• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

ফিরে যায় কাঠঠোকরা – সেলিম হোসেন

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » গল্প » ফিরে যায় কাঠঠোকরা – সেলিম হোসেন

আলোকিত পটভূমি। দূরে চেয়ারে বসে আছে একজন, অন্যজন কাছেই দাঁড়িয়ে। ঘরে আলো জ্বালেনি বলে শুধু অবয়ব দৃশ্যমান, অভিব্যক্তি আলোকিত নয়।
নীরবতা।
চায়ের কাপে চুমুক দিল উপবিষ্টজন, পিরিচে কাপ রাখার শব্দ।
উঠে দাঁড়াল সে, অন্যদিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ।
চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারি করল দু কদম, আবার থামল।
‘ব্যাপারটা খুব জটিল লাগছে আমার কাছে’, বলল সে, ‘আমাকে একটু পরিষ্কার করে বল দেখি। প্রথম থেকে শুনি, তুই আর তার কাছে থাকছিস না, বাচ্চাটা তোদের কারও কাছেই থাকছে না, তোরা দুজন…,’ কথা শেষ করতে পারল না সে, থামার আগেই অন্যজন বলল, ‘এখানে আরেকজন আছে, বাবা।’ বাতি জ্বালাল, আলো এসে পড়ল তার মুখে।
‘আরেকজন, মানে তৃতীয় পক্ষ।’
‘হ্যাঁ।’
‘কী করে ছেলেটি?’
‘ছেলেটি নয়, মেয়েটি।’
‘মানে? (আঙুল তুলে) জামাই…।’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা!’ (চিন্তা, পায়চারি), ‘তাই তো বলি, আমার মেয়ে…! (পায়চারি) ঠিক আছে। কিন্তু বাচ্চা তোর কাছেই থাকবে। আইন তাই বলে। আমার…।’
‘আমার সঙ্গে থাকবে না, বাবা, তানিম বাচ্চা পছন্দ করে না।’
‘তানিম? সে কে?’
‘আমি যার সঙ্গে থাকব।’
‘মানে?’
‘মানে বাচ্চাটা তোমার কাছে থাকবে। ওর বাবা আর তার নতুন বউ ওকে নেবে না, ওরা চলে গেছে নরওয়েতে, ওর কোম্পানির হেড অফিসে জয়েন করবে সে।’
‘এসব হচ্ছেটা কী!’ অধৈর্য ভঙ্গি বাবার।
‘কেন, বাচ্চাটা এখানে থাকলে অসুবিধা হবে? তুমি না ওকে এত ভালোবাসো? ওকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাবে, পার্কে যাবে, শপিং মলের চিলড্রেনস কর্নারে যাবে, আর্ট স্কুলে নিয়ে যাবে, পারবে না?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু…।’
‘কোনো কিন্তু নয় বাবা, প্লিজ, তোমার পায়ে পড়ি, বাবা!’ পায়ে না পড়ে সোজা ওভাবেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলল মেয়ে।

এক মাস পর
‘একটু গুছিয়ে বল, আমি তোর কথা ঠিক…বুঝতে পারছি না।’
‘আমি এখানেই থাকব, বাবা, আমি ফিরে আসতে চাই। বাচ্চাটাকে নিয়ে স্কুলে যেতে চাই, ওকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যেতে চাই, পার্কে নিয়ে যেতে চাই, রোজ আর্ট স্কুলে নিয়ে যাব। বলো, বাবা, তুমি চাও না আমি এখানে থাকি?’
‘কিন্তু…।’
‘কোনো কিন্তু নয়, বাবা, তোমার পায়ে পড়ি।’ সত্যি সত্যি নিচু হয়ে পা ধরতে গেল মেয়ে।
দ্রুত হাত লম্বা করে মেয়েকে থামানোর ভঙ্গিতে, ‘কিন্তু ওই তসলিম না কি যেন নাম…, সে? সে কোথায়?’
‘ওসব আমি বানিয়ে বলেছিলাম, বাবা, আমি আসলে একটু একা থাকতে চেয়েছিলাম।’
চিন্তিত ভঙ্গি বাবার, ‘উহু, নিশ্চয় ওর সঙ্গে ঝগড়া করেছিস। এক কাজ কর, ওকে ডেকে নিয়ে আয় আমার কাছে, আমি কথা বলব। একদম চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস।’
‘তুমি ভুল করছ, বাবা, তানিমের সঙ্গে ওই ধরনের কোনো ব্যাপার নেই। বিশ্বাস না হলে তুমি ওকে ফোন করতে পার; আমরা এখনো ভালো বন্ধু। আমি একাই ছিলাম, কিন্তু এখন আর ভালো লাগছে না। আমি তোমাদের সঙ্গেই থাকতে চাই, বাবা, প্লিজ!’

তিন মাস পর
মেয়েটি বুকে হাত বেঁধে ভুরু কুঁচকে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। দৃশ্যের বাইরে পুরুষ কণ্ঠের আকুতি শোনা গেল, ‘কী বলছ এসব, ওকে কেন আমি বিয়ে করতে যাব! আমরা একসঙ্গে গিয়েছিলাম ঠিক আছে, কিন্তু বিয়েটিয়ের কথা আসছে কেন? দেখো, তোমাদের জন্যই ফিরে এসেছি। সবাইকে নিয়ে নরওয়েতে থাকব, বাচ্চাটাকে চিলড্রেনস পার্কে নিয়ে যাব, ওয়াটার জু দেখতে নিয়ে যাব, আর্ট স্কুলে নিয়ে যাব। ও তো আমাদের বাচ্চা, তাই না? ওর কথাটা অন্তত একবার ভাবো! (চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে কিছু একটা বলতে গেল মেয়ে, হাঁ করেও থেমে গেল লোকটির কথার তোড়ে), আমার দিকে তাকাও, যত যা-ই ঘটুক, তুমি এখনো আমাকে আগের মতোই ভালোবাসো। বলো, বাসো না?’
এ সময় হঠাৎ দরজায় শব্দ হলো, মেয়েটি এগিয়ে গেল দরজার দিকে, ততক্ষণে ভেতরে ঢুকল একজন। আগন্তুক লোকটিকে দেখে, ‘দেখো না, এই লোকটি…মানে, আমার স্বামী ছিল, হঠাৎ কোত্থেকে এসে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে,’ আদুরে গলায় তাকে বলল মেয়েটি, ‘তুমি কিন্তু হইচই কোরো না, প্লিজ, ও এমনিতেই চলে যাবে, এখনই যাবে, দেখো!’ বলে ঘাড় ঘুরিয়ে উজ্জ্বল চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল স্ত্রী।

সাত দিন পর
রকিং চেয়ারে বসে দুলতে দুলতে কোকের গ্লাস নাড়ছে স্বামী। নিরাসক্ত আলস্যে মেয়েটির কথা শুনছে।
‘আমাদের বাচ্চাটার কথা একবার ভাবো, ও সারাক্ষণ তোমার কথা বলে, জানো? আমরা ওকে নিয়ে পার্কে-চিড়িয়াখানায় যাব, রোজ সকালে ওকে স্কুলে নিয়ে যাব, তুমি ওকে আর্ট স্কুলে নিয়ে যাবে।’
‘ধরো, ওই লোকটা…।’
‘বললাম যে, বিশ্বাস হচ্ছে না? স্রেফ তোমাকে রাগানোর জন্যই বানিয়ে বানিয়ে ওই সব বলেছিলাম। আসলে ও আমার জাস্ট একজন বন্ধু। ইচ্ছে হলে বাবাকেও জিজ্ঞেস করতে পার, ওর নাম তানিম।’
‘ঠিক আছে,’ উদাসীন গলায় বলল লোকটা। ‘তুমি রাঁধ ভালো। তানিয়া তো অফিস করে সময় পায় না, আশা করি সেও খুশি হবে। ও খুব ভালো মেয়ে। তুমি দেখলেই…,’ লোকটির মুখ নড়ছে, হয়তো কিছু বলছে সে, যেন স্লো মোশনে মুখ নড়ছে, কিন্তু শব্দগুলো মুখ থেকে মেয়েটির কানে এসে পৌঁছাচ্ছে না, মাঝপথে এসে থেমে গিয়ে বুদ্বুদের মতো হাওয়ায় ভাসছে যেন। তারপর কিছু ধ্বনি টানা সুরে একটু একটু করে এসে কানে বাড়ি খেল, বিলাপের মতো, ঘণ্টার শব্দের মতো, তারপর কলস্বরে হট্টগোলের মতো, যুদ্ধের গোলার মতো, মেঘ গর্জনের মতো, বজ্রের মতো একসঙ্গে সবকিছু মিশে প্রচণ্ড বেগে কানে বাড়ি খেতে লাগল। বাড়তে বাড়তে অবশেষে হঠাৎ একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
অসহ্য নীরবতা।
দূরে একটা করুণ সুর হালকা বাতাসের মতো যেন পিছলে যায়।
‘তানিয়া! কে সে?’ কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে জানতে চাইল হাঁ করে হাঁপাতে থাকা মেয়েটি।
‘আমার সঙ্গে থাকে। এখানেই এক ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। কয় দিন পরেই অবশ্য…।’ আর শুনল না মেয়ে, ধৈর্য হারিয়ে ফেলল। ছুটে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থেকে হাত নেড়ে বাক্যটি শেষ করল লোকটি, ‘চলে যাবে অস্ট্রেলিয়ায়।’
ঠকাস করে গ্লাসটা রেখে উঠে দাঁড়াল লোকটি। ডোজটা একটু বেশি হয়ে গেছে বুঝে উত্তেজিত হয়ে দরজার দিকে চেয়ে চিৎকার করে বলল, ‘আরে, ওর স্বামীও এখানে থাকে!’
কিন্তু শুনতে পায়নি বুঝতে পেরে পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা কাগজের বাক্সে লাথি মেরে বলল, ‘ধুত্তর!’

দুই দিন পর
‘না না, আমি বেশি কিছু বলতেও আসিনি। তুমি কথা না শুনেই ফোনের লাইন কেটে দিচ্ছিলে, পরে তো বন্ধই করে রেখেছ, তাই আমি নিজেই চলে এসেছি অ্যাপলোজি চাইতে, ব্যস।’
‘কথা শেষ হয়েছে?’
‘তুমি যেমন তানিমের কথা বানিয়ে বলেছিলে, আমিও তেমনই জাস্ট একটু তোমাকে জ্বালাতে…।’
‘গেট লস্ট।’
‘আমি চলে যাওয়ার সময় তানিয়ার হাজব্যান্ডকে বাসাটা ভাড়া দিয়েছিলাম। ইনফ্যাক্ট আমিই এখন ওদের সঙ্গে থাকি। ওদের থেকে সামনের রুমটা চেয়ে নিয়ে…।’
জোর গলায়, ‘গেট লস্ট, কান্ট য়্যু হিয়ার মি?’
চিৎকার করে, ‘আই ওয়াজ অনলি জোকিং, দ্যাটস অল!’
চিৎকার করে হাত নেড়ে দরজা দেখিয়ে, ‘ফাইন। এবার বাইরে।’
চিৎকার করে দুই ধাপ এগিয়ে এসে মাথা সামনে তুলে, ‘আই সেইড, আই অ্যাম সরি।’
‘গো টু হেল উইথ ইওর আগলি ফেইস, আগলি জোক, আগলি অ্যাপলোজি!’
দড়াম করে দরজা লাগার শব্দ হলো ধুপধাপ করে লোকটি বেরিয়ে যাওয়ার পর।

একটু পরে, টেলিফোনে
‘হ্যাঁ, মোয়াজ্জেম সাহেব!…হ্যাঁ ভাই, (বিরতি), আর ভালো! ভাই, আমাকে শুধু একটি টিকিট কনফার্ম করে দেন, কালই। (বিরতি) না না, বাকি কাগজগুলো রেখে দেন, আমি নিয়ে নেব। (নীরবতা) না না, ওদের ভিসা লাগবে না…(বিরতি), আহা, বললাম তো, ওরা যাচ্ছে না, (কিছুটা আস্তে…আনমনে) সেধে সেধে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি! (আবার স্বাভাবিক জোরে) আমি একাই (বিরতি), হ্যাঁ-হ্যাঁ, ওয়ান ওয়ে, (বিরতি) ঠিক আছে, ধন্যবাদ।’

অতঃপর দীর্ঘ বিরতি, বছর খানেক পর
ধূসর দেয়ালের পাশে ধীরে ধীরে দেখা গেল লোকটির শান্ত মুখ, বুকে হাত ভাঁজ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। প্রশ্ন করল, ‘বাচ্চা কোথায়? কেমন আছে সে? অনেক বড় হয়ে গেছে, না?’
‘স্কুলে গেছে।’
‘বাচ্চা…, মানে, তোমার সঙ্গে ভালোই আছে?’
‘অবশ্যই, কেন থাকবে না, আহ্! আমরা একসঙ্গেই থাকি। বিভিন্ন ছবির বইপত্র কিনে দিই। ওকে নিয়ে বেড়াতে যাই, ফ্যান্টাসি কিংডমে নিয়ে যাই, আর্ট স্কুলে যাই। ভাবছি, সাঁতারটাই বা বাদ যাবে কেন, ওতেও ভর্তি করে দেব কদিন পর।’
‘ঠিক আছে, আমিও আসি। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে বল! আমরা একসঙ্গে বেড়াতে যাব, তোমার হাতের রান্না খাব।’
‘না। ব্যাপারটা ভালো দেখাবে না। তা ছাড়া আরও একজনের কথাও ভাবতে হবে। সে হয়তো ঠিক সহজভাবে মেনে নেবে না, ফ্রি ফিল করবে না।’
‘আরেকজন!’ হাত ঝুলিয়ে গুঙিয়ে উঠল লোকটি, ‘তার মানে তৃতীয় পক্ষ! কে সে? কোত্থেকে এল?’
‘আরে, আমার বাবা আরকি। তুমি এখানে থাকলে কী মনে করবেন তিনি, ভাবো তো!’
‘তা হলে চলো আমার সঙ্গে।’
‘কোথায়?’
‘কেন, আমার বাসায়!’
‘না-না, ইট ইজ টু লেইট নাউ। ওসব এখন আর মাথায় না আনাই ভালো। তুমি বরং যাও, হ্যাঁ, খোদা হাফেজ!’

অবশেষে এক মাস পর
চেয়ারে উপবিষ্ট লোকটিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার মাথার ওপর থুতনিটা রেখে দাঁড়িয়ে আছে নারী। বলল সে, ‘এসিটা কমিয়ে দিই? নাকি অফ করে দেব? তোমার তো আবার অল্পতেই ঠান্ডা লাগে।’
‘তোমার মনে আছে? সবকিছু মনে আছে?’
‘থাকবে না! বেশি রাত জাগলে আগের মতো ঘুমাতে অসুবিধা হয়? নাকি ওষুধ খাও?’
‘আজকে ঘুমাবে না। বলো না, তুমি যে চলে এলে, বাচ্চা রাগ করেনি?’
‘আরে না। কোথায় যাচ্ছি বুঝতেই পারেনি। বাদ দাও, তোমার কাছে এসে কী যে ভালো লাগছে, জানো? আসলে এখন শুধু আমরাই পারি একজন আরেকজনের সহায় হতে, সঙ্গী হতে। আর সবকিছুই কেমন গৌণ লাগে, তাই না?’
‘নিশ্চয়। আমরা দুজনে দুজনার, সুপার মার্কেটে ঘুরে বেড়াব, আর্ট এক্সিবিশনে যাব, পার্কে বসে বাদাম খাব, মুভি দেখব, মিউজিক…আহ্।’

কিন্তু সাত দিন পর
লোকটি সোফায় উপবিষ্ট। স্ত্রী সদা সঞ্চারমাণ।
হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে ঘোষণার ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি ঠিক করেছি একটা বুটিক দেব।’
‘দর্জি!’
‘ওভাবে বলছ কেন? ওসব কিছু না-কিছু আজকাল সবাই করছে।’
‘সবাই করলেই সেটা সঠিক হয়ে যায় না।’
‘কেন হয় না? ঠিক না হলে সবাই করে?’
‘কোথায় যেন একটি বইতে পড়েছিলাম, লেখক গালি দিতে গিয়ে বলছেন, তোমার চেয়ে মুদি ভালো! আর এখন দেখি, সবাই মুদি হতে চায়। ভালো মুদি হতে প্রতিযোগিতা করে। মুদি বিষয়ে পড়াশোনা করে।’
‘হুহ্, নীতিকথা!’ মুখভঙ্গি করল নারী, ‘খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই তো, বড় বড় বুলি কপচায়।’
‘তার মানে বুলিগুলো বড় বড় ছিল।’
‘যারা ওসব পড়ে, তাদের কাছে হয়তো ছিল।’
‘কিন্তু তুমি একটু আগেই “বড় বড়” কথাটা বলেছ।’
‘বলেছি তো কী হয়েছে? তুমি আমার সঙ্গে ঝগড়া করছ?’
নীরবতা।
‘বুদ্ধিটা কার?’
কিছুক্ষণ নিরুত্তর থেকে অস্পষ্ট ভঙ্গিতে একটা নাম বলল নারী।
‘ও, সেই বাঁদরটা?’
ফুঁসে উঠল মেয়ে। ‘ও একজন সেলিব্রিটি!’ রাগত অভিব্যক্তি।
‘মুদি সেলিব্রিটি।’
‘বাজে কথা বলবে না!’ শাসানোর ভঙ্গি।
‘মুদি সমাজ, মুদি সংস্কৃতি, মুদি মানসিকতা। নাপিত, বাবুর্চি, মুদি সেলিব্রিটি।’
‘অসহ্য!’ ঝামটা দিয়ে উঠল নারী। ‘তোমার সঙ্গে কথা বলাই মুশকিল। আর্ট-কালচার কিচ্ছু বোঝ না। একটা ভালো বই, ভালো মুভি, ভালো মিউজিক—কোনোটা নিয়েই তোমার সঙ্গে শেয়ার করা যায় না।’
‘তোমার ভালো আর আমার ভালো এক হয় না যে! তুমি খোঁজ কোন বইটা বিখ্যাত, মিউজিক, মুভি কোনটা হিট হয়েছে—সেটা।’
‘ভালো বই-ই তো বিখ্যাত হয়, নাকি? ভালো মিউজিকই তো সবাই শোনে।’
‘না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় না। সত্যিকারের ভালো বই কিংবা মিউজিক-মুভি নিয়ে কথা বললে সেসব তোমার মাথায় ঢুকবে না। দেখো না, তোমার সঙ্গে আমি তোমার মতো করে কথা বলি?’
‘আমার মাথায় ঢোকে না!’ তেড়ে এল নারী, ‘আমার মতো করে কথা বল, মানে কী—অ্যাঁ, মানে কী? আমার মতো করে কথা বলতে পারবে তুমি, পারবে? তোমার সঙ্গে…।’
ওদের তর্ক ক্রমশ উচ্চকিত হতে হতে ধীরে ধীরে ঝগড়ায় রূপ নেয়, আরও বাড়তে থাকে, তখনো ওরা হাতমুখ নেড়ে কথা বলেই চলে।

তিন দিন পর
টেলিফোনে—
‘না-না, ডেনমার্ক হয়ে যাব না, ওরা অনেক জায়গায় থামবে। আপনি ভাই ব্রিটিশ এয়ারে করে দেন। লন্ডনে একটু থামুক, তাও ভালো।’ একটু বিরতি। ‘অনেক দিন কাজ করতাম তো, একটা সোসাইটি হয়েছে, বাকি জীবনটা ওখানেই কাটাব ভাবছি।’ বিরতি। ‘আরে না, একাই…, একটা সিঙ্গেল টিকিট করে দিন, ওয়ানওয়ে, ব্যস।’ বিরতি। ‘সম্ভব হলে কালই…হ্যাঁ, ঠিক আছে…, ওকে।’ ফোন রেখে দিল সে।
নীরবতা।
‘কিন্তু তুই বারবার হেরে গিয়ে পালিয়ে যাবি কোথায়?’
বক্তার দিকে ফিরে যেন কিছুটা রেগে গিয়ে বলল সে, ‘অ্যাডজাস্ট করা উচিত, সংসার করতে হলে কিছু ছাড় দুজনকেই দিতে হয়, অন্যের মতামতকে সম্মান…,’ হাত নেড়ে শব্দ খোঁজার ভঙ্গি, ‘অন্তত সহ্য করা উচিত…, এসবই তো বলবি? নাকি আরও কিছু? বল। বলার জন্যই তো এসেছিস।’
‘না, এসব কিছুই আমি বলব না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তুই বারবার হারিস কেন? হেরেই যদি যাবি, তো আবার ফিরে আসিস কেন?’
বিরতি। চিন্তা।
‘ওই যে, কুকুর যেমন তার বমির কাছে যাবেই, শুয়োর বিষ্ঠার পাঁকে—কে যেন বলেছিল কথাটা? (বিরতি) বোকারা প্রথমে তিনবার বোকামি করে এবং তারপর করতেই থাকে।’
‘হুম, (বিরতি) এই তোর ব্যাখ্যা?’ সোফায় হেলান দিয়ে বসেই আছে বক্তা।
ঘর, কাপড়চোপড়, ব্যাগ গোছাতে গোছাতে কথা বলছে অন্যজন। বলল, ‘হয়তো…অন্যভাবেও বলা যায়, কিংবা হয়তো আরও কারণ আছে।’
‘ভালোবাসা?’
মাথা নেড়ে, ‘কখনো অহমিকা—জেদ, কখনোও ক্লান্তি—ভরসা।’
‘তার মানে আশ্রয়। অবচেতনে তুই ওর মধ্যে এক ধরনের নির্ভরতা খুঁজে পাস।’ নিজেই মাথা ঝাঁকিয়ে, ‘তোর ফেরা হবে না। শুধু শুধু আবার দুদিন পর প্লেন ভাড়া না দিয়ে, চুপ করে বসে থাক। একটু সময় দে, নিজেই ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ঠিক হয়ে গেছে বলে মনে হবে, বলছিস?’
‘একটু ভালো করে বুঝিয়ে বললে কী না হয়! একটু আগ্রহ দেখিয়ে…।’
‘ওসবও ট্রাই করে দেখেছি, নাটকের মতো করে বলেছি। আগে বলতাম বাচ্চার কথা, পরে বয়সের কথা, নিঃসঙ্গতায় নির্ভরতার কথাও বলেছি।’
‘খায়নি?’
চিন্তিত ভঙ্গিতে, ‘উম্ম?’
‘কাজ হয়নি ওতে?’
‘হয়েছে তো, দেরিতে হলেও ভালোই কাজ দেয় ওসব। কিন্তু…, (হতাশা) খুবই সাময়িক। (শ্রাগ করে) টেকে না।’
‘আংশিক বিশ্বাসও একটা টেকসই সম্পর্ক দিতে পারে। তাও বা মন্দ কী!’
‘খারাপ না হলেই সেটা ভালো হয়ে যায়? (হাসি) কী সরল সমীকরণ!’
‘তুই পোষ না মানার জন্য পণ করে আছিস।’
মাথা নেড়ে, ‘ভালো এবং মন্দের একই পুরস্কার হতে পারে না। আমি ভালোবেসে ফুল কিনে আনি, ও সেটাকে ভাজি করে খায়। অনেক দেখেছি।’
‘যথেষ্ট দেখা হয়ে গেছে বলেই তুই কাউকে পরিত্যাগ করতে পারিস না। প্রত্যেকেরই একটা দায়িত্ব আছে।’
‘আবেগ আর দায়িত্ব এক হতে পারে না। হূদয়াবেগ, ভালোবাসা আর দৈনন্দিন কাজকর্ম যাদের কাছে এক—(হাত-মুখের ভঙ্গি করে) আমি তাদের দলে নই।’
নীরবতা।
‘আর, কী একটা একঘেয়ে ব্যাপার, জানিস, একই জিনিস যেন বারবার ঘটছে!’
‘হুম, দিস ইজ লাইফ, এই রিপিটেশন, পুনরাবৃত্তিই জীবন।’
‘নো, দিস ইজ নট লাইফ। ওসব হচ্ছে ব্যর্থ লোকদের আত্মপ্রবঞ্চনা। আমি এই পুনরাবৃত্তি চাই না!’
‘কিন্তু না চাইলেও তা ঘটবে। চাওয়া না-চাওয়ার আমরা কেউ নই। এসবই হচ্ছে, যাকে আমরা বলি, জীবনের প্রাত্যহিকতা; যাতে থাকে অনিচ্ছুক বিষণ্নতা এবং চাপিয়ে দেওয়া আনন্দও। তখন কিংবা এখন, আসলে জীবন তো জীবনই!’
‘শুনেই মনে হয় না, কথাটা কত মিথ্যা?’
‘কী রকম?’
বিরতি, একটু ভেবে নেওয়ার ভঙ্গি।
‘তখনকে এখন দিয়ে ভাগ কর, তারপর সময় দিয়ে গুণ কর। তার সঙ্গে ভালোবাসা যোগ না করে জীবন থেকে বিয়োগ কর—দেখবে ফলাফল শূন্য।’
‘যে মানুষ তার অহংকে মূল্য দেয়, সে জানে কীভাবে বেদনা লুকাতে হয়। “সায়মন অ্যান্ড গারফাঙ্কল”-এর মতো হয়তো সে বৃষ্টির ফাঁকে কেঁদে নেয়।’
‘এমনকি আমার কান্নাও তাকে বিচলিত করে না। অশ্রু যেন প্রস্রাবের মতোই নৈমিত্তিক।’
নীরবতা।
‘এমন একটা অচেনা জীবন, যাকে যাপনের যন্ত্রণা কল্পনাও করিনি।’
‘তোদের ব্যাপারটা যেন সেই ফলের মতো, পাকার আগেই যেটা পচে যায়।’
বিরতি।
‘এখন পুরোনো জুতোর মতো আরামদায়ক নতুন জুতোই কিনতে পাওয়া যায়।’
‘এবং সেই জুতোর ফিতাও আর আগের মতো সহজে বদলাতে হয় না।’
‘এখন আর কারও শার্টের বোতামও ছেঁড়ে না।’
নীরবতা। দুজনই থেমে নিশ্চুপ হয়ে গেছে।
‘কিন্তু, তবুও…ধর, এখন এই মুহূর্তে ও যদি এসে বলে থেকে যেতে?’
‘টিভিতে যেমন দেখায়?’ তিক্ত হেসে মাথা নাড়ে সে, ‘বাদ দে।’ একটু থেমে, ‘আসলে আমি এবার বড় বেশি আশা করে এসেছিলাম। বয়স হয়েছে তো, একটা স্থিতি খুব দরকার ছিল। কিন্তু দেখলাম, ও আগের চেয়ে আরও বেশি অনমনীয় হয়ে গেছে, পুরোনো লোহার মতো। হয়তো আমিও হয়েছি।’ শ্রাগ করে, ‘হলো না,’ মাথা নেড়ে বলে, ‘হবে না।’
পেছন থেকে দেখা যায় অপরজনও মেনে নেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে, দুহাত পেতে নিজের নিম্নমুখী মুখ-মাথাটা ধরে থাকে। দূরে অন্যজন দুহাত ছড়িয়ে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা সোফার পেছনে দিয়ে বসে রয়।
ধীরে ধীরে আলো কমে এসে অন্ধকার হয়ে যায় নীরব ঘরখানি।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২৯, ২০১১

Category: গল্প
Previous Post:দাস্তাম্বু: মির্জা গালিব – অনুবাদ: জাফর আলম
Next Post:হারানো চপ্পলের গান – খোন্দকার আশরাফ হোসেন

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑