২. হামেদ তখন ঘুমিয়ে ছিল

হামেদ তখন ঘুমিয়ে ছিল। নাসিমা অপলক অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে। আমিও কি বিবর্ণ হয়েছি এমনি? ক্ষীণ নিঃশ্বাস পড়ছে হামেদের। পৃথিবীর সঙ্গে জীবনের ক্ষীণ সূত্র। তুমি আমার সহোদর। আমি বেঁচে থাকতে চাই। খাটের পাশে আস্তে আস্তে নিঃশব্দে বসল নাসিমা। আমি বেঁচে থাকতে চাই। মমতায়, প্রীতিতে, সংগ্রামে, সৌন্দর্যে আমি বেঁচে থাকতে চাই। তোমাকে বিশ্বাস করেছি আজ শিশুরাত্রিতে। অসংখ্য আরো মৃত্যুর জন্যে তুমি আমাকে আর প্রস্তুত কোরো না, প্রবীর।

হামেদের কপালে হাত রাখলো নাসিমা।

এসেছিস?

এখন তুমি কেমন আছো?

ওই রকমই। ব্যথাটা বিকেলে আর আসেনি। বোধহয় ভালো হয়ে যাবো। তারপর একটু থেমে হামেদ চোখ বুজে বলল, তোর ভাবীকে আনিয়ে নিবি?

নাসিমা এ প্রশ্নের কোনো উত্তর করলো না। তোমার মৃত্যু শুধু তোমারই। অসুস্থতা কি কেটে যাচ্ছে হামেদের? বদলে নাসিমা বলল, বিনতার সঙ্গে দেখা হলো। আর প্রবীর।

অনেকদিন দেখিনি ওদের। এলো না?

আসবে।

তুই তাহলে কলকাতায়ই থাকবি?

কলকাতা থেকে চলে গেলে আমি দম আটকে মরে যাবো। নাসিমা অস্পষ্ট হাসতে হাসতে বলল, বড় ভালো লাগল কলকাতা। আমি এখানেই থাকব। আর মনে মনে সে বলল, আমাকে বাঁচতে দাও। আজ আমি বহু দিন পরে নরক মুক্ত হয়েছি। প্রীতির আবিরে আমি এখন আচ্ছন্ন।

বিশাল কলকাতা উদার একটা মানুষ। তার উদ্দেশে নাসিমা সমস্ত রজনীগন্ধা সমর্পণ করে ঘুমিয়ে পড়ল।

.

বুধবার বিকেলে কলকাতায় বৃষ্টি নামলো। তখন নাসিমা আর প্রবীর চৌরঙ্গির এক রেস্তোরাঁয় বসে। আস্তে আস্তে চুপ হয়ে গেল চারদিক, কেবল বেঁচে রইলো বৃষ্টির শব্দ। প্রবীর টেবিলের ওপর দুকনুই রেখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আর নাসিমার বাঁ হাতের করতলে রাখা কপোল, ডান হাত অন্যমনস্ক খেলা করছে প্রবীরের দেশলাই নিয়ে। নাসিমা দেশলাইটা দূরে সিগারেট প্যাকেটের ওপর সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলল, আমি আমার মত করে বাঁচতে পাবো না, এইটেই বোধহয় পৃথিবীর সবচে বড় দুঃখের, তাই না?

প্রবীর কোনো কথা বলল না।

আমি কার কাছে কী এমন অপরাধ করেছিলাম যে আমাকে এমনি করে কষ্ট পেতে হবে?

কেন আপনার এত কষ্ট?

কেন?

ছায়া ছায়া হাসলো নাসিমা। যেন বিষাদ বৃষ্টি হলো। বলল, একেক জন বুঝি এমনি কষ্ট পাবার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। বিনতার গান গাইবার মত হয়ত আমারও এ কষ্ট পাবার প্রতিভা। নইলে এমন হয় কেন?

নাসিমাকে আজ যেন পেয়ে বসেছে। বাইরের অবিবল বৃষ্টি ধারার মত তার মনের দুয়ার খুলে গেছে।

প্রবীর আস্তে আস্তে আঙ্গুল স্পর্শ করে নাসিমার।

নাসিমা তার স্পর্শ সরিয়ে দেয় না। হয়ত তার বাইরের ইন্দ্রিয়গুলো এমন স্তব্ধ হয়ে গেছে যে সে বুঝতে পারেনি প্রবীর কখন তাকে স্পর্শ করেছে। প্রবীর কি নাসিমার ভেতরে এই স্পর্শ দিয়ে সঞ্চারিত করে দিতে চায় তার আত্মিক শক্তি?

নাসিমা অনেকক্ষণ পরে উত্তর করে, মানুষ এত নীচ হয় কেন বলতে পারেন?

প্রবীর উত্তর দিল না।

—-এত নীচ, এত অসুস্থ কেন মানুষ, বলতে পারেন প্রবীর বাবু?

প্রবীর কোনো কথা বলে না। মাথা নিচু করে নাসিমার আঙ্গুল নিয়ে অস্পষ্ট খেলা করতে থাকে।

নাসিমা এবারে হাত টেনে নেয়। বলে, জানি এ সব প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না, জিজ্ঞেস করে শুধু শুধু আপনাকে বিব্রত করলাম।

আমি আপনার প্রশ্নটাই ভাবছিলাম। আসলে আমরা হয়ত সবাই খুব স্বার্থপর, নিজের দিকটাকে বড় করে দেখতে গিয়ে অহেতুক আরেকজনকে ছোট করে ফেলি, তাকে কষ্ট দি তার কষ্ট বুঝতে চাই না।

আর অসুস্থতা?

কিসের? শরীরের না মনের?

শরীরের অসুখ অনেক ভালো প্রবীরবাবু। স্বার্থপরতাও কি একটা অসুখ নয়? এ অসুখটা আরেকজনকে শুছু কবরে নিয়ে যায় যে।

প্রবীর কোমল হয়ে ওঠে।

আপনি অনেক আঘাত পেয়েছেন জীবনে। আমার একটা কথা মনে হচ্ছে। বলবো?

বলুন—-কী কথা?

আমার কী মনে হচ্ছে জানেন, কারো অসুখ তবে আমরা ঘৃণা করি না ওষুধ দিয়ে তাকে সারিয়ে তুলি। মনের অসুখ হলে কেন তাকে ঘৃণা করবো তাহলে?

আমি তো কাউকে ঘৃণা কবিনি, প্রবীরবাবু।

এই উত্তরটা মুখে দিলেও, মনে মনে নাসিমা প্রবীরের কথাটা নিয়ে বিশদ ভাবতে থাকে। প্রবীর বলে চলেছে, আমি জানি, আপনার মত মানুষ কাউকে ঘৃণা করতে পারে না। মনের অসুখটাকে কি আমরা সবাই মিলে সারিয়ে তুলতে পারিনে? মনের অসুখটাও তো সাময়িক। একটা মুহূর্তের বিকার মাত্র?

হয়তো। কিন্তু এ অসুখটা যার হয় সে অসুখটাকে ভালোবাসে বলেই হয়।

নাসিমা এতক্ষণে প্রবীরের গোড়ার প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে পায়।

আপনি বলছিলেন না, মনের অসুখ হলে তবে ঘৃণা করব কেন? প্রবীরবাবু, আপনি কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন?

না।

ভালোবাসেন নি?

নাসিমা আবার প্রশ্ন করে। করেই প্রবীরের চোখের দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে যোগ করে, —-ভালোবাসার দরকার হয় না, এমনিতেই বুঝতে পারা যায় মনের অসুখ আর শরীরের অসুখ এক নয়, প্রবীরবাবু।

বলতে বলতে কণ্ঠস্বর কখন ভাবনায় রূপান্তরিত হয়ে যায় তার। শরীরের এমন একটা নিয়ম আছে ওষুধ তাকে মানতেই হবে, যদি জীবনীশক্তি ব্যয়িত হতে হতে তার শেষ লগ্নে তখনো পৌঁছে থাকে। কিন্তু মন? মনের ভেতরে চলেছে নিয়ত নিয়মের এক দ্বিমুখী সংগ্রাম। সেখান থেকে কি মুক্তি আছে কারো? আমার মনের যে শুদ্ধ নিয়ম তাকে দিয়ে সৃষ্টি করি বাইরের পৃথিবীকে, আর আরেক দিকে বাইরের পৃথিবী তার নিয়ম দিয়ে শাসন করতে চায় আমাকে। বার থেকে এমন কোনো শক্তি নেই মনের অসুখ সারিয়ে তোলে। আত্মাকে দৃঢ় করতে পারলে আর ভয় নেই। এই দ্বিমুখী সংগ্রামের শেষ হবে কবে? কবে আমি পারবো থুতু আর কাদাকে ভয় নয়, উপেক্ষা করতে, প্রবীর?

অনেকক্ষণ কথা বলেনি নাসিমা। হঠাৎ সেটা লক্ষ্য করে সে বলল, সহজ, শাদা একটা মানুষ আজ অবধি আমার চোখে পড়ল না।

আমরা সবাই কত একা।

প্রবীর তাকাল তার চোখের দিকে।

বাইরে বৃষ্টি ধরে গেছে। আর কোনো শব্দ নেই বৃষ্টিপতনের।

প্ৰবীর বলল, আরো বসবেন, না বেরুবেন?

চলুন বেরোই। বৃষ্টির পরে শহর খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, না?

নাসিমা উঠবার আগেই দাঁড়িয়ে পড়ল প্রবীর। উঠতে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেল সে। মনে হলো, প্রবীর অদৃশ্য হয়ে গেছে, বদলে সিল্কের একটা হাওয়াই শার্ট আর চকোলেট উলেন ট্রাউজার ঝুলছে তার সমুখে।

.

আরজুর আয়নাটা নগ্ন, নিষ্ঠুর।

 নেয়ে আসবার পর আসল চেহারাটা যেন বেরিয়ে এসেছে শ্যাওলা ছাড়ানো পৈঠার মত। কানের দুপাশ দিয়ে লতিয়ে নেমেছে চুলের গুচ্ছ, হয়ত সেখানে খুঁজলে একটা দুটো শাদা চোখে পড়বে। আমি পুরনো হয়ে যাচ্ছি। এই পুরনো হয়ে যাওয়াটা বড় অদ্ভুত; মনে হয়, অনেক দূরে সরে গেছি পৃথিবী, পৃথিবী ছাড়িয়ে যা কিছু সমস্ত থেকে।

বত্রিশ বছরের পুরনো মুখটাকে আয়নায় নাসিমা দেখতে থাকে।

কালো—-হ্যাঁ, কালো বই কি—- কালো ছিল বলে ছোট বেলায় মা–র আফশোসের অন্ত ছিল না। বিকেল বেলায় কোলের কা; বসিয়ে, আজো মনে আছে নাসিমার, দুধের সর দিয়ে মেজে দিতেন তার মুখ। মসৃণ হয়েছে, কমনীয়তা এসেছে, কিন্তু রঙ কাটে নি। অত শত বুঝতো না নাসিমা। মায়ের দুঃখটা আবছা করে মনে থাকতো শুধু। তারপর যখন শাড়িতে সে শ্রীমতি হয়ে উঠলো তখন অনেকটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তার মুখশ্রী। নিজের বর্ণ সম্পর্কে সচেতন হয়ে থাকাটা কোনদিন তার স্বভাব ছিল না। সামান্য একটু প্রসাধন, একটু সাবান–তোয়ালে তা–ই যথেষ্ট। আনিস বলত, তোমার মুখ আকাশের মত।

কৈশোর পেরুনো সেই প্রথম বয়সটাই অদ্ভুত একটা অহংকার সঞ্চারিত করে দিত যেন এই প্রশংসাটুকু। করাচির সেই দুকামরার ফ্ল্যাটে ডাক্তারের ওখান থেকে ফিরে আসবার পর তার এই কথাটা অনেকক্ষণ ধরে মনে পড়েছিল। জওয়াদ ট্যাকসির ভাড়া দিয়ে ওপরে ওঠে এলে পর তার মনে হয়েছিল প্রাণের সমস্ত দরদ ঢেলে কেউ যদি আজ গান গেয়ে উঠে তবু এই দূরত্ব ভরে উঠবে না। এত দূর এত দূরত্ব আমার। কে যেন বলেছিল আমার মুখ আকাশের মত। বাইরের রঙটাই শুধু নয়, আমার মনও যে তেমনি সুদূর হয়ে গেছে, আনিস কি তা বুঝতে পেরেছিল? না কি জওয়াদও বুঝতে পারে এ কথা? আমি যে আকাশের মত দূর থেকে প্রীতিতে নত হয়ে তোমাদের মিছিল দেখে চলেছি আজীবন দিনগুলি।

আকাশের মত নাসিমার মুখ।

আজ সে মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে বার থেকে। ফ্যাকাশে ছাই ছাই একটা আভা এসেছে। গালের হাড় স্পষ্ট হয়ে ওঠায় দুচোখের তীক্ষ্ণতা যেন বেড়ে গেছে, আর রেখা রেখা জ্যামিতিক চেহারায় ওই বৃত্ত দুটো যেন বিদ্রোহ করে আছে সারাক্ষণ। সারাটা মুখে কোনো সঙ্গতি নেই। একেই কি বলে বীভৎসতা? বত্রিশ বছরের ফসিল এই মুখ এতকাল পৃথিবীর কোন গোপনে লুকোনো ছিল, অনেক নাসিমার মৃত্যুর পর সে তার সময় বুঝে বেরিয়ে এসেছে বিবর থেকে।

 মতির মা–র কণ্ঠস্বরে হাতটা কেঁপে গেল গলায়। পাটা ডিবেয় রাখতে রাখতে সে উঠে দাঁড়াল।

আজ আবার সে আরজুর শাদা শাড়িটা পরেছে। যেন অদৃশ্য রূপোর রেকাবি থেকে উথিত গাঢ় ধুপরেখা বাতাসে স্থির হয়ে আছে।

মুখ ফেরাতে গিয়ে কেমন সংকোচ হলো নাসিমার। মতির মা তার এই বারবার নাওয়াটাকে মোটেই যে ভালো চোখে দেখতে পারছে না, এ সে প্রথম দিনেই বুঝে নিয়েছে তার হাসি থেকে। এখন যেন হঠাৎ চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে নাসিমা।

কিন্তু আজ আমাকে স্নিগ্ধ রাখতে হবে আমার মন। আরজুর বারান্দার শাদা শাদা ফুলের মত, কলকাতার ফুটপাতে কেনা রজনীগন্ধার টিউবের মত।

নাসিমা ঘুরে দাঁড়াল।

না, এখন আমি চা খাবো না। পরে দিবি।

উনুনে পানি দিয়েছি যে।

তোর কি আর কোনো কাজ নেই, মতির মা? আরজু বলে গেছে বলে আমাকে নিয়ে এমনি করে পড়তে হয়? পানি ফেলে দেগে যা, চাচাস নে।

চাঁচালাম কই আপামনি, জিজ্ঞেস করছিলাম শুধু।

তারপর একটু থেমে, —-ওই সাহেব আসবার কথা আছে বুঝি?

নারী হলেই কি অনুভূতি এত প্রবল হতে হয়?

সেদিন মতির মা–কে দিয়ে ফুল পাড়ানোর কুফল ভুগতে হচ্ছে নাসিমাকে, শুনতে হচ্ছে ইঙ্গিত, দেখতে হচ্ছে চাপা হাসির বিচ্ছুরণ। মনে হলো ঠাস্ করে একটা চড় বসিয়ে দেয় মতির মা–র গালে।

আর একটু পরে বেবি আসবে তার উজ্জ্বল দুই চোখ নিয়ে। তার মসৃণ করে কামানো তরুণ গালে সন্ধ্যের আলো এমন একটা নীল আভার সৃষ্টি করবে যে বারবার ইচ্ছে করবে সেখানে আলতো করে একটা চুমো দিতে।

বেবি আসবে। আমার জন্যে সে আসবে। বেবি আসবে। বেবি এক্ষুণি আসবে।

রাতে প্লেন এলো ঢাকা বিমানবন্দরে।

জানালা দিয়ে অনেক আগে থেকেই দেখা যাচ্ছিল বিন্দু বিন্দু আলো—-নিচে, অন্ধকার শহরে। বব জানালা থেকে ক্লান্ত চোখ ফিরিয়ে শুধালো, ইজ দ্যাট ডাউন দেয়ার হোয়ার উই গো? ইয়েস, ডার্লিং।

সংকেত।

নাসিমা ববের সিট বেল্ট লাগিয়ে দিল। তারপর নিজেরটা। ববের মাথা ব্রাশ করে দিল খানিক আঙুল দিয়ে। বব বলল, আই স্লেপট লং।

ইউ ডিড।

হ্যাভ আই মিস্ড এ্যানি ফান?

নাসিমার হৃদস্পন্দন মুহূর্তের জন্যে দ্রুত হয়ে আবার স্বাভাবিকতা ফিরে পেল। আমি মনে করেছিলাম, তুমি মরে গেছ, বব। আমি বোধহয় চিৎকার করে উঠেছিলাম। সবাই মুখ টিপে হাসছিল অনেকক্ষণ। শুনে তুমিও কি হেসে উঠবে, বব? না, কোনদিন তুমি জানবে না।

নো ডিয়ার, ইউ হ্যাভ মিস্ড এ্যানিথিং—-দেয়ার ওয়াজ ক্লাউড অ্যান্ড সান অ্যাণ্ড ক্লাউড এগেন অ্যাণ্ড ইউ কুড সি ডাউন বিলো—-রিয়ালি দেয়ার ওয়াজ নো ফান।

মাটির স্পর্শ শিহরণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা প্লেনে। দৌড়তে থাকে রানওয়ে দিয়ে। দুদিকে পাল্লা দিয়ে যেন অন্ধকার আর গাছ ছুটে চলেছে। আর বাতাস যেন বদলে গেছে হঠাৎ। নাসিমার মন তখন বিষ হয়ে আসছে। যে উত্তেজনা নিয়ে করাচি ফেলে এসেছিল সে কখন যে সেটা অন্তর্হিত হয়েছে তা বুঝতে পারেনি। আবার তাকে আবিষ্কার করে নিতে হবে দ্বীপ। আবার কি তাকে পালাতে হবে?

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ববকে হারিয়ে ফেলল নাসিমা।

চারদিকে আকুল হয়ে খুঁজেও ববকে যখন পেল না তখন মনে হলো একটা শক্তি অন্তর্হিত হয়ে গেছে তার শরীর থেকে। মৃত্যুর শীতলতা সে অনুভব করতে পারলো হৃদপিণ্ডে।

কাস্টমসের পাল্লা চুকিয়ে হলে এসে দাঁড়াতে চোখে পড়ল ববকে। বব হৈহৈ শুরু করে দিয়েছে এরি মধ্যে ছোট ছোট তিনটে ছেলেমেয়ের সঙ্গে। ওর বাবা, নতুন মা দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। হাসছে।

পাশ কাটিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো নাসিমা।

বব যেন আমাকে দেখতে না পায়।

.

বৃষ্টির পরে সারা কলকাতা নতুন একটা পয়সার মত ঝকঝক করছে। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা সন্ধ্যেটাকে আবাহন জানাল। মনে মনে। তারপর কার্জন পার্কে গিয়ে। পাশাপাশি বসলো দুজন। এতক্ষণ কেউ কোনো কথা বলেনি, বলল না। নাসিমা এতটা অন্তরঙ্গ বোধ করছে আজ প্রবীরের সঙ্গে যে শব্দের আদান–প্রদানটাই বাহুল্য মনে হচ্ছে তার কাছে। প্রবীরকে বিশ্বাস করেছে সে, এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে? আমার শরীরে আজ কোনো জ্বালা নেই, আমি হয়ত আজ ঘুমোতে পারব ঘুমের ওষুধ ছাড়াই।

প্রবীর বসে বসে সিগারেট টানছে। আলোয় ধিকিধিকি জ্বলে উঠছে তার চোখ। কখনো কখনো মাথা ফিরিয়ে দেখছে নাসিমাকে, তারপর আবার দূরে দূরে মানুষ, মানুষের ওপরে আকাশকে। নাসিমা মনে মনে বলল, আমি তোমাকে আজ বৃষ্টির মুহূর্তে চৌরঙ্গির রেস্তোরাঁয় সৃষ্টি করেছি।

বাসায় পৌঁছে দিল প্রবীর। তখন অনেক রাত। প্ৰবীর বলল, আজ ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না, কী করি বলুন তো।

আমি কি ফিরিয়ে দিচ্ছি আপনাকে?

আহা তা কেন? বসবো কিছুক্ষণ? একটু চা খাওয়াবেন?

খাবেন? আসুন।

বলতে বলতে দুজনে গিয়ে বাইরের ঘরে ঢুকলো। বাতিটা জ্বেলে দিতেই অন্ধকারে–বিশাল কামরাটা ছোট হয়ে এতটুকু হয়ে গেল যেন।

প্রবীর সোফায় বসে টিপয়ের ওপর পা তুলে দিয়ে ক্লান্তিতে আড়মোড়া ভাঙ্গল। পরে বলল, অনেকক্ষণ পরে হাত পা ছড়িয়ে বসতে পেয়ে যেন মুক্তি পেলাম।

কৌতুক–অভিযোগে স্বচ্ছ হয়ে এলো নাসিমা।

এতক্ষণ তাহলে শুধু শুধু আমার জন্যে কষ্ট পেয়েছেন বলুন।

কষ্ট? তা পেলামই বা। এই কিছুক্ষণ আগে ছেলেমানুষের মত একটা প্রতিজ্ঞাও করে ফেলেছিলাম মনে মনে।

কী রকম?

আপনার জন্যে মনে হচ্ছিল আমি যে কোনো কষ্ট করতে পারি।

তাই নাকি?

যেন কিছুটা অভিমান ভরা কণ্ঠে প্রবীর বলল, ঠাট্টা মনে করলেন?

প্রবীরের এই অভিমানটুকু মধুর লাগল নাসিমার। প্রবীর নিচু হয়ে সিগারেট ধরালো আরেকটা। নাসিমা বলল, চা খাবেন বলছিলেন? আপনার চা করে আনি।

অনেকক্ষণ পরে খালি হাতে ফিরে এলো নাসিমা। বলল, কপাল মন্দ আপনার, অতিথিকে যত্ন করতে পারলাম না। চা পাতা নেই ঘরে। কী করবেন?

থাক, না হলেও চলবে।

তাহলে বসুন আরো কিছুক্ষণ।

আসলে নাসিমার ফিরতে দেরি দেখে প্রবীর উঠে ঘরময় পায়চারি করছিল। নাসিমা তার মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বসলো অবশেষে।

বসবেন না? দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি?

বসে থেকে পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরে গিয়েছিল। হাঁটছি খানিকটা।

দাদাকে দেখে এলাম, ওখানে দেরি হয়ে গেল।

কেমন আছেন উনি?

ওই রকমই। একটু বেড়েছে মনে হলো।

ব্যথা?

হ্যাঁ। ডাক্তার সন্ধ্যেয় ইঞ্জেকশান দিয়ে গেছে শুনলাম। এখন ঘুমোচ্ছে।

রাত বেশ হলো, না? আজ সারাটা দিন কাটালাম আমরা। বলতে বলতে প্রবীর এসে বসলো তার সমুখে। বলল, কথা বলুন। কিছু বলুন।

কী বলব?

আপনার কথা। আপনার সব কথা আমাকে বলুন, আমি শুনবো।

কষ্ট পেতে চান?

প্রবীর অস্পষ্টভাবে নাসিমার হাতে হাত রাখলো।

চাই।

হামেদকে যখন দেখতে গেলাম, নাসিমা ভাবল, তখন সে কত অসহায় হয়ে ঘুমোচ্ছিল। প্রবীরের চোখের দিকে তাকাতে পারল না নাসিমা। হঠাৎ নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো তার। দুর্বল একটা হাসি ছড়িয়ে ভাঙ্গা গলায় বলল, তারচে গল্প শুনুন, কিসের গল্প বলবো? প্রবীর কোনো কথা বলল না। স্পর্শ সরিয়ে নিল না।

—-আমি তখন খুব ছোট। আমার মনে আছে একদিন খুব বড় বড় শিলাবৃষ্টি হলো। ছোটবেলার গল্প শুনতে আপনার ভালো লাগে? আমাদের দেশের বাড়িতে সবকটা ঘরই টিনের।

প্রবীর এবার তার মনিবন্ধে তার রাখলো।

নাসিমার কণ্ঠ হঠাৎ দ্রুত দুর্বল হয়ে এলো—-টিনের ছাদে কখনো শিল পড়ার আওয়াজ শুনেছেন? শোনেননি? ইংরেজি রেকর্ডের সোলা ড্রাম পিসের মত আরো জোরে আরো তীব্র। বীভৎস, বুক স্তব্ধ করা।

প্রবীরের হাত কী উষ্ণ। কাঁপছে, প্রবীর তোমার হাত কাঁপছে।

ভয়ে নাসিমা উঠে দাঁড়াল, যেন কেউ তাকে জোর করে উঠিয়ে দিল আসন থেকে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল প্রবীর পাহাড়ের ঢালে গড়ানো একটা পাথরের মত। নাসিমা বন্ধ করতে পারল না তার কথা। যেন এ সমস্ত কথা সে নিজে উচ্চারণ করছে না; অন্য কেউ তার ভেতর থেকে করছে, তার কোনো হাত নেই।

—-এত ভয় পেয়েছিলাম সেদিন—-নাসিমা হাসতে চেষ্টা করল—-যে খাটের তলায় গিয়ে লুকিয়েছিলাম।

প্রবীর, তোমার চোখে আগুন।

প্রবীর তাকে দুহাতে বুকের পাথরে পিষে ফেলল।

না—-না—-প্রবীর।

 কিন্তু আমি কেন স্তব্ধ হতে পারছি না? আমি কেন বলে চলেছি—-বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরও বেরোইনি। এত ভয়।

প্রবীর ঠোঁট দিয়ে খুঁজলো তার ঠোঁট। আমি ঠোঁট সরিয়ে নেব, আমাকে কথা বলতে হবে। কথা—-কথা।

—-শেষে আব্বা আমাকে জোর করে টেনে বের করেছিলেন খাটের তলা থেকে। বলেছিলেন

প্রবীর তার বাঁ হাত দিয়ে ব্লাউজের মুক্তি খুঁজছে।

নাসিমা চিৎকার করে উঠলো এই প্রথম —- প্রবীর।

ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল তাকে। প্রবীরের মুখ অবাস্তব হয়ে উঠেছে। তাকে চিনতে পারলো না নাসিমা। আমি তোমাকে কোনদিন দেখিনি।

যান, চলে যান আপনি। আমার জন্যে কাউকে আর কষ্ট পেতে হবে না।

মিথ্যে, শুধু মিথ্যে।

পালাও, নাসিমা, পালাও।

এই স্তব্ধতা কি এক মৃত্যু থেকে আরেক জন্মের মধ্য–শূন্যতা?

নাসিমা অনেকক্ষণ ধরে গোসল করল। তবু যেন কণামাত্র মুছে ফেলতে পারল না প্রবীরের স্পর্শ।

.

চারদিন পরে হামেদ মারা গেল তার ঘুমে। তার মৃত্যু যে একটা মুক্তি এনে দিল নাসিমাকে। একমুহূর্তে সমস্ত ক্ষোভ আর ক্লেদ মুছে গেল আত্মা থেকে। আমার অনুতাপ নেই, প্রতীক্ষা নেই, আমি নির্মল একা। গোরস্তান থেকে ফিরে এসে হামেদের শূন্য বিছানায় বসলো সে। একটা মানুষ মরে গেলে তার কামরা সহসা এত বিশাল হয়ে যায় কেন?

শূন্যতা কেন স্পন্দিত হয়ে উঠতে চায় বারবার?

সেই বিশালতায় দাঁড়িয়ে নাসিমা মনে মনে উচ্চারণ করল, আমি তোমাকে করুণা করি, প্রবীর। এবারে আমি চলে যেতে পারি।

.

বেবি যখন এলো তখন ছটা বেজেছে। আর আকাশের পশ্চিমে নিবিড় একটা অন্ধকার ভায়োলেট হয়ে নেবে আসছে আস্তে আস্তে। তার পদপাত অনেকটা বেবির মত। প্রায় বোঝ। যায় না, কিন্তু অস্থির, একমুখী।

বেবি এসে বলল, দেরি করে ফেলোম। অনেকক্ষণ বসেছিলে?

ছিলাম। দেরি হলো কেন? তোমার জন্যে এখন অবধি চা খাইনি আমি।

বেবি একটু অপ্রতিভ হলো।

আর দেরি করবো না।

কোরো না। কক্ষনো কোরো না। কেউ বসে থাকলে তার কষ্ট হয় না?

হঠাৎ নাসিমা হেসে ফেলে—-ইস, আজ তোমাকে খুব করে বকতে ইচ্ছে করছে।

কেন?

কেন আবার? মানুষ বকে কেন? দোষ পেলেই বকে।

বেবি বাতাসের কাঁপনের মত মৃদু মৃদু হাসে। তার যেন কোনো সত্যি সত্যি ভয় নেই নাসিমার কাছ থেকে এখন, এই কথাটা বুঝতে পেরে দুহাতের তালু বাজাতে থাকে অস্পষ্ট করে। নাসিমা বলে, মতির মা চা নিয়ে আসুক, কেমন? না কি ঘরে খাবে?

ঘরের প্রসঙ্গে উঠতেই বেবির আগ্রহ যেন বিবর্ণ হয়ে যায়—-কেননা, বেবি যে আরজুর। স্বামীর ছাত্র ইউনিভার্সিটিতে, এই কথাটা মনে পড়ে গেছে হঠাৎ। কী একটা অপরাধবোধ সচকিত হয়ে ওঠে ভাবনায়। বলে, না, বারান্দাতেই ভালো। কী বলে?

যা বলো তুমি।

মতির মা চা আর নাশতা এনে রাখলো। নাসিমা ফেরার পথে কিছু শাদা সুগন্ধ ফুল মুঠো করে এনে বেবির হাতে দিল।

পকেটে রেখো। বাসায় ফিরে আমার কথা মনে পড়বে।

বেবি বলে নাকের কাছে ছুঁইয়ে, বেশ ঘ্রাণ। বলতে বলতে ওপর পকেটে রেখে দেয়। যোগ করে, আমার টেবিলে রাখবো।

তারপর দুজনে মুখোমুখি বসে চা খেতে থাকে।

চা খেয়ে বেরোয়।

প্রীতিতে মন আচ্ছন্ন হয়ে আসে নাসিমার। এতক্ষণ ধরে আরজুর আয়নার নগ্নতা আর শরীরের নামহীন সেই অস্বস্তিটা তাকে দগ্ধে দগ্ধে মারছিল। বাইরে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে তার আর চিহ্নমাত্র রইলো না।

রিকশার দোলায় বেবির শরীর ছুঁই ছুঁই হয় নাসিমার সঙ্গে। বেবি সঙ্কুচিত হয়ে এতটুকু হয়ে যায় যেন। মধুর লাগে নাসিমার। মুখে বলে, এত লাজুক তুমি!

কই না?

বদলে বেবি আরো সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে, রক্তিমাভা ছড়ায় সারা মুখে। অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায় না। কিন্তু নাসিমা জানে ওর মুখ এখন করতলের মত বক্তিম হয়ে উঠেছে। আরো একবার তার নাম ধরে ডাকে নাসিমা, বেবি, বেবি।

প্রায় ফিসফিস তার কণ্ঠস্বর।

কী, বলো না? বলবে কিছু?

না, এমনি।

বেবি আবার হাসলো। তেমনি কাঁপন তোলা ওর পুরনো মৃদু মৃদু হাসি। এক মুহূর্তের জন্যে নাসিমার ভালো লেগেছিল তার নাম ধরে ডাকতে নাম উচ্চারণের ভেতর দিয়ে এই নাম যার তাকে নিশ্চয় করে অনুভব করতে। হঠাৎ এক ঝলক তীব্রতার মতো নাসিমার মনে দ্রুত প্রবাহিত হয়ে গেল একটা অন্ধকার যে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আকাশের অনেক শূন্যতা থেকে কে যেন বলেছিল, ইজ দ্যাট ডাউন দেয়ার হোয়ার উই গো?

ইয়েস, ইয়েস।

মনের ভাবনাটা কখন অস্পষ্ট উচ্চারণ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে। বেবি উন্মুখ হয়ে তাকাল তার দিকে। বলল, কী?

এই অতল অন্ধকারে কি আমার যাত্রার শেষবিন্দু? না, আমি তো কিছু বলিনি। ইয়েস, ইয়েস। বেবি, আমি কিছু বলিনি তোমাকে কিছুই বলিনি।

তবু কেন এমন হবে আমার কণ্ঠের ওপর থাকবে না আমার কোনো শাসন? কেন আমার ভাবনাগুলো আপনা থেকেই বেছে নেবে বাইরে বেরুবার শরীর? উচ্চারিত হবে?

নাসিমা এইসব ভাবলো বেবির ছোট্ট প্রশ্নের পর। ব্ৰিত, ক্ষুদ্র বোধ করল নিজেকে। বলল, ঢাকায় এই প্রথম এলাম আমি।

জানি।

তোমাকে নিয়ে বেরুলাম শহরটা চিনবো বলে—- আর তুমি কিনা চুপ করে রইলে?

কই?

কথা বলো। এত অন্ধকার কেন, বেবি? আলো নেই, মানুষ নেই, একী রকম শহর?

এত বিনষ্ট মনে হলো শহরটাকে নাসিমার, রিকশা থেকে বাইরে দৃষ্টি করে বুকের ভেতর সে একটা দম আটকানো ব্যথা অনুভব করল। কেমন বিচ্ছিন্ন, উদ্বেগহীন, কম্পিত এই শহর। একটা কালির ফোঁটাকে মাইক্রোস্কোপের ভেতর দিয়ে দেখলে যেমন—-ইজ দ্যাট ডাউন দেয়ার? ওখানে? ওখানেই কি? আমি জানি না, নাসিমা ভাবলো; নাসিমা আরো ভাবলো, অথচ এখানেই।

বেবি বলল, এই পথটা আগে এত সরু ছিল! এখন যা দেখছ ঠিক তার আদ্ধেক। আর দুধারে পঞ্চাশ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলা সব দোকান। উনিশ শপঞ্চাশের পর এইসব হয়েছে। আরো হবে।

তাই নাকি?

শহরটা বাড়ছে। এত তাড়াতাড়ি বাড়ছে যে, সাতদিন আগে কোথায় কী ছিল মনে রাখা যায় না। এখানে, হ্যাঁ এখানেই হবে, সেই গাছটা ছিল—-একটা সিগারেটের দোকান, ওইখানে মাঠ আর ওধারে বোধহয় সিনেমা হলটা। কী জানি, ঠিক মনে পড়ছে না।

নাসিমা চোখ বুজঁলো। ভাবনাগুলো চোখের পাতার মতো নিঃশব্দে নেবে এলো। আমিও আর কিছু মনে রাখতে চাই না। কোনো স্মৃতি. কোনো সঞ্চয়, কিছু না। শুধু আমার শরীরে দাগ দেখে কেউ হয়ত কোনদিন মনে করতে চেষ্টা করবে– না!

আবার ফিরে এলো। আনিস, জওয়াদ, লাবু চা বাগান। ওরা কারা? হামেদ আমাকে বিশাল করে দিয়ে গেছে।

আনিস বলেছিল, আকাশের মত আমার মুখ। আমি কি অপূর্ণ থাকব? করাচির অপারেশন টেবিলে কি আমার শেষ মৃত্যু হয়ে গেছে? বেবি পাশে বসে উসখুস করেছিল, সেটা হঠাৎ চোখে পড়ল নাসিমার।

কিছু বলবে?

কোথায় যাবে তাই শুধোচ্ছিলাম।

কোথাও না। এমনি।

মনে মনে বলল, আমার নতুন জন্ম, নতুন শহর। তুমি আমার আনন্দ, তুমি আমার সুন্দর। মুখে হঠাৎ চঞ্চল হয়ে বলল, চল, এখানেই নেবে পড়ি। হাঁটব আজকে।

রিকশা থেকে নেবে বেবি পয়সা দিতে গেল কিন্তু নাসিমার জন্য সম্ভব হলো না। খুচরো পয়সা ফিরিয়ে নিতে নিতে তরলকণ্ঠে বলল, খুব বড়লোক হয়েছ, না? বাড়ি থেকে বুঝি পাঁচশ টাকা করে অ্যালাউন্স দিচ্ছে?

তবে কী!

বেবিও কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পরে যোগ করে, বাঁচালে আমাকে।

বাসা থেকে বেরুবার সময় অনেক খুঁজে–পেতে বেবি পনেরো টাকা পকেটে নিয়ে বেরিয়েছিল।

নাসিমা আচমকা প্রশ্ন করে, তুমি সিগারেট খাও, না?

কেন? মানে খাই তো।

ডেঁপো কোথাকার। আমার সমুখে বলতে লজ্জাও করলো না? আছে? না, কিনতে হবে? না থাকলে কিনে নাও।

বলতে বলতে নাসিমা ব্যাগ থেকে টাকা বার করলো।

.

বেবির সিগারেট ধরানো অনভ্যস্ত ভঙ্গিটি লক্ষ্য করে নাসিমা না হেসে পারলো না। বেবি ফস করে ঠোঁট থেকে সিগারেট নাবিয়ে শুধালো, হাসলে যে?

কদ্দিন হলো সিগারেট খাচ্ছো শুনি?

কেন?

শুধোচ্ছি।

বেবি তখন ভারী লজ্জা পেয়ে গেল। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দূরে সাইন আলোর দিকে। তাকিয়ে উত্তর করল, আগে খেতাম না। এই ইউনিভার্সিটিতে উঠে।

তাই বলো।

নাসিমার কণ্ঠের স্বচ্ছতা বেবিকে এমন করে স্পর্শ করে যে তখন তার মনে হয় সে একেবারে এতটুকু হয়ে গেছে। নিজেকে জোর করে দুপায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখবার চেষ্টাটা কেমন ব্যর্থ হয়ে যেতে থাকে। এমন কি খুব অস্পষ্ট করে একটা অভিমান গড়ে উঠতে থাকে তার বুকের ভেতরে। কিন্তু নাসিমার পরের কথা তার শ্রুতিতে এসে কাঁপন তোলার সঙ্গে সঙ্গে মনটা আবার প্রসন্ন হয়ে যায়।

নাসিমা বলছে, রাগ করলে নাকি?

না—-না।

ওরা তখন হাঁটতে থাকে রমনা পোস্টাফিসের সমুখ দিয়ে। কেমন আঁধার আঁধার, আর তারি ফাঁকে ফাঁকে মানুষ, টাঙ্গাইল যাবার বাস আর টিমটিমে লালচে আলো ফেরিদোকান থেকে। দীর্ঘ বাসগুলো যেন একেকটা অনুভূতির মত স্তব্ধ হয়ে আছে। তাদের হলুদ রঙ মৃতের মত পাণ্ডুর দেখাচ্ছে। আর গাছ। আর শাদা মসজিদটা শাদা।

নাসিমা বেবির ডান হাত তুলে নেয়। আঙুলে আঙুল ছুঁইয়ে হাঁটতে থাকে। আঙুলের উষ্ণ স্পর্শে নাসিমা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে, সে এই পৃথিবীর কঠিন মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। আছে, শুধু আছে এই বোধ তার এত প্রয়োজন।

আস্তে আস্তে আলোয় এসে পড়ে ওরা। একটা স্বচ্ছন্দ স্রোতোধারায় অনায়াসে যেন তারা প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে।

এই মুহূর্ত যে কত পবিত্র তা পৃথিবীর কেউ জানব না। নাসিমার মনে হয় জীবনে সমস্ত থুতু আর কাদার সাম্রাজ্য থেকে তার শুভনির্বাসন ঘটেছে। সে মুক্ত। অনুরাগে তার মন গান হয়ে উঠতে চাইলো।

বাঁদিকের ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে স্টেডিয়ামের দিকে মোড় নিল ওরা। এখানটায় এত আলো, এত কণ্ঠ যে নাসিমার মন বিশুদ্ধ রকমে চঞ্চল হয়ে ওঠে। বলে, বেবি, রোজ আমি এখানে আসব।

বেশতো। আমিও থাকবো।

থাকবে, থাকবে বৈকি।

সমুখে জুতোর দোকান পড়ল। বেবি দাঁড়িয়ে বলল, দাঁড়াও।

কেন? জুতো কিনবে?

না, এমনি। দেখব। শো কেসে দাঁড়িয়ে জুতো দেখতে তোমার ভালো লাগে না? আমার লাগে।

অদ্ভুত তোমার শখ।

কিন্তু নাসিমাও তার সঙ্গে সঙ্গে অনেকক্ষণ দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে।

তোমার কোনটা পছন্দ? এইটে?

দূর—-এত শৌখিন যে মনে হয় গালে বুলোবার জন্যে।

বলেই হেসে ফেলে।

তাহলে ওটা?

হ্যাঁ, ওটা, ওটা ভালো। কিনছ নাকি?

দেখছি।

কিনবে তো চলো না?

বলে নাসিমা একটু আমতা আমতা করে। বেবি, আমাকে তুমি বলতে পারো না? আমার কাছে চাইতে পারো না? একটা ব্যথা অনুভব করে নাসিমা। কেমন বিচ্ছিন্ন অসহায় মনে হয় নিজেকে।

যোগ করে, —-আমার কাছে কিন্তু টাকা আছে।

না, থাক।

তখন নাসিমা দ্বিগুণ মনোযোগ দিয়ে জুতো দেখতে থাকে সাজানো শো কেসে। আস্তে আস্তে তার মনে হতে থাকে কার্নিভালের নাগরদোলার মত জুতোগুলো যেন একটা বৃত্তপথ ধরে ঘুরছে—-উঠছে, নামছে। আবার উঠছে। খুব আস্তে, এত আস্তে যে চোখে দেখা যায় না রক্ত দিয়ে অনুভব করতে হয়। রক্তের ভেতর দোলা অনুভব করে নাসিমা আখতার। স্থির, আরো স্থির। দ্রুত, আরো দ্রুত। হঠাৎ এক সমযে চাবি ছেড়ে দেয়া স্প্রিংয়ের মত মুহূর্তে তার ভাবনার টানটান সরলরেখা শিথিল হয়ে আসে, ঝুলতে থাকে হাওয়ায় গুড়া শুকনো লতার মত। তখন জন্ম হয় নতুন ছবির। মনে হয়, জুতোগুলো এখন অই শোকেসে সাজানো আছে কারিগরের যন্ত্রে বানানো একটা নৈর্ব্যক্তিক চেহারা নিয়ে, মাপ নিয়ে। তারপর কেউ হয়ত তাকে কিনবে, আস্তে আস্তে তার পায়ের প্রতিরূপ সৃষ্টি হবে জুতোর শরীরে। তখন আর ঐ চেহারাটা থাকবে না, তখন হবে তার একমাত্র তার পৃথিবীর আর কারো নয়। তখন এই জুতোজোড়াকে আলাদা করে চেনা যাবে না।

কিন্তু কেন আমি ভাবলাম এ কথা? কতক্ষণ ধরে ভাবছিলাম? বেবি তখনো জুতো দেখছে—-এবারে মেয়েদের শো কেস। নাসিমা তাকে আড়চোখে দেখে নিল পলকে।—-এমনি করেই কি আমরা সবকিছুকে বদলে দিই? আরোপ করি আমাকে? আমার সৃষ্টি তুমি, আর তুমিও, আর এমন কি তুমিও। আমি যদি তোমাকে সৃষ্টি না করতাম তাহলে তুমি হতে। জন্মহীন একটা কুয়াশা মাত্র। আমার রূপ তোমাতে বলেই তুমি বাঁচো।

আমি তোমাকে আমার সুন্দর তৃষ্ণা দিয়ে সৃষ্টি করব, বেবি।

বেবি।

কী?

চলো যাই।

কোথায়?

মনে মনে কষ্ট ছড়িয়ে পড়ল নাসিমার।

আমি প্রশ্ন বুঝতে পারি না। যেখানে খুশি। বলেছি না, আমাকে তুমি শহর দেখাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *