতে পারবে।
দেখা যাক।
লাঠি রেখে উঠে বাথরুমে গেল অলি। টেনশনে পড়লে পেটটা খালি মোচড়ায়। পরীক্ষার সময়ও এমন হতো। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনো কষ্ট পায় অলি, হয়তো কলেজে ভর্তি হতে পারলে তার জীবনটা অন্য রকম হতে পারত। তবে নতুন কিছু শেখার এবং পড়ার অভ্যাসটা রয়ে গেছে, হঠাৎ পেয়ে গেলে কোনো বই ত বটেই—প্রায় নিয়মিত পত্রিকা পড়ে সে। সকালে হকার এসে পত্রিকার বান্ডিল ওর কাছে রেখেই আশপাশের প্রতি ফ্ল্যাটে বিলি করে। কেউ কোনো ‘জ্ঞানের কথা’ বললে মনোযোগ দিয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা করে, কখনো বক্তার সঙ্গে একমত হতে না পারলেও চুপ করে শোনে।
সাভারে বাজারের কাছে একসময় একটা সবজির দোকান ছিল তার। কিন্তু খুঁড়িয়ে গিয়ে আড়ত থেকে মাল নিয়ে আসতে আসতে বেলা হয়ে যেত, বেচতে বেচতে অর্ধেক যেত ফেলা। তারপর লসটস করে ব্যবসার চিন্তা বাদ দিয়েছে।
কিন্তু এখন সে জানে কীভাবে দোকানে বসেই মোবাইলে লেনদেন ফয়সালা করা যায়, জায়গায় বসেই মাল ডেলিভারি নেওয়া যায়। তা ছাড়া রুকিয়া বলেছে, দরকার হলে সে-ও মাঝেমধ্যে দোকানে বসতে পারে, তাতে দুজনের চেষ্টায় অবশ্যই একটা ভালো কিছু দাঁড়িয়ে যাবে। শুনে অলির বুকের ছাতি ছেচল্লিশ ইঞ্চি ফুলে ওঠে।
সবকিছু ঠিকঠাক, এখন শুধুই সুন্দর আগামীর দিকে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যাওয়া।
এখনই আসবে রুকিয়া।
কখন?

বিদ্যুৎ চমকাল, হঠাৎ করেই বাতাসের বেগ বেড়ে গেছে, রীতিমতো ঝড় বইছে, মেঘের গর্জন, সেই সঙ্গে বৃষ্টি। কারেন্ট চলে গেল।
একটু পরে বিদ্যুচ্চমকের আলোয় অলি দেখল সিঁড়ি দিয়ে নামছে রুকিয়া, এই সময় হঠাৎ উকিল সাহেবের পিয়ন লোকমান ডাক দিল অলির নাম ধরে। দ্রুত সেদিকে গেল অলি, যাতে সে এইদিকে না আসে, রুকিয়াকে দেখে না ফেলে। কাছে যেতে লোকমান বলে সে অফিস বন্ধ করবে, তাই রেঞ্চটা ফেরত দিতে চায়। ধুত্তোর! কিন্তু বিরক্ত হলেও কথা না বাড়িয়ে আপাতত রেঞ্চটা হাতে নিল অলি, ফিরে আসতে লাগল লাঠি ভর দিয়ে দিয়ে।
বাতাসের শোঁ শোঁ আর বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে এ সময় হঠাৎ তার কানে এল একটা অতিপরিচিত কণ্ঠ, কই যাও আমার ময়না পাখি!
ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সেই আলোয় দেখা গেল ড্রাইভার হারুন, ডান হাতে রুকিয়ার চুল ধরেছে মুঠ করে, আরেক হাতে ওকে ধরে টানছে।
কড়কড় করে বাজ পড়ল, জোর বাতাসের সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি।
চিৎকার করে রুকিয়ার নাম ধরে ডাকল অলি, জবাবে কেঁদে উঠল রুকিয়া, কোনো রকমে জানাল এই সেই স্বামী—এবার তাকে খুন করবে। ওদের কথা বলতে দেখে কিছু একটা বুঝে নিল সে, দাঁত কিড়মিড় করে বলল—‘কিরে, তুই দেহি আমার কইলজার মইদ্দে আত দিছাস, কার উপ্রে চোক ফালাইছাস, জানস না এইটা আমার বউ?’
—আছিল, এহন আর কেউ না। অরে ছার।
—ও-ও বুজছি, আয় দুইটারেই আইজ খাইছি! বলে হিংস্র হুংকার দিয়ে রুকিয়াকে ছেড়ে লাফিয়ে এসে প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিল অলিকে, মুহূর্তের বেসামাল অবস্থার মধ্যে হ্যাঁচকা টানে ওর হাত থেকে লাঠিটা কেড়ে নিতেই তাল হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল অলি।
দেখতে পেয়ে হাতের ছোট ব্যাগ-পুঁটলিটা ফেলে চিৎকার করে পেছন থেকে হারুনের জামা ধরে আচমকা এক টান মারল রুকিয়া। অলিকে মারতে লাঠিটা মাথার ওপর তুলেছিল হারুন, অশ্লীল একটা গালি দিয়ে ঘুরে রুকিয়াকেই মারল বাড়ি। আর্তনাদ করে পড়ে গেল সে।
তাই দেখে পাগলা ঘণ্টি বেজে উঠল অলির মাথায়, খুন-চিৎকার দিয়ে একপায়ে লাফিয়ে উঠল, হাতের ভারী রেঞ্চটা ঘুরিয়ে সোজা মেরে দিল হারুনের ঘাড়-মাথা বরাবর।

এর পর কিছু ঘটনা দ্রুত ঘটে গেল। হারুন চট করে মাথাটা সরিয়ে নিল, ফলে অলির বাড়িটা জুতমতো লাগে নাই। তবু যতটুকু লেগেছে তাতেই কাবু হয়ে পড়ল সে, মাথা কেটে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ওর চিৎকার-চেঁচামেচিতে লোক জড়ো হয়ে গেল প্রচুর। একসময় ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সেক্রেটারি সাহেবও এসে পড়ল। সবার সামনে হারুন তার বউয়ের সঙ্গে অলির সম্পর্কের কুৎসিত ইঙ্গিত করল। সবিস্তারে বানিয়ে বানিয়ে বলল তার নিজের চোখে দেখা বিভিন্ন মিথ্যা ঘটনা। তখন কে একজন বলে উঠল, এই রকম একটা বাজে মেয়েকে বউ বলে স্বীকার করছে কেন সে, ছেড়ে কেন দিচ্ছে না। হঠাৎ ওই কথার উত্তরে হারুন তার নিজের ‘ইজ্জইৎ’ কিংবা ‘ব্যাডাগিরি’ রক্ষা করতে গিয়ে মুখ ফসকে বলে ফেলল, রুকিয়াকে সে বহু আগেই ছেড়ে দিয়েছে।
তখন সবাই হারুনকে ছেড়ে অলিকে নিয়ে পড়ল, একমত হলো যে, এই রকম একটা খারাপ কাজের পর সে কিংবা ওই রুকিয়া—কাউকেই আর এখানে রাখা যাবে না, এখনই, এই মুহূর্তে ওদের বিদায় করতে হবে।
আরে ওরা ত তা-ই চায়!
খুশি হয়ে উঠল অলি, খুশি হয়ে উঠল রুকিয়া।
একটুও দেরি না করে সমস্ত মিথ্যা অপবাদের কলঙ্ক বিনা প্রতিবাদে যেন রঙিন মুকুটের মতো মাথা পেতে নিল ওরা সানন্দে।

বৃষ্টি হচ্ছে, তবে ঝড় কমে এসেছে, থেমে যাওয়ার আগেই পালাতে হবে। এক হাতে লাঠি আর এক হাতে রুকিয়াকে ধরে বেরিয়ে পড়ল অলি।
ওকে ধরে রেখেছে রুকিয়া, শক্ত করে।

কী নিচ্ছ ঠোঁটের ফাঁকে, সুদূরের পাখি?
আমি নিচ্ছি দুটো খড়, এই মৃত্যু, আরেক জীবন।
—খোন্দকার আশরাফ হোসেন

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৯, ২০১১

Category: গল্প
Previous Post:নির্বাচিত গল্প : ওয়াসি আহমেদ
Next Post:মাটির ময়না – বিলোর চৌধুরী

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑