• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

আমার বাবা – ফাহমিদা খাতুন

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » স্মৃতিচারণ » আমার বাবা – ফাহমিদা খাতুন

কাজী মোতাহার হোসেন [জন্ম: ৩০ জুলাই ১৮৯৭—মৃত্যু: ৯ অক্টোবর ১৯৮১]

আমার চারপাশে দেখা সব বাবার থেকে একেবারে আলাদা রকমের ছিলেন আমাদের আব্বু। তাঁর জগৎই ছিল সম্পূর্ণ অন্য ধাঁচের। খাওয়া-দাওয়া, জামা-জুতা কখন কোনটা পরবেন, সবই তদারক করতেন আম্মু। আব্বুর কথা মনে পড়লেই যে ছবিটা ফুটে ওঠে তা হচ্ছে, একজন সৌম্যদর্শন, রাশভারী ভদ্রলোক বৈঠকখানায় বসে নিবিষ্ট মনে দাবা খেলছেন বা বই পড়ছেন। আমরা কেউ গিয়ে যখন বলতাম, খাবার খেতে যেতে বলেছেন আম্মু, তখন মাঝেমধ্যে বলতেন, ‘ওহ্, আমি খাইনি বুঝি? তাই তো কেমন খিদে লাগছিল।’ সংসারের যাবতীয় ভার ছিল আম্মুর ওপর। চড়-চাপড় যা খেয়েছি, তা তাঁরই হাতে। আব্বু যেন এক অতি আদরের মেহমান। যথেষ্ট ভয় পেতাম তাঁকে দেখে, কিন্তু তার পরও লোভ হতো কাছে গিয়ে এটা-ওটা বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটু আদর কাড়ার। সেই আশাতেই মাঝেমধ্যে কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে নালিশ করতাম ভাইবোনদের নামে—কেউ মেরেছে বা কটু কথা বলেছে, এই আরকি। তাতে যে কেউ কোনো শাস্তি পেত তা নয়, তবে আমার উপরি পাওনা হতো। ‘সুম্মা’ (সোনা মা) বলে কাছে টেনে নিয়ে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলতেন, ‘কে রে, ওকে মেরেছিস, এদিকে আয় দেখি?’ ব্যস, আর কিছু প্রয়োজন হতো না। মনে হতো জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই যেন।
খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল আমাদের। তার কারণ, আব্বু সেই কাকভোরে উঠে টানা লম্বা বারান্দায় গুনগুন করে গান গেয়ে পায়চারি করতেন। তাতেও কারও ঘুম না ভাঙলে ডেকেই তুলতেন। বলতেন, ‘ভোরে ঘুম থেকে উঠলে দিনটা কত বড় হয়ে যায় বল তো? কত কাজ করার সময় পাওয়া যায়, ঘুমিয়ে সেই সময়টা নষ্ট করবি কেন?’ তা ছাড়া ১১৩ সেগুনবাগিচার আমাদের এ বাড়িটায় অনেক বড় একটা ফুল-ফলের বাগান ছিল। নানা জাতের পাখির ডাক শোনা যেত ভোর হতেই। বড় শান্ত, সুন্দর পরিবেশ—ভালোই লাগত সকালে উঠে।
আব্বুর সব কাজ খুব শৃঙ্খলায়, সময়মতো করার অভ্যাস ছিল। কখনো কোথাও যেতে দু-এক মিনিট দেরি হতেও দেখিনি কোনো দিন; বরং কখনোসখনো কোনো নেমন্তন্নে এক দিন আগেই গিয়ে উপস্থিত হয়ে খুব বিরক্তির সঙ্গে ফিরে এসে বলতেন, ‘ইয়েটিয়ে করে সব ফাঁকিফুঁকি।’ কোনো কাজ ফেলে রাখা তাঁর স্বভাবেই ছিল না। কোনো মিটিংয়ে যেতে অনেক আগেই তৈরি হয়ে অপেক্ষা করতেন, উদ্যোক্তাদের কেউ এসে নিয়ে যাবেন বলে এবং তাঁরা দেরি করে এলে ভীষণ বিরক্ত হতেন।
ছেলেবেলায় আব্বু নিজে কোনো দিন মাইনে করা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া বুঝে নেওয়ার বিলাসিতার কথা কল্পনাও করতে পারেননি। তাই আমাদের পড়ানোর ভার নিজেই নিতে চেয়েছেন বরাবর—বলতেন, ‘ওই মাস্টার কি আমার চেয়ে ভালো পড়াবেন?’ আমি হচ্ছি ১১ ভাইবোনের (সাত বোন, চার ভাই) মধ্যে দশম, তাই পড়া বুঝতে যেতে আমার ভয়টাও ছিল বেশি। আম্মু ঠেলে পাঠাতেন, ‘যা না, তোর পরীক্ষার পড়াগুলো বুঝে নে তোর আব্বুর কাছে।’ বাংলা বা ইংরেজি পাঠ্যবই নিয়ে গেলে চমৎকার করে বুঝিয়ে দিয়ে, আলতো করে গালে একটা চড় মারার ভঙ্গি করে বলতেন, ‘তোর তো বেশ বুদ্ধি আছে রে। এবার অঙ্ক বইটা আন তো দেখি।’ তাতেই হতো যত মুশকিল। নিজের ছেলেমেয়েদের কাছে আব্বুর প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। তাই প্রথমে একটা সহজ নিয়মে বুঝিয়ে দিতেন যেকোনো অঙ্ক, যেটা আমি খুব ভালোই বুঝতাম। কিন্তু সেখানেই যদি থামতেন। এরপরে মহা উৎসাহে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ নিয়মেও যে অঙ্কটা করা যায়, সেটা বোঝানোর চেষ্টায় লেগে যেতেন। আর ততক্ষণে আমি যেটুকু বুঝেছিলাম, তা-ও গুলিয়ে ফেলে এক্কেবারে গোলক ধাঁধায় পড়ে যেতাম। এই করে অঙ্কের প্রতি এমনই ভীতি জন্মে গেল যে, জীবনে আর অঙ্কই শেখা হলো না। আমার বয়সের কথাটা বোধ করি খেয়ালই থাকত না আব্বুর, তাই এই বিপত্তি। তাঁর স্কুলের অঙ্কের মাস্টার একবার আমাদের বাসায় এসেছিলেন এবং আব্বুর অনুরোধে বড়দা, ছোড়দাকে অঙ্ক আর জ্যামিতি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পরে আব্বু দুজনকে বললেন, ‘তোদের দেখে তো খুব খুশি খুশি মনে হচ্ছে—কেমন বুঝলি, আমার মতো ভালো?’ সমস্বরে দুজনে বলে উঠল, ‘উঁহু, তার চেয়ে অনেক ভালো!’ উত্তর শুনে খুশিও হলেন নিজের মাস্টারের পারদর্শিতায়। আবার বুঝলেন, তিনি ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে কত অসহিষ্ণু।
আব্বুর শেখানোর পদ্ধতিটাই ছিল অন্য রকম। টেক্সট বুক বোর্ডের পাঠ্যবই নির্বাচনের জন্য যে বইগুলো পাঠানো হতো তাঁর কাছে, সেগুলো থেকে কতগুলো বই পড়তে দিয়ে পরে আবার জানতে চাইতেন—কেমন লাগল, ভালো কি মন্দ এবং কেন ভালো বা মন্দ ইত্যাদি। বানান ভুল বের করতে বলতেন। অনেক শব্দের মানে জানতে চাইতেন, না পারলে ডিকশনারি দেখে নিতে বলতেন। একটা শব্দ দেখতে গিয়ে আরও কতগুলো নতুন শব্দও শেখা হয়ে যেত। এভাবে ডিকশনারি নিয়ে নাড়াচাড়া করাটাও নেশায় দাঁড়িয়ে গেল। এভাবে চাঁদ আর সূর্যের কত নাম রয়েছে, তার একটা তালিকা করে আব্বুকে দেখিয়ে বাহ্বা পেয়ে ঝোঁকটা আরও বেড়ে গেল। কখন নিজের অজান্তে আব্বু আমার মনের মধ্যে এ ধারণাটা গেঁথে দিয়েছেন, আমি ইচ্ছে করলেই অনেক শক্ত কাজ করতে পারি। এ প্রসঙ্গে একটা অদ্ভুত ঘটনা মনে পড়ে। আমি ছেলেবেলায় কনভেন্টে পড়েছি, স্ট্যান্ডার্ড থ্রিতে ওঠার পরে আমাকে বাংলা মিডিয়ামে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করলেন আম্মু। এক হাতে রাবার, অন্য হাতে পেনসিল নিয়ে লিখি তখন আমি। হারতে তো শিখিনি, তাই কোনোমতে টেনেটুনে পাস করলাম সেবার। তার পরই আমাকে এনে কামরুননেসা স্কুলে সেভেনে ভর্তি করা হলো। বাংলার তো ওই অবস্থা—হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় পেলাম ২৯ নম্বর ১০০ তে। মীনু (সন্জীদা খাতুন) তাই দেখে গম্ভীর মুখে, খুব কড়া গলায় বললেন, ‘তুই কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়ে হওয়ার যোগ্য না।’ কথাটা আমার বুকে এমন করে বিঁধল যে এরপর বাকি ছয় মাসে আমি বঙ্কিমচন্দ্রের পুরো গ্রন্থাবলি পড়ে শেষ করেছি (পাশে অবশ্যই ডিকশনারি নিয়ে)। বাংলা ব্যাকরণ এমনভাবে পড়েছি যে সেবার বার্ষিক পরীক্ষায় বাংলায় পেয়েছিলাম ৭৩, তিন সেকশন মিলে সর্বোচ্চ নম্বর।
ভাইবোনদের মধ্যে অনেক ছোট হওয়ার জন্য এবং মেজদির চার মেয়ে নিয়ে বিধবা হয়ে আমাদের বাসায় থাকার ফলে আব্বুর কেমন সব গোলমাল হয়ে যেত। একে তো তাঁর ভোলা-মন, তার ওপর অন্যমনস্ক। ফলে, একদিন তো আমাকে জিজ্ঞেস করে ফেললেন, ‘তোর নাম কী রে? কোন ক্লাসে পড়িস?’ এরপর অবশ্য তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হই নানাভাবে। আমার গানও খুব পছন্দ করতেন তিনি।
যেকোনো বিষয়ে নিজের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন আব্বু। তাই সব সময় চাইতেন, আমরা যেন নিজের বিচার-বুদ্ধি দিয়ে ভালো-মন্দ বিচার করতে শিখি। বিভিন্ন জায়গায় আমাকে গান গাইতে যাওয়ার জন্য যখন কেউ এসে আব্বুকে অনুরোধ করতেন অনুমতি দেওয়ার জন্য, তিনি তখন আমাকে ডেকে আমার মতটা আগে জানতে চাইতেন। যে জিনিসটা বেশির ভাগ মা-বাবাই করেন না বলে আমার ধারণা।
ঘরে বসে তাঁর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করার মতো সময় খুব একটা পেতাম না ঠিকই, তবে ইউনিভার্সিটিতে জুওলজি পড়ার সময় ওই একই বিল্ডিংয়ের প্রথমে নিচতলায়, পরে তিনতলায় ছিল স্ট্যাটিসটিকস ডিপার্টমেন্ট। দুপুরে একসঙ্গে খেতে বসে বা আসা-যাওয়ার পথে রিকশায় নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হতো। প্রায়ই আব্বু ছেলেবেলার নানা রকম দুষ্টুমির গল্প শোনাতেন। তা ছাড়া তাঁর বাপজানের কথা, স্কুল-কলেজের মাস্টারদের কথা বলতেন। কত যে ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা মেশানো থাকত তাতে। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করে ঠিক উত্তর না পেলে খুব বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘তোদের মাস্টাররা কি কিছুই শেখায়নি? আমরা তো এটা ক্লাস টুতে (ক্লাস নাইন) শিখেছি।’
আব্বু যাকে ভালোবাসতেন তাঁর প্রতি পক্ষপাতিত্বের মাত্রাটাও বেশি হতো। যেমন—ছেলেমেয়েদের মধ্যে বড়দি, মিনু এবং বড়দা, ছোড়দা—এঁদের ধারেকাছেও আমি কখনো পৌঁছাতে পারিনি। সে দুঃখ আমার রয়েই গেছে। অবশ্য বড়দিকে আক্ষেপ করে বলতে শুনেছি, ‘আব্বুর কথা আর বলিস না, তাঁর প্রিয় ছাত্রদের নিয়ে কী দিল-খোলা হাসি আর গল্প চলে, দেখে পিত্তি জ্বলে যায়। কই, আমাদের সঙ্গে তো ওভাবে কথা বলেন না।’ রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা ভীষণ পছন্দ করতেন। শেষ বয়সে গীতবিতান-এর পাতা উল্টিয়ে আপন মনে মগ্ন হয়ে সুর করে গাইতেন। যে গান জানা নেই, তা-ও গাইতেন নিজেই সুর দিয়ে। একদিন ওভাবে গাইছিলেন নিজের সুরে—আমাকে দেখে জানতে চাইলেন, গানটার সুর জানি কি না। গেয়ে শোনানোর পরে বললেন, ‘হ্যাঁ, এই সুরটাও বেশ ভালো।’ নজরুলের ব্যাপারে কিছু বলতে গিয়ে তাঁর চেহারাই যেন পাল্টে যেত। এই প্রিয় বন্ধুর ব্যাপারে তাঁর দুর্বলতাটাও ছিল অনেক বেশি। তিনি নজরুলের গলায় তাঁর গান শুনেছেন, সেই অভিজ্ঞতা তো খুবই ভিন্ন। কারণ, সে গান যখন তাঁর সমস্ত মন-প্রাণ এবং দেহ দিয়ে গাইতেন, সে তো তুলনাহীন হবেই। যখন তিনি চাকরি থেকে অবসর নিলেন, তখন তাঁর বিদায় অনুষ্ঠানে, স্ট্যাটিসটিকস ডিপার্টমেন্টে আমাকে ডাকা হয়েছিল গান গাওয়ার জন্য। সেই দিন ফেরার পথে, রিকশায় বললেন, ‘তোর গানগুলো বড় ভালো লাগল রে।’ তারপর একটু থেমে বিষণ্ন গলায় বললেন, ‘তোরা কেউ নজরুলের গান শিখলি না, আমার মাঝেমধ্যে এটা নিয়ে খুব আফসোস হয়। নজরুলের নিজের গলায় যে গানগুলো শুনেছি, সেসব বুঝি হারিয়ে গেল। কারও গলায় তো আর তেমন লাগে না।’ শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বললাম, ‘আমরা তো সে গান শুনেছি, শেখার সুযোগ পাইনি।’
এ কথা মানতেই হবে যে কাজী মোতাহার হোসেন অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। তাই তিনি সুযোগ্য অভিভাবক, বন্ধু এবং স্কুল-কলেজে অনেক প্রতিভাবান শিক্ষকের তাঁর প্রতি সজাগ দৃষ্টি এবং সঠিক পথে পরিচালনার দিক-নির্দেশনা পেয়েছিলেন। আব্বুর মুখে শোনা সেসব ব্যক্তির নানা চমকপ্রদ কিছু ঘটনার উল্লেখ এখানে করতে চাই এবং আশা করি, নবীন প্রজন্ম এর থেকে অনুপ্রেরণা পাবে।
তিনি ফরিদপুরের (এখন রাজবাড়ী জেলা) এক সম্ভ্রান্ত অথচ দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিলেন। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নিদারুণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠে এক আদর্শস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন। এটি সম্ভব হয়েছে নিজের অসাধারণ মেধা, সততা, চারিত্রিক বলিষ্ঠতা এবং অসীম আত্মবিশ্বাসের জোরে। ফলে এক অনন্যসাধারণ এবং কল্পকথার মতো বর্ণাঢ্য জীবন যাপন করে গেছেন তিনি।
ছেলেবেলা থেকেই বিশিষ্ট ব্যক্তিসত্তা ও মূল্যবোধ বিনির্মাণে তাঁর স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের এবং সমাজের কিছু হূদয়বান ব্যক্তির যে সহযোগিতা তিনি পেয়েছেন, তাঁদের কয়েকজনের কথা এখানে বলছি—শ্রীযুক্ত রাইচরণ দাস মহাশয় তখন কুষ্টিয়ায় ওকালতি করতেন। সেনগ্রাম মাইনর স্কুল, যেখান থেকে আব্বু উচ্চ প্রাইমারি পাস করেছিলেন। তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং সেক্রেটারি ছিলেন এই রাইচরণ বাবু। স্কুলের ছাত্রবেতনে বা সরকারি সাহায্যে স্কুলের শিক্ষকদের বেতন দেওয়া এবং স্কুলঘরের মেরামতের খরচপত্র পোষাত না—অতিরিক্ত খরচ যা লাগত সব রাইচরণ বাবু একাই বহন করতেন। কুষ্টিয়া হাইস্কুলে পড়ার সময় আব্বু এক কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। তিনি একদিন রেলস্টেশনের স্কেল-ব্যালান্সের হ্যান্ডেল ধরে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে কেমন করে যেন লিভারের ওজন-কাঠিটা মাপনযন্ত্রের পেটের ভেতর ঢুকে গেল। তিনি তো হতভম্ব। এমন সময় স্টেশনমাস্টার ব্যাপারখানা দেখে, ধমক দিয়ে আব্বুকে ওখানেই বসিয়ে রাখলেন। আব্বু তো সুবোধ বালকের মতো বিষণ্ন মনে চুপ করে বসে রইলেন। ভাবলেন, সম্ভবত তাঁকে এরপর জেলেই পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ঘণ্টা খানেক পর দেখা গেল, ওই পথে রাইচরণ বাবু প্ল্যাটফর্মের দিকে হেঁটে আসছেন। কাছে এসে তিনি বললেন, ‘একি! মোতাহার, তুমি এখানে ওমন করে বসে কী করছ।’ আব্বু যখন ব্যাপারখানা তাঁকে বললেন, রাইচরণ বাবু তো রেগে আগুন হয়ে গেলেন। স্টেশনমাস্টারকে বললেন, ‘কী হয়েছে? তোমাদের কল, তোমরাই জানো কেমন করে ঠিক করতে হয়। ছেলেমানুষ তো কলকাঠি দেখলে অমন নাড়াচাড়া করেই থাকে। সে জন্য কি ওকে এভাবে নজরবন্দী করে রাখবে? ফের এমন করলে তোমার স্টেশনমাস্টারি ঘুচিয়ে দেব।’ এই বলে তিনি আব্বুকে সঙ্গে করে রেললাইনের ওপারে গিয়ে নিজের গাড়িতে করে বাড়ি নিয়ে গিয়ে পেটপুরে খাইয়ে দিলেন আর বললেন, ‘তোমার কোনো দরকার হলেই আমার এখানে চলে এসো। যেমন করে আমার সেনগ্রাম স্কুলের নাম উজ্জ্বল করেছ, তেমনি করে কুষ্টে স্কুলের নাম রাখবে, এ-ই আমি চাই।’
কুষ্টিয়ার একজন নামজাদা লোক মুক্তিয়ার খোদাদাদ খাঁ সাহেব বিশেষ বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। তিনি একটি সাহায্য তহবিল খুলেছিলেন। সেই তহবিল থেকে গরিব ছেলেদের পরীক্ষার ফি, ভালো ছাত্রদের উৎসাহ দান ইত্যাদির অর্থ-সাহায্য দিতেন। যার নাম ছিল ‘কর্জে হাসানা’ অর্থাৎ পরবর্তীকালে অবস্থা সচ্ছল হলে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি হওয়ার পর আব্বু কুষ্টিয়ায় গিয়ে তাঁকে এই টাকা সম্পূর্ণ শোধ করে দিয়েছিলেন। খাঁ সাহেব তো অবাক। বললেন, ‘এ পর্যন্ত কেউ তো এই “কর্জে হাসানা”র টাকা ফিরিয়ে দেয়নি। তবে তুমি দেবে কেন?’ আব্বু বললেন, ‘গরিব লোকের তো অভাব নেই, আপনার তহবিল যাতে উজাড় হয়ে না যায়, সে জন্য যারা এই ফান্ডের সাহায্যে উপকৃত হয়েছে, সম্ভব হলে তাদেরই উচিত ঋণ পরিশোধ করে আরও কিছু সাহায্য করা।’ আব্বু কর্জের ৭০ টাকার সঙ্গে আরও ২০-৩০ টাকা দান করেছিলেন। বস্তুত আব্বুকে সেই ছেলেবেলা থেকেই তাঁর বৃত্তির সম্পূর্ণ টাকা বাপজানকে পাঠিয়ে দিতে হতো এবং নিজের খরচ চালানোর জন্য ছুটির মাসগুলোতেও টিউশনি বা জায়গির থেকে ছাত্র পড়াতে হতো।
কুষ্টিয়া স্কুলে আব্বুর সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক ছিলেন যতীনবাবু (যতীন্দ্রমোহন রায়)। যখন আব্বু চতুর্থ শ্রেণীর (অর্থাৎ সপ্তম শ্রেণী) ছাত্র, তখন যতীনবাবু ভূগোল পড়াতেন, তৃতীয় শ্রেণীতে জ্যামিতি আর দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণীতে পড়িয়েছেন মেকানিক্যাল। চতুর্থ শ্রেণীতে যখন আব্বুর জলবসন্ত হয়, সংবাদ পেয়ে তাঁর বাবা স্কুল থেকে নিতে এসেছিলেন। যতীনবাবু কিছুক্ষণ পড়ানো বন্ধ রেখে বিশদ করে বলেছিলেন, আব্বুর কী খাদ্য, কী অখাদ্য, কেমন করে মশারির মধ্যে রেখে মশা-মাছি থেকে দূরে ওষুধ ও মলম লাগাতে হবে ইত্যাদি। যতীনবাবুর চোখ থেকে তখন কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পড়ল। বোঝা গেল, আব্বুর জন্য কত উদ্বেগ, কত স্নেহ, যত্ন, ভালোবাসা। তৃতীয় শ্রেণীতে থাকতে একদিন স্কুলে আসতে দেরি হয়েছে। বিকেলবেলা তিনি আব্বুকে হোস্টেল থেকে ডেকে পাঠালেন। ভয়ে ভয়ে তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, ‘আজ তোর কাপড়টা (ধুতিখানা) একটু ভিজে ভিজে দেখলাম। তোর বুঝি আর কাপড় নেই। তাই বুঝি কাপড় শুকিয়ে নিতে দেরি হয়েছে?’ আব্বু চুপ করে রইলেন। এরপর তিনি একটা পোঁটলা বের করে বললেন, ‘এই নে। তোর জন্য এনেছি একখানা ধুতি, শার্ট আর গেঞ্জি।’ আব্বুকে ইতস্তত করতে দেখে বললেন, ‘তোর লজ্জা কিসের? তোর পিতা দিলে নিতি নে? তোদের তো নিজের ছেলের মতোই দেখি।’ তৃতীয় শ্রেণীতে থাকতেই যতীনবাবু জোর করে একটা রচনা প্রতিযোগিতায় আব্বুর নাম দিয়ে এসেছেন। প্রতিযোগিতা হবে স্কুলের সব ছাত্র এবং কুষ্টিয়ার আইএ, বিএ, এমএ পড়া সব ছাত্রের সঙ্গে। আব্বু প্রথম স্থান পেয়েছেন এবং এতে তাঁর আত্মপ্রত্যয় অনেক বেড়ে গেল। এমনই বহু রকম ঘটনা আছে, যার সাহায্যে তিনি ছাত্রদের তিলেতিলে গড়ে তুলেছেন। ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান হওয়ার পর এই আদর্শ শিক্ষক, যতীনবাবুকে তাঁর সাধের কুষ্টিয়া স্কুল থেকে বিদায় করে দেওয়া হলো। বুকভরা অভিমান নিয়ে তিনি কলকাতায় চলে গেলেন। পরে তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় ৪০ বছর পরে, আব্বু খোঁজ করে তাঁর কলকাতার বাসায় গিয়ে ডেকে বললেন, ‘স্যার, আমরা কুষ্টিয়ার লোক, আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’ তিনি ভেতর থেকে বেরিয়ে বললেন, ‘কে তোমরা? আমি যেন মোতাহারের গলা শুনছি।’ আরও একটি ঘটনার কথা বলি। যতীনবাবু অনেক সময় (সম্ভবত ছাত্রদের মনে নৈতিক চিন্তার উদ্রেক করার জন্যই) শিক্ষাবহির্ভূত প্রশ্নাদি করে ছাত্রদের জবাব শুনতেন, কিন্তু নিজে কোনো মন্তব্য করতেন না। একদিন ক্লাসে প্রশ্ন তুললেন, ‘দেখো হিন্দু ছেলেরা সন্ধ্যা-আহ্নিক করবে, আর মুসলমান ছেলেরাও মাগরিবের নামাজ পড়বে। এমন সময় দেখা গেল একটা বাড়িতে আগুন লেগেছে। তখন তোমরা কে কে আগে আগুন নেভাতে যাবে, আর কে কে আগে উপাসনা সেরে নেবে?’ দুই দিকেই রায় দিল ছাত্ররা। আব্বু সন্ধ্যা-আহ্নিক বা নামাজের দিকেই রায় দিলেন। তিনি কিছুই বললেন না। এর ২০-৩০ বছর পর তাঁর সঙ্গে দেখা করে বললেন, ‘স্যার, চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ানোর সময় আমাদের একটা প্রশ্ন করেছিলেন, আমি এখন বুঝতে পারছি, আমি ভুল উত্তর দিয়েছিলাম।’ তিনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী প্রশ্ন রে?’ আব্বু বললেন, ‘স্যার, আমি আগে আগুন নেভাতে যাব, তারপর বাড়িতে গিয়ে “কাজা” নামাজ পড়ব।’ তিনি আব্বুর পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন, ‘বেশ, বেশ।’
কুষ্টিয়া স্কুলের হেডমাস্টার গোপাল চক্রবর্তীরও একটা অদ্ভুত ঘটনা আছে। একজন নিচের ক্লাসের মাস্টার, রামবাবুকে স্কুলের ভেতর দিয়ে আসতে দেখে আব্বুর ক্লাসের এক ছাত্র বলে উঠেছে, ‘ওই দেখ, রাস্তা দিয়ে রামা আসে।’ আব্বু কথাটা শুনতে পাননি কিন্তু রামবাবু তক্ষুনি হেডমাস্টারের কাছে ফরিয়াদ করেন। এ কথা শুনে কড়া বেত হাতে হেডমাস্টার ক্লাসে এসেই সেই ছেলের নাম জানতে চাইলেন এবং যথারীতি কেউ কোনো নাম বলল না। তখন সপাসপ বেত পড়ল সবার হাতে। পরদিন এক অভাবনীয় কাণ্ড। ক্লাসের সবাইকে নেমন্তন্ন করলেন হেডমাস্টার এবং পেটপুরে খাওয়ালেন। তারপর বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করো তোমরা, একজনের দোষে তোমাদের সবাইকে মেরেছি, তাতে আমি নিজেও খুব কষ্ট পেয়েছি। আবার খুশিও হয়েছি তোমাদের একতা দেখে। জেনে রাখো, শৃঙ্খলাই চরিত্রের সর্বপ্রধান উপাদান, ছাত্রজীবনে চরিত্র সুগঠিত না হলে পরে আর হয় না। তাই আমাকে বাধ্য হয়েই শিক্ষকটির মুখ চেয়ে বিচার করতে হয়েছে।’
আমার বিশ্বাস, এমন সব শিক্ষকের অভিভাবকত্বে আব্বুর চরিত্রেও তার দারুণ প্রভাব পড়েছিল। কোনো অন্যায় দেখলে যেমন কড়া হাতে শাসন করতেন, নিজের ছেলেকেও রেয়াত দিতেন না; তেমনই সহজ, সাদাসিধে সরল, কোমল মনেরও পরিচয় পাওয়া যেত এই মানুষটার মধ্যে। তাঁর জন্মদিনে (৩০ জুলাই) তাঁকে অশেষ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২৯, ২০১১

Category: স্মৃতিচারণTag: কাজী মোতাহার হোসেন
Previous Post:গেরুয়া জীবন – নীলিমা আফরোজ
Next Post:নজরুল স্মৃতিকক্ষ – নাসির আলী মামুন

Reader Interactions

Comments

  1. রাসেল সরকার

    December 15, 2012 at 12:14 pm

    সত্যই আসাধারন!

    Reply
  2. ইমন

    February 18, 2013 at 10:12 pm

    খুব ভাল লাগল । আমি কুষ্টিয়া থেকে বলছি।

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑