• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

ঢাকার খাওয়াদাওয়া – পবিত্র সরকার

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » প্রবন্ধ » ঢাকার খাওয়াদাওয়া – পবিত্র সরকার

পৃথিবীর অনাহারী-অর্ধাহারী মানুষের কাছে মাথা নিচু করে ক্ষমা চেয়ে এ লেখা লিখছি।
ঢাকায় খাওয়াদাওয়ার কথা মনে পড়লেই আমার—
১. পেট গুড়গুড় করতে শুরু করে,
২. মাথা ঝিমঝিম আরম্ভ হয়,
৩. বুকের ভেতরে হূৎপিণ্ড লাফাতে থাকে,
৪. চোখে আঁধার ঘনিয়ে আসে এবং
৫. অজ্ঞান হয়ে মাটিতে ঝুপ করে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়।
আমার যেসব বন্ধু কথায় কথায় আমার খুঁত ধরেন, তাঁরা বলবেন, আমি আসলে ঠিক করে কথা বলতেই শিখিনি, যেমন আরও অনেক কিছুই শিখিনি। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ব, না পড়ে অজ্ঞান হব, ঝুপ করে পড়ব, না পড়ে ঝুপ করব—এ রকম অনন্ত তর্ক তাঁরা এখনই শুরু করে দেবেন, যাতে ঢাকার খাওয়াদাওয়া সম্বন্ধে আর একটি কথাও আমি না বলতে পারি। কিন্তু জন্মের হিসাবে আমিও ঢাকাইয়া পোলা, আমারে দাবায়ে রাখতে পারে এমন ক্ষমতা তাঁদের নেই।
প্রথম শুরু হয়েছিল সেই ১৯৮৮ সালে, যেবার স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পা দিলাম বন্ধুবর জামিল চৌধুরীর আমন্ত্রণে। উঠেছিলাম অগ্রজ বন্ধু রফিকুল ইসলামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে। সেবারই প্রথম ওই কথাটার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তার পর থেকে কতবার যে ওই বাক্যটা শুনেছি, আর যতবার শুনেছি ততবারই সারা শরীর শিউরে উঠেছে এবং একই সঙ্গে শরীর ঘামতে শুরু করেছে।
পাঠকেরা, নিশ্চয়ই ভুরু কুঁচকে ভাবছেন, সে আবার এমন কী কথা, যা শুনলে একই সঙ্গে শরীর শিউরে ওঠে আবার ঘামতেও থাকে—এসব কথা না আছে শারীরতত্ত্বে, না আছে বৈষ্ণব রসতত্ত্বে। লোকটার বাজে বকার অভ্যাস গায়ের জোরে বন্ধ না করলে আর চলছে না দেখি।
না, কথাটা ভয়ংকর কিছু নয়। ঢাকার বন্ধুরা ভীষণ বন্ধুলোক, তাঁরা বুকের ওপর পিস্তল ধরে বা হাতে গ্রেনেড নিয়ে একটা কিছু সম্ভাষণ করবেন, সে সম্ভাবনা স্বপ্নেরও অতীত। তাঁরা শুধু বলেন, রফিকুল যেমন বলেছিলেন, ‘অহন ত কিসুই পাওয়া যায় না, কী খাওয়ামু আপনেগো?’ বলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভূগোলের একটা ভয়াবহ বিবরণ উপস্থিত করেন। নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, খালবিলও হয় শুকোচ্ছে, না-হয় কচুরিপানায় মজে যাচ্ছে, বৃষ্টিও তেমন হয় না, পদ্মা-মেঘনার মোহনায় ইলিশ মাছের কোটি কোটি তরুণ সন্তান পুষ্ট-পরিণত হওয়ার আগেই জেলেদের জালে ইহলীলা সাঙ্গ করে, তরিতরকারির ফলন কমে গেছে, মুরগি এবং পাঁঠারা বংশবৃদ্ধির দিকে তত নজর দিচ্ছে না, ভারত থেকে বিশেষ চতুষ্পদ জন্তু বিনা পাসপোর্ট-ভিসায় অবৈধ পথে বাংলাদেশে না ঢুকলে বাংলাদেশের মানুষ প্রোটিনের অভাবে মারা যাবেন, দেশি গরুরা দুধ উৎপাদন প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে, তাই অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা দুধেই শিশুরা বেঁচে আছে। তাই রফিকুলের গৃহিণী, এককালের স্বনামধন্যা গায়িকা জুবিলি আমাদের আতিথেয়তা কী দিয়ে করবেন, সেই ভেবে নাকের জলে, চোখের জলে অবস্থা। বারবার বলতে লাগলেন, বছর-কুড়ি আগে এলে কী আদর-আপ্যায়নই না করতে পারতেন তাঁরা, এখন শুধু অন্তহীন হাহুতাশ করা ছাড়া আর কোনো গতি নেই—বলে তাঁরা আমাদের টেবিলে নিয়ে গিয়ে বসালেন।
দেখলাম, তেমন কিছুই না, টেবিলে পাঁচ রকমের মাছ, তিন রকমের মাংস, সাদা ভাত (আমিষ ও নিরামিষ, পাঁচ রকমের ভর্তা, মাছ ভাজা, ডাল আর ইলিশের ঝোল দিয়ে খাবার জন্য), বিরিয়ানি, রাজশাহীর দই এবং বেশি নয়, মাত্র চার রকমের বিশাল সাইজের মিষ্টি সাজিয়ে দিয়েছেন।
এটা অস্বীকার করব না যে, আমি লোকটা তখনো একটু পেটুক গোছের ছিলাম, কিন্তু টেবিলে আয়োজন দেখে আমার মাথায় নিরবচ্ছিন্ন বজ্রপাত হতে লাগল। আমার স্ত্রী আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালেন যে, আমি যদি এর এক-চতুর্থাংশ পদে হাত দিই, তাহলে ঢাকা শহীদ মিনারের পাশে সেই কোয়ার্টারে সেই রাতেই তিনি আমাকে হত্যা করবেন।
ফলে সৌজন্য ও অসহায়তার মধ্যে একটা বিষম টাগ্ অব ওয়ার শুরু হলো। আমরা যত বলি, ক্ষমা করুন, পারব না, মরে যাব, দেশে ফিরতে পারব না—তত রফিক আর জুবিলি নিজেরা উঠে দাঁড়িয়ে চামচ দিয়ে বাটি থেকে পাতে ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করেন। চেঁচামেচি, হইহট্টগোল পার হয়ে ব্যাপারটা যখন প্রায় শারীরিক দ্বন্দ্বযুদ্ধের পর্যায়ে যাচ্ছে, এমন একটা অবস্থা যে, যেকোনো একটি দম্পতির বা দুটিরই মৃতদেহ মেঝেয় পড়ে যাবে, তখন রফিক আর জুবিলি খুব হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বলবেন, ‘যাঃ, তবে কার জন্য এসব করলাম। মেহমানরাই যদি পেটভরে না খান, তবে আল্লাহর কাছে কী জবাবদিহি করব?’ আমি বললাম, ‘আপনার সঙ্গে আমাকে নিয়ে যাবেন, আমি আল্লাহর পায়ের কাছে মাথা ঠুকে আপনার এবং আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নেব, কিন্তু আমাকে এত সব খেতে বলে শূদ্রহত্যার পাতক হবেন না।’
আমার উপকারী বন্ধুরা এ কথাটাতেও ঝাঁপিয়ে পড়ে বলবেন, ‘ব্যাটা কিছুই জানে না। শূদ্রহত্যায় আবার পাপ হয় কিরে হতভাগা? চিরকাল শুদ্দুরদের মুড়ি-মুড়কির মতো হত্যা করা হয়েছে, রামচন্দ্রের শম্বুক বধের গপ্পোও জানিস নে।’ আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে, পুরাণ না হয় জানিই না—কিন্তু সেদিন ব্রহ্মহত্যাও হতে পারত, কারণ আমার স্ত্রী বামুনের ঘরেই জন্মেছিলেন। এ সংবাদ শোনার পর উপকারী বন্ধুদের ব্যঙ্গ কীভাবে ঝলসে উঠবে তাও জানি, তাঁরা বলবেন, ‘তোকে বিয়ে করে তার জাতজন্ম কি আর আছে?’
‘অল্পস্বল্প’ যা খেয়েছিলাম তাতেই রফিককে পরদিন ওষুধের দোকানে দৌড়াতে হয়েছিল এবং জুবিলিকে মর্মান্তিক যাতনা ও অনুতাপ নিয়ে আমার জন্য পাতিলেবু-লেবু চটকানো দইভাতের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।

২.
সেই হলো শুরু। তার পর থেকে যতবার এ দেশে এসেছি, ততবারই ওই সব মারাত্মক ও নৃশংস আয়োজন আমাদের অভ্যর্থনা করেছে। ১৯৯৬ সালে এলাম বাংলা একাডেমীর একুশের গ্রন্থমেলা শেষের অনুষ্ঠানে, রবীন্দ্রভারতীয় নিরাপত্তা আধিকারিক মলিনচন্দ্র ঘোষের দাদা শান্তিনারায়ণ ঘোষ (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্সের অধ্যাপক, এখন মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার) টেবিলে বসিয়ে পুরো এক কড়াই গলদা চিংড়ি ভাজা সামনে ধরে দিলেন, তাতে ৪০ থেকে ৪৫টি চিংড়ি পরিপক্ব গেরুয়া রং নিয়ে হাতছানি দিচ্ছে। বললেন, অন্তত খানবিশেক যদি আমি না খাই, তাহলে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মর্মান্তিক যন্ত্রণা পাবেন, তাঁদের ইহকালের সমস্ত সুখ অন্তর্হিত হবে।
আমরা কি আর ওই প্রলোভনে পা দিই? তত দিনে জামিলের বাড়ি, নাসির উদ্দীন আর শিমূলের বাড়ি, আরও সব নানা বাড়িতে একই রকম আয়োজন ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে আমরা সেয়ানা হয়ে গেছি, আমাদের হূদয় পাষাণ হয়ে গেছে। নিষ্ঠুরতম কথা বলতেও আর মায়াদয়া করি না, করলে আমাদের প্রাণ রক্ষা করা দায় হবে।
তবু কি পুরোপুরি রক্ষা পেয়েছি! এই তো গত বছর, অধ্যাপক আহমদ শরীফের বাড়িতে ছোট ছেলে নেহাল করিমের আতিথ্য আমাদের যথেষ্ট কাবু করেছিল, আর বড় ছেলের ফ্ল্যাটে নেমন্তন্ন সেরে যখন এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম তখন আমার কাত হওয়ার মতো অবস্থা। ভাগ্যিস, হজরত শাহ জালাল এয়ারপোর্টের মেডিকেল সেন্টারের নার্স মেয়েটি ছিল। সে আমার অবস্থা বুঝে একটা কড়া ট্যাবলেট দিল, তার ফলে কোনো রকমে প্রাণ হাতে নিয়ে কলকাতায় ফিরতে পেরেছিলাম।

৩.
সেই থেকে সাবধান হয়ে গেছি। ‘অহন ত’ শুনলেই ভূতগ্রস্তের মতো লাফালাফি শুরু করি এবং প্রথমেই লোককে ঘাবড়ে দিই।
এখন হয়েছে কি, গত বছর আগস্ট থেকে ঢাকায় বেশ কয়েকবার আসা হলো প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ রচনার কাজে, গিন্নি কখনো সঙ্গে আসেন, কখনো আসেন না। তাতে কোনো অসুবিধা নেই, কারণ এর মধ্যে আমার রক্তে শর্করা ভালোই চাগান দিয়েছে, পেসমেকার বসেছে এবং একবার বদল হয়েছে, যেখানেই যাই সেখানে ইনসুলিনের বাক্স বরফ ব্যাগে মুড়ে বয়ে নিয়ে যেতে হয়, নিজেই সুচ ফুটিয়ে ইনসুলিন নিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব এক্সেলেন্সে রাজার হালে থাকি। সেখানে আমাদের অভিভাবক দীপু অর্থাৎ দিদারুল ইসলাম চমৎকার দেখাশোনা করে। সকালে শুকনো টোস্ট, রাতে রুটি এবং একটি পেঁপে-গাজর-লাউঘটিত ব্যক্তিত্বহীন সবজির ব্যবস্থা সে দিব্যি করে। চিকেন খেয়ে ক্লান্ত হলে সে প্রায়ই মাছেরও ব্যবস্থা করে।
বাংলা একাডেমীতে ডিজির পাশের কমিটি ঘরে আমাদের ব্যাকরণের কাজ চলে, সেখানেও ওয়াহাব আমাদের আর তার সহকর্মী রুমানা আর সায়েরা চমৎকার দেখাশোনা করে—ঘণ্টায় ঘণ্টায় চিনিবর্জিত চা, সকালে-বিকেলে নানা মুখরোচক জলখাবার ইত্যাদির আয়োজন থাকে। শিঙাড়া, চিকেন পাকোড়া, পুরি—সবই কনভেয়ার বেল্টের উৎপাদনের মতো ধারাবাহিকভাবে টেবিলে এসে পড়ে কর্মী স্বপনের পরিকল্পনায়। নিজের অবস্থা ভুলে সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে দ্বিধা করি না এবং শর্করা যা-ই হোক, কখনো তাতে প্রাণহানিকর অবস্থা হয় না। এবং প্রতিবারই দু-তিন কেজি ওজন বাড়িয়ে খুব অপরাধীর মতো দেশে ফিরি। দেশে ফিরলে সবাই বলে, দাদা কি এই বুড়ো বয়সে জলহস্তীকে ‘রোল মডেল’ করেছেন নাকি?
মুশকিল হয়, যখনই বিশেষ উপলক্ষে কারও না কারও বাড়িতে নেমন্তন্ন এসে পড়ে, কিংবা কোনো রেস্টুরেন্টে সবাই মিলে খেতে যাই।
নেমন্তন্ন থাকলে আগের রাতে এবং ব্রেকফাস্টে পরিকল্পিতভাবে কম খাই, যাতে চলমান খিদে নিয়ে আয়োজনের প্রতি সুবিচার করতে পারি। খিদে সুগার ভোলায়, প্রেসার ভোলায়, হূদযন্ত্র ভোলায় সেসব জানা আছে। আর যেটা আসল কথা, খিদে ভালো হজমও করায়।
খিদে প্রসঙ্গে পৃথিবীতে নানা গল্প আছে, খিদের গল্পই বোধ হয় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। একটি যেমন: এক সাধুর শিষ্য, সাধুর সঙ্গে থেকে দেখল, সাধু সকালে কিছু ছোলা ভিজিয়ে রাখে, কিন্তু সারা দিন কিছু খায় না। শিষ্য বেচারার খিদে পেয়ে যায়, সেও লজ্জায় খেতে পারে না। গুরু কিছু মুখে না দিলে সে বেচারা খায় কী করে? শেষে বিকেলবেলা খিদেয় অস্থির হয়ে সে গুরুকে জিজ্ঞেস করল, ‘গুরুজি, ইয়ে চনা আপ কব্ খায়েঙ্গে?’ গুরু শিষ্যের অবস্থা বুঝে স্মিতহাস্যে বললেন, ‘খাউঙ্গা বেটা, চনা যব জলেবি, বনেগা, তব খাউঙ্গা।’
শিষ্য তো চমৎকৃত! ছোলা জিলিপি হবে? নিশ্চয় গুরুজির অলৌকিক ক্ষমতা আছে, ভেজা ছোলা মন্ত্রবলে জিলিপি হবে। কী দারুণ ব্যাপার!
রাত দশটায় খিদেয় নেতিয়ে পড়া শিষ্যকে গুরু আদেশ করলেন, ‘চনা লাও।’
শিষ্য এক লাফে গিয়ে ছোলার বাটি নিয়ে এল। গুরু বললেন, ‘খা!’ বলে নিজেও একমুঠো তুলে নিলেন, একটু গুড় মাখিয়ে মুখে দিয়ে চিবুতে লাগলেন।
শিষ্য ভাবল, এ কী? গুরু ব্যাটা তো খুব ঠকাল। যা-ই হোক, খিদের মুখে গুড় দিয়ে মুখে দিল সেও। আহ্। ভিজে ছোলাই যেন অমৃতের মতো লাগছে।
গুরু মিটিমিটি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেয়া বেটা, চনা জলেবি বন্ চুকা কি নহি?’
শিষ্য বলল, ‘বন্ চুকা, গুরুদেব!’
তবে খিদে প্রসঙ্গে আমার শিক্ষাগুরু প্রমথনাথ বিশিও একটা গল্প বলেছিলেন খিদে নিয়ে। তাঁর সঙ্গে ব্যাকরণেরও একটু সম্পর্ক আছে—ঢাকায় এসে ব্যাকরণের বাইরে বেরোনো এক দুঃসাধ্য কর্ম, তাই সেটাও বলে নিই।
তিন ব্রাহ্মণ বেরিয়েছেন কাশী যাবেন বলে। বাংলার গ্রাম থেকে কাশী, বহু দূরের পথ। তিনজনের বয়স তিন পর্যায়ের—একজন মোটামুটি বৃদ্ধ, আরেকজন মধ্যবয়সী। তরুণও একজনকে সঙ্গে নিয়েছেন, সে পথে রান্নাবান্না সেবাযত্ন করবে। কিছুদূর হাঁটবেন, তারপর জায়গা খুঁজে বিশ্রাম আর খাওয়াদাওয়া করবেন, তারপরে আবার হাঁটা—রাতে পুরো বিশ্রাম—এই হলো রুটিন। কষ্টের পথ, তবু কাশীতে বিশ্বেশ্বর দর্শন—সেই পুণ্যে স্বর্গলাভ কোন্ বাপের ব্যাটা আটকায়। তাই কষ্ট করেও চলেছেন।
প্রথম দিনই ভয়ংকর রোদে ক্লান্ত হয়ে তাঁরা এক বনের মধ্যে এসে পৌঁছালেন। ছোট বন, খুব ভয়ের কিছু আছে বলে মনে হলো না। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণটি একটি গাছের ছায়ায় বসে বললেন, ‘আর পারছিনে বাপু। এখানেই উনুন করে চারটি ভাত বসিয়ে দাও। সঙ্গে অপক্ব কদলী আর ঘৃত আছে, পাশেই পুষ্করণীও দেখছি—স্নান করে আসি, ভোজন করে বিশ্রাম করব, রোদ একটু পড়লে আবার হাঁটা দেব।’ বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের কথামতো তরুণ যুবকটি পুকুর থেকে কাদা তুলে মাটির তাল বসিয়ে একটা উনুন তৈরি করে ফেলল, কাঠটাঠ এনে উনুন ধরিয়ে মাটির হাঁড়িতে ভাত বসিয়ে দিল কাঁচকলা সেদ্ধ দিয়ে। তারপর তিনজনেই চান করতে গেল পুকুরে।
চান সেরে ফিরে এসে দেখে যুবকটি এর মধ্যে মাটির হাঁড়ির ঢাকনা খুলে রেখে গিয়েছিল, ভাত ফুটে কাঁচকলা-টাচকলাসুদ্ধ চমৎকার সেদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু কী সর্বনাশ! কাঁচকলার পাশে ওটা কী? সবাই দেখে একটা অচেনা ফল কাঁচকলার সঙ্গে সেদ্ধ হয়েছে। সবাই ওপরে তাকিয়ে দেখল গাছে ওই ফল অজস্র ঝুলছে, তারই একটা হাঁড়ির মধ্যে পড়ে গেছে কখন।
তখন তিন ব্রাহ্মণে তুমুল তর্ক বেধে গেল। এ ভাত খাওয়া যাবে কি যাবে না। অন্য কিছু ফলও পড়ে ছিল আশপাশে, সেগুলো দেখে খুব বিপজ্জনক বা বিষাক্ত মনে হলো না। কারণ, দেখা গেল গাছে পাখি আসছে সেই ফল খেতে। তবু না-জানা ফল, অশুদ্ধ অবস্থায় ভাতে পড়েছে, খেলে হয়তো কাশীযাত্রার পুণ্য সব ফুস করে উবে যাবে। তর্ক চলতেই থাকল। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের খিদে পেয়েছে, তিনি যত বোঝাতে লাগলেন যে, বিষাক্ত নয় যখন ফল, এ ভাত খাওয়াই যায়, কিন্তু যুবক এবং মধ্যবয়সী পাপের ভয়ে নানা রকম যুক্তি তুলতে লাগল।
খিদেতে বৃদ্ধ একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তার ওপর এই তর্ক! শেষে আর থাকতে না পেরে রাগে জ্বলে উঠে বললেন, ‘দেখ, আমি বলছি এ ভাত খাওয়া যায়! যদি তোরা এ ভাত ফেলিস তো আমি তোদের পৈতে ছিঁড়ে অভিশাপ দেব।’
এই দুর্ধর্ষ ভীতি প্রদর্শনে বাকি দুজন একটু দমে গেল। কিন্তু তরুণ যুবকটির মাথা গরম। সে বলল, ‘খেতে চান ভাত, সে বুঝলাম। কিন্তু খাবেন কোন নিয়মে? বিশেষত একটা অশুদ্ধ ফল যখন তাতে পড়ে সেদ্ধ হয়েছে!’
বৃদ্ধ বললেন, ‘ওইটাই তো নিয়ম!’
যুবক অবাক হয়ে বলল, ‘কী নিয়ম?’
বৃদ্ধ বললেন, ‘কেন? নিপাতনে সিদ্ধ!’

৪.
আমারও এখন বয়স হয়েছে, তাই খাওয়ার ব্যাপারে এখন সব সময়েই নিপাতনে সিদ্ধ নিয়ম মেনে চলি। আগের রাতে, সেদিনকার সকালে স্বল্পাহার করি, তারপর রফিক ভাইয়ের উত্তরার বাড়িতে গিয়ে মৌরলা, ইলিশ, কাতলা, চট্টগ্রামের রূপচাঁদার শুঁটকি, মুরগি, পাঁঠা এবং বৃহত্তর জীবের মাংস, নানা ধরনের ভাজা, ভাজি, ভর্তা, দই ইত্যাদি খেয়ে জীবন সার্থক করি। কোনো দিন জামান ভাইয়ের (বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান) বাড়িতে এই রকম চতুর্দশ পদ খাওয়া হয়, মনে হয় পৃথিবীতে জন্মে এবং ঘন ঘন ঢাকায় এসে একটা বেশ ভালো কাজ করছি, আমার চতুর্দশ পুরুষ স্বর্গ থেকে আমাকে দুহাতে আশীর্বাদ করছেন। হয়তো বলছেন, ‘ধন্যিরে ব্যাটা ধন্যি! আমরা আমাদের চৌদ্দপুরুষে যা করে উঠতে পারিনি, তুই একার জীবনে তা করে উঠলি। চালিয়ে যা! তবে পকেটে ডাইজিন রিফ্লাকস জেলুসিল পুদিনহরা এসব রেখেছিস তো?’
আমি তাঁদের অভয় দিয়ে বলি, ‘সে আর বলতে, দাদুগণ! সেই ১৯৮৮ থেকেই তো আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। আমার সাইডব্যাগে সেসবের ভর্তি স্টক থাকে। ইউনি-এনজাইমও থাকে।’
চৌদ্দপুরুষ বলেন, ‘তবে লড়ে যাও। ইনসুলিন তো নিচ্ছই!’ দরকার হলে ডোজ বাড়িয়ে দিয়ো। তুমি আমাদের বংশের কুলতিলক, তোমার চাঁদমুখ দর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি।’
শেষের কথাটা আমার তত ভালো না লাগলেও কী আর করব। চৌদ্দপুরুষ বলে কথা।

রেস্টুরেন্টে যাওয়ার ব্যাপারে এখানকার অভিধানে একটা নতুন শব্দ শিখলাম। ‘ওখানকার খাবারে খুব “মজা” আছে!’ ‘মজা’ কী রে ভাই? না, ভালো খাবার, স্বাদের খাবারকে এরা বলে ‘মজা’র খাবার। বেশ, বেশ! বাংলা ভাষার ক্ষমতা কত বাড়ছে।
কিন্তু সেদিন ‘নীরব’ না কী নামের একটা হোটেলে যাওয়ার কথা উঠল। সেখানে নাকি দারুণ বাঙালি খাবার পাওয়া যায়। কিন্তু অভিধানকার স্বরোচিষ হঠাৎ বলে বসল, ‘শুনেছি হোটেলটার নাম ন-এ হ্রস্ব ই-কার দিয়ে, তাহলে সেখানে আমরা যাই কী করে ব্যাকরণ লিখতে লিখতে?’
সবাই তো শুনে হতবাক। বলে কী রে? এ তো আরেক নিপাতনে সিদ্ধর ঝামেলা। এত নামী হোটেল, দারুণ সব খাবার, ডজন ডজন ভর্তা থেকে শুরু করে মাছ, মাংস এমনকি অভাবিত সেটের আইটেম, তোমার থালার চারপাশে প্লেটের সভা বসে যাবে, আর তুমি কিনা নীরব-এ দীর্ঘ ঈ-কার নেই বলে গাঁইগুঁই করছ? তুমি জানো, সেখানে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে বসতে পাওয়া অসম্ভব, কেউ কেউ ঝাড়া এক ঘণ্টাও দাঁড়িয়ে থাকে, নেমন্তন্ন-বাড়ির মতো খেতে-থাকা লোকগুলোর চেয়ারের পেছনে শকুনের মতো খাড়া থাকতে হয়, পেছন থেকে ওদের কলার ধরে তুলে দেওয়ার হিংস্র ইচ্ছে নিয়ে, ওরা উঠলেই চেয়ারে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবাই—রসনার সেই দিব্যধামে তুমি দীর্ঘ ঈ-কার দেখাচ্ছ? সাধে কি মাঝে মাঝে হুজুগ ওঠে যে, বাংলা বর্ণমালা থেকে দীর্ঘ ঈ-কে তাড়িয়ে দেওয়া হোক!
আমাদের সমবেত আক্রমণে স্বরোচিষ আর বেশি কথা বলতে পারল না। কিন্তু বোঝাই গেল যে, সে খুব আপত্তি, প্রতিবাদ আর বিরক্তি নিয়ে খাজা নাজিমুদ্দীন রোডের সেই রেস্টুরেন্টে গেল সবার সঙ্গে, নিছক যৌথতার নিয়ম মেনে ‘আন্ডার ডিউরেস’ যাকে বলে, অভিধান আর ব্যাকরণের নিয়ম ভেঙে।
আমরা যখন প্রায় ২২-২৩ পদ পরম তৃপ্তিতে খেয়ে ফিরছি, তখন মাহবুবুল, যে স্বরোচিষের পাশে বসেছিল, বলল, ‘স্বরোচিষও বেশ ভালোই খেয়েছে।’
আহ্, আমাদের তৃপ্তির ষোলোকলা পূর্ণ হলো। একটা দীর্ঘ ঈ-কারের জন্য সব মাটি হয়েছিল আরকি।

পবিত্র সরকার: নাট্যজন। দীর্ঘদিন নান্দীকার নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সম্পাদনা করেছেন পাক্ষিক থিয়েটার পত্রিকা (১৯৬৬-৬৭)। নাটক ও অন্যান্য বিষয়ের বহু গ্রন্থের রচয়িতা। সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১২, ২০১১

Category: প্রবন্ধTag: পবিত্র সরকার
Previous Post:টাপ্পাস কি টুপ্পুস করিয়া – মুস্তাফা জামান আব্বাসী
Next Post:আমি মৃত্যুর পরও বাঁচতে চাই—মুর্তজা বশীর

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑