• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

সৃজনশীল ১০ বই – একুশে বইমেলা ২০১১

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » বই পরিচিতি » সৃজনশীল ১০ বই – একুশে বইমেলা ২০১১

মুক্তিযুদ্ধের মর্মচেরা গাথা
আখতার হুসেন

অন্ধকারে নয় মাস—রেজাউর রহমান \ প্রকাশক: অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ প্রচ্ছদ: আবুল
কাহিনির পটভূমি রাজধানীর গণ্ডি পেরিয়ে জয়দেবপুরের অদূরবর্তী ব্রহ্মডাঙ্গা ও তার আশপাশের পাঁচটি গ্রাম বা জনপদ। এখানে ‘দু-চার পাঁচটা বাদ দিলে মাঝারি গোছের সচ্ছল পরিবার খুব একটা নেই।’ কাহিনির কেন্দ্রে আছে ‘বাতিঘরের’ মতো সেই ব্রহ্মডাঙ্গা বাজার, যেখানে ইংরেজি কোনো পত্রিকা আসে না। বাংলা পত্রপত্রিকা যাও আসে, তাও দু-এক দিন পর পর। শৌখিন গোছের চায়ের স্টলে রেডিও-ট্রানজিস্টার বাজে। ‘সেই সুবাদে দু-চারজন দিনের খবরাখবর পায়। মুখে মুখে ছড়ায়ও কিছুটা।’ একাত্তরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এরকমটাই ছিল উল্লেখ করা ওই জনপদের দিনানুদৈনিকতার চালচিত্র।
এ উপন্যাসে অনেক চরিত্রের সমাগম। ক্রমশ তারা মূর্ত হলেও সময়ের ব্যবধানে তাদের অনেককেই আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে তারা মনের পটে স্থায়ী দাগ কেটে যায়। মনে হয়, তাদের সবাই আমাদের অনেক চেনাজানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে বসবাসকারী সুবিমল, একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পরেও যে ঘরে ফেরে না, যাকে হন্যে হয়ে যে সন্ধানরত, সন্তানের প্রতীক্ষায় যার ঘুম নেই, সেই লক্ষ্মণ এমনই একটি চরিত্র। একাত্তরে লক্ষ্মণের মতো এ রকম পিতা-মাতার সংখ্যা ছিল বেশুমার। লক্ষ্মণের হাহাকার আমাদেরও দীর্ণ-বিদীর্ণ করে।
গজারিয়া, ইনদুরকুমা, তিতাসের টেক, ডাহুককান্দা ও উজানীর চর, আমার বিশ্বাস, রেজাউর রহমানের অন্তরঙ্গভাবে দেখা সব জনপদ। না-হলে তাদের রূপরসগন্ধসমেত এত ধ্রুবচিত্র তিনি আঁকলেন কী করে! প্রতিটি চরিত্রই জীবন্ত। সহজ-সরল তাদের জীবনের ধারা। তবে সেই জীবন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিলোড়নরহিত থাকার এতটুকু অবকাশ পায়নি।
অন্ধকারে নয় মাস-এর কাহিনি বা ঘটনাক্রম যতই অগ্রসর হতে থাকে, ততই প্রকাশমান হতে থাকে চন্দন, ইসরাফিল, কুসুমী আর মালতীর চরিত্র। তাদের চোখ দিয়ে একটি নির্দিষ্ট গ্রামজনপদে মুক্তিযুদ্ধের চলমান ঘটনাধারা এবং তার পরিণতি আমরা লক্ষ করি। পাকিস্তানি বাহিনীর মারণযজ্ঞ, তাদের পরিচালিত নিপীড়ন-নির্যাতন এবং ত্রাস কীভাবে জনপদের পর জনপদের মানুষকে গ্রাস করেছিল, তার সমূল চিত্র মূর্ত হয়ে ওঠে। খুবই জ্বলন্ত তখনকার পরিপার্শ্ব ও প্রকৃতির বিবরণ।
এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র ইসরাফিলকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কখনোই অস্ত্র হাতে দেখি না। তবে অস্ত্র হাতে না নিলেও সে মুক্তিযুদ্ধ-সৃষ্ট অভিঘাতের বাইরে চলে যায় না। নেপথ্য থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সক্রিয় সমর্থন জুগিয়ে চলে। দোতারা হাতে লালনের গান গায় কখনো কখনো। কিন্তু তার সেই সাংগীতিক জীবন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একপর্যায়ে চরম নির্যাতনের শিকার হয় ইসরাফিল। তবুও দমে না। বরং মুক্তিযুদ্ধে দুঃসহ রকমে পীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের জন্য তার সহমর্মিতা অন্তহীন। তাদের প্রত্যেকের জন্য সে কাতর, উদ্বেল ও উৎকণ্ঠ।
কুসুমী—এ বইয়ের অন্যতম নারী চরিত্র, বেদে বহরের সদস্যা। তাদেরও জীবন নিরাপদ নয়। পঁচিশে মার্চের পর তারা ঢাকার ডেমরাঘাট থেকে পালিয়ে এখানে চলে এসেছে। আকস্মিক পরিচয়ের সুবাদে ক্রমেই ইসরাফিলের সঙ্গে একটা হার্দ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে কুসুমীর। হয়তো পরোক্ষ ভালোবাসা। না হলে যখন রাতের অন্ধকারে তাদের বেদে বহর নিয়ে কুসুমীরা আরও নিরাপদ কোনো আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যায়, তখনো তার অবচেতনে জেগে থাকবে কেন কুসুমী? তাই তো হঠাৎ করেই সে দেখে, ‘মালতী বেদে নৌকার গলুইয়ে বসে একটানা হেসে চলেছে। পরনে তার কলকে পেড়ে শাড়ি। এলোচুলে লাল বুনো ফুল। কপালে টিপ। সে নদীর জলে মৃদু মৃদু পা নেড়ে চলেছে হালকা খেলাচ্ছলে। ইসরাফিলের ঘুম ভেঙে যায়।’ এ সবকিছুই তো তার অবচেতনে সংগুপ্ত বাসনারই আঁকিবুকি।
বস্তুত এই উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি অভিঘাত যেমন চিত্রিত, তেমনি সেই অভিঘাত সৃষ্ট পরিণতিও সমভাবে উপস্থিত। মালতী চরিত্রও মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ পরিণতি। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধর্ষিতা মালতী যেন ইসরাফিলের জীবনে আবির্ভূত হয় কুসুমীর বিকল্প মানবীসত্তার রূপ ধরে। মালতী যেন তার হারিয়ে যাওয়া কুসুমী। মানসিকভাবে বিকল মালতীকে তাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তার চেষ্টার অন্ত নেই। যখন ভোর রাতে ‘সে শোনে, কুয়োতলায় ঝপঝপ পানি ঢালার শব্দ’, যখন দেখে বিবস্ত্র মালতী বালতি বালতি পানি ঢালছে তার গায়ে, যেন শরীরে লেপটে থাকা নয় মাসের সমস্ত পঙ্কিলতা ধুয়েমুছে ফেলতে উন্মুখ, তখন তার সঙ্গে সে ‘বেদের মেয়ে কুসুমীর মুখশ্রীর অদ্ভুত মিল খুঁজে পেতে থাকে।’ আর তার একার একাগ্র চেষ্টায় মালতীর সুস্থ হয়ে ওঠার লক্ষণে তার চোখেমুখে পরিতৃপ্তির আভাস। ঠোঁটে অমলিন হাসির ঝিলিক। তাই দেখে চন্দন ইসরাফিলকে বলে, ‘বনে জঙ্গলে বন্দুক লইয়া ঘুরছি। আইজ বুঝলাম, আসল যোদ্ধা তুই। তরে আম চিনি নাই…’, এ কথা বলে আর ‘চন্দনের দুই গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে নামে।’
অশ্রু চন্দনের দুগাল বেয়ে নামে তো বটেই, আমাদেরও দুচোখ আপনাআপনি সিক্ত হয়ে ওঠে।

হার না মানা জীবনকাহিনি
সোহরাব হাসান

মাদারডাঙার কথা—শওকত আলী \ প্রকাশক: নান্দনিক, ঢাকা \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ \ ১৭৩ পৃষ্ঠা
মাদারডাঙ্গার কথা বাংলাদেশের যেকোনো গ্রাম বা প্রত্যন্ত জনপদের কথা হতে পারে, কুশলী কথাশিল্পী শওকত আলী মাদারডাঙ্গাকে তাঁর কাহিনির উপাদান হিসেবে বেছে নিয়েছেন। যে গ্রামটিতে একটি মাজার আছে, আছে সেই মাজারকে ঘিরে কিছু ভক্ত মুরিদান, আছে খাদেম এবং লোকবিশ্বাসে আস্থাশীল কিছু নিরীহ মানুষ। আরও আছে উন্নয়নের নামে শহুরে ভদ্রলোকদের উৎপাত তথা পুঁজির আগ্রাসন।
বাংলাদেশের আর দশটি গ্রামে যেমন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আছে, স্বার্থের বিরোধ আছে, ভূস্বামী ও ভূমিহীনের অসম লড়াই আছে, আছে অলৌকিক শক্তির প্রতি অন্ধবিশ্বাস, মাদারডাঙ্গা তার থেকে ভিন্ন নয়। তবে সেই বিরোধকে আরও উসকে দিয়েছে তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রাক-আরম্ভে লেখক বলেছেন, ‘ফকির দরবেশদের নিয়ে অনেক কাহিনি ও গল্প এ দেশে সাধারণ মানুষদের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং সেগুলো এখনো গ্রামের বয়োবৃদ্ধদের মুখে শোনা যায়। সেসব কাহিনির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শহুরে ভদ্দরলোকদের নষ্টামি ভ্রষ্টামি তথা পুঁজির দৌরাত্ম্য। শেষমেশ গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো এ দৌরাত্ম্য মেনে নেয় না।’
শওকত আলীর উপন্যাসে ইতিহাস থাকে, জনজীবনের চিত্র থাকে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ, যারা কেবল ইতিহাসের দর্শক নয়, নির্মাতাও। এ উপন্যাসের কাহিনি বিন্যস্ত হয়েছে দৌলতালি নামে একজন দরবেশকে কেন্দ্র করে, যিনি গ্রামের নিঃস্ব, অসহায় মানুষের সহায়, গ্রামবাসী যাঁর কথা মানে, যিনি নিজে সংসারবিরাগী হয়েও জগৎ-সংসারকে আপন করে নেন। একসময় মাদারডাঙ্গায় গোড়া সেপাই এসেছিল ব্রিটিশ বেনিয়াদের স্বার্থরক্ষায়, এখন দেশি সেপাই তথা থানা পুলিশ ও প্রশাসন সেই স্থান পূরণ করেছে। উপন্যাসের শুরুতে আমরা আকলিমা নামের এক অসাধারণ ত্যাগী নারীর সাক্ষাৎ পাই, যিনি গভীর জঙ্গলে গিয়ে সোনার মোহর খুঁজে পেতে সাপের কামড়ে মারা যান। দেশীয় গুনিনের চিকিৎসা তাঁকে বাঁচাতে পারেনি। কাহিনির শেষে দেখতে পাই, সাপের দংশনে আহত দৌলতালি বেঁচে যান হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা নেওয়ায়।
আলী আফজাল মাদারডাঙ্গায় গিয়েছেন তাঁর বিরাট কৃষি খামার, পোলট্রি খামার ও মৎস্য খামারসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে, যার পেছনে আছে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা, আছে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মদদ। আলী আফজাল তাঁর প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য খনন করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন মৃত মানষের মুণ্ড, হাড়গোড়। মজুরেরা বিদ্রোহ করে। প্রকল্পে বিরাট ক্ষতির আশঙ্কায় ঠিকাদার তাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন। সেই মামলার অন্যতম আসামি আব্বাস গজুয়ার। যাঁকে হাবাগোবা যুবক ভাবা হয়। কিন্তু সেই আব্বাস গজুয়া রুখে দাঁড়ান। তিনি দৌলতালিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘না চাচা আমার জিরাইবার সময় নাই। কেহ দুনিয়াতে জিরায় না, আসমানের চাঁদ সুরুজ দেখেন, গাছ বিরিখ দেখেন, ভূইয়ের ফসল দেখেন, কেহ কেহ জিরায় না।…মরনের আগে হামারও জিরান নাই।’
বাংলাদেশের গ্রাম সমাজের রূপান্তর ঘটেছে, সেখানে চাষবাষের জন্য ট্রাক্টর গেছে, আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে গেছে পুঁজি এবং পুঁজির যা ধর্ম, সবলকে আরও সবল এবং দুর্বলকে নিঃস্ব করে। সাধারণ কৃষক তার জমি বিক্রি করে লক্ষ মহাজনের প্রকল্পে বেতনভুক মজুর হচ্ছে। এই যে শহর থেকে গ্রামে পুঁজি যাচ্ছে, সেই পুঁজির সঙ্গে অনাচারও যাচ্ছে, প্রকল্প মালিকের সঙ্গে থানা পুলিশ ও প্রশাসনের লেনদেন হচ্ছে, পুলিশ ভালো মানুষকে দাগী অপরাধী বানাচ্ছে।
অন্যান্য উপন্যাসে যেমন, মাদারডাঙ্গার কথায়ও শওকত আলী শ্রেণীবিভাজিত সমাজের মূল দ্বন্দ্বটি তুলে ধরতে ভোলেন না। সেই সঙ্গে পীর-দরবেশদের প্রগতিশীল ভূমিকা, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখে তাদের একাত্ম হওয়ার বিষয়টিও এখানে উত্থাপিত হয়েছে বিশ্বস্ততার সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত আব্বাস বা দৌলতালি আপস করেন না। এর বাইরে সুজাত আলী মুন্সী, রাজু, শম্ভুনাথ, বাটু বেলাল, ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, হাসেম চৌধুরী—সবাই আমাদের চেনাজানা জগতের মানুষ।
মাদারডাঙ্গার কথা আসলে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামের কাহিনি। লেখককে অভিনন্দন।

কবির জীবনাখ্যান
সৈয়দ আজিজুল হক
যমুনা নদীর মুশায়রা—সেলিনা হোসেন \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা \ প্রচ্ছদ: ধ্রুব
আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের জীবনরস অবলম্বনে উপন্যাস রচনায় সেলিনা হোসেনের রয়েছে এক দীর্ঘ ও গভীর অভিনিবেশ। তাঁর এ ধারার উপন্যাসে ইতিমধ্যে চিত্রিত হয়েছে চর্যাপদ-এর জীবনপরিবেশ, মনসামঙ্গল-এর অন্তর্ভুক্ত চাঁদ সওদাগরের লোকপ্রিয় কাহিনি, চণ্ডীমঙ্গল-এর অন্তর্গত কালকেতু ও ফুল্লরার বৈচিত্র্যময় জীবনগাথা, আমাদের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সবচেয়ে আরাধ্য ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথের বর্ণাঢ্য জীবন, বিপ্লবী নারী প্রীতিলতা ও ইলা মিত্রের কঠিন সংগ্রামশীলতা, বাংলাদেশের ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ কালপর্বের সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস প্রভৃতি। তাঁর এরূপ উপন্যাসভাবনার ক্ষেত্রে সর্বশেষ সংযোজন হলো, উর্দু গজলের কিংবদন্তি-পুরুষ মির্জা গালিবের কবিত্বময় জীবনযন্ত্রণা অবলম্বনে যমুনা নদীর মুশায়রা। এ ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিকের কল্পনাপ্রতিভা এই প্রথম বাংলা ভূখণ্ড অতিক্রম করে দিল্লি-আগ্রাকে স্পর্শ করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে ঔপন্যাসিকের কল্পনাসূত্রকে বাস্তবমণ্ডিত করে তোলার আন্তর্গরজে ভৌগোলিক ও কালিক দূরত্বকে জয় করার জন্য তাঁকে ব্যাপৃত হতে হয়েছে এক কঠিন সংগ্রামে।
মির্জা গালিবের জীবৎকালে (১৭৯৭-১৮৬৯) দিল্লি-আগ্রার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ, সেখানকার উর্দু ও ফারসিভাষী অভিজাত মুসলমানদের জীবনধারা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও রাজদরবারকেন্দ্রিক কাব্যচর্চার আবহ প্রভৃতিকে বাস্তবোচিত করে তোলার অভিপ্রায়ে লেখককে আশ্রয় নিতে হয়েছে এক উত্তম কল্পনারসের। এ জন্য মির্জা গালিবের জীবন ও জীবনব্যাখ্যার বিচিত্রমুখী তথ্য সংগ্রহ, দিল্লি-আগ্রার ভৌগোলিক জীবনপরিবেশকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণসহ নিজেকে এমন একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় পর্যাপ্তভাবে দক্ষ করে তোলার লক্ষ্যে লেখককে পরিচয় দিতে হয়েছে গবেষণামূলক নিষ্ঠার। ইতিহাসের তথ্য নিয়ে উপন্যাস রচনা করতে হলে ইতিহাসরস ও জীবনরসের মধ্যে যে সামঞ্জস্য বিধান করতে হয়, এ ব্যাপারে লেখক সচেতন ছিলেন। প্রসঙ্গত, ঐতিহাসিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উক্তি স্মরণীয়। রাজসিংহ উপন্যাস বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: ‘ইতিহাস এবং উপন্যাসকে একসঙ্গে চালাইতে গিয়া উভয়কেই এক রাশের দ্বারা বাঁধিয়া সংযত করিতে হইয়াছে। ইতিহাসের ঘটনাবহুলতা এবং উপন্যাসের হূদয়বিশ্লেষণ উভয়কেই কিছু খর্ব করিতে হইয়াছে—’। সেলিনা হোসেনের ক্ষেত্রেও আমরা লক্ষ করি, তিনি মির্জা গালিবের জীবৎকালে সংঘটিত ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ নামে বহুলপ্রচলিত ভারতের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রামের ঘটনাটিকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ইতিহাস-সত্যের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেও কবিহূদয়ের পরিপ্রেক্ষিতকে মান্য করেছেন। বিদ্রোহী সেপাইদের দ্বারা সৃষ্ট রক্তপাত এবং পরবর্তীকালে বিজয়ী ইংরেজদের সৃষ্ট রক্তপাত—এই উভয়ই যে কবিহূদয়ে সমান যন্ত্রণার কারণ হয়, তা উল্লেখে লেখক পরিচয় দিয়েছেন ঔপন্যাসিক সততার।
সংগত কারণেই সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসকে ছাপিয়ে কবি মির্জা গালিবই উপন্যাসে বড় হয়ে উঠেছেন। সমগ্র উপন্যাসেই বর্ণিত হয়েছে একজন মহৎ কবির জীবনালেখ্য। ফলে কবিত্বশক্তির জাগরণেই উপন্যাসটি প্রাণবন্ত। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপন্যাসের সমগ্র আবহটিই কবিত্বময়। কবি গালিবের জন্ম-ইতিহাসের মধ্যে লেখক প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন কবিত্বের এক চমৎকার ব্যঞ্জনা। যমুনা নদীর কাছ থেকেই কবি গালিবের জন্মের অগ্রিম বার্তাটি লাভ করেন আগ্রার এক প্রসিদ্ধ কবি। এই ঘটনার মধ্যে উপন্যাসোচিত বাস্তবতা ক্ষুণ্ন হলেও ইতিহাসখ্যাত এক কবির জীবনাখ্যানের সূচনাসূত্র হিসেবে এটি যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং পাঠক এর কাব্যিকতায় গভীরভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
লেখক জোর দিয়েছেন কবির জীবনবৈশিষ্ট্যের ওপর, যেখানে বিষয়বুদ্ধিহীন সুরাসেবী এক কবির জীবনযন্ত্রণাই মুখ্য। দ্রাক্ষারসের আসক্তির মধ্যে তিনি খুঁজে পান তাঁর কবিত্বের উৎসশক্তি। সংসারের মধ্যে থেকেও তিনি সংসারকে শৃঙ্খল মনে করে অন্তরে লালন করেন এক বিবাগী সত্তাকে। ফারসি কবি ওমর খৈয়ামের যোগ্য উত্তরসাধক এই কবির কাছে সুরা আর কবিতাই শেষ কথা। তার মধ্যে সুরাশক্তির পাশাপাশি রয়েছে বাইজি-আসক্তিও। বাইজি-সন্নিধানে বিপুলভাবে তৃপ্তি বোধ করে তার সৃজনশীল সত্তা। ঋণ করে ঘি খাওয়ার চার্বাকনীতিতেও তিনি বিশ্বাসী। আমৃত্যু তাঁর জীবন ঋণভারে জর্জরিত হলেও আসক্তিবিহীন পৃথিবী তাঁর কাম্য নয় মোটেই। তিনি তাঁর বংশবৃত্তির পারম্পর্য ভেঙে তলোয়ারকে পরিণত করেছেন কলমে, যে কলমে আছে প্রেম, যে প্রেম দিয়ে চেয়েছেন জগজ্জয় করতে। হূদয়ের আগুন দিয়ে তিনি কবিতার আলো জ্বালেন। লেখকের চমৎকার ভাষাভঙ্গিটিও মির্জা গালিবের কাব্যময় জীবনপরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হয়েছে।
বৃহদায়তনের এই গ্রন্থের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লেখক গালিবের জীবনস্রোতের মধ্যেই গেঁথে দিয়েছেন তাঁর কাব্যপ্রবাহকে। লেখকের জন্য এটি সহজসাধ্য ছিল না। গালিবের সমস্ত জীবন যে কাব্যসাধনায় উৎসর্গীকৃত সেই সত্যটিই পরস্ফুিট হয়েছে এরূপ বিন্যাসে।

উদ্ভট ঘটনা কেন ঘটে
মশিউল আলম

সুখদুঃখের গল্প—সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ নিমফিয়া পাবলিকেশন \ প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজর
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পে ঢাউস কাঁঠালের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে জ্বলজ্যান্ত এক নারী। প্রেমিক-প্রেমিকা পালিয়ে যাবে বলে নৌকায় চাপে, তারা টের পায় না রাতের অন্ধকারে বিরূপ বাতাসে নৌকা এগোয়নি। সকালের আলোয় যখন তারা দেখতে পেল, প্রেমিকার বাপ-চাচারা ছোটলোকের সন্তান প্রেমিকটিকে মারার জন্য তীরে টেঁটা-বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তখন প্রেমিক-প্রেমিকা নৌকা থেকে নেমে পড়ল হাওরে। হাওর হয়ে গেল মাঠ। সেই মাঠ ধরে হেঁটে চলল তারা।
এ রকম, তাঁর কোনো গল্পে যদি দেখি গরু গাছে উঠেছে, অবাক হব না। কারণ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের অনেক গল্পেই এ রকম বা এর চেয়ে বেশি উদ্ভট ঘটনা ঘটে। বাস্তব জীবনে যেমন ঘটে না, তাঁর গল্পে তেমন অবাস্তব ঘটনা কেন ঘটে আমরা জানি না। লেখক, মানে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেন এবং গল্প লেখেন, তিনিও সম্ভবত জানেন না তাঁর গল্পে এসব উদ্ভট ঘটনা কেন ঘটে।
তার মানে আবার এই নয় যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম উদ্ভটতার শিল্পী। মোটেও তা নয়, নিরেট বাস্তবের চুল পরিমাণ ব্যত্যয় ঘটে না এমন ঘটনার গল্পও তিনি অনেক লিখেছেন। কিন্তু তাঁর ওই অতিবাস্তব বা উদ্ভটের বিবরণগুলো তাঁকে বাংলাদেশের আর দশজন গল্পলেখকের থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়।
গত পাঁচ বছরে লেখা তাঁর কুড়িটি গল্প নিয়ে এবারের বইমেলায় প্রকাশিত সুখ-দুঃখের গল্প পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল তাঁর এই বিশিষ্টতার কথা। অবশ্য শুধু পরাবাস্তবের প্রতি আগ্রহের কারণেই যে তিনি বিশিষ্ট তাও নয়। তাঁর আরও একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি লেখক, গল্প লিখছেন, মানে বানাচ্ছেন বা অন্যের কাছে যা শুনেছেন তাই লিখছেন—এটা তিনি পাঠককে বারবার জানিয়ে দেন। ঈশ্বরের মতো সর্বজ্ঞ, সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক অবস্থানের ভান তাঁর নেই। তিনি পাঠককে ভোলানোর চেষ্টা করেন না, বরং কখনো কখনো তাকে আমন্ত্রণ জানান তাঁর কথনের বা ডিসকোর্সের অংশীদার হতে। আবার, মানুষ হিসেবে তাঁর ভালো-মন্দের বোধ, তাঁর নৈতিকতা এমন প্রকটভাবে ফুটে ওঠে না, যা তাঁকে তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোর ব্যাপারে পক্ষপাতের দোষে দুষ্ট করে। তাঁর গল্পে ভালো মানুষ ও খারাপ মানুষ একসঙ্গেই থাকে। কেউ কাউকে দুঃখ দেয়, ঠকায়, পীড়ন করে; কেউ সব সয়ে যায়। কিন্তু ভালো লোকটিকে লেখক পছন্দ করেন, খারাপ লোকটিকে ঘৃণা করেন—এ রকম দেখা যায় না। তাঁর গল্পে নায়কও নেই, ভিলেনও নেই।
তিনি রসিকও বটেন। এমন রসিক যে দুঃখের গল্পও বলতে পারেন রসিকতার ছলে। কিন্তু এই রসিকতা কখনো লেখকের নিষ্ঠুরতা বলে মনে হয় না; চরিত্রদের নিয়ে তিনি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও করেন না। তাঁর চরিত্রগুলোর স্বভাব-চরিত্র আমরা জানতে পারি তাদের পারস্পরিক কথাবার্তা, একের প্রতি অন্যের আচরণের বর্ণনা থেকে। একই কারণে তাঁর গল্পের উদ্ভট অংশগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়। যেমন, ‘কাঁঠালকন্যা’ গল্পের প্রধান পুরুষচরিত্র আবসার, যে কিনা বিরাট এক কাঁঠালের ভেতর থেকে একটি মেয়েকে বেরিয়ে আসতে দেখেছে বলে লেখককে জানায়, তার কাছে ও রকম উদ্ভট ঘটনা ঘটা অসম্ভব নয়। কারণ, আমরা দেখেছি, সে বিশ্বাস করে তার প্রথম বউ ছিল ডাইনি। আবসারের কথাবার্তায় আমরা তার এই অন্ধবিশ্বাসের শক্তি টের পাই, এবং আমাদের মনে হয় লেখককে সে যে বিবরণ শোনায়, তা আমাদের কাছে যতই উদ্ভট আর অসম্ভব ঠেকুক, তার কাছে তা সত্য।
আখ্যানশৈলীর বিচারে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যে বহুস্বর-ভিত্তিক পদ্ধতিটি প্রয়োগ করেন, এবং এই পদ্ধতিতে বহু বছর ধরে তিনি যেভাবে গল্প লিখে চলেছেন, তাতে মনে হয়, তাঁর এই একান্ত নিজস্ব কথনভঙ্গিটি তাঁকে পুনরাবৃত্তির বৃত্তে আটকে রেখেছে। তাঁর লেখা কুড়ি বছর আগের গল্প ও গত বছরের গল্পের মধ্যে ভাষায়, বর্ণনাশৈলীতে, সুরে ও মেজাজে খুব বেশি পার্থক্য ধরা পড়ে না। কিন্তু জীবন ও জগৎ সম্পর্কে গভীর শিল্পীসুলভ অন্তর্দৃষ্টি ও আখ্যান রচনায় তাঁর যে দক্ষতা রয়েছে, তাতে তিনি অবশ্যই অনেক নতুন গল্প আমাদের উপহার দিতে পারেন।

কুর্নিশ বাদশাহ নামদারে
ধ্রুব এষ
বাদশাহ নামদার—হুমায়ূন আহমেদ \ প্রকাশক: অন্য প্রকাশ, ঢাকা \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ \ ২৩১
নাসিরুদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ূন মীর্জা। জন্ম চতুর্থ জিল্কদ, ৯১৩ হিজরি। তাঁর নামের আবজাদ সংখ্যা হলো ৯১৩। বাদশাহ নামদার বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন এভাবে, ‘আমি বাদশাহ নামদার গ্রন্থে ৯১৩ আবজাদ সংখ্যায় সম্রাট হুমায়ূনের বিচিত্র কাহিনী বর্ণনা করব।’ বিচিত্র কাহিনি। ২১৩ পৃষ্ঠায় সেই বিচিত্র কাহিনি বর্ণনা করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। রং চড়ানোর চেষ্টা করেননি অযথা। কারণ, বয়ান আছে বইয়ের ভূমিকায়, ‘সম্রাট হুমায়ূন বহুবর্ণের মানুষ। তাঁর চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে আলাদা রং ব্যবহার করতে হয়নি। আলাদা গল্পও তৈরি করতে হয়নি। নাটকীয় সব ঘটনায় তাঁর জীবন পূর্ণ।’
বাদশাহ নামদার ইতিহাস আশ্রিত ফিকশন। ইতিহাসের কোনো চরিত্রকে নিয়ে, সরাসরি নিয়ে, এই প্রথম (এবং এই শেষ?) কোনো উপন্যাস রচনা করলেন হুমায়ূন আহমেদ। সেটা আবার হুমায়ূন মীর্জার মতো ‘বহু বর্ণে’র একজন সম্রাটকে নিয়ে। কবি, চিত্রকর, সংগীতরসিক, নেশাসক্ত, একসেনট্রিক এবং তীব্র আবেগপূর্ণ এই সম্রাটের চরিত্র। ‘রক্তের রঙের চেয়ে বৃক্ষের সবুজ রং কি কম সুন্দর?…’ গান শুনে মুগ্ধ হয়ে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করে দিতে পারেন ইনি, ক্ষমা করে দিতে পারেন নিজের রক্তপিপাসু ভাইকে, কথা দিয়েছিলেন বলে, আধা দিনের জন্য সম্রাটের আসনে বসাতে পারেন সামান্য এক ভিস্তিঅলাকে।বাদশাহ নামদার বইয়ের ১৩৬ পৃষ্ঠায় স্ত্রী হামিদা বানু এই সম্রাটকে বলছেন, ‘আপনি দুর্বল সম্রাট; কিন্তু অত্যন্ত সবল একজন কবি।’ ৭৩ পৃষ্ঠায় শত্রু শের খাঁ (শের শাহ) বলছেন, ‘তিনি মহান মানুষদের একজন। এই মানুষটির অন্তর স্বর্ণ খণ্ডের মতো উজ্জ্বল। সেখানে কলুষতার কণামাত্রও নেই।’ হুমায়ূন আহমেদের সম্রাট হুমায়ূন মূলত এই ‘মহান মানুষদের একজন।’ সম্রাট হয়েও রক্ত-মাংসের অসাধারণ একজন মানুষ।
কাহিনিতে চরিত্র অসংখ্য। সম্রাট হুমায়ূন এবং তাঁর আত্মীয়-পরিজন, সেনাপতি বৈরাম খাঁ, জওহর আবতাবচি, শত্রু শের শাহ, হেরেমের বাদী আসহারি, আচার্য হরিশংকর, পারস্য-সম্রাট, অম্বা…। কাহিনির শাখা-প্রশাখারও শেষ নেই। মনে রাখতে হবে, এই কাহিনি বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অধ্যায়। সিদ্ধ না হলে নাড়াচাড়া দুরূহ। এ ধরনের ঐতিহাসিক কাহিনি নিয়ে যখন উপন্যাস লেখেন কোনো লেখক, কী করেন? পুনর্নির্মাণ করেন আখ্যানের, পুনর্জন্ম দেন প্রতিটি চরিত্রের। পুনর্জন্ম। এ না হলে হয় না। প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না কাহিনির। আর সময়। সময়কেও পল অনুপল ধরে আবার নির্মাণ করতে হয় লেখককে। দূর অতীতকাল পুনর্নির্মাণ। সামান্য বিচ্যুতি হলেও মুশকিল। আর, পিরিয়ড পিসের সম্রাট আকবরকে সুদর্শন হূতিক রোশন হলেও হয় না। সে সিনেমা হোক কিংবা সাহিত্যে। বিশ্বস্ততা অতীব জরুরি। বাদশাহ নামদার-এ হুমায়ূন আহমেদ এ ক্ষেত্রে পূর্ণমাত্রায় সতর্ক এবং বিশ্বস্ত। চরিত্র-চিত্রণ, কাহিনি বিন্যাসে। সেই সময়ের পুনর্নির্মাণে। তাঁর অজস্র রচনার মধ্যে বাদশাহ নামদার এ জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। ‘রং চড়াতে’ হয়নি বলেছেন কিন্তু রঙের প্লেট তাঁর হাতে এবং আশ্চর্য পরিমিত তিনি। চমৎকার উদাহরণ হতে পারে, সতীদাহ প্রথার দৃশ্যটি কিংবা অম্বা, আকিকার মৃত্যু, কিংবা জোছনা রাতে পত্নী হামিদা বানুর সঙ্গে সম্রাট হুমায়ূনের কথোপকথনের বিষণ্ন দৃশ্য। মনে হবে লেখক স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন সব দৃশ্যে। ভাষা নিয়েও এই উপন্যাসে যথেষ্ট নিরীক্ষাপ্রবণ হুমায়ূন আহমেদ। আলাদা আদলের এক ভাষায় লিখেছেন, সচরাচর যে ভাষায় তিনি লেখেন না। এটা কাহিনির প্রয়োজনেই। এবং অব্যর্থ হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর ভাষা এমনিতেই মায়াবী। গাঁওগেরামের মানুষেরা যে রকম, বকুল ফুলের গাছবাহিত চৈত্রের আশ্চর্য হাওয়ার কথা বলেন, তেমনি একটা মায়া থাকে তাঁর ভাষায়। বাদশাহ নামদার-এও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে বাদশাহ নামদার-এর ভাষা একই সঙ্গে রুদ্ধশ্বাসও। থ্রিলারের মতো। ঘটনার পর ঘটনা এবং চরিত্রের পর চরিত্র আসছে, একটা কোথাও তাল লয় কাটেনি একটুও।
লক্ষণীয় আরেকটা বিষয়। সম্রাট হুমায়ূনের মৃত্যুদৃশ্য। লেখক এর বিতংবর্ণনায় যাননি। ‘পরিশিষ্টে’র একটা বাক্যাংশ শুধু, ‘সম্রাটের মৃত্যুর পর…।’ বিশেষ তাৎপর্য মণ্ডিত এটাও। বোঝা যায় লেখক নিশ্চিত যে কতটুকু তিনি লিখবেন এবং কতটুকু না লিখবেন।
সব মিলিয়ে বাদশাহ নামদার একটা মোগল মিনিয়েচার পেইন্টিংয়ের মতো। সূক্ষ্ম, ডিটেইল। পরিমিত, পরিণত এবং দ্যুতিময়।
বইয়ের ফ্ল্যাপে একটা শের আছে,
‘যদিও দর্পণে আপন চেহারা দেখা যায়
কিন্তু তা পৃথক থাকে
নিজে নিজেকে অন্যরূপে দেখা
আশ্চর্যের ব্যাপার।
এ হলো আল্লাহর অলৌকিক কাজ।’
সম্রাট হুমায়ূনের লেখা শের এটা। সম্রাট না, কবি হুমায়ূন। কবি, চিত্রকর, শিল্পের সমঝদার, মূলত একজন মানুষের কাহিনিই বিধৃত বাদশাহ নামদার-এ। মানুষের জয় হোক। আফসোস বইটি প্রকাশের পর হুমায়ূন আহমেদ পত্রিকায় মুদ্রিত এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ ধরনের লেখা আর তিনি লিখবেন না!
যাক। কিছু আফসোসও আসলে মধুর। আপাতত এই আফসোস বাদ দিয়ে, ‘আসুন, আমরা বাদশাহ নামদারের জগতে ঢুকে যাই। মোগল কায়দায় কুর্নিশ করে ঢুকতে হবে কিন্তু।
নকিব বাদশাহর নাম ঘোষণা করছে—
“আল সুলতান আল আজম ওয়াল…।”
কুর্নিশ বাদশাহ নামদার-এর লেখককে।’

দ্বিতীয় অদ্বৈত
কাজল রশীদ
জলদাসীর গল্প—হরিশংকর জলদাস \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা \ প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ \ ১১১ পৃষ্ঠা
ক্রুসেড শুধু ধর্মে সীমাবদ্ধ নয়। নানা কারণে ক্রুসেড সংঘটিত হয়। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের মতো প্রতিষ্ঠানেরও ক্রুসেড থাকে, যদি তার সংগঠন ও প্রয়োগ ইতিবাচক হয়। শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক—এঁদেরও নিজস্ব ক্রুসেড রয়েছে। তাঁরা ধারণ করেন, চর্চিত রাখেন। শক্তিশালী ও নিষ্ঠাবান লেখকের পক্ষেই কেবল সম্ভব ক্রুসেডে ধ্যানস্থ থাকা।
হরিশংকর জলদাস যেমনটা করে চলেছেন। জলদাসদের সুখ-দুঃখে, শোষণ-নির্যাতনসহ যাপিত জীবনের রূপ-রস-ঐশ্বর্যকে তিনি শিক্ষিতজনের ড্রয়িংরুমে পৌঁছে দিচ্ছেন। জেলেজীবনের রোদে-জলে অঙ্গার হয়ে অভিজ্ঞতার নির্যাসে জলদাসদের একদা লিখেছিলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। এখন লিখছেন হরিশংকর জলদাস। দ্বিতীয় অদ্বৈত শিরোপা তাঁর জন্য যথার্থ ও যথোপযুক্ত। দুজনের মধ্যে অবশ্য সূক্ষ্ম ফারাক রয়েছে। অদ্বৈত লিখেছেন নদীসংলগ্ন জেলেদের কথা। হরিশংকর লিখছেন সমুদ্রগামী জেলেদের নিয়ে। লেখক হিসেবে পালন করছেন ক্রুসেডের ভূমিকা। লেখালেখিতে সেই ইঙ্গিতবহতার অভ্রান্ত স্বাক্ষর স্পষ্টত। । প্রথম থেকেই তিনি সেই পথের পথিক। ‘জলপুত্র’, ‘দহনকাল’, ‘কসবি’, ‘কৈবর্তকথা’য় যার প্রমাণ মিলেছে। একুশে বইমেলা-২০১১তে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ জলদাসীর গল্প। ১০টি গল্পেই হরিশংকরের তীক্ষধী লেখকসত্তা দৃশ্যগ্রাহ্য হয়। গল্পগুলোর বিশিষ্টতা হলো, এখানে লেখকের চর্চিত ক্রুসেডসত্তা স্পষ্টত। প্রান্তিক মানুষকে সর্বসমুখে তুলে ধরার এই প্রত্যয় ও প্রতীতিতে প্রশংসাযোগ্য । ভিন্ন ভিন্ন চারিত্র কাঠামোতে প্রান্তজনদের হাজির করেছেন তিনি। গল্পের নায়ক কিংবা কেন্দ্রীয় চরিত্ররা রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের বাস্তবিতায় নায়ক নন। কিন্তু পাঠান্তে মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে এঁরাই নায়ক। সত্য ও সাহসের নির্ভীক পতাকাবাহক। যাঁদের চয়ন ও চিত্রণে হরিশংকরের সার্থকতা ইর্ষণীয়।
বাস্তবের কোনো ঘটনা কিংবা চরিত্রকে অবিশ্বাস্য মনে হলেও তাঁর কোনো ক্ষতি নেই, প্রশ্নবাণে জর্জরিত হওয়ার ভয় নেই। কেননা তা বাস্তব। সে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পরোয়া করে না, কর্জ দেওয়া-নেওয়া করে না। সাহিত্যের সীমাবদ্ধতা ও বাধ্যবাধকতা হলো, তাকে বাস্তবযোগ্য হতে হয়। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রশ্নে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়। হরিশংকর জলদাসের চরিত্রগুলো বাস্তব-অবাস্তবের রসায়নে সৃষ্ট হলেও শেষাবধি বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য। খুনী দইজ্যাবুইজ্যাকে তাই আদর্শ মনে হয়। প্রশ্ন দেখা দেয়, আমরা কি পারব তাঁর মতো সাহসী হতে, জীবন বাজি রাখতে? কোটনা ক্ষীরমোহনকে উপস্থাপনেও হরিশংকরের শিল্পীত কৌশল আমাদের মুগ্ধ করে। ছোটগল্পের ছক্কা-পাঞ্জা রপ্ত বলেই, এ খেলা সম্ভবপর হয়েছে। ‘সুবিমল বাবু’, ‘ঢেন্ডেরি’, ‘একজন জলদাসীর গল্প’—প্রতিটিতেই সেই মুন্সিয়ানার ছাপ দৃশ্যমান। সাধারণ অর্থে, সহজিয়া ঢংয়ে, রূপকথা কিংবা আড্ডার ছলে তিনি গল্পে প্রবেশ করেন। চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় করান। পরিবেশ-পরিস্থিতি-প্রতিরূপের বর্ণনা দেন। তৈরি করেন অদ্ভুত আকর্ষণ ও মোহমুগ্ধতা। হরিশংকরকে চেনা পাঠক, তখন পরিণতির জন্য উদগ্রীব হন। গল্পের শেষভাগে লেখক তাই হতাশ করেন না, বড় রকমের চমক দেখান। কুঠারাঘাত করেন চেতনায়। যার মধ্য দিয়ে পাঠককে হাজির করান ক্রুসেড ময়দানে। যে ময়দানে তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা আগে থেকেই উপস্থিত। শেষ পরিণতির জন্য অপেক্ষমাণ। মুহূর্তেই ঘটে যায় কাঙ্ক্ষিত-অনাকাঙ্ক্ষিত কিংবা অপ্রত্যাশিত যবনিকা। যা-ই ঘটুক না, যবনিকার পরেই হরিশংকরের চরিত্ররা নবজন্ম লাভ করে। মোহনা, সরলাবালা, লক্ষ্মীবালা, চরণদাসী সেইসূত্রে সচেতন পাঠকের মনে নায়কোচিত আসন লাভ করে। চেনা প্রান্তিক মানুষ, জলদাসদের জীবন শুধু নয়, ইতিহাসের পথ বেয়েও তিনি জলদাসদের অন্বেষণ করেছেন। মোহনা যার উজ্জ্বল প্রতিভূ। চণ্ডককে খুন করেও যে খুনী নয়, ভালোলাগা-ভালোবাসার পরশমণি হয়ে ওঠে।
হরিশংকর জলদাস শুধু কাহিনিই লেখেন না, সমাজকেও লেখেন। যতটা বাইরের দিকে দৃষ্টি দেন, তার চেয়ে অধিক দেন ভেতরে। তাঁর চরিত্রগুলো তাই নতুন, চেনাজানা হয়েও অন্তর্গত সত্য, সাহস ও সৌন্দর্যে আদর্শযোগ্য। যাপিত জীবনের মতোই এদের লড়াইও নীরবে নিভৃতে নিরুপায় হয়ে। হরিশংকর সেভাবেই লিখেছেন। এ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের উপর্যুপরি উপস্থিতি এখানে অপ্রতুল। এমনকি নাটকীয়তাও জীবনের অনিবার্য উপাদান হলেও হরিশংকরের জীবনঘনিষ্ঠ এসব গল্পে তার উপস্থিতি নেই। চমক সবই যেন পরিণতিতে, উপসংহার টানার আবশ্যকতায়। কিন্তু জীবনের ধারাপাত কি বাস্তবিকই এ রকম?
জলদাসীর গল্পগ্রন্থের পীড়াদায়ক দিক হলো বানান বিভ্রাট, যা পাঠকের মনোযোগকে বারংবার বাধাগ্রস্ত করে।
জলদাসীর গল্প’র নিবিড় পাঠ চেতনায় অদ্ভুত এক বোধ নাড়া দেয়। আলোড়ন ধরায়, বিনম্র করে। সন্তর্পণে লোকচক্ষুর আড়াল হয়ে, চলে যেতে ইচ্ছে করে মোহনা, সরলাবালাদের কাছে। প্রণাম জানাতে ইচ্ছে করে ওঁদের, বারাঙ্গনাপল্লির মোহনাকে। দ্বিতীয় অদ্বৈত হরিশংকর জলদাস এই ইচ্ছাপূরণ কী খুব বেশী অসম্ভব?

নরক গুলজার
তৈমুর রেজা
নিক্রপলিস—মামুন হুসাইন \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ শুদ্ধস্বর, ঢাকা। প্রচ্ছদ: শিবু কুমার শীল \ ৯৬ পৃষ্ঠা \
‘এইভাবে কথাগুলো বলতে পারলাম, …হয়ত তাতে করে আমার কোন রিডার তৈরি হবে না।’ (মামুন হুসাইন: নিক্রপলিস)
এই বইটি পাঠকের সঙ্গে ‘গোস্বা’ করে লেখা। আম-পাঠকের পক্ষে তাই এখানে দাঁত বসানো প্রায় বারণ। সাহিত্য যাঁদের ‘ব্যবসা’, এ বইয়ের বাঁধা পাঠক বলতে শুধু তাঁদের ধরতে হবে। মামুন হুসাইন স্বয়ং এ ব্যাপারে যে বেখেয়াল নন, তার নজির হিসেবে ওপরের উদ্ধৃতিটি তুলে রাখা হলো।
মামুন হুসাইনের নিক্রপলিস আনকোরা ফিকশন, সে কারণেই অনাত্মীয়, যোগাযোগ পদে পদে ঠেকে। যেসব লক্ষণ বিচারে আমরা উপন্যাস চিনি, সেগুলো খুব গরজ নিয়ে তিনি হাপিশ করে ফেলেন। বাঙালি পাঠকের চিরকেলে প্রেম ‘কিচ্ছা’র সঙ্গে, এই সৃষ্টিছাড়া লেখক কাহিনির পুঁথিটাই কুটি কুটি করে ছেঁড়েন। তিনি আমাদের শহরের অভিধা করেছেন ‘নিক্রপলিস’ (সিটি অব ডেড); তাঁর ব্যাখ্যা: ‘উন্নয়ন-রাজনীতির সহজবোধ্য উদাহরণ তৈরির লক্ষ্যে, বহুকাল আগে পুরো শহর এবং আমাদের জনপদ একটি সমাধিক্ষেত্রে রূপান্তরিত’ হয়েছে।
মামুন হুসাইনের নির্মিত সিমেট্রিতে পা দিয়েই আকলমন্দ পাঠকের হুঁশ হবে, তিনি প্রায় অকুল পাথারে পড়েছেন। অস্বস্তির প্রথম খুন বেরোবে ভাষা থেকে। মামুন হুসাইনের বাঁধো-বাঁধো কাব্যিক গদ্যে সিন্দবাদের ভূতের মতো সওয়ার হয়েছে ইংলিশ ঢং-ঢাং; হঠাৎ সন্দেহ হয়, যেন কাঠের ঘোড়ার ‘ড্যান্স’। একটা বাক্য পড়া যাক: ‘ম্যাগডোনাল্ড, ডোমিনো এবং গিওভানির টিনটেড গ্লাসডোরের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পিজাহাট-এ ভিড় দেখলেন—টেস্টস আর অলসো ভেসটেড উইথ পাওয়ার!’ সঙ্গে যোগ করুন এ রকম দুর্বোধ্য কাব্য: ‘…শরীর হারাচ্ছে বেঁচে থাকার আর্দ্রতা, জরুরি সোহাগ ছেড়ে মৃত্যু এসে ঘুম নেবে শেষ মৃত্যুর’।
ফিকশনের পাঠকের একটা খিদে থাকে ডিটেইলের জন্য। নিক্রপলিসে ডিটেইল তো আছে বেশ, কিন্তু সেসব পাঠকের জন্য ‘পুষ্পশয্যা’ নয়। কাহিনির চাক বাঁধিয়ে তুলতে এসব ডিটেইলের মধ্যে কোনো গরজ নেই, এর দশ আনাই খরচ হয়েছে লেখকের রাজনৈতিক মনোভাব জানান দিতে (যেমন: ‘এশিয়ান ব্যাংকের ড্রেজিং করা নদীতে’ বা ‘বহুজাতিক কোম্পানির সুশ্রী মনিটরে’ বা ‘গভীর রাজনৈতিক টাকি মাছ’)। তাঁর বহুমুখী খাতের জ্ঞানের ভার বইতে গিয়েও বাক্যগুলোর কুঁজো-দশা। জ্ঞান যেখানে ভারিক্কি, মন্তব্য যেখানে আলটপকা—লেখক সেখানে বন্ধনী ব্যবহার করেন; ফলে বন্ধনী দেখলেই ধড়ফড় লাগে।
তাঁর ন্যারেশনের ধরনটিও পাঠকের অতি অনাত্মীয় এবং কিছুটা রগচটা। কে কখন ন্যারেট করছে, তার খেই পেতে পেতেই পাঠক বেছবর হয়ে যেতে পারেন। ন্যারেশনের এই রীতিটি সাহিত্যের এক ক্ষীণতোয়া ধারা। উইলিয়াম ফকনার তাঁর অ্যাজ আই লে ডাইং উপন্যাসে ‘মাল্টিপল ন্যারেটর’ ব্যবহার করেছেন। পাশাপাশি ‘স্টিম অব কনশাসনেস’-এর এন্তার নজির পাওয়া যাবে সেখানে। নিক্রপলিস প্রসঙ্গে কুটুম হিসেবে এই উপন্যাসের কথা তোলা যায়; এখানে বহু-কথক যেমন আছে, তেমনি আছে ‘স্টিম অব কনশাসনেস’-এর স্তম্ভিত হয়ে যাওয়ার মতো অসাধারণ নমুনা।
কাহিনির কথা উঠলে পাঠক ঘোর আতান্তরে পড়ে যাবেন। লেখকের কাছে কাহিনি হয়তো নিছক বিড়ম্বনা। এখানে প্রথম পাওয়া কাহিনি-সূত্র হচ্ছে: সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যার পাণ্ডুলিপি পড়া হচ্ছে। তার পরই শুরু হয়ে যাবে তেজি ঘোটকীর মতো তেপান্তরের মাঠে কাহিনির দিশাহীন ছোটাছুটি, পাঠকের সাধ্য নেই এই পর্যটনের কোনো পূর্বাপর নির্ণয় করে।
কোনো প্রটাগনিস্ট নেই বইতে, ন্যারেটর ফুস করে বদলে যাচ্ছে দৈবিক আইনে; গল্প আছে তবু গল্প কোথাও যাচ্ছে না। মনোলগের দোর্দণ্ড ঝাপটার মুখে হাবুডুবু খাবেন পাঠক, দম ছোট হলে দাঁড়ানোর কোনো আশাই নেই।
এই তীব্র অভাব-অভিযোগ সম্বল করে কোনোমতে বইয়ের অর্ধেক পেরোতে পারলেই একটা জাদুর মতো ব্যাপার ঘটে। ফুল যেমন কাউকে জানান না দিয়ে নীরবে ফোটে, পাঠক হঠাৎ টের পাবেন, বইটিও তেমনি অলক্ষ্যে মাথা জাগিয়েছে; এত দূর পর্যটনে যার দিক-দিশা কিছুই ঠাহর হয়নি, সেই বইটি হঠাৎ মানুষের গলায় কথা বলছে, সে বাক্য অনায়াসে পড়ে নিচ্ছে আপনার মন। যে যন্ত্রণা এতক্ষণ ঘুরে মরছিল, যাকে আমাদের অভ্যস্ত মন সইতে পারছে না, লেখক তো সেই যন্ত্রণার কাসুন্দিই ঘাঁটতে বসেছেন। স্মৃতির হদ্দ ঘেঁটে তিনি আমাদের দেখাচ্ছেন জাতীয় ক্ষতগুলো, পুরো দেশের ওপর দিয়ে যেসব কান্না ঝড়ের মতো বয়ে গেছে, সেসব ভুলে যাওয়া পৃষ্ঠাগুলো তিনি মেলে ধরেছেন। বইটা তাই পত্রিকার পুরোনো ফাইল ঘাঁটার মতোই: ব্যারাকে গণহত্যা, বোমা, গ্রেনেড, বাংলা ভাই—যেন এক নিঃশ্বাসে আগুনের হলকার ওপর দিয়ে দৌড়ে যাওয়া।
মামুন হুসাইন নীলকণ্ঠের মতো পুরো জাতির বিষ পান করেছেন। তিনি একটা ফিকশনের আদলে বাংলাদেশের কান্নার ইতিহাস লিখেছেন।
শুরুতে যে ভাষাটাকে মনে হচ্ছিল ‘কাঠের ঘোড়া’, শেষ হতে হতে সেই ভাষা পার্সিয়াসের ঘোড়া হয়ে উঠল। এলায়িত গদ্যে বোমা হামলার কয়েক পৃষ্ঠাজোড়া একটা প্রায়-জ্যান্ত বিবরণ, আবার কাটা কাটা থেমে থেমে লেখা দীর্ঘ ভাষ্যে বেঁচে থাকার অর্থহীন অনড় প্রতিমা। লেখক যেন পাঠকের ওপর অস্ত্রোপচার করছেন। বাড়ি মেরে মেরে আগে অবশ করে তারপর বিষ ঢালছেন কানে, যেন সে বাধ্য হয় চাপা কান্নাগুলো শুনতে, যেন তার ‘মৃত্যু কিঞ্চিৎ সহজ হয়’। নিক্রপলিস তাই সর্বজনীন দুর্গাপূজার মণ্ডপ নয়। এটা নতুন, স্বতন্ত্র, আকস্মিক—এবং এসব গুণ নিয়েই শুধু এক গুহ্য সমাজের মন্ত্র।

বিচিত্র গল্পের ইশারা
আলতাফ শাহনেওয়াজ
পাকিস্তান—মশিউল আলম \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা \ প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ \ ১৪২ পৃষ্ঠা \ ২৫০
গল্পের ভেতর কী থাকে, কী ঘটে—সোজাসাপটা জবাব খুঁজলে বলা যাবে, গল্পের শরীরে গল্পটাই মুখ্য। কাহিনি সূত্রে চরিত্রের জন্ম-বিকাশ-পরিণতি—সব মিলেমিশে পাঠকের চোখে একসময় পুরো গল্পের আকার ফরসা হয়ে ওঠে। এ রকম হিসাব মাথায় রেখে মশিউল আলমের সাম্প্রতিক গল্পগ্রন্থ পাকিস্তান পড়তে গেলে কেন জানি না মনের মধ্যে অতর্কিতে ধন্দ এসে উপস্থিত হয়। ধন্দ এই জন্য যে, গল্পের চেনাজানা আবরণের মধ্যে শেষ অবধি গল্পগুলো কতটা এবং কীভাবে গল্প হয়ে ওঠে; আর কেমন করেই বা পরিণতি পায় চরিত্রগুলো? কেননা, গোটা বইয়ে মশিউল যেভাবে একের পর এক গল্প বলে যান, তার মধ্যে টলটলে গল্প আছে বটে; কিন্তু গল্পের চরিত্রগুলো কতটা পরিণতি পায় কিংবা এখানে চরিত্রের পরিণতি সেভাবে আবশ্যিক কি না—এ রকম গুটিকয় প্রশ্ন মাথার ভেতর বন বন করে পাকিস্তান-এর পাট চুকানোর পরেও।
এই গ্রন্থে জায়গা পেয়েছে নয়টি গল্প। গল্পগুলো আবার বিচিত্রমুখী—নির্দিষ্টভাবে বিষয়গত কোনো কেন্দ্র নেই বইটির। একেকটি গল্প পাঠককে একেক রকম অভিজ্ঞতার সামনে নিয়ে যায়। তবে ঐক্যের বিচার করলে মধ্যবিত্ত মানুষজনের বর্ণিল মনোভঙ্গিই গ্রন্থে নানামাত্রায় ছড়ানো ছিটানো।
কথাসাহিত্যিক হিসেবে মশিউল আলম মোটেই অচেনা নন। হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক-পরবর্তী গল্পকারদের সারিতে তিনি এর মধ্যেই নিজেকে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। লেখক সম্পর্কে কোনো পূর্ব ধারণা না রেখে শুধু এই বইটি পড়লেও পাঠক বুঝতে পারবেন, বিচিত্র আইডিয়ার পাশাপাশি গল্প নির্মাণকৌশলও তাঁর কতটা করায়ত্ত।
প্রথম গল্প ‘ঘোড়া’কে দৃষ্টান্তে রেখেই আলোচনা বিস্তারিত করা যাক। ‘ঘোড়া’ গল্পের পুরো কাহিনির মধ্যে দুটি উপকাহিনী আছে—একটি বাবার, অন্যটি ছেলের। এখানে দুই প্রজন্মের মানুষের শৈশবের চোখ দিয়ে ঘোড়াকে দেখেছেন লেখক—‘একটা শাদা ঘোড়ার স্বপ্ন দেখতাম, যার পাখা ছিল। সে ঘোড়া দৌড়াত না, উড়ে-উড়ে যেত।’ এটা হলো বাবার শৈশবের চোখে দেখা। অন্যদিকে পরের প্রজন্মে পৌঁছে ছেলে যখন ঘোড়াটিকে দেখে, তখন তার চোখে নিরেট বাস্তবতার ছাপ ঢুকিয়ে দেন লেখক। ছেলে বাবাকে বলে, ‘ঘোড়া তো পাখি না, ঘোড়ার কেন পাখা থাকবে!’ আলাদাভাবে দুই প্রজন্মের দুই ব্যক্তির মধ্যে দেখার যে ফারাক, সেটি জলবৎ তরলং। স্কুলপড়ুয়া ছেলের চোখে যেখানে বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে এক ধরনের স্বপ্ন-আবেশ থাকার কথা, সেখানে ছেলের চোখে বাস্তবতার ঘাই ছাড়া অন্য কোনো স্বপ্ন নেই। ঘোড়ার পাখা গজানোর ব্যাখ্যা হিসেবে বাবা যতই তার সামনে রূপকথার জগৎ পেশ করেন, ছেলে কিন্তু বিভ্রান্ত নয় মোটেই। “আমি বলি, ‘মানুষেরা তাদের বলেছে, এই ঘোড়ারা, তোমরা তো পাখি না। তোমাদের পাখা থাকতে পারবে না। তোমরা যদি তোমাদের পাখাগুলি ঝরিয়ে না ফ্যালো তাহলে আমরা তোমাদের পাখির মতো গুলি করে মারব, তারপর রান্না করে খেয়ে ফেলব।’ তারপর থেকে ঘোড়ারা মানুষের ভয়ে পাখাগুলি লুকিয়ে রাখে, কিন্তু ইচ্ছা করলেই তারা পাখা মেলাতে পারে। অবশ্য সেটা তারা করে শুধু রাতের বেলা, বিশেষ করে যেসব রাতে পূর্ণিমা হয়, যখন চাঁদের আলোয় ভরে যায় সারা পৃথিবী।”—বাবার স্বপ্নজড়ানো ছেলেভোলানো কাহিনির পর ‘তুমি আমাকে এখনো বাচ্চা ছেলেই মনে করো, তাই না?’ প্রশ্নের মতো করে ছেলের এই উত্তর দুই প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যবধানকেই নির্দেশ করে। বিষয়টি আরও খোলাসা হয়ে ওঠে গল্পের শেষে। ছেলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাবার বয়ান—‘রাজ্যের বইখাতায় ঠাসা ভারী স্কুলব্যাগটির দুটি ফিতার ভেতরে ক্ষিপ্র দুই হাত গলিয়ে দিয়ে সেটিকে পর্বতারোহীর মতো পিঠে নিয়ে কাঁধ দুটো বার দুয়েক ঝাঁকিয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে ভদ্রলোকের মতো সৌজন্যের মৃদু হাসি হেসে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে সে গট গট করে হেঁটে গেল স্কুলভবনের প্রধান ফটকের দিকে।’ সামান্য ঘোড়াকে কেন্দ্র করে লতিয়ে ওঠা গল্পটি সত্যিই অসাধারণ, নতুন ঢঙে লেখা। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, গল্পের চরিত্ররা কি ঠিকঠাক পরিণতি পেয়েছে? পাক আর না পাক গল্পে বলা কথাটি কিন্তু ঠিকই বলা হয়ে গেছে—পাঠক বুঝতেই পারবেন না গল্পটি এর মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছে! গল্পকার হিসেবে মশিউলের অভিনবত্ব এখানেই। অপ্রত্যাশিত ঝলকানি লাগিয়ে তিনি গল্পের নটেগাছটি মুড়িয়ে ফেলতে পারেন!
‘ঘোড়া’র মতো প্রভুভক্ত অন্য গল্পগুলোও সরল-সহজভাবে হুট করে শুরু হয়। তেমন কোনো বাড়তি আয়োজনের দরকার পড়ে না। লেখকের সাবলীল ভাষাভঙ্গি গল্পের মধ্যে পাঠককে টেনে নিয়ে যায়। ‘পাকিস্তান’, ‘জামিলা’, ‘ট্রয়ের হেলেন’, ‘কোকিল ডেকে যায়’—সব গল্পের একই অবস্থা। ‘পাকিস্তান’ গল্পের ইমতিয়াজ, রূপিন্দর বা ফারহানা; ‘ট্রয়ের হেলেন’-এর হাবিব বা হ্যাপি; ‘অপরাধ ও শাস্তির গল্প’-এর কাজী মাজেদুর রহমান—সব চরিত্রের মুখ দিয়ে লেখক তাঁর কথাটি বলিয়ে নিলেন। ওদিকে গল্প থেকে গল্পে পৌঁছে শুরুর প্রশ্নটি যদি আরও একবার করা যায়, চরিত্রগুলো কী রকম পরিণতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল শেষ পর্যন্ত? থাকল। পড়া শেষে নিশ্চিত মনে হবে মশিউল তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোকে যেনবা এমনভাবে নির্মাণ করেছেন, যেখানে গল্পের শুরু থেকেই চরিত্রটি পরিণত। গল্প বলার নিজস্ব কৌশলের কারণেই লেখকের হাতে এমনটি ঘটেছে, তিনি তাঁর করণকৌশলগুলো আড়াল করতে পেরেছেন।
তাই বলা যায়পাকিস্তান বইয়ের গল্পগুলো এমনই সহজাত-সাবলীল; আরোপ কিংবা জবরদস্তির চিহ্নমাত্র নেই।

একদম সরাসরি
পিয়াস মজিদ
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি—মাসুদ খান \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ প্রকাশক: ভাষাচিত্র \ প্রচ্ছদ: সব্য
মাসুদ খানের এটা চতুর্থ কবিতার বই। পাখিতীর্থদিনে, নদীকূলে করি বাস আর সরাইখানা ও হারানো মানুষ-এর পর আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি। অবশ্য বইয়ের নাম নিয়ে পাঠকের ধন্দে পড়ার যথেষ্ট কারণ আছে। বইয়ের প্রচ্ছদপটে আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি হলেও বইয়ের ভেতরভাগে বারদুয়েক ‘আঁধারতমা আলোকরূপে তোমার আমি জানি’ নামটি মুদ্রিত রয়েছে। বইভুক্ত কবিতাগুলোর চারিত্র্য-বিচারে ‘তোমায়’ই আমাদের কাছে সঠিক মনে হচ্ছে।
নতুনরূপে প্রকাশ পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। ৫১টি কবিতায় মাসুদ খান প্রমাণ রেখেছেন যে নতুনতা তার স্বভাব। খোলস-ত্যাগেই তার প্রকৃত রূপের বিকাশ। চতুর্থ বইয়ে তিনি কবিতাকে উদোম করে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন কবিতার আদিম সৌন্দর্য। যাবতীয় আবছায়া ছিন্ন করে সহজ সোজা যোগাযোগের সেতু বাঁধার প্রয়াসী তিনি—
শ্রুতি ছুঁয়ে যাক শ্রুতি, হূদিতে মিশুক হূদি, শ্রবণে শ্রবণ…
যোগাযোগ হোক একদম সরাসরি, সোজা ও সহজ!
(যোগাযোগ, পৃ.-১৬)
বিষয়টি কাব্য করে বলা যত সহজ ততটাই কঠিন তা কবিতায় ফলিয়ে তোলা। এহেন কঠিন কর্ম মাসুদ খান সম্পন্ন করেছেন তাঁর এই ৬৪ পৃষ্ঠার কবিতা-ভূভাগে। ধর্ম-দর্শন, গণিত-সংগীত, প্রেম-কাম, ভক্তি-বিদ্রোহ, বর্ষা-বসন্ত, শিমুল-মান্দার মিলেমিশে অভাবিত দরবার পেশ হয়ে আমাদের সমীপে। আর হ্রস্ব-দীর্ঘ নানান অবয়বের কবিতাগুলোর মিলিত অভিযাত্রা অখণ্ড এক বোধের দিকে। তাই আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানির কাব্যোপকরণে রূপকথার প্রভূত রসদ থাকলেও কবি প্রত্যক্ষাভিসারী। সমকালের অভিজ্ঞতাগ্রস্ত কবির চোখে নির্মাণ হতে থাকে সিসাগ্রস্ত ভবিষ্যৎ দেখার স্বচ্ছ দৃষ্টি—
যেইদিন বৃক্ষ ত্যাগ করবে তার বৃক্ষধর্য
মিষ্ট নয়, ফল হবে কটু বা কষায়
আর সোজা না ফেলে সে ফল ফেলবে তির্যক ভঙ্গিতে
যেইদিন আম্রবৃক্ষে জাম হবে, তাম্রবৃক্ষে সিসা…
(বীতকৃত্য, পৃ.- ৯)
কবিতা তো শুধু শব্দের পর শব্দের ছন্দিত ঠোকাঠুকি নয়, কবিতা ইতিহাস-ভূগোল-রাজনীতির মিলিত পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা ব্যক্তির সংবেদী স্বর। কবিতার প্রকৃত বৈশিষ্ট্যে আস্থাশীল বলেই মাসুদ খান আমাদের এই গুরুগম্ভীর-তামাশাময় গ্রহের স্থিতি ও ঘূর্ণিকে বাঙ্ময় করে তোলেন কবিতায়—
একবার এক মনোজ্ঞ লাল ফল ছিঁড়ে খেয়েছিলাম। অসম্ভব ঝাঁঝ। জিহ্বা পুড়ে
যাচ্ছিল প্রায়। পৃথিবীতে তখন কি আদালত প্রাঙ্গণে তুমুল হট্টরোল? যুদ্ধাপরাধীদের
বিচার? জাদুঘরে সংরক্ষণ?
পৃথিবীর কথা উঠতেই মনটা খুব বিষণ্ন হয়ে গেল।
(নিরুদ্দেশপর্ব, পৃ.-৫৬)
পৃথিবীর কথা তুলে কবি নিজেই বিষণ্ন হন না, একই সঙ্গে পৃথিবীর বিষণ্ন মুখচ্ছবিও জাজ্বল্য করেন। যে পৃথিবীর সবুজ গাত্রবর্ণ আজ পরমাণুময়, আলকাতরামাখা। রণদামামায় ধ্বস্ত ধরিত্রী কবির ভেতর জন্ম দিয়ে চলে নতুন নন্দনের—
আহা! আকশে আজ কী সুন্দর আগুনরঙা পৃথিবী উঠেছে!
(নিরুদ্দেশপর্ব, পৃ.-৫৬)
এই অগ্নিকরোজ্জ্বল পৃথিবীর আভায় কবি আর নতুন কী কবিতা লিখতে পারেন?
মাসুদ খানের আলোচ্য বইয়ের কেন্দ্র-কবিতা ধরা যায় ‘সেতু’কে। দেখা যাচ্ছে নারীর ভেতর প্রকৃতি বা সৃষ্টিধারাকে বহমান ভাবছেন তিনি—
ভাব-উচাটন পুরুষ হলে
প্রকৃতিস্থ হও।
কিংবা যদি হও প্রকৃতি,
পুরুষরত হও।
(সেতু, পৃ.-৪০)
এই অভেদাত্মক ভঙ্গি কবির কোনো বিচ্ছিন্ন বৈশিষ্ট্য নয় বরং কবিতার বইটি জুড়ে যে ক্ষয়িত পরিস্থিতি দৃশ্যমান কবি তার রূপ বদলে দিতে চান অনন্ত সৃষ্টিসম্ভবা নারীপ্রকৃতির বলে। হোক সে আঁধারতমা। সে আঁধার কবির কাছে আলোর অধিক। তার সন্ধানে কবি জন্ম-জন্মান্তর ঘুরে আসেন তবু তাঁর অন্বেষা অশেষ। বইয়ের প্রথম কবিতা ‘বীতকৃত্য’ থেকে শেষ কবিতা ‘নাট্যমালা, তামাশাপ্রবাহ…’ পর্যন্ত এই অন্বেষা বিস্তৃৃত।
‘মৎস্যস্বভাবা’ কবিতাটির কথা উল্লেখ করে বলতে চাই কবিতাকে স্ল্লোগান হওয়ার আশঙ্কা থেকে রক্ষা করা এবং একই সঙ্গে পাঠকের কাছে যোগাযোগযোগ্য করে তোলার সুকঠিন কাজটি সাধন করে মাসুদ খান আমাদের অভিবাদনীয়।
‘প্রেম’ নামের এক কবিতায় যখন কবি বলেন, ‘যেইখানে গণিতের শেষ সেইখান থেকে শুরু সংগীতের…’ তখন সংগীতের ছলে তিনি যেন কবিতার কথাই বলেন। কারণ, কবির চিত্রিত কঙ্কালভারাতুর সময়ে কবিতাই সেই সুর, যা হাড়গোড়ের স্তূপের ওপর ‘ভীষণবর্ণা এক গন্ধরাজ্ঞী হয়ে ফুটে থাকে অবাধ…’।

মৃত্যুর ভিতরে জাগরণ
নির্লিপ্ত নয়ন
অশ্রুময়ীর শব—মোহাম্মদ রফিক \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা। প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী \ ৪৮
কবিতার সঙ্গে অনেককাল বসবাস করে বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের মালিক হওয়ার পর একজন কবির সামগ্রিক গন্তব্যের দিশা পাওয়া যায় কি না, বিষয়টি নিয়ে অনেকের হয়তো অনেক রকম ব্যাখা আছে। তবে কয়েকটি কবিতার বই প্রকাশের পর ওই কবির কাব্য অনুষঙ্গ ও ভুবন সম্পর্কে গড়পড়তা একটি ধারণা যে দাঁড় করানো সম্ভব, এটি মোটামুটি বলা যাবে। বাংলাদেশের কাব্যজগতে কবি মোহাম্মদ রফিকের কবিতা সম্পর্কে পাঠকের মধ্যে একটি পোক্ত ধারণা বর্তমান। মোটাদাগে ধারণাটি এমন—তাঁর কবিতায় বাংলার মাটি-মানুষের ঐশ্বর্য-ঐতিহ্য ও জীবনযাপনের চিহ্নগুলো হাজির। আছে আখ্যানের মায়ামেশানো মাটি, যার মধ্যে এ দেশের স্বপ্ন ও বাস্তবতার চেহারাটি বেশ তাগড়া—স্পষ্ট।
কিন্তু প্রশ্নটি যদি এভাবে আসে—কবিতার সঙ্গে দীর্ঘদিন বসবাসের পর মোহাম্মদ রফিক এখন কোথায় যেতে চান, তবে খানিকটা প্যাঁচ লেগে যেতে পারে। যে বাংলাকে শব্দে শব্দে অদ্যাবধি তিনি লিখছেন, সে কি ঐশ্বর্যমণ্ডিত মরমি ভাবপ্রবণ বাঙ্গালা নাকি বর্তমানের হাওয়া-বাতাসপূর্ণ বাংলাদেশ?—এই যুগপৎ জিজ্ঞাসার জবাব আছে মোহাম্মদ রফিকের সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ অশ্রুময়ীর শব-এ। কেননা ঐতিহ্য আর মহাকালের পাটাতনে দাঁড়িয়ে সমকালীন মসলার ঝাঁঝে ভরপুর এই গ্রন্থ।
অশ্রুময়ীর শব গ্রন্থে কবিতার সংখ্যা ৩৬। রফিকের কবিতার চিরচেনা অনুষঙ্গের সঙ্গে এখানে বড়সড় তল্লাট নিয়ে আসন পেতেছে মৃত্যুচিন্তা-কেন্দ্রিক শূন্যতার আবহ—‘ফিরে আসা ঠিক নয়,/ এই বাক্য শুধরে নিয়ে/ অবশেষে সেও ফিরে এল,/ ছায়ার জগৎ থেকে/ ঘোর অপচ্ছায়ার প্রান্তিক/ তীর্থভূমে, ইচ্ছায় অথবা/ অনিচ্ছায়, সাধ করে…’। গ্রন্থে ‘অনিঃশেষ’ নামে এই প্রথম কবিতাতেই শূন্যতার আরও বলিষ্ঠ নিশানা দেখি কবিতার শেষ পর্বে—‘আলো ছুঁয়ে আছে আলো/ ছায়াচ্ছন্ন জলে, মারমুখী/ স্রোতে একা হাঁটছে শূন্যতায়!’ শূন্যতার সেই নিঃসীম চরাচরে কবির পদচ্ছাপ ছাড়া তো আর কাউকে দেখা যায় না। কবির ব্যক্তিজীবনের নৈঃসঙ্গ, শেষ বেলার আক্ষেপ গ্রন্থের পরতে পরতে মাতম করছে। আর নিঃসঙ্গতার লেজে লেজ জোড়া দিয়ে এসেছে মৃত্যুচিন্তা।
মৃত্যুভাবনাটি অর্গল ছিঁড়ে আরেকটু খোলতাই হয়েছে ‘মাটির কাফন’ নামাঙ্কিত কবিতায়। প্রান্তর মাড়িয়ে, বিষকাটারির বনঝোপ বেয়ে এখানেও ফেরার প্রসঙ্গ আছে। এরপর অন্তিম বাক্যে প্রশ্নাকুল হয়ে উঠেছেন কবি—‘বলে যাও, ভাষা কোনো বাধা নয়, চিন-পরিচয়ে/ সূত্রাধার তার চেয়ে অধিক বাঙ্ময়, ওই ভস্মের অগ্নিতে/ নিভে আসা চোখের ইশারা, ক্ষণিকের স্পর্শ, ঈষৎ মন্থর;/ তবু, যদি না-ই খোলে, ওপারে যাওয়ার কানাগলি,/ পদশব্দ, হিম শ্বাস, তবে কার মাটির কাফন’। শেষ পঙিক্ততে এসে কবির এই সংশয়বোধ মৃত্যু আর মাটির কাফনকে যেন জীবনের দরবারেই ফিরিয়ে এনেছে।
মৃত্যুগন্ধি বাতাবরণ রফিকের নোনাঝাউ ও দোমাটির মুখ কাব্যগ্রন্থেও জারি আছে। কিন্তু অশ্রুময়ীর শব-এ পৌঁছে এই মৃত্যু স্বদেশের মলিন মুখের ওপর ‘দুস্থতার ভাঙনের ছায়া’ ফেলে, ‘বিকট রহস্যময় ধাঁধা’ হয়ে ‘কোনো পিছ দুয়ারি ঘরে’ কবির সঙ্গে বসে একা দোল খায়, কখনো বা ‘ভূ-বিশ্বের সীমা-পরিসীমা মানচিত্র ছেড়ে’ জীবনকে আবাহনও করে—এমনই বৈচিত্র্যে জেল্লাদার তার শরীর। আবার মরণের এই বর্ণিল আবহের সঙ্গে বাঙ্গাল কবির মরমি ভাব যখন জোড় বাঁধে, এক আড়ালচারী কুহক তৈরি হয় বটে তখন। কথার সপক্ষে ‘দেখা-সাক্ষাৎ’ কবিতাকে তবে সাক্ষী মানা যাক—‘বন্দর থেকে একে একে/ জাহাজগুলি ছেড়ে যাওয়ার পর/ আমি জিজ্ঞাসা করলাম/ আমার স্যুটকেসটি কোথায়!/ সে বলল, ঠিকমতো তুলে দেয়া হয়েছে।/ স্যুটকেসটির সঙ্গে আমার/ আর সাক্ষাৎ হওয়ার সুযোগ রইল না/ তা হলে!’ গোটা কয়েক পঙিক্তর কবিতাতে মরমি ভাবতত্ত্বের অগোচরে আত্মা ও দেহের কথাই কি বলা হলো? ‘স্যুটকেস’ কি আত্মার প্রতীক, ‘বন্দর’ মানবজীবনের সমার্থক? অনেক তরফেই ভাবনার সুযোগ আছে। রহস্যের আবির ছড়িয়ে কবি এরপর আর টুঁ শব্দ করেননি। তবে বলার কথাটি হলো, এ কবিতার শব্দগুলো কোনো নির্দিষ্ট অর্থে আবদ্ধ নয়, মুহূর্তেই সে একরকম প্রতিসরণ তৈরি করে। পাঠককে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে অর্থ উদ্ধারে। এ ছাড়া ‘আক্ষেপ’, ‘বিবেক’, ‘তবে’, ‘স্বপ্ন’, ‘শুধু এই’, ‘মরমি বাখান’, ‘জাতিস্মর’—এমন বেশ কিছু কবিতা রয়েছে এ গ্রন্থে, প্রতিসরণের মাধ্যমে যা কবি ও পাঠকের মধ্যে বুঝপোড়ের দ্বৈরথ তৈরি করে কবিতাকে বরং আরও রসগ্রাহী করে তুলেছে। অশ্রুময়ীর শব গ্রন্থে মোহাম্মদ রফিকের ‘অন্যরূপে বিন্যস্ত’ হওয়ার কৃতিত্ব বোধ করি এখানেই। পাঠক হিসেবে চেনা-পরিচিত আদলের বাইরে কবিকে এখানে নতুন অবয়বে চিনে নেওয়ার মওকা মিলেছে অন্তত!

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৭, ২০১১

Category: বই পরিচিতি
Previous Post:কবির সান্নিধ্যে – ফিরোজা বেগম
Next Post:সাহিত্য রাজনীতি ও জীবন – ফিলিপ রথ

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑