যাদুমণি (১৮৫৩? — ১৯১৮)। কণ্ঠসঙ্গীতে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী, বাঙলার নাটমঞ্চে প্রথম যুগের নায়িকা-অভিনেত্রী যাদুমণি একসময়ে বাঙালী বাঈশ্রেণীর মধ্যে সুপরিচিত ছিলেন। পাথুরিয়াঘাটার শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়িতে তাঁর মা কাজ করতেন। বালিকা যাদুমণির গানের প্রতি আগ্ৰহ দেখে শৌরীন্দ্রমোহন বিখ্যাত ধ্রুপদী গুরুপ্ৰসাদ মিশ্রেীর কাছে তাঁর গান শেখার ব্যবস্থা করে দেন। তাঁর কিছুটা পরিণত বয়সের সঙ্গীত-গুরু জগদীশ মিশ্র ছিলেন একাধারে ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা ও ঠুংরীর একজন শ্রেষ্ঠ গায়ক, উপরন্তু নৃত্যবিৎ। যাদুমণি তাঁর কাছে গানের সঙ্গে নৃত্যও শিক্ষা করেন। জগদীশ মিশ্রেীর কাছে শিক্ষার অনেক আগেই রঙ্গমঞ্চে তিনি গায়িকা হিসাবে খ্যাতিলাভ করেন। গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রথম পাঁচজন অভিনেত্রীর মধ্যে তাঁকে নেওয়া হয়েছিল গায়িকা হিসাবে। এই থিয়েটারে ১৯-৯-১৮৭৪ খ্রী. ‘সতী কি কলঙ্কিনী’ নাটকে প্ৰথম অভিনয় করেন। তখন তাঁর বয়স ২০/২২ বছর। তাঁর শেষ নাটকাভিনয় শরৎসরোজিনী সম্বন্ধে ১৭-৮-১৮৭৫ তারিখের ইংলিশম্যান পত্রিকা লেখে, ‘The songstress Jadumani deserves praise’। এরপর তাঁর আর কোনও অভিনয়ের বিবরণ পাওয়া যায় না। সঙ্গীতের আসরেই তাঁর খ্যাতি বিশেষভাবে ছড়িয়ে পড়ে। খেয়াল, টপ্পা, ঠুংরি–তিন অঙ্গেই তিনি সুগায়িকা; নাচেও তাঁর অধিকার ছিল। সেকালের আসরে বাঙালী নারীশিল্পী প্ৰায় দুর্লভ ছিল। তাই সঙ্গীতামোদী ও বিলাসী সমাজে তাঁর অসাধারণ নাম-ডাক হয়। পশ্চিমের কোনো কোনো রাজদরবারেও সঙ্গীত পরিবেশন করে যশঃ ও অর্থ নিয়ে ফিরেছেন। নটী জীবনের সেই উচ্ছসিত মধ্য-পর্ব হঠাৎ এক রাত্রের বিপর্যয়ে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে যায়। চোর তাঁর অলঙ্কারাদি সব চুরি করে নিয়ে যাওয়ায় সম্ভবতঃ তিনি আসরে গান গাওয়া ছেড়ে দেন। ফলে লোকের মন থেকেও অল্পদিনেই হারিয়ে গেলেন। বহু বছর পর এক বৃদ্ধ ভিখারিণীর গান শুনে নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ডেকে কথাবার্তা বলে জানতে পারেন তিনি সেই যাদুমণি। এককালের ধনী যশস্বিনী যাদুমণির এমন অবস্থা কি করে হল তা জানা যায় না। তাকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে ১৯১৪ খ্রী. নগেন্দ্ৰনাথ ‘সঙ্গীত পরিষদ বিদ্যালয়’ নাম দিয়ে একটি স্কুলের পত্তন করেন। শিক্ষিক যাদুমণি। সঙ্গীত পরিষদকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালনার জন্য যে সমিতি গঠিত হয়েছিল তাতে ছিলেন মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়, সভাপতি মতিলাল ঘোষ (অমৃতবাজার পত্রিকা), সম্পাদক গোপেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র, তত্ত্বাবধায়ক নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। যাদুমণি ছাড়া অপর শিক্ষক ছিলেন ধ্রুপদী কৃষ্ণধন ভট্টাচাৰ্য। ছাত্রসংখ্যা ৮/১০ জন। সঙ্গীতপ্রিয় কিছু লোক ও আগেকার আমলের তাঁর পৃষ্ঠপোষক এবং গুণগ্ৰাহীদের মধ্যে কেউ কেউ সঙ্গীতক্ষেত্রে তাঁর ফিরে আসার কথা শুনে তাঁর গান শুনবার ইচ্ছা প্ৰকাশ করলে তিনি উল্লেখযোগ্য তিনটি আসরে গান করেন। দরবারী আদবকায়দা অনুসারে আসর সাজিয়ে তিনি তাঁর প্রাক্তন পৃষ্ঠপোষক দ্বারভাঙ্গার মহারাজা রামেশ্বর সিংকে গান শোনান। অন্য এক আসরের শ্রোতা ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। তাঁর সঙ্গীত-জীবনের শেষ পর্যায়ের সঙ্গীতানুষ্ঠানের আসরটি গুরুত্বপূর্ণ। উদ্বোধনী এবং সমাপ্তি সঙ্গীত ছাড়া তিনি রবীন্দ্রনাথের যে তিনটি গান গেয়েছিলেন, তা রবীন্দ্রনাথের নির্দেশিত পথে গাননি। রবীন্দ্রনাথ ‘সঙ্গীতের মুক্তি’ নামে ভারতীয় সঙ্গীতের যে সমালোচনা করেন, তাঁর প্রতিবাদে, সঙ্গীত পরিষদ উক্ত অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিল। সভায় কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষ বেদান্ত-চিন্তামণি মূল প্রতিবাদ-প্রবন্ধটি পাঠ করেন এবং ভারতীয় সঙ্গীতে তালের গুরুত্ব কতখানি এবং তা যে বিজ্ঞানসম্মত, এ কথা সঙ্গীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে এই সভায় প্রদর্শন করেন যাদুমণি। সঙ্গীত পরিষদে তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন অভয়াপদ চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বাপতি চৌধুরী, গঙ্গাধর ঘোষ চৌধুরী, ইন্দুভূষণ প্রভৃতি। কিন্তু তাদের কেউই সঙ্গীত-জগতে কৃতী হননি। তাঁর মধ্যজীবনে বাঙলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণী অন্ধগায়ক সাতকড়ি মালাকারকে তিনি টপ্পা ও খেয়াল শিখিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে সঙ্গীত পরিষদের ছাত্ররা তাঁর শেষকৃত্য করেন এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে তাঁর স্মৃতিসভার আয়োজন হয়। সে সভায় সভাপতিত্ব করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং বক্তা ছিলেন নাট্যাচাৰ্য অমৃতলাল বসু ও পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়।
ওটা নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নয়
নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী হবে।কিন্তু যে নাটক টিতে অভিনয় করে উনি বিখ্যাত হন।ওই নাটকের নাম সতী কি কলঙ্কিনী ,রচনা করেছেন নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী যাদুমনি কে ভিখারিনির বেশে দেখেন।জায়গাটির নাম বলরাম ঘোষ স্ট্রিট।ঐখানে নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলির ছাপা খানা ছিল। ওই বাড়ির দোতলায় যাদুমনি থাকতেন।৬৭/৯, বললাম ঘোষ ষ্ট্রীট
বৃদ্ধা যাদুমণির গান শুনে চিত্তরঞ্জন মুগ্ধ হয়ে যান।
চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর তাঁর যে জীবনী বার হয় এবং তাতে যাদুমণি প্রসঙ্গ ঠাঁই পায়।
জীবনের শেষ পর্যায়ে এক অনুষ্ঠানে যাদুমণির গান সাড়া ফেলে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের শুরুতে তিনি একটা ধ্রুপদ গান করেন এবং সমাপ্তি অনুষ্ঠানও তাঁর গান দিয়েই হয়। ঐ আসরে যাদুমণি রবীন্দ্রনাথের তিনখানা গান আপন সুরে তালে গেয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের সম্পর্কে অমৃতবাজার পত্রিকার ১৫ই ডিসেম্বর, ১৯১৭ তারিখের সংখ্যায় একটা রিপোর্ট প্রকাশিত হয় –
The Sangit Parishad/A musical demonstration/ Hindu Music and Sir Rabindranath:
The musical demonstration given by the Parishad by way of a protest against the latest utterance of Sir Rabindranath Tegore on Indian Music came off last Friday evening at the Presidency Theatre. On the motion of Rai Jagadindrenath Choudhary, Babu Motilal Ghosh was voted to the chair.
The demonstration was opened with two Dhrupad songs by Smt. Jadumani and Prof. Jogindra Kishore Banerjee of Parishad Vidyalaya. Babu Krishna Chandra Ghosh then read his paper which was explained by practical demonstration …. another song by the Lady Vice-Principal of the Vidyalaya.
রামমোহন লাইব্রেরীতে রবীন্দ্রনাথ ‘সঙ্গীতের মুক্তি ‘ নামে যে সমালোচনা করেন তার প্রতিবাদে সঙ্গীত পরিষদ উক্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। যাদুমণি রবীন্দ্রনাথের যে তিনটি গান নিজের সুরে ও তালে গেয়েছিলেন তার স্বরলিপি পরিষদের পরবর্তী সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ঐ আসরে যাদুমণি শুধু গায়িকা হিসেবে নয়, একজন তাত্ত্বিক হিসেবেও নিজের গুণপণা প্রকাশ করেন। তাঁর থেকে মনেহয় যে যাদুমণির ভারতীয় সঙ্গীতের উপপত্তিক জ্ঞান যথেষ্ট গভীর ছিল।
যাদুমনির সংগীত শিক্ষা
গুরু প্রসাদ ছিলেন বিহারের বেতিয়া ঘরাণার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়ক। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শিব প্রসাদের সঙ্গে তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় কোলকাতায় কাটান। তাঁর বেশিরভাগ শিষ্যই ছিলেন বাঙালি। রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী ছিলেন গুরু প্রসাদের সেরা শিষ্য। তাছাড়াও, শশীভূষণ দে (কৃষ্ণচন্দ্র দের প্রথম গুরু), গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বিখ্যাত গায়কেরা ছিলেন তাঁর শিষ্য। বিষ্ণুপুর ঘরাণায় বেতিয়া ঘরাণার মিলন ঘটে এই গুরু প্রসাদের মাধ্যমে।
যাদুমণির দ্বিতীয় গুরু ছিলেন জগদীপ মিশ্র। ইনি ছিলেন জয়পুর ঘরাণার এক প্রতিভাবান গায়ক এবং নর্তক। তিনি বয়সে যাদুমণির থেকে ছোট ছিলেন। অবস্থার ফেরে জগদীপ মিশ্রের পক্ষে বেশিদিন কোলকাতায় থাকা সম্ভব হয়নি। যাদুমণিই ছিলেন তাঁর একমাত্র শিষ্য। যাদুমণির নাচ শেখা এই জগদীপ মিশ্রের কাছে। যাদুমণির শেষ গুরু কাশীর বিখ্যাত প্রসদ্দু-মনোহর ঘরাণার মনোহর পুত্র সারদা প্রসাদ মিশ্র। এই ঘরাণার বিখ্যাত সঙ্গীত আচার্য ছিলেন পণ্ডিত লছমী প্রসাদ মিশ্র, যাঁকে সরস্বতীর বরপুত্র বলা হতো। তবে সারদা প্রসাদের কাছে শেখার আগেই যাদুমণি গায়িকা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর খ্যাতির প্রথম সোপান ছিল রঙ্গমঞ্চ। বছর কুড়ি বয়সের পরেই তিনি রঙ্গমঞ্চে গায়িকা হিসেবে যোগদান করেন। যদিও নটীর জীবন তাঁর দীর্ঘ হয়নি। মাত্র বছর দুয়েক স্থায়ী হয়। কিন্তু কোলকাতার থিয়েটার সংস্কৃতির সেই প্রথম যুগে তাঁর থিয়েটারে যোগদান বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।