• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

ফেরা – শেখ আবদুল হাকিম

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » গল্প » ফেরা – শেখ আবদুল হাকিম

১৯৮৫ সালে আমার বয়স ছিল তেইশ, ভাষা আর সাহিত্যে শিক্ষকতা করার জন্য একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করছি। সে বছর শীত কেটে গিয়ে বসন্ত একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। সময়টা তখন খুব সকাল। মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের পেছন দিকটায় নতুন জমি বরাদ্দ পেয়ে দু-একটা করে বাড়ি তৈরি করছে মানুষজন। এই রোডে আমাদেরটাই একমাত্র অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। আমি আমার ঘরে বসে পড়াশোনা করছি। আমরা ছয়তলায় থাকি।
ছাত্র হিসেবে আমি খানিকটা অলস, অভ্যাসমতো বই-খাতা থেকে মুখ তুলে মাঝেমধ্যে জানালা দিয়ে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছি। এখান থেকে রাস্তাটা বেশ ভালোই দেখতে পাই। এ মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি রাস্তার ডান মাথায় জসিম কাকুর পাঁচ কোনা বাড়ির বাগান। বাড়িটা আগে পাঁচ কোনা ছিল না, তিন দিকে রাস্তা দিতে হওয়ায় ছোট-বড় বাহু নিয়ে পেন্টাগন হয়ে গেছে।
জসিম কাকুর পাশের বাড়িটা খাদেম চৌধুরীর। খুবই সুন্দর মানুষ ওঁরা, দুস্থ মানুষকে সাহায্য করার জন্য সবার আগে এগিয়ে আসেন। সব ভালো কাজে সবার আগে। খাদেম চৌধুরীর তিন মেয়ে; বড় মেয়ে তানির সঙ্গে আমার সম্পর্ক। তো স্রেফ অভ্যাসবশেই চোখ বোলাচ্ছি ওদিকটায়, আসলে এত সকাল-সকাল ওকে দেখতে পাব বলে আশা করছি না। ওর পড়াশোনার চাপও তো কম নয়।
প্রবীণ ভদ্রলোকের যেমন রুটিন, পাঁচ কোনা বাড়ির জসিম কাকু নিজের শখের বাগানের যত্ন নিচ্ছেন, থেমে থেমে প্রতিটি গাছের গোড়ায় পানি দিচ্ছেন। বাগানটা লোহার নিচু রেলিং আর তিনটে পাথুরে ধাপ দিয়ে রাস্তা থেকে আলাদা করা।
রাস্তা ফাঁকা, কাজেই পাশের সড়ক থেকে সরু গলিপথ হয়ে আমাদের এদিকে চলে আসা সচল ব্যক্তিটির ওপর আমার চোখ পড়লই। একটু পর জসিম কাকু আর খাদেম চৌধুরীর বাড়ি দুটোকে পাশ কাটাবে সে, আদৌ যদি আরও এগোতে থাকে। লোকটা আমার দৃষ্টি ধরে রাখল, কারণ তার পরনে গাঢ় রঙের শতচ্ছিন্ন ন্যাকড়া নোংরা রংধনুর মতো লাগছে। মিরপুর মাজার থেকে ছিটকে আসা কোনো পাগল? এত সকালবেলা সাধারণত কোনো ভিখারিকে এদিকে দেখা যায় না।
মুখে দাড়ি, হাড্ডিসার, মাথায় গেরুয়া রঙের কাপড় জড়ানো। গরম পড়া সত্ত্বেও ছেঁড়া আধখানা কম্বল কাঁধে ফেলে রেখেছে। তার ওপর বড়সড় নোংরা একটা চটের বস্তা বয়ে আনছে সে। ভাত-রুটি কিংবা টুকিটাকি যা পায়, কুড়িয়ে ভরে রাখে ওটায়।
আমি তাকিয়ে আছি। পাগলটা জসিম কাকুর বাড়ির সামনে দাঁড়াল। একটা হাত আকাশের দিকে তাক করা, অপর হাতটা নেড়ে জসিম কাকুর কাছ থেকে কিছু চাইছে। নিশ্চয় সাহায্য, মানে ভিক্ষাই হবে। জসিম কাকু খুব নিচ-প্রকৃতির বদমেজাজি মানুষ, হাড়কিপটে হিসেবে খুব দুর্নাম, লোকটাকে মোটেও পাত্তা না দিয়ে হাত ঝাঁকাচ্ছেন, অর্থাৎ আপদ বিদায় হতে বলছেন। কিন্তু ভিখারিটা মনে হলো নিচুগলায় ঘ্যানঘ্যান করে যাচ্ছে। তারপর জসিম কাকুর চিৎকার শুনতে পেলাম আমি।
‘ভাগো বলছি, ভাগো, দূর হও এখান থেকে, আমাকে একদম বিরক্ত করবে না!’
তা সত্ত্বেও নাছোড়বান্দা ভিখারি অসহায় কাতর ভঙ্গিতে অনুনয়-বিনয় করতে লাগল। এবার সে পাথরের ধাপ তিনটে বেয়ে ওপরে উঠে পড়ল, রেলিং ধরে ঝাঁকাচ্ছে। ওই ঝাঁকানোটাই কাল হলো। অনুদার জসিম কাকু তাঁর সমস্ত ধৈর্য এক নিমেষে হারিয়ে ফেললেন। লোকটার বুকে দু হাত দিয়ে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিলেন তিনি। ভেজা পাথরে পা হড়কে গেল, হাত ছুটে গেল রেলিং থেকে, পাকা ফুটপাতে পিঠ দিয়ে পড়ল লোকটা। আমি তার পা দুটোকে আকাশের গায়ে মোটা দাগ টানতে দেখলাম। আর যে আওয়াজটা শুনেছি, তা শুধু কারও খুলি ফাটলেই সৃষ্টি হতে পারে। বাকি শরীর রাস্তার ওপর পড়লেও লোকটার মাথা পড়েছে প্রথম ধাপটার কিনারায়।
গেট খুলে হন্তদন্ত হয়ে বাগান থেকে রাস্তায় নেমে এলেন জমিস কাকু, লোকটার ওপর ঝুঁকলেন, হাতের কবজি ধরে পালস দেখলেন, বুক পরীক্ষা করলেন। ভয়ে কাবু, তার পরও উপস্থিত বুদ্ধি ধরে রেখেছেন। লোকটার পা ধরে টেনে ফুটপাত থেকে রাস্তায় নামিয়ে দিলেন। রাস্তার ফাঁকা দুটো দিক দ্রুত একবার দেখে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লেন, বাগানের গেট লাগালেন, বাড়ির ভেতর ঢুকে বন্ধ করে দিলেন সদর দরজা। তিনি নিশ্চিত, তাঁর অনিচ্ছাকৃত অপরাধ কেউ দেখতে পায়নি।
একমাত্র সাক্ষী আমি। একটু পরই এক পথিক পাশ কাটানোর সময় মৃত ভিখারির পাশে থামল। তারপর আরও লোকজন এল। আসতেই থাকল। একসময় আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের অ্যাম্বুলেন্স এসে লাশ নিয়ে চলে গেল।
এই হলো ঘটনা। এরপর আর কিছু নেই। ব্যাপারটা নিয়ে কেউ কখনো আলাপ করেনি।
আমার কথা যদি বলেন, মুখ না খোলার ব্যাপারে আমি খুব সতর্ক ছিলাম। আমি হয়তো কাজটা ভালো করিনি, কিন্তু প্রবীণ একজন মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে কী লাভ হতো আমার, যিনি কখনো আমার কোনো ক্ষতি করেননি? ভেবে দেখুন, ভিখারি লোকটাকে মেরে ফেলার কোনো ইচ্ছে তাঁর ছিল না। স্রেফ একটা দুর্ঘটনাই ছিল ওটা। জীবনের শেষ কটা বছর খুনের মামলায় জড়িয়ে ভুগবেন, মনে হয়েছে এটা আমার চাওয়া উচিত নয়। আমি চেয়েছি, শাস্তি যা পাওয়ার তা তিনি নিজের বিবেকের কাছ থেকে পাবেন।
একটু একটু করে ব্যাপারটা আমি ভুলে যাচ্ছি, কিন্তু জসিম কাকুকে যখনই দেখি, অদ্ভুত একটা অনুভূতি নিয়ে আমি চিন্তা করি, ভয়াবহ সত্যটা দুনিয়ায় একমাত্র আমি জানি। কী জানি কেন, তাঁকে আমি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। সেই ঘটনার পর থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সাহস হয়নি আমার।
১৯৮৯ সালে আমার বয়স ছাব্বিশ, ভাষা আর সাহিত্যের ওপর লেখাপড়া শেষ করে আমি এখন কলেজে পড়ানোর জন্য প্রায় তৈরি। খাদেম চৌধুরীর বড় মেয়ে তানি আমাকে নয়, বিয়ে করেছে অন্য এক তরুণকে। কে জানে তানিকে সে আমার মতো ভালোবাসতে পারছে কি না, কিংবা তানিকে পাওয়ার অধিকার আমার চেয়ে তার বেশি ছিল কি না।
যা-ই হোক, ওই সময় তানি সন্তানসম্ভবা, প্রসব হতে খুব বেশি দিন আর বাকি নেই। আমার চোখের সামনে প্রতিদিন আরও অপরূপ হয়ে উঠছে তানি। আগের মতোই নিজেদের সুন্দর বাড়িটায় থাকে সে, স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে।
আমার রেজাল্ট বেরোতে দেরি হচ্ছে, সকালবেলা কয়েকজন ছাত্রকে বাড়িতে বসে ব্যাকরণ পড়াই আমি। পড়ানোর ফাঁকে, আমার যেমন অভ্যেস, মুখ তুলে এদিক-ওদিক তাকাই। ডিসেম্বরের ঠান্ডা হিম সকালটিতেও চোখ বুলাচ্ছি রাস্তার ওপর।
হঠাৎ আমার হূৎপিণ্ড ডাঙায় তোলা মাছের মতো লাফাতে শুরু করল। তারপর আমার সন্দেহ হলো, হয় আমি পাগল হয়ে গেছি আর নয়তো দৃষ্টিভ্রমের শিকার।
রাস্তা ধরে হেঁটে আসছে চার বছর আগে দেখা সেই ভিখারি বা পাগল, জসিম কাকু যাকে খুন করেছিলেন। পরনে সেই রংচঙে, নোংরা ন্যাকড়া। মাথায় গেরুয়া রঙের কাপড় জড়ানো। কাঁধে ছেঁড়া আধখানা কম্বল। মুখে দাড়ি, হাড্ডিসার শরীর। এক হাতে বোঝা—সেই চটের বস্তাটা।
ছাত্রদের কথা ভুলে গিয়ে লাফ দিয়ে জানালার সামনে চলে গেলাম। হাঁটার গতি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছে পাগলটা, ভাবটা যেন সে তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে।
‘লোকটা প্রাণ ফিরে পেয়েছে?’ ভাবলাম আমি। ‘জসিম কাকুর ওপর প্রতিশোধ নেবে?’
কিন্তু লোকটা ওই বাড়ির সামনে থামল না। বাগান আর লোহার গেটকে পাশ কাটিয়ে হাঁটছে সে, পাশ কাটাল রেলিংটাকেও। তবে থামল চৌধুরীদের বাড়ির গেটে। ঠিক থামলও না, ওদের গেট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। পাথর ফেলা সরু পথ ধরে বাড়ির দরজার সামনে চলে গেল। তারপর আধখোলা কবাট পুরোটা ফাঁক করে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
‘এখনই আসছি!’ ছাত্রদের বসতে বলে ছুটলাম আমি। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। এলিভেটরে চড়ে নিচে নামলাম, ছুটলাম রাস্তা ধরে, তানিদের বাড়ির গেটে পৌঁছে হাঁপাচ্ছি। ভেতরে যখন ঢুকেছে, একসময় তো লোকটা বেরোবে। আমি অপেক্ষা করছি।
কিন্তু এ রকম অবস্থায় কি স্থির থাকা সম্ভব? ওই লোক কি আমার-আপনার মতো সাধারণ কেউ? প্রবল উত্তেজনায় বাড়িটার সামনে পায়চারি করছি; না পারছি ভেতরে ঢুকতে, না পারছি বাইরে থাকতে। ওদের কেউ যদি দরজা খুলে বাইরে বের হতো, তাকে আমি লোকটার কথা জিজ্ঞেস করতে পারতাম। কিংবা সতর্ক করতে পারতাম।
কী বলতাম? বলতাম তোমাদের বাড়িতে নতুন জীবন ফিরে পাওয়া একজন লোক ঢুকে পড়েছে? শুনে ওরা এ রকম ধরে নেবে না তো, তানিকে বিয়ে করতে না পেরে আমি পাগল হয়ে গেছি?
দেখতে দেখতে চল্লিশ মিনিট হয়ে গেল, লোকটা তানিদের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে না। এরপর আর নিজেকে আমি ধরে রাখতে পারলাম না। গেট খুলে, দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম বাড়ির ভেতর।
চোখমুখে অপার হাসি আর আনন্দ নিয়ে আমার সামনে পড়লেন তানির মা। তিনি যেন আমার অপেক্ষাতেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিংবা বাইরে বেরোতে যাচ্ছিলেন। ‘কী চাও…কে তুমি…আরে, তুমি? এখানে? কী আশ্চর্য!’
তানির মা চিরকাল আমার প্রতি সদয়। আমার মুখে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি। কিন্তু বাড়ির ভেতর কী ঘটছে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। বাড়ির সবাইকে সামনের ঘরে দেখা যাচ্ছে। সবাই খুব উত্তেজিত। ভীষণ খুশি। তারপর বুঝলাম।
মাত্র আধঘণ্টা আগে মা হয়েছে তানি। যিনি খবরটা দিলেন, সেই বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে বাধ্য হয়ে হ্যান্ডসেক করতে হলো আমাকে।
প্রসঙ্গটা কীভাবে তুলব বুঝতে পারছি না। ভাবলাম, নাকি চুপ করে থাকাটাই ভালো? কিন্তু এ রকম একটা সময় হঠাৎ আমার অনধিকার প্রবেশ একটা ব্যাখ্যা দাবি করে না? দ্বিধায় পড়ে আমি মধ্যপন্থা অবলম্বন করলাম। ওদের বললাম, ‘বেল না বাজিয়ে ঢুকে পড়লাম, তার কারণ নোংরা একটা বস্তা নিয়ে আমি একজন ভিখারিকে আপনাদের বাড়িতে ঢুকতে দেখেছি। ভাবলাম কিছু চুরি করে কিনা…।’
আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল ওরা। ভিখারি? বস্তা? কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। ওরা সবাই সামনের এই বৈঠকখানায় কয়েক ঘণ্টা হলো বসে আছে। কই, কাউকে তো বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেখেনি।
মান-সম্মান বাঁচানোর জন্য আমাকে বলতে হলো, ‘তা হলে দেখতে ভুল করেছি আমি।’
তানির স্বামী আমাকে তানির কামরায় নিয়ে গেল। এ রকম পরিস্থিতিতে কী বলতে হয় জানি না। তানিকে বললাম, ‘খুশির খবর। ভালো থাকো।’ শিশুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী নাম রাখবে?’
তানি জবাব দিল, ‘আমার সাত কি আট নম্বর দেবর ফোন করে জানিয়েছে, ওর নাম রাখতে হবে শক্তি।’
মনে মনে একটা বিস্ময়ের ধাক্কা খেলাম। আমার আর তানির ব্যক্তিগত একটা মুহূর্তে আমরা দুজন একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বিয়ের পর আমাদের প্রথম সন্তান ছেলে হলে তার নাম রাখা হবে শক্তি। কি না কি ধরা পড়ে যায়, ভয়ে আমি আর তানির দিকে তাকালামই না। আর কিছু না বলে বিদায় নিয়ে চলে এলাম ওদের ওখান থেকে।
বাড়ি ফিরে ভাবলাম, ‘এই লোকই যে সেই ভিখারি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই আমার মনে। একেই জসিম কাকু মেরে ফেলেছিলেন। লোকটা প্রতিশোধ নিতে আসেনি, বরং তানির ছেলে হিসেবে পুনর্জন্ম নিতে এসেছিল।’
যা-ই হোক, দু-তিন দিন পর আমার বিশ্লেষণ উদ্ভট বলে মনে হলো এবং ধীরে ধীরে সব আবার আমি ভুলে গেলাম।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণই ভুলে যাওয়ার কথা, কিন্তু ১৯৯৯ সালের একটা ঘটনা আবার আমাকে সব মনে করিয়ে দিল। বয়স বাড়ছে, যত দিন যাচ্ছে ততই বুঝতে পারছি আমার ক্ষমতা কত কম। জানালার সামনে বসে বই পড়ে অবসর সময় কাটাই। তবে বই খুলে মুখ তোলার অভ্যাসটা এখনো আমার আছে।
তানির ছেলে, শক্তি, ওদের বাড়ির রেলিং দেওয়া ছাদে একা একা খেলছে। ওর বয়সী একটা ছেলেকে এই কাণ্ডজ্ঞানহীন খেলাটা ঠিক মানাচ্ছে না। ও নিশ্চয়ই ওর বাপের মতো কম বুদ্ধি পেয়েছে। ও আমার ছেলে হলে আনন্দ পাওয়ার জন্য এ রকম একটা কর্কশ খেলা খেলত না।
রেলিংয়ের মাথায় টিনের কয়েকটা খালি কৌটা সাজিয়েছে সে, তারপর চার গজ দূর থেকে নুড়িপাথর ছুড়ে ওগুলোর একটায় লাগানোর চেষ্টা করছে। স্বভাবতই প্রায় সব পাথর ছুটে গিয়ে পাশের বাড়ির বাগানে পড়ছে। আর ওই বাগানটার মালিক আমাদের পাড়াতুতো জসিম কাকু। যাঁকে সবাই বদমেজাজি হিসেবে ভয় পায়।
জসিম কাকু এ মুহূর্তে বাগানে নেই। কিন্তু গাছের প্রচুর ফুল নষ্ট হয়েছে দেখলে তিনি না আবার রাগে [হিতাহিত] জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে দরজা খুলে বাড়ি থেকে বাগানে বেরোলেন জসিম কাকু। এত দিনে একেবারে থুত্থুড়ে বুড়ো হয়ে গেছেন তিনি, কুঁজো হয়ে এক পা-দুই পা করে হাঁটেন, হাতে ধরা লাঠিটা ঠকঠক করে কাঁপে। বাগানে তিনি থামলেন না, সরু পাকা পথটা ধরে গেটের দিকে হাঁটছেন। নষ্ট হওয়া ফুলগুলো এখনো তিনি দেখতে পাননি। একটু স্বস্তি বোধ করলাম। বাগান থেকে রাস্তায় বেরোনোর জন্য লোহার গেটটা খুললেন তিনি, ধাপ তিনটে টপকে ফুটপাতে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন আস্তে-ধীরে।
ওই একই সময়ে শক্তি—জসিম কাকুকে সে দেখতে পাচ্ছে না—অবশেষে টিনের একটা কৌটায় পাথর লাগাতে পারল। কান ঝালাপালা করা বিচ্ছিরি একটা আওয়াজ হলো। রেলিং থেকে ছিটকে গিয়ে ছাদের কার্নিশে দু-তিনটে বাড়ি খেল, তারপর পড়ল পাশের বাগানের এক ধারে—প্রতিটি ধাক্কা প্রচণ্ড কর্কশ শব্দ ছড়াল। জসিম কাকু তখন ছোট্ট সিঁড়িটার মাঝখানে রয়েছেন। কর্কশ টিনের একাধিক আওয়াজ চমকে দিল তাঁকে, আকস্মিক রাগে অন্ধ হয়ে সেদিকে ঘুরতে গেলেন তিনি, অমনি তাঁর পা হড়কে গেল, ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেলেন সিঁড়ির ওপর, প্রথম ধাপটায় বাড়ি খেয়ে ফেটে খেল খুলি।
আমি সবটুকুই দেখলাম, তবে শিশুটি জসিম কাকুকে, কিংবা জসিম কাকু শিশুটিকে দেখেননি। কোনো কারণে খেলা ছেড়ে ছাদ থেকে নেমে গেল শক্তি। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জসিম কাকুর লাশকে ঘিরে লোকজনের ভিড় জমে গেল। সবার কাছেই ব্যাপারটা পরিষ্কার যে দুর্ঘটনাবশত নিজের বাড়ির সামনে পড়ে মারা গেছেন তিনি।
দুপুরের খানিক আগে রাস্তা আর ফুটপাতের ওপর লোকজন জড়ো হয়েছে। একটু পরই বাগানের ভেতর ফাঁকা জায়গায় জসিম কাকুর জানাজা পড়া হবে। জসিম কাকুর আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমিও আছি।
হঠাৎ দেখলাম লোকজন চোখমুখে অস্বস্তি আর অসন্তোষ নিয়ে দুই ভাগ হয়ে দুই পাশে সরে যাচ্ছে। কেউ কেউ এমনকি নাকে রুমালও চাপা দিচ্ছে। কী ব্যাপার বোঝার জন্য ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছি। তারপর দেখতে পেলাম তাকে। সেই ভিখারি, জসিম কাকু যাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে ফেলেছিলেন। গায়ে বহুরঙা নোংরা ন্যাকড়া, মাথায় হলুদ পট্টি, একটা চটের বস্তা টেনে আনছে। লোকজনের ভিড় ঠেলে, কারও দিকে না তাকিয়ে, সোজা চলে গেল সে। একসময় তাকে আমি আর দেখতে পেলাম না। যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই ফিরে গেল—দুবার।
জসিম কাকুকে কবর দিয়ে ফিরে আসার পর দুঃসংবাদটা জানতে পারলাম আমি। তানির ছেলে শক্তিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নেই তো নেই-ই। চৌধুরী পরিবার হন্যে হয়ে কোথাও আর খুঁজতে বাকি রাখল না, কিন্তু আজও সেই ছেলের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ওদের অনুসন্ধান থেমে নেই। মিথ্যে আশা নিয়ে আজও ওরা শক্তিকে খুঁজছে। ওদেরকে আমার থামতে বলতে মন চায় না।

[মূল: ফার্নান্দো সরেনটিনো]
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৩, ২০১১

Category: গল্প
Previous Post:রোকেয়ার উত্তরসূরি
Next Post:সিউল – কাইয়ুম চৌধুরী

Reader Interactions

Comments

  1. মাহফুজ

    September 27, 2012 at 5:42 pm

    দারুন । সুন্দর………

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑