০৯. ক্ষীরভবানী

নবম পরিচ্ছেদ
ক্ষীরভবানী

অমরনাথ যাত্রার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি ঘটনা ছিল শিববিষয়ক চিন্তার সহিত জড়িত; প্রতি পদক্ষেপে মনে হইত, আমরা সেই চিরতুষারমণ্ডিত মহান পর্বতমালার সমীপবর্তী হইতেছি, যাহা একাধারে তাহার প্রতিরূপ এবং আবাসভূমি। সায়াহ্নে তুষারময় গিরিসঙ্কট ও আন্দোলিতসরলবৃক্ষগুলির উপর দিয়া দৃশ্যমান নবীন চন্দ্রমা যেন আমাদের জোর করিয়া মহাদেবের কথা স্মরণ করাইয়া দিত। সর্বোপরি, যে ধ্যানরাজ্যের পরিমণ্ডলে আমরা অবস্থান করিতেছিলাম, তাহার অন্তরতম প্রদেশে ও কেন্দ্রস্থলে সেই মহাদেবই বিরাজ করিয়া থাকেন ধ্যানমগ্ন, নির্বাক—যিনি সর্বগুণের অতীত, মনোবুদ্ধির অগোচর। একদা নিঃসন্দেহ যে, প্রজ্ঞাসহায়ে মানুষ ঈশ্বরকে যতদূর ধারণা করিতে সমর্থ হইয়াছে, হিন্দুর এই শিববিষয়ক ধারণা তাহার সর্বোচ্চ সীমা। তিনিই সর্বোপাধিবর্জিত ঈশ্বর, আবার তাহাকেই অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লাভ করা যায়।

সম্ভবতঃ চরম জ্ঞানের অন্বেষণে, অব্যক্ত সত্তাকে এইরূপ ব্যক্তি জ্ঞানে চিন্তা করার পর ঈশ্বর সম্বন্ধে বিপরীত ধারণা—অর্থাৎ ঈশ্বরকে এই পরিদৃশ্যমান জগতের অন্তরালে অবস্থিত শক্তিরূপে চিন্তা করা অনিবার্য হইয়া পড়ে। সহজেই বুঝা যায়, যিনি এই উভয় ভাবের গভীরতম তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করিয়াছেন, তাঁহার পক্ষে প্রতীক সহায়ে ঈশ্বরকে ধারণা করিবার জন্য মানব মনের যে চেষ্টা তাহার প্রত্যেকটির অর্থবোধ করা সম্ভব, কারণ, সকল প্রতীকই শিব বা অনন্ত সত্তা ও শক্তি এই দুই প্রতীকের একটির অন্তর্ভুক্ত হইবেই। মানুষ যদি পরব্রহ্মকে আদৌ চিন্তা করে, তবে অনাদি-অনন্ত সত্তারূপে, অথবা অনাদি-অনন্ত শক্তিরূপে তাঁহার চিন্তা করিতে হইবে। এই তথ্যের অন্তরালে কোন প্রাকৃতিক নিয়ম বিদ্যমান কিনা, সে বিষয়ে চিরকাল অনুমান বা কল্পনার অবকাশ থাকিয়া যাইবে। যাহা হউক, কোন অজ্ঞাত কারণে, ক্ষীরভবানী। আগস্ট মাস হইতে স্বামীজীর চিত্ত শিব হইতে শক্তির প্রতি আকৃষ্ট হয়। সর্বদাই তিনি রামপ্রসাদের গানগুলি গাহিতেন, যেন নিজেকে শিশুরূপে কল্পনা করিয়া সেইভাবে মগ্ন হইতে চাহিতেন। একবার তিনি আমাদের কয়েকজনকে বলেন, যে দিকেই দৃষ্টিপাত করিতেছেন, জগন্মাতার উপস্থিতি অনুভব করিতেছেন—যেন তিনি সাকার রূপ ধারণ করিয়া কমধ্যে বিরাজ করিতেছেন। সর্বদা জগন্মাতা সম্বন্ধে অত্যন্ত সরল ও স্বাভাবিকভাবে কথা বলা তাঁহার অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল। আমাদের দলের মধ্যে যাহারা প্রবীণ ছিলেন, তাঁহারাও এই ধরনে কথাবার্তা বলিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। সুতরাং কোন সযত্নপোষিত উদ্দেশ্য ত্যাগ করিবার প্রয়োজন হইলে তাহারা এই বলিয়া মনকে প্রবোধ দিতেন, “মার যা ইচ্ছা, মা সব জানেন।”

কিন্তু ক্রমে স্বামীজীর তন্ময়ভাব গাঢ়তর হইল। ক্ষোভের সহিত তিনি অভিযোগ করিলেন, চিন্তারূপ ব্যাধির দ্বারা তিনি পীড়িত—যে চিন্তা মানুষকে দগ্ধ করে, নিদ্রা বা বিশ্রামের অবসর দেয় না, এবং বহু সময় ঠিক যেন মানুষের কণ্ঠস্বরের ন্যায় প্রবোচিত করিতে থাকে। তিনি সর্বদা আমাদের নিকট সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ প্রভৃতি সর্বপ্রকার দ্বন্দ্বের অতীত হইবার আদর্শটি বোধগম্য করিবার চেষ্টা করিতেন—যে ধারণায় হিন্দুর পাপবোধ সমস্যার সমাধান নিহিত। কিন্তু বর্তমানে মনে হইল, তিনি যেন জগতের মধ্যে যাহা কিছু ঘোররূপ, যন্ত্রণাদায়ক ও দুর্বোধ্য, তাহারই উপর সমগ্র মন অৰ্পণ করিয়াছেন। ঐ পথ অবলম্বনে এই জগৎপ্রপঞ্চের পশ্চাতে অবস্থিত অদ্বয় ব্রহ্মকে লাভ করিবার জন্য তাহার দৃঢ় সঙ্কল্প দেখা গেল। কাশ্মীর যাত্রার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ায় ভীষণের পূজাই এখন তাঁহার মূলমন্ত্র হইয়া উঠিল। রোগ ও যন্ত্রণা তাহাকে মনে করাইয়া দিত, “যেখানে বেদনা অনুভূত হইতেছে, সে স্থান তিনি, তিনিই যন্ত্রণা এবং যন্ত্রণাদাতা। কালী! কালী! কালী!”

একদিন তিনি বলেন, তাহার মাথায় কতকগুলি চিন্তা প্রবল হইয়া উঠিয়াছে এবং উহাকে লেখনী সাহায্যে প্রকাশ না করা পর্যন্ত তাহার অব্যাহতি নাই। সেই সন্ধ্যায় কোন স্থানে ভ্রমণের পরে বজরায় প্রত্যাবর্তন করিয়া দেখিলাম, স্বামীজী আসিয়াছিলেন এবং আমাদের জন্য স্বহস্তে লিখিত Kali the Mother

(মৃত্যুরূপা মাতা’) কবিতাটি রাখিয়া গিয়াছেন। পরে শুনিলাম, দিব্যভাবের তীব্র উন্মাদনায় কবিতাটি লেখা শেষ হইবামাত্র তিনি মেঝের উপর পড়িয়া গিয়াছিলেন।

কবিতাটি এই :

মৃত্যুরূপা মাতা

নিঃশেষেনিভেছে তারাদল, মেঘ এসে আবরিছে মেঘ,
স্পন্দিত, ধ্বনিত অন্ধকার, গরজিছে ঘূর্ণ বায়ুবেগে!
লক্ষ লক্ষ উন্মাদ পরাণ বহির্গত বন্দিশালা হতে,
মহাবৃক্ষ সমূলে উপাড়ি, ফুৎকারে উড়ায়ে চলে পথে!
সমুদ্র সংগ্রামে দিল হানা, উঠে ঢেউ গিরিচূড়া জিনি,
নভস্তল রশিতে চায়! ঘোররূপা হাসিছে দামিনী।
প্রকাশিছে দিকে দিকে তার, মৃত্যুর কালিমা মাখা গায়,
লক্ষ লক্ষ ছায়ার শরীর! দুঃখরাশি জগতে ছড়ায়,
নাচে তারা উন্মাদ তাণ্ডবে; মৃত্যুরূপা মা আমার আয়!
করালি। করাল তোর নাম, মৃত্যু তোর নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে;
তোর ভীম চরণ-নিক্ষেপ প্রতিপদে ব্রহ্মাণ্ড বিনাশে!
কালী, তুই প্রলয়রূপিণী, আয় মাগো, আয় মোর পাশে।
সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মুত্যুরে যে বাধে বাহুপাশে
কাল-নৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা তারি কাছে আসে।(২)

এই সময়ের কিছুদিন পূর্ব হইতে স্বামীজী তাহার নৌকা আমাদের নিকট হইতে দূরে সরাইয়া লন। একজন তরুণ ব্রাহ্ম ডাক্তাব ঐ গ্রীষ্মকালে কাশ্মীরে অবস্থান করিতেছিলেন। তিনিই কেবল জানিতেন, স্বামীজী কোথায় আছেন এবং তাহার দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সম্বন্ধেও খোঁজ-খবর লইতে পারিতেন। স্বামীজীর প্রতি তাহার সহৃদয়তা ও ভক্তিপূর্ণ ব্যবহার প্রশংসার অতীত। পরদিন প্রতিদিনের মতো ডাক্তারবাবু স্বামীজীর নিকট গেলেন, কিন্তু তাহাকে ধ্যানমগ্ন দেখিয়া কোন কথা না বলিয়া ফিরিয়া আসেন। পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর স্বামীজী ক্ষীরভবানী নামক কুণ্ডদর্শনে যাত্রা করেন, বলিয়া যান, কেহ যেন তাহার অনুসরণ না করে। সেইদিন হইতে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি অনুপস্থিত ছিলেন।

ঐ দিন অপরাহ্নে দেখিলাম, তিনি নৌকায় ফিরিয়া আসিতেছেন। নৌকা স্রোতের উজানে চলিতেছে। তিনি এক হাতে নৌকার ছাদের বাঁশের খুঁটি ধরিয়া সামনে দাঁড়াইয়া আছেন। তাহার অপর হাতে একছড়া গাঁদাফুলের মালা। তাঁহার আকৃতি যেন পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। বজরায় প্রবেশ করিয়া তিনি নীরবে মালাছড়াটি এক এক করিয়া সকলের মস্তকে স্পর্শ করাইয়া আশীর্বাদ করিলেন। অবশেষে মালাটি একজনের হাতে দিয়া বলিলেন, “এটি আমি মাকে নিবেদন করেছিলাম।” তারপর তিনি উপবেশন করিলেন, এবং হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আর ‘হরিঃ ও’ নয়, এবার ‘মা’, ‘মা’!”

আমরা নিস্তব্ধ বসিয়া রহিলাম। কথা বলিবার চেষ্টা করিলেও পারিতাম না। এমন কিছুতে স্থানটি এরূপ ভরপুর হইয়া গিয়াছে যে, চিন্তাস্রোতও যেন থামিয়া গিয়াছে। তিনি আবার বলিলেন, “আমার সব স্বদেশপ্রেম ভেসে গেছে। আমার সব গেছে। এখন কেবল ‘মা’, ‘মা’!”

ক্ষণকাল নীরবতার পর তিনি কেবল বলিলেন, “আমার খুব অন্যায় হয়েছে। মা আমাকে বললেন, “যদিই বা ম্লেচ্ছরা আমার মন্দিরে প্রবেশ করে, আমার প্রতিমা অপবিত্র করে, তোর তাতে কী? তুই আমাকে রক্ষা করিস, না আমি তোকে রক্ষা করি? সুতরাং আমার আর স্বদেশপ্রেম বলে কিছুই নেই। আমি তো ক্ষুদ্র শিশু মাত্র!”

তারপর তিনি নানা বিষয়ে এবং অবিলম্বে কলিকাতা যাত্রার কথা বলিলেন। গত সপ্তাহের নানারূপ মানসিক দুশ্চিন্তার ফলে তাঁহার যে শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়, তাহারও উল্লেখ করিলেন। সস্নেহে বলিলেন, “এখন আমি এর চেয়ে বেশি বলতে পারব না; নিষেধ আছে।” বিদায় লইবার পূর্বে আবার বলিলেন, “কিন্তু আধ্যাত্মিকতার দিক থেকে আমি কোনরূপ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইনি।”

পরবর্তী কয়দিনে আমরা স্বামীজীকে অতি অল্পই দেখিয়াছিলাম। তবে পরদিন প্রাতরাশের পূর্বে আমাদের মধ্যে দুইজন অতি অল্পক্ষণের জন্য তাহার সঙ্গে নদীতীরে উপস্থিত ছিলেন, এমন সময় নাপিতকে আসিতে দেখিয়া তিনি বলিলেন, “এ সব আর থাকবে না।” তিনি চলিয়া গেলেন এবং আধ ঘণ্টা পরে ফিরিয়া আসিলেন একেবারে মুণ্ডিত মস্তকে। গত সপ্তাহে কঠোর তপস্যা ও সাধনার দ্বারা তিনি যে দিব্যদর্শন লাভ করিয়াছিলেন, তাহার বিশেষ বিবরণ আমরা মধ্যে মধ্যে তাহার কথা বা আচরণের মাধ্যমে অনুমান করিয়া লইতাম—এখন ঐ সকল স্মরণ করিয়া বর্ণনা করা অসম্ভব বলিয়াই মনে হয়। তাহার উপবাস, কুণ্ডে প্রত্যহ পায়স ও বাদাম ভোগ নিবেদন এবং প্রতিদিন প্রাতে এক ব্রাহ্মণপণ্ডিতের শিশুকন্যাকে কুমারী উমারূপে পূজা করা—এসকল আমরা কল্পনানেত্রে দেখিতে পাইতাম। আবার এই সকল অনুষ্ঠান এরূপ পূর্ণ অহংশূন্যতায় সম্পন্ন হইয়াছিল যে, উহার ফলে তাহার বিশেষ শারীরিক অনিষ্ট হইলেও সেজন্য কখনও তাঁহার মনে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নাই।

একদিন এক ব্যক্তি একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে আসেন। স্বামীজী সন্ন্যাসীর পরিচ্ছদে ও মুণ্ডিতমস্তকে ঠিক সেই সময়ে আসিয়া পড়েন। “ন্যায়ের সমর্থন করিতে গিয়া মৃত্যুও শ্রেয়ঃ অথবা গীতার উপদেশ(৩) গ্রহণ করা উচিত, যাহাতে কোন কিছুর প্রতিকার না করিতে হয়?”–তাহার নিকট এই সমস্যাটি উপস্থাপিত করা হয়। বহুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া স্বামীজী ধীরে ধীরে বলিলেন, “আমি কোন প্রতিকারের পক্ষপাতী নই।” তারপর আবার বলিলেন, “এটি সন্ন্যাসীর জন্য। গৃহীর পক্ষে আত্মরক্ষাই বিহিত।”

স্বামীজীর অন্তর্মুখ ভাব ক্রমশঃ গভীর ও গাঢ় হইতে লাগিল। এই সময়টিকে ‘তাহার জীবনের সঙ্কট-মুহূর্ত বলিয়া তিনি একবার উল্লেখ করেন। আবার জগন্মাতার ক্রোড়স্থিত শিশু বলিয়া নিজেকে তিনি অভিহিত করেন, মা তাহাকে আদর করিতেছেন। আর আমাদেরও স্বতই মনে হইল, হয়তো জগন্মাতার এই আদর মানবের স্নায়ু ও মনে দুঃসহ যন্ত্রণারূপে প্রকাশ পায়; তথাপি তাহারই স্নেহপ্রসূত বলিয়া পরমানন্দে স্বীকৃতি লাভ করে। তিনি কি বলেন নাই, “তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও পরম আনন্দ থাকতে পারে?”

সকল ব্যবস্থা হইয়া যাইবামাত্র আমরা বারামুল্লা যাত্রা করিয়া ১১ অক্টোবর, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পৌঁছিলাম। পূর্বেই স্থির হয় যে, তিনি পরদিন অপরাহ্নে লাহোর যাত্রা করিবেন এবং আমরা আরও কিছুদিন বারামুল্লায় অবস্থান করিব। নদীপথে আসিবার সময় আমরা তাঁহাকে অতি অল্পই দেখিতে পাইয়াছিলাম। তিনি প্রায় সর্বদাই মৌনাবলম্বী থাকিতেন এবং একাকী নদীতীরে দীর্ঘকাল ধরিয়া ভ্রমণ করিতেন-কদাচিৎ আমাদের বজরায় তাহার পদার্পণ ঘটিত। ভারত-প্রত্যাবর্তনের পর দীর্ঘকালব্যাপী পরিশ্রমে তাঁহার স্বাস্থ্য একেবারে ভাঙিয়া যায়। আবার সাম্প্রতিক মহান উপলব্ধির ফলে তাঁহার শারীরিক অবনতি তাহাকে এতদূর অবসন্ন করিয়া তোলে যে, তিনি নিজে উহা তেমন বুঝিতে পারেন নাই! নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করিলে যন্ত্রণার যেমন আর উপলব্ধি হয় না, তেমন শরীরও অনির্দিষ্ট কাল ধরিয়া মাত্রাতিরিক্ত আধ্যাত্মিক ভাবাবেগ ধারণে অসমর্থ হয়। বোধ হয়, এই সকল কারণে আমাদের মনে হইতেছিল, কে জানে কত দিনের জন্য আমরা তাহার নিকট বিদায় লইতেছি। আর সম্ভবতঃ এই চিন্তা করিয়াই তিনি বুধবার প্রাতে জলযোগ শেষ হইয়া যাইবার পর আমাদের নিকট আগমন করেন এবং কথাবার্তা বলিবার জন্য থাকিয়া যান।

সেদিন সকালে ঘন্টার পর ঘণ্টা কথাবার্তায় কাটিয়া গেল। এখানে তাহার বিশদ বিবরণ দেওয়া অপেক্ষা, আমাদের মনে উহা কিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করিয়াছিল, তাহার একটা সাধারণ আভাস দেওয়া সহজ। কথা শুনিতে শুনিতে আমরা যেন এক অন্তরতম পবিত্র রাজ্যে প্রবেশ করিলাম। মধ্যে মধ্যে তিনি কোন ভক্তিমূলক সঙ্গীতের একাংশ গাহিয়া তাহার অনুবাদ করিতেছিলেন—গানগুলি সবই জগন্মাতার উদ্দেশ্যে।

“শ্যামা মা উড়াচ্ছ ঘুড়ি (ভব সংসার বাজার মাঝে)…
ঘুড়ি লক্ষের দুটো-একটা কাটে, হেসে দাও মা হাত চাপড়ি,”

এই গানটি তিনি বহুক্ষণ ধরিয়া বার বার গাহিলেন। গানের সঙ্গে সঙ্গে সেই ভক্তজন চিত্তহারিণী শ্যামা মায়ের মূর্তি আমাদের মনে উজ্জ্বল হইয়া উঠিতে লাগিল।

নিজের কবিতা হইতে তিনি আবৃত্তি করিলেন–

“দুঃখরাশি জগতে ছড়ায়,
নাচে তারা উন্মাদ তাণ্ডবে; মৃত্যুরূপা মা আমার আয়!
করালি! করাল তোর নাম, মৃত্যু তোর নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে;
তোর ভীম চরণ-নিক্ষেপ প্রতিপদে ব্রহ্মাণ্ড বিনাশে।”

মাঝখানে তিনি থামিয়া বলিলেন, “দেখেছি, সব বর্ণে বর্ণে সত্য!”–

“সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাধে বাহুপাশে,
কাল-নৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা তারি কাছে আসে।”

“মা সত্যসত্যই তার কাছে আসেন। আমি নিজ জীবনে এটি প্রত্যক্ষ করেছি। কারণ, আমি মৃত্যুকে সাক্ষাত্তাবে আলিঙ্গন করেছি!”

ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তিনি কথা বলিলেন। বলিলেন, “গঙ্গাতীরে মৌনী কৌপীনমাত্রধারী পরিব্রাজকজীবন যাপন ছাড়া আর কোন কামনা নেই। আব কিছুরই আমার প্রয়োজন নেই। স্বামীজী চিরদিনের মতো মরে গেছে। আমি কে যে জগৎকে শিক্ষা দেবার দায়িত্ব আমার বলে মনে করছি? এ কেবল বৃথা আস্ফালন ও অহঙ্কার। জগন্মাতার আমাকে কোন প্রয়োজন নেই আমারই জগন্মাতাকে প্রয়োজন। এই অবস্থা যিনি উপলব্ধি করেছেন, তার কাছে নিষ্কাম কর্মও মায়া ব্যতীত আর কিছু নয়।

“প্রেমই একমাত্র পথ। লোকে যদি আমাদের প্রতি অন্যায় করে থাকে, তাহলেও আমাদের তাদের ভালবেসে যেতে হবে, অবশেষে তারা এই ভালবাসায় বশ না হয়ে থাকতে পারবে না। এই আর কি।”

.

তথাপি এই কথাগুলি লিপিবদ্ধ করিতে গিয়া আমি বেশ বুঝিতেছি, ইহারা যে বিশাল হৃদয়ের ভাষা, তাহার বিন্দুমাত্র আভাস আমি দিতে পারিব না। জগতের যে-কোন ব্যক্তির সামান্য আঘাতও যেন আমাদের গুরুদেবের হৃদয়কে স্পর্শ না করিয়া যাইত না; কোন যন্ত্রণাই, এমনকি মৃত্যু-যন্ত্রণাও যেন তাহার নিকট হইতে প্রেম ও আশীর্বাদ ব্যতীত আর কিছু বাহির করিতে পারিত না।

তিনি আমাদের বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের কাহিনী বলিলেন; বশিষ্ঠের শতপুত্র বিশ্বামিত্র কর্তৃক নিহত, পুত্ৰশোকভারাক্রান্ত ঋষিকে কিরূপ জীবন যাপন করিতে হইয়াছিল তাহাও বলিলেন। অতঃপর স্বামীজী চন্দ্রালোকে বৃক্ষরাজির মধ্যে অবস্থিত কুটিরের বর্ণনা করিলেন কুটিরের মধ্যে বশিষ্ঠ এবং তাহার স্ত্রী অরুন্ধতী। ঋষি তাহার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিরচিত অমূল্য গ্রন্থপাঠে নিবিষ্টচিত্ত, এমন সময়ে অরুন্ধতী নিকটে আসিয়া মুহূর্তের জন্য নত হইয়া দেখিলেন তিনি কি করিতেছেন, তারপর বলিয়া উঠিলেন, “দেব, আজ চন্দ্রের কি উজ্জ্বল শোভা!” ঋষি না তাকাইয়া বলিলেন, “প্রিয়ে, বিশ্বামিত্রের প্রতিভা তার চেয়ে দশ হাজার গুণ উজ্জ্বল!”

সব ভুলিয়া গিয়াছেন! শতপুত্রের নিধন, নিজের অপমান, ক্লেশ-সমস্ত বিস্মৃত হইয়া তিনি তাহার শত্রুর প্রতিভার প্রশংসায় তন্ময়!

“আমাদের প্রেমও ঐরূপ হওয়া চাই, বিশ্বামিত্রের প্রতি বশিষ্ঠের যেরূপ ছিল—তাতে ব্যক্তিগত ভালমন্দের স্মৃতির লেশমাত্র থাকবে না” –স্বামীজী বলিলেন।

এই সময়ে একজন কৃষক কতকগুলি পল্লবসমেত নাশপাতি ফুল আনিয়া আমরা যে টেবিলে বসিয়াছিলাম, তাহার উপর রাখিয়া দিল। আমাদের মধ্যে একজন সেগুলি তুলিয়া লইয়া বলিলেন, “স্বামীজী, পূজার জন্যই এ ফুলগুলির সৃষ্টি, কারণ এদের ফল হবে না।” কিন্তু তিনি তাঁহার দিকে স্মিত হাস্যের সহিত দৃষ্টিপাত মাত্র করিলেন, আর তিনিও স্বামীজীর প্রগাঢ় তন্ময়ভাব ভঙ্গ করিতে না পারায় ইচ্ছা সত্ত্বেও ফুলগুলি তাহাকে নিবেদন করিতে পারিলেন না।

স্বামীজী সত্যই চলিয়া গেলেন। ভৃত্য, মাঝি, বন্ধু, শিষ্য, পিতামাতা ও সন্তানসকলে মিলিয়া আমরা তাহার নিকট বিদায় লইবার জন্য বড় রাস্তার উপর টাঙ্গা পর্যন্ত গেলাম। স্বামীজীর প্রতি যাহার অনুরাগ আমরা বহুদিন লক্ষ্য করিয়াছি, তাহার সর্দার মাঝির সেই চার বৎসরের ছোট শক্তসমর্থকালো মেয়েটি যাত্রাপথে ব্যবহার করিবার জন্য এক বারকোশ ফল মাথায় করিয়া দৃঢ়চিত্তে ছোট ছোট পা ফেলিয়া স্বামীজীর পাশে পাশে চলিল এবং হাসিমুখে তাহাকে বিদায় দিয়া দাঁড়াইয়া তাঁহার গাড়ি চলিয়া যাওয়া দেখিতে লাগিল। এই ক্ষুদ্র শিশু অপেক্ষা আমরা কম অভিভূত না হইলেও চিন্তা ও অনুভূতি বাড়িলে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়, তাহার ফলে তাহার ও আমাদের মধ্যে নিঃস্বার্থতায় অত্যন্ত ব্যবধান ছিল। পুনরায় কখন তাহার দর্শনলাভ করিব তাহা কেহই জানিতাম না, কিন্তু একথা বুঝিতে পারিয়াছিলাম, সেদিন তাহার সঙ্গে আমরা যে কয়েক ঘণ্টা কাটাইয়াছি, তাহার উজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় আমাদের সমগ্র ভবিষ্যৎ অতিবাহিত হইবে।

———–
(১) স্বামীজী একটি মঠ ও সংস্কৃত কলেজ স্থাপনের উপযোগী একখণ্ড জমি মনোনীত করিবার জন্য কাশ্মীব-মহারাজের বিশেষ আমন্ত্রণে আগমন করেন। তাঁহাকে উক্ত জমি মনোনীত করিবার প্রস্তাবটি দুইবার উত্থাপন করা হয়, কিন্তু তদানীন্তন রেসিডেন্ট স্যার অ্যালবার্ট ট্য:লবট দুইবারই উহা কাউন্সিলের কার্যতালিকা হইতে বাদ দেন। সুতরাং ঐ সম্বন্ধে আলোচনা পর্যন্ত হইতে পারে নাই।

(২) শ্ৰীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকৃত অনুবাদ।–অনুঃ

(৩) এখানে ইহা বলা অপ্রাসঙ্গিক হইবে না যে, আমার নিজের কথা বলিতে গেলে, আমি কোনক্রমে বুঝিতে পারি নাই, কিরূপে এই ব্যক্তি গীতা হইতে এই বিশেষ উপদেশটি সংগ্রহ কবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *