০৪. সুখময় মল্লিক যখন নীচের পারলারে

সুখময় মল্লিক যখন নীচের পারলারে বসে সকলের জবানবন্দি নিচ্ছেন—কিরীটী সেখানে গিয়ে উপস্থিত।

মল্লিকের সঙ্গে কিরীটীর পূর্বপরিচয় ছিল। কিরীটীকে আসতে দেখে ঐ সময় মল্লিক একটু যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই শুধায়, কি ব্যাপার মিঃ রায়, আপনি?  

কিরীটী বলে, কাল রাত দশটা নাগাদ মিঃ সাহা আমাকে ফোন করেছিলেন আজ সকালে আটটা নাগাদ একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য।

কেন বলুন তো? মল্লিক যেন একটু বিস্ময়ের সঙ্গেই প্রশ্ন করেন।

কি একটা জরুরী ব্যাপারে তিনি আমার সাহায্য চান বলেছিলেন।

কি জরুরী ব্যাপার, কিছু বলেন নি আপনাকে?

 না, তা অবিশ্যি কিছু ফোনে বলেন নি। কিন্তু আপনি এখানে—কি ব্যাপার বলুন তো সুখময়বাবু?

কিরীটীর জ্ঞাতার্থে সুখময় মল্লিক তখন গতরাত্রের সমস্ত ব্যাপারটা বিবৃত করেন।

সব শুনে কিরীটী তো একেবারে বোবা। বলে, সে কি! তিনি মৃত? হ্যাঁ।

খুব সম্ভবতঃ সুইসাইড বলে মনে হচ্ছে।

সুইসাইড!

হ্যাঁ, সেই রকম মনে হচ্ছে।

হুঁ, তা মৃতদেহ কোথায়?

ওপরে তাঁর শোবার ঘরে।

মৃতদেহটা আমি একবার দেখতে পারি?

নিশ্চয়ই। চলুন না।

আর কালবিলম্ব না করে কিরীটী সুখময় মল্লিকের সঙ্গে দ্বিতলে যায় এবং যে ঘরের মধ্যে তখনও সোফার উপরে মৃতদেহটা ছিল সেই ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে।

মৃতদহের ভঙ্গীটাই যেন প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিরীটীর।

মৃতদেহের ভঙ্গী দেখলে মনে হয় যেন মৃত্যুর কারণটাই যাই হোক না কেন, ঐ ভাবে চেয়ারের উপরে বসে বসে তাঁর মৃত্যু হয়নি।

মৃত্যুর পরে কেউ ব্রজদুলালকে ঐভাবে সোফাটার উপরে বসিয়ে দিয়েছে যেন।

মৃতের দুচোখে আতঙ্ক নয়, যেন এখনও বিস্ময়ের আকস্মিকতা স্পষ্ট হয়ে আছে।

কিরীটীর দিকে তাকিয়ে মল্লিক প্রশ্ন করে, কি মনে হচ্ছে আপনার মিঃ রায়?

আমার কিন্তু সেরকম মনে হচ্ছে না মিঃ মল্লিক। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বলে।

মনে হচ্ছে না?

না।

তবে?

কি জানি কেন মনে হচ্ছে, দেহের ভঙ্গী যেন ঠিক আত্মহত্যা নয়। তাছাড়া কোন তীব্র বিষের ক্রিয়াতেই যদি আকস্মিক মৃত্যু ঘটে থাকে, মৃত্যু মুহূর্তের বিক্ষেপ ও কুঞ্চনের কোন চিহ্নই তো মৃতের দেহে দেখা যাচ্ছে না।

কথা বলে পুনরায় কিরীটী প্রখর দৃষ্টি নিয়ে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে থাকে আরও কিছুক্ষণ।

দেখতে দেখতেই তার নজরে পড়ে মৃতের ঝুলন্ত ডান হাতের তর্জনীর দিকে। তর্জনীর মাথায় কালো একটা দাগ।

এগিয়ে গিয়ে মৃতের মুখটাও একবার তুলে দেখল। ঘাড়টা শক্ত হয়ে রয়েছে।

বুঝতে পারে কিরীটী, মৃতদেহে রাইগার মটিস সেটু ইন করেছে ইতিপূর্বেই।

তারপর তর্জনীর মাথার ছোট কালো দাগটিও বেশ কিছুক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল।

মিঃ মল্লিক কিরীটীকে লক্ষ্য করতে থাকেন নিঃশব্দে।

এবারে ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগল কিরীটী।

বেশ বড় সাইজের ঘর। চারিদিকে বড় বড় জানলা। দক্ষিণে একটিমাত্র জানলার কবাট ব্যতীত সব বন্ধ। এবং সব জানলাতেই পর্দা টানা। রুচি আভিজাত্য ও প্রাচুর্যের চিহ্ন—যা কিছু ঘরের মধ্যে আছে সবকিছুর মধ্যেই যেন বিরাজ করছে। একধারে কোণাকুনি একটি সিঙ্গল বেড।

মাথার ধারে ত্রিপয়ের উপরে ঈষৎ নীলাভ রংয়ের ফোন।

অন্যদিকে একদিকে একটি গডরেজের স্টীলের প্রমাণ সাইজের আলমারি, তার পাশেই দেওয়ালের মধ্যে গাঁথা একটি লোহার সে।

আর এক পাশে একটি কাচের ছোট আলমারি। তার মধ্যে কিছু ফরেন লিকারের বোতল ও কাচের গ্লাস ইত্যাদি সাজানো। এবং ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় সুদৃশ্য মাঝারি সাইজের একটি সোফা সেট।

আর কোন আসবাবপত্র নেই ঘরের মধ্যে। মেঝেতে দামী পুরু কাশ্মীরী কার্পেট বিস্তৃত। ঘরের মধ্যে দুটি দরজা।  

একটি দরজা খোলাই ছিল। অন্য দরজাটি পাশের ঘরে যোগাযোগ রেখেছে। সেটা এ-ঘর থেকে বন্ধ। দুটি দরজায়ই ইয়েল লক লাগানো।

ঘরের সংলগ্ন বাথরুমও আছে। বাথরুমের দরজাটা ভেজানোই ছিল। বাথরুমের ভিতরে। গিয়েও একবার ঘুরে এল কিরীটী।

ফিরে এসে ঘরে ঢুকে আবার যেখানে সোফার উপরে মৃতদেহ ছিল সেখানে এসে দাঁড়াল।  

সামনে ত্রিপয়ের উপরৈ টেবিল-ল্যাম্পটা তখনও জ্বলছিল।

নতুন ঝকঝকে দামী একটা টেবিল ল্যাম্প। প্লাগ পয়েন্টের সঙ্গে লাগানে! ল্যাম্পটা। ল্যাম্পের সঙ্গে যে সুইচ সেটা টিপে আলোটা নিভিয়ে দিল কিরীটী।

তারপরই হঠাৎ সুখময় মল্লিকের দিকে তাকিয়ে বললে কিরীটী, সব চাইতে পুরনো চাকর এ-বাড়িতে কে মিঃ মল্লিক?

জীবন।

তাকে একবার ডাকতে পারেন এ-ঘরে?

এখুনি ডাকছি। সুখময় ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।