সুঁচাদের বারোমাস্যা

সুঁচাদের বারোমাস্যা

অনেক ঘাট বাট পেরিয়ে সুচাঁদ উঠল এসে রায়চরে। রায়চরে ঝুলনের মেলা বসবে কাল। গত সনের আগের সন মন্বন্তর গেছে। যুদ্ধ নাকি চলছে এখনও। ঝাঁক বেঁধে ওড়ে হাওয়াই জাহাজ। কুরমিটোলায় মিলিটারির ভিড় কাটেনি আজও। তবু আশা ছিল, গত দু সনের থেকে এবছরের মেলা একটু জমবে। কিন্তু আকাশের গতিক ভাল নয়।

শেষ শ্রাবণে ঝুলন। আষাঢ়ের ঢল নেমেছিল একটু আগে আগেই। আকাশে ঘোর লেগেছে শ্রাবণের। ভারী ঘোর। বড় ঘটা। চিকচিক বিজলি হানছে যখন তখন। যেন আকাশ জুড়ে বাসুকীর নোলা ছোঁক ছোঁক করছে। চেটেপুটে নেবে জগৎ সংসারটা। গুরু গুরু গর্জন, কড়কড় ঝঙ্কার রোজ। হাট বাজারে কাজের মনকে অষ্টপ্রহর ডেকে ডেকে আকাশ তার ঘটা দেখাচ্ছে।

উত্তর-পশ্চিম দিকটা দেখতে দেখতে এসেছে সুচাঁদ। ওদিকে টঙ্গি, উত্তরে পুবলী, জয়দেবপুর, তারাগঞ্জ, চরসিন্দুর, সব ঘুরে, এঁকেবেঁকে এসে উঠেছে রায়চরে। বানার নদীতে জল নেমেছে আষাঢ়েই। পাটখেতের বুক ড়ুবেছে। বানারে যমুনার ঝাপটায় কালশিরা পড়েছে, ফুলেছে। কেঁপে উঠেছে বালু নদী, চাপ দিয়েছে বংশী। চাপ দেয়নি ঠিক। যমুনার যে অনেক গান! বাজিয়ে ফিরছে বংশী নদী। সুরের ডাক কী! তীব্র কান্নার নীল সুর শেষ পর্যন্ত বানারে মহাকান্নায় এসে তরতর করে নেমে গেছে দক্ষিণে। ওদিকে উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে, নালা বিলের তলায় তলায় সিঁদেল চোরের মতো মাথা গলিয়েছে ব্ৰহ্মপুত্ৰ। তারপর, নামো দক্ষিণে, আরও দক্ষিণে। বাঁকশাল, ঘোড়াশাল, জোড়াশালের কিনারে কিনারে নীচে মেঘবরণী লখ্যা। এর মধ্যেই পার-হারানী তীরহারানী তা-থৈ তা-থৈ। মহাসঙ্গম মেশামেশি করেছে মিশমিশে গাঢ় আকাশে।

রায়চরের গাঙ ফুলেছে। খানে খানে কাটাল। টানা স্রোতের বুকে হঠাৎ জল ঠেলে দাঁড়িয়েছে যেন উলটো স্রোত, সারি সারি, বাঁকা ঝকঝকে লম্বা হাঁসুয়ার মতো। টানা স্রোত মানে মানে ফণা গুটানো সাপের মতো পাশ দিয়ে গেছে বেঁকে। এর নাম কাটাল। সোজা টানে যে আসে ভেসে, তাকেই কাটে। দায়ের মতো নয় হঠাৎ থামিয়ে, টুপ করে টেনে নেয় তলায়।

নৌকাগুলিকে ঠিক জুত করতে পারে না। জলে যাদের কারবার, তেমন সবল সেয়ানা মানুষ হলেও একটু বেকায়দায় পড়ে। মেয়েমানুষের চুল আর শাড়ি পেলে হয় একবার। এক গরাস মাত্র। ঘুর্ণি অন্য জিনিস। লাট্টুর মতো পাক দিয়ে বোঁ করে টেনে নিয়ে যায় তলায়।

দেখতে দেখতে এসেছে সুচাঁদ। বুঝছে রায়চরের খালে আগেই লখ্যা ঝাঁপ দিয়েছে। এমনিতে বড় হাসির ছটা। হাসিতে ফেঁপে ফুলে কলকল চলচল, যেন ভারী পিরিতের ইশারা। সুচাঁদ মনে মনে নমস্কার করে বলেছে, আলো সব্বোনাশী, ঢলানি, আর ঢলাইস না।

পুবে বাতাসে গোলাপী নেশার আমেজ। মাঝে মাঝে খ্যাপা মাতালের চাপা গর্জন শোনা যায়। পুবের উঁচু ত্রিপুরা থেকে বাতাস ঢালুতে নেমে আসছে যেন জলের টানে টানে। সেই টানে বিজলি ঝলকানো আকাশটাও গড়িয়ে নেমে এসেছে এদিকে। নেমে এসেছে মুখে নিয়ে মেঘনার জল। উত্তর থেকে, থেকে থেকে আসছে ময়মনসিংহের টিলার বাতাস। নদী কংসের ক্রুদ্ধ শাসানি সেই বাতাসে। বাতাসে বাতাসে কাটাকাটি চলছে শুন্যে। তারপর জলে।

শুক্লপক্ষ যাচ্ছে। আগামী কাল পূর্ণিমা। কিন্তু এ কালি আকাশের কপালে কোনওদিন যে চাঁদ উঠেছিল, মনে হয় না। কোনওদিন উঠবে, সে ভরসাও নেই। শুধু বিদ্যুৎ আর নির্ঘাত বাজ।

তবু রায়চরের গাঙে নৌকা লেগেছে মন্দ নয়। মেঘনার চালাঘরও উঠেছে কিছু কিছু।

গাঙের জলের ছিটা মাথায় দিয়ে নেমে এল সুচাঁদ। জায়গার নাম রায়চর। শাসন করেন অকুলীন কায়স্থ দাশ মহাশয়েরা। ঝুলন তাদেরই।

কুচকুচে কালো সুচাঁদ। কালো শলুইয়ের মতো কোঁচকানো বাবরি। মা দুর্গার অসুরের মতো শরীর। খাঁটি নমঃশূদ্রের গঠন তার শরীরের। গোঁফদাড়ি কামানো মুখখানি মেয়েমানুষের মতো কোমল।

লাঠির ডগায় একটি বোঁচকা। একটু বড় বোঁচকা। বোঁচকার সঙ্গে একটি ছোট হ্যারিকেন ঝুলনো। খালি গায়ে, লাঠির ডগায় বোঁচকা কাঁধে নিয়ে এসে উঠল সুচাঁদ। দেখা করল দাশবাবুদের সঙ্গে বৈঠকখানায়।

পায়ে হাজা পড়েছে সুচাঁদের। প্রতিটি আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে, গোড়ালি আর পায়ের পাতা অবধি বাসি মাংসের মতো নীরক্ত সাদা-সাদা ঘা। মাঝে মাঝে ফাটল, জমাট রক্তের আভাস। গাঙের জলে ধোয়া কালো থ্যাবড়া পা দুটিতে আলতা পরার মতো শ্বেত প্রলেপ পড়েছে।

সুচাঁদ বলল, বাবু, এট্টুস আমার চরণ দুইখান দেইখা নাইরাল ত্যাল দেন।

এক বাবু বললেন, পাবি পাৰি। আক্কেবারে যে জলের পোকা হইয়া গেছসরে? সারা দ্যাশটা মইয়াইয়া আইলি নাকি?

সুচাঁদ হাত জোড় করে বলল, হ, তা-ই একরকম। উঁচান থেইখ্যা আইলাম। অদিকে ঢল নামছে মন্দ না কত্তা। চণ্ডাইলা নদী কংস যদি না বানে চ্যাতে, তা হইলেও, এইবার জলডা এট্টুস বেশিই হইব।

বাবুদের মুখও অন্ধকার। একজন বললেন, হ, হেইরকমই তো দেখি। মেলাডা এইবার তেমন জমব না মনে হইতেছে।

সুচাঁদ বলল, হ। তারপর হেসে বলল, তবে, ওই যে কইলেন না, জলের পোকা? খালি জলের পোকা না কত্তা, আমি পউষ্যা কালীর পাঁটাও। হাত পাও ফাটে শীত ঠাণ্ডার দিনেই। শুকাইতে জল আইয়া পড়ে। হাজা-ফাটা বারমাইস্যা। আমি আপনেগো পোকা আর পাঁটা।

বলে গড় করল আবার। বাবুরা হেসে উঠলেন হ্যা হ্যা করে। বললেন, যা যা হারামজাদা, যা, তর লগে বকতে পারি না।

সুচাঁদ কপালে হাত ঠেকিয়ে আবার বলল, আমি আপনেগো হারামজাদা। বলে ঘর পেরিয়ে চলে গেল পেছনের নির্জন বারান্দায়। বাবুরা সঙের মসকরায় হাসতে লাগলেন পেট ফুলিয়ে।

সুচাঁদ বাবুদের বাগান দেখে ফিসফিস করে বলল, হ, সোন্দর, বড় সোন্দর জমি, সোনার লাহান!..

সুচাঁদ নিজে, আরও নাবালের, দূর দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের নমঃশূদ্র ঘরের ছেলে। বাপের আমলে কোনওদিন নিজেদের জমি ছিল না। বারো বছর বয়সে ঢুকেছিল বজ্রহাটের মামুদ ফকিরের কৃষ্ণ-যাত্রার দলে। গলাখানি মন্দ ছিল না। শিখিয়ে দিলে ঢং-ঢাংও করতে পারত ভাল।

তারপর দিনকাল গেল খারাপ হয়ে। উঠে গেল যাত্রার দল। ততদিনে ভূঁইয়াদের দেওয়া চাকরান ভিটাখানিও গেছে। বাপ গেছে মরে। বোনটা চলে গেছে এক ডাকপিয়নের সঙ্গে। আর কেউ ছিল না।

মামুদ ফকিরের ভিটাতেই হল বাস। তাই বা কতদিন চলে। একদিন ফকিরের কাছ থেকে যাত্রার কিছু ছেঁড়া পোশাক নিয়ে দিল গায়ে। মুখে মাখল রং। দাঁড়াল গিয়ে বজ্রহাটের বাজারে।

সঙ আইছেরে বউরূপী আইছেরে, বলে লোকে ভিড় করল। পয়সাও উঠল কয়েকটা। সেই থেকে শুরু। সেই থেকে সুচাঁদ—চাইন্দা বইরূপী।

বারো থেকে কুড়ি পর্যন্ত গেছে যাত্রা। কুড়ি থেকে আজ বারো বছর সঙ। এইবার সাজতে বসতে হয় সুচাঁদকে। রায়চরে যা পয়সা পাওয়া যাবে, একদিনেই। কালকেই রওনা দিতে হবে নসীরপুর। নসীরপুর থেকে সোজা ঢাকা শহরে। জল নেই, কাদা নেই, খটখটে শুকনো রাস্তায় হেঁটে বেড়াবে কিছুদিন। হাজাফাটায় টান ধরবে একটু। তবে, গণ্ডগোল মূলে। শহরে বড় সঙের ভিড়। রোজই সঙ। পেটের মধ্যে কুকুর ডাকে।

সেখান থেকে ঘুরতে ঘুরতে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, সিরাজদিঘা, আবার বজ্ৰহাট। তারপর মেঘনার এপারে-ওপারে চক্কর দিয়ে ঠেলে উঠবে ওপরে পুব ঘেঁসে। উঠতে উঠতে ময়মনসিং থেকে আবার নামবে। নামতে নামতে আবার এই রায়চরে। তারপর নসীরপুর। নসীরপুর, নসীরপুর আর চাইন্দা, সোনার লাহান জমি না, এইবার নসীরপুর।

তাড়াতাড়ি বোঁচকা খুলল সে।

এখন সম্বল পাঁচ আনা পয়সা। পয়সা রেখে বসল জলের ঘটি নিয়ে পেছনের বারান্দায়। মান্ধাতার আমলের একখানি ক্ষুর নিয়ে শান দিল।

তারপর ঠ্যাং থেকে পায়ের পাতা অবধি লোম চাঁছল। দুই হাত চাঁছল, বুক চাঁছল, মুখের তো কথাই নেই।

বোঁচকা থেকে বের করল পরচুলা। প্রায় রাক্ষসীর চুল, কচুরিপানার শুকনো শিকড়ের মতো। তাও আবার তালুতে ন্যাকড়া বেরিয়ে পড়েছে। হাজায় দেওয়ার নারকেল তেল দিয়ে ভাঙা চিরুনিতে আঁচড়াল সেই চুল। কাগজের নরমুণ্ড আর ছোট ছোট হাড়ের মালা বের করল। সব আছে বোঁচকাটিতে। বগলে বাঁধল দুটি ন্যাকড়ার হাত।

তারপর নীল রঙের ল্যাঙট পরে, গায়ে মাখল নীল রং। কালোর উপরে সেই নীল রং জলস্থলের লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠল। সাদা খড়ির ত্রিনয়ন আর বগলে বাঁধা দুই ন্যাকড়ার হাত। মাথায় পরচুলা দিয়ে টিনের খাঁড়া নিয়ে, দাঁতে দাঁতে কামড়ে ধরল রাঙানো জিভ। একেবারে চতুর্ভুজ মা কালী।

ওদিকে রায়চরের গাঙ ফুলছে। তবু ভিড় হয়েছে মন্দ নয়। সারারাত্রি জল হয়েছে। সকাল থেকে পুবে সাওটা সোঁ সোঁ করছে! উঁচু থেকে গাছগাছালির মাথায় পা দিয়ে নেমেছে কিনা। সকলেই বলছে, দ্যাওয়ার কপালে আগুন।

তাকে দেখে লোকে। সে দেখে, দূরে, গাঙের জল আর পাটখেত। রায়চরের গাঙ নেই আর। লখ্যা লকলক করছে। তবে, এখনও রায়চরের দক্ষিণে, তিন হাত নীচে জল। কালীবেশী সুচাঁদ বলল মনে মনে, আলো সব্বোনাশী ঢলানি, এট্টুস থাম, নসীরপুরটা যাইতে দে।

আর নসীরপুর। বেলা শেষে, হাতের চেটো খুলে গুণে দেখল তেরো পয়সা সম্বল।

দেখে সবাই, হাততালি দেয়, দেয় না কিছু। নেই কিছু হবে কী! সোনার লাহান জমি কি আর দেবে? না, ধলা টুকটুকে একখানি বউ…।

আর চাইন্দা! খাইতে পাইলে শুইতে চাস! সত্যি, আবার বউয়ের কথাও ভাবে সে কোন সাহসে!

পরদিন সকালবেলা মিলিটারি সাহেব সেজে সঙ দেখাল। মেলায় ভারী হাসির ধুম। ওদিকে গাঙের কিনারে লেগেছে চার-মাল্লাই নৌকা। খবর নিয়ে জানল, পাট কাটতে যাচ্ছে সবাই নাবিতে। নাবির দেশে ড়ুবে ড়ুবে গাছের গোড়া কাটতে হয়। মজুরিটা একটু বেশি পাওয়া যায়। নাবিতে কোথায় যাবে? শুনল, সোনাইগঞ্জ।

সুচাঁদ বলল, হাবলী বিলের উত্তর দিক দিয়া যাইবা?

হ।

আমারে নামাইয়া দিয়া যাও তোমরা কুড়াইল। আমি যামু নসীরপুরের জন্মাষ্টমীর মেলায়।

নসীরপুর। আরে বাপ্পুইসরে! কুড়াইল থেকে চৌদ্দ মাইল নসীরপুর।

মাঝি বলল, তা যাইবা, চলো। দশটা পয়সা দিতে হইব। বলতে না বলতেই চাপা আর্তনাদ করে, পায়ে হাত দিয়ে সুচাঁদ বসে পড়ল, আরে বাপরে, বাপরে, বাপরে..

কী হইল, কী হইল? আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল সবাই।

সুচাঁদ হেসে বলল, সঙ। সঙ দেখামু, লইয়া যান মাঝি ভাই। দশ পয়সা নাই।

মাঝি আর পাটকাটারা হেসেই খুন। ডাক দিল, তাড়াতাড়ি চল।

বিদায় নিল সুচাঁদ। বোঁচকা আর হারিকেন নিল ঘাড়ে।

রায়চরের মেলায় রোজগার হয়েছে সোয়া সাত আনা। একখানি ছেঁড়া জামা, পুরনো ধুতি একখানা।

.

রায়চরের গাঙে লখ্যার জল এসেছে পশ্চিমদিক থেকে। গাঙ গেছে রায়চরে পুবদিক দিয়ে ঘুরে, এঁকেবেঁকে দক্ষিণে। চারমাল্লাই নৌকা ভাসল পশ্চিমে। গলুইয়ের মুখ রইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। ছেঁড়া পালে বুক দিয়ে পড়েছে উত্তর-পুবের পাহাড়ি সাওটা। মেঘের চেহারা এখন নিরীহ। মেঘ দলা পাকিয়ে এলিয়ে গড়িয়ে নীচে নামছে যেন নেশা করে। কেবল দূর উত্তরে বিকিয়ে উঠছে আকাশটা।

কিন্তু নৌকা ছুটল একটু বাঁয়ে চেপে, গোঁ ধরে।

নৌকার মধ্যে টোকা, হুঁকা, কাস্তে আর ছোট ছোট বোঁচকা অনেকগুলি। পাটকাটাদের গেরস্থালি। প্রত্যেকেরই সঙ্গে আছে হারিকেন, নয় তো লম্ফ, তলা-পোড়া হাড়ি। বোঁচকার মধ্যে আছে লুঙ্গি, নয় তো ধুতি, থালাবাটি-ঘটি, সব আছে। কুল্যে প্রায় পঁচিশ জন চলেছে পাট কাটতে।

দাঁড়িরা সব ছইয়ের ভিতরে বসেছে। সুচাঁদ রঙ্গ করল ঘণ্টাখানেক। তারপর ঘুরে ফিরে এল আবার জলের কথা। বংশীনদী যদি কালীগ্রাম ভাসায়, তবে সোনাইগঞ্জে পাট কাটা বড় বিপদ। থির জলে ড়ুবে কাটা এক কথা। সোঁতের জলে আর এক কথা। গাছের গোড়ায় হাঁসুয়ার পোঁচ দিতে না দিতে জল টেনে নিয়ে ফেলবে দূরে।

সুচাঁদ বলল, কেডা? বংশী? দশদিন আগে দেইখা আইছি। উনি তো কালী গেরামের পায়ে ধরছেন। অ্যাদ্দিনে সোনাইগঞ্জে কি আর টান যায় নাই? এইবার জলটা এট্টুস বেশি। চিন্তিত মুখে পাটকাটারা তাকিয়ে রইল দূরের দিকে। ভেসে গেছে দুপাশের মাঠগুলি। গ্রামে জল ঢুকেছে।

একজন বলল, জলের লাহান দেবী নাই। মাইনষে কয়, ভূত-পিরেত সব বাতাসে ঘোরে। কিন্তু জলের সঙ্গেই আসল অপদ্যাবতার বাস। ভাল কইরা ঠাওর কইরো, অনেক কিছু দেখবা।..

সুচাঁদ বলল, হ, আমার পাও দুইডারে তো খাইয়া ফেলাইছে, এই দেখ। বলে হাজা-ঘা পা দুটো দেখাল।

এটাও রঙ্গ ভেবে দুঃখের মধ্যে হাসল সবাই। হালমাঝি হাঁক দিল, কুড়াইল!

লাঠির ডগায় বোঁচকা। বোঁচকার সঙ্গে হ্যারিকেন। কাঁধে ঝুলিয়ে নামল সুচাঁদ। চলি তবে, আসি ভাই, আসছে বছর আইয়ো চাইন্দ, নানান কথার মধ্য বিদায় নিল সবাই। নৌকা এগুল।

দূরে হাবলীবিল দেখা যায়। বিল নয়, দশটা লখ্যা নদীর মুখ একত্র হয়েছে যেন। ওই বিল পার হয়ে সোজা পশ্চিমে গেলে, ডাঙায়-ডাঙায় দক্ষিণে যাওয়া যায়। কুল্যে চৌদ্দ মাইল, তা হলে নসীরপুর।

কিন্তু নৌকার ভাড়া নেই সুঁচাদের। আধসেরটাক চাল আছে এখন সম্বল। কুড়াইল তো উপোসীভূতের গ্রাম। বিলে মাছ ধরে খায়। একটা নৌকা নেই কারও ঘরে। মাটির গামলাতে চলাচল করে।

কুড়াইলের দক্ষিণ দিক দিয়ে চর-নিশিন্দা পার হওয়া যাবে। ডাইনে থাকবে হাবলীবিল। চরনিশিন্দায় চাষ হয়, বাস নেই। যা আছে, তাও খানে খানে, দূরে দূরে। উঁচুতে ধান, নিচুতে পাট। জায়গাটা একটু হাজা, বিলের ধার কিনা! বহুদূর, দুস্তর ছড়ানো জায়গা। তবে ডাঙা-পথ তো বটে। এখন একটু জল হয়েছে। কত আর। হাঁটু, নয় তো কোমর। তারপর হিজলবাগ। ঢাকা জেলার এইপারে জোয়ারের দেশে হিজলগাছ একটু কম। কিন্তু চরনিশিন্দার পর মাইল খানেক শুধু হিজলের সারি। হিজলবাগ আর একটু নীচে। সেখানেও বাস নেই। তারপর সোজাসুজি ইমলীপুর। তারপরে নসীরপুর। কুল্যে আট মাইল। না পৌঁছুতে পারলে হরিমটর। তা ছাড়া ঢাকা শহরে যেতেই হবে।

কুড়াইলের দক্ষিণপ্রান্তে চলে এল সে। দু-পাশে জল-ঘাসের সারি। মাঝখান দিয়ে জলের দাগ চলে গেছে এঁকেবেঁকে। ওইটি রাস্তা।

পা দিল সুচাঁদ। লোক দেখা যায় না একটাও। যা-ও আছে, বিলের ওদিকটায় মাছ ধরছে।

ছপ ছপ ছপ..হাঁটু জলে চলল সুচাঁদ।

আকাশজোড়া মেঘ নেমে আসছে এঁকেবেঁকে বিশাল বাসুকীর মতো। মাঝে মাঝে চেরা জিভের মতো বিদ্যুতের ঝিলিক। বাতাসে ওড়া ছাইয়ের মতো বৃষ্টিকণা, গায়ে লাগে না। আসতে না আসতেই হাওয়া। বাতাসে পাটপচা গন্ধ। তার মধ্যে বেশ আঁশটে আভাস। এদিকে পাট কাটবে ভাদ্র আশ্বিনে। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে ঘাসবনে। আর কোনও শব্দ নেই। শুধু ছপ ছপ..

ছপ ছপ কমে এল। জলটা কোমর ধরছে আস্তে আস্তে। পায়ের হাজাগুলি ভিজে উঠেছে এতক্ষণে। নীচের পাঁক ঢুকে জ্বালা ধরছে এবার। কচুরিপানা দেখা যায়। হঠাৎ দাঁড়াল সুচাঁদ। তীক্ষ্ণচোখ একদঙ্গল কচুরি পানার দিকে তাকাল। পানা সরছে আস্তে আস্তে দক্ষিণে। বলল, আরে লইখ্যা ঠসইক্যা এদিকেও চলছস?

অর্থাৎ হাবলীবিলের তলায় তলায় লখ্যা এসে পড়েছে। টান লেগেছে মাঠের জলেও। তবে মন্দের ভাল। জলটা বেশি না বেড়ে থাকলেই হয়। পা চলবে একটু তাড়াতাড়ি।

পাটখেত দেখা দিল। মাঝে মাঝে ধানখেত। খেতের ধারে ধারে মালীশালার বেড়া। লোকে বলে বাউতা শোলা, অর্থাৎ বেতো শোলা। খুব মোটা আর হালকা। ওই শোলাতে টোপর আর দুর্গার সাজ তৈরি হয়। খেতের মধ্যে পানা ঢুকবে, তাই বেড়া দিয়েছে।

হঠাৎ নজরে পড়ল, দরের একটা পাটখেতের ধার দিয়ে দিয়ে কে যেন যাচ্ছে। হাঁটছে না, বোধহয় চারীতে অর্থাৎ গামলায় ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। যাচ্ছে, কিন্তু যা মেঘের ভার, দেখাই যায় না। যেতে যেতে আড়াল পড়ে গেল আবার।

মনটা একটু খুশি হল সুচাঁদের। একলা নয়, লোক আছে তা হলে চরনিশিন্দার নিরালা সমুদ্রে। দেখা না হোক, আছে, এই তো যথেষ্ট।

আকাশের এ-পাশে ও-পাশে একটা আচমকা ফালা দিল যেন কেউ হাঁসুয়া দিয়ে। দুম করে শব্দ হল বাজের।

সুচাঁদ বলল, রইয়ো হে বউরূপী, চাইন্দা সঙ যায়।

ঘাস পার হয়ে এসেছে অনেকক্ষণ। এখন কলমি আর হিঞ্চে, মাঝখান দিয়ে জলের দাগ। কলমি, হিঞ্চে হেলে পড়েছে দক্ষিণে, টানটা ওই দিকে। জলের টান যেন বাড়ছে আস্তে আস্তে। ঘাড়ের বোঝা কাঁধ বদলাল সুচাঁদ।

সামনে বেতবন। বুক ড়ুবিয়ে মাথা ভাসিয়ে আছে উপরে। পুবের হাওয়ায় ভারী শনশন তুলেছে জলের বুকে। একটু ঘুরে যেতে হবে। বড় কাঁটা। সাপও এমন আশ্রয়টি জড়িয়ে-সড়িয়ে ভোগ করতে পারে না। কচুরিপানা আটকে আছে বেত-ঝোপের গায়ে।

নিমেষে একঝাঁক বৃষ্টি নেমে কাঁপ ধরিয়ে দিয়ে গেল। কিন্তু পায়ের ঘাগুলি যেন আগুনে পুড়ছে। মাঝে মাঝে সুড়সুড়ি লাগছে পাঁক ঢুকে। মনে হয় এবার পা দুটো তুলে, মাথা দিয়ে চলতে পারলে জুত হত।

জলটা বুক থেকে কোমরে ওঠা-নামা করছে। হাঁটু জল আর পাওয়া যাচ্ছে না। পেছনে চেয়ে দেখল কুড়াইল হারিয়ে গেছে ঘাসবন পাটখেতে।

আবার বেত-ঝোপ দু-পাশে। চারদিকেই। কেন, রাস্তা ভুল হল নাকি? নাকি সঙ দেখায়।

রাস্তা তো ভুল হয়নি। পা আটকাল কীসে! বেতগাছের শিকড় এক ঝোপ থেকে আর এক ঝোপে চলে গেছে। একই ঝাড়ের বংশ। খোঁচা লেগে একটি আঙুলে বোধহয় ছর ফুটে গেল। নসীরপুরের বাবুদের কাছে একটু তেল পাওয়া যাবে।

জলটা কিন্তু বড় পরিষ্কার। সাফ সাফ দেখা যায় নীচে, আশ-শেওড়ার বন আছে ড়ুবে।

বেতঝোপগুলি পার হয়েই, ছড়ানো মোতরা ঝোপ। কালো কালো ডাঁটা, বড় বড় পাতা মোতরার। ফুল ফুটেছে সাদা সাদা। জলে ড়ুবে গেছে ঝোপের গলা। মোতরার বাকল তুলে তৈরি হয় শীতলপাটি। বড় নাগিনীর ভিড় ওই ঝোপে। এখন অগতি নাগনাগিনীর গতি। অসহায় নাগ ছোবলায় আবার মোতরার বুকেই।

এক মুহূর্ত থমকাল সুচাঁদ। মোতরা ঝোপগুলি এড়ানো দরকার। গেল একটু উত্তর দিক দিয়ে। ঝোপঝাপ কম ওদিকটায়।

আবার দেখা। কে যায় গামলায় ভেসে। প্রায় ঝোপের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে যেন। সুচাঁদ হাসল একগাল, একবুক জলে দাঁড়িয়ে। গলার সুর ঢেলে হাঁক দিল, কোন সঙ যাও হে।

কোনও সাড়াশব্দ নেই। মাছ ধরছে নাকি নিঃশব্দে। কিন্তু এত দূরে। নাকি, কোনও পাকা বহুরূপী। হেসে উঠে আবার ডাক দিল, আবডাল দিয়া কে যান হে।

আরও খানিকটা এগিয়ে, থমকে দাঁড়াল সুচাঁদ। কে? পায়ের তলা থেকে মাথা অবশি বিদ্যুৎ খেলে গেল। যেটাকে গামলা ভেবেছিল সেটা একটা হাত দেড়েকের কলগাছের গুঁড়ির ভেলা। তার উপরে বসে আছে.. ওটা কী? শেয়াল!

হেসে ফেলল সুচাঁদ, আরে হালা বহুরূইপ্যা! চাইন্দা সঙের রূপ দেখাইতে আইছস।

শেয়ালটা ভয় পেয়ে ল্যাজটা প্রায় পেটের তলায় ঢোকাল। ভীত করুণ হলদে চোখে সুঁচাদের দিকে তাকাল। দাঁত বের করে, বড় করুণভাবে ডেকে উঠল কোঁক কোঁক করে। যেন বাড়ির পোষা কুকুরটা। ওদিকে টাল সামলাতে হচ্ছে টলমল ভেলায়।

সুচাঁদ যত এগুতে লাগল ভেলার দিকে, শেয়ালটা কুঁকড়ে কুঁকড়ে ছোট হতে লাগল। কিন্তু নামছে না। সুচাঁদ যে মারমুখী নয়, সেটা যেন বুঝেছে। একেবারে কাছে আসতে একটা ঠ্যাং জলে নামিয়ে, ঠিক কান্নার সুরে শেয়ালটা ক্যাঁকক্যাঁক করতে লাগল।

সুচাঁদ দেখল, ভেলাটার মধ্যে রক্ত। কয়েক ফালি রক্তাক্ত নেকড়া। এ বর্ষায় মড়া পোড়াবার ডাঙা থাকে না, ভাসিয়ে দেয় সবাই। বোধহয়, কোনও শিশুর মৃতদেহ ছিল এই ছোট্ট ভেলায়। লোভী শেয়াল খেতে খেতে ভেসে এসেছে, এখন অকুলে পড়েছে। সুচাঁদের মতো বুঝি। 

সুচাঁদ ফিরে তাকাল জানোয়ারটার দিকে। জানোয়ারটাও তার দিকেই চোখ পিটপিট করে তাকিয়েছিল। যেন পোষা জীবটি, কিছুই জানে না। জলে ভিজেছে, কাঁপছে থরথর করে।

সুচাঁদ বলল, প্যাটের জ্বালায় তুইও চাইন্দা সঙের মতো ঘর হারাইছসরে বহুরূইপ্যা। মাইনষের ছাও খাইছসরে হালা? তারপর জল আর ঝোপের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি যদি মরি, তাইলেও তর বড় ফলার হইব না? চল, কেউ যখন নাই, তর লগেই এট্টস কথা কইতে যাই, মরি তো, ভাল কইরা খাইস।

এগুল সুচাঁদ। একটু ফারাক দিয়ে শেয়ালটা ভাসতে ভাসতে চলল ভেলায়।

জলের টান দক্ষিণে, পথও দক্ষিণে। শেয়ালটার চোক সর্বক্ষণ তার দিকে। মাঝে মাঝে আড়াল পড়ছে নোতরা আর বেত ঝোপে। মনে মনে বলল সুচাঁদ, হালারে না লাগে কাটে।

সে প্রায় সস্নেহ গলায় খেঁকিয়ে উঠল, আরে ওই ঢ্যামনা সঙ, কোনদিকে দিয়া যাস, মোনসায় খাইব যে।

খ্যাঁকানি শুনে শেয়ালটার পাছাটা গুটিয়ে গেল। তাকাল অসহায় করুণ চোখে। একটু একটু দুলছে ভেলাটার তালে তালে।

সুচাঁদ ভেলাটায় হাত দিল। যেন পেটের ভিতর থেকে কঁকিয়ে উঠল শেয়ালটা।

উঃ, অ্যাক্কেবারে যে গেলি রে সঙ। বলে ভেলাটা সরিয়ে নিয়ে এল একটু মোতরা ঝোপের কাছ থেকে। সুচাঁদ বলল, বাপ্পু ইসরে, গোঁফ দেখি রায়চরের দাশবাবুর মতন? রায়চর থেইক্যা আসতেছেন নাকি?

শেয়ালটা ভয়ে ভয়ে পাছা পাতল। জল ঠেলার কষ্টটা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেল সুচাঁদ। বলল, শোন, ওর বায়চরের বাবুহো সঙ দেখাইয়া আইলাম, পয়সা দিছে চাইর আনা। আর ভালবাইসা কইছে, দূর হ হারামজাদা।

শেয়ালটা চোখ পিটপিট করে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল। সুচাঁদ বলল, হাসস নাকিরে? সঙ দেইখা? তবে বোঝ, রায়চরের এক নমঃর মাইয়া বুঁচি আবার আমার লগে পিরিত করতে চায়। মরণের লেইগ্যা। আঃ, সঙের পায়ে বড় হাজা হইতেছে রে! বাবুরা নাইরেল ত্যাল দিছিল, জ্বালা যায় না তবু।

জানোয়ারটা করুণ চোখে চেয়ে কাঁপতে লাগল। কিন্তু নজর ঠায় সুচাঁদের দিকে। সুচাঁদের মনে হল, সত্যি যেন কেউ আছে তার সঙ্গে। এই চরশিন্দার শ্বাপদসঙ্কুল জলজঙ্গলে মুখ খুলে গেল তার বলল, রায়চরে সঙ দেইখা আইছি। ক্যান, কালা চশমা চোখে দিয়া বাবুগো সামনে বইসা কইলাম, বাবু, বেশ সঙ দেখলাম। বাবু কইলেন, কইরে? বাবুরে দেখাইয়া কইলাম এই তো!

বলে হা হা করে হাসল সুচাঁদ। শেয়ালটা ভয়ে ডাক ছেড়ে দিল, খ্যাঁক খ্যাঁক।

আরে ব্যাটা, খুব যে হাসি!

সুচাঁদকে ঠেকতে হচ্ছে। এবার পায়ে পায়ে বাধা। পায়ের তলায় শাপলা আর কাইচলা।

এখন শুধু আঁশটে গন্ধ জলে। থেকে থেকে মোতরা ফুলের গন্ধ পাওয়া যায়। বড় শক্ত লতা কাইচলার। ডগায় ডগায় আবার নীল ফুলের বাহার। শালুক ফুল মুচড়ে গেছে দক্ষিণ দিকে।

শেয়ালটা একটু আগে আগে যাচ্ছে। ভাসছে কিনা। কাইচলার জটায় আটকাচ্ছে না পদে পদে। জলের নীচের অপদেবতারা যেন বাড়িয়েছে সহস্র হাত কে যায়? ধরে রাখ, ধরে রাখ।

সামনে হিজলবাগ। দিনের বেলায়ও ঘুটঘুট্টি অন্ধকার যেন। হিজলের মাথা ঠেকেছে মেঘে। মেঘে-হিজলে-জলে একাকার। পার হলেই ইমলীপুর।

হঠাৎ বুকে আলতো স্পর্শে ফিরে দেখল, বেশ একখানি হলদে পেট বড় জোঁক শুঁড় ঢুকিয়েছে। আরে সঙ! টেনে তোলা যায় না। কখন ধরেছে। বড় মিষ্টি চাইন্দার রক্ত, না। ছুড়ে ফেলল জোঁকটা দূরে। রক্ত পড়ছে, থামানো দায়।

লক্ষ পড়ল জলের দিকে। আরে বাপ্পু ইসরে। রক্তচোষার রাজত্ব যে! পরিষ্কার দেখা যায়, জলের নীচে বন। তার পাতায় পাতায়, পাতার মতো জোঁক। জলের টান, কিন্তু কামড়ে ধরে আছে। কিন্তু, মানুষের গন্ধ পায় বোধ হয়। সুচাঁদ দেখল, কুঁকড়ে কুঁকড়ে সব ভেসে আসছে তার দিকে।

সুচাঁদ তাড়াতাড়ি, জলের নীচে পায়ে হাত দিল। যা ভেবেছে। হাজা ঘা পেয়ে, গোটা তিনেকে ছেঁকে ধরেছে। টেনে টেনে তোলা যায় না। তাই বোধ হয় জ্বালাটা কম ছিল। অসাড় হয়ে গেছে তো। টেনে টেনে তুলল।

শেয়ালটার দিকে তাকিয়ে দেখল। নজরটা তার দিকেই। ওদিকে জোঁক ধরেছে ওর নাকের কাছে। রক্ত পড়ছে টপটপিয়ে। কিন্তু ভয়টা মানুষকেই বেশি।

সুচাঁদ হেসে বলল, আরে সঙ! জোঁকে তরেও খায়!

শেয়ালটা একটু ছোট হয়ে গেল কুঁকড়ে।

তারপরে হিজলবাগ। জলের তোড় বড় এখানে। চোখে দেখা যায় সব, কিন্তু অন্ধকার। বনস্পতি হিজলের ফাঁকে ফাঁকে কী জমাট বেঁধেছে মেঘ। পাখি-পাখালি কিছুই নেই। থাকবে কী করে। এখন নাগের বাস।

এখানে জল কোমরে। কিন্তু বড় টান। আপনি টেনে নিয়ে যায়। কলকল শব্দ। ছলছল করে গাছের গায়ে। আবার কাটালের নকশা করে।

শেয়ালটা ক্যাঁকক্যাঁক করছে। ভয় পেয়েছে জলের তোড়ে। ভেলা গিয়ে মাঝে মাঝে ধাক্কা দিচ্ছে গাছে। অসহায়, বেসামাল। চকিতে আড়াল হয় আবার দেখা যায়।

সুচাঁদ বলে, যা সঙ, ভাইস্যা যা, তরে লইখ্যা টানছে।

কিন্তু চোখাচোখি হতে বলল, ইস। একেবারে কোলের পোলার মতো চাইয়া রইছস দেখি? বলে, এগিয়ে ভেলাটা হাত দিয়ে গাছের ফাঁকে ফাঁকে এগিয়ে দিতে লাগল। জোঁকটা ফেলে দিল নাকের থেকে টেনে। শেয়ালটা কোঁ-কোঁ করে উঠল। একটু একটু করে কমে এল হিজলের ঠাসাঠাসি। ওই দেখা যায় ফাঁকে ফাঁকে, ইমলীপুর।

ইমলীপুর, তারপর নসীরপুর। পা দুটি জলে ভেজা ন্যাকড়া হয়ে গেছে। জোর নেই। ঘায়েও সাড় নেই। তবু জোর দিল সুচাঁদ! জোর, খুব জোর।

হিজলবাগ শেষ। আবার ঘাস কলমি-হিঞ্চে। হঠাৎ ঝপ করে শব্দ হল। সুচাঁদ দেখল, ঝাঁপ দিয়েছে শেয়ালটা। সাঁতরে চলেছে ইমলীপুরের দিকে! আরে সেয়ানা সঙ। পরান বড় সোনা! সুচাঁদের আগে আগে গেল।

সামনেই একটা ঝাঁকাল গাব গাছ। শেয়ালটার গতি ওই দিকেই। ও! এদিককারই বাসিন্দা বুঝি। দেখা গেল, গাব গাছের নীচে ছোট ছোট ঘাস, তবে ডাঙা। ইমলীপুরের ডাঙা।

শেয়ালটা ধরল গিয়ে গাব গাছ। সুচাঁদ তখনও হাত কুড়ি দূরে। ঠিক! মাটি দেখা যায়।

শেয়ালটা উঠে দাঁড়াল, একবার গা ঝাড়ল। নুলো দিয়ে নাক ঘষল, বোধ হয় জোঁকটা ফেলল। দেখল একবার সুচাঁদকে, তারপরে রওনা দিল।

সুচাঁদ বলল, চললি? চাইন্দারে মনে রাখিস।

কিন্তু একটু গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল শেয়ালটা। সুচাঁদও দূর জলেই দাঁড়াল। কী হল? শেয়ালটা পা তোলবার চেষ্টা করছে। পারছে না। টলছে, নড়ছে আর একটু একটু করে ড়ুবে যাচ্ছে।

ড়ুবছে! ও, প্যাঁক! অর্থাৎ পাঁক। মানুষ-ডোবা পাঁক কাদা! গোড়ালি উঁচু করে, মুখ তুলল সুচাঁদ। দেখল, পেট অবধি ড়ুবে গেছে, ডাকছে ক্যাঁক ক্যাঁক করে। তারপরে পিঠ ড়ুবল। মাথাটা বাকি।

আরে সঙ! তবে গেলি কেন। সুচাঁদ তো তোকে ওখানে গিয়ে বাঁচাতে পারবে না। শেয়ালটা কেঁউ কেঁউ করে ডেকে উঠল অসহায় কুকুর বাচ্চার মতো।

হঠাৎ সুচাঁদের বুকটা ফুলে উঠল। মুখটা ফিরিয়ে নিল। তা হলে! হ্যাঁ, ওই উত্তরদিক দিয়ে, ওই কৃষ্ণচূড়ার তলা দিয়ে ঢুকতে হবে।

কৃষ্ণচূড়ার তলায় এসে একবার ফিরে তাকাল সুচাঁদ। দেখা যায় না শেয়ালটাকে।

হালায় সঙ। মর, তর লেইগ্যা কেউ কান্দব না, কেউ না।

কিন্তু কালো মুখটা জলে ভাসছে। শেয়ালের জন্য নয়, সঙ্গীহারা হয়ে। মেলায় এসে দেখল, গায়ের লোমগুলি আবার বেড়েছে। ক্ষুর দিয়ে বসল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *