৪.০৬-১০ মোতি রায়ের জাল-নিক্ষেপ

৪.০৬ মোতি রায়ের জাল-নিক্ষেপ

পরদিন ভোরবেলা অন্ধকার থাকতে রেশমী ও টুশকি নিয়মিত সময়ে গঙ্গায়ান করে এল। অন্যদিন তার পরে কিছুক্ষণ সংসারের কাজ করে দুজনে বাজারে যেত। আজ টুশকিকে একাকী যেতে হল, রেশমী কিছুতেই গেল না, বলল, শরীরটা তেমন ভাল নেই।

বিকালবেলায় দুজনে কিছুক্ষণের জন্য গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসত, রেশমী ঐ শরীর খারাপের অজুহাতে গেল না দেখে টুশকিও গেল না। অবশ্য সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এলে নিয়মিতভাবে দুজনে মদনমোহনতলায় গেল। সেখানে গিয়েও অন্য দিনের মত রেশমী আরতিদর্শনে মন দিতে পারল না, ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। তার সারাদিনের শঙ্কিত ভাব টুশকির চোখ এড়াল না, বাড়ি ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করল, সৌরভী, সত্যি করে বল তো ব্যাপার কি! আজ সারাদিন অমন মনমরা হয়ে আছ কেন?

রেশমী বলল, এখন থাক, শোবার পরে বলব।

যথাসময়ে শয্যায় এসে টুশকি শুধাল, এবারে বল তো বোন, কি হয়েছে?

রেশমী পুলিসের ঢোল-শোহরতের সংবাদটা চেপে গেল—কারণ সেটা প্রকাশ করতে গেলে অনেক কথা প্রকাশ করতে হয়—নিজের প্রকৃত পরিচয় দিতে সে নারাজ। অথচ টুশকিকে তার ভয়ের অংশ না দিলেই বা চলে কি করে? তাই খানিকটা হাতে রেখে বলল—দিদি, কালকে বিকেলে যখন গঙ্গার ঘাটে বসে ছিলাম, তাদের একজনকে দেখলাম।

টুশকি শুধাল, কাদের একজনকে?

সেই যারা আমাকে চুরি করে এনেছিল।

বল কি!

তার পরে শুধায়, সে লোকটা কি তোমাকে দেখেছিল?

আমি ভিড়ের মধ্যে ছিলাম, দেখে নি বলেই মনে হয়। কিন্তু লোকটা এখনও কাছেই ঘোরাফেরা করছে—তাই ঠিক করেছি দিনের বেলায় আর বের হব না।

তখন টুশকি বলল, এখান থেকে চোরে তোমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারবে না।

কেন?

কেন কি! এ যে কোম্পানির রাজত্ব—ধরা পড়লে তার ঘাড়ে কি মাথা থাকবে নাকি?

রেশমী মুখে বলে, যাক, তবে ভয় নেই, কিন্তু মনে মনে ভয় কিছুমাত্র কমে না, কেননা কোম্পানির পুলিসকেই তো সে দেখেছে ঢোল-শোহরতে তার সন্ধান করতে।

টুশকি বলে, তবু না হয় কিছুদিন দিনের বেলায় নাই বের হলে।

আমিও তাই স্থির করেছি দিদি, সকালবেলায় অন্ধকার থাকতে গঙ্গাস্নান সেরে আসব, আর সন্ধ্যার অন্ধকারে মদনমোহনের বাড়িতে গিয়ে আরতি দেখে আসব।

তার পরে শুধায়, আচ্ছা দিদি, মোতি রায় লোকটা কে?

চমকে উঠে টুশকি বলে, মোতি রায়ের নাম জানলে কি করে?

রেশমী বলে, আগে লোকটার পরিচয় দাও, তার পরে সে-কথা বলছি।

মোতি রায় এ পাড়ার মস্ত জমিদার। তার জন্যে পাড়ার ঝি-বউ-এর আত্মসম্মান নিয়ে বসবাস করা কঠিন।

সরলা রেশমী শধায়, কোম্পানির রাজত্বেও কি এমন সম্ভব?

টাকায় কি অসম্ভব বল? পুলিস ম্যাজিষ্ট্রেট সব মোতি রায়ের মুঠোর মধ্যে।

মোতি রায়ের পরিচয় শুনে রেশমীর রক্ত জমে যাওয়ার উপক্রম হয়। সে চুপ করে থাকে।

এবারে টুশকি বলে, কিন্তু তার পরিচয়ে তোমার হঠাৎ দরকার পড়ল কেন?

রেশমী বলে, ওরা যখন আমাকে চুরি করে আনছিল, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি মনে করে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল।

কি কথা?

মোতি রায়ের বাগানবাড়িতে নিয়ে যাবে বলেই ওরা আমাকে নিয়ে আসছে।

টুশকি সংক্ষেপে বলে, সর্বনাশ!

সর্বনাশ তো মোতি রায়ের, বলে রেশমী।

কি রকম?

আমি তো পালিয়েছি।

আরে ওর যে পুলিসের সঙ্গে যোগাযোগ।

হক না যোগাযোগ। আমি তো আছি তোমার বাড়ির মধ্যে, খবর রাখবে কে?

খবর রাখাই যে পুলিসের কাজ।

পুলিস কি বাড়ির মধ্যে থেকে ধরে নিয়ে যাবে?

না, সে কাজটা করবে মোতি রায়ের পাইকেরা।

আর পুলিসে?

পুলিসে দেখবে কেউ যেন তাদের বাধা না দেয়।

তবে কোম্পানির পুলিসে আর নবাবের পুলিসে তফাৎ কি হল?

নবাবের পুলিস নিজেরা টেনে নিয়ে যেত—এরা সেটুকু করে না।

তবে বলে যে, এ রাজত্ব কোম্পানির নয়, মোতি রায়ের।

টুশকি বলে, রাজত্ব চিরকালই তাদের।

কাদের?

যাদের টাকা আছে।

এর পর আর তর্ক সম্ভব নয়, তাই প্রসঙ্গ পালটিয়ে নিয়ে রেশমী শুরু করে, কিন্তু খুব সন্তর্পণে, আচ্ছা দিদি, কালকে ঘাটে লোকে বলাবলি করছিল যে, কোম্পানির পুলিস নাকি কাকে খুঁজে পাওয়ার জন্যে ঢোল-শোহরত দিচ্ছে।

উদাসীনভাবে টুশকি বলে, এমন তো প্রায়ই দিয়ে থাকে।

তুমি কিছু শোন নি?

কত আর শুনব-ও-সব আমাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে।

রেশমী নিশ্চিন্ত হয়, অন্তত তার প্রকৃত নামটা টুশকির কানে পোহয় নি। কিন্তু তখনই দ্বিগুণ ভয় জাগিয়ে তোলে মোতি রায়ের প্রকৃত পরিচয়। পুলিসের সঙ্গে তার যোগাযোগের সংবাদ শুনে এবারে মনে হল, খুব সম্ভব মোতি রায়ের হাতে সমর্পণ করবার উদ্দেশ্যেই পুলিসের লোকে তার সন্ধান করছে।

সে দেখল টুশকি ঘুমিয়ে পড়েছে, তারও ইচ্ছা ঘুম আসে, ঘুম এলে আপাত দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু ঘুম আর আসে না।

টুশকি নেহাত মিথ্যা বলে নি। মোতি রায়ের অসীম প্রতাপ। পুলিসের সঙ্গে যোগাযোগ সে প্রতাপ রাজকীয় সর্বশক্তিমত্তায় পৌঁছেছিল। পুলিস যার বশংবদ, নাম তার যাই হক, কার্যত সে ছাড়া আর কি। কিন্তু পুলিসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকাতেই মোতি রায় জানত পুলিসের দৌড়। পুলিসে মেয়েটিকে খুঁজে এনে তার হাতে দেবে এমন ভরসা তার ছিল না। তবু সে পুলিসে খবর দিয়েছিল, তার বিশেষ কারণ আছে। সে জানত যে ব্যাপারটার মধ্যে কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ জড়িত আছে। এখন ব্যাপারটা পুলিসের কানে উঠেছে জানলে পুলিসের সন্দেহভাজন পাদ্রীরা সতর্ক হয়ে যাবে, মেয়েটিকে উদ্ধার করতে আর চেষ্টা করবে না, এই ভরসাতেই মোতি রায় গিয়েছিল পুলিসের কাছে। সে বুকে নিয়েছিল যে, এবারে পাত্রীদের আক্রমণের আশঙ্কা আর নেই। ঐটুকুই আশা করেছিল সে পুলিসের কাছে। নতুবা পুলিসের অপদার্থতা সম্বন্ধে তার কোন মোহ থাকবার কথা নয়—পুলিসের বড় সাহেবের মুখের উপর দুই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে যে সে জীবনযাপন করে। মেয়েটিকে খুঁজে বার করবার ভার নিল সে নিজে।

যে চারজন পাইক আটজন মাঝি রেশমী-হরণ করে আনতে গিয়েছিল, তাদের ডাকিয়ে মোতি রায় বলল, তোরা তো দেখেছিলি মেয়েটিকে?

সকলেই স্বীকার করল, দেখেছি বই কি কর্তা।

এখন দেখলে চিনতে পারবি?

তা আর পারব না। কর্তা যে কি বলেন!

তখন মোতি রায় ঢালাও হুকুম দিল, তবে তোরা মেয়েটাকে খুঁজে বার কর। যেখানে পাৰি সোজা নিয়ে যাবি কাশীপুরের বাগানবাড়িতে।

তাদের ইতস্তত ভাব লক্ষ্য করে বলল, না না, থানা পুলিসের ভয় তোদের করতে হবে না। সে-সব আমি ঠিক করে রেখেছি।

তার পরে তাদের উৎসাহের মূলে জলসিঞ্চন করে বলল, মেয়েটাকে খুঁজে আনতে পারলে একশ টাকা বকশিশ পাবি।

তারা মস্ত সেলাম বাজিয়ে প্রস্থান করল।

সত্য কথা বলতে কি, তারা এখন রেশমীকে দেখলে চিনতে পারত কি না সন্দেহ, রাত্রির অন্ধকারে তাকে দেখেছিল। কিন্তু তারা ভাবল অত খুঁটিয়ে বিচার করতে গেলে নগদ একশ টাকা বকশিশ পাওয়া সম্ভব হয় না। তারা স্থির করল, ঐ বয়সের মেয়ে পেলেই নিয়ে হাজির করবে বাগানবাড়িতে, তার পরে সে ঘুড়ি রেশমী কি সাদা সুতো বিচার করবে বঙ্গী মশাই। বিশল্যকরণী যদি খুঁজে না পাওয়া যায়, গন্ধমাদন নিয়ে যেতে বাধা কি?

মোতি রায় চণ্ডী বক্সীকে প্রহরাধীনে বাগানবাড়িতে রেখে দিয়েছিল; বলে দিয়েছিল, আমার লোকে মেয়ে খুঁজে নিয়ে আসবে, তুমি সনাক্ত করবে তাদের মধ্যে কোনটি তোমাদের মেয়ে।

চণ্ডীকে স্বীকার করতে হয়েছিল, কারণ সে এই কদিনেই বুঝেছে যে, সে এখন নজরবন্দী-অস্বীকার করলে কি হবে, সে বিষয়ে তার কোন ভ্রান্ত ধারণা ছিল না।

মোতি রায়ের লোকের উপদ্রবে পাড়ার কচি বয়সের ঝি-বউ-এর পথেঘাটে বের হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ল।

এমন না করে মোতি রায়ের উপায় ছিল না। সেকালে কামিনী-কাঞ্চনের তোলে কৌলীন্য বিচার হত। মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুর মাতৃশ্রাদ্ধে নয় লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন, সে কেবল মাতৃভক্তির প্রেরণায় নিশ্চয় নয়। এটা ছিল তখনকার দিনে ধনের বিজ্ঞাপন। তেমনি বিজ্ঞাপনের আর একটা উপায় ছিল রক্ষিতার সংখ্যা ও কদর। ওর মধ্যে গোপনীয়তা কিছু ছিল না—অপ্রকাশ্যের প্রকাশ্যে যাচাই করে ধনীর মর্যাদা স্থির হত। মোতি রায়ের কামিনী-কাঞ্চনের যুগল-অশ্ববাহিত রথ হঠাৎ চোট খেল রেশমী হরণ ব্যাপারে, ছিটকে পড়ল মোতি রায় পথের উপরে, গায়ে এসে লাগল নিন্দার কর্দম।

সেদিন সকালে দেউড়ির সামনে দড়ি ও কলসী দেখে মোতি রায় বুঝল যে, এ হচ্ছে মাধব রায়ের লোকের কাজ। তখনই সে লোক দিয়ে দডিকলসী জলে ভাসিয়ে দিল। কিন্তু সংসারে তো দড়ি-কলসী একটিমাত্র নয়—প্রতিদিন সকালে ঐ দুটি বস্তু একযোগে তার দেউড়িতে আবিষ্কৃত হতে লাগল। একদিন সকালে মাধব রায়ের লোকেদের দড়ি-কলসী রাখতে দেখে মোতি রায়ের লোকেরা তাদের মাথা ন্যাড়া করে খেদিয়ে দিল। বিকালবেলায় মাধব রায়ের দল সঙ বের করল। একটা লোককে মোতি রায়ের মত সাজিয়েছে, তার গলায় দড়ি-কলসী বাঁধা—আর সকলে খোল করতাল বাজিয়ে কীর্তন করতে করতে লোকটাকে নিয়ে চলেছে গঙ্গায়। সঙের দল মোতি রায়ের দেউড়ির সম্মুখে আসতেই তার লোকজন লাঠিসোঠা নিয়ে পড়ল সঙের দলের উপরে। দুই পক্ষে অনেকগুলো মাথা ফাটল। এই রকম নিত্য নূতন উপদ্রবে পাড়ার শান্তি পাড়া ত্যাগ করল—কিন্তু কারও আপত্তি করবার উপায় নেই। শান্তিকামী তোক দুই পক্ষের লাঠির লক্ষ্য।

ওদিকে বাগানবাড়িতে নৃতন করে রঙ আর সাজসজ্জা শুরু হয়ে গেল। মোতি রায়ের ইচ্ছা রেশমীকে পেলে জাঁকজমকের সঙ্গে নাচগানের ব্যবস্থা করবে, যাতে সবাই জানতে পারে যে, মোতি রায়ের সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু রেশমী কোথায়?

মোতি রায়ের পাইকেরা যে মেয়েকেই ধরে আনে, চণ্ডী বলে, না, এ আমাদের মেয়ে নয়।

অবশেষে পাইকেরা গেল চণ্ডীর উপরে চটে। তারা বলল, বক্সী মশাই, অত বাছবিচারে কাজ কি? যে-কোন একটা মেয়েকে তোমাদের মেয়ে বলে স্বীকার করে নাও না। তারা বলল, তোমাদের মেয়েরও জাত বাঁচুক, আমরাও ইনাম পাই।

চণ্ডী জিভ কেটে বলল, কি সর্বনাশ! আমার মুখে মিথ্যা বের হবে না।

সংসারে অষ্টমাশ্চর্যের একটি হচ্ছে এই যে, সময়বিশেষে অত্যন্ত মিথ্যাবাদী লোকের মুখেও একটি মিথ্যা বের হতে চায় না।

পাইকেরা গিয়ে মোতি রায়কে বলল, হুজুর, বজী মশাই বড় সোজা লোক নয়।

কেন?

নিজেদের মেয়েদের জাত বাঁচাবার আশায় মেয়ে সনাক্ত করতে চাইছে না, নইলে আমাদের চেষ্টায় তুটি নেই।

মোতি রায় গর্জন করে উঠল, কি, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! আমার বাগানবাড়িতে গেলে জাত যাবে! লাগাও বক্সীকে পঁচিশ ঘা জুতো।

পাইকেরা সেই মহদুদ্দেশ্যে এসে দেখল বঙ্গী কখন সরে পড়েছে। তারা ভাবল, ভালই হল, এবারে যে-কোন একটা মেয়েকে সবাই হলফ করে রেশমী বলে চালিয়ে দেবে।

এদিকে টুশকি আর রেশমীর দিনের বেলাটা কোন রকমে বাড়ির মধ্যে লুকিয়ে থেকে চলে যায়, কিন্তু রাতটা আর যেতে চায় না। নিত্য নূতন নূতন উপদ্রবের কথা তাদের কানে আসে, মুখে মুখে পল্লবিত হয়ে মেয়ে-ধরার সংবাদ তাদের কাছে পৌঁছয়। রেশমী কাঁদ-কাঁদ ভাবে বলে, দিদি, আমার জন্যেই লোকের এই সর্বনাশ হচ্ছে।

টুশকি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, না বোন, তা নয়-এমন সর্বনাশ চিরকাল চলছে, দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে গেলাম।

সেদিন অনেক রাত্রে নারীকণ্ঠের তরুণ আর্তস্বরে দুজনেরই ঘুম ভেঙে গেল।

রেশমী শুধাল, দিদি, ও কি?

টুশকি নিদ্রাজড়িত স্বরে বলল, আবার কি! কোন অভাগিনীকে নিয়ে চলেছে মোতি রায়ের পাইকেরা।

অবুঝ রেশমী বলে, জোর করে?

নইলে আর এমন করে কাঁদে?

কেউ সাহায্য করবে না?

কার ঘাড়ে দুটো মাথা বোন!

অসহায় কষ্ঠ পাড়ার নিদ্রা বিদীর্ণ করে সর্বশক্তিমানের দরবারে আবেদন পৌঁছে দেয়। সর্বশক্তিমানের আসন কি উপলক্ষে টলে কেউ জানে না, তিনি যে দুয়ে!

ক্ষীয়মাণ আর্তকণ্ঠকে মনে মনে অনুসরণ করে রেশমী ভাবতে থাকে, ঐ মেয়েটা তার বদলে বলিপ্রদত্ত হতে যাচ্ছে। যাওয়ার কথা তো তারই। সে ভাবে, এর কি কোন প্রতিকার নেই? কিন্তু কি প্রতিকার ভেবে পায় না। সে একবার টুশকিকে ঠেলা দেয় টুশকি ঘুমিয়ে পড়েছে। রেশমীর ঘুম আসে না সে বিনিদ্র জেগে বসে থাকে।

.

৪.০৭ পথনির্দেশ

নৌকার গতি এমন নিঃশব্দ আর মসৃণ যে আরোহী জানতেও পায় না নৌকাখানা ছাড়ল কিনা কিংবা কতদূর এল-হঠাৎ এক সময়ে সচেতন হয়ে চমকে উঠে দেখতে পায় যে তীরভূমি কতদূর গিয়ে পড়েছে—আবার সেই সঙ্গে দেখে যে অপর তীর কখন অভাবিতভাবে কত কাছে এসে পড়েছে। তেমনি অবস্থা হল রেশমীর। তার ধারণা ছিল তার অবস্থা স্থির নিশ্চল আছে কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে পরিবর্তন ঘটছিল তা কি জানত! কিন্তু একদিন যখন এদিক-ওদিক দৃষ্টি পড়ল, বুঝল একটা দিক দূরে গিয়ে পড়েছে, অন্য একটা এসে গিয়েছে কাছে। তার চোখে পড়ল ছায়াপ্রায় পুরাতন তীর, সেখানকার লোকজন কত ছোট হয়ে গিয়েছে—জন, লিজা, রোজ এলমার, কেরী দম্পতি, সব বাষ্প পুত্তলিকা—আর অন্য তীরের টুশকি, মদনমোহন ঠাকুর সব কেমন প্রোজ্জ্বল, স্পষ্ট। সে চমকে উঠে ভাবল—এ কেমন হল! কিন্তু তখন আর নৌকার হাল তার মুঠোর মধ্যে। নেই–অস্পষ্ট অস্পষ্টতর, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রতর হতেই লাগল, স্পষ্ট স্পষ্টতর, বৃহৎ বৃহত্তর হতেই লাগল, অসহায়ভাবে তীরান্তরের লীলা চলতেই লাগল তার জীবনে। বিমূঢ়ভাবে ঘটনাচক্রের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তার উপায় রইল না।

বাইরের জগতের সঙ্গে তার দুটি স্থানে মাত্র যোগ ছিল। সেই অন্ধকার থাকতে ভোরবেলা গঙ্গাস্নান, আর সন্ধ্যাবেলায় মদনমোহনের আরতি-দর্শন। এই দুটি ঘটনা তার মনের উপরে পুণ্যস্পর্শের সাদা রঙ বুলিয়ে দিতে লাগল; এতদিন যে-সব ছবি সেখানে ধীরে ধীরে অঙ্কিত হয়ে উঠেছিল, সেগুলো এখন ঢেকে যাওয়ার মুখে। কথন ঢাকা পড়ে গিয়েছে মদনাবাটির জীবন; ঢাকা পড়ে যাচ্ছে কলকাতার সাহেবপাড়ার জীবন; লিজার। ঈর্ষামিশ্রিত চক্ষুদ্বয়ের একটা ওই বুঝি এখনও দেখা যায়; আর এখনও সবটা ঢাকা পড়ে নি জনের প্রেমাতুর, আর্ত অসহায় চোখ দুটো—তবে তার উপরে পাতলা একপোঁচ রঙ পড়েছে-শরতের স্বচ্ছ মেঘে চাপা পড়া চাঁদের মত তা এখনও মনোহর আর দূরত্বে। চাঁদ তো দূরের বস্তু। অবোধ শিশুর মত তাকে এক সময়ে কাছে মনে করেছিল, সে দুরের চাঁদ দুরেই আছে—রঙের পোচ ক্ৰমে ঘনতর হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিলিয়ে। যাবে মনে করে তার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। কিন্তু নিরুপায়—ঘটনাধীন মানব।

প্রথম প্রথম গঙ্গাস্নানে কিছুমাত্র বৈশিষ্ট্য অনুভব করে নি সে, তাড়াতাড়ি গোটাকয়েক ডুব দিয়ে বাড়ি ফিরত। কিন্তু কখন যে সঙ্গোপনে সুরধুনীর প্রভাব এসে পড়ল তার জীবনে সে জানতেও পারে নি। গঙ্গাস্নানে ক্রমে তার সময় বেশি লাগতে শুরু করল। আগে সে স্নান সেরে উঠে কাপড় ছেড়ে অপেক্ষা করত টুশকির জন্যে, দেখত যে টুশকি গলাজলে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে গঙ্গা-স্তব করছে। দেখত সেই ভোরবেলাতেই আরও কতজন স্তব করছে, পূজা-আহ্নিক সারছে, ফুল বেলপাতা এক গভূষ দুধ গঙ্গায় সমর্পণ করছে। তার পরে সে নিজেও গলাজলে দাঁড়িয়ে থাকত যতক্ষণ না টুশকির স্তব সমাপ্ত হয়। প্রতিদিন শুনে শুনে গলার স্তব মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে মনে মনে আবৃত্তি করত স্তব, জোরে উচ্চারণ করতে কেমন লজ্জা অনুভব করত, মনে হত জন বা কেরী শুনতে পাবে।

একদিন স্নান সেরে উঠে টুশকি বলল, সাজিতে আমার ফুল কম ঠেকছে যেন।

রেশমী অপরাধীর মত বলল, দিদি, আমি গঙ্গায় দিয়েছি।

মনে মনে খুশি হয়ে টুশকি বলল, বেশ করেছ, কাল থেকে বেশি করে আনব।

রেশমীর লজ্জার ভাব কাটে নি, বলে, হাঃ, আমার আবার দেওয়া। মরই জানি নে!

টুশকি বলল, গঙ্গাপূজোর বুঝি মন্তর লাগে! শোন নি যে কথায় বলে গঙ্গা জলে গঙ্গাপুজো! তার পর বলল, তুমি যা মনে করে দাও না কেন, মা গঙ্গা ঠিক বুঝে নেবেন।

পরদিন থেকে ফুল বেলপাতা ভাগ করে নিয়ে দুজনে গঙ্গাজলে দিতে লাগল।

তখন থেকে গঙ্গায় ডুব দেওয়ার সময়ে রেশমীর দুই চোখে জল গড়াত, জলে জল মিশে যেত, কেউ দেখতে পেত না। এমন কত অসহায়ের চোখের জলেই তো গঙ্গার স্ফীতি, নইলে কতটুকু সম্বল নিয়ে সে রওনা হয়েছিল গোমুখী থেকে!

সেদিন স্নান করে ফেরবার সময় রেশমী হঠাৎ বলে উঠল, গঙ্গায়ান করলে শরীরটা বেশ পবিত্র লাগে দিদি।

লাগে বইকি বোন, গঙ্গা যে পতিতপাবনী কলুষনাশিনী।

সব পাপ দূর হয়ে যায়, না? শুধাল সরলা রেশমী।

হয় বইকি বোন।

আমার পাপ কি দূর করতে পারেন?

বিস্মিতা টুশকি বলে, শোন একবার কথা, গঙ্গার অসাধ্য কি? তা ছাড়া তুমি আর জীবনে এমন কি পাপ করেছ? সগর রাজার সন্তানরা কপিলের শাপে ভস্ম হয়ে গিয়েছিল, উদ্ধার করলেন তাদের জাহ্নবী।

রেশমীর মনে পড়ে চিতা-পলায়নের স্মৃতি, সে ভাবে তারও তো ভস্ম হয়ে যাওয়ার

তার পর সারাদিন বাড়িতে থাকে সে আবদ্ধ। টুশকি এখানে-ওখানে যায়, কাজকর্মে তার বের না হয়ে উপায় নেই।

রেশমী বলে, দিদি, সাবধানে চলাফেরা কর।

কেন রে?

মোতি রায়ের লোক।

না বোন, আমার ভয় নেই। বলে সে বেরিয়ে যায়।

একাকী বসে থাকে রেশমী।

মাঝে মাঝে আকাশ-ফাটানো সেই অসহায় কণ্ঠ তার স্মৃতিকে বিদ্ধ করে জাগ্রত হয়ে ওঠে—”ওগো তোমরা তাকে ব’ল, আমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে, সে যেন গিয়ে আমাকে কেড়ে নিয়ে আসে।”

এমন সঙ্কটের মধ্যেও সতীর মুখে পতির নাম উচ্চারিত হয় না।

রেশমী ভাবে নামটা জানলে তাকে খোঁজ করে জানিয়ে আসত পত্নীর অসহায় আবেদন। তার মনে হয় এ দায়িত্ব যেন বিশেষ করে তার উপরেই বর্তেছে, তারই জন্যে ঘরে ঘরে এমন বিপদ। লজ্জায় ভয়ে সে এতটুকু হয়ে যায়। যদি একেবারে শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারত তবে ঐ আর্ত তীব্র চীৎকারের শূল-বেদনা থেকে বুঝি উদ্ধার পেত—”ওগো, তোমরা সবাই আমাকে রক্ষা কর’।

এমন সময়ে রাধারানী এসে উপস্থিত হয়।

রেশমী শুধায়, হাঁরে রাধারানী, আজকে পাড়ার খবর কি?

রাধারানী এটো বাসন মাজতে মাজতে মুখ তুলে বলে-পাড়ার খবর তো এখন একটাই।

বোঝে, তবু না বোঝবার ভান করে রেশমী বলে, কি?

আর কি দিদিমণি, পাড়ার ঝি-বউ-এর ইজ্জৎ আর রইল না।

কেন রে?

কেন আর কি! কচি বয়সের মেয়ে পেলেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে মোতি রায়ের বাগানবাড়িতে।

হঠাৎ?

হঠাৎ নয়, এমন চিরকাল চলেছে, তবে এখন যেন বেড়েছে।

তাই তো জিজ্ঞাসা করছি, হঠাৎ বাড়তে গেল কেন?

কি করে বলব দিদিমণি, শুনছি রেশমী বলে কোন্ একটা পোড়ারমুখীর সন্ধানের জন্যেই নাকি এখন গাঁ উজাড়!

তার পরে বাসনগুলো আয়ত্তে এনে বলে, ঐ যে বলে ঠগ বাছতে গাঁ উজোড়, তা-ই হতে চলেছে।

রেশমী একবার দেখে নেয় যে টুশকি কাছে নেই, তখন আবার বলে রেশমী কে?

সজোরে মাথা-ঝকানি দিয়ে বলে, কেমন করে জানব কে? মেয়েটাকে নাকি মোতি রায়ের পাইকেরা ধরে আনছিল, মেয়েটা পালিয়েছে।

তাই বলে যাকে-তাকে ধরে নিয়ে যাবে?

যাবে না! মুখের গ্রাস পালানোয় বাবুর যে ইজ্জৎ যেতে বসেছে, কি করবে বল!

বিস্মিত রেশমী বলে, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে মোতি রায়ের যেন দোষ নেই?

মোতি রায়ের দোষ কি? বড়লোকে ওরকম করেই থাকে।

তবে কি দোষ যাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে তাদের?

দোষ ঐ পোড়ারমুখী রেশমীরবলে সজোরে সে ঝামা দিয়ে কড়াইটা ঘষতে থাকে।

রেশমীর মুখ শুকিয়ে যায়, তবু বলে, তার কি দোষ?

মুখ না তুলে আপন কাজ করতে করতে রাধারানী বলে যায়, দোষ নয়? পাদ্রীদের হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছিল, তার ধর্ম রক্ষা করেছিল যে মোতি রায়।

আর বাগানবাড়িতে নিয়ে গেলে বুঝি ধর্ম থাকত!

কপালে হাত ছোঁয়াবার ভঙ্গী করে বলে, কপাল আমার। ও সব মেয়ের বুঝি আবার ধর্ম আছে। কত হাত ঘুরেছে জিজ্ঞেস করে দেখো।

তার সম্বন্ধে লোকের ধারণার আভাস পায় রেশমী।

বাসনগুলো কুয়োর জলে ধুয়ে তুলতে তুলতে রাধারানী বলে—পাড়ার লোকে কি ঠিক করেছে জান? রেশমীকে পেলে চুলের মুঠো ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেবে বাগানবাড়িতে।

কেন?

কেন কি? তা নইলে ঝি-বউ বাঁচাবার আর উপায় কি?

হাতের কাজ শেষ করে যাওয়ার আগে রেশমীর মুখের দিকে তাকিয়ে রাধারানী বলে-একটু সাবধানে থেকে দিদিমণি।

রেশমী কি বলবে ভেবে পায় না।

তখন রাধারানী ব্যাখ্যা করে বলে, আয়নায় একবার মুখখানা দেখ, এত রূপ তো। হঠাৎ চোখে পড়ে না, একবার মোতি রায়ের লোকের চোখে পড়লে আর রক্ষে নেই!

রেশমীর শুকনো মুখ আরও শুকিয়ে যায়, তার অন্তরাত্মা কাঁপতে থাকে। ভাবে, কাছেই আছেন মা গঙ্গা পতিতপাবনী, কলুষনাশিনী!

রাধারানী চলে যায়। রেশমী দরজা বন্ধ করে ঘরে গিয়ে ঢোকে।

যেদিন টুশকি উপস্থিত থাকে, এত কথা হয় না, ফিস ফিস করে দু-চার কথা জিজ্ঞাসা করে—একই রকম উত্তর পায়।

রাত্রিবেলা ঘুম ভেঙে হঠাৎ জেগে ওঠে রেশমী, ওগো তোমরা আমাকে বাঁচাও ধনি তার নিদ্রাকে বিদীর্ণ করে। সেদিনকার শ্ৰত এই আর্তরব গানের ধুয়ার মত ফিরে ফিরে যেন বাজতে থাকে; দিনের শান্তি, রাত্রির নিদ্রা দুই-ই তার গিয়েছে।

আজকাল টুশকি মাঝে মাঝে তাকে জিজ্ঞাসা করে, সৌরভী, মুখ শুকনো কেন? খুব ভয় পেয়েছ বুঝি?

রেশমী বলে, না, ভয় পাব কেন!

আমিও তো তাই বলি, বাড়ি থেকে না বের হলে ভয় কিসের! তাছাড়া তুমি যে এখানে আছ তা জানছেই বা কে!

রেশমী ভাবে, ভয় কি শুধু বাইরে রাস্তায়? রাস্তার শব্দ যে তার কানে এসে ঢুকছে তাকে তো থামানো যায় না?

তার পরে তার আরও মনে পড়ে, সেই মেয়েটির আর্তকণ্ঠ মিলিয়ে গেলে অনুচ্চ স্বরে পাড়ার গুঞ্জনও তো কানে এসেছিল, সে সবও তো ঠেকানো যায় নি। সে এখনও কানে শুনতে পায় পাড়ার অভিযোগ। কোন্ ঘর-জ্বালানী পাড়ায় এসে বিপদ ঘটাল। ‘একবার দেখতে পেলে তাকে চুলের খুঁটি ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে মোতি রায়ের বাগানবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। আরে তুমিও যেমন, দেখ গিয়ে এতক্ষণে সে কার বাগানবাড়িতে লীলাখেলা করছে। ছুটে পালিয়ে সতীপনা দেখালেন, এদিকে পাড়ার সর্বনাশ!

কথাগুলোর স্মৃতি ঘুরে ঘুরে বারে বারে হল বিধিয়ে যায় রেশমীর মনে। রাধারানীও এইভাবে কথা বলে। সে বোঝে চারিদিক থেকে অভিযোগের আঙুল তার দিকেই উথিত। এক-একবার তার বিস্ময় বোধ হয়—সব দোষই কি তার? ঐ মোতি রায় লোকটার দোষ তো কেউ দেয় না। সে ভাবে, বিচিত্র বিচার সংসারের।

সে কেমন করে জানবে যে, দুর্বলের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত অনুভব করাই সমাজের নিয়ম। সমাজ দুর্বল, ব্যক্তি প্রবল।

এক ফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে নিদ্রিত টুশকির মুখে। কি সুন্দর ঐ অনুদ্বিগ্ন মুখখানা, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে রেশমী। তার পরে কখন আবার মনে মনে মদনমোহনকে প্রণাম করে শুয়ে পড়ে—এবারে ঘুম আসতে দেরি হয় না।

রেশমীর সন্ধ্যাবেলার সান্ত্বনা মদনমোহনের আরতিদর্শন, ভোরবেলার সান্ত্বনা যেমন গঙ্গায়ান।

প্রথম প্রথম সে সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে টুশকির সঙ্গে যেত আরতিদর্শনে। ধূপ দীপ শঙ্খ ঘণ্টা, জনতার ভক্তিগদগদ ভাব কেমন যেন অবাস্তব মনে হত, তামাশা দেখবার চোখে সব দেখত সে। বাল্যকালে গায়ে থাকতে নিয়মিত ঠাকুর দর্শন করত বটে কিন্তু বয়সের মোড় ঘোরবার সময় এল অবস্থান্তর, পড়ল গিয়ে খ্রীষ্টানদের সঙ্গে, চাপা পড়ে গেল সেদিনকার স্মৃতি। তার পরের কটা বছর কাটল তার দেবতাহীন জীবন। পাত্রীদের কথা শুনতে শুনতে ‘পুতুল-পূজো’ সম্বন্ধে একটা—কি বলব-অভক্তি ঠিক নয়, উদাসীনতার ভাব এসেছিল তার মনে। তার মনটা ছিল ফাঁকা অবস্থায়, দেবদেবী অপসারিত হয়েছে, খ্রীষ্টও প্রতিষ্ঠিত হয় নি, এমন সময়ে পদার্পণ করল জন। জন তার জীবনে প্রথম পুরুষ। এমন সময় আবার অবস্থান্তর ঘটল, দেবদেবী এসে পড়ল কাছে, কোথায় গিয়ে পড়ল জন।

পিছিয়ে কেন মা, এগিয়ে যাও না।

রেশমী পিছনে ফিরে দেখে যে বক্তা বর্ষীয়সী বিধবা মহিলা। রেশমীর ধারণা হল যে মহিলাটি এগিয়ে যেতে চায়, বলল, আপনি এগিয়ে যান। বলে সে নিজে পিছোবার উপক্রম করল।

মহিলাটি তাকে বাধা দিয়ে বলল, এগিয়ে যেতেই তো চাই, পারি কই?

আমি সরহি আপনি এগিয়ে যান।

মহিলাটি করুণ হাসি হেসে বলল, সম্মুখে এগোলেই কি এগোনো যায়?

বিস্মিত রেশমী শুধায়, তবে?

ভক্তি চাই। আমার মনে ভক্তি কই।

তবে আসেন কেন?

যদি মদনমোহন দয়া করেন।

এর আর উত্তর কি? রেশমী চুপ করে থাকে।

পরদিন সেই মহিলাকে দেখে রেশমী সরাসরি প্রশ্ন করে, এখানে এলেই কি মদনমোহন দয়া করেন?

তা কেমন করে হবে মা! বেশ্যামাগীরাও তো আসে!

তবে কি মদনমোহন বেছে বেছে দয়া করেন?

আত্মসমর্পণ করলেই তিনি দয়া করেন।

রেশমীর কথায় মহিলা বোধ করি কিঞ্চিৎ বিস্ময়বোধ করে; শুধায়, তুমি কে মা?

রেশমী সংক্ষেপে বলে, আমি দুঃখিনী।

তবে তোমাকে দয়া করবেন মদনমোহন।

কেমন করে জানলেন?

দুঃখিনীর প্রতিই যে তাঁর টান, আমার মদনমোহন যে দুঃখীর দেবতা।

এবারে রেশমী বলে, আমার মনে হয় আপনিও দুঃখিনী।

কোন উত্তর দেয় না মহিলা। রেশমী দেখে তার চোখ জলে ভরে উঠেছে।

রেশমী দেখে যে জনতার পিছনের দিকটায় বুড়ি বিধবাদের ভিড়। যতক্ষণ আবতি চলে তারা একমনে জপ করতে থাকে। এদের দেখে আর রেশমী ভাবে ভাঙা নৌকার বহর ভিড়েছে সংসারের শেষ বন্দরে। তার মনে হয়, যে কারিগর এদের গড়েছিল সে এবারে এদের ভেঙে চেলা কাঠে পরিণত করবে। আঘাত পড়তে শুরু করেছে, ওরা দয়ার ভিখারী। তার মনে হয় সে-ও বুঝি অল্প বয়সেই শেষ বন্দরে এসে ভিড়েছে।

ক্রমে সে মদনমোহনের প্রতি টান অনুভব করতে লাগল, কেমন যেন একটা নেশার মত। আগে টুশকি তাকে তাগিদ করত, চল সৌরভী, আরতির সময় হল! এখন সে তাগদি দেয়, দিদি, যাবে না? আরতি যে শুরু হয়ে গেল?

টুশকি বলে, দাঁড়াও হাতের কাজটা সেরে নিই।

রেশমী বলে, ও এসে হবে, চল এখন। মদনমোহনের মূর্তিতে আগে কোন মাধুর্য দেখতে পেত না রেশমী—এখন সে মূর্তি মধুর মনে হয়। পাত্রীদের কাছে পুতুল-পুজোর সম্বন্ধে অনেক নিন্দা শ্লেষ সে শুনেছে। তার ধারণা হয়েছিল পুতুল পুজোর অসারতা সে বুঝেছে। বুঝুক আর নাই বুঝুক খ্রীষ্টান হওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছিল। আজ সে কথা মনে করে সে কেমন বিস্ময়বোধ করে। সেদিন স্বপ্নেও ভাবে নি কোন পুতুলে এত জীবনরসের সন্ধান সে পাবে। তার মনে হয় সেদিনের রেশমী আর এক মানুষ। যতক্ষণ আরতি হয় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সে মদনমোহনের দিকে; জপতপ জানে না, মনে মনে ঐ নামটি উচ্চারণ করতে থাকে।

রেশমী লক্ষ্য করত, এক বুড়ি প্রতিদিন নিয়মিত এক কোণে বসে থাকে, আসে সকলের আগে, যায় সকলের পরে, কারও সঙ্গে কোন কথা বলে না, নিঃশব্দে আসে, নিঃশব্দে চলে যায়। একদিন সে তার কাছে গিয়ে বলল, বুড়ি মা, তুমি কি ভাব?

বুড়ি এমন প্রশ্ন যেন জীবনে শোনে নি এমনিভাবে তার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কাদের মেয়ে গা?

কি প্রশ্নের কি উত্তর! অন্য স্থান হলে রেশমী হেসে ফেলত—যদিচ আগের মত কথায় কথায় হাসির মুদ্রাদোষ এখন আর নেই।

রেশমী বলল, আমি কায়েদের মেয়ে।

বুড়ি সংক্ষেপে বলল, তাই বল।

রেশমী আবার ভাবে, কি প্রশ্নের কি উত্তর।

এবারে রেশমী ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, বুড়ি মা, আমার মনে হচ্ছে মদনমোহন তোমাকে দয়া করেছেন।

দয়া না করে উপায় আছে?

কৌতুক অনুভব করে রেশমী বলে-বাপ্ রে, এ যে দেখছি জুলুম!

জুলুম নয়। আমি সব সমর্পণ করলাম আর তিনি দয়া করবেন না এমন কি হতে পারে?

রেশমী বলে, সমর্পণ করা কি মুখের কথা? তোমার ঘর গেরস্থালি আছে না?

সেই কথাই তো বলছিলাম। ঘর গেরস্থালি তিনি আর রাখলেন কই?

কেন?

ওলাউঠোয় এক রাতে আমার ঘরের সবগুলো বাতি নিভে গেল। পড়লাম এসে ঠাকুরের পায়ের তলায়, বললাম, এক সার বাতি নিভিয়ে দিয়েছ, আর এক সার জ্বালিয়ে দাও, নইলে রইলাম এই পড়ে।

তার পর?

তার পর আর কি! ও ছেলে আমার দুষ্ট্রর শিরোমণি, জুলুম না করলে ওকে ধরতে পারা যায়? মা যশোদাকে কত কষ্টই না দিয়েছে ও? শোন নি সে-সব কথা?

এই সব অভিজ্ঞতার টুকরো কথা শুনতে শুনতে দিনে দিনে ধীরে ধীরে ক্রমে মদনমোহন কেমন যেন সত্য হয়ে ওঠে রেশমীর মনে। সে পরিবর্তনের সূত্র অনুসরণ তার সাধ্য নয়। শুধু এইটুকু বুঝল যে পুতুল হয়ে উঠল মানুষ, মানুষ হয়ে উঠল আত্মীয়। যখন সে মদনমোহনের বাড়ি থেকে ফিরে আসে, মনের কোণে জেগে থাকে অন্ধকার আকাশের কোণে শুক্লা তৃতীয়ার চন্দ্রকলার মত তার মধুর হাসিটুকু। হাসি নাকি এমনি মধুর হয়।

এখন তার এমন হয়েছে যে ঘরের কাজ করতে করতেও সেই হাসি, শ্রীঅঙ্গের সেই ভঙ্গি, আড়বাঁশির সেই বঙ্কিম ইঙ্গিত দেখতে পায়, গুন গুন করে গান ধরে, “ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণী অবনী বহিয়ে যায়।”

পাশের ঘর থেকে টুশকি হাসতে হাসতে বলে, কি সৌরভী, তোমাকে যে মদন মোহন পেয়ে বসল!

রেশমী বলে, না দিদি, তোমাদের মদনমোহনের বাহদুরি আছে।

কেমন?

রেশমীর মুখে প্রায় এসে গিয়েছিল যে, নইলে আমার মত পাত্রীর হাতে পড়া মেয়েকে–

সর্বনাশ! কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, নইলে আমার মত পাষাণ মেয়ের প্রাণে—

সৌরভী, তুমি পাষাণ মেয়ে, এই কথা আমাকে বোঝাতে চাও!

তাছাড়া আর কি?

তা হবে, পাষাণেও তো ঝরনা আছে।

তার পর বলে, বোন, সবটা মন মদনমোহনকে দিও না।

একটুখানি হাতে রাখব কার ভরসায়?

আর একজন যে আসবে। সে-ও অবশ্য মদনমোহন, কিন্তু ভাই মনটা যেন একটু ফরসা হয়।

রেশমী অনেকদিন পরে কৌতুকের অবকাশ পায়, বলে, হাঁ, ধোপর ইস্তিরি করা কাপড়ের মত, কি বল?

মন্দ কি?

কিন্তু কালো রঙটাও তো মন্দ নয়।

টুশকী বলে, দেবতার ভাল, মানুষে একটুখানি ফরসা চায়।

অত তুমি চাও, কি বল টুশকি দি?

চাই তো বটে, কিন্তু পাই কই?

রেশমী আর বেশি খোঁচায় না, কি জানি আবার কোন চোখের জল উৎস হতে বের হবে! এই কদিনের অভিজ্ঞতায় সে বুঝেছে চোখের জলের সমুদ্রের উপরে পালা সর পড়েছে, আর আমরা নির্ভয়ে বিচরণ করছি তারই উপরে। একটুখানি অসতর্ক আঘাতেই নীচের রুদ্ধ জল ছুটে বেরিয়ে আসে। সংসার ধীরপদ-প্রত্যাশী।

বাস্তবিক টুশকির কথাই সত্যি। প্রথমে অজ্ঞাতসারে, তার পরে জ্ঞাতসারে রেশমী এখন মদনমোহনময়। জনের জন্য যে প্রেম সে তুলে রেখে দিয়েছিল, ঘটনার রূঢ় হস্তক্ষেপে কলসী উজাড় হয়ে পড়ে গেল তা মদনমোহনের পায়ে।

রেশমী, আমার বাঁশি লুকিয়ে রেখেছ কেন, দাও।

বাঃ, আমি তোমার বাঁশি সুকোতে গেলাম কেন?

ফের চালাকি! সে জন্মের অভ্যাস এ জন্মেও ভোল নি দেখছি!

কোন্ জন্মের? শুধায় রেশমী।

মদনমোহন বলে, সে জন্মে ছিলে রাধা, এ জন্মে হয়েছ রেশমী! আমার কিছু অজান আছে নাকি।

আচ্ছা, দেব তোমার বাঁশি। আগে তোমার কুঞ্জের পথটা দেখিয়ে দেবে!

এই কথা! তাহলে দেবে আমার বাঁশি?

নিশ্চয়।

তাহলে দেব পথনির্দেশ; দাও বাঁশি।

ও চালাকি চলছে না, আগে পথ দেখাও।

ঐ দেখ আমার কুঞ্জের পথ।

শোরগোলে একসঙ্গে রেশমী ও টুশকির ঘুম ভেঙে গেল। দুজনে শুনতে পায় অদূরে গঙ্গাতীরে ঢাকের বাজনার সঙ্গে অনেক নরনারীর কণ্ঠ। স্বপ্নের বিবরণ ভুলে গিয়ে রেশমী শুধায়, এত রাতে ও কি হচ্ছে দিদি?

টুশকি জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে বলে, কোন পুণ্যবতী স্বর্গে চলল।

মরেছে বুঝি?

না বোন, পতির চিতায় উঠতে চলল।

বিস্ময়ে রেশমী বলে ওঠে, সহমরণ!

তাই তো মনে হচ্ছে।

চল দেখে আসি।

দুজনে বেরিয়ে গঙ্গাতীরে যায়।

গঙ্গাতীরে জলের ধারে সজ্জিত চিতায় নববস্ত্রপরিহিত যুবকের দেহ শায়িত। রোরুদ্যমান আত্মীয়স্বজনের বহমধ্যে রক্টাম্বরা মাল্যভূষিতা কিশোরী বধু দয়মান। ইতস্তত দর্শকের ভিড়। রেশমী আর টুশকি গিয়ে একান্তে দাঁড়াল।

রেশমীর সেদিনের কথা মনে পড়ল, যেদিন মৃত্যুভয়ে চিতা থেকে পালিযেছিল। কিন্তু আজ ঐ কিশোরীর মুখে ভয়ের কোন চিহ্ন দেখতে পেল না সে। রেশমী ভাব যুবক স্বামীকে ছেড়ে তার বেঁচে থাকা নিরর্থক মনে করেই সে অকুতোভয়; হয়তো যুবক স্বামী হলে সে-ও এমনি অকুতোভয় হত; কিন্তু ক্ষণেকমাত্র পরিচিত বৃদ্ধের জন্য কেন যাবে সে মরতে। মরবারও একটা সার্থকতা চাই তো!

কিশোরী বধু গুরুজনদের প্রণাম করে, খই আর কড়িবৃষ্টির মধ্যে অবিচলিত পদে অগ্রসর হয়ে চিতায় উঠল। নবোদ্যমে বেজে উঠল শখ, কাঁসর, ঢাক। চিতায় অগ্নি পৃষ্ট হল। একবার আগুনের হকার মধ্যে দেখা গেল তার ঈষৎ আনত মুখ। সেদিকে আর তাকাবার সাহস হল না রেশমীর, সে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকল, জলে অগ্নিময় সেতু বিস্তারিত।

তার পর কখন যে টুশকি তার হাত ধরে টেনে বাড়িতে নিয়ে এসেছে তার মনে পড়ে না। শয্যার শুয়ে শুয়ে তার স্বপ্নের কথা মনে পড়ল, মনে হল মদনমোহন স্বপ্নের পথ বুঝি বাস্তবে নির্দেশ করে দিলেন। সে ভাবল ঐ তো তার পথ। তার পর মনে পড়ল পাড়ার মেয়েদের দুর্দৈব। তখন মনে হল তার সম্মুখে দুটো পথ আছে—এক মোতি রায়ের মত লোকের বাগানবাড়িতে আর এক ঐ চিতাগ্নিতে। মনে হল এক-তরফ তার বেছে নিতে হবে। চিতাগ্নি যদি চিরকালের জন্য নিভে গিয়ে থাকে তবে তো ঐ বাগানবাড়ির পথটাই মাত্র উন্মুক্ত। এইরকম এলোমেলো কত কি ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল।

জীবনে সুখ সৌভাগ্য একবার মাত্র আসে। জীবনে সুখের পুনরাবৃত্তি ঘটে না। রেশমী সেই অসম্ভবের আশায় উদ্যত।

পরদিন নীরবে আপনমনে সে কাটিয়ে দিল। বিকালবেলায় আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে সে চমকে উঠল। চিতাগ্নির শিখা কি তাকে স্পর্শ করেছে, এমন বিবর্ণ শুষ্ক কেন তার মুখ?

মদনমোহন দর্শন করতে গিয়ে মনে মনে সে কেবলই বলতে লাগল, ঠাকুর, ঠাকুর, হয় শক্তি দাও নয় পথ দেখিয়ে দাও, নইলে মাথা কুটে মরব তোমার পায়ের কাছে।

সেই বুড়িটি তাকে হাত ধরে কাছে বল, বলল, কি ভাবছ মা?

রেশমী জল-ভরা চোখে অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে। কি উত্তর দেবে?

বুড়ি বলল, বুঝেছি মা, তুমি অল্প বয়সে অনেক দুঃখ পেয়েছ। দেবে, দেবে, ঠাকুর শাস্তি দেবে, কেবল খুব জোর করে চেপে ধরা চাই।

তার পরে স্নেহের হাসি ঝরিয়ে বলল, ও আমার দুষ্টর শিরোমণি কিনা। কিন্তু এমন দয়ালও আর নেই।

তার কথার সমর্থনে রেশমীর দুই চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।

.

৪.০৮ হংসত

জনের মুন্সী কাদির আলী জনকে বৃথা সান্ত্বনা দেয়নি। রেশমীকে খুঁজে বের করবার উদ্দেশ্যে অফিসের দারোয়ান, চাপরাসী, ছোকরাদের সে নিযুক্ত করেছিল। সকলেই রেশমীকে চিনত, রেশমী অফিসে দু-তিন দিন কাটিয়েছিল। কাদির আলী তাদের বলে দিয়েছিল, রেশমী বিবির সন্ধান এনে দিতে পারলে জন সাহেবের কাছে ইনাম মিলবে। বকশিশের লোভে তারা সবাই অবসর সময়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াত। অবশেষে একদিন গঙ্গারাম বলে এক ছোকরা মদনমোহনতলায় টুশকির বাড়িতে রেশমীর দেখা পেল।

সে একগাল হাসি হেসে প্রকাণ্ড এক সেলাম করে দাঁড়াল।

রেশমী তাকে চিনতে পেরে বলল, গঙ্গারাম যে!

গঙ্গারাম বলল, হাঁ মাঈজি।

গঙ্গারাম খুব ভদ্র ও বিনীত ভাবে কথাবার্তা বলতে শুরু করল রেশমীর সঙ্গে। কাদির আলীর কাছে জন সাহেবের সঙ্গে তার সম্বন্ধটা ইশারায় জেনেছিল সে।

রেশমী বলল, হঠাৎ যে? এদিকে কোথায় এসেছিলে?

কোথায় আর আসব, আপনাকে খুঁজতে আমরা চারিদিকে সব বেরিয়েছি।

আমাকে খুঁজতে!

কেমন যেন বিস্ময়বোধ করে রেশমী। তার পরে তার মনে পড়ে এখন সকলেই তার সন্ধান করছে, এদিকে মোতি রায়, ওদিকে জন। বিস্ময়ের সঙ্গে যুক্ত হয় একটু গৌরবের ভাব।

সে বলে, আমাকে কেন খুঁজছ?

কি যে বলছেন মাঈজী, আপনার জন্যে সাহেব যে বাউরা হয়ে গেল।

কে, জন সাহেব?

আর কে, বলে গঙ্গারাম।

রেশমীর মনে শুকনো পাতার তলে ফুল ফোঁটা শুরু হয়ে যায়। মনের উতলা ভাব দমন করে উদাসীনভাবে শুধায়, সাহেবের হুকুম কি?

আপনার দেখা পেলে পালকি করে নিয়ে যেতে।

রেশমী লঘুভাবে বলে, পালকি এনেছিস নাকি?

আপনার হুকুম হলেই নিয়ে আসি।

রেশমী বলে, এখন তো যেতে পারব না।

গঙ্গারামের মুখ গম্ভীর হয়, ইনাম বুঝি ফসকে যায়। তবু সে আর একবার চেষ্টা করে-তবে কখন পালকি নিয়ে আসব?

তাকে বিদায় করে দেবার আশায় রেশমী বলে, সে কথা পরে জানাব।

গঙ্গারামের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। তারপরে ভাবে, খুব সব সাহেব ও বিবির মধ্যে প্রণয়-কলহ চলছে। এমন হয়ে থাকে বলে সে শুনেছে। তার মনে পড়ে হরিরামের মাকে বিয়ে করবার আগে সে কতবার তার সঙ্গে ঝগড়া করেছে, গাল দিয়ে বিদায় করে দিয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ে না করে তো পারে নি। নিজের অভিজ্ঞতার সাকে তার মনটা হাল্কা হয় বুঝতে পারে ইনামটা ফসকে যাবে না। তবে এক্ষেত্রে কিছু যেন বাড়াবাড়ি। ভাবে, বড় ঘরের বড় কথা।

সে বলে, তবে একখানা চিঠি লিখে দিন।

না, চিঠিও দেব না।

গঙ্গারাম মাটিতে মিশে যায়। তার দীন ভাব লক্ষ্য করে রেশমী বলে, কাল ঠিক এই সময়ে এসো, চিঠি লিখে রেখে দেব।

অগত্যা গঙ্গারাম আর একটা দীর্ঘ সেলাম করে প্রস্থান করে।

এই সময়টা টুশকি বাড়ি থাকে না, বাজারে যায়; ভাগ্যে গঙ্গারাম সেই সময়ে এসেছিল।

বহুপূর্বে দৃষ্ট স্বপ্নের মত জনের কথা রেশমীর মনে পড়ে যায়। কদিনের ব্যবধানে সে স্মৃতি আজ কত যুগ দূরে গিয়ে পড়েছে। মানুষ একই সময়ে হাজার কালের মধ্যে বাস করছে, কোনটা সাপের মত কুণ্ডলীকৃত একটুকু, কোনটা সাপের মত লম্বিত এতখানি! কাল যে নাগ!

গঙ্গারাম চলে যাওয়ার পরে মনের অবস্থা বিচার করবার জন্যে রেশমী গিয়ে নিভৃতে বসল, তখনও টুশকি ফেরেনি। জন তাকে ভোলে নি, তাকে না পেয়ে ‘বাউরা’ হয়ে গিয়েছে, তাকে খুঁজতে চারদিকে লোক পাঠিয়েছে, সে আঙুল তুললে এখনই জন এসে পায়ে লুটিয়ে পড়ে, চিন্তা করে আনন্দমিশ্রিত গৌরব অনুভব করল। তার মনে পড়ল দ্রৌপদীর ছদ্মবেশে বিরাট-রাজগৃহে অবস্থানের ঘটনা। সে যেন দ্রৌপদী, এদিকে ওদিকে কীচকের অভাব নেই, ওদিকে তার রক্ষাকর্তাও আছে। সে নিরুপায় নয়, নিঃসহায় নয়। আঃ কি সান্ত্বনা, কি আনন্দ! এই কদিনে জনের স্মৃতি দূরে গিয়ে পড়ে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ আবার এক ঝাপটায় তা কাছে চলে এল। স্মৃতির আর এক দিগন্তে সে তাকিয়ে দেখতে পেল প্রত্যক্ষের তীর কত দুরায়িত! কে এই টুশকি? কে ঐ মদনমোহন? আর কেই বা মোতি রায়? কোথায় ছিল এরা কদিন আগে? কেরী আর রাম বসুই তো রক্ষা করেছে তাকে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে, ভরণপোষণ করে শিক্ষা দিয়েছে, নইলে আজ তার কি গতি হত! আর রোজ এলমার! নিদাঘের গোলাপের মত শুকিয়ে গেল সে। আর জন! বালকের মত অসহায়, যৌবনে দীপ্যমান, শিশুর মত পরনির্ভর, প্রেমে করুণ। তার প্রতিটি কথা প্রতিটি ভঙ্গি স্মৃতির রঙে উজ্জ্বলতর হয়ে চোখে পড়তে লাগল। কথা বলার সময়ে তার ঠোঁটের দুই কোণে দুটি খাঁজ পড়ত, নীলাভ সূর্যের কিরণ কুড়িয়ে নিয়ে ঝলমল করে উঠত তার চোখ, আর রক্তাভ ওষ্ঠাধরে চুম্বনের যে ফুল প্রস্ফুটিত তার সৌগন্ধ ও কণ্টক তাকে উদ্ভ্রান্ত করে তুলল। এমন কি সেই কণ্টকটাও!

জন একদিন বলেছিল, রেশমী, তুমি আমার জন্যে সব ত্যাগ করতে চললে?

রেশমী বলেছিল, কি আছে আমার যে ত্যাগ করছি?

পৈতৃক ধর্ম।

আমার ধর্ম তুমি।

আমি! বিস্ময়ে বলে জন।

প্রত্যেক লোকে নূতন করে নিজের ধর্মকে লাভ করে, আমি লাভ করেছি তোমাকে।

কিন্তু পৈতৃক ধর্ম বলে কিছুই নেই?

রেশমী বলে, পৈতৃক ধর্মের চেয়ে স্বধর্ম বড়।

এত কথা রেশমীর জানবার নয়, কিন্তু মনের মধ্যে প্রেমের গীতা অবারিত হয়ে গেলে নিরক্ষরেও প্রজ্ঞা লাভ করে।

রেশমী বলে, ধর্মের চেয়ে প্রেম বড়।

বলে, প্রেমের জন্যই ধর্ম। আমি যদি এক লাফে ধর্মকে ডিঙিয়ে প্রেমকে পেয়ে থাকি, সে তো মস্ত লাভ। তার কথায় বিস্মিত জন বলে, রেশমী, তুমি এমন সব গভীর তত্ব জানলে কি করে? তোমাদের দেশের লোকের কাছে দুরূহ দার্শনিক তত্ত্ব অত্যন্ত সহজ।

রেশমী বলে, তা নয় জন, হৃদয়ে প্রেম প্রবেশ করলে আপনি সব সহজ হয়ে যায়। যার ও অভিজ্ঞতা ঘটে না, তারই জন্যে প্রয়োজন দর্শনের। চক্ষুষ্মান আপনি দেখতে পায়, অন্ধকে দেখিয়ে দিতে হয়।

এসব কথার উত্তর জনের মাথায় আসে না, সে চুপ করে থাকে।

তখন রেশমী বলে, তুমি আমার জন্যে যা ত্যাগ করতে উদ্যত—

জন বাধা দিয়ে বলে, আমি কি ত্যাগ করলাম?

আমাকে বিয়ে করলে আত্মীয়স্বজন তোমাকে ত্যাগ করবে, হয়তো সমাজেও তোমার স্থান হবে না।

কিন্তু তার বদলে আমি কি পাব ভেবে দেখেছ?

কি এমন পাবে?

জন মুখটা আগিয়ে নিয়ে যায়। রেশমী একেবারে অনুমান করে নি তা নয়, কৌতুকবিলাসে পিছিয়ে যায় সে।

সেদিনকার সেই ব্যর্থ চুম্বন নলের হংসদূতের মত দুই শুভ্র তপ্ত কোমল পক্ষপুটে আচ্ছন্ন করে, শম্প-মৃদু গ্রীবাটি রাখে রেশমীর গ্রীবায়। রেশমীর সমস্ত দেহ রী রী ঝিম ঝিম করতে থাকে, বেদনাময় আনন্দের নীহারিকায় সে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ব্যর্থ চুম্বন দুর্ভাগ্যের মত নিদারুণ।

সে সঙ্কল্প করে একটু সময় পেলেই জনকে চিঠি লিখে রাখবে। মদনমোহনের ছবি আঁকবার জন্য টুশকিকে বলে সে কাগজ কালি আনিয়ে নিয়েছিল।

অনেক রাতে ভগ্ননিদ্রা রেশমী শুনতে পায় নারীকণ্ঠের সেই পুরাতন আর্তনি; ভাবে, আঃ এর কি-আর শেষ হবে না! নারীকণ্ঠ মিলিয়ে যাওয়ার পরে প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে ওঠে চাপা গুঞ্জন—কোন পোড়ারমুখী এল পাড়ায়, সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল। ‘দেখা পেলে চুলের মুঠি ধরে নিয়ে হাজির করে দিই মোতি রায়ের বাগানবাড়িতে, পাড়ায় শান্তি ফিরে আসে!’ ইত্যাদি।

হঠাৎ রেশমীর মনে হল, ঘরে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে এখন কি তার জনের কাছে ফিরে যাওয়ার অধিকার আছে? তখনই তার আবার মনে হয়—এ দুস্কৃতির দায়িত্ব মোতি রায়ের—সে কেন এ দায় বহন করে নিজের সুখ-সৌভাগ্য বিসর্জন দিতে যাবে? জীবনে সুখসৌভাগ্য কত বিরল, আজ যদি তা জনের সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিয়ে থাকে, তবে তা প্রত্যাখ্যান করা কি উচিত হবে? আর মোতি রায়ের এ রকম ব্যবহার তো নূতন নয়, আগেও হয়েছে, পরেও হবে—তার কি দোষ? রেশমী সঞ্চয় করে, না, আর বিলম্ব নয়, কাল সকালে গঙ্গারাম এলে জনকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেবে তাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে। তখনই ঐ নারীকণ্ঠের স্মৃতি মনে পড়ে। সে কেমন দোমনা হয়ে যায়। অবশেষে পড়ে ঘুমিয়ে।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে রেশমী। সে আর জন পাশাপাশি শয্যায় শুয়ে আছে, সুখসুপ্তিপ্রফুল্ল জনের মুখ। সে মাথা উঁচু করে জনের মুখ চুম্বন করতে যাবে এমন সময় দেখে যে মশারিতে আগুন লেগে গিয়েছে। মুহূর্তকাল স্তম্ভিত থেকে জনকে ধাক্কা দেয়, জন, ওঠ ওঠ, আগুন! জন ওঠে না, নড়ে না। সে তড়াক করে শয্যা পরিত্যাগ করে নামে, জনের হাত ধরে টানাটানি করে, কিন্তু জন নিশ্চল। তার সম্মুখে শয্যাসু জন পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কে লাগাল আগুন? ঘরে তো দীপ ছিল না। বাইরে থেকে তাবে কেউ এল কি? দরজা খোলা কেন? হঠাৎ দরজায় চোখ পড়ে, সেখানে কে একজন যেন দাঁড়িয়ে। এগিয়ে গিয়ে দেখে যে-মদনমোহন।

আগুন লাগল কেন?

তুমি কত ঘরে আগুন লাগিয়েছ!

শোন শোন–

আর কোন কথা না বলে রহস্যময় হাসি হেসে অন্তর্হিত হয়ে যায় মদনমোহন।

ঘুম ভেঙে যায় রেশমীর। এ কি দুঃস্বপ্ন! তখনই মনে হয়, এ কি স্বপ্ন না স্বপ্নময় ইঙ্গিত? শয্যায় উঠে বসে রেশমী। মদনমোহনের উপরে কেমন একটা বিদ্বেষ অনুভব করে সে। কিন্তু যে দেবতা অদৃশ্য, অর্থাৎ মনের মধ্যে, তার প্রতি বিদ্বেষ ফিরে এসে ঘা দেয় অন্তরে। নিজের চোখে নিজেকে ঘৃণিত বলে মনে হয়। কিন্তু কেন, কি তার দোষ? চিন্তার সূত্র তাকে বলে দেয় জনের কাছে ফিরে যাওয়া বোধ করি মদনমোহনের অভিপ্রেত নয়। জনকে চিঠি লিখে সম্মতি জানাবার সঙ্কল্প তার শিথিল হয়ে আসে।

সকালবেলায় টুশকি বাজারে বেরিয়ে গেলে জনকে চিঠি লিখতে বসে। রেশমীর সংক্ষিপ্ত চিঠি, শেষ করতে সময় লাগল না। সে লিখল–

“জন,

তুমি আমাকে ভুলে যেয়ো। এতদিনে আমি মদনমোহনকে পেয়েছি। এখন সে ই আমার সুখ, শান্তি, স্বামী। অন্য কোন লোকের সঙ্গে আর কোন সম্বন্ধ সম্ভব নয়। তুমি বিয়ে করে সুখী হও এই প্রার্থনা করব। অনেক অনেক ধন্যবাদ। রেশমী।”

চিঠি শেষ হওয়ামাত্র গঙ্গারাম এসে উপস্থিত। পাছে শেষ মুহূর্তে নূতন সঙ্কল্প বদলে যায়, তাই রেশমী তখনই চিঠিখানা তার হাতে দিয়ে তাকে বিদায় করে দিল। জন সাহেবের বকশিশ হস্তগত হয়েছে ভেবে একগাল হাসি হেসে গঙ্গারাম ছুটল অফিসের দিকে। আর রেশমী ঘরে প্রবেশ করে গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করতে গিয়ে কান্নার ভারে ভেঙে লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর।

.

৪.০৯ শক্ত সরাব

কাদির আলীর প্রতিশ্রুতিকে জন গতানুগতিক প্রবোধবাক্য মাত্র মনে করেছিল তাই তার উপরে বিশেষ আস্থা স্থাপন করে নি। সত্য বলতে কি, কথাটা ভুলেই গিয়েছিল সে। এ কয়দিন সে অফিসেই রাত্রিযাপন করেছে, দিনমান তো বটেই। লিজা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে দু-তিন দিন এসেছে, ক্ষমা প্রার্থনা করেছে, বাড়ি ফিরে যেতে অনুরোধ করেছে, কিন্তু জন সে কথায় কর্ণপাত করে নি।

লিজা বলেছে, জন, তুমি আমার কথা ভুল বুঝেছ।

জন বলেছে, লিজা, আমার ভাষাজ্ঞান মোটামুটি রকম সাধারণের মত, অতএব ভুল বোঝবার সম্ভাবনা কোথায়?

লিজা বলেছে, ভাষাজ্ঞানের অভাবে নয়, তোমার মনটা বিকল্প ছিল বলে ভুল বুঝেই।

মন বিকল থাকবার কথায় তার মনটা অধিকতর বিকল হয়ে গিয়েছে, বলেছে, মন বিকল কেন হতে যাবে, আর কি করেই বা তা বুঝতে তুমি?

লিজা বুঝেছে এ পথে তর্ক চললে আবার তা কলহে পরিণত হবে। তাই সে নিজের ত্রুটি স্বীকার করে বলেছে, স্বীকার করছি আমি ভুলে বুঝছিলাম, এখন বাড়ি ফিরে চল, বাড়ি তোমার।

বাড়ি আমার!

বিক্ষুব্ধ হয়ে জন বলে ওঠে, যে বাড়িতে আমি অপম্মনিত হই সে বাড়ি আমার!

লিজা বলে, ধর তুমি যদি অপমানিত হয়েই থাক, বাড়ির কি দোষ?

কি মুশকিল, বাড়ির দোষ দিচ্ছে কে? বাড়ি কি কথা বলে?

আমার যদি দোষ হয়েই থাকে, আমি তো বারংবার ক্ষমাপ্রার্থনা করেছি।

জন তার ক্ষমাপ্রার্থনার উপর জোর না দিয়ে বলে ওঠে, যদি তুমি দ র থাক।

নিশ্বাসের সবটা জোর গিয়ে পড়ে ‘যদি’ শব্দটার উপরে। তার পরে সে একটা সিগারেট ধরায়। জ্বলন্ত সিগারেট অনেক সমস্যাকে চাপা দিতে পারে।

সেদিন ঐ পর্যন্ত।

পরে আরও দুইদিন ভাইবোনে এইভাবের কথাবার্তা হয়েছে কিছু জনের মন টলে নি।

জনের মন সত্যই বিকল হয়ে গিয়েছিল, নইলে সে এমন কঠোর প্রকৃতির নয়। জন অব্যবস্থিতচিত্ত যুবক। ও গুণটার প্রকৃতি এই যে যখন কঠোর হয় অস্বাভাবিক ভাবেই

নিরুপায় লিজা মেরিডিথের কাছে গিয়ে পরামর্শ চেয়েছে। মেরিডিথ সব শুনে বলেছে, থাকতে দাও না, দু-চার দিন থাকুক, সে তো আর জলে পড়ে নি।

তাই বলে বাড়ি ছেড়ে থাকবে?

ক্ষতি কি, অফিসে আরামের সব ব্যবস্থাই তো আছে।

তা অবশ্য আছে। কিন্তু বাড়িছাড়া হয়ে থাকলে লোকে আমাকে বলবে কি?

জনকে লোকে যা বলছে তার চেয়ে খারাপ বলবে না।

লিজা শুধায়, লোকে জনকে নিয়ে বলাবালি শুরু করেছে?

করবে না? এমন একটা সুযোগ পেয়েছে!

কি বলছে বল, এ কদিন আমি কোথাও যেতে পারি নি।

মেরিডিথ বলে, আর গেলেও কি তোমার সম্মুখে কিছু বলত!

তোমার সম্মুখে তো বলেছে। এখন বল আমাকে।

লোকে বলেছে, মেরিডিথ আর লিজা মিলে চক্রান্ত করে জনকে বাড়ি থেকে বিদায় করে দিয়েছে।

চমকে ওঠে লিজা। তোমার সঙ্গে চক্রান্ত করে? কিন্তু তোমার সঙ্গে চক্রান্ত করতে যাব কেন?

আমি নাকি তোমাকে বিয়ে করতে উদ্যত হয়েছি, এখন জনকে তাড়াতে পারলেই সম্পত্তিটা দুজনে মিলে ভোগ করতে পারব।

লিজা রাগের মাথায় বলে, যারা এমন বলে তারা নরকস্থ হক।

বিয়ের কথাটা সুদ্ধ?

লিজা বলে, তুমি তাদের প্রশ্রয় দিয়েই।

বিয়ের কথায় অবশ্যই প্রশ্রয় দিই নি।

তবে সম্পত্তি ভোগ করবার কথায় দিয়েছ।

বিয়ে না হলে সম্পত্তি ভোগ করবার কথাই ওঠে না।

মেরিডিথ, এখন লঘু পরিহাস রাখ।

পরিহাস কোনটা?

সবটাই।

বিয়ের কথাটা সুদ্ধ? ও মাই গড!

হেসে ফেলে লিজা বলে, তবু ভাল যে, তোমার মুখে গড় শব্দটা বের হল!

জান তো লিজা, প্রয়োজনকালে শয়তানও শাস্ত্র আওড়ায়।

তুমি কি শয়তান?

সে যোগ্যতা কই! তবে তার চেলা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখি বটে!

বিস্মিত লিজা বলে ওঠে, কি বলছ মেরিডিথ?

মেরিডিথ বলে, শয়নানের চেলারা তোমার ধর্মধজীদের চেয়ে অনেক ভাল।

কেন?

সবাই জানে তারা মিথ্যা কথা বলে। কিন্তু ধর্মধ্বজীদের মত সময়ে সত্য সময়ে মিথ্যা কথা বলে লোককে বিভ্রান্ত করে না।

যে যা বলে বলুক, এখন জনকে নিয়ে কি করি বল?

কিছুই কর না, সময়বিশেষে সেইটেই শ্রেষ্ঠ পন্থা।

সাময়িক ভাবে মেরিডিথের পরামর্শ লিজা মেনে নিয়েছিল, কিন্তু আবার দিন কয়েক পরেই জনের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল।

তাতেও কোন ফলোদয় হয় নি।

জন রেশমীকে খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। তার ধারণা হয়েছিল যে রেশমী হয় মারা গিয়েছে নয় এমন স্থানে যেতে বাধ্য হয়েছে যেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়। জন বুঝল যে, সে এখন কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজের উপহাসের পাত্র; বুঝল যে, এমন কৃপার পাত্র হয়ে তার কলকাতায় থাকা সম্ভব নয়। কি করা যায়, ভাবতে ভাবতে তার চোখে পরিত্রাণের একটা উপায় পড়ল। আর্থার ওয়েলেসলির হস্তক্ষেপে মহীশূর যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল বটে কিন্তু পেশবার সঙ্গে শীঘ্রই যুদ্ধ বেধে উঠবে এমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। যুদ্ধ সত্যই বেধে উঠলে ননকমিশন্ড অফিসার হিসাবে যোগদান করা যায় কি না সেই চেষ্টায় সে নিযুক্ত হল। তার মনে হল যুদ্ধ উপলক্ষে কিছুদিন অন্যত্র ঘুরে এলে গ্লানি দুর হতে পারে। আর যুদ্ধে যদি মৃত্যু হয় তবে তো সব আপদ চুকে যায়। তখন তার মনে জীবনের চেয়ে মৃত্যু বাঞ্ছনীয়।

সেদিন সরকারী অফিস থেকে সবে তদ্বির করে সে ফিরেছে, তার প্রার্থনা পূরণ হওয়া অসম্ভব নয় আশ্বাস পাওয়ায় তার মন অনেকটা সুস্থ, এমন সময়ে গঙ্গারামকে নিয়ে কাদির আলী এসে সেলাম করে দাঁড়াল।

কি কাদির আলী, খবর কি?

প্রশ্নটা নিতান্ত গতানুগতিকভাবেই করল, তার আশ্বাস জন ভুলেই গিয়েছিল।

হুজুর, রেশমী বিবির সন্ধান মিলেছে।

কথাটা শুনেও অর্থবোধ হল না জনের, শুধাল, কি মিলেছে?

হুজুর, রেশমী বিবিজির পাত্তা মিলেছে।

জন মূঢ়ের মত শব্দগুলোর আবৃত্তি করল, রেশমী বিবিজির পাত্তা মিলেছে!

জী হুজুর।

দু-চার মুহূর্ত গেল জনের শব্দগুলোর অর্থ গ্রহণ করতে, তার পরেই ব্যাকুলভাবে চীৎকার করে উঠল, কোথায় সে? এনেছ তাকে? শীগগির বল কোথায়?

তখন কাদির আলী বিস্তারিতভাবে অনুসন্ধানপর্বের বর্ণনা শুরু করল। সে যে বৃথা সান্ত্বনা দেয় নি, বিবির সন্ধানে কলিঙ্গাবাজার, ডিঙিভাঙা, ডিহি ভবানীপুর, পটলডাঙা, বাগবাজার সব জায়গায় লোক পাঠিয়েছিল তা বলল; বলল, অনেক তকলিফ করেছে তার লোকজন; বলল, আজ কদিন তাদের আহার নিদ্রা বন্ধ।

জন অকালে তার বর্ণনা থামিয়ে দিয়ে বলল, ও সব কথা থাক, এখন বল কোথায় আছে বিবি?

কাদির আলী আবার বর্ণনা শুরু করল। গঙ্গারাম দেখল যে তার কৃতিত্ব মিঞা গ্রাস করবার চেষ্টায় আছে, হয়তো বা বকশিশটাও গ্রাস করবে, তাই সে বলে উঠল, হুজুর, বিবিজি বাগবাজারে আছে।

কে দেখেছে?

কাদির আলী মুখ খুলতেই গঙ্গারাম বলে উঠল, হুজুর, আমি দেখেছি।

তাকে নিয়ে এলে না কেন?

এ প্রশ্নের হঠাৎ কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না গঙ্গারাম।

কাদির আলী তার মৃঢ়তার সূত্র কুড়িয়ে নিয়ে আরম্ভ করে, হুজুর, অমনি কি বিবিজানকে আনা যায়? সে এখন ডাকুলোকের কাছে নজরবন্দী হয়ে আছে।

জনের কাছে সে শুনেছিল যে ডাকুলোক রেশমীকে জোর করে কেড়ে নিয়ে এসেছে।

ডাকুলোকের কাছে নজরবন্দী!

জনের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। টেবিলের দেরাজা থেকে পিস্তলটা বের করে নিয়ে সে বলে, এখনই যাচ্ছি আমি।

কাদির আলী বলে, তাতে দাঙ্গাহাঙ্গামা হবে, ডাকুলোকেও গুলি ছুঁড়বে—

জন গর্জে ওঠে, ননসেন্স।

কাদির বলে, বিবির গায়েও গুলির লাগতে পারে।

জন টেবিলের উপরে পিস্তলটা রেখে দিয়ে বলে, তবে উপায়?

উদ্যতবচন গঙ্গারামকে থামিয়ে দিয়ে কাদির আলী বলে, একটু কৌশল করতে হবে।

কি কৌশল?

সেটা বিবি কাল চিঠি লিখে জানাবে।

চিঠি লিখবে এইটুকু জানিয়েছিল গঙ্গারাম, বাকিটুকু কাদির আলীর মস্তিষ্কপ্রসূত। দোষ দেওয়া যায় না তাকে। বিবি যখন চিঠি লিখবে বলেছে তখন তাতে পলায়নের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কি থাকবে, ভেবেছিল কাদির আলী।

জন সরাসরি গঙ্গারামকে শুধায়, বিবি আস্থা হ্যায়?

গঙ্গারাম বলে, তবিয়ত আচ্ছা হয়, লেকিন—

কি বলবে ভেবে পায় না, কাদির আলী সমস্যা পূরণ করে বলে, লেকিন দিল তো বহুত খারাপ হ্যায়।

উজ্জ্বল হয়ে ওঠে জনের মুখ।

জন গঙ্গারামকে বলে, কাল খুব ভোরে গিয়ে বিবির চিঠি নিয়ে আসবে, বকশিশ মিলবে।

বকশিশটা মধ্যপথে লুফে নিয়ে কাদির আলী বলে, হুজুরকে সেজন্য ভাবতে হবে, আমার হাতে দিলে সব ঠিক ঠিক দিয়ে দেব।

গঙ্গারাম বিদায় নিতে নিতে ভাবে, কি আপদ! সংসারে সুবিচার বলে কিছু নেই। কাজ করে একজন, বকশিশ পায় অপরে।

তারা বিদায় হয়ে গেলে দরজা বন্ধ করে দেয় জন, তার পরে নতজানু হয়ে প্রার্থনা শুরু করে। কিন্তু কি বলে প্রার্থনা করবে সে! জন হচ্ছে মেরিডিথের দলের লোক; গির্জা, ভগবান, প্রার্থনা, ধর্ম এসব তাদের কাছে দূরত কিংবদন্তী। সে হঠাৎ আবিষ্কার করে যে প্রার্থনার রীতিপ্রকৃতি তার জ্ঞানের অতীত। বাইবেলখানা খুলে মুটের মত পাতা ওলটাতে থাকে, হঠাৎ খুলে যায় পরবাসবন্দিনী রুথের কাহিনী।

মূঢ়ের মত আবৃত্তি করে যায় কাহিনীটি, শব্দাবলী মুখে মুখে এগিয়ে যায়, অর্থ খুঁড়িয়ে চলে পিছনে পিছনে, মুখে মনে মিল ভেঙে গিয়েছে জনের। বিদেশে বিয়ে হয়েছিল সুন্দরী রুথের। অল্পদিন পরে স্বামী গেল মারা। শাশুড়ী বলল, বাছা, আমার সাধ্য নেই তোমাকে ভরণ-পোষণ করবার, যাও তুমি স্বদেশে তোমার স্বজনগণের মধ্যে। রুথ বলে, সেখানে কোথায় আমার স্থান? তখন দুজনে কাজ করে অপরের শস্যক্ষেত্রে। ক্ষেত মালিকের ছেলের ইচ্ছা রুথকে করে বিয়ে।

কোন্ দুয়ে নিয়মে পৌরাণিক কাহিনী মিলে যায় আধুনিক বাস্তবের সঙ্গে। রুথ হয়ে দাঁড়ায় রেশমী; জন মুখে বলে-বুথ, মনে ভাবে-রেশমী। হঠাৎ কখন মন ছাপিয়ে গিয়ে ওষ্ঠাধর গুঞ্জরণ করে ওঠে-রেশমী। শব্দটি কানে প্রবেশ করবামাত্র সজাগ হয়ে ওঠে জন। বাইবেল রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে, ছায়া পড়ে আয়নায়।

পোশাকের অবস্থা দেখে শিউরে ওঠে—এতদিন এই বেশে শহরে ঘোরাঘুরি করেছে সে! কোট প্যান্টালুন শার্ট সমস্ত মলিন, সমস্ত দীন, সমস্ত কেমন লক্ষ্মীছাড়া! পোশাক বদলাতে চলে যায় তখনই।

কিছুক্ষণ পরে যখন পোশাক বদলে আয়নার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়, মুখে তার হাসি। তাকে দেখলে রেশমীর মুখে যে হাসি ফুটত এ তারই প্রতিচ্ছবি। মনে পড়ে তার রেশমীর কথা।

রেশমী বলত, জন, তোমার হাসিটি বড় মিষ্টি।

তোমার চেয়েও? শুধাত জন।

নিশ্চয়, মেয়েদের চেয়ে পুরুষের হাসি অনেক বেশি মিষ্টি।

এ যে দেখি উল্টো কথা! মোটেই উল্টো নয়, বলে রেশমী।

সে বলে যায়, মেয়েরা স্বভাবতই মিষ্টি, হাসি আর বেশি মিষ্টি হবে কি করে? স্বভাব-কঠিন পুরুষের মুখে হাসি অপ্রত্যাশিত, তাই মিষ্টি।

আর স্বভাবকোমল মেয়েদের মুখে রাগটি বুঝি বেশি মিষ্টি? শুধায় জন।

ঠিক ধরেছ, ঠিক যেন কোমল আঙুলে হীরের আঙটি।

জনের বিস্ময়ের অবধি থাকে না, রেশমী এতও জানে!

কাল সকালে গঙ্গারাম আনবে রেশমীর চিঠি। অপেক্ষায় দীর্ঘায়িত রাতটা আর কাটতে চায় না জনের। বারে বারে ঘড়ি দেখে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না ঘড়ির উপরে, হাজার হক মানুষের তৈরি তো, নির্ভুল নয়; জানালার ফাঁকে তাকিয়ে দেখে আকাশের তারাগুলো, ওগুলোর ভুল হওয়ার কথা নয়। কোথাও সমর্থন পায় না তার মন। মানুষ থেকে শুরু করে গ্রহনক্ষত্র সমস্ত যেন ষড়যন্ত্র করেছে তার বিরুদ্ধে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে একখানা বই তুলে নেয়। দু পৃষ্ঠা পড়বার পরে কাহিনীর দেয়ালে ফাটল ধরে, ফাটল ক্রমে চওড়া হয়ে দেখা দেয় করুণা-কৌতুকে সমুজ্জ্বল একখানি মুখ।

কি দেখছ রেশমী?

দেখছি মানুষ কত বোকা হতে পারে।

সারাদিন আমাকে বোকা বলে টীজ কর কেন? এমন কি নির্বোধ আমি সত্যি করে বল তো?

ও বলে বোঝানো যায় না।

তাহলে বুঝিও না। আর বলে যদি খুশি হও তবে না হয় বল, আমি আর বাধা দেব না।

যাক এটা তবু বুদ্ধিমানের মত কথা, বলে রেশমী।

তবে তো ভুল হয়ে গেল দেখছি, আবার বোকার মত ব্যবহার করা যাক

এই বলে সে রেশমীর হাত ধরে টান দেয়, রেশমী পিছিয়ে যেতে চায়, কিছুক্ষণ দুজনের খুব টানাটানি চলে। অবশেষে এক সময়ে রেশমী আত্মসমর্পণ করে। সে ইচ্ছা কিছু কম হলে অনেকক্ষণ আগেই ধরা দিত। বাধা দিয়ে জনের মনকে ফেনায়িত করতে চায় সে।

আঃ কি কর, কি কর, হাড়।

রেশমী যখন ছাড়া পায়, ঝড়ে দোল-খাওয়া বসন্তের পুষ্পবনের মত তার চেহারা। গাছতলায় বিন্যস্ত রঙ্গন, পলাশ, রক্তকরবী; বিতান-পরিত্যক্ত মাধবীলতা ভূলুষ্ঠিত; পল্লবনিলীন পুষ্পস্তবক দস্যু হাওয়ার করক্ষেপে মর্দিত, পাণ্ডুকপেলি চমুকদল ছিন্নভিন্ন, বনানীর পত্রলেখা অবলুপ্ত, বসনাঞ্চল বিস্ত আর তার বক্ষের শিখরিণী হল তখন শার্দুলবিক্ৰীড়িতের উৎকট তালে সংস্পন্দিত।

জন ভাবে রেশমী ফিরে এলে কলকাতাতেই হবে তার দীক্ষা, আর লুকিয়ে-চুরিয়ে শ্রীরামপুরে বা অন্যত্র নয়। আর তার পরে বিয়েটা হবে সেন্ট জনের গির্জায়, কলকাতা শহরের বুকের উপরে, শ্বেতাঙ্গ সমাজ ও দেশী সমাজের চোখের সামনে। সে ভাবে, দেখুক সকলে। দেখি কার সাধ্য বাধা দেয়। আর বিয়ের পরেই দুজনে চলে যাবে রিষড়ায়, আগেই ভাড়া করে রাখবে ওয়ারেন হেস্টিংসের বাগানবাড়িটা, সেখানে গিয়ে কাটাবে হনিমুনের পক্ষকাল।

জেগে জেগে স্বপ্ন সৃষ্টি করে জন। দিবা আর রাত্রির মত স্বপ্ন আর বাস্তবে মানুষের জীবন যে নিত্য ভাগাভাগি।

অবশেষে প্রভাত হয়।

গঙ্গারামের অপেক্ষায় হলঘরে অধীরভাবে পায়চারি করে জন। এমন সময়ে বেলা দশটা নাগাদ গঙ্গারাম ঘরে ঢুকে সেলাম করে একগাল হাসি হেসে দাঁড়ায়।

বিবিজি চিঠি দিয়া?

জী হুজুর।

গঙ্গারাম এগিয়ে দেয় চিঠি।

চিঠিখানা লুফে নিয়ে একটা মোহর ছুঁড়ে দেয় জন গঙ্গারামের দিকে, তার পরে। দ্রুতপদে ঘরে ঢুকে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়।

.

৪.১০ শতু সরাব (২)

মনের গতিবিধি মানুষের সম্পূর্ণ পরিজ্ঞাত হলে সংসার বুঝি এমন দুঃখের উপত্যকা হত না। বিধাতা-পুরুষ যখন বিশ্ব-সৃষ্টি করে আত্মপ্রসাদ অনুভব করছেন, তখন কোন্ শয়তান সকলের অগোচরে তার মধ্যে এক ফোঁটা মন ফেলে দিয়ে অনর্থক জটিলতার সৃষ্টি করে তুলল। সুখের শিখর দেখতে দেখতে দুঃখের উপত্যকায় হল পরিণত।

জনকে চিঠি লিখে দেওয়ার পরে রেশমী খুব একপ্রকার আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিল, ভেবেছিল, যাক সব চুকিয়ে দিলাম; ভেবেছিল, এখন অনন্যমনা হয়ে আত্মসমর্পণ করলাম মদনমোহনের পায়ে।

কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় মদনমোহনের বাড়িতে গিয়ে মনে কেমন খটকা অনুভব করল, দেখল অন্যদিনের মত মন লাগছে না, কেমন যেন ক্ষণে ক্ষণে অবাধ্য মনটা খাঁচার ফাঁক দিয়ে উড়ে উড়ে নায়। তখনও সে বুঝতে পারে নি মনের অবাধ্যতার কারণ। তার চঞ্চলতা লক্ষ্য করে সেই বুড়িটা পিছন থেকে বলল, আজ বুঝি মন লাগছে না মা?

রেশমী স্বীকার করল, বলল, না মা, মন লাগছে না।

তবে বুঝি মনে এখনও ভাগাভাগি আছে!

রেশমী চমকে উঠল, তবে কি সত্যি মনে এখনও ভাগাভাগি আছে? কিন্তু কে বসাল ভাগ? তখন যদি কেউ বলত যে, আর কেউ নয়, জন ভাগ বসিয়েছে তার মনে, তাহলে কিছুতে বিশ্বাস করত না সে।

আরতি শেষ হয়ে গেলে টুশকি বলে, চল সৌরভী, এবারে ফিরি।

পথে আসতে আসতে টুশকি বলল, পুরুষমানুষ বড় নেমকহারাম।

হঠাৎ একথা মনে হল কেন?

টুশকি বলল, আজ বাজারে গিয়ে ক্ষান্ত দিদির কাছে একটা গল্প শুনলাম, সারাদিন সেই কথাটা মনে পাক দিয়ে উঠছে।

কি গল্প বল না দিদি?

ক্ষান্তদিদি বাপের বাড়ি থেকে সবে কালকে ফিরেছে, তার কাছে শুনলাম। গল্পটা শুনে বুক ফেটে যাচ্ছে।

খুলে বল দিদি।

গোবিন্দ জোয়াদ্দার গাঁয়ের মধ্যে বর্ধিষ্ণু গৃহস্থ। অনেকদিন আগে একটা ভবঘুরে হেলে তার বাড়িতে এসে আশ্রয় নেয়। জোয়াদ্দার তাকে নিজের ছেলের মত মানুষ করে। ছেলেটি বড় হলে জোয়াদ্দার ভাবল যে, তার মেয়ের সঙ্গে ছেলেটার বিয়ে দেবো-পাটি ঘর, কোন বাধা ছিল না। মেয়েটাও মনে মনে স্থির করেছিল, বাপ-মায়ের যখন ইচ্ছা, ওকেই বিয়ে করবে। সব যখন প্রায় ঠিকঠাক, ছেলেটা পালিয়ে গিয়ে পাশের গায়ের এক মেয়েকে বিয়ে করল। জোয়াদ্দারের মেয়ে ঘেন্নায় দুঃখে গঙ্গায় ডুবে মরল।

রেশমী বলল, সত্যি দিদি, ছেলেটা কি নেমকহারাম!

শুধু ঐ ছেলেটা নয় বোন, পুরুষ জাতটাই নেমকহারাম। তোমার ভাগ্য ভাল যে, এমন নেমকহারামদের পান্নায় তোমাকে পড়তে হয় নি।

ততক্ষণে তারা বাড়ি এসে পৌঁছেছে। গল্প শেষ হয়ে গেল, বেশ বাজতে লাগল রেশমীর মনে। হঠাৎ মনের অবাধ্যতার কারণ পেল সে খুঁজে-জনও তো কম নেমকহারাম নয়। হবেই বা না কেন, পুরুষমানুষ তো বটে। সাধারণভাবে পুরুষমানুষের সুত্রে তখন একটি মাত্র পুরুষ এসে তার মনের রঙ্গমঞ্চে দাঁড়াল। ধিক্কার, ঘৃণা, ক্রোধ, কৃপা পাঁচমিশেলি ভাব অনুভব করল সে জনের প্রতি। রেশমী যদি মনস্তাত্বিক হত, তবে বুঝত যে, ঐসব প্রতিকূল ভাবের সিধকাঠি দিয়েই সুড়ঙ্গ কাটা হয় মনের দেয়ালে। রেশমীর বদ্ধদ্বার মনের সুড়ঙ্গপথে প্রবেশ করল জন। সে স্থির করে রেখেছিল যে জনের সঙ্গে সম্বন্ধ চুকিয়ে দিয়েছে কিন্তু এখন দেখল, কি আপদ-মনের সর্বত্র জন। অনধিকার তার প্রবেশ সন্দেহ নেই, কিন্তু যে দুর্বল, কেমন করে সে ঘোষণা করবে ঐ সত্যটা আততায়ীর কাছে। নিদ্রাভঙ্গে ভীত যেমন নিদ্রিতবৎ পড়ে থেকে চোরের গতিবিধি লক্ষ্য করে, ভাবে দেখা যাক কত দূর কি করে, ভরসা রাখে শেষ পর্যন্ত সিন্দুকের চাবিটা খুঁজে পাবে না, অসহায়ভাবে রেশমী পর্যবেক্ষণ করতে লাগল জনের পদসঞ্চার।

নেমকহারাম, নেমকহারাম!

মনের নীচের তলার অধিবাসী বলে ওঠে, তার দোষ কি, তুমিই তো সব সম্বন্ধ চুকিয়ে চিঠি লিখে দিয়েছ।

কিন্তু চিঠিখানার জবাব দিতেও তো পারত।

ও চিঠির জবাব পেলে কি খুশি হতে? বৃঢ় জবাব ছাড়া আর কি সম্ভব ও চিঠির?

কেন, এমন কি রূঢ় কথা আমি লিখেছি।

না, এমন আর কি! মরার বাড়া যে গাল নেই, তা-ই দিয়ে মাত্র।

সে-ও না হয় তা-ই দিত।

ঝগড়া করা সকলের স্বভাব নয়।

জন বুঝি কম ঝগড়াটে? বোনের সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে যায় নি সে?

কার জন্যে ঝগড়া করেছিল? কার জন্যে বাড়ি ছেড়েছিল? নেমকহারাম কে?

জন, জন, জন!

ও তো রাগের কথা হল।

করব না রাগ? কেন ঢুকেহে আমার ঘরে?

জন হয়তো এটাকে নিজের ঘর মনে করে।

নিজের ঘর! দেখছ না দরজা বন্ধ!

আর দরজা বন্ধ হলেই কি মালিক ফিরে যায়?

তাই বলে সিঁধ কেটে ঢুকবে?

অগত্যা। তা ছাড়া হাতের কাছে সিঁধকাঠি যুগিয়ে দিলে কেন?

সিঁধকাঠি? কি বলছ?

ঐ রাগ, দ্বেষ, ঘৃণা—ঐ তো সুড়ঙ্গ খোডবার অস্ত্র।

বেশ করেছি।

তবে ঘরে ঢুকে জনও বেশ করেছে।

রেশমী স-কৌতূহলে লক্ষ্য করছিল যে তার মনটা দুইখানা হয়ে জন সম্বন্ধে সওয়াল জবাব করছে আর সে নিরপেক্ষ বিচারকের মত নির্বিকারভাবে বসে কৌতুক অনুভব করছে। তার ভারি মজা লাগছিল। মনের সুক্ষ্ম গতিবিধি সম্বন্ধে এই তার প্রথম অভিজ্ঞতা। বাদী-প্রতিবাদীর উকিল কিছুক্ষণের জন্য বিতণ্ডা থামালে নিরপেক্ষ বিচারক একটি ছোট্ট প্রশ্ন করল, আচ্ছা, চিঠির উত্তর পাওয়ার সময় কি সত্যই অতিক্রান্ত হয়েছে? জন। চিঠিখানা পেয়েছে, পড়বে, ভাল-মন্দ যা হক একটা উত্তর লিখবে, তার পর তো পাঠাবে।

তার মনের মধ্যে জনের উকিল বলে উঠল, ঠিক কথা। তাছাড়া চিঠি রেশমীর হাতে এসে পৌঁছবার একটা সময় নির্দিষ্ট আছে, টুশকি যখন ভোরবেলা বাজারে যায়। সেই সময়, এদিক ওদিক হলেই বিপদ। রেশমী তাকে সমর্থন করে বলল, তবে? তবে অযথা কেন জনকে দুষছ?

তখন তার মনটা সবলে জনের অনুকূলে প্রতিক্রিয়াবান হয়ে উঠল, জনকে অন্যায়ভাবে দুষেছে ভেবে অনুতাপ দেখা দিল। জন হঠকারিতা করে অসময়ে চিঠি পাঠিয়ে তাকে বিপন্ন করে নি ভেবে সে কৃতজ্ঞতা অনুভব করল জনের প্রতি। জন সম্বন্ধে প্রতিকূল মনোভাব মুহূর্তে লোপ পেল। আশার পূর্বাগে মনের দিগন্ত দেখতে দেখতে রাঙা হয়ে উঠল।

মানুষের মন চরাচরের সবচেয়ে আশ্চর্য পদার্থ, ভগব-অস্তিত্বের এটাই বোধ হয় সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

রেশমী কল্পনায় দেখল তার চিঠিতে মর্মাহত জন যন্ত্রণায় ছটফট করছে। এই দৃশ্য কেমন যেন তাকে আনন্দিত করে তুলল, শিকারী যেমন আনন্দ পায় স্ব-শরাহত শিকারের যন্ত্রণা দেখে। ঐ যন্ত্রণাই কি প্রমাণ করে না যে জন তাকে কত ভালবাসে। তার পরে সে কল্পনায় দেখল যে, বিনিদ্র জন সারারাত ধরে লিখল সুদীর্ঘ চিঠি; সে চিঠি অনুনয়ে, অনুরাগে, সাধ্যসাধনায়, প্রতিশ্রুতিতে পূর্ণ। তার পরে দেখল চিঠিখানা গঙ্গারামের হাতে দিয়ে জন বলে দিল, জলদি গিয়ে দিয়ে এস, বিবিজি পুরস্কার দেবে।

রেশমী ভাবল, গঙ্গারামকে কি পুরস্কার দেবে, কিছুই তো নেই তার।

এই ভাবে রাত কেটে গেল। দুঃখের রাতও কাটে, সুখের রাতও কাটে।

টুশকি বাজারে চলে গেলে দরজায় দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করতে লাগল, গঙ্গারামের আগমন সম্বন্ধে কোন সংশয় ছিল না তার মান।

যথাসময়ে অপ্রত্যাশিতের আবির্ভাব সংসারে বড় ঘটে না, কিন্তু এক্ষেত্রে ঘটল, দেখা গেল পথের মোড়ে গঙ্গারামকে।

সারারাত কেটে গেল, এইটুকু সময় আর কাটে না, কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে গঙ্গারামকে সে বলল, চিঠি কই?

চিঠি বের করে দিল গঙ্গারাম। চিঠি দিয়েই ফিরছিল, রেশমী বলল, দাঁড়া।

এই বলে ভিতর থেকে কয়েকটা মোয়া নিয়ে এসে তার হাতে দিয়ে বলল, পথে খেতে খেতে যাস বাবা, আর কাল সকালে একবার নিশ্চয় আসিস।

গঙ্গারাম তো অবাক। কাদির আলীর কাছে শুনেছিল যে পুরস্কার চাওয়া চলবে, ভাল খবর নেই চিঠিতে। এখন এই অপ্রত্যাশিত আনুকূল্যের অর্থ বুঝতে না পেরে সে ভাবল, কি জানি বাবা, বড়লোকের কথাই আলাদা, তারা যে কিসে চটে আর কিসে খুশি হয় মা গঙ্গাই জানেন। সে দ্রুত অদৃশ্য হল।

চিঠিখানা বুকের মধ্যে চেপে ধরে রেশমী বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগল, প্রত্যাশার চাপা আনন্দের উদ্দাম ছন্দে তখন হাতুড়ি পিটছিল হৃৎপিণ্ডটা।

চিঠিখানা মুঠোয় নিস্পিষ্ট করে সে অনুভব করছিল জনের কোমল হাতখানাকে— অনেক দিন পরে জনের সান্নিধ্য লাভ করল ঐ ক্ষুদ্র পত্রপুটে। মাধুর্যে, করুণায়, প্রেমে, প্রত্যাশায় তার মনের কানায় কানায় গেল ছাপিয়ে, বয়ে গেল অমর্ত্য সুরধুনীর প্রবাহ। এক একবার প্রচণ্ড আগ্রহ হচ্ছিল চিঠিখানা পড়বার, আবার তখনই সংযত করছিল ঔৎসুক্য। কি হবে পড়ে? জন চিঠি পাঠিয়েছে এই কি যথেষ্ট নয়? তার পর অনেকক্ষণ পরে যখন চিঠিখানা পড়া মনস্থ করলে, বাইরে পদশব্দ উঠল টুশকির। দ্রুত হয়ে চিঠিখানা খোঁপার মধ্যে লুকিয়ে প্রিয়-সমাগম-সঞ্জাত-রক্তাভ মুখে যখন সে বেরিয়ে এল, টুশকি তার দিকে চেয়ে মুগ্ধভাবে বলল, সৌরভী ভাই, আজ তোমাকে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে।

রেশমী অস্বীকার করে বললে, আমি কি আগে কুশ্রী ছিলাম?

তা কেন, তবে আজ একটু বিশেষ দেখছি।

হবেও বা।

তখন দুইজনে গৃহকার্যে নিযুক্ত হল, প্রসঙ্গটা ঐখানেই চাপা পড়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *