• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

১০ মননশীল বই: একুশে বইমেলা ২০১১

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » প্রতিক্রিয়া » ১০ মননশীল বই: একুশে বইমেলা ২০১১

চোখের জলে লেখা জীবনকথা
আখতার হুসেন

কর্নেল হুদা ও আমার যুদ্ধ—নীলুফার হুদা \ প্রকাশক: প্রথমা \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী সত্য যে গল্পগাথার চাইতেও রোমাঞ্চকর—এ বই পড়তে গিয়ে বারবার সেই পুরোনো প্রবাদের কথাই মনে হয়েছে। সত্যিই তো, যাঁর জবানিতে এই বইয়ের ঘটনা পরম্পরা, তার বিস্তার এবং সমাপ্তি, সেই নীলুফার হুদার জীবন গল্পগাথার চাইতে কম রোমাঞ্চকর নয়। ঘটনার কেন্দ্রে তাঁর স্বামী কর্নেল নাজমুল হুদা, যিনি আলোড়ন সৃষ্টিকারী কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন, ছিলেন অসমসাহসী মুক্তিযোদ্ধা (বীরবিক্রম), স্বাধীনতা-উত্তরকালে যিনি চাকরিজীবনে সেনাসদরে এজি ব্রাঞ্চ পুনর্গঠনে রাতদিন পরিশ্রম করেন, একেবারে শূন্য থেকে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি, ছিলেন এর প্রথম কমান্ডান্ট, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল সাফায়েত জামিলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যিনি সামরিক বাহনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অনড় সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন, সেই তিনি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের তথাকথিত সিপাহি বিদ্রোহে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন। সেই মহান দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার ট্র্যাজিক জীবন-কাহিনি স্মৃতিচারণসূত্রে তুলে ধরেছেন তাঁর সহধর্মিণী নীলুফার হুদা।
নীলুফার হুদা নিজেদের প্রেমভালোবাসা, স্বামীর বীরত্ব, রাষ্ট্রিক ষড়যন্ত্র, পারিবারিক দুঃখকষ্ট ও যন্ত্রণা ইত্যাদির বর্ণনা অনুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন ‘নিজের চোখের পানির কালি দিয়ে’।
বিয়ের এক থেকে দেড় বছরের মাথায় ১৯৬৮ সালে ৩ জানুয়ারি তাঁর স্বামী খোন্দকার নাজমুল হুদা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হন। বন্দি অবস্থায় গোপনে তিনি সহধর্মিণী নীলুফার হুদাকে যেসব চিঠি লেখেন, তার থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নাজমুল হুদার প্রগাঢ় দেশপ্রেমের বিষয়টি। তিনি স্ত্রী নীলুফারকে লিখছেন, ‘আমার বিবেকের কাছে আমি পরিষ্কার যে, যে কারণ বা আদর্শের জন্য আমাকে এই কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে, সেই আদর্শের পেছনে আমার কোনো স্বার্থপর ইচ্ছা বা পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র কাজ করেনি। বরং এটা এমন এক আদর্শ, যাকে মহৎ বলে মনে করি এবং এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’
১৯৬৯ সালের উত্তাল গণঅভ্যুত্থানের মুখে আগরতলা মামলা থেকে নাজমুল হুদাসহ অভিযুক্তদের সবাই বেকসুর খালাস পান। কিন্তু নাজমুল হুদা অন্যদের মতো সামরিক বাহিনীর চাকরি হারান। তাঁর এই সময়কার সংগ্রামের কথা স্মৃতিচারণসূত্রে নীলুফার হুদার যত সবিস্তারে তুলে ধরেন, তার পাঠ সত্যিই আবেগমথিত করে তোলে।
জীবনের এই পর্যায়ের সংগ্রাম শেষ হতে না-হতেই শুরু হয়ে যায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। নীলুফার হুদা এই সময় তার স্বামীর বেসরকারি কর্মস্থল কুষ্টিয়ায় থাকতেন। নাজমুল হুদা কালবিলম্ব না করে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন সেই যুদ্ধে। আবার নতুন করে আরেক সংগ্রাম শুরু হয় নীলুফার হুদার জীবনে। স্বামী যুদ্ধক্ষেত্রে, এবং যেখানে তিনি থাকতেন, সেই জায়গাটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে বলে নিরাপদ কোনো আশ্রয়ের সন্ধানে যাত্রা করেন। তিনি জানাচ্ছেন, কোলে তাঁর অবোধ কন্যাসন্তান। ছেলেটির বয়স বছর চারেক। চরের বালু ভেঙে পথ চলা সহজ ছিল না। ফলে ছেলেটিকে তার ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে নেওয়ার জন্য নীলুফার হুদা একটা পথ বের করেন। ‘বালুর মধ্য থেকে মাটি বা পাথরের টুকরো হাতে তুলে নিয়ে আমি দূরে ছুড়ে মেরে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলাম, দেখি তো বাবু, কে আগে ধরতে পারে, আমি পারি, না তুমি পার?’ নীলুফার আরও জানাচ্ছেন, ‘এতে ভালোই কজ হলো।…আমার ছুড়ে দেওয়া ঢিল ধরার জন্য বাচ্চা ছেলেটা দৌড়ে দৌড়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল।’ এভাবেই তিনি চরের কঠিন পথ ছেলেকে অতিক্রম করান। এ-রকম অনেক বিবরণ আছে এ-বইয়ে, যা সত্যিই মর্মস্পর্শী।
পরিশেষের দুটি অধ্যায় ‘কুমিল্লা থেকে রংপুর এবং কালো পঁচাত্তর’ ও ‘আমার নতুন জীবনযুদ্ধ’। এই দুটি অধ্যায় থেকেই আমরা জানতে পারি, কীভাবে কোন্ অবস্থায় খোন্দকার নাজমুল হুদা, খালেদ মোশাররফ ও মেজর হায়দারকে হত্যা করা হলো। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নীলুফার হুদা বারবার জিগ্যেস করেও জানতে পারেননি কেন তাঁর স্বামী, মেজর হায়দার ও খালেদ মোশাররফকে হত্যা করা হলো? তাঁরা তো কারো রক্ত ঝরাননি। তাঁর প্রশ্নের জবাব মেলেনি।
তারপর জিয়াউর রহমান নিহত হলেন। তার হত্যাকাণ্ডের কথিত বিচারের নামে হত্যা করা হলো অনেক সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যকে। নীলুফার হুদা এসব-কিছুরই সাক্ষী। এ সূত্রেই এই বইয়ের উপসংহার টানা হয়েছে এইভাবে, ‘একটা সাইকেল চলতে থাকে আর কি! মানে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়াননি বলে জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছেন। খালেদ মোশাররফ, হুদা ও হায়দারকে যারা তাদের প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাঁরা বাঁচতে পারেননি।’ এসব কিছু থেকে নীলুফার হুদা যখন সিদ্ধান্ত টানেন এই বলে যে, ‘পৃথিবীতেই মানুষের বিচার হয়ে যায়’, তখন এই গ্রন্থের পাঠ শেষে অনেকক্ষণ থমকে থাকতে হয়।

ভিন্ন চোখে রবীন্দ্রনাথ
সোহরাব হাসান

দেড়শত বর্ষ পরে রবীন্দ্র ভুবনে—রুশিদান ইসলাম রহমান \ মাওলা ব্রাদার্স \ প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ \ ১৫০ টাকা রবীন্দ্রনাথ চিরায়ত। তাঁর গল্প, কবিতা, গান বাঙালি পাঠক-শ্রোতার কাছে কখনো পুরোনো হয় না। চির নতুন হিসেবে ধরা দেয়। তাঁর অমর সাহিত্যকীর্তি সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যায়নি; বরং যুগে যুগে গবেষকেরা পুনর্বিবেচনা ও পুনরাবিষ্কারে সচেষ্ট রয়েছেন। দেড় শ বছর পরও তিনি কতটা বাঙালি মনকে আচ্ছন্ন করে আছেন, তারই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পাই নবীন ও প্রবীণ গবেষকদের লেখায়।
রুশিদান ইসলাম রহমান। প্রথাগত রবীন্দ্র-গবেষক নন। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র অর্থনীতি। কাজ করেন বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি নিয়ে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কীভাবে আচ্ছন্ন করে আছে, তারই প্রতিফলন দেখি তাঁর দেড়শত বর্ষ পরে রবীন্দ্র ভুবনে বইয়ে। নিবন্ধগুলো আগেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
রুশিদান বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘মহান কাব্যকীর্তি ও সাহিত্যের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে না পারলেও প্রত্যেক পাঠকই তাঁর স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সেটা গ্রহণ করতে পারেন এবং অর্থানুসন্ধান করতে পারেন। এই লেখাগুলো অর্থানুসন্ধানের ফসল।’ এ বইটি মূলত সেই পাঠকের মূল্যায়ন প্রয়াস।
রুশিদান এ বইয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, গল্প ও উপন্যাস নিয়ে বিক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। তিনি বেছে নিয়েছেন সেসব ছোটগল্প ও উপন্যাস, যেখানে তাঁর প্রার্থিত চরিত্র ও ‘উন্নয়নদর্শন’ খুঁজে পেয়েছেন। গান প্রসঙ্গে লেখক লিখেছেন, ‘খুব সহজ কথার মধ্য দিয়ে মনে পৌঁছে যায় বলেই রবীন্দ্রসংগীতের একটি প্রবল আকর্ষণ আছে।’ তবে তিনি গানের ভেতরে কতটা যেতে পেরেছেন, সে ব্যাপারে সংশয় আছে। লেখক বিশ্লেষণ করেছেন মূলত গানের বিন্যাস ও বিষয় নিয়ে। অনেকটা পাঠ্যবইয়ের শিক্ষার্থীদের অনুশীলনের মতো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান তো কথা ও সুরকে ছাড়িয়ে শ্রোতাদের অন্য এক ভাবালোকে নিয়ে যায়।
বইয়ের আকর্ষণীয় দিক হলো রবীন্দ্রনাথের গল্প ও কবিতা নিয়ে ভিন্ন মাত্রা ও দৃষ্টিতে আলোচনার। যেসব গল্পের চরিত্রের পেশা ও আবাসস্থল গ্রাম কিংবা শহর, সেগুলোর মধ্য দিয়ে লেখক সামাজিক বিবর্তন তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। এর মধ্যে আছে ‘দেনা-পাওনা’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘কংকাল’, ‘মুক্তির উপায়’, ‘সমস্যা পূরণ’, ‘মধ্যবর্তী’, ‘শাণিত শুভ দৃষ্টি’, ‘দুর্বাদ্ধ’, ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’, ‘নষ্টনীড়’, ‘মাস্টার মশায়’ ইত্যাদি।
লেখকের বিশ্লেষণ হচ্ছে, ‘পেশার বৈশিষ্ট্য এবং পেশার বন্ধনে পরিচিতি ঘটেছে সময়ের সঙ্গে। সময়ের সঙ্গে কর্মস্থলেরও বিবর্তন ঘটেছে। প্রথম পর্বের গল্পগুলোর পটভূমি গ্রাম, দ্বিতীয় পর্বের গ্রাম থেকে শহর এবং শেষ পর্বের গল্পগুলোর পটভূমি শহর।’
এই স্থান বদলে চরিত্রগুলো কতটা বদলে গেছে, সেটাই দেখিয়েছেন লেখক।
বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ সম্ভবত রবীন্দ্র সাহিত্য ও বহির্জগতে নারীর পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের দুর্বলতার কথাও রুশিদান উল্লেখ করেছেন। তাঁর গল্প, উপন্যাসের নায়িকারা সর্বক্ষেত্রে সেই সীমানা ভাঙতে পারেনি। বহির্জগতে প্রতারিত ও বঞ্চিত নারী শেষ পর্যন্ত ঘরেই আশ্রয় খোঁজে। কিন্তু ‘ঘরে বাইরে’র অনেক পরে লেখা ‘নারী’ প্রবন্ধে কবির উপলব্ধি হচ্ছে ‘সকল দেশেই মেয়েরা আপন ব্যক্তিগত সংসারের গণ্ডি পেরিয়ে আসছে। আধুনিক এশিয়াতেও তার লক্ষণ দেখতে পাই। তার প্রধান কারণ, সর্বত্রই সীমানা ভাঙার যুগ এসে পড়েছে; কিন্তু নারী যখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, সমাজ নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখবেন, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করবেন, তার মধ্যে এমন দিকনির্দেশনা থাকতে হবে, যা পুরুষশাসিত সমাজ থেকে আসছে না।’ পুরুষশাসিত সমাজের উন্নয়নও পুরুষের উন্নয়ন, সমাজের অপরাংশ সেখানে বঞ্চিতই থাকে।
রুশিদান ইসলাম রহমান রবীন্দ্রনাথের গল্প ও উপন্যাসে নারীর মুক্তির আকাঙ্ক্ষারই সন্ধান করেছেন। সাধারণ পাঠকের কাতারে থেকেও কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, যা ভবিষ্যতের রবীন্দ্র-গবেষকদের ভাবতে সাহায্য করবে।

বনলতা সেনের স্বরূপ উদ্ঘাটন
মিজানুর রহমান খান

অন্ধকারের উত্স হতে—আকবর আলি খান \ পাঠক সমাবেশ \ প্রচ্ছদ: সেলিম আহমেদ \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ ৬৯৫ টাকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো থেকে বইয়ের নামকরণ যথার্থ। ড. আকবর আলি খানের অফুরান জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় অন্ধকারের উৎস হতে অন্ধকার বিদূরিত, পুরোপুরি আলোকিত। বাংলা সাহিত্যের মোনালিসা বনলতা সেনের স্বরূপ উদ্ঘাটনের প্রয়াস তাঁর প্রবন্ধগুচ্ছের মধ্যে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক। প্রতিটি প্রবন্ধই রীতিমতো মৌলিক গবেষণাধর্মী। কিন্তু তাঁর দাবি, লেখা হয়েছে রম্য রচনার আদলে। তবে ১৪টি সারণি বইটিকে নীতিনির্ধারক, গবেষক ও লেখকদের জন্য এক দরকারি হ্যান্ডবুকেও পরিণত করেছে।
আকবর আলি খান জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনকে অধিকতর মৌলিকত্ব দিয়েছেন। সমালোচনার দায়মোচনে তাঁর প্রয়াসে যত্ন ও দরদ উপচানো। সমালোচকেরা বলার চেষ্টা করেন যে বনলতা সেন কবিতায় অন্তত দুটি ইংরেজি কবিতার প্রভাব রয়েছে। এর একটি মার্কিনি কবি এডগার এলান পোর প্রথম প্রেমের নৈবেদ্য ‘টু হেলেন’ (মূল কবিতা ১৮৩১-এর, বইয়ে ১৮৪৫-এর পরিমার্জিত রূপটি ছাপা হয়েছে)। অন্যটি গ্রিক কবি হোমারের ইলিয়াডের চ্যাপম্যানকৃত অনুবাদ পড়ে রোমান্টিক ইংরেজ কবি জন কিটসের লেখা চতুর্দশপদী। আকবর আলি খানের মতে, এসবের প্রভাব ‘অতি নগণ্য’। বাঙালি সংস্কৃতির প্রগাঢ় জারকরসেই বনলতা সেন সিক্ত। তবে পো প্রেমিকা হেলেনের ‘ক্ল্যাসিক ফেস’ কী শ্রাবস্তির কারুকার্য, ‘পারফিউমড সি’ কী দারুচিনি দ্বীপ—সেই প্রশ্নের গুঞ্জরন এড়ানোর নয়। সন্দেহ কী, ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছে’ এর চৌকস অনুবাদ কিটসের সনেটের প্রথম লাইন ‘মাচ হ্যাভ আই ট্রাভেলড ইন দ্য রিয়েলম অব গোল্ড’ হতে পারেই। এমনকি পো ও কিটসের বাইরেও ‘জোনাকির রঙে ঝিলমিল’ সন্ধ্যার সঙ্গে ইয়েটসের ‘দেয়ার মিডনাইটস অল গ্লিটার’ ঠিকই স্মরণ করিয়ে দেবে।
জীবনানন্দ দাশ নিজেই বনলতা সেনের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। আনাড়িরা বলবেন, কাঁচা। আকবর আলি খান বলেছেন, ‘প্রহেলিকা’। পো ও হেলেন সম্পর্কে এত কথা জীবনানন্দ জানতেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন আকবর আলি খান। তবে ইংরেজির শিক্ষক হওয়ায় এর বিপরীত সম্ভাবনা হয়তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন।
বইটিতে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ, ভাষা ও ধর্মের সঙ্গে তার সম্পর্ক, জাতীয়তাবাদী বিপ্লবের তাৎপর্য, পরিবেশ সমস্যা বিশেষ করে টিপাইমুখ বাঁধ, বাংলাদেশ অর্থনীতির সবলতা ও দুর্বলতা, শহুরে গরিবির রকমফের, ব্যাংক-ব্যবস্থায় নৈতিকতার টানাপোড়েন গভীরতায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তবে বইটিতে হরতালসর্বস্ব রাজনীতির মুখোশ খুলে দেওয়া, ধর্মের সঙ্গে বাঙালি মুসলিমের আত্মপ্রবঞ্চনা এবং সংবিধান সংশোধনবিষয়ক সুপারিশ বইটিকে সময়োপযোগী ও সমৃদ্ধ করেছে।
পাকিস্তানি আমলের ‘আজগুবি’ জাতীয়তাবাদের পাকচক্রে আজও আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। ধর্মেই মানুষের প্রথম পরিচয়, ভারতীয় উপমহাদেশের সব মুসলমান একটি জাতি—এই পাকিস্তানি ভুয়ো দর্শনের লিগেসি আজও আমাদের মানুষ হতে বাধা দিচ্ছে। আকবর আলি খান লিখেছেন, ‘ইসলামি উম্মাহর আদর্শকে আরবিভাষী মুসলমানদের মধ্যেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সংলগ্ন ভূখণ্ডে বসবাসকারী আরবরা কমপক্ষে ২২টি জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত।’ (পৃ. ৮৯)। এটা পাঠে পাঠকদের মনে পড়বেই, বাহাত্তরের সেক্যুলার সংবিধানে ফেরার প্রবক্তাদের অনেকে ইতিমধ্যে ক্লান্ত ও বিভ্রান্ত। তাঁরা ভোটের রাজনীতির কারণে সংবিধান থেকে উম্মাহর গন্ধ মুছতে দোদুল্যমান, পলায়নপর।
সংবিধান সংশোধনে লেখকের ভাবনা ২০১০ সালে প্রকাশিত তাঁর হাম্পটি ডাম্পটি বইয়েও দেখেছি। কিন্তু পরিহাস হলো, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাসহ তাঁর সুনির্দিষ্ট সুপারিশগুলো সংসদের বিশেষ কমিটির প্রতিবেদনে অগ্রাহ্য থেকেছে। চরমতম পরিহাস হলো, এসব নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো আলাপ-আলোচনা পর্যন্ত নেই। বুদ্ধিজীবীরাও নির্বাক। তবে এ নিয়ে উচ্চকিত হওয়ার সময় শেষ হয়ে যায়নি। আকবর আলি খান যেসব প্রশ্ন তুলেছেন, সেগুলোকে বাদ দিয়ে আমরা অবশ্যই কোনো গণতান্ত্রিক সংবিধান পেতে পারি না। তাঁর ‘ক্রীড়াতত্ত্ব’ আমাদের ‘রাজনীতিবিদদের’ জন্য অবশ্য পাঠ্য। বিশেষ করে, বিরোধী দলের নেতার প্রতি সরকারপ্রধানের সাম্প্রতিক ‘খাল কেটে কুমির আনা’ প্রসঙ্গে আকবর আলি খানের ‘কয়েদিদের উভয় সংকট’ (প্রিজনার্স ডিলেমা) অতীব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তাঁর ক্রীড়াতত্ত্বের (গেম থিওরি) সার কথা হলো, যুক্তভাবে দোষী দুই আসামিকে পুলিশ কয়েদে পাঠায়। কিন্তু পুলিশের কাছে তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। পুলিশ এই অবস্থায় তাদের একজনকে আরেকজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে উৎসাহিত করতে চারটি প্রস্তাব দেয় (পৃ. ১১৭)। এই প্রস্তাবগুলোর মূল কথা হলো, তারা যদি পরস্পরকে বিশ্বাস করে, তাহলে মাত্র এক বছরের সাজা ভোগ করে তারা মুক্তি পাবে। কিন্তু এই গেম থিওরির মজাটাই এই যে তারা নিজেদের সন্দেহ ও অবিশ্বাস করে এবং এর ফলে তারা যুক্তভাবে সর্বোচ্চ সাজা ভোগ করে। অবিশ্বাসের কারণে বাংলাদেশে বহুকাল ধরে সর্বোচ্চ সাজা ভোগের রাজনীতি চলছে।
আকবর আলি খানের হরতাল-সংক্রান্ত বিশ্লেষণ সরকারি প্রচারমাধ্যম বিশেষ করে বিটিভি ব্যাপকভাবে প্রচারে আনন্দ পেতে পারে। একটি হরতালে গড় ক্ষতি ৬০ মিলিয়ন ডলার। ইউএনডিপির মতে, ১৯৯১-২০০০ সময়কালে হরতালের মোট ক্ষতি জাতীয় উৎপাদনের ৩ থেকে ৪ শতাংশ। আকবর আলি খান মনে করেন, এসব তথ্য অতিরঞ্জিত। এটা বড়জোর দশমিক ৫ শতাংশ হতে ১ শতাংশ হতে পারে। তাঁর মন্তব্য, ‘সম্ভবত এ জন্যই রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় প্রভাব অর্থনীতিতে দেখা যায় না।’
হরতালের ক্ষতি বড় করে দেখালে বিরোধী দলকে আরও হরতাল দিতে উন্মাদনায় পেয়ে বসে। বরং সত্যিটা বললে হয়তো তারা কিঞ্চিৎ হলেও নিরুৎসাহিত হতে পারে।
আকবর আলি খানের পাণ্ডিত্যপূর্ণ বাক ও বাক্যশৈলী অসাধারণ। নান্দনিকতায় যুক্তিশক্তির বহিঃপ্রকাশের এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁর রূপকল্প ও গাঁথুনি অবশ্যই চেনা রম্য নয়, এক অনিন্দ্যসুন্দর নির্ভার গদ্য।

কৈশোরক স্মৃতিলহরি
মশিউল আলম

উঁকি দিয়ে দিগন্ত—হাসান আজিজুল হক \ ইত্যাদি \ প্রচ্ছদ: সমর মজুমদার \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ ২৪০ টাকা এই যে রৌদ্রছায়াশব্দগন্ধময় ছেলেবেলা! কথার পরে কথা সাজিয়ে ঝিঁকিয়ে তোলা ছবি: নিখুঁত, নিটোল চলচ্চিত্র! ভালোবাসা-ঘৃণা, সংহতি-বিদ্বেষ নিয়ে কলরব করে যে মানবজীবন, এক বালকের চোখের ভেতর দিয়ে সেই জীবনের ছবি ফুটে উঠল। সে বালক সদ্য মহাজীবনের মহাজগতের দিগন্তপানে উঁকি দিচ্ছে। তার চোখে এখনো লেগে রয়েছে না দেখার, না জানার বিস্ময়কুয়াশা।
ছবিগুলো আঁকছেন কিন্তু সপ্ততিপর এক মানুষ, ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা সম্বন্ধে যাঁর ধারণা ও বিশ্বাস পাকা। তিনি লেখক, আজীবন ছোটগল্পই লিখে চলেছেন; উপন্যাস বলতে লিখেছেন কুল্লে একখানা, সম্ভবত এই কারণে যে, তিনি সাধনা করেছেন ছোট আখ্যানের শৈল্পিক উৎকর্ষের চুড়ো স্পর্শ করার। অথবা আরেকটু গুছিয়ে বললে, তিনি পরখ করে দেখতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের হাতে জন্ম নেওয়া বাংলা ছোটগল্পকে উৎকর্ষের কোন উচ্চতায় নেওয়া যায়। তিনি যে আগাপাছতলা একজন কথাশিল্পী, তার স্বাক্ষর বারে বারে পাই—কি তাঁর কল্পনাশ্রয়ী কাহিনিগদ্যে (ফিকশন), কি নিবন্ধে-প্রবন্ধে, কি সত্য কাহিনির বিবরণে।
গল্প-উপন্যাসে তিনি প্রায় সর্বদা আড়ালে রেখেছেন নিজেকে। গল্প লিখেছেন অন্য মানুষদের নিয়ে, যাদের বেশির ভাগই গরিব; যাদের অবস্থান সমাজ ও রাষ্ট্রের একদম প্রান্তসীমায়। যারা বিরূপ প্রকৃতি আর বৈরী রাষ্ট্রব্যবস্থার মার খেতে খেতে, মরে যেতে যেতে ফের বেঁচে ওঠে, তাদের টিকে থাকার নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যে মানবজীবনের অর্থময়তা দেখেন যে কথাশিল্পী, তাঁর অবকাশ কোথায় নিজের মধ্যবিত্ত তথাকথিত ভদ্রজীবনের ছবি আঁকার? গল্প-উপন্যাসে তিনি তা করেননি। তবে যাঁরা তাঁর অনুরাগী পাঠক এবং ভবিষ্যতে যাঁরা তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করবেন, তাঁদের জন্য বড় সুখকর সংবাদ এই যে বছর দুই আগে তিনি যে আত্মস্মৃতি লিখতে শুরু করেছেন, তা অব্যাহত রেখেছেন। এর আগে আমরা পেয়েছি তাঁর শৈশবের স্মৃতিকহন: ফিরে যাই ফিরে আসি। একদম আঁতুড়ঘর থেকে শুরু হয়েছে সেই কহন এবং এ বছরের বইমেলায় আমরা পেলাম তাঁর কিশোরবেলার স্মৃতিকথা: উঁকি দিয়ে দিগন্ত। পাঠশালার পড়ো, পঞ্চম শ্রেণী পার হয়ে স্কুলে যাবে, তার প্রস্তুতি থেকে পরীক্ষার ফল বের হওয়া পর্যন্ত বছর দুয়েক সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ কাহিনি, তাতেই দুই শ পৃষ্ঠা!
আত্মজীবনী কত রকমের হতে পারে, জানি না। কিন্তু হাসান আজিজুল হকের স্মৃতিলহরির প্রথম খণ্ড ফিরে যাই ফিরে আসি আর দ্বিতীয় খণ্ড উঁকি দিয়ে দিগন্ত পড়ার পর মুগ্ধ বিস্ময়ে যেন আবিষ্কার করি—অটোবায়োগ্রাফি তো এ রকমও হতে পারে! ইউরোপের লোকেরা যেটাকে ‘নভেল’ বলে, খানিকটা বা অনেকখানি সেই রকম। এ কথার মানে এই নয় যে ফিকশন আর নন-ফিকশন একাকার হয়ে যাচ্ছে। সত্য কাহিনির অকপটতা অনুভব করা যায়; পড়তে পড়তে মন বারবার সায় দিয়ে বলে, সত্য সত্য, এ রকমই হয়। জীবন এমনই! নিজের জীবন যখন লেখার বিষয়, তখন আত্মপরতা বেশি রকম ক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারে। উত্তম পুরুষে লেখা দস্তইয়েফস্কির আত্মজৈবনিক উপন্যাস কৈশোর-এর নায়ক বলে, অতি মাত্রায় নির্লজ্জ না হলে কেউ আত্মজীবনী লিখতে পারে না। রাগী, একপেশে মন্তব্য বটে। কিন্তু এতে এইটুকুন সত্য আছে যে পৃথিবীতে অনেক আত্মজীবনী লেখা হয়েছে অমরত্ব লাভের আত্মম্ভর আশায়, যেখানে জীবনের একটিমাত্র পিঠ শুধু দেখা যায়। বিশেষত বাঙালি সমাজে অনেক আত্মজীবনী লেখা হয়েছে নিজের ও পূর্বপুরুষের মহিমা প্রকাশের বাসনায়।
কিন্তু সচেতন পাঠকের অনুভবে অথবা সজ্ঞায় আত্মপরতার সেই খাদ ধরা পড়ে। গভীর মনোযোগের সঙ্গে হাসান আজিজুল হকের উঁকি দিয়ে দিগন্ত পাঠ করতে করতে মনে সেই কথাটাও উঁকি মারে—কোথাও লেখক নিজেকে লুকোচ্ছেন না তো? এ যে বয়ঃসন্ধিকাল, কত গ্লানি উঁকি মারে এই কালে! সেসব কথা এড়িয়ে যাননি তো লেখক? দেখলাম, না, মোটেও বাদ রাখেননি। বাৎস্যায়নের পোকায় কাটা কামসূত্র হাতে পেয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বইটির ছবিগুলো দেখতে দেখতে কিশোর হাসানের মনে ও শরীরে কী সব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তার বিবরণ এখানে রয়েছে এবং সেই সূত্রে তিনি বছর দুয়েক আগের এক স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছেন। মরদানা নামের এক পাড়াতো বুবু, যার বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু স্বামী অকম্মা বলে তার সঙ্গে যে থাকে না, যার বুকজোড়া ছিল কাঁচা বেলের মতো এবং সেই বেল দুটোর দুই বোঁটা ছোরার মতো যখন তাঁর বুকে খচ করে লেগেছিল, তখন তাঁর চোখে কেমন পানি চলে এসেছিল! আর কামসূত্র পড়ার বয়সে সেই প্রসঙ্গটি স্মরণ করে কী মনে হয়েছিল—এই সমস্ত কথা অকপটে লিখেছেন তিনি।
আত্মজৈবনিক রচনা করে সেতু—অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যতের। হাসান আজিজুল হকের উঁকি দিয়ে দিগন্ত তেমনই একটি সেতু। এ লেখায় সন-তারিখের বালাই নেই; কিন্তু সময়টি চিনে নিতে একটুও কষ্ট হয় না। ঘটনাপ্রবাহ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের এক গ্রামীণ জনপদের। কিন্তু সারা দেশের ও সমস্ত পৃথিবীর ঢেউ ছুঁয়ে যায় সেই জনপদের মানুষগুলোকে। বিশ্বযুদ্ধ, মহামারি, বভুক্ষা, হিন্দু-মুসলমান কাটাকাটি-ভাগাভাগি, কংগ্রেস-মুসলিম লীগ—সবকিছু এসে পড়ে। এবং সবই দেখা যায় পাঠশালার পড়ো এক বালকের চোখ দিয়ে। আবার এই সমস্ত বড় বড় ঘটনার অন্তরালেই বয়ে চলে মানুষের চিরন্তন জীবনপ্রবাহ, দেশ-কাল নির্বিশেষে যেখানে মানুষ শুধুই মানুষ। কত মানুষ, কত ঘটনা, কত কথা, কত দৃশ্য, কত মুহূর্ত, কত অনুভব—সম্পূর্ণ একটি ভুবন। কিন্তু সেই ভুবন আজ হারিয়ে গেছে, যেমন সেই কিশোরটিকে আজ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এত কথা বলার পরও কিছুই বলা হলো না আসলে। এ যে সমাজগবেষকের, ইতিহাসবিদের, নৃতত্ত্ব-পণ্ডিতের কাজ নয়—সে কথাও বলা দরকার। কিন্তু তাতেও সব কথা বলা হয় না; উঁকি দিয়ে দিগন্ত থেকে যা পাওয়া যায়, তা যে আর কোনো ধরনের রচনা থেকে এবং হাসান আজিজুল হক ছাড়া আর কারও কাছ থেকেই পাওয়ার নয়—এই কথাটি বারে বারে মনে হয়। সে জন্য প্রত্যাশা করি, তাঁর স্মৃতিলহরির পরবর্তী পর্বগুলিও রচিত হবে।

অনেক দূরের ঢাকা
জাহীদ রেজা নূর

ঢাকা পুরাণ—মীজানুর রহমান \ প্রথমা \ জানুয়ারি ২০১১ \ প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী \ ৩০০ টাকা ঢাকা শহরেই আমাদের বেড়ে ওঠা। সত্তরের শুরুতে নতুন ঢাকার রাস্তাগুলোই ছিল অপ্রশস্ত। ক’জন মানুষেরই বা গাড়ি ছিল তখন? যে জ্যাম আজ ঢাকা মহানগরীর ললাটলিখন, তার দেখা মিলত কেবল নবাবপুর-সদরঘাটের দিকে গেলে। তাও গাড়ি-বাসের নয়, রিকশার; মাঝে মাঝে অটোরিকশার। সেই ঢাকাই দু-তিন দশকের মধ্যে বেমালুম পাল্টে গেল। ভরাট হয়ে গেল জলাভূমি, মাঠগুলো আর থাকল না, বাইরে লনওয়ালা বাড়িগুলো হারিয়ে গিয়ে উঠল অ্যাপার্টমেন্টের পর অ্যাপার্টমেন্ট—এক চিলতে জায়গাও ছাড়া হলো না। যে মোহাম্মদপুর বা মিরপুরের শরীরে মফস্বলের সুবাস পাওয়া যেত, তা-ও ছেয়ে গেল ইট-কাঠ-কংক্রিটে। ঢাকা শহর তার কেন্দ্রের চতুর্দিকে মেলে দিল ডানা। সে ডানা কেবলই প্রশস্ত হচ্ছে।
যে কারণে নতুন প্রজন্ম যখন বেয়াড়া প্রশ্ন করে বসে তা যথেষ্ট বিব্রতকর: এক শায়েস্তা খাঁ’র আমলে টাকায় আট মন চাল পাওয়া যেত— এ কথা বলে ওদের কাছে আর নিস্তার নেই—হাতীর পুল নাম কেন হলো এই রাস্তার, এখানে কি হাতীর চলাচল ছিল? মালিবাগে কি মালীরা থাকত? এই জায়গাটার নাম লোহারপুল কেন? ধানমন্ডি নামের কারণ কী? তোমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে রেসকোর্স বল কেন?—প্রশ্নের পর প্রশ্নে নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার উপক্রম।
মীজানুর রহমান আমাদের বাঁচিয়ে দিলেন। ঢাকা শহরের শিরা-উপশিরার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিলেন। এমন নয় যে ঢাকার ইতিহাস আগে কেউ লেখেননি, কিংবা মীজানের পর এ বিষয়ে লেখা থেমে থেকেছে। তারপরও বলা যায়, মীজানের ঢাকা পুরাণ বইটি মন কাড়ে আড্ডার ভাষা আর রসের ভিয়েন দিয়ে তথ্য পরিবেশনার অসাধারণ ঢংয়ের কারণে। এক একটি অধ্যায়ে প্রবেশ মানেই আজকের পুরনো ঢাকার এক একটি রহস্যের উন্মোচন। শুরুতে সত্তর দশকের ঢাকার কথা বলেছি। মীজানুর রহমান আমাদের নিয়ে যান তার চেয়েও অনেক দূরের এক ঢাকায়। সত্তরের দেখা ঢাকার কথা আমরা যখন বলি, তখন আমাদের সন্তানেরা যে অপার বিস্ময় নিয়ে তা শোনে, মীজানুরের কাছ থেকে তারও বহু আগের ঢাকার কথা শুনে আমাদের মধ্যে সে একই বিস্ময়ের জন্ম হয়। মীজানুর তাঁর দেখা এবং তাঁর গবেষণা দিয়ে অজানা ঢাকাকে খুলে দিলেন আমাদের সামনে।
মনোযোগী পাঠকের জন্য এ এক সোনার খনি। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নামকরণ, ঐহিত্যবাহী খাবার-দাবার, বাজার, সিনেমা হল, মসজিদ-মন্দির, বইয়ের দোকান, আহসান মঞ্জিলসহ পুরনো প্রাসাদ, পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা, ঘোড়দৌড়ের মাঠ, জিন্দাবাহার-সাঁচিবন্দরসহ এমন অনেক বিষয় উঠে এসেছে, যাকে নতুন করে চিনে নিতে হচ্ছে, যার অনেককিছুই আজকের ঢাকায় পাওয়া যাবে না। আলোর ঝলকানির মতোই মাঝে মাঝে কিছু নাম উঠে এসেছে। হাবিবুল্লাহ বাহার, বুদ্ধদেব বসু, জসীমউদদীন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, ভানু বন্দোপাধ্যায়, শহীদ নিজামুদ্দীন আহমেদ, মাহমুদুল হক, কাইয়ুম চৌধুরী…এ রকম অনেক। সেগুলো তথ্য হিসেবে স্থির হয়ে থাকেনি, বরং ইতিহাসের গল্প হয়ে উঠেছে। তাই উল্টো করেই বলি, আমাদের চেনাজানা শহরটাকে এক বইয়ের আঘাতে অচেনা করে দিলেন মীজানুর রহমান। নতুন করে চিনতে হচ্ছে নিজেকে, নিজের শহরকে।
তাই বইটি শেষ করেও মাঝে মাঝে পাতা উল্টিয়ে বার বার পড়ার আনন্দেই বিভিন্ন অধ্যায়ে চোখ রাখতে হয়। দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার…বহুবার ভাষা ও বিষয়বস্তুর কারণে ফিরে যেতে হয় বইটির কাছে। এ বড় আনন্দ যে, বইটি স্রোতস্বীনী নদীর মতোই টেনে নিয়ে যেতে পারে পাঠককে, এককালের প্রমত্তা ধোলাই খালের প্রবাহকে যেমন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেভাবে বন্ধ হয় না বইটির সচলতা, বরং পুনর্বার পঠনে তা আরো বেগবান হয়ে ওঠে।

নতুন মানুষের আকাঙ্ক্ষায় লজিকবিদ্যা
মোহাম্মদ আজম

তিমির জন্য লজিকবিদ্যা—ফরহাদ মজহার \ আগামী প্রকাশনী \ প্রচ্ছদ: শিবু কুমার শীল \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ ৪৫ তিমির জন্য লেখা হয়েছে যে বই, তাতে কি আর সবাই দাঁত বসাতে পারবে? তিমি তো যে সে মেয়ে নয়—সাগর আর শঙ্খের সন্তান। খাসা মগজ। অফুরান আগ্রহ। দেদার খাটতে পারে। দিব্যি ছক কেটে এঁকে ফেলে লজিকের নতুন কারখানা। বিনা আয়াসেই উচ্চারণ করে দিব্যবাণী, যা তার ওস্তাদেরই মনের কথা। লেখক অবশ্য আমাদের অভয় জুগিয়ে যান—ঠারেঠুরে জানিয়ে দেন, সম্ভব। বোঝা তো সম্ভবই, আমল করাও এমন কিছু কঠিন নয়। কেবল ভিতরবাগে নজর দেওয়ার কৌতূহল চাই, চাই নিষ্ঠা আর শ্রম। তাহলেই তিমির জন্য লেখা বইটি হয়ে উঠবে ‘তিমিদের’ জন্য। তিনি পথের কতক ইশারা বাতলানোর কাজ নিয়েছেন কেবল। সে পথ চিন্তার। জ্ঞান ও জ্ঞানতত্ত্বের। মানুষ হিসাবে নিজের সম্ভাবনায় ইমান রাখার। তিমির জন্য লজিকবিদ্যা বাংলাভাষীদের জন্য সেই নতুনলোকের বলিষ্ঠ আহ্বান।
বইটির নামের মধ্যে ফাঁক বা ফাঁকি বিশেষ নেই। এটা লজিকেরই বই। কিন্তু যুক্তির শুকনা ছকে পাঠক যেন হাঁফিয়ে না ওঠে, তার জন্য যথেষ্ট কায়দা-কসরত করেছেন লেখক। কিংবা হয়তো তাঁকে বাড়তি কিছুই করতে হয়নি। যেহেতু আমাদের কোনো কোনো সময় কাটে ‘সজল নৈঃশব্দ্যের মধ্যে, লজিক এবং লজিকের অনুপস্থিতির মাঝখানে’, তাই কাব্যের জন্য, উপন্যাসের জন্য একটা পরিসর তৈরি হয়েই থাকে। এ বইয়ের উপন্যাস অংশ তাই লজিক-গণিত-বিজ্ঞান-দর্শনের নাছোড় হিসাব-নিকাশকে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে নিয়ে ঠিকই আপন সুরতে রূপবান হয়ে ওঠে। আদিতে তিমিকে সাগর আর শঙ্খের পয়দা বলে চিনিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে কল্পনা আর বাস্তবের যে মিশেল তৈরি হয়, তাকে পর্যাপ্ত মূল্য দিয়ে তিমি বাস করতে থাকে ইট-কাঠ-পাথরের এই নগরে। দিব্যি জ্বরে ভোগে, আইসক্রিম খায়, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা-বেড়ানো চলতে থাকে। তার বন্দী খোঁপা কাঁধের ওপর মুক্তি পেলে স্পষ্ট শোনা যায় ‘শঙ্খের আওয়াজ’। আবার তার হাস্য-লাস্য-স্নিগ্ধতা-খুনসুটির মধ্যেই বুদ্ধির শান চাবুকের মতো বশীভূত করে তার ওস্তাদকেও—যিনি কবি, কিন্তু ‘কবি’ অভিধাটির চালু তাৎপর্যে স্পষ্টতই বিব্রত।
আমরা অবশ্য এসব নরম আরামের অবসর বইটিতে খুব বেশি পাই না। তিমি এখানে জ্বরে ভোগে বটে, কিন্তু সে জ্বরে ভাইরাসের চেয়ে ‘চিন্তাশীলতা’র ভূমিকাই প্রবল। বহুদিনের খরার পর বৃষ্টি নামলে ‘বাংলার বৃষ্টি’ ‘ইট, লোহা আর পাথর ভেঙে’ নিজের স্রোত তৈরি করে নেয়। তদুপরি, এখানকার সাগরের জল ‘জননীমূলক’। বলা যায়, উপন্যাসত্ব বা কবিত্বের লোভে না পড়ে লজিকবিদ্যার ভাষ্য তৈরির কাজেই বইটি নির্বিকার এগোতে থাকে।
সে ভাষ্যের প্রথম লক্ষ্য যুক্তিশাস্ত্রের গোড়ার কথাগুলো খোলাসা করে বলা। বলা হয়েছে সরল ভাষায়, সংক্ষেপে; কিন্তু জটিল এই বিষয়টির গভীরতা যেন ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকে পুরোমাত্রায় হুঁশিয়ার থেকে। ধাপে ধাপে, কখনো কথা চালাচালির মাধ্যমে, কখনো চিঠি লিখে, কখনো বা আস্ত প্রবন্ধের মতো নোটে চলেছে যুক্তিশাস্ত্র শেখার নানা পর্ব। এ শিক্ষার সবচেয়ে মূল্যবান দিক বোধ করি সৃজনশীলতা—পশ্চিমা শাস্ত্রটি তোতাপাখির মতো না শিখে কীভাবে নিজের জীবনে ও কাজে সৃষ্টিশীলভাবে খাটানো যায়, তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ফলে কথা উঠেছে পাঠ্যপুস্তকের হালচাল এবং শিক্ষার পদ্ধতিগত দিক নিয়ে। কথাগুলো নতুন নয়। কিন্তু বাস্তব নজির হিসেবে দুই ক্ষেত্রেই এই ছোট্ট বইটি আমাদের জন্য পথনির্দেশক হয়ে উঠতে পারে। বইটি জোর দিয়েছে নিজের ভাষায় যুক্তিশাস্ত্রের চর্চার ওপর। দৈনন্দিন জীবনযাপনের ভাষায়। স্বভাবতই পরিভাষার কথা এসেছে। কথাগুলো বাংলায় পরিভাষা প্রণয়নের ক্ষেত্রে মনে রাখলে আমরা উপকৃত হব।
এ বইয়ের বড় অংশজুড়ে আছে পশ্চিমা যুক্তিবিদ্যার ইতিবৃত্ত। তার কাজের ধরন, সংকটের জায়গা, প্রগতি ও সীমাবদ্ধতা। ধারাবাহিক খতিয়ান পেশ করে লেখক দেখিয়েছেন, পশ্চিম বুদ্ধি দিয়েই বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা টের পেয়েছে, বুঝেছে প্রজ্ঞার মহিমা। ফলে বাংলার পুরোনো ভাবমণ্ডলকে নতুন দুনিয়ার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে আবিষ্কার করার বিরাট সুযোগ এখন আমাদের সামনে। এটাই এ গ্রন্থের অন্তর্নিহিত আকাঙ্ক্ষা—যুক্তি-বুদ্ধির সর্দারি আর টেকনোলজির দৌরাত্ম্যে পীড়িত দুনিয়াকে মুক্ত করে নতুন মানুষ গড়ার অভিযানে বাংলার ভাবের কার্যকর অংশগ্রহণ। মজহারের কবিতা-গদ্যে এ কথা বহুবার শুনেছি আমরা। এ বইতে যুক্তিবিদ্যার শাস্ত্রীয় সিঁড়ির ছায়ায় ব্যাপারটা দেখিয়ে দেওয়া হলো।
বইটি সাজানো হয়েছে সংগীতের আদলে। পরিচ্ছেদের নাম দেওয়া হয়েছে সাংগীতিক পরিভাষা থেকে। সঙ্গে আছে সংশ্লিষ্ট পরিভাষার ছোট ছোট ভাষ্য। ভাষ্যগুলো বাংলায় সংগীতবিষয়ক লেখালেখির সাবালক দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য। উপলব্ধির এক প্রজ্ঞাময় স্তরে যুক্তি-গণিত-বিজ্ঞান-দর্শন-সংগীত তো বটেই, এমনকি কাব্য আর ভাষার অন্য সব কারিগরিও একাকার হয়ে যায়। তিমির জন্য লজিকবিদ্যা সেই সামঞ্জস্যের উত্তম নজির।

জলেশ্বরীর বিশ্বভ্রমণ
কাজল রশীদ

জলেশ্বরীর দিনপত্রী— সৈয়দ শামসুল হক \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ প্রচ্ছদ: শিবু কুমার শীল \ শুদ্ধস্বর \ ৩৭৫ টা� ‘নদী তুমি দীর্ঘ অতি, নদী জীবন
ঘাটে ঘাটে রাখিয়াছো অমূল্য রতন।’
গানে গানে চমকিত হওয়ার মতো চিরন্তন এক সত্য উপস্থাপিত হয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে আবহমান বাংলার প্রাণভোমরা হলো নদীনদী কথা বলে, জীবনানন্দ দাশের ভাষায় ‘নদী তুমি কোন কথা কও ?’
নদী ও মানুষে একাত্ম হলেই বোধ করি জানা যায় সেই কথা। উত্তর প্রজন্মের কবি সৈয়দ শামসুল হক-এর জলেশ্বরীর দিনপত্রী যার অনুপম উদাহরণ। কুড়িগ্রামের এক নদীর বিশ্বভ্রমণের নির্মোহ কথন। সাহিত্য ও সাংবাদিকতার চেনাধারা থেকে ব্যতিক্রম। জনয়িতা যেহেতু সাহিত্যিক, সব্যসাচিরূপে পরিগণিত। করোটি যাঁর সাংবাদিকসুলভ সহজাত দৃষ্টি, কৌতূহল, জিজ্ঞাসা ও বিশ্লেষণপ্রবণতায় ঋদ্ধ। সৃজনকর্ম তাই সাহিত্য-সাংবাদিকতার যুগপৎ রসায়নে উদ্ভাসিত। নিজস্ব ভাষা বোধ, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার রঙে রাঙায়িত।
জলেশ্বরী দিনপত্রীতে প্রাক কথা কিংবা ভূমিকা কোনটিই নেই। ফ্ল্যাপেও নেই বিজ্ঞাপিত শব্দরাজি। লেখার নামকরণ-শিরোনামও অনুল্লেখ্য। সন-তারিখ নেই। সূত্র, টীকা, পাদটীকারও দেখা মেলে না। শুধু রয়েছে ক্রমমান। পাঠ আকর্ষণ ও আনন্দকে সহায়ক করতে এসব থাকা প্রয়োজন ছিল। বানান বিভ্রাটের যত্রতত্র উপস্থিতি পীড়াদায়ক, যা এড়ানো অনিবার্য ছিল।
জলেশ্বরী বাংলাদেশকে ভালবেসে দিনপত্রীতে বিশ্বভ্রমণ করেছে। গুরু সদয় দত্ত যেমন বলেছেন: ‘বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ।’ শিকড় বাংলার মাটিতে রেখে লেখক ঢাকা, কলকাতা, লন্ডন চষে বেড়িয়েছেন। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে গিয়েছেন। বিষয়, কত রকমের উপস্থাপনে ঋদ্ধ হতে পারে ভাষার জাদুকরি খেলায়, শব্দের নিপাট বুননে সাধারণ প্রসঙ্গও কীভাবে অসাধারণ হয়ে ওঠে, তার দৃষ্টান্ত হলো জলেশ্বরীর দিনপত্রী।
নদী যেমন মাঠ-ঘাট-পাহাড়-জনপদ পেরিয়ে সমুদ্রে একীভূত হয়। অপার আনন্দ ও কল্যাণব্রতে বিশ্বমাঝে ছড়িয়ে দেয়। জলেশ্বরীর দিনপত্রীও একই সত্যের ফানুস উড়িয়েছে। ‘ব্যক্তি’ হযে ওঠার কথা বলেছেন। ‘পেইন্টার’ কিংবা ‘রাইটার’ হওয়া-না হওয়ার শানে নজুল বয়ান করেছেন। সদ্যপ্রয়াত চিত্রশিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার কথা বলেছেন। কবি আবুল হোসেন বলেছেন। ১৫ আগস্ট ও বঙ্গবন্ধুর কথা বলেছেন। এভাবে শুধু দেশ নয়, হাতের মুঠোয় ধারণ করেছেন পুরো বিশ্ব।
যার মধ্যে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, গুস্তাভ ফ্লবেয়ার, জালালউদ্দিন রুমি, শামসুর রাহমান, তলস্তয়, যুধিষ্ঠির, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, সত্যেন সেন প্রমুখ ব্যত্ত্বিও চরিত্রেরা।
সৈয়দ শামসুল হকও উন্মোচিত হয়েছেন এই বইয়ে। কথা বলেছেন তাঁর নাটক, উপন্যাস, কবিতাসহ বিবিধ বিষয়ে। যাতে প্রতিভাত হয়েছে
সৃজন যন্ত্রণা ও আনন্দের নির্মোহ নির্যাস।
জলেশ্বরী দিনপত্রী বিশ্বভ্রমণের অপার আনন্দ ও অভিজ্ঞতায় স্নাত হওয়ার
অভাবিত হওয়ার কৌশল বলে দেয়। রং-বেরঙের ঝাঁপি ও তার ভেতরের রসদ, মণি-মাণিক্যকে চেনাজানার সুযোগ করে দেয়, যার স্বত্বাধিকারী হলেন সৈয়দ শামসুল হক। যিনি নানাভাবে সমৃদ্ধ করছেন আমাদের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনকে। সব্যসাচী এই সৃজন কারিগরের সৃষ্ট সম্ভারে জলেশ্বরীর দিনপত্রী আরও একটি মাত্রা যোগ করেছে, যা অভিনব ও চেতনা উদ্দীপক।

‘বাঙাল’ রবীন্দ্রনাথ
তৈমুর রেজা

রবীন্দ্রনাথ: একালের চোখে—আনিসুজ্জামান \ সন্ধানী \ প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ ১৭০ ট� রামায়ণ কাব্যে আছে: রামের আদেশবলে সীতা বনবাসী হয়েছেন। ওঁর সঙ্গে দুই পুত্র—লব আর কুশ। লব-কুশ মায়ের সঙ্গে থাকে বাল্মীকির আশ্রমে, আর বনে বনে রামের ভজন গেয়ে বেড়ায়। পূর্ববঙ্গের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক বুঝতে এটা বোধ করি উপমা হিসেবে খাটে। একনিষ্ঠ দীনতার সঙ্গে বহুকাল পূর্ববঙ্গের বাঙালরা রবীন্দ্রনাথের দহলিজে ধরনা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যে রামের মতো গোমড়া মুখে বসে ছিলেন, তেমন নয়। তাঁর যৌবনের প্রায় পুরোটাই তো কেটেছে পূর্ববঙ্গে। তবু তাঁর লেখা পত্র থেকে টের হয়—পূর্ববঙ্গকে তিনি যতটা নিসর্গ হিসেবে নিয়েছেন, ‘আইডিয়া’ হিসেবে ততটা নেননি।
কিন্তু ‘বিজাতীয় পায়জামা’ পরা বাঙালের দল প্রায় সাধকের ধ্যানে কবিতে আত্মীকৃত করে নিল। এভাবে কবির দখল নেওয়ার ফলে কী ঘটল, সেটা সহজ ভাষায় বলে দিচ্ছেন আনিসুজ্জামান: ‘আমাদের রুচি তিনিই [রবীন্দ্রনাথ] গঠন করে দিয়ে গেলেন’। কবির পুঁজি-পাট্টা থেকেই রুচির জোগান হলো, কিন্তু সেখানে ঘটকালি করলেন কতক বাঙালি মুসলমান। এঁরাই বহুকাল ধরে বার্নিশ করে করে কবিকে আমাদের সঙ্গে প্রায় একাকার করে এনেছেন।
যাঁদের স্মরণে রেখে এই কথাগুলো বলছি, আনিসুজ্জামান তাঁদের অন্যতম। ষাটের দশকে তিনি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৮) নাম দিয়ে একটি সংকলন করেছিলেন। সে সময়ের যেসব চিহ্ন আজও মুছে যায়নি, তার একটি এই সংকলন। যৌবন থেকে অদ্যাবধি আনিসুজ্জামান রবীন্দ্র-চেতনার সোনার কাঠি হয়েই আছেন, রবীন্দ্রনাথ: একালের চোখে বইটি তার সাবুদ। এই বইয়ের কলজের মধ্যেও সেই পুরাতনী বার্তা খোদিত: রবীন্দ্রনাথ আমাদেরই লোক। বইয়ের দ্বিতীয় বার্তা হলো: রবীন্দ্রনাথ সেকেলে নন, সমকালীন। এই ‘কলের যুগে’ রবীন্দ্রনাথ কেমন করে ঠাঁই পাচ্ছেন, সেটা বোঝাতে তাঁর ‘স্বদেশ-শিক্ষা-সমাজের বিবিধ’ ভাবনার ‘সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গি’তে বিশ্লেষণ করছেন আনিসুজ্জামান। কবি যে আমাদেরই লোক, এই বার্তা রটেছে পুরো বইতেই। সমকালীনতার দাবিটি আসছে আরেকটু নির্দিষ্ট আকারে; ‘শুধু গীতাঞ্জলি নয়’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ’, ‘গণতান্ত্রিক চেতনা ও রবীন্দ্রনাথ’—এ রকম কয়েকটি প্রবন্ধে।
লেখক গোড়াতেই মেনে নিচ্ছেন—রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে হবে তাঁর অসংগতি দিয়েই; কারণ তাঁর চিন্তার ধাত হলো: ‘বেশ কিছুকালের জন্যে একটা বিশেষ ভাবনা যখন তাঁকে আশ্রয় করে, তারপরই তিনি সেই ভাবনার কিছু ত্রুটি আবিষ্কার করেন, ব্যগ্র হয়ে পড়েন সেই পরিমণ্ডল থেকে বের হয়ে আসতে।’ ফলে রবীন্দ্রনাথের জবান দু-রকম হলেও তিনি বিগড়ে যাননি, বা একটাকে আড়াল করে অন্যটাতে ফুঁ করেননি—দুটোই শরমিন্দার ধার না ধেরে অবলীলায় বলে গেছেন। দুই বাংলাজুড়ে রবীন্দ্রচর্চায় এই কাণ্ডজ্ঞানের প্রতিফলন অতি সামান্য; চৌদ্দআনা লেখাতেই কবিকে লুকিয়ে-ছাপিয়ে দেখানো হয়েছে। ফলে আনিসুজ্জামানের এই নৈষ্ঠিক পাঠে রবীন্দ্রনাথকে আরেকটু অখণ্ডভাবে টের হচ্ছে। খণ্ডিত পাঠের অন্তত একটি বিপদ লেখক বেশ যত্ন করে দেখাচ্ছেন। পাশ্চাত্যে গীতাঞ্জলির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি ঋষি ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। এই কোণঠাসা পাঠের দোষেই পশ্চিমে কবির কদর বেশি দিন টেকেনি।
লেখক বইয়ের মুখবন্ধে বলে দিচ্ছেন, ‘সংকলিত প্রবন্ধগুলো ৪৪ বছরের পরিসরে লেখা’। এর ‘কিছু গভীর স্বভাবের, কিছু হালকা চালের’। দোষের মধ্যে আছে ‘নানা রচনার মধ্যে কিছু পুনরাবৃত্তি’। এই দোষটা বড্ড চোখে লাগে, কতক জায়গায় একই উদ্ধৃতি তিন জায়গায় খাটানো হয়েছে। কয়েকটি প্রবন্ধ বাদ দিলে বেশির ভাগই অগোছালো, আচম্বিতে প্রসঙ্গ পাল্টে যাওয়ার দরুন খেই পাওয়া মুশকিল। খেটেখুটে তৈরি করা প্রবন্ধগুলোর পাশে ঢেঁকি-গেলা ফরমাশি লেখাগুলো বিসদৃশ ঠেকেছে।
তাঁর প্রবন্ধগুলো কেমন? ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা, দ্বিজেন্দ্রলালের সমালোচনা’ প্রবন্ধটি সংহত, নতুন; মেজাজটাও ভারি রসিক। রবিবাবুর সঙ্গে দ্বিজু রায়ের এই ঝগড়া বাংলা সাহিত্যে প্রায় কিংবদন্তি। দ্বিজেন্দ্রলাল ‘সোনার তরী’ কবিতার নিন্দা করতে গিয়ে লিখছেন, ‘…কবিতাটির গদ্যার্থ যা দাঁড়ায় তাহা নিতান্ত অস্বাভাবিক। কোন কৃষক রাশি রাশি ধান কাটিয়া, কি করিবে ভাবিয়া না পাইয়া, কূলে নির্ভরসা হইয়া বসিয়া থাকে না; সে ধান সে বাড়ি লইয়া যায়’। রবীন্দ্রনাথ নরম ভাষায় এর ‘ইঙ্গিতময় প্রত্যুত্তর’ দিলেন। কিন্তু দ্বিজু রায় তাতে নিরস্ত নন, ফিরে চিত্রাঙ্গদার খুব একচোট নিন্দা করলেন। এই কোঁদলের যে ইতিহাস লেখক তুলে ধরছেন, তাতে ফুর্তি তো আছেই, কিন্তু শিরদাঁড়াটা খুঁজতে হবে আরও নিচে, যেখানে লেখক এই দুজনের মতান্তরের মধ্যে ‘বাংলা সাহিত্যের একটা বিশেষ যুগের মনোবৃত্তি ও রুচিবোধের’ ইতিহাস তুলে ধরছেন।
আনিসুজ্জামানের লেখালেখির ধাতটাই এমন; নিস্তরঙ্গ, হিল্লোল তুলে দেওয়ার মতো হুড়োহুড়ি নেই, কিন্তু সন্তর্পণে মধু জমে, নির্জল করে ভাবলে তলানির ক্ষারটা পাওয়া যায়। একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনের ধ্রুবতারা’ গানটির ইতিহাস জানাচ্ছেন লেখক, যে-গান কবি নিবেদন করেছিলেন এক মানবীকে: ‘চার মাসের মধ্যেই, একটু বদল করে তা-ই দেয়া হলো ব্রহ্মকে’। আনিসুজ্জামান অসীমের স্পন্দ বইয়ের ওপর করা তাঁর আলোচনার সঙ্গে বইটির লেখক আনিসুর রহমানের জবাব জুড়ে দিয়েছেন। প্রাজ্ঞ-তর্কের একটি নজির হিসেবেও এটা পাঠ করা চলে।
একটা দ্বিধার কথা জানানো দরকার। রবীন্দ্রনাথের সূত্রে লেখক এক জায়গায় বলছেন, ‘জাতিগত স্বধর্ম পালন করতে গিয়ে নিম্ন-বর্ণের মানুষের মন মরে গেছে। সে যন্ত্র হয়ে একই কাজের পুনরাবৃত্তি করে চলেছে।’ কিংবা গান্ধী প্রসঙ্গে লেখক জানাচ্ছেন: ‘রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের যোগ ঘটানোই যে গান্ধী-রাজনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, সে-কথা রবীন্দ্রনাথের মতো আর কেউ তখন উপলব্ধি করেননি।’ নিম্নবর্গকে নিষ্ক্রিয় শ্রেণী হিসেবে ভাবা, বা তার ধর্মবোধকে হীনজ্ঞান করার জন্য রবীন্দ্রনাথ এখনকার পণ্ডিতদের কাছে খুব বকাঝকা খাচ্ছেন; বিশেষত, সাবলটার্ন ধারার তাত্ত্বিকেরা এখানে স্পষ্ট করেই রবীন্দ্রনাথকে ভুল ভাবছেন। কিন্তু এই ঝকমারি বিতর্কের আঁচ আনিসুজ্জামানের বইতে কোথাও লাগেনি।
কিছু প্রবন্ধ আছে দীর্ঘ, কিন্তু সেখানে চলতি কথাই বেশি।

কানা ও দ্রষ্টার হাট
পবন চক্রবর্তী

কানার হাটবাজার—সুমন রহমান \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ শুদ্ধস্বর, ঢাকা। প্রচ্ছদ: শিবু কুমার শীল \ ৯৬ পৃষ্ঠা সাংস্কৃতিক-অধ্যয়ন এ দেশে খুব অর্বাচীন ব্যাপার নয়, অল্প হলেও লেখালেখি হয়েছে। এটা মনে রেখেই বলতে হবে, সুমন রহমান প্রণীত কানার হাটবাজার একটি পাইওনিয়ার গ্রন্থ। কারণ, দুইআনা-ছয়আনা নয়, গোটা বইটিই সাংস্কৃতিক-অধ্যয়নের মানসে রচিত।
সুমন রহমান জানাচ্ছেন: নগর, জনসংস্কৃতি ও গণমাধ্যম—‘এই তিন পরস্পর-সম্পর্কিত বলয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আত্মপরিচয় বিনির্মাণের ধারণা কীভাবে বিকশিত হয়েছে’ সেটাই এই বইতে তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়। কীভাবে অনুসন্ধান করছেন তিনি? ‘আমার পদ্ধতি সমন্বিত: প্রথমত, একটি সাংস্কৃতিক টেক্সটকে আমি চিহ্নতত্ত্বীয় পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করছি এবং তার পর আমার এথনোগ্রাফিক পর্যবেক্ষণের সাথে এর সমন্বয় করছি।’
কিন্তু পড়তে গিয়ে শুরুতেই হোঁচট খেতে হলো। জনসংস্কৃতি, নগর বা গণমাধ্যম—এগুলোর কোনো সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি; ফলে অনেক কথা আঁতকা ঠেকে। বইয়ের শুরুর ভাগে, এন্তার তাত্ত্বিকের নাম দিয়ে নানা কথা প্রচারিত হয়েছে, এটা সলতে পাকানোর কাজ। এসব বাতচিতের কোনো তথ্যসূত্র লেখা হয়নি। লেখক ‘ব্যক্তিগত কথনভঙ্গি’র কথা বলেছেন, কিন্তু বিদ্যায়তনিক পরিসরে তথ্যসূত্র না লেখার অধিকার এত অল্পে কারও জন্মায় না। এটা আরও বে-আবরু হয়েছে যখন দেখা গেল, কোথাও কোথাও তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে তথ্যসূত্র দিচ্ছেন। ফলে লেখককে অত্যন্ত অগোছালো ও খানিক হলেও ‘অ্যামেচার’ ঠেকে।
ভয়, তারুণ্য, মৃত্যু, টিভি, সিনেমা, নিম্নবর্গের আর্ট—এ রকম ছয়টি ভাগে বইটি বিন্যস্ত; পর্ব-ভাগ অতি সুচিন্তিত, যৌক্তিক। এই ষড়ভুজা বইটি এত প্রকাণ্ড যে সবদিকে আলো ফেলার ফুরসত নেই। শুধু কয়েকটি প্রবণতা দাগিয়ে রাখা যাক। লেখক সযত্নে একটি ভূমিকা দিয়েছেন, কিন্তু বইটি বুঝতে ভূমিকাটা তেমন কাজে লাগে না। এখানে আলোচনার পরম্পরা রক্ষিত হয়নি, অনেক ক্ষেত্রে ‘অবসকিউর’ ঠেকেছে; এবং পুরো ভূমিকা পড়লে কোনো সংহত মানে তৈরি হয় না।
কানার হাটবাজার গ্রন্থের সবচেয়ে বড় শক্তি বোধ হয় সুমন রহমানের দৃষ্টি। তিনি অনেক কিছু দেখতে পান, বুঝতে পারেন; ঘাপটি মেরে থাকা অর্থের অরণ্যে ঘাই তুলে দেন। আলোচিত খুনি রসু খাঁকে নিয়ে লেখা একেবারে গোড়ার প্রবন্ধ থেকে পড়া যাক। তিনি লিখছেন, ‘রসু খাঁ নয় বরং ক্রসফায়ারই আমাদের সবচে নারকীয় সিরিয়াল কিলার?’ বস্তির ছেলে মজিবুর লেখককে বলছেন, ‘লাল মানে মাইজভাণ্ডার আর নীল মানে সুরেশ্বর। লাল হোক আর নীল হোক, গান দিয়াই আমরা আল্লারে ডাকি’। চটিবইতে পাওয়া নারী-চরিত্র প্রসঙ্গে লেখকের মন্তব্য, ‘রোকেয়াবিবি সীতা ও রূপবানের একটি ইন্টারেস্টিং শংকর। রোকেয়াবিবি যেন সীতার অনমনীয় পৌরাণিক চরিত্রের একটি লৌকিক সমালোচনা।’ একটু নাড়াচাড়া করলেই বই থেকে পেন্ডোরার বাক্সের মতো এ রকম অসামান্য সব দৃষ্টিকোণ, পর্যালোচনা পাঠকের নজরে বিঁধবে।
এর সঙ্গে যোগ করুন তাঁর আলটপকা মন্তব্যের নমুনা, ‘যে হারে সহিংসতা বেড়েছে, তাতে বাংলাদেশের অর্ধেক লোকের রসু খাঁ হয়ে যাওয়ার কথা।’ তাঁর লেখার সবচেয়ে ক্লান্তিকর দিক হবে ‘ভালগার জেনারালাইজেশন’ এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ব্রহ্মাস্ত্রের শিকার তাঁর অসহায় পাঠক। তিনি পাঠককে ‘আপনি’ সম্বোধনে প্রায়ই ‘এককাট্টা শ্রেণী’ হিসেবে নিয়েছেন। উদাহরণ দিচ্ছি: ‘প্রিয় পাঠক, হে অদূর ভবিষ্যতের সেলিব্রিটি, আপনাকে সালাম।’ নিজের মনোভাব তিনি জোর করে ঘাড় গুঁজে দেওয়ার মতো পাঠকের ওপর চাপিয়ে দেন: বসুন্ধরা সিটির অগ্নিকাণ্ড প্রসঙ্গে ‘ইতিমধ্যেই আমরা টের পেতে শুরু করেছি এটা রীতিমতো ফুল লেংথ মুভির চেয়ে বড় লেংথের বিনোদন’, বা বিডিআর বিদ্রোহ প্রসঙ্গে ‘তাদের নৃশংসতায় আমাদের গা শিউরে উঠছে, তারা যে “সাধারণ ক্ষমা”র অযোগ্য এ বিষয়ে আমাদের কোনো সংশয় আর নেই।’ এভাবে নিজের মনস্তত্ত্বের উতোর-চাপান পাঠকের ওপর নির্বিকার চলতে থাকলে একসময় পীড়নের মতো লাগে।
সেমিওটিক পদ্ধতিতে চিহ্ন-পাঠের অসামান্য ক্ষমতা আছে লেখকের। সাংস্কৃতিক-অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এই বিরল ক্ষমতাই তাঁর মূল পুঁজি। ‘এক বক্তা, এক শ্রোতা’ প্রসঙ্গে তিনি একটি আলোকচিত্রের যে-পাঠ লিখেছেন, তা ইতিমধ্যে কিংবদন্তি (যদিও বল্গাহীনভাবে ফিকশনালাইজ করা হয়েছে এখানে)। ‘দুইরকম তারুণ্য’ লেখাটি, তিনি যে রচনা-রীতি গ্রহণ করেছেন, তার সবচেয়ে সফল দৃষ্টান্ত। পাঠককে মুখ্য-সুখ্য ধরে নেওয়ার কেশর-ফোলানো ভাব নয়, আন্তরিকভাবে তিনি দুই প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গির অর্থের খোঁজ করছেন। মাটির ময়না ছবিটি, তাঁর অসামান্য বিশ্লেষণে ধরা পড়ছে: ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই একটি সাংস্কৃতিক প্রকল্প’ হিসেবে। বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে লিখতে গিয়ে খচ করে রায় লিখে দেন, ‘সে ইতিহাসের পাতায় খলনায়ক হয়ে থেকে’ যাবে।
খুচরো আলোচনা শেষ, এবার উপসংহার। কানার হাটবাজার অবশ্য-পাঠ্যগ্রন্থ। বইটি ওপেন-এন্ডেড, তাই ঠোরামুরির জায়গা আছে বেশুমার। তাতে লেখক-পাঠক দুই পক্ষেরই জিত। সুমন রহমান এই প্রজন্মের সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্লেষকদের অন্যতম, এ বইতে অন্তত সেই দড়টা টের পাওয়া যাচ্ছে।

আত্মজীবনী না ‘উপন্যাস’
মেহেদী উল্লাহ

নদী নিরবধি—রিজিয়া রহমান \ ইত্যাদি \ প্রচ্ছদ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ ২৪০ টাকা বাবা দিয়েছিলেন ‘জোনাকি’। কিন্তু ১২ মাসই অসুখ-বিসুখ লেগে থাকত মেয়েটির, ছুটোছুটির সামর্থ্যহীন। গলার শব্দেও কমজোর। তাই সুন্দর নামটা সইল না। জোনাকির বদলে জুটল শুটকি। বাড়িতে দুধ দিতে আসা হিন্দুস্থানি গোয়ালারা পর্যন্ত ডাকত এ নামে। যোগ হলো আরও দুটি নাম, নকরানি ও লাকড়ি। সেই মেয়েটিই শেষ জীবনে এসে আত্মজীবনীতে দিয়েছেন নিজ শরীরের বর্ণনা, শরীরটা ছিল যেন ছোটখাটো একটা তালপাতার সেপাই। সরু ঘাড়-গলা, বেঢপ বড় মাথা আর কাঠি কাঠি হাত-পা, একেবারে রীতিমতো এক ‘আগলি ডাকলিঙ।’
তো এই মেয়েটি এ কালের কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান। জন্ম পশ্চিম বঙ্গের ভবানীপুরে, চিকিৎসক বাবার সন্তানের অবোধবেলা কেটেছে ভবানীপুর হাসপাতালে। স্মৃতি হাতড়ে জীবনের স্মৃতিগ্রন্থে হাজির করেছেন শৈশবমাখা নাম—বেনীমাধব স্ট্রিট, হরিশ মুখার্জি রোড, জগুবাবুর বাজার, দ্বারিক ঘোষের মিষ্টির দোকান, আলিপুর চিড়িয়াখানা, ঘোড়দৌড়ের মাঠ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, কালীঘাটের ব্রিজ, গড়ের মাঠ…।
মানুষের বেলায় দারুণ অমিশুক থাকলেও শৈশবের স্মৃতিতে মিশে আছে ঠিকই, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স্মৃতি। সাইরেনের বিকট চিৎকার, বোমার গগনবিদারী আওয়াজ, জাপানি বোমারু বিমানের গুট গুট শব্দ আর অ্যান্টি-এয়ারক্রাফটের ঘন ঘন কড়া ধমক…।
রিজিয়ার মা ছিলেন পদ্মাপারের অভিজাত রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে, অথচ কলকাতায় নিজেকে মানিয়ে নিয়ে ‘আধুনিকা’। হঠাৎ আশ্চর্য খবর রটল, জাপানিরা এবার অন্য রকম বোমা ফেলবে, দেখতে খেলনা পুতুলের মতো। শিশুদের সাবধানে রাখতে বলা হলো মায়েদের।
যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যেও তিনি শোনান ‘কলকাতা’র নামকরণ নিয়ে মজার এক গল্প। সুতানুটি গোবিন্দপুরের জলা-জঙ্গল কিনেছিলেন ইংরেজ জব চার্নক। সেটিই এককালে হয়ে উঠল বিশিষ্ট নগরী কলকতা। সুতানুটি থেকে কলকাতা হলো কীভাবে? গল্পটি শুনুন, এক ইংরেজ সাহেব এলেন সুতানুটির ঘেষোডাঙায়। সেখানে ঝোপজঙ্গল থেকে গরুর জন্য ঘাস কেটে ফিরছিল একলোক। কাউকে না পেয়ে সাহেব লোকটিকেই জিজ্ঞেস করল, ‘এ জায়গাটার নাম কী?’ লোকটা তো আর ইংরেজি বুঝত না, ফলে সে ভাবল, সাহেব বুঝি জানতে চাইছে, ঘাসগুলো কবে কাটা। তখন বেশ করে জবাব দিল, ‘কাইল কাটা’। আর সাহেব বুঝল, ‘ক্যালকাটা’। এ রকম গল্প আরও কটি আছে। হাওড়া ব্রিজের গল্পটিও বেশ অদ্ভুত-আজগুবি।
যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গেই আছে অভিবাসান্তরের ইতিহাস।
রিজিয়ার লেখক হওয়ার প্রসঙ্গটি আছে এভাবে, ‘পূর্বপুরুষের দেশ থেকে এনেছিলাম গ্রামীণ জীবনাচারের অভিজ্ঞতা, সেইসঙ্গেই হয়তো নিজের মধ্যে বয়ে এনেছিলাম ঐতিহ্যগত মেধা ও জেনেটিক বিজ্ঞানের অবদান জিন। সে সুবাদে হয়তো দাদার “জিন” আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল তাঁর লেখার কলমটি। আমাকে হতে হলো কালি-কলমের মানুষ। হলাম লেখক।’
লেখক না হলে হতেন চিত্রকর বা ভাস্কর। পেনসিল স্কেচের দারুণ নেশা ছিল তাঁর। লিখেছেন, ‘এখনো কখনো কখনো ভাবি, চিত্রকর বা ভাস্কর হলেই নিজের সঠিক প্রতিভাটি প্রকাশ করতে পারতাম।’
‘সেথা সব পড়শি বসত করে’ পর্বে আছে রিজিয়ার বেড়ে ওঠার জগৎ। ফরিদপুরের সংস্কৃতি, প্রকৃতি, প্রতিবেশই লেখকের পড়শি। এর ভেতর দিয়েই জীবনের পরিণতি-বিকাশ। প্রকৃতির সঙ্গে জীবনে মিশেছে গানের স্রোত—লোকসংগীত ও শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের সুর।
দেশভাগের পর চারপাশে শুরু হয় ‘পাকিস্তানকরণ’। পোশাক, সংস্কৃতিতে আগ্রাসন, রবিঠাকুরের সংগীতের বদলে স্কুলের অ্যাসেম্বিলিতে কবি গোলাম মোস্তফার গান নির্ধারণ, নজরুলপনা ইত্যাদি। জানতে বাধ্য করা হচ্ছিল আল্লামা ইকবাল বড় কবি, রবিঠাকুর ও নজরুলের চেয়েও বড়।
পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় শুনলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নাম। সপ্তম শ্রেণীতে উঠে জানলেন, অন্যান্য বিষয় বাংলা পাঠ গ্রহণের অনুমতি থাকলেও ধ্রুপদী, আরবি ভাষা এবং বাধ্যতামূলক উর্দু ভাষা শিখতে হবে। আর শিক্ষকেরা ইতিমধ্যে জিন্নাহর টুপিও পরা শুরু করে দিলেন। খাঁটি মুসলমান হওয়ার হিড়িক চারদিকে। উর্দু বলতে, লিখতে ও শিখতে হবেই। বাংলা নাকি নাপাক ভাষা। পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রবণতা যাই হোক, রিজিয়ার অবস্থাটা তখন কী? পাকিস্তানের ইসলামি তমদ্দুনের পবিত্র পানিতে ‘ব্যাপটাইজড’ না হয়ে মনটাকে ধুয়ে নিলেন শাহলাল ফকিরের আস্তানার মারফতি মরমি গানের সলিলে। শেষ হলো ‘নদী নিরবধি’।
শেষ করে মনে হলো ‘নদী নিরবধি’ আত্মজীবনী না ‘উপন্যাস’! জোনাকি কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার সঙ্গে সঙ্গে অভিবাসান্তরিত হচ্ছে ঘটনাপ্রবাহ। আর ধরাবাঁধা জীবন নয়, বয়সের ধারা মেনে উপস্থিত হয়নি জীবন, জীবন এসেছে প্রসঙ্গের প্রয়োজনে। বরং এই গ্রন্থ পরিকল্পনায় ছিল তাঁর মহাযুদ্ধ আর অভিবাসান্তরের দর্শী জীবন।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৭, ২০১১

Category: প্রতিক্রিয়া
Previous Post:আমার ছবি চিরদিন বেঁচে থাকবে – মকবুল ফিদা হুসেন
Next Post:রবীন্দ্রনাথ, এই সময়ে

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑