১৫. লখাই গরুর গাড়ি ছাড়ল

পরদিন কাঞ্চনকে নিয়ে লখাই গরুর গাড়ি ছাড়ল। উত্তরে কাঁটালপাড়ার পুবকোণে দেউলপাড়ায় কাঞ্চনের বাপের বাড়ি। প্রায় তিন ক্রোশ পথ।

পথে যেতে যেতে তাদের কথা হল— তেলেনীপাড়ার সেই গোরা সাহেব দুটোর কথা। এখনও পর্যন্ত সেখান থেকে কোনও খবর বা সন্ধান আসেনি। ব্যাপারটা কেমন অস্পষ্ট হয়ে উঠল। কাঞ্চন বার বার বলে দিল, আর যেন কোনও রকম গোয়ার্তুমি লখাই না করে। আর…

বলে সে থামতে লখাই জিজ্ঞেস করল, কী?

কাঞ্চন বলল, এসে যদি দেখি বা কাকপক্ষীর মুখেও শুনি সরি বোষ্টমির সঙ্গে মজেছ, তবে কিছু পারি বটি দে নিজের গলা তো কোপাতে পারব।

লখাই হো হো করে হেসে উঠল, তোমার য্যাত আকথা।

ভাটপাড়ার পর কাঁটালপাড়ার সীমা অবধি মাঝের এ স্থান বাগান ও জঙ্গলে ভরা, নির্জন ও নিস্তব্ধ। মুক্তোপুরের খাল গিয়েছে কাঁটালপাড়ার দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে। সেখানে মদের ভাটিখানা রয়েছে। আশেপাশে দু-একটা ছিটেবেড়ার ঘর। খানিকটা বা দিয়ে শুরু হয়েছে ব্রাহ্মণদের বর্ধিষ্ণু গ্রাম।

ভাটপাড়া পেরিয়ে খানিকটা নির্জনে আসতেই কাঞ্চন লখাই যুগপৎ চমকে উঠল একটা মোটা গলার স্বর শুনে, কালী কালী বল।

গাড়ীর মধ্যে থেকেই কাঞ্চন লখাইয়ের দিকে তাকাল। লখাই গাড়ি থামিয়ে দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে বিস্মিত চোখে দেখতে লাগল এ-দিকে ও-দিক। তার পর হঠাৎ দেখল তার সামনেই মনোহর বেদে বিশাল গোঁফের ফাঁকে মিট মিট করে হাসছে। সেই মূর্তি, সেই চোখ, তেমনি কপালে সিঁদুরের দাগ, মাথায় কাপড়ের পুটলি বাঁধা।

বলল, কোথায় গো চাঁদ রাজার ছেলে লক্ষীন্দর!

কাঞ্চনের বুকের মধ্যে ধকধক করতে লাগল লোকটার চেহারা দেখে কিন্তু সে দেখল লখাই নেমে গিয়ে লোকটার হাত ধরে বলল, দাদা, তুমি এখেনে?

মনোহর বলল : আমি তো সবস্থানেই ভাই। তোমাকে দেখতে পেয়ে আর স্থির থাকতে পারলুম। তা, ওই কি আমার লখাই ভায়ের বেউলে বউ?

কাঞ্চন তাড়াতাড়ি একগলা ঘোমটা টেনে দিল।

মনোহর আবার বলল, বাঃ ভাদ্দর বউটি আমার বেশ। কালী কালী বল। তা কোথাও যাওয়া হচ্ছে?

ওর বাপের বাড়ি—দেউলপাড়া।

দেউলপাড়ার মেয়ে? বেশ। তা বউমার আমার…

লখাই বলল, ছেলেপুলে হবে।

মনোহর হা হা করে হেসে উঠল, বা রে জোয়ান। বেঁচে থাকো। তা ছেলে হলে আমি দেখে আসব গে, কেমন? আর দাঁড়াব না, চলি।

আর দেখা হবে না, দাদা?

দেখা? এক মুহূর্ত ভেবে মনোহর বলল, হবে, রাতের পেথম পোহরে যদি জেগে থাকো আজ দেখতে পাবে। উত্তরে আমার নিশেনা আজ। তবে সাবধান, ভাদ্দর বউকে বলে দিয়ো, চাউড় না হয় এ কথা।

বলে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। কাঞ্চন উগ্র কৌতূহলে ভেঙে পড়ল সব জানবার জন্য। লখাই বুঝল, মনোহর প্রকৃতপক্ষে কাঞ্চনকে সব কথা বলার অধিকার তাকে দিয়ে গেল। সে সব কথা বলল কাঞ্চনকে। কাঞ্চন কয়েকবার শিউরে উঠল। একবার পেছনে ফিরে দেখতে লাগল। কিন্তু কিছুই দেখা গেল না।

বেলা পড়ে এসেছে। কাঁটালপাড়ার কাছে ডান দিকে গাড়ির মোড় ফিরতেই বলদ দুটো পথের উপর থমকে দাঁড়াল। লখাই দেখল অদূরেই এক মস্তবড় বাড়ি, মন্দিরের চূড়া। মাঝে পথ দিয়ে এক সুপুরুষ অশ্বারোহী মন্থর গতিতে এগিয়ে আসছেন। কাছেই একটা চাষীমতো লোক ছিল। বলে উঠল, গাড়ি সরাও, পাশ দেও, দেখছ না হাকিম কত্তা আসছেন?

লখাই তাড়াতাড়ি নেমে গাড়িটা সরিয়ে দিল পাশে। জিজ্ঞেস করল, উনি কে, বললে?

লোকটি বিরক্ত হয়ে বলল, কোথাকার মানুষ হে তুমি, ওনাকে চেনো না? শোনোনি চাটুজ্যে ম্যাজিস্টর, মস্ত পণ্ডিত, কেতাব লেখেন?

বলতে বলতে অশ্বারোহী সামনে এসে পড়লেন। লখাই দেখল, গৌরবর্ণ নধরকান্তি, ঠোঁটের কোণ কিঞ্চিৎ বঙ্কিম, ঈষৎ আরক্ত চোখজোড়াতে গভীর চিন্তার ছায়া।

সেই লোকটি ঘাড় নুইয়ে নমস্কার করল। দেখাদেখি লখাইও দুহাত তুলে মাথা নত করল।

অশ্বারোহীর ঠোঁটের কোণে বিদ্যুতের মতো একবার হাসি দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল। একবার সেই লোকটি এবং একমুহূর্ত বেশি তিনি লখাইয়ের দিকে দেখলেন। মন্থর খুরের শব্দ তুলে এগিয়ে গেল ঘোড়া। লখাইয়ের মনে পড়ল সেজবাবুর কথা, সেই কেতাবের কথা। কী যেন নাম ছিল সে কেতাবের! দুগগা…হ্যাঁ দুগানন্দিনেই বুঝি। পাচন নেওয়ার নাম করে যে কেতাবের পাতা জোয়ান ছেলেরা ছিঁড়ে নিয়ে যায় বউকে শোনাবে বলে।

কাঞ্চন লখাই বাড়ি এসে পৌঁছুল। ইতিপূর্বেই লখাইয়ের সমস্ত পরিচয় কাঞ্চনের বাপের বাড়িতে জানত এবং প্রকৃতপক্ষে লখাইকে কাঞ্চনের মা বাবা জামাইয়ের মতোই গ্রহণ করল।

কাঞ্চনের সই ও বান্ধবীর দল এল ছুটে দেখতে তাদের এত দিনের শোনা সেই রূপকথার পুরুষকে। ভারী একটা হইচই পড়ে গেল। গান, গল্প, ঠাট্টা, তামাশা, বাড়িটা জমজমাট হয়ে উঠলো একেবারে।

কাঞ্চনের সইয়ের গাইয়ে বর গেয়ে উঠলো :

ওই কালো পুরুষ যে-সে লয়, আগুন আছে ওর সব্বো অঙ্গে
কামিনীকুল সাবধান থেকো, (লয় তো) পুড়ে মরবে রঙ্গে রঙ্গে।
অমন কাঞ্চন পাষাণী রাই
(ও রূপে) সেও যদি মল ছাই
ভয় আমার কামিনীরা কুল ছেড়ে সব, পালাবে ওর সঙ্গে সঙ্গে।

মেয়েরা হেসে কুটিকুটি হয়ে কৃত্রিম রোষে সবাই গাইয়েকে বলে উঠল, দূর দূর দূর, মরণ।…

তার পর রাত্রি এল। রাত গভীর হল। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। লখাইয়ের চোখে ঘুম নেই। আধঘুমন্ত কাঞ্চন থেকে থেকে বলে উঠছে, এসেছে?

লখাই বারবারই জবাব দিচ্ছে, না।

একসময় হঠাৎ লখাই শুনতে পেল মোটা চাপা গলা, কালী কালী বল।

সামনে তাকিয়ে দেখল তার খোলা দরজার কাছে মানুষের মূর্তি। লখাই উঠে এল। কাঞ্চন জেগেছিল, কিন্তু সামনে আসতে ভরসা পেল না।

মনোহর বলল, কাছে হলে দূর, দূর হলে কাছে বুঝ। আজ কাছেই যাব। চলি।

বলে চকিতে কীসে ভর দিয়ে লাফিয়ে সে দুটো বাঁশের উপর উঠে দশ হাত দূরে চলে গেল। অন্ধকার কুঁড়ে দেখা গেল আরও কয়েকজন অমনি বাঁশের উপর দিয়ে তারাভরা আকাশের তলা দিয়ে ছুটেছে।

কাঞ্চন ফিসফিস করে উঠল, রণপায় যাচ্ছে।

রণপায় করে সেই দল গ্রামপ্রান্তরের মাথার উপর দিয়ে, অন্ধকারে তারা-ভরা আকাশের ধার ঘেঁষে, গাছ-গাছালি খাল-খানা-খন্দ পেরিয়ে ছুটে চলেছে সুদীর্ঘ ঠ্যাং বিশিষ্ট প্রেতের মতো। চোখের পলকে সেই দল চলতে চলতে ছোট হতে হতে কয়েকটি কালো রেখার মত দূর আকাশের অন্ধকার কোলে মিশে একাকারে হয়ে গেল।

.

পরদিন লখাই দুপুরবেলা ফিরেই দেখল, তার জন্য কালীবউ, শ্যাম উৎকণ্ঠিত হয়ে বসে আছে। সে আসতেই কালী বলল, স্যানবাড়ি থেকে তোমার জরুরি তলব এসেছে। বলে গেছে, আসা মাত্র পেইঠে দিতে।

লখাই একমুহূর্তে থমকে রইল। এক রাত্রির বিদায় নিয়েই সে দেউলপাড়া গিয়েছিল। তার মধ্যে এ জরুরি ডাক তার বুঝতে দেরি হলো না এবং সেই গোরার মুখ দুটোই বার বার তার চোখের উপর ভেসে উঠল।

শ্যাম গাড়ি থেকে গরু খুলতে লাগল। চোখে তার অশান্তি ও উৎকণ্ঠা। যেন উদ্বেগেই বা রুদ্ধ তার।

লখাই আর বিলম্ব না করে বেরুবার উদ্যোগ করল। কালী তাড়াতাড়ি তার সামনে এসে উৎকণ্ঠায় ভেঙে পড়ল, কী হবে তা হলে?

লখাই বলল, দেখি কী হয়। আসতে যদি দেরি হয়, খবরটা নিয়ে একবার।

তার পর, দুপা গিয়ে হঠাৎ থেমে বলল, এক দিন জল থেকে এনে আচ্চয় দিইছেলে, তুমি আর শ্যামদাদা আমার মা বাপের মতন। যদি কোনও বেপদ-আপদ হয় তো বলে যাই, অল্যায্য আমি কিছু করিনি। আর যদি কোনও দিন না ফিরি তো কাঞ্চী বউকে বলল…

বলতে পারল না সে কথা লখাই! গলা ভারী হয়ে এল। সমস্ত আবহাওয়াটা মুহূর্তে পরিবর্তন হয়ে যেন সত্যিই প্রিয়জনের অনির্দিষ্ট বিদায়ের বেদনায় ও উৎকণ্ঠায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।

লখাই আবার বলল, মধু কোথায়?

মধু বাড়ির পেছন থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসে বলল, তুমি যাও কাকা, আমি তোমার পেছনে আছি। সব খবর নে আসব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *