২২. বেদনার অশ্রু

বেদনার অশ্রু

ধীরে ধীরে হতভাগ্যের প্রাণবায়ু বোধ করি বাতাসে মিলিয়ে গেল।

সকলের চোখের কোলেই অশ্রু। এত বড় শয়তান, তবু সকলের বুকেই যেন আজ দোলা দিয়ে গেছে।

অত বড় একটা পাপীর এমনি করুণ পরিসমাপ্তি! তীব্র বিষের ক্রিয়ায় সমস্ত দেহ একেবারে নীল হয়ে গেছে। কিরীটী অশ্রুসজল চোখে ডাক্তারের বা কালো ভ্রমরের মাথায় হাত রেখে বললে, ভগবান তোমার আত্মার মঙ্গল করবেন।

কথাগুলো বলতে বলতে কিরীটী যেই কালো ভ্রমরের মাথায় হাত বোলাতে যাবে, অমনি তার কাঁচাপাকা চুলের পরচুলাটাও কিরীটীর আঙুলের সঙ্গে খসে এল।

একমাথা ভতি সুন্দর ঢেউ-খেলানো কোঁকড়ানো কোঁকড়ানো চুল। এতক্ষণে যেন মাথার চুল থেকে দেহের প্রতি অণু-পরমাণু পর্যন্ত অপরপ সৌন্দর্যে বিকশিত হয়ে উঠল। এত সুশ্রী যে কেউ হতে পারে এ যেন ধারণারও অতীত। এমন সুন্দর দেহের অন্তরালে জঘন্য এক শয়তান লুকিয়ে ছিল! আজ শয়তান দেহ ছেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই দেহ আবার আপন সৌন্দর্য ফিরে পেল।

***

কিরীটী বলতে লাগল, ডাক্তার প্রথম পরশু রাত্রে আমাদের গৃহে গিয়েছিল এই নকল সাঙ্কেতিক লেখাটার আসল কাগজটা চুরি করতে। কিন্তু সে জানত না যে তার মতলব আমি জাহাজেই ধরে ফেলি। বলে সে একে একে জাহাজের দু-রাত্রির সমস্ত ঘটনা খুলে বললে।

তারপর একটু থেমে কিরীটী আবার বলতে লাগল, কিন্তু তখনও আমার সন্দেহটা ভাল করে দানা বেধে ওঠেনি। সেদিন রাত্রে যখন কাগজটা চুরি করে গাড়িতে করে পালায়, তখন তার গাড়ির পিছনে চেপে তার বাড়ি পর্যন্ত যাই। শুধু তাই নয় কাঁকর দিয়ে তার গাড়ির গায়ে K অক্ষরও লিখে রেখে আসি। কাল দুপুরে ডাক্তারের ওখানে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে ওর শোবার ঘরে পিতলের মুর্তিটার পাশে ওর ডায়েরীটা পেয়ে তখনই সকলের চোখের আড়ালে সেটা লুকিয়ে ফেলি। তারপর মিঃ সেনকে নীচে বিদায় দিতে এসে তাঁর গাড়ির গায়ে K অক্ষরটা দেখে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলাম। যা হোক তখনই বেরিয়ে গিয়ে ডাক্তারের বাড়ির পিছনে গেলাম। চিনতে পারলাম, সেখানেই গতরাত্রে গাড়ির পিছনে করে এসেছিলাম। তখন আর কোন সন্দেহ রইল না। হ্যাঁ, ডাক্তার সান্যালই যে কালো ভ্রমর তাতে আর কোন সন্দেহই আমার রইল না। তারপর ডায়েরীটা খুলে পড়তে পড়তে একেবারে সকল সন্দেহের অবসান হল। কিন্তু একটা কথা তখনও বুঝতে পারিনি। মিঃ সেনের গাড়িতে K লেখা হল কেমন করে? সেটাও পরে একটু ভাবতেই পরিষ্কার হয়ে গেল, ভাবলাম হয়তো সে-রাত্রে মিঃ সেনের গাড়িটাই ডাক্তার নিয়ে এসেছিল।

এমন সময় মিঃ সলিল সেন বললেন, হ্যাঁ, ডাক্তার তাঁর গাড়িটা কারখানায় দেওয়া হয়েছে বলে বিকেলের জন্য আমার টু-সীটারটা চেয়ে নিয়েছিলেন।

কিরীটী অমনি সহাস্যে বলে উঠল, তবে তো সব কিছুই ঠিক ঠিক মিলে গেছে। আর একটা কথা, সনৎবাবুকে যে রেঙ্গুনে আনবে এ কথায় স্থিরনিশ্চিত কেমন করে হয়েছিলাম, আপনারা এখন হয়তো বুঝতে পেরে থাকবেন। কালো ভ্রমরের আগাগোড়াই ইচ্ছা ছিল সে সকলকে নিজের এলাকার মধ্যে টেনে নিয়ে আসে। সে ভেবেছিল দলের একজনকে যদি টেনে নিয়ে আসা যায়, তবে সকলেই তার উদ্ধারের জন্য বর্মা পর্যন্ত ছুটে আসবে। তার অনুমানের বিষয় সে ডায়েরীতেও লিখে রেখেছে। বলা বাহুল্য, তার অনুমান ভুল হয়নি। এবং এও জানতাম, ঐ সাঙ্কেতিক লেখাটা উদ্ধার করতে কালো ভ্রমর আমার গৃহে আসবেই এবং এসেছিলও।

তবে তার ব্যথার দিকটা, অর্থাৎ কি কারণে অমরবাবু ও সনৎবাবুর ওপর তার এতটা প্রতিহিংসার ভাব জেগে উঠেছে, সেটা আমরা তাঁর ডায়েরী পড়বার আগে পর্যন্ত টের পাইনি। এবং ঐখানেই ছিল আমার যত সন্দেহ।

এই পর্যন্ত বলে কিরীটী তার কথা শেষ করল। সব কথা শুনে তারা সবাই বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে গেল।

***

প্রভাতী সুর্যের সোনালী আলোয় ইরাবতী হেসে যেন গড়িয়ে পড়ছে।

সুব্রত, রাজু আর কিরীটী ডাক্তারের মৃতদেহ ধীরে ধীরে ইরাবতীর বুকে ভাসিয়ে দিল। ঢেউয়ের তালে তালে দেহটা ভেসে চলল।

সকলের চোখই অশ্রুভারে ঝলমল করে উঠল।

ইরাবতীর শান্তশীতল জলের তলে কালো ভ্রমর ঘুমিয়ে রইল। স্রোতবিধৌত গৌতম পর্বতোপরি প্যাগোডা ও পর্বতগাত্রে খোদিত অসংখ্য বুদ্ধদেবের মূর্তি সূর্যের আলোয় অতি সুন্দর দেখাচ্ছিল।

কালো ভ্রমরের কি সত্যিই মত্যু হল?

এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে?

কে ও? কে?