০১.৫ জীব দেহে শুক্ররূপে এ ব্রহ্মাণ্ড আছে ব্যেপে

জীব দেহে শুক্ররূপে এ ব্রহ্মাণ্ড আছে ব্যেপে

দুপুরে অন্নভোগের পর সবে বন্ধ হয়েছে মন্দির। যুগলকিশোরের এখন বিশ্রামের সময়। সারাদিনে দর্শনার্থীর ভিড়ে তাঁরা চোখের পাতা এক করতে পারেননি। এত-এত মানুষের প্রার্থনা আর্তি সব শুনেছেন। এখন দু’দণ্ড জিরোচ্ছেন। ভক্তদের এরকমই সব বিশ্বাস। গোঁসাই বাবাজি বললেন, এত কতা কেনে? তোমাদেরও তো পেটে ভাত পড়েছে। এখন জিরোও দিকি। কতা থামান দাও তেনারা সবে শুয়েছেন।

জিজ্ঞাসা করলাম, কাদের কথা বলছেন বাবাজি?

গোঁসাই বাবাজি অবাক হলেন। সামান্য ভুরু কুঁচকোলেন। পাকা ভুরুর জঙ্গলে কৃষ্ণের হাওয়া খেলল যেন।

বললেন, বলেন কী কতা! আপনি খেলেন, খিলানে হেলান খেয়ে পা ছড়িয়ে বসলেন আর রাধামাধব জিরোলেই দোষ।

বুঝলাম, বাবাজি এতক্ষণ যুগলকিশোরের যাতে ঘুম, বিশ্রামে কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্যই ভক্ত-শিষ্যদের নীচু স্বরে কথা বলতে বলছেন। এতখানিই রক্তমাংসের মনে করছেন বাবাজি আরাধ্য রাধামাধবকে।

বেলুড় মঠেও দেখেছি সন্ন্যাসীরা বিবেকানন্দের ঘরে সারা দুপুর ফ্যান চালিয়ে রাখেন। রাতে খাটে মশারি টাঙিয়ে গ্লাসে পর্যন্ত জল ঢেকে রাখেন। রোজ সকালে চাদর, বালিশের ওয়াড় পাল্টে দেন। রামকৃষ্ণ, সারদা মা ও অন্যান্য জাগতিক মায়া কাটিয়ে চলে-যাওয়া সন্ন্যাসীদের ঘরেও একইভাবে ফ্যান-লাইট জ্বালিয়ে, চাদর-বিছানা বদলে খাবার, জল ঢেকে রাখা হয়। এতখানি রক্তমাংসের মনে করেন তাঁরা স্থূল দেহ ছেড়ে যাওয়া এইসব সাধক-সাধিকাদের।

শঙ্কর মহারাজের মুখে একবার শুনেছিলাম বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ মন্দিরের পার্শ্বস্থ মাঠের কাঁকর নাকি রোজ বিকেল-বিকেল একটা-একটা করে বেছে ফেলে দেওয়া হয়। কারণ এই মাঠেই রোজ ব্রহ্মমুহুর্তে ঠাকুর স্বশরীরে পায়চারি করেন। অনেক মহারাজই ঠাকুরকে ভোরবেলাকার আচ্ছন্ন সেই আভায় হাঁটতে দেখেছেন। ঠাকুর খালি পায়ে হাঁটেন। তাই ঠাকুরের পায়ে কাঁকরের আঘাতে যাতে কোনও ব্যথা না লাগে সন্ন্যাসীরা সেজন্য রোজ রোজ কাঁকর বাছেন মাঠের।

প্রেমানন্দ গোঁসাই বাবাজিও যুগলকিশোরকে রক্তমাংসের মনে করেই ঠাকুরের বিশ্রামের সময় শোরগোলটা একটু কম করতে বলছেন।

আজ জৈষ্ঠ্য-সংক্রান্তি। যুগলের মেলার এই ভিড়ে, কলরবে যুগলকিশোর বা কতখানি বিশ্রাম পাবেন, নিশ্চিন্তে জিরোতে পারবেন খানিক-কে জানে!

দুপুরের রোদ নিস্তেজ হয়ে আসছে সবে। মেলা সাজ পরে নিচ্ছে। বাউল আখড়ায় একতারা-ডুবকি, ঘুঙুর-খমক সব এমন জোড়ায় রাখা হয়েছে যে, দেখে মনে হবে রাধাকৃষ্ণ যুগল হয়ে বসে। বাউলের রাখার ঢঙ কি তারই ইঙ্গিত করছে?

বিকেলে ফাঁকা মাঠে হাওয়া খেলছে। জিলিপি-গজার ডাঁইয়েও রাধাকৃষ্ণ মাছি পাশাপাশি জোড়ায়-জোড়ায় বসে সব। আখড়ার দিকে হাঁটছি। দোসতিনার দিলীপ দাস বাউল কুশল সংবাদ নিলেন। বললেন, রাতের গানে নেমন্তন্ন। আসবেন কিন্তু খ্যাপা।

ঘাড় কাত করলাম। হাতে ধরা পাঁপড় ভাজাতেও দেখি শ্রীকৃষ্ণ মাছি। রজত বলল, রাধাটা বুঝলে আমার পাঁপড়ে বসে। সেই থেকে ও এসব নিয়ে পড়েছে। মাঝ দুপুরের পর নবদ্বীপের বাবাজিদের সঙ্গে বসেছিলাম। তাঁরাই বলছেন কৃষ্ণ সর্বত্রগামী। শরীরে, মনে, চারধারে কৃষ্ণ বিরাজমান। রাধা নিয়ে যুগল হয়ে আছে। রজত সেসবই এখন ইয়ার্কির ছলে জানান দিচ্ছে আমাকে।

আমরা নটবর দাসের আখড়াতে এসে পড়লাম। তখন সেইভাবে গান শুরু হয়নি। মেলা কমিটির মঞ্চেও গাইতে ওঠেনি বাউল। এ-কথা সে-কথার পর কথা গিয়ে পড়ল। যুগলতত্ত্বের উপর।

বাউল বললেন, বেশ শক্ত কথা। তার চে বরং যুগলের গানই গাই। কী কন খ্যাপা?

রজত, সুজিত ওরা সব বলল, হোক হোক।

নটবর একতারা তুলে নিলেন। গাইতে লাগলেন যুগলের গান।

সব আমরা তন্ময় হয়ে গেলাম বাউলের গানে।

নটবর দাস বাউল গাইতে থাকলেন। হৃষীকেশ গোঁসাইয়ের পদে, রাধাকৃষ্ণের যুগলে একেবারে ডুবে গেলেন নটবর।

কৃষ্ণপ্রেম কি সহজে মেলে।
অকৈতব প্রেম
জম্বুনদ-হেম,
উদয় হয় ভাগ্য-ফলে।।

সাধারণী কিছু নয়,
সমজ্ঞসা কিছু হয়,
 সমর্থা প্রকৃত প্রেমের
হয় রে উদয়।
প্রেমে হয় না বিয়োগ,
সদাই থাকে যোগ,
মরে যায় বিয়োগ হ’লে।।

মা বাশুলীর পূর্ণ কৃপায়
যেমন দ্বিজ চণ্ডীদাস,
অপূর্ণ সম্পূর্ণ প্রেমে
মিটলো প্রেমের আশ;
প্রেমের রামী হয় গুরু,
কল্পতরু,
প্রেম-ভাণ্ডার দেয় খুলে।।

কৃষ্ণ প্রেম সুধাসিন্ধু
বিন্দুর কণা যদি পায়,
বিন্দুর প্রভাবে
চৌদ্দভুবন ডুবে যায়।
এ তো কইবার কথা নয়,
কে করিবে প্রত্যয়,
প্রেমের ভজন না জানিলে।।

এমন প্রেমেতে বিমুখ
ফেলে ভাবি আপ্তসুখ,
সুখে এবার বৈরী হ’লাম,
সুখের উপর দুখ।
ধরণীর কৃপায়
হৃষীকেশে কয়,
এই ছিল কি কপালে।

থামলেন বাউল। থেমে কৃষ্ণের ব্যাখ্যায় মাতোয়ারা হলেন। এরই মধ্যে দেখি যুগলের ভিড় উপচে পড়ছে। রাধাকৃষ্ণ একাকার হয়ে যাচ্ছে সব যুগলকিশোরের মেলায়।

*****

দুপুরবেলায় বাবাজি বললেন, তা বাবা রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি ত্রিভঙ্গ কেন? কেন আমরা বলি ত্রিভঙ্গমুরারি?

কেন? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

বাবাজি বললেন, আমাদের শরীরের তিনখানা গুণ নিয়ে তিনি যে ত্রিভঙ্গ হয়ে রয়েছেন। কী এই তিনখানা গুণ?

বললাম, কী?

বললেন, সত্ত্ব, রজ, তম গো।

বললাম, যদি একটু বুঝিয়ে বলেন।

–সত্ত্ব হল শরীরের নিত্যতা। স্থূল দেহ আমাদের। সবাইকার স্থূল শরীরে নিত্য জাগ্রত যে তিনি।

জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে জেগে আছেন তিনি?

–উপলব্ধিতে।

অস্তিত্বে কি তিনি কখনও তবে জেগে নেই?

হাসলেন, বাবাজি।

বললেন, আছে বাবা আছে।

–কীভাবে আছেন?

–রজ হয়ে।

ভাবলাম, বাবাজি প্রকৃতির গুণের কথা বলছেন। রজঃগুণ।

বললেন, রজ হল গিয়ে বাবা রাজসিক। আমাদের শরীরকে রাজসিক মায়ায় তিনি ধরে রাখেন। মায়া হল বন্ধন।

বললাম, অষ্টপাশের বন্ধন?

–অবশ্যই। কৃষ্ণকে শরীরের নিত্যতা মানলে আটপাশ তো থাকবে বাবা।

হাসলেন তিনি। বললেন, লীলা কী বাবা?

বললাম, খেলা।

চৈতন্যচরিতামৃত আওড়ালেন বাবা।

–কৃষ্ণের যতেক লীলা, সর্বোত্তম নরলীলা, নরবপু কৃষ্ণের স্বরূপ। তার জন্যই তো বললাম বাবা, কৃষ্ণের অস্তিত্ব শরীরের নিত্যতা। সেই নিত্যতা বুঝতে, জানতে, ধরতে নববিধা ভক্তিরস ছাড়া গতি নেই গো। এই নববিধা ভক্তি দিয়েই তো সাধক কৃষ্ণভজনা। করেন।

আরেক বাবাজি বললেন, কৃষ্ণকথা শুনে, গেয়ে, মনে রেখে, বন্দনা করে, সেবা করে, নিবেদন করে, পূজা করে, সখ্য তৈরি করে কৃষ্ণকে শরীরময় করে তোলা যায় বাবা।

–তম হল ভাব। মনের অন্ধকারকে দূর করে তামসিক ভাব আনা। এই ভাব এলে কৃষ্ণ হৃদয়ে, মনে, শরীরের সকল স্থানে আলো ফেলবে গো। তবেই তো কৃষ্ণের মাধুর্য বোঝা যাবে।

প্রেমানন্দ গোঁসাই বাবাজিও এ সময় এলেন। যোগ দিলেন।

বললেন, শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃততেই আছে–আপন মাধুর্য হয়ে আপনার মন। আপনে আপনা চাহে করিতে আলিঙ্গন।

তবে কৃষ্ণের সদর্থক শরীরী উপমার কথা আমাকে সর্বপ্রথম কিন্তু শুনিয়েছিলেন জগদীশ পণ্ডিতের শ্রীপাঠের সদানন্দ বাবাজি।

সান্ধ্য কীর্তনের পর একদিন তার সঙ্গে কথা চলছিল।

বললেন, কৃষ্ণ হল গিয়ে আমি নিজে। কৃষ্ণ হল গিয়ে তোমার শরীর, আমার শরীর, সবার শরীর। কৃষ্ণ হল নাড়ি।

বললাম, শরীরের নাড়ির কথা বলছেন আপনি?

–হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ। ঠিক ধরেছ গো।

–আমাদের শরীরে তো সাড়ে তিন লক্ষ নাড়ি রয়েছে।

বাবাজি বললেন, ঠিক বলেছ তুমি। এই সাড়ে তিন লক্ষ নাড়িই হল গিয়ে কৃষ্ণ। আর তার ভেতর প্রধান আটটা নাড়ি হল রাধারই অষ্টসখি বাকি সব নাড়ি গোপিনী।

–তাহলে রাধার উপস্থিতি কি আমাদের শরীরে নেই?

বললেন, হ্যাঁ। ঠিক কথা বলেছ। রাধা ছাড়া কৃষ্ণ হবে কী করে? শরীরের প্রধান তিন নাড়িকে তো গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতীর রূপ দেওয়া হয় যোগসাধনাতে। গঙ্গা ইড়া, যমুনা পিঙ্গলা, সুষুম্না সরস্বতী। কৃষ্ণমহিমায়। রাধা হল গিয়ে প্রধান। তিন নাড়ির মধ্যে সুষুম্নার কাজ বেশি। তা সুষুম্নকেও তুমি রাধা ধরতে পারো। পিঙ্গলা তো যমুনা। রাধা নিজেও তো এই নদীর সঙ্গে সংযুক্ত কৃষ্ণলীলায়। যমুনার লীলাকে আমরা তো পিঙ্গলাতেও রূপ দিতে পারি। পারি না বাবা? কৃষ্ণ তো আসলে রূপকল্পনার দৈত্য?

–দৈত্য কেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

–কেন নয় বাবা! সে তো রাখে, সে মারে। নির্ধারক সে।

আমি বললাম, এই যে আপনি বললেন নাড়িগুলো সব কৃষ্ণ। তাহলে…

–তাহলে কি? নাড়িগুলো সব না জাগলে কৃষ্ণ জাগবে কী করে শুনি? যার নাড়ি যত বেশি জাগবে ধ্যানে,যোগে, ভক্তিতে তার তত বেশি সিদ্ধ দশা আসতে শুরু করে দেবে। সাধককে তো নির্ধারণ করবেন শরীরের সাড়ে তিন লক্ষ কৃষ্ণ। তিনিই রাখবেন। সিদ্ধস্তরে পৌঁছে দেবেন আবার তিনিই মারবেন। স্থূল দেহেই বসিয়ে রাখবেন।

বাবাজি সেদিনকার মতো উঠে যাবার পর আমি বসেই রইলাম নাটমন্দিরে। কৃষ্ণ ভজনার ঘন্টা সব তখন জোরে জোরে বাজতে লাগল। আমার সারা শরীরে গিয়েও যেন আলোড়ন তুলল ঘন্টাধ্বনি। একসময় থেমেও গেল। বৃদ্ধা বৈষ্ণবী গাইতে থাকলেন কানু-বন্দনার গীত।

*****

নটবর দাস বাউল যুগলের গানে যে কথা শুনিয়েছিলেন তা হল কৃষ্ণ সহজে না পাড়ার কথা। সদানন্দ বাবাজি যতই বলুন নাড়ি হয়ে কৃষ্ণ শরীরস্থ হয়েছেন বা প্রেমানন্দ গোঁসাই, নবদ্বীপের বাবাজিরা সব যাই বলুন না কেন–নববিধা ভক্তিরসকে রসস্থ করে কৃষ্ণ পাবার কথা যতই বলুন না কেন–বাউল কিন্তু বলছেন: ‘কৃষ্ণপ্রেম কি সহজে মেলে। অকৈতব প্রেম/ জন্ধুনদ–হেম/ উদয় হয় ভাগ্য-ফলে।।’

ভাগ্যফল বলতে কী বলতে চাইছেন বাউল?

এই ভাগ্যফল হল গিয়ে সাধন ভাগ্যফল।

বাউল তাঁর জীবন দিয়ে আসলে কৃষ্ণ পাবার সাধনা করেন। কৃষ্ণ তাঁর কাছে প্রকৃতি। কৃষ্ণ সঙ্গিনীর সাহায্যে প্রাপ্ত সুধাকণা। রস। কৃষ্ণ পাবার আকুতি তাই বাউলের সারা জীবনেরই আকুতি। দুদ্দু শাহের পদের ভেতরও আমরা সে কথাই পাই। এই পদও যুগল-মেলাতেই নটবরের গলাতেই শুনেছিলাম। মেলা কমিটির মঞ্চে নটবর দাস বাউল এ গান গেয়েছিলেন সেদিন। গাইতে গাইতে বললেন, খ্যাপা, খ্যাপারা সব মেলায় কৃষ্ণবস্তু নিয়ে বসে আছেন যে, তারে জানতে–চিনতে-বুঝতে হবে তো কী খ্যাপা?

নটবর আমার দিকে চোখ ফেরালেন। খমকে বোল তুলে নিলেন। গাইতে থাকলেন কৃষ্ণ খোঁজার, কৃষ্ণ জানার, কৃষ্ণ বোঝার, কৃষ্ণ সাধনের গান।

কোন কৃষ্ণ হয় জগৎপতি
মথুরার কৃষ্ণ নয় সে সে-কৃষ্ণ হয় প্রকৃতি।
জীব দেহে শুক্ররূপে এ ব্রহ্মাণ্ড আছে ব্যেপে
কৃষ্ণ তারে কয় পুরুষ সেই হয় সেই রাধার গতি।
কৃষ্ণবস্তু নিগম ঘরে জীবদেহে বিরাজ করে
রসিকের করণ যে কৃষ্ণ ধারণ করণ গম্ভীর অতি।
আত্মতত্ত্ব জানে যে জন
কৃষ্ণ-সেতু চেনে সে জন
লালন সাঁইর বাণী রসিক ধনী বলে দুদ্দুর প্রতি।

হাটগোবিন্দপুরে একবার গেছি সাধন দাস বৈরাগ্যের খোঁজে। আশ্রমে ছিলেন না তিনি। কোথায় এন এক প্রোগ্রামে গিয়েছেন। শুনসান ফাঁকা আশ্রমে ঠিক গন্ধরাজ গাছতলায় বসে ছিলেন একখানা খাতা নিয়ে দয়াল সরকার। সাধনের আশ্রমে বহুদিন আছেন।

আমাকে বস্তে বললেন দয়াল। শীতলপাটিটা পরম যত্নে খুলে দিয়ে বললেন, বসেন।

জিজ্ঞাসা করলাম, কী লিখছিলেন?

বললেন, কিছু না। গানের খাতাখান দেখছিলাম আর কী। কত গান যে মুখে মুখে লিখি আবার মুখেই হারিয়ে যায়!

খাতায় লেখেন না কেন?

সব সময় কি আর খাতা থাকে। মনের খাতায় লিখি। আবার মনের পাতাখানা ছিঁড়েছুঁড়ে কখন যে মনেই মিলিয়ে যায়।

দয়াল সরকারকে দেখে মনে হল যথার্থ কবিমানুষ। ভাব আর শব্দ যেন সবসময় তাঁকে ঘিরে রেখেছে। শব্দ দিয়ে গান নয় শুধু, আশ্চর্য সব কথকতা তৈরি করে দিতে পারেন দয়াল।

খাতাখানা একঝলক দেখতে চাইলাম। দেখালেন দয়াল। হাতের লেখা স্পষ্ট। গোটাগোটা।

বললেন কথাপ্রসঙ্গে–তাঁর কথা তিনিই লেখেন তিনিই আবার মুছে দেন। জিজ্ঞাসা করলাম, কার কথা বলছেন আপনি?

–কেন গো। শরীরের কথা। শরীর দিয়ে শরীর লেখার কথা। বাউল তো তাই করে গো। শরীরই তাঁর গয়া-কাশী-বৃন্দাবন।

বললাম, শরীর মথুরা নয়?

বললেন, বুঝেছি। আপনে ঘুরিয়ে কৃষ্ণকথা জানতে চাইছেন।

–কৃষ্ণ কী আপনার চোখে?

–কী আবার! দেহ গো, দেহ। শরীরের এই ঘরখানাতে কৃষ্ণর বসবাস।

বললাম, নাড়িগুলোর কথা বলছেন আপনি?

–তা নয় গো, তা নয়। নাড়ি কৃষ্ণ নয়। রিপু কৃষ্ণ।

–ষড়রিপু? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

বললেন, ছয় রিপু, দশ ইন্দ্রিয়, চার চন্দ্র, সাত দিনের রজঃধারা দিয়ে কৃষ্ণ গঠিত। সাধক রিপু দমন করে। ইন্দ্রিয়গুলোকে বশ করে। চারচন্দ্রকে বশীভূত করে। তবে না সঙ্গিনীর রজে, মহাযোগে তাঁর কৃষ্ণবস্তু রক্ষিত হয়।

–কৃষ্ণ তাহলে কেবল কৃষ্ণবস্তুই?

হাসলেন দয়াল।

বললেন, তা কেন। দেহ কৃষ্ণ। সাধনের দেহ। পিতার হাড়, মজ্জা, মগজ, মণি আর মাতার রক্ত, মাংস, চামড়া, চুল নিয়ে দেহ গঠিত। দেহেই তো ইন্দ্রিয়,রিপু থাকে নাকি? রজ-বীর্যও থাকে। দেহ দিয়ে দেহ রক্ষা করাই কৃষ্ণ পাওয়া।

আর কিছু বললেন না তিনি। হয়তো বলতে চাইলেন না আর। তাই গান ধরলেন। এখন বেশ বুঝিতে পারি বাউলের গুহ্যতা ভাঙতে আপত্তি থাকলে তখনই তিনি গান ধরেন। আবার অনেক সময় এটাও হয়, গুহ্যতা ভাঙবার মতো শিক্ষাবস্তু তাঁর নেই। তাই তখন মুখস্থ গানের আড়াল নেন বাউল আর হাসেন। এই হাসির অর্থ হল যার-তার কাছে সাধনকথা বলা যাবে না। কিন্তু তিনি যে সাধন কথা দূর অন্ত গানকথাও ঠিকঠাক বোঝাতে অপারগ–তাঁর জারিজুরি সব গেছে খুলে তা তিনি বুঝতে পারলেন না। শুধু হাসলেন আর হাসলেন। গায়ক বাউলরা এটাই বেশি করে থাকেন।

দয়ালের কথা আমি বলছি না। দয়াল সাধনস্তরের মানুষ। তাঁর মুখেই শুনেছি বহু। সাধকের সঙ্গ করেছেন তিনি। এক জায়গাতে তাঁর মন টেকে না। দীর্ঘদিন হল সাধনের আশ্রমে আছেন। আগে ছিলেন নবাসনে। হরিপদ গোঁসাইএর আখড়ায়।

সাধনের আশ্রমে গন্ধরাজ ফুটেছিল তখন। দয়ালের গানের আর ফুলের ভুর ভুর গন্ধ কেবল বাতাসে মিশে যাচ্ছে। ফাঁকা আশ্রমে দয়ালের গান যেন একাই ধরে রেখেছে। কৃষ্ণের কলরব।

দয়াল গাইছেন–

প্রেম সুখদ্বার কৃষ্ণ রসাকার রসনাতে তাঁর কর আস্বাদন
সে যে যোগাযোগ স্থলে মৃণাল পথে চলে
সহজ কমলে সুধা বরিষণ।।
সর্ব ঘটে বটে পটে পট্টস্থিতি
শক্তিতত্ত্বগুণে আনন্দ মুরতি।
শৃঙ্গার-আকার ধরে সাধ্য কার
ওই যে স্বরতি-সঞ্চার নবীন মদন।।
আদ্য সুখসাধ্য, বাদ্য কারুর নয়,
ইন্দু বিন্দুগতি সদা বিরাজয়।
জীবে নাহি জানে সাধু সন্ত চেনে,
রসপানে জানে তাঁরা অমৃত-সেবন।
মন আত্মা বপু যত রিপুচয়,
দেহেন্দ্রিয় সবাই তাহাতে মিশায়।
তাঁদের ব্রজ-প্রাপ্তি দেহ, তৃপ্ত হয় জীবন।।
কাম-প্রেম-রতি হবে এক ঠাঁই
সুখ-দুঃখ-আদি তথায় কিছু নাই,
নির্মল সে পথে হাউড়ে চায় যেতে
ওই শক্তি আত্মশক্তি হলে যায় দর্শন।।

ঘোষপাড়া মেলায় বেশ রাতের দিকে বাউল আখড়াগুলো সব জমজমাট। সাধুদের ওখানেও তেমন ভিড় নেই। আর বৈষ্ণবীরা সব মাছি তাড়াচ্ছেন। ভিড়ে, মানুষের ঘেঁষাঘেঁষিতে তখন আমার অস্বস্তি হচ্ছে বেশ। জিরোতে ফাঁকাতে এলাম। দেখি অতিবৃদ্ধা এক বৈষ্ণবী নিমগ্ন হয়ে বসে আছেন। বুঝলাম এ বয়সে সঙ্গী নেই আর তাঁর। গিয়ে বসলাম তাঁর একটু পাশে।

মাটিতে ঘাসের ’পরেই বসলাম আমি। তিনি টের পাননি। চোখ খোলা। ঘুমে যে ঢুলছেন না তা বেশ স্পষ্ট। সম্বিৎ ভাঙলে বললেন, ভাই এখানটাতে বসো। একেবারে মাটিতে কেন? ঠাকুমার ঘেঁড়া চাটাইটা ‘তালে আছে কী করতে? নাতি আমার মাটিতে বসবে তা কী হয়!

শতছিন্ন চাটাইতে আমি বসলাম।

বললেন, এখন আর ঘুম হয় না ভাই। তাই চেয়ে চেয়ে তাঁর অপেক্ষাতে থাকি। তবে তিনি সাত তাড়াতাড়ি না এলেই ভালো।

বললাম, না না। এত তাড়াতাড়ি মৃত্যু আপনাকে টানবে না। বলতে নেই, আপনার বয়স হলেও দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি অসুস্থ নন।

আমি তার কথা বলছি নে। বলছি ঘনশ্যামের কথা।

মানে! আমি চমকে গেলাম।

বৈষ্ণবী বললেন, একটা কথা আছে ভাই। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণই আশ। এই যে তিনি আসবেন। অপেক্ষা–এটাই তো জেবন। তিনি এলে, শ্যাম এলে তো আর আশা থাকবে না। না আসাটুকুই শ্যাম ভাই। এসব তুমি বুঝবা না। তা ভাই তোমার সাথে কেউ নেই কেন? রাধা ছাড়া কৃষ্ণ কি মানায় ভাই? সেজন কোথা?

তার কোনো খোঁজ পাইনি ঠাকুমা।

বৃদ্ধা হাসলেন।

বললেন, পাবা ভাই পাবা। তাড়া কিসের? প্রত্যেক কৃষ্ণর জন্য প্রত্যেক রাধা থাকে। খোঁজো খোঁজো। গরু খোঁজা করে ফেলো। দেখবা পাবা একদিন। কৃষ্ণ ছাড়া সে থাকবে ক্যামনে শুনি?

ঠাকুমা কৃষ্ণ কী? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

কী আবার ভাই! কৃষ্ণ হল গিয়ে আসলে সুর। অপেক্ষার সুর। তাঁকেই শুনতে হয়, ধরতে হয়, বুঝতে হয় দাদুভাই। বাঁশি কেন তাঁর হাতে?

কেন ঠাকুমা।

বাঁশিই তো সুর দাদু। বাঁশি বাজানো মানে আমাদের কামকে, ক্রোধকে, লোভকে, মোহকে, মাৎসর্যকে, মদকে বাজানো। এই দুইকে মন দিয়ে বাজাতে হবে দাদুভাই। তবেই না কৃষ্ণ বাজবে। বাঁশি বাজবে। বাঁশির সাতখান ফুটোর মানে হল। ষড়রিপুকে মন দিয়ে বাজানো। আর বাজাতে পারলেই কৃষ্ণ মিলবে। তাঁকে বাজাবা ভাই। তাহলে মানুষের ঊর্ধ্বে উঠবা। তোমার বাঁশিখান তোমাকেই তো বাজাতে হবে। তবেই না রাধা আসবে।

রাধা কী ঠাকুমা?

রাধা আগমন। অপেক্ষার শেষ। তাঁর জন্যই তো কানাইয়ের পথ চেয়ে বসে থাকা। এই তুমি যেমন আছো ভাই।

ঠাকুমা আপনার আশ্রম কোথায়?

হাসলেন তিনি।

বললেন, আশ্রম নেই ভাই। একখান বাড়ি আছে। পোড়া বাড়ি। তিনি চলে যাবার পর বাড়িটা বাজে। ষড়রিপু নিয়ে বাজে গো বাড়ি। বাড়ি ছেড়ে তাই ভাই পথে-পথে ঘুরি। যাও যাও, খোঁজো তারে। আমি খুঁজি আমার সেই ঘনশ্যামরে।

পার্শ্ববর্তী আখড়া থেকে তখন ভেসে আসছে কৃষ্ণ খোঁজার সেই অতি পরিচিত গান। আমি শুনতে শুনতে এগোচ্ছি আর ঘুরে তাকিয়ে দেখছি, এ কী! বৈষ্ণবী ঠাকুমা বসে নেই সেখানে। তবে গেলেন কোথায় তিনি এই মধ্যরাতে? কৃষ্ণ খুঁজতে কি!

আমি শুনতে পাচ্ছি বাউল গাইছেন–

এমন মন ব্যবসা ছেড় না ওগো সুখের ধানভানা
কর কৃষ্ণপ্রেমের ভান কুটো কোনোই কষ্ট থাকবে না
তোমার দেহ ঢাকশালে অনুরাগের ঢেঁকি বসালে
ভজন সাধন পাড়ুই দুটো দু দিকে দিলে
আবার নিষ্ঠা আঁশ কলাই লাগালে
ঢেঁকি চলবে ও সে টলবে না।।
রাগ দরদী দুইজন ভানুনী তাঁদের নাম কৃষ্ণ মোহিনী
তাঁদের একজন সদা গোপের মেয়ে একজন তেলেনী
তারা ধান ভানে ভালো জানে ভালো গায়ে তাঁদের উপাসনার গহনা।
রাগ বিবেকের মুষল আঘাতে বাসনা তোর
যাবে ছেড়ে পাহার দিতে দিতে
চাল উঠবে সেঁটে বিকার কেটে ঠিক যেন মিছরি দানা।
ঘরের বিদ্যাবুদ্ধি বেশ গিন্নি হবে শেঁকার দেউনী
শুদ্ধরতি শুদ্ধমতি কুলা চালুনী
এবার কাম কামনা ছেড়ে ঝেড়ে ঝুড়ে তুসকুঁড়ো চেলে লও না।
শ্রীগুরু সেই মহাজনের ধান তাতে হবিরে সাবধান
ষোল আনা বজায় রেখে করবি ব্যবধান।
লাভে লাভে কাল কাটাবি আসলে হারাইও না।।
গোঁসাই বলে অনন্ত ধান ভানতে পারবি না
তোর ঘটবে যন্ত্রণা
পাপ ঢেঁকি তোর মাথা নাড়ে গড়ে পড়ে না
দেখিস যেন বেহুঁশ হয়ে যাতে ঢেঁকি পড়ে না।

কৃষ্ণ দেখছি রূপকের আড়ালেই বারবার সাধকের শান্ত আত্মসমর্পনের আবেগ দিয়ে শরীরের জন্মদিন পালন করছে। চিত্রল-মুগ্ধতায় সদর্থক মিতায়ন নিয়ে এমন সব। প্রতীক নিবন্ধকে গানে সংগত আড়াল করে দিচ্ছে যে প্রতীকে বসে সদর্থক সাধনতত্ত্ব সব বারবার আলো ফেলছে।

কৃষ্ণের প্রেমকে ‘কৈতব’ নয় ‘অকৈতব’ প্রেম বলে অভিহিত করেছেন পদকর্তা। ছলনা, কপটতাহীন প্রেম। তাই অকৈতব। ‘জম্বুনাদ হেম’ও বলেছেন পদকর্তা কৃষ্ণপ্রেমকে। জন্ধুনদের শীতার্ত সাদা বরফ জমা রূপ-স্বরূপের সঙ্গে তুলনীয় কৃষ্ণপ্রেম। বোঝা যাচ্ছে। প্রেমকে বিম্বিত আরশি দিতে চাইছেন পদকর্তা হৃষীকেশ গোঁসাই।

যেটা এখানে বলতে হয়: ‘কৃষ্ণ’ শব্দের প্রতিবিম্বিত আধারেই কিন্তু ‘প্রেম’ শব্দটি বর্তমান। কৃষ্ণের যে স্বরূপ তা কিন্তু লীলারূপ। এই লীলা যোগীরা বিশ্বাস করেন শুরু হয় ভূলদেহে। ‘প্রেম’ কথাটি, শব্দটি যদি স্থূল অর্থে দেখি তবে তাঁর শব্দরূপের যে দুই সংখ্যার সমষ্টি ‘কৃষ্ণ’ কথাতেও তাই বর্তমান আছে। সুতরাং প্রেম আর কৃষ্ণকে সাংখ্যিক অনুপাতে আমরা পরস্পরের কাছে নিয়ে যেতে পারি। আমাদের স্কুল দেহ নাশ হয় যোগে। তা শুরু হলেই দেহ ছাড়খাড় হয়ে যায়। কুণ্ডলিনী জাগে। মূলাধার থেকে সহস্রারে সেই শক্তি মিশে যায়। নাড়িগুলো সব আনন্দিত হয়ে পড়ে। নাড়িগুলোকে গোপীর কথা বলেছেন বাবাজি। তা। যদি হয় নাড়িগুলোর জাগৃতি সব নৃত্যরত গোপিনী। রাধাও আছেন সেখানে। তাহলে দাঁড়ালো এই, গোপীদের সঙ্গে অর্থাৎ কিনা শরীরের নাড়িগুলোর সঙ্গে সাধকের যে বোঝাপড়া তাই কৃষ্ণের লীলা। স্থূল শরীর যোগে, সাধনায় নাশ হয়ে সূক্ষ্ম শরীর কৃষ্ণ হয়ে গিয়ে রাধা ও গোপী সহ নৃত্য করছেন, আনন্দ করছেন সাধক কৃষ্ণ। প্রেমময় জাগতিক আনন্দ এ নয়। এ আনন্দ সাধকের। কৃষ্ণ সাধকের দিব্যতা। বাউলও তাই-ই করছেন কিন্তু। ‘প্রকৃতি’কে কৃষ্ণ বলছেন তাঁরা। প্রকৃতিকে আমরা সঙ্গিনী, সাধিকা না ধরে যদি ধরি অপার অনন্ত শূন্যতা–তবে তাঁর রূপ তমোময়। এই তমসা উত্তীর্ণ জ্যোতি আহ্বান করছে। প্রকৃতির বর্ণচ্ছটাতে আমাদের নৃত্য করতে। অর্থাৎ কিনা আনন্দ করতে। নৃত্যকে, আনন্দকে ‘গোপী’ বললে গোপীর ‘গ’ হল প্রকৃতি। ‘পী’ হল ডাকা বা আহ্বান করা। আপ্যায়ন বললে ঐকতানটা যেন আরওই ঠিক থাকে। বৈষ্ণবরা তো রাধাকে মহাপ্রকৃতি বলেন। গোপীদের তাহলে ধরি বিশ্বপ্রকৃতি। যে গোপীরা সব শরীরের মধ্যেই অবস্থান করছেন। সাধকের শক্তির আধারে লীলা করছেন, আনন্দ করছেন, নৃত্যকলা প্রদর্শন করছেন। বলতে পারি বিশ্বপ্রকৃতিকে আহ্বান করছেন, ডাকছেন, ইশারা করছেন প্রকৃতি। বাউল সাধককেও ডাকছেন প্রকৃতি। মহাযোগে বৈষ্ণবীয় নামান্তরের মহাপ্রকৃতি বাউল সাধককে উর্দ্ধরেতা দান করে কৃষ্ণ করে দিচ্ছেন। কৃষ্ণকে শুদ্ধতা নয়–সিদ্ধতা হিসাবে দেখছি আমরা। বাউলের কৃষ্ণ বীর্য। বস্তুরক্ষা। ‘কৃষ্ণবস্তু’ বলেন তাঁরা কিন্তু বীর্যকে। রজ, প্রকৃতির প্রবাহ বা আনন্দ রাধাবিন্দু। ‘বিন্দুসাধন’ বলেন বাউল। বিস্কুধারণ আর পতন। ধারণ হল উর্ধ্বারেতা দান করে সিদ্ধতা। পতন-যোনিতে পতন। অকৃতকার্যতা তা আর কী।

গানে পদকর্তা রামীকে প্রেমের ‘গুরু’, ‘কল্পতরু’ বলেছেন। বলেছেন এই কারণে বাউলের সঙ্গিনী প্রকৃতি। তিনিই তো সাধককে কৃষ্ণবস্তু রক্ষা করার সাহায্য করে সিদ্ধাসনের ‘প্রেমভাণ্ডার’ খুলে দেন। পদকর্তা বলছেন–’মা বাশুলীর পূর্ণ কৃপায়/ যেমন দ্বিজ চণ্ডীদাস অপূর্ণ সম্পূর্ণ প্রেমে/ মিটলো প্রেমের আশ, / প্রেমের রামী হয় গুরু, / কল্পতরু/ প্রেম-ভাণ্ডার দেয় খুলে।

কৃষ্ণপ্রেমকে ‘সুধাসিন্ধু’ বলছেন পদকর্তা। সুধা হল জল। জল হল শুক্র বা মূত্র। এদের রস’ও বলেন বাউল। সঙ্গিনীর রজ’কে তাঁদের ‘রূপ’ বলতে শুনেছি। বাউল তো চারচন্দ্র ভেদ করেন। শুক্র, রজ, মল, মূত্রকে শরীরে ধারণ করে শরীরে ফিরিয়ে দেন। ‘শুক্র’কে তাঁরা ধারণ করেন। গানে নটবর সেকথাই বলেছিলেন–’কৃষ্ণপ্রেম সুধাসিন্ধু/ বিন্দুর কণা যদি পায়, / বিন্দুর প্রভাবে/ চৌদ্দভুবন ডুবে যায়। এ তো কইবার কথা নয়, কে করিবে প্রত্যয়,/ প্রেমের ভজন না জানিলে।।’

সাধকের বীর্য আর সঙ্গিনীর রজ এই দুই বস্তুকে বাউল দেহ গঠনের মুখ্য হিসাবে ধরেন। শুক্রের যে প্রাণকনা তা বাউলের কৃষ্ণবস্তু বা তাঁরা বলেন কৃষ্ণবিন্দু। সঙ্গিনীর রজর ডিম্বানু তাঁদের কাছে রাধাবিন্দু। এই দুইয়ের মিলিত যে প্রাণ বাউলের তা হল সুধাসিন্ধু। বাউল সাধনায় সন্তান সাধনপ্রনালীর অঙ্গ নয় মোটেই। যদিও এখন বাউল পুত্রকন্যা নিয়ে রীতিমত ঘর করেন। তবে সাধক বাউল সন্তানের জন্ম দেন না। অনেক বাউল সাধক-সাধিকা আছেন যারা সংসার ত্যাগ করে দীর্ঘদিন সাধনায় নিমগ্ন আছেন। যেমন মীরা মা-কাকা গোঁসাই, হরিপদ গোঁসাই–নির্মলা মা, সাধনা-গৌরখ্যাপা–এঁদের কথা আমরা জানি। তন্ত্রেও সন্তান জন্ম নিষিদ্ধ। তন্ত্রসাধক তাঁর সঙ্গিনীকে শরীরে বীর্যকে উর্ধ্বগতি দিয়ে প্রেমের দিব্যতায় ডুবে যান। তান্ত্রিক সাধুর যুক্তি ভৈরবীকে তাঁরা মা বলেন কারণ–মাতৃভাব আর রমণীভাব দুটোই আরোপিত ভাব। আসলে নারীর দুই রূপ। যেই রূপে ভাব আরোপ করা হয়, নারীর যে জননীরূপ, মাতৃভাব তাও যেমন আরোপিত তেমনি নারীর যে রমণী বা ভৈরবী হয়ে ওঠা তাও তো আরোপিত প্রকৃতিকে আমরা নারী। হিসাবে দেখি। আকাশকে পুরুষ। মানে হল আকাশের বিশালতা, ব্যাপ্তি প্রকৃতিকে ধরে রাখার জন্য। সাধক যে সঙ্গিনীকে ধরে রাখেন দেহ সাধনায় বা যুগল সাধনায় তাঁর কারণ তাঁরা সৃষ্টিপথকে প্রসারিত করেন। সৃষ্টি এখানে প্রাণ নয় কোনো প্রেমস্বরূপ প্রাণতরঙ্গ। সৃষ্টি হল শক্তির ব্যাপ্তি। বিশালতা। যোগীপুরুষ শরীরস্থ সমস্ত চক্রের শক্তিকে জাগিয়ে নিয়ে এই ব্যাপ্তি বা বিশালতাকে অনুভব করে থাকেন। প্রত্যেকটি চক্রে যোগী শক্তিরই আরাধনা করেন। মূলাধারে থাকে ডাকিনী শক্তি। ডাকিনী কথাটি তিব্বতী ঘেঁষা শব্দ। তিব্বতের ডাক শব্দ থেকে যোগশাস্ত্রে ডাকিনী শব্দটি এসেছে। তিব্বতে ডাকের অর্থ হল জ্ঞান। যোগশাস্ত্রে ডাকিনী হল জ্ঞানী রমণী। বলা হয় এই চক্রেই সাধকের মধ্যে প্রথম জ্ঞানের উদয় হয়। তাই এই চক্রে সাধক ডাকিনী শক্তির ধ্যানজপ, আরাধনা করে থাকেন। স্বাধিষ্ঠানে শক্তির নাম রাকিনী। অনেকে বলেন আবার কাকিনী। ডাকিনীও মতান্তরে শাকিনী। মণিপুরে থাকেন। শক্তিরূপিণী লাকিনী। অনাহতে কাকিনী। বিশুদ্ধে শাকিনী। বৌদ্ধরা বলেন এঁকে সুবেশা যোগিনী। কারণ এই চক্রে ধ্যানে যোগশক্তির মাত্রা অতিরিক্ত নাকি বেড়ে যায়। আজ্ঞাচরে হাঁকিনী। বৌদ্ধরা বলেন আবার, চিৎকারকারিণী যোগিনী। এখানেই নাকি শক্তির বিস্ফোরণ ঘটে সাধন শরীরে। সেজন্যই হাঁকিনী। সহস্রারে সন্ধিনী শক্তির বিকাশ। কারণ এই চক্রেই পরমের বা চিপিণী শক্তি বা সম্বিত জাগে পুরো মাত্রাতে সাধক শরীরে। সাধক নির্বাণত্ব লাভ করেন এখানে এসেই।

তন্ত্রেও এই শক্তিগুলোর আনাগোনার কথা বলে থাকেন দেহসাধক। বাউল সাধনের শক্তি এরূপ কল্পিত শক্তি নয়। যোগশক্তি অবশ্যই রেচকে, পূরকে, কুম্ভকে তাঁরা শরীরকে জাগান কৃষ্ণবস্তু রক্ষার তাগিদে। যোগশাস্ত্রে আটপ্রকার কুম্ভকের কথা উল্লেখ আছে তা কিন্তু তাঁরা করেন না। প্রয়োজনই নেই তাঁর। কেননা বাউলের পরম নিরাকার মহাশূন্যতার জ্যোতি কখনওই নয়, তাঁর পরম শরীরে কৃষ্ণবস্তু রক্ষা। নটবর দাস বাউল যুগলমেলায় মঞ্চে যে গান শুনিয়েছিলেন সে গানে স্পষ্টই বলা আছে–’কৃষ্ণবস্তু নিগম ঘরে জীবদেহে বিরাজ করে/ রসিকের করণ সে কৃষ্ণ ধারণ করণ গম্ভীর অতি।’ হৃষীকেশ গোঁসাইয়ের পদে বলা হচ্ছে–’বিন্দুর প্রভাবে/ চৌদ্দভুবন ডুবে যায়। চৌদ্দভুবন হল দুই চোখ, দুই কান, দুই নাক, মুখ, মাজা, লিঙ্গ, যোনি, বুক, স্তন, নাভি, ব্রহ্মরন্ধ্র। যা কিনা যুগলেরই প্রত্যঙ্গ সব। বিন্দুর প্রভাব’–বীর্যর ঊর্ধ্ব ধারা, যাতে দুই শরীর আর বাহ্য শরীর থাকেনা। স্কুল, প্রবর্ত, সাধক পেরিয়ে সিদ্ধ হয়ে ওঠে। আর এখান থেকেই তো প্রশ্ন ওঠে। প্রতিবাদ ওঠে। ঝড় ওঠে নারী বাউল সমাজে। তন্ত্রে ভৈরবীর কিন্তু অতখানি নগণ্য দশা নয়। কারণ সিদ্ধা ভৈরবী কিন্তু ছিলেন অনেকেই। যারা অষ্টসিদ্ধি রপ্ত করেছেন রীতিমত। তারাও তন্ত্র সাধকদের মতো অণিমা(ক্ষুদ্র হবার ক্ষমতা), মহিমা(বৃহৎ হবার ক্ষমতা), লঘিমা(হাল্কা হবার ক্ষমতা), গরিমা(ভারী হবার ক্ষমতা), প্ৰাপতি(যা ইচ্ছা লাভের ক্ষমতা), প্রকাম্য(যে কোনো জিনিস পাবার ক্ষমতা), ইশিত্ব(যে কোনো কিছুর ওপর নিজের প্রাধান্য স্থাপনের ক্ষমতা), বশিত্ব(বশ করার ক্ষমতা) অর্জন করতে পারেন। এরকম সাধিকা ভারতীয় আধ্যাত্মবাদে কম নেই কিন্তু। তাই ভৈরবীদের যথার্থ মর্যাদা আছে। যদিও সেই সাধনেও ধস নেমেছে এখন। স্বাভাবিকই। কারণ তন্ত্র করা, কিছুটা শক্তির সিদ্ধি পেয়ে ভক্তশিষ্য জোগাড় করে পেট চালানো একটা জীবিকাই হয়ে উঠেছে অনেকটা বাউলের কেবল গান গাওয়ারই মতো। বাউল আটপ্রকার কুম্ভক না করলেও হঠযোগ করেন। বৈষ্ণবরাও নানাবিধ প্রাণায়াম করে থাকেন। একবার চৈতন্য ডোবার প্রভু বলেছিলেন আমাকে, কৃষ্ণ তো প্রতিনিয়ত আমাদের শরীরে ঢোকেন আর বেড়িয়ে চলে যান।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কীভাবে কৃষ্ণ শরীরে ঢোকেন আর কীভাবে বা তিনি শরীর থেকে বেড়িয়ে চলে যান?

বললেন–যোগে, আসনে, প্রাণায়ামে। বায়ুগ্রহণ হল শরীরে কৃষ্ণের প্রবেশ আর ত্যাগে হল তাঁর বেড়িয়ে যাওয়া। জপ তো আসনে উপবিষ্ট হয়েই করতে হয়। জপে তো কৃষ্ণ ঢোকেন আর বেরোন। তাই কৃষ্ণ যাতে সব সময় শরীরে বিরাজ করেন তাঁর জন্যই তো সব সময় ধ্যানজপ।

যোগশাস্ত্রে আট প্রকার কুম্ভকের উল্লেখ আছে। ‘সহিতঃ সূৰ্য্যাভেদশ্চ উজ্জায়ী শীতলী তথা। / ভস্ত্রিকা ভ্রামরী মূৰ্ছা কেবলী চাষ্টকুম্ভিকা।।’ সহিত, সূৰ্য্যাভেদ, উজ্জায়ী, শীতলী, ভস্ত্রিকা, ভ্রামরী, মূৰ্ছা, কেবলী–এই আট প্রকার কুম্ভক। যোগীপুরুষই যা রপ্ত করেন। চক্র জাগাতে এগুলো সবই গুরুত্বপূর্ণ। অনাহত চক্রে বায়ুবীজ লং অবস্থিত। দশ বায়ু আছে–‘প্রাণোহপানঃ সমানশ্চোদানব্যানৌ চ বায়বঃ/ নাগঃ কুম্মোহথ কুকরো দেবদত্তো ধনঞ্জয়ঃ।।‘ প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান, নাগ, কুর্ম, কূকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয়–এই হল দশ বায়ু। এর মধ্যে প্রধান পাঁচ বায়ু প্রাণ, অপান, গুহ্যদেশে; সমান নাভিমণ্ডলে; উদান কণ্ঠদেশে; ব্যান সমস্ত শরীরে অবস্থান করে। দশ বায়ুর দশটি গুণ বর্তমান। যার গুণগুলো ঠিকমতো জেনে নিতে পারলে সাধক শরীরের উপর ইচ্ছামত আধিপত্য স্থাপন। করতে পারেন। এতে সাধক শরীর সুস্থ ও নিরোগ থাকে।

প্রাণবায়ু খাবারকে পরিপাক করে; পানীয়কে স্বেদ ও মূত্ররূপে এবং রসকে। বীর্যরূপে, রজঃরূপে প্রতিস্থাপন করে দেয়। অপান বায়ু খাবার পরিপাকের জন্য অগ্নিপ্রজ্জোলন করে। গুহ্যে মল নিঃসারণ করে, উপছে মূত্র এবং অণ্ডকোষে বীর্য। তাছাড়া ঊরু, জানু, কটিদেশ ও জঙ্র কাজও সম্পন্ন করে থাকে। সমান বায়ু পরিপক্ক রসকে সমস্ত নাড়িতে চালিত করে; দেহের পুষ্টিসাধন করে। আমাদের প্রত্যঙ্গগুলোকে উন্নত করে উদান বায়ু। ব্যান বায়ু চোখ, কান, গলা ইত্যাদির কাজ সম্পন্ন করে। নাগবায়ু উদরের কাজ, কুর্মবায়ু সংকোচনের কাজ করে থাকে। খিদে-তৃষ্ণার তৈরি হয় কুকর বায়ুর কাজে। নিদ্রা হয় দেবদত্ত বায়ুতে। শোষনাদির কাজ করে থাকে ধনঞ্জয় বায়ু। সাধক এইসব বায়ুগুণকে আত্মস্থ করে নেন যোগক্রিয়ায়। তন্ত্রে এই বায়ু প্রয়োগ দরকার। বাউল সাধনায় এতখানি দরকার নেই। তাঁদের ক্রিয়াকল্পে হঠযোগ, রেচক, পূরক, কুম্ভক ইত্যাদিই যথেষ্ট।

যুগলের মেলায় কমিটির মঞ্চে নটবর দাস বাউল আমাকে বাউলের কৃষ্ণকে যেন প্রতীকী অনুষঙ্গের পরিধি বাড়াতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি বললেন, ‘খ্যাপারা সব কৃষ্ণবস্তু নিয়ে বসে আছেন।’

পুরাণ কাহিনী কিন্তু কৃষ্ণকে সেভাবেই উপস্থিত করে প্রাণময় করে রেখে দিয়েছে। পুরাণকারেরা কৃষ্ণকে যে সব অধিবিদ্যা দিয়ে বসেছেন সেগুলো কিন্তু সব আসলেই একেকটি স্মারক। যা তুলে দেওয়া যায় অনায়াসে মানুষের হাতে। আর এভাবেই। মানুষ ‘কৃষ্ণবস্তু’কে ইচ্ছে করলেই লাভ করতে পারেন। যেটা মনে হয় কৃষ্ণ হল আমাদের অন্তদৃষ্টি। সুসাৰ্থক প্রতীক সব কৃষ্ণকীভাবে?

কৃষ্ণকে সাধক শরীর আমরা ধরেছি আগেই। গোপীরা সব নাড়ি। কৃষ্ণ শরীরস্থ আত্মা বা অনুভব। যোগের প্রসারিত অঞ্চল সব। দেহস্থ নাড়িগুলো গোপী সেজে কৃষ্ণকে সবসময়ই বিরক্ত করেন। সাধকের বিরক্তি এতে। নাড়ি অর্থাৎ কিনা গোপীরা সব যোগক্রিয়াতে সাড়া দিচ্ছে না ঠিকমতো। চক্ৰস্থ শক্তিগুলোকে দেহসাধক একীভূত করে নিতে পারছেন না কিছুতেই। তাই তাঁদের শিক্ষা দেবার জন্য, উপদ্রব কমাবার জন্য কৃষ্ণ তাঁদের পাশমুক্তি দিয়ে বসলেন। এই পাশমুক্তি হল আবরণ উন্মোচন। বাসনার বস্ত্রকে সাধনার শরীর থেকে টেনে খুলে ফেলা। নাড়িগুলো যদি গোপী হয়, তাহলে তো কৃষ্ণ তাঁদেরই কাপড় সব টেনে খুলে একেবারে ন্যাংটা করে দিচ্ছেন। আবার নাড়িগুলো যদি প্রতীকী আবরণের গোপী হয়, তাহলে তো কৃষ্ণ তাঁদের সঙ্গে লীলাও করবেন না কী! কীভাবে করবেন সাধক কৃষ্ণ এই লীলা?

গোপীদের বশ করে নেবেন তিনি। বস্ত্র যদি বাসনা হয় তাহলে বাসনা মুক্ত শরীরে সর্বদাই চলবে নাড়িগুলোর ছন্দগত ক্রিয়াকরণের সব লীলা। এঁদের মধ্যে তো রাধাও বর্তমান ভেবে নিয়েছিলাম আমরা। দাঁড়াল এই–সাধক কৃষ্ণ মহিমায় মহিমান্বিত। হয়ে এভাবেই গোপীরূপী সব নাড়ি আর রাধারূপী সুষুম্নার সঙ্গে বিশেষ লীলা করে থাকেন। সুষুম্না হল প্রধানা নাড়ি। তাঁর দুই পাশে ইড়া, পিঙ্গলা। রাধার অষ্টসখিকেও নাড়ির প্রতীকী অবয়ব দিয়েছি আমরা। ইড়া, পিঙ্গলাও তাহলে এই অষ্টসখিরই অন্তর্গত।

কৃষ্ণের যে কালীয়দমন তাঁকে তো আমরা কুণ্ডলিনীর পাশ খোলাও অনায়াসে ধরতে পারি। শিবের গলার সাপকেও একই অভিধায় রাখতে পারি। ত্রিশূল দিয়ে দুর্গা। অসুরকে বধ করেছিলেন। ত্রিশূলের ‘ত্রি’ কে যদি আমাদের সত্ত্ব, রজ, তমগুণ সব ভাবি তাহলে ত্রিশূল দিয়ে দুর্গা অপান বায়ুকে বধ করেছিলেন। প্রাণায়াম, যোগে একে তো বশীভূত করা, পরাস্ত করা একান্তই জরুরি। অসুরকে তো অপান বায়ুর প্রতীকময়তা আমরা আগেও দিয়েছি। কুণ্ডলিনী তো সাপের মতই পেচিয়ে থাকে। সমুদ্রমন্থনের গল্পটি যদি এ প্রসঙ্গে আমরা মনে করি তাহলে দেখব সমুদ্রকে মন্থন করা হচ্ছে সাপ দিয়েই। বাসুকি যার নাম ছিল। সমুদ্রকে যদি সাধকের স্থূল দেহ মনে করি তবে তাঁকে মন্থন করা হচ্ছে। আমাদের শরীরের যেসব ইন্দ্রিয় তা যদি সাধক মন্থন করে নেন তবে সেই মন্থনেও হলাহল ও অমৃত দুই-ই তো উঠবে। অমৃত হল সিদ্ধির দিব্যতা বা জ্ঞান আর হলাহল বা বিষ হল বশীভূত সত্তা। যার মোহ সাধককে কাটাতে হয়। কুলকুণ্ডলিনীকে সর্প আকার দিয়েছি। যোগে তা জাগলে রস ক্ষরণ হতে থাকে সব, যা মদ্যর নামান্তর (‘সোমধারা ক্ষরে যাতু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ বরাননে।‘) তাহলে দাঁড়াল এই–শরীররূপী সমুদ্রমন্থনেই। প্রতীককল্পের বিষ ও অমৃত উঠে আসছে সব। কুণ্ডলিনী বেঁকিয়েচুরিয়ে সর্পগতিতে হিস হিস ধ্বনিতে চক্ৰস্থ শক্তির দিব্যতা সাধক অমৃতস্বরূপ পান করছেন। আর তাঁর জন্যই তন্ত্রসাধক করছেন মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুনরূপী পঞ্চ ‘ম’ কারের সাধনা। বৈষ্ণবসাধকও ভিন্ন প্রতীকী অর্থে করেছেন একই সাধনা। বাউল সাধকও তাই করছেন। সকলেই ষড়রিপু, অষ্টপাশ, পঞ্চভূতকে নিয়ে দেহস্থ উপাচারে ব্রতী হচ্ছেন। আমরা সচ্চিদানন্দের কথা এর আগেও বলেছি। সৎকে নিউট্রন, চিৎকে প্রোটন ও আনন্দকে যদি ইলেক্ট্রন হিসাবে বিজ্ঞানের প্রতীকী অবয়ব পরিয়ে দেখি তাহলে দেখব এই সকল সৎ, চিৎ, আনন্দ শূন্যতার মধ্য থেকে বস্তুহীন প্রবাহে ধাক্কা খেতে খেতে পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুফেনা নিয়ে বিন্দু হিসাবে প্রতিভাত হচ্ছে। এই তিনভাগকে যদি ত্রিভঙ্গ হিসাবে ভাবি তাহলে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তিখানির যে ত্রিভঙ্গ মুরতি নাম তাঁর প্রতীকী অর্থময়তাও স্পষ্ট হবে। তিনের যোগফলে ত্রিভঙ্গ যা কিনা ধাক্কায়, আঘাতে বেঁকেচুরে যাচ্ছে। ত্রিভঙ্গর মানেও তো তাই, তিন অংশে বাঁকা। তাহলে দাঁড়ালো এই–সৎ শূন্যতা/ নিউট্রন + চিৎ/ শক্তিপ্রবাহ প্রোটন+ আনন্দ ভাঙাচোরা বস্তুফেনা/ ইলেকট্রন। এই তিনের একত্র সমন্বয় ত্রিভঙ্গ। নটবর বাউলের বলা কৃষ্ণবস্তুকে কি প্রতীকী ভাবনার বিচ্ছুরণ দিয়ে একেবারের জন্যও এভাবে ভাবা যেতে পারে না।

গানে রীতিমতো প্রশ্ন তোলা হয়েছে যেন–’কোন কৃষ্ণ হয় জগৎপতি।‘ উত্তরও তাঁর সাজানো–’মথুরার কৃষ্ণ নয় সে সে-কৃষ্ণ হয় প্রকৃতি।‘

বাউল বলেন শরীর হল গিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। এই বিশ্ব আমির স্বরূপকে নিয়ে সাকার হয়ে ওঠে বাউলের কাছে। আত্মতত্ত্ব ধরে থাকে আমি। হুল আমি যখন আস্তে আস্তে প্রবর্তস্তরে গিয়ে মেশে, গুরু হাল ধরেন। ত্রিকাল বিস্তৃত মহেশ্বরের মতোই গুরু আমির তীব্র মুহুর্তের এষণাকে জাগিয়ে দেন। বাউল তখন আমির স্বরূপকে চিনতে পারেন। আমি পঞ্চেন্দ্রিয় বাসনার থেকে মুক্ত হতে হতে, ষড়রিপুকে কম্পমান নক্ষত্রটুকুর আলোবিজ্ঞান পরাতে পরাতে, অষ্টপাশকে প্রসন্ন উন্মেষের কাছে নিয়ে যেতে যেতে ক্রমবর্ধমান আত্মসম্বিতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে। আর তখনই গুরু সাধক বাউলের আমিতে একশরীরী আকুলতার জন্ম দিতে ব্যাকুল হয়ে পড়েন। কীভাবে গুরু সাধক বাউলের আমিতে একশরীরী আকুলতার জন্ম দেন? সাধন দাস বৈরাগ্যকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

বলেছিলাম, বাউলের আত্মতত্ত্বের বিকাশ কীভাবে হয়?

বললেন, সহচরীর ভাবনায়।

বললাম, দেহসঙ্গী কীভাবে বাউলকে আত্মতত্ত্বের বিকাশ দিতে পারে?

–দেহ কী শুধু শরীর? দেহ আনন্দস্বরূপ চৈতন্য। যার নারী নেই, পুরুষ নেই।

–একশরীরী মতবাদের কথা বলছেন আপনি?

— যুগল সাধনা তো এক শরীরেরই। এই সাধনায় নারীই ইষ্ট। আবার নারে অন্বিষ্ট। কখনও কখনও অনিষ্টও বটে নারী। নারী গুরু। নারীই দেহ দিয়ে দুই দেহের আত্মসম্বিতকে। এক করে দেন। চণ্ডীদাসকে রামী যেভাবে পার করেছিলেন। বিল্বমঙ্গলকে চিন্তামণি। পদ্মাবতী পার করে দিয়েছিলেন জয়দেবকে। বাউলকে পার করেন তাঁর রাধারানি। রাধারানি মোহ কাটান। আবার তিনিই মোহগ্রস্ত করে দেন। তিনি যে টানেন। কৃষ্ণ যেভাবে। টেনেছিলেন তাঁকে। যুগল সাধনায় এই টানাটানির খেলাতেই যখন দুই দেহ এক হয়ে ওঠে তখনই সাধক তাঁর আত্মতত্ত্বের ব্রহ্মাণ্ডে শুক্রকে জমা করে অটল হয়ে যান। সাধনায় সিদ্ধ হন বাউল। রাধারানি তাঁকে পার করেন।

বলতে বলতে একতারা তুলে নিলেন সাধন। গাইতে লাগলেন। হাটগোবিন্দপুর আশ্রমে বিকেল যেন রাধা হয়ে আসন পাতল সাধনের গলা আর একতারায়।

ওই গোরা কি শুধুই গোরা।
আছে রাধা-রূপে রসান করা।।
তামাতে সোনা হল করিলে চিনে নেওয়া কি কঠিন বলে;
এমনি রাধার অঙ্গ,অঙ্গ পরশিলে তাইতো কালোরূপে গৌর রূপের পারা।
আহা মরি মরি, এ কি রে ভাব অন্য, অন্তরে কালো রূপ বাহিরে গৌরাঙ্গ;
গোরা পেয়েছিল ভালো ভাবিনীর সঙ্গ তাইতে রূপে রূপ ব্যেপে রেখেছে ধরা।।
গোরার ভাব বুঝিতে পারে কে এমন ছিল পুরুষ করল নারীর বেশ ধারণ,
গুরু অনুসারে কহিছে লালন, আছে শতদলে ভাব নিহারা।

নটবরের গানে আমরা কৃষ্ণকে প্রকৃতি হিসাবে পেয়েছিলাম। অর্থাৎ রাধা যেন। ধরে আছেন কৃষ্ণকে। চালিত করছেন। তাঁর সাধনাসম্পৃক্ত দেহ, দেহী সাধকের যুগলে সাধনবস্তুকে কৃষ্ণানুষঙ্গের পরিমণ্ডল দিচ্ছেন। পদকর্তা দুদ্দু বলছেন–’কৃষ্ণবস্তু নিগম ঘরে জীবদেহে বিরাজ করে/ রসিকের করণ সে কৃষ্ণ ধারণ করণ গম্ভীর অতি।‘ ‘কৃষ্ণ ধারণ’ বস্তুরক্ষা। আর এই বস্তুরক্ষা আত্মতত্ত্বকে না জানলে কখনও সম্ভব নয়। আত্মতত্ত্বতেই তো ইন্দ্রিয়ের আসক্তি নাশ হয়। কামেন্দ্রিয় প্রেমেন্দ্রিয়তে রূপ পায়। রূপের দরজা দিয়ে সোজা এগোলেই তখন প্রতিভাত হয় কৃষ্ণ, যিনি লালনের কথা অনুযায়ী রাধা-রূপে রসান করা।

ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে আছে–’কুম্ভকার বিনা-মৃত্তিকায় ঘট করিতে পারে না, স্বর্ণকার স্বর্ণ বিনা কুন্ডল গড়িতে পারে না। তেমনই আমি তোমা ব্যতীত সৃষ্টি করিতে পারি না। আমি যখন তোমা ব্যতিত থাকি, তখন লোকে আমাকে ‘কৃষ্ণ’ বলে, তোমার সহিত থাকিলে শ্রীকৃষ্ণ বলে…তুমি বিশ্বের মূল প্রকৃতি… এই বিশ্বের সমস্ত স্ত্রী তোমার কলাংশের অংশকলা যেমন দুগ্ধ ও ধবলতা, তেমনই যেখানে আমি, সেইখানে তুমি। আমি দীপ্তিমানদিগের মধ্যে সূর্য, তুমি সঙ্গে থাকিলে আমি দীপ্তিমান হই, তুমি না থাকিলে হই না।

দুদ্দু শাহের গানে যে ‘কৃষ্ণ প্রকৃতি’ সে কৃষ্ণ কৃষ্ণত্বের আমির ‘তোমা ব্যতীত’ থাকা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুযায়ী। আবার সাধন দাস বাউলের গানে যে কৃষ্ণরূপ দেখি–’ওই গোরা কি শুধুই গোরা। / আছে রাধা-রূপে রসান করা। এই রস ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুযায়ী ‘তোমার সহিত থাকিলে’র রসস্থ কৃষ্ণ।

রামকৃষ্ণদেব বলেছেন–’অনন্ত রাধার মায়া কহনে না যায়/ কোটি কৃষ্ণ কোটি রাম হয় যায় রয়।।‘ রাধার এই মায়াকে যদি কৃষ্ণ ও রামের রক্তমাংসে স্থাপনা করি তবে সাধনের গাওয়া লালনের গানটিই সামনে আসে–’এমনি রাধার অঙ্গ, অঙ্গ পরশিলে তাইতে কালো রূপে গৌর রূপের পারা।।‘ গৌর তো গৌরাঙ্গ স্বরূপ ঠিকই কিন্তু সেই গৌর ‘অনন্ত রাধার মায়া’ নিয়েই প্রতিভাত বাউলের কাছে। ‘রাধার মায়া’ বাউল সাধকের ‘রাধারানি’। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন–Radha was not of flesh and blood, Radha was froth in the ocean of love.’ রাধা রক্তমাংসের নয়, প্রেমসাগরের একটি বুদবুদ। বাউল সাধকের প্রেম দুদ্দু শাহের গানে বর্ণিত ‘আত্মতত্ত্ব’ জেনে ‘কৃষ্ণ-সেতু’ চিনে নেবার প্রেম। কৃষ্ণ-সেতু কৃষ্ণবস্তুর গৌরবী সমুজ্জ্বলতা। কৃষ্ণ মুখ্যত একটা প্রতীকী সাবয়ব নিয়ন্ত্রণের ধারা। যুগল সাধনায় এই নিয়ন্ত্রণ ইন্দ্রিয়ের সীমানাগুলোতে সচেতন অস্তিত্বের সহসা সঞ্চারণ যেন। অস্তিত্ব দেহসাধকের ‘আত্মতত্ত্ব’। যা কিনা ‘কৃষ্ণ সেতু’কে নির্ণয় করতে পারে। ঋগ্বেদে রাধা কথার অর্থ করা হয়েছে ধন বা ঐশ্বর্যের দেবী-রা-ধা, রয়িং বা রায়।

এই দেবীরূপ দেহস্থ চক্রের মধ্যস্থ বিভিন্ন শক্তির ভেতর দেহসাধক কল্পনা করেন। ডাকিনী, হাঁকিনী, লাকিনী ইত্যাদি নাম্নী শক্তিরূপের কথা আমরা বলেছি, যা কিনা চক্রপদ্মে অবস্থিত। ঋগ্বেদে রাধাকে যে ধন বা ঐশ্বর্যের দেবী বা অধিষ্ঠাত্রী হিসাবে দেখানো হয়েছে সেই ঐশ্বর্য কিন্তু দেহসাধক অনাহত পদ্মচক্রে ধ্যানে লাভ করে থাকেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে রাধাও পদ্মচক্রে অধিষ্ঠান করছে। নাড়ি জাগৃতিতে তাঁকে তো আমরা ইতিমধ্যে বিশিষ্টতার স্থান দিয়েই দিয়েছি। বাউল সাধক রাধাকে পদ্মচক্রে প্রতীকী করে রেখে কৃষ্ণকে জাগৃতি দিয়েছেন উৰ্দ্ধরেতাতে। কৃষ্ণ মদনমোহন কেন? কারণ তিনি কামকে মোহিত করে নিচ্ছেন। কামকে বশীভূত করে রাখছেন। আর এই কাম আসছে কোথা থেকে? আসছে কিন্তু সঙ্গিনীর শরীর থেকেই। তার জন্যই সাধক বাউল সঙ্গিনীর শরীরের কামকে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্ৰস্পর্শে একেবারে ভোঁতা করে দেন। সঙ্গিনীর কামকে বাউল সাধক ভোঁতা করেন। তাহলে দাঁড়ালো, রাধাই মদনমোহন। কারণ রাধার কামকেই বাউল ভোঁতা করে দিচ্ছেন কিন্তু। বাউলের পদে রাধা যে পদ্মচক্রে শরীরস্থ হয়ে রয়েছেন যে কথা তো বললামই। তেমনই একখানি গান ফটিক গোঁসাইয়ের–’আমার দয়া, ও দয়া কর। বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই। / রাধে গো রাধে প্রেমময়ী, তুমি মৌন ভাবে মনমোহিনী/ তুমি চতুর্দলে কুণ্ডলিনী তুমি স্বাধিষ্ঠানে নারায়ণী/ তুমি দশম দলে কালরূপিনী তুমি হৃদকমলে কমলিনী/ রাধে আমায় দয়া কর হে, রাধে গো।।/ তুমি বিশুদ্ধাখ্যে পঞ্চাননী, দ্বিদলে আনন্দরূপিনী/ সহস্রারে ব্রজবিলাসিনী, রাধে আমায় দয়া কর হে, রাধে গো।।‘

দয়াল খ্যাপা সাধন দাসের আস্তানাতে বসে যে গান আমাকে শুনিয়েছিলেন সেখানেও রাধা কিন্তু শরীরের পদ্মচক্রেই রয়েছেন আর কৃষ্ণকে পদকর্তা রসাকার করেছেন। অর্থাৎ শুক্ররক্ষার চিহ্নস্বরূপ কৃষ্ণ দাঁড়িয়ে আছেন সাধক রাধার শরীরস্থ পদ্মচক্রগুলোকে–’প্রেম সুখদ্বার কৃষ্ণ রসাকার রসনাতে তার কর আস্বাদন/ সে যে যোগাযোগ-স্থলে মৃণাল পথে চলে/ সহজ কমলে সুধা বরিষণ।

কৃষ্ণের চলাচলকে ‘মৃণাল পথ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন পদকর্তা হাউড়ে গোঁসাই। মৃণাল পদ্ম। তাহলে দেখা যাচ্ছে কৃষ্ণপথ পদ্মচক্রেরই পথ। কৃষ্ণবস্তুর রসনা আস্বাদন এই পথেই সম্ভবপর। ‘কৃষ্ণ রসাকার’ বলবার কারণ কৃষ্ণ হল শুক্রবস্তু। রজকেও বাউল রস বলেন। মূত্রও তাঁর কাছে রস। শরীরস্থ পদার্থ বাউল শরীরেই ফিরিয়ে নেন। তিন রস শরীরস্থ পদার্থই। বাউল সাধক শুক্ররস ব্রহ্মরতে উঠিয়ে নিতে পারেন। মূত্রও শিক্ষা দীক্ষার সময় পান করে শরীরে ফিরিয়ে নেন তিনি। তবে বাউল সঙ্গিনী রজ পান করেন বলে কোনোদিন শুনিনি। সঙ্গিনী মূত্র ও মলও শরীরে ফিরিয়ে নেন না। এ কার্য কেবল বাউল সাধকেরই। সঙ্গিনীর নয়। যুগল মিলনকে, সম্ভোগকে বাউল বলেন ‘অপ্রাকৃত মিলন’। তাঁদের মতো শরীরে শরীরে মিলন হয় না, মিলন হয় আত্মায় আত্মায়। আত্মার। সঙ্গেই আত্মার রমণ চলে। এভাবেই প্রাকৃত দেহ ভাবদেহ হয়ে ওঠে। এই দেহস্থ মিলনের অপার মহিমা কেবল রসিক হলেই জানা যায়। রসিক হল রসধারণকারী মানুষ। বীর্যরক্ষার মানুষ। কৃষ্ণ সাধনের মানুষ।

মৃণাল-পথে কৃষ্ণ-যোগাযোগ কীভাবে হয় বাউল সাধকের? সাধক বলেন অন্ত্রে বায়ুর প্রকোপ কমিয়ে এনে দেহকে সর্বপ্রথমে হালকা করতে হয়। দেহের মধ্যে বায়ু উনপঞ্চাশের প্রধান পাঁচটি নিয়ে সাধক শুরু করে দেন দেহসাধনা।

পাঁচ গুরুত্বপূর্ণ বায়ুর(প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান, উদান) প্রধান দুই বায়ুর (প্রাণ, অপান) যে শ্বাসক্রিয়া তা চলে আবার শরীরের প্রধানা তিন নাড়িকে ঘিরেই। ইড়াতে চলতে থাকে প্রাণ বায়ুর ক্রিয়া। অপান বায়ুর ক্রিয়া হয় পিঙ্গলাতে। শ্বাস যখন নেওয়া হয় তখন প্রাণ বায়ু অপান বায়ুকে টেনে একেবারে নীচের দিকে নামিয়ে দেয়। শ্বাস ছাড়ার সময় প্রাণ বায়ু অপান বায়ুকে উপরে উঠিয়ে দেয়। শ্বাস উপরে ওঠাকে আমরা বলতে পারি চেতনার বিকাশ। প্রাণ বায়ু থাকে হৃদয়দেশে। অপান বায়ু গুহ্যদেশে। সাধক প্রাণ বায়ুকে ‘রা’ বলেন আর ‘ধা’ হল অপান বায়ু। দিনরাত আমাদের শরীরে দুই বায়ুর খেলা চলছে। সদানন্দ বাবাজি আমাকে বলেছিলেন, কৃষ্ণের লীলা হয় গো শরীরে। রাধার সঙ্গে খেলে।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কৃষ্ণপ্রাপ্তি কীভাবে হয়?

বললেন, কৃষ্ণ হল গিয়ে আত্মসাক্ষাৎকার। তা হয় কুম্ভকে।

বললাম, কীভাবে হয় তা?

–তা বাবা এ তো বলে বোঝানো যাবে না। এ যেন করণক্রিয়া।

বাবাজি হাসলেন। আমি তাঁর হাসির রেখায় যেন দেখলাম আত্মসাক্ষাৎকারের প্রতিবিম্ব সব জড় হচ্ছে।

— শরীরে সব সময় রাধা নাম চলে।

শ্রীপাঠের বৃদ্ধা বৈষ্ণবী আমাকে বলেছিলেন।

–কীভাবে চলে?

–অভিমান, অভিসারে। এই অথর্ব শরীর এখনও অভিসারে যে বের হয়। তাঁর জন্যই তো অসুস্থতাতেও বেঁচে থাকা বাঁচার ইচ্ছা।

বৈষ্ণবীয় ‘অভিমান’ ‘অভিসার’কে আমরা যদি সংগ্রাম ধরি তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে আরও কীসের এই সংগ্রাম? না হয় সহজিয়া মত নিয়ে প্রেম সংগ্রামই আমরা ধরলাম।

সাধক বলেন জীবাত্মা বিস্তৃতপ্রায় হয়ে এলেই তবে পরমাত্মার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। আসলে যেটা হয়, প্রাণ বায়ু অপান বায়ুকে কাছে টানে। ভাবি যদি প্রতীককল্পে তবে দাঁড়ায় এই : ‘রা’ টানছে ‘ধা’ কে। রাধাকে উল্টোলে হয় ধারা। অর্থাৎ অব্যাহত। এই টানাটানি সব সময় চলে। এই টানকে বৃদ্ধা বৈষ্ণবীর বিশ্বাসের বা প্রতীকী কল্পনার অভিমান, অভিসারও ধরা যেতেই পারে। টানার এই অভিমানে, অভিসারে যেটা হয় তা হল–এক সময় যোগে অপান বায়ুর পরাজয় ঘটে। প্রেম সংগ্রামে অপান বায়ু নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। প্রাণ বায়ু বিজয় লাভ করে। অপান বায়ু না থাকায় তখন ক্রিয়া চালানোর ক্ষমতা থাকে না সাধকের। শ্বাস প্রশ্বাস ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় দেহসাধকের। এই দশাকে সাধকরা বলেন কুম্ভক। কুম্ভকে জলপূর্ণ কলসির ন্যায় বায়ু ধারণ করে রাখা হয় শরীরে। সাধক এখানে শ্বাস প্রশ্বাসের ক্রিয়া বন্ধ করে দিয়ে কুম্ভকের মতই পূর্ণ হয়ে ওঠেন অতীন্দ্রিয় তরঙ্গে। সদানন্দ বাবাজি একেই বলছেন কৃষ্ণ। আত্মসাক্ষাৎকার। সাধক এই দশাকে হংস বলে থাকেন। হং হল শ্বাস, স হল প্রশ্বাস।

‘হংকারো নির্গমে প্রোক্তঃ সকারন্তু প্রবেশনে। / হংকারঃ শিবরূপেণ সকারঃ শক্তিরুচ্যতে।।’ শ্বাস পরিত্যাগ করে যদি আর গ্রহণ না করা হয় তবে তাঁকে মৃত্যু বলে। হং হল শিবস্বরূপ বা মৃত্যু। স হল গ্রহণ বা শক্তির স্বরূপ। ক্রিয়াযোগ বন্ধ মানেই সাধক জীবাত্মার খোলস ফেলে দিয়ে পরমাত্মাকে লাভ করে ফেললেন যোগবলে। না হলে শ্বাস প্রশ্বাসই তো জীবত্বের দশা। হংসই জীবের দশা। তা থেকে সরে এলে সাধক হয়ে ওঠেন। পরমহংস।

বাউল সাধকও শ্বাসক্রিয়াতেই ‘সহজ কমল’ লাভ করেন। তার সুধা অনুভব করতে পারেন। পদকর্তা তাই বলেছেন–’সর্ব ঘটে বটে পটে পট্ট স্থিতি / শক্তিতত্ত্ব গুণে আনন্দ মুরতি।‘ ‘সর্ব ঘট’ দেহের চক্ৰন্থ অধ্যায় সব। যে অধ্যায়তেই বায়ুক্রিয়ায় যুগল মিলনে ‘শৃঙ্গার আকার’ সাধারণ জনের না ধরতে পারার কথা বলা হয়েছে গানে। পদকর্তা বলেছেন ‘ইন্দু বিন্দু গতি সদা বিরাজয়। / জীবে নাহি জানে সাধুসন্ত চেনে/ রসপানে জানে তারা অমৃত-সেবন।’

ইন্দু হল চাঁদ। যার সাধনা ‘বি’র জন্যই সাধনা। বিন্দু শুক্র। বাউল বলেন বিন্দু সাধনায় আত্মশক্তির দর্শন হয়ে যায়। হাউড়ে গোঁসাইও সে কথা শুনিয়েছেন।

শ্রীমদ্ভগবদগীতাতে আমরা দেখি শ্রীভগবান বলছেন–’রজোগুণসমুদ্ভবঃ এষঃ কামঃ এষঃ ক্রোধঃ মহাশনঃ মহাপাপমা ইহ এন বৈরিণম্ বিদ্ধি। রজগুণ থেকেই কাম উৎপন্ন হয়ে ক্রোধে পরিণত হয়। যাকে সব সময় শত্রু বলে জানবে। তৃষ্ণা ও আসক্তি থেকে আসে রজগুণ। রজগুণের এই আসক্তি থেকেই আসে কামনা। দেহসাধকের সাধনা কামনার কামকে প্রেমে রূপান্তরিত করে নেওয়া। আর তা হলেই কৃষ্ণপ্রাপ্তি। ‘আত্মশক্তির দর্শন’। অষ্টপাশ নাশ, ষড়রিপু দমন, চন্দ্ৰসাধন–এসবের মহদ্য দিয়ে কাম প্রেম হয়। ‘অষ্টপাশ’ কিন্তু প্রতীকী কৃষ্ণরূপ। এরকম ভাবতেই পারি আমরা। বাউল অষ্টমচন্দ্রের কথাও বলেন। সবই তাঁদের যদি কৃষ্ণবস্তু রক্ষার সাধনা হয় তাহলে তাঁদের ‘অষ্ট’তেও কিন্তু কৃষ্ণ বিরাজমান। কৃষ্ণ দেবকীর অষ্টম গর্ভেরই সন্তান। বাউলের কৃষ্ণ প্রতীকের বহিষ্কৃতি যেহেতু, তাই ‘প্রতীকের আট’ও সদর্থক অর্থেই কৃষ্ণসূচক। কৃষ্ণ আস্তিকতায় স্থৈর্য কৃষ্ণ চিত্তস্থৈর্যের ঈষৎ উচ্চাবচতা।

মনোহর খ্যাপার আশ্রমে একবার অজিত দাস বাউলের গলায় শুনেছিলাম এরকমই এক অতিক্রমের গান। গুরুপূর্ণিমা ছিল সেদিন। ভক্তশিষ্যরা অনেকেই এসেছিলেন। আশ্রমে থই থই করছে লোক। রোজকার ফাঁকা আশ্রম আর নেই। শ্রাবণের দু’এক পশলা লেগেছে হাওয়ায় বেশ কয়েকদিন ধরা বৃষ্টির পর এদিনই যেন মাঝ দুপুরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। সন্ধ্যেয় বেদনাশা বটের পাতায় খিলখিলিয়ে উঠছে সিক্ত হাওয়া। ভরা অজয়েও যেন দোলা লেগেছে। বিকেলে ফুরফুর করে জলের স্রোত এসে লেগেছিল। আশ্রম বেষ্টনীর পাঁচিলে। হাওয়ায় জলের গন্ধ। রাধাকৃষ্ণের মতোই দুলে উঠছে বেদনাশার পাতা। জ্যোৎস্না পড়ে চিক চিক করছে জলে ভেজা পরিষ্কার পাতা। বাউল গাইছেন নিবিষ্ট মনে। ভক্তশিষ্য থ মেরে বসে আছেন গানের সামনে। এমনই পরিবেশের সম্মোহন। খ্যাপার গান গিয়ে ধাক্কা মারছে নির্জন আশ্রমের চরাচরে রাধাকৃষ্ণের শূন্য অখণ্ডতায়।

বাউল গাইছেন–

অকৈতব গাছের লতায় পাতায় রাধা-কৃষ্ণ দোলে
পাতা নয়, শ্রীগোবিন্দ, লতা নয় সে প্রাণবন্ধু
ইন্দু বিন্দু এক দোলায় দোলে।
(ক্ষ্যাপা) সেই অপ্রাকৃত মদনমোহন।
কৈতবেতে না যায় লিখন।।
(রাধা) শ্যাম দোলে (ক্ষ্যাপা) ওই দ্বিদলে,
অকৈতব গাছের লতায় পাতায় রাধা-কৃষ্ণ ঝুলে
পাতা নয়, শ্রীগোবিন্দ, লতা নয় সে প্রাণবন্ধু
ইন্দু বিন্দু এক দোলায় দোলে।
সেই অপ্রাকৃত মদনমোহন
কৈতবেতে না যায় লিখন।।
(রাধা) শ্যাম দোলে
(ক্ষ্যাপা) ওই দ্বিদলে
গোঁসাই পূৰ্ণানন্দ ভনে,
দোলার কথা কেই বা জানে।
গোলকপতি আপন মনে
(ক্ষ্যাপা), এক দোলায়, আজ দুজন দোলে।।
অকৈতব গাছের লতায় পাতায় রাধা কৃষ্ণ দোলে
পাতা নয়, শ্রীগোবিন্দ, লতা নয় সে প্রাণবন্ধু,
ইন্দু বিন্দু এক দোলায় দোলে।
(ক্ষ্যাপা) সেই অপ্রাকৃত মদনমোহন।
কৈতবেতে না যায় লিখন।।
(রাধা) শ্যাম দোলে
(ক্ষ্যাপা) ওই দ্বিতলে।।

‘অকৈতব গাছ’ এখানে ছলনা কপটতাহীন সাধক ও তাঁর সাধন সঙ্গিনীর যুগল শরীর। গাছের লতায় পাতায় রাধাকৃষ্ণ দুলছে। মনে হচ্ছে যুগল শরীরের সমস্ত প্রত্যঙ্গগুলোতে অপার্থিব হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। কেননা দুই শরীর স্থূল দেহকে অতিক্রম করে চলে গেছে সাধনের সিদ্ধতায়। যার জন্য ইন্দু বিন্দু এক দোলাতে দুলে যাচ্ছে। ইন্দু হচ্ছে চাঁদ আর কি কৃষ্ণবস্তু। সাধক বাউল ইন্দুরই সহায়তায় বিন্দুধারণ করে জাগতিকতার উর্ধ্বে উঠে গেছেন, সাধন সঙ্গিনীর সঙ্গে তাঁর মিলন এখন রাধাকৃষ্ণেরই মিলন। রাধাকে প্রকৃতিও বলেন। প্রকৃতি হল তাঁর সঙ্গিনী প্রকৃতির সাহায্যে সাধক বাউল কৃষ্ণবস্তুকে নিগম করে নিয়েছেন। সাধক আর সঙ্গিনী দুলছেন দ্বিদলে। ভ্রদ্বয়ে আজ্ঞাচক্রে দ্বিদল পদ্মের অবস্থান। আজ্ঞাপদ্ম দুই দলের। বাউল সাধক হৃদ্বয়ের মিলনস্থলকে আরশিনগরও বলে থাকেন। বহুশ্রুত লালনের গানে আমরা এর উল্লেখ পাই–’আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে/ আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর/ ও এক পড়শি বসত করে।‘ বাউল বিশ্বাস রাখেন আজ্ঞাচক্রেই পড়শি বা উপাস্য থাকে। বাউলের উপাস্য হল বীর্য। যার সাধনক্রিয়ায় বাউল অটল হয়ে যান। বাউল কামকে ধ্বংস করেন। কামের বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ করা সেজন্যই তাঁর প্রধান সাধনা। ভীষ্মর ইচ্ছামৃত্যুর মতো কামকে বাউল ইচ্ছাকামের মধ্য দিয়ে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে রাখেন বস্তু সাধনাতেই। ভীষ্মর যে শরশয্যা–এই শরশয্যাকে আমরা কল্পনা করতে পারি সংসারের সঙ্গে। সংসার শরশয্যা। অর্থাৎ সাধক সংসারের মায়ারিপুতে যাতে না বশীভূত হয়ে পড়েন তাঁরই প্রতীকীরূপ ভীষ্মর শরশয্যা। ভীষ্ম ত্যাগ তিতিক্ষার উর্ধ্বে উঠতে চেয়েছিলেন। প্রতিজ্ঞা পর্যন্ত করেছিলেন ব্রহ্মচর্য পালনের। মহানুভবতার পরিচয় দিতে গিয়েও ব্রহ্মচর্যের নাগপাশে তিনি আটকে থাকলেও তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল মায়া। শুধু কি মায়া? আড়ালে থেকেও রাজ্যের পুরোধা হবার বিশেষ বাসনা তাঁর কি একেবারেই ছিল না? ছিলই। না থাকলে তিনি ত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে বেড়িয়ে পড়তেন। আর তা পারেননি বলেই ভীষ্ম শেষপর্যন্ত শরশয্যায় বিদ্ধ হয়ে পড়ে রইলেন গৃহ থেকে দূরে কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে। ভীষ্মর এই শর যোজনার উপাখ্যান রিপু বশ্যতার উপাখ্যানই। যার থেকে সাধককে দূরে থাকতে হয়। বাউলের সাধনা শরীর থেকে কামের বন্ধন টেনে ছিঁড়ে কামকে নির্মূল করে দেওয়া। যার জন্যই তাঁর বস্তুরক্ষার প্রশ্ন। বাউলের সাধনাতে জন্মনিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যকে প্রসারিত করারই সাধনা। যদিও এ নিয়ে এখন প্রবল মতান্তর আছে। এক শ্ৰেণী বলছেন সাধক বাউলের যদি সন্তান না আসবে তবে আসল বাউল কী করে জন্মাবে? তবে বীর্য সাধনার মূল বিষয় নিয়ন্ত্রণেরই সাধনা। সৃষ্টির আদিবীজকে তাঁরা দেহ ব্রহ্মাণ্ডের সক্রিয় যোগশক্তির ভেতর ভ্রমণশীল বিচরণক্ষেত্র করে নিতে পারেন। এতেই তাঁদের সিদ্ধ স্তরের যে প্রবর্তনা তা প্রতিপন্ন হতে থাকে। আজ্ঞাচক্রে দ্বিদল যেমন থাকে তেমনই থাকে পদ্মের উপরে ইড়া,পিঙ্গলা, সুষুম্নার মিলনস্থল। বাউল একে ‘তিনরতি’ও বলে থাকেন। এই রতিকেই মতি দেন তাঁরা। আজ্ঞাপদ্মকে জ্ঞানপদ্মও বলে থাকেন সাধক। পরমাত্মা এর অধিষ্ঠাতা। জীবাত্মার বিনাশ হলে তবেই সাধক পরমাত্মার কাছাকাছি যেতে পারেন। বাউল সাধক অকৈতব মিলনে সেই স্তরে বিচরণ শুরু করে দেন। কেননা বিন্দুধারণে তাঁর উপাস্য, পড়শি বা কৃষ্ণবস্তু পরমাত্মার সংবর্ধনাকে গহন বৈভব দিয়ে দেয়। যার ফলে সিদ্ধ হয়ে ওঠেন সাধক। মদনমোহনও অপ্রাকৃত হয়ে এক দোলায় দুলতে থাকে। মদনমোহন কামজয়কারী মানুষ। অটল মানুষ। দ্বিদলে বা দ্বিতলে তখন রাধাকৃষ্ণ দোলে। অর্থাৎ প্রকৃতি ও পুরুষ এক হয়ে ওঠে। কে পুরুষ আর কে বা প্রকৃতি সেই বাহ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। আমরা যে দশ অবতারের কথা বলে থাকি সেও কিন্তু আমাদের বাহ্যতা নাশেরই প্রতীকস্বরূপ।

মত্স্য হল আমাদের প্রথম অবতার। মৎস’র সঙ্গে জল সংযুক্ত। মানুষের জ্ঞান সমুদ্রকেই মৎস্য অবতার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল তখন। দ্বিতীয় অবতার কুর্ম উভচর প্রাণী। মানুষের মানসিক অবস্থাও অনেকটাই কুর্মের মতো। কুর্ম জলে ও ডাঙ্গায় দু’জায়গাতেই থাকতে পারে। সমুদ্রকে জ্ঞান স্বরূপ হিসাবে আমরা ভেবেছি। ডাঙাকে ব্যক্তিস্বরূপ হিসাবে ভাবি যদি তাহলে দাঁড়ায় মানুষ জ্ঞানসমুদ্র ও ব্যক্তিস্বরূপ থেকে অর্জিত চেতনার মধ্যে বিচরণ করতে পারে। তৃতীয় অবতার বরাহ। জলে থাকে না সে। ডাঙ্গা তার বাসযোগ্য জমি–তবে বরাহ প্রয়োজনে সাঁতারও দিতে পারে। মানুষ। ব্যক্তিস্বরূপকে জেনে চিনে বুঝে সেখানেই কেবল আবদ্ধ হয়ে থাকে না নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চায়। তাই তাঁর জ্ঞানসমুদ্রও উথলে ওঠে। এর পরের অবতার নৃসিংহ। অর্থাৎ সিংহের মাথা, শরীরটা মানুষের। মানুষের ভেতর যে পশুচেতনাও মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠে এই অবতার তাকেই চিনতে সাহায্য করে প্রতীকী আলোকসম্পাতে। পঞ্চম অবতার বামন। ক্ষুদ্রতা, নীচতার প্রকাশকে যা চিহ্নিত করে। পরশুরাম পূর্ণ মানবসত্তার বিকাশপথটির। সূচনা। তাই রামের আগে পশুর বন্যতা লাগিয়ে নেওয়া হয়েছে। সপ্তম অবতার রাম। পশুত্বের মুক্ত চেতনা থেকে উদ্ভূত তাঁর রূপ। অষ্টম অবতার বলরাম। অর্থ হল হলধর। যা দাঁড়ায়, মানুষের সেই জ্ঞান সমুদ্রকেই আরও কর্ষণ। নবম অবতার বুদ্ধ। সংসারের মায়াপাশ ফেলে রেখে সাধনার নির্জন খুঁজে বোধি লাভ করার প্রতীককল্প। দশম অবতার কল্কি অর্থাৎ নিষ্কলঙ্ক হয়ে ওঠা। দশ অবতার এভাবেই আমাদের চেতনার পটভূমিকে তৈরি করে দেয়। যে চেতনার জোরেই বাউল সাধক অকৈতব গাছের লতায় পাতায় দুলতে পারেন। পুরুষ ও প্রকৃতির কম্পনকেও ঠিক রাখতে পারেন বিশ্বনৃত্যের একাত্মতায়।

বাউল সাধক পরমাত্মার স্বরূপ আস্বাদন করেন দু’জনের একত্র সাধনায়। বাউল বলেন নিজেকে নিজে আস্বাদন করা যায় না। সঙ্গিনীর ভেতর দিয়েই নিজেকে চেনা যায়। স্বরূপ বেড়িয়ে পড়ে তখন।

শশাঙ্কশেখরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম একবার, সঙ্গিনীর ভেতর দিয়ে কীভাবে নিজেকে চিনতে পারেন বাউল?

বললেন, শিক্ষা-দীক্ষাই তো বাউলকে সঙ্গিনীর ভেতর নিজেকে চিনতে সাহায্য করে।

–কীভাবে হয় শিক্ষা-দীক্ষা?

–সে অনেক কথা বাবা। ব্রহ্মচর্যের শুরু হয় শিক্ষা-দীক্ষায়। তখনই তিন রস শরীর থেকে ধরে শরীরে ঢুকিয়ে নিতে হয়। মূত্র যতবার হবে নারকেল মালাতে ধরে খেতে হবে।

–খেতে পারেন কি সবাই?

— না পারলে চলবে? ঘেন্নাকে মন থেকে না তুলতে পারলে কিছুই হবে না। পাশ, রিপু সব মূত্র গেলার মতোই খেতে হবে। খেতে খেতে মূত্রকে এক সময় মনে হবে অমৃতধারা। মল হবে মাখন। সঙ্গিনীর রজ হবে সদ্য দোয়ানো ঘন গরম দুধ।

–তারপর?

জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

বাউল বললেন, তারপর ব্রহ্মচর্য ভাঙা যুগল সাধনায়। ভাঙতে ভাঙতে নিজেকে আবার গড়েপিঠে নেওয়া। এ এত সহজ নয় বাবা। আসন আসন সিদ্ধাসন। শ্বাস ভেঙে শ্বাস নিয়ে শ্বাস ছেড়ে দু’জনকে দু’জনের মধ্যে গড়তে হয়। ভাঙতে গড়তেই রাধাকৃষ্ণের স্বরূপ বেড়িয়ে পড়ে।

সন্ধ্যা ঢলে এসেছে তখন। মজলিশপুরের আশ্রমে ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। যুগলের ঘন্টা ছড়িয়ে যাচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায়। অল্পলোয় ভেসে উঠছে রাধাকৃষ্ণের মুখ। শশাঙ্কশেখর তাঁকেই যেন উসকে তুলেছিলেন সেদিন। বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মানুষ তিনি। বাউলের ভাব পরে তিনিও একদিন মেতেছিলেন যুগল সাধনায়। আজ তাঁর ছেলে আছে আর আছে ছড়ানো ভক্তশিষ্য। দ্বিধারা স্রোত নিয়ে তিনি যেন একাই এই বৃদ্ধ বয়সে যুগল হয়ে বসে আছেন। সেদিন তাঁকে দেখে যেন তেমনই আমার মনে হচ্ছিল।

*****

যুগলকিশোরের মেলায় গোপাল দাস বাউলের মুখে শুনেছিলাম যে গান, তা শোনানোর আগে তিনি বলেছিলেন, কৃষ্ণের দরজায় এসেছেন আর নাড়া খাবেন না তা কী হয়!

–কীভাবে নাড়া খাব বলুন তো?

বাউল বললেন, কীভাবে আবার? সুরে নড়িয়ে দেব আমি। সুরে কৃষ্ণ শরীর ধারণ করবেন যে!তার বাঁশি যে সদর্থক বাঁশি। বাজলেই শরীর ধারণ বাঁশি আর কী বলুন, বাঁশি তো হল গিয়ে আমাদের মগ্ন চৈতন্য।

একতারা বাজাতে আরম্ভ করলেন বাউল। ভরদুপুরে তাঁর ভাত পেটে পড়েনি তখনও।

বললেন, কৃষ্ণকে খাইয়ে তবেই খেতে যাব আজ। যখন তুললেন ও কথা। আপনার সেবা হয়েছে তো?

ঘাড় নাড়লাম আমি। বাউল গাইতে লাগলেন।

কৃষ্ণ অনুরাগের বাগানে, আমার মন যাবি রে ভ্রমণে
প্রাণ জুড়াবে মন্দ মন্দ আনন্দ সমীরণে।
সেথা নিত্য ফুটে পাঁচ রকমের ফুল
যার সৌরভে প্রাণ মুগ্ধ করে গৌরবে অতুল,
আত্মারামের আত্মা ব্যাকুল, করেছে যার আঘ্রাণে।।
সেই বাগানে আছে দুই মালি
তাঁদের মধ্যে একজন উড়ে একজন বাঙালি
তাঁরা বাগান ছিঁড়েখুঁড়ে নাড়েচারে গাছ বাড়ে তাঁদের যতনে।।
আছে সেই বাগানের চার দিকে বেড়া
আছে আশমানে খাড়া ও তার মেলে না গোড়া।
সেথা শিব ব্রহ্মা আছে খাড়া প্রবেশ করবার সন্ধানে।।
তাঁর মধ্যে সরসী, সুধাতুল্য জলরাশি
সেই স্বচ্ছ জলে সদা খেলে হংস আর হংসী।
কোটি জন্মের পিপাসা যার তার বিন্দু মাত্র জলপানে।।
সেই বাগানে ফলে মেওয়াফল, তাঁর কাছে তুচ্ছ চারি ফল
সে ফল যে পেয়েছে যে খেয়েছে হয়েছে পাগল।
তার জন্ম সফল কর্ম সফল, সেই ফলের নাম সেই জানে।।
বাগানের অতি মনোেহর শোভা মনোহরের মনোলোভা
সাধুমুখে শুনেছি তার নাম সুদর্লভা।
সেথা নাই রাত্রিদিবা প্রভা পায় আপন গুণে।।
গোঁসাই তাই ভাবছেন অন্তরে,
শোন অনন্ত রে সেই বাগান আছে কোটি জন্মের অন্তরে।
সেথা যাবি যদি স্বকাম নদী পার হবি তার কেমনে।।

‘কৃষ্ণ অনুরাগের বাগান’ দেহসাধকের স্থূল শরীর। গুরু প্রদর্শিত পথে সেই স্থূলতাই প্রবর্ত হয়ে উঠবে আর তখনই কৃষ্ণ অনুরাগের বাগানকে টের পেতে শুরু করে দেবেন সাধক বাউল। প্রবর্ত ছাড়িয়ে সাধক স্তরে এলেই তিনি বাগানের ‘পাঁচ রকমের ফুলকে’ দেখতেও পাবেন। সাধক দেখবেন শরীরের পাঁচ চক্রপদে পাঁচ ফুল ফুটে গিয়ে শোভা ছড়াচ্ছে। সৌন্দর্য দান করছে। সেই শোভা, সৌন্দর্য সবই কৃষ্ণ অনুরাগের কারণেই। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম–এই পাঁচ ফুলের শোভা সাধক বুঝে যাবেন। তাঁর সৌরভে মুগ্ধও হবেন।

বলা হয়ে থাকে স্কুল সাধনার পরই জ্ঞানযোগ হয়ে থাকে। স্থূলতাকে অতিক্রম করার জন্যই মূর্তি, প্রতীক–লিঙ্গ বা শালগ্রাম, দেবদেবীর ছবি ইত্যাদির সাহায্য নেওয়া হয়ে থাকে। এর সঙ্গে সশব্দে মন্ত্র উচ্চারণ করার কথাও বলা হয়ে থাকে।

বাউলে এই সব উপাচার নেই। বাউল ভুল শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন যোগে। তন্ত্রসাধকের একই পথ। স্থূল শরীরকে নিয়ন্ত্রণের জন্য যে যোগ, তাঁর নাম হল গিয়ে হঠযোগ। স্থূল শরীর সূক্ষ্ম শরীরের সঙ্গে যুক্ত। স্থূল শরীরের ভেতরই তো থাকে শরীরের যাবতীয় সূক্ষ্মতা। সূক্ষ্ম স্তরে দেহের কোষগুলো সব তরবারির মতো খুলে যায়। সাধক বলেন সূক্ষ্ম শরীরে রয়েছে বুদ্ধি, ভাব, লোভ, কামনা, বাসনা ইত্যাদি। স্থূল শরীরের স্তর পেরোনোর পর যে সূক্ষ্ম শরীরের কথা বললাম সেখানের কোষগুলো পাঁচটি স্তরে সাজানো। এখানে পাঁচ চক্রের কল্পনাকে আমরা সামনে আনতেই পারি। পাঁচটি কোষ পার হবার পর ষষ্ঠে এসে পৌঁছলে সাধক বলে থাকেন নতুন জন্মান্তরে তিনি এসে পৌঁছেছেন। হঠযোগে এই স্তর পেরিয়ে আসেন সাধক। ষষ্ঠের জন্মান্তরের সঙ্গে ষটচক্রভেদের বোধহয় কোনো সম্বন্ধ আছে। তাই তন্ত্রে হঠযোগের বিধিব্যবস্থা। চক্রভেদ মানে একেকটি কোষকে অতিক্রম। বাউল সাধকও ষড়রিপু বা ষটচক্রকে ছয়েরই ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন। যেমন প্রচলিত এক গানের ভেতরও পাই সেই ছয়েরই ইঙ্গিত–’মন পাখি বিবাগী হয়ে ঘুরে মোর না/ ভবে আসা যাওয়ার কি যন্ত্রণা/ তাও কি জান না। / পাখির আছে দশ ইন্দ্রিয় / রিপু আছে ছয় জনা।’ হঠযোগে শরীরের মধ্যস্থ প্রাণ বায়ুকে টানে অপান বায়ু। প্রাণ বায়ু থাকে গিয়ে হৃদপিণ্ডে। সে অপান বায়ুকে ঠেলে তুলে দেয় হৃদপিণ্ডে। মূলাধার চক্র থেকে এসে অপান বায়ু মিশে যায় প্রাণে যোগশাস্ত্র হঠযোগের পদ্ধতিকে সাত ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। প্রথম ভাগ শোধন। ছটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে এখানে শরীর পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা হয়। দ্বিতীয় ভাগ দৃঢ়তা। এক্ষেত্রে আসন দ্বারা শক্তি সঞ্চয় করা হয়। তৃতীয় ভাগ হল গিয়ে স্থিরতা। বিভিন্ন মুদ্রা দ্বারা স্থৈর্য অর্জন করা আর কী। চতুর্থ ভাগ ধৈর্য। ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পঞ্চম ভাগ লাঘব। প্রাণায়ামে হাল্কাবোধ। ষষ্ঠ ভাগ ধ্যান। যা মনঃসংযোগেরই অংশবিশেষ। সপ্তম ভাগ হল গিয়ে নির্লিপ্ততা। বহির্বিশ্ব থেকে আত্মাকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। ষটচক্র দ্বারা দেহশুদ্ধির কথাও বলেন সাধক। এই শুদ্ধতা আসে। ধৌতিতে। অন্তর ধৌতি। বায়ুর সাহায্যে হৃদয় পরিষ্কার। দন্ত ধৌতি, দাঁত, জিভ, কান ইত্যাদি পরিষ্কারকরণ। হৃদ ধৌতি। কফ, পিত্ত, মল ইত্যাদির নিষ্কাশন। ধৌতির পর ষটকর্মে আসে বস্তিযোগীপুরুষ উৎকটাসনে বসে গিয়ে নাভি পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে রাখেন। এতে সিক্ততা আসে। শুষ্কতা চলে যায় সব প্রাণায়ামে। বিশেষত কপালভাতিতে। তিন রকম কপালভাতি করে থাকেন দেহসাধক। শ্বাস নেওয়া ও শ্বাস ছাড়া, নাকদিয়ে জল নিয়ে মুখ দিয়ে বের করে দেওয়া, মুখ দিয়ে জল টেনে নাক দিয়ে বের করে দেওয়া। এরপর হঠযোগে বসেন সাধক। তন্ত্রসাধক এখানে আরও কিছু আসন সারেন। সেগুলো হল মুণ্ডাসন, চিতাসন আর শবাসন। মুণ্ডের সন্নিবেশ নিয়ে তৈরি আসন মুণ্ডাসন। চিতায় বসে চিতাসন আর শবের উপর বসে শবাসন। হঠযোগের পর মুদ্রার সাহায্য নেন দেহসাধক। এও এক ষটচক্রের দেহশুদ্ধি। অগ্নির দাহিকা, জলের সিক্ততা, বায়ুর প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে পারে মুদ্রাভঙ্গি। অশ্বিনী মুদ্রা, যোনি মুদ্রা, খেচরী মুদ্রা, মহাবোধ মুদ্রাতে ধ্যান করে তিনি কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগান। তারপর রেচক, পুরক, কুম্ভক প্রাণায়াম। বাউল সাধক এগুলো রপ্ত করেন। হঠযোগও করেন। তবে মুদ্রার ব্যবহার তাঁর ক্রিয়াকরণের অঙ্গিভূত নয়। ষটচক্রে এরপর লয় যোগ। আসন, কুম্ভক, মুদ্রা–এসবই কুণ্ডলিনীকে জাগরনের জন্য করে থাকেন দেহসাধক। বাউল সাধক শ্বাসক্রিয়াতে তাকে জাগান। কুণ্ডলিনী জেগে গেলে ইড়া ও পিঙ্গলার প্রভাবে শক্তি সুষুম্নাতে প্রবেশ করে ব্রহ্মরন্ধ্রে চলে যায়। বাউল। সাধক এই শক্তির সাহায্যেই শুক্রকে উধ্বগতিতে মূলাধার থেকে আজ্ঞাচক্রের উপরে অবস্থিত ব্রহ্মরন্ধ্রে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।

গানে কৃষ্ণ অনুরাগের বাগানে দুজন মালির কথা বলা হয়েছে। এই দুইকে দুইভাবে দেখতে পারি আমরা। এক,ভক্তিকে বেড়া দিয়ে শাখা-উপশাখা সব ঘেঁটে জল সার ইত্যাদি দেওয়া। এ কাজে আগের দিনে উড়িয়াদের কদর ছিল। তাই এক মালিকে পদকর্তা উড়ে করে নিয়েছেন। দুই, দুইজন বলতে আমরা দু’প্রকার ধ্যানের কথাও বলতে পারি। সগুণ ধ্যান আর নিগুণ ধ্যান। সগুণ ধ্যান মূর্তি কল্পনা করে ধ্যান। বাউল তা করেন। না তা কিন্তু নয়। কেননা অনেক বাউলই বৈষ্ণব ভাবাপন্ন বাউল। শশাঙ্ক দাস বৈরাগ্য বাউলের কথা কিছু আগেও বলেছিলাম। তিনি বৈষ্ণব ভাবাপন্ন বাউল ছিলেন। তিনি এই দু’প্রকার ধ্যানের কথা বলেছিলেন। নিষ্ঠুণ ধ্যান হল যে ধ্যানে মনকে ধাবিত করা হয় মহাশূন্যতার দিকে। আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির জন্য। সুতরাং ভক্তির বেড়া দিয়ে মালির যত্নে গাছ বাড়তে পারে আবার ধ্যানযোগেও তা সম্ভব। কেননা দুটো তো একেবারেই সংযুক্ত রূপ।

সুধাতুল্য জলরাশি সঙ্গিনীর রজ। হংস সাধক নিজেই। হংসী সাধিকার সম্বোধন। এই জলপান আসে বিন্দুধারণে। আর তা ধারণ করেই বাউল সাধক স্বকাম নদী পার হয়ে যান অনায়াসে। এই পারাপারে কৃষ্ণ যেন জল সীমানা ছাড়িয়ে সাধকের বস্তুজল ধারণ করে বসে থাকেন। জল হল রজপাত। প্রতীকী যমুনা ধরতেও পারি আমরা। রাধাকে বেশ আগে সুষুম্না চিহ্নিত করেছিলাম আমরা। রাধাকে শরীরস্থ সাধকের নাড়িতে স্থান দিলে যমুনা অর্থাৎ পিঙ্গলার লীলা থাকবে না তা কি হয়? শরীর যদি এক্ষেত্রে পূর্ব কথিত কৃষ্ণ হয়। বাউলের কৃষ্ণ শরীর ধারণেরই কৃষ্ণ। রক্ষাবস্তুর কৃষ্ণ। সঙ্গিনীর জলকে সিঞ্চন করেই তিনি কৃষ্ণ পান। সঙ্গিনী রাধারূপ। সম্বোধিত বাউলের ‘রাধারানি’। বৈষ্ণব সাধক আবার নিজেকেও রাধারানি ভাবেন। তা যদি ভাবেন তাহলেও কৃষ্ণ শরীরধারণ করে ভক্তিরসে রসস্থ হয়। বাউলের কৃষ্ণ যথার্থই শরীর ধারণের কৃষ্ণ।

ঘোষপাড়ার মেলায় প্রতিবছরই আমতলায় আখড়া করেন নবকুমার দাস বাউল। তাঁর ভক্ত শিষ্য,গুণমুগ্ধর সংখ্যা কম নয়। আখড়া একেবারে গমগম করতে থাকে। বেশ রাতেই এখানে গাইতে ওঠেন নবকুমার। সবাইকে গাইয়ে, তদারকি করে তাঁর গাইতে গাইতে একেবারে শেষ রাত। শেষে প্রভাতী গেয়ে তিনি নেমে পড়েন। এবছর প্রভাতী গাইবার আগে বললেন, দেখেন এখনই কীরকম গৌরের আধাপ্রকাশ্য, আধাগোপন আলো এসে গিয়েছে। এবার বোধহয় প্রভাতী গাইবার সুযোগ দেবেন না গৌর। গৌর যে আমার এমনই।

সমবেত ভক্তমণ্ডলী তখন ধ্বনি দিলেন–জয় গৌর, জয় গৌর।

গান ধরলেন বাউল। নবকুমারের গানে গৌর যেন ছড়িয়ে পড়তে লাগল সতী মায়ের মেলাতে।

এই গৌর লীলার বাজারে
অবাক যাই হেরে।
একটা সূচের ছিদ্র মজার কথা
পার করে গজবরে

একটা সোনা গাছেতে
জোড়া আম ধরে তাতে
আমের ভিতর জামের গাছ ভাই
জাম ধরে তাতে।

আছে তার তলে এক বাঁকা নদী–
হেম নামেতে প্রেম ঝরে
একটা সাপে-নেউলে
আর একটা ইঁদুর-বেড়ালে
এক যোগে বাস করে এরা
থাকে নির্মলে।

তাই দেখে এক মজায় হেসে
নিতাই গৌর রব করে।
একটা সর্পের মাথাতে
হংসের ডিম্ব দিয়েছে
তার ভিতরে চোদ্দ ভুবন
বাজার বসেছে।
(আবার) সেই বাজারের বেচাকেনা
হচ্ছে কেবল একদরে।
গোঁসাই হরি পোদোয় বলে
শোন রে মন কানা
তোর হাতে তুলে দিলাম রতন
যতন করলি না।
সে ধন অযতনে হারায়ে
(জগৎ) পড়েছে কর্ম ফেরে।

গৌর লীলার বাজার’ হল কৃষ্ণের বাজার কোথায় বসেছে সেই বাজার? বাজার বসেছে দেহচক্রে। স্থূলদেহে নয়, আত্মিক সত্ত্বায় এ বাজারে সমাগম ঘটছে সাধকের। যার জন্যই ‘সূচের ছিদ্র মজার কথা/ পার করে গজবরে।‘ ‘গজবর’ হল হাতি। হাতি কামমত্ততার প্রতীক। ছিদ্র অবশ্যই যোনিদ্বার। তার তীক্ষ্ণতার জন্য সূচের বিশেষণ পরানো হয়েছে। যুগল মিলনের সম্ভোগে কাম পেরিয়ে যাচ্ছে ওই ছিদ্রপথ দিয়ে। দেহ কামেন্দ্রিয়ের। প্রতিটি দরজা বন্ধ করে দিয়ে প্রেমেন্দ্রিয়ের সদর খুলে দিয়েছে। প্রকৃতির উপর মগ্ন পুরুষের সৌন্দর্য যেন ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতি এখানে স্থির নিবেশ। যা সাধককে সাধন সঙ্গিনীই কেবল দিতে পারেন। আর সেই উৎসারণে শরীর সোনা গাছ হয়ে উঠেছে। সোনা হল আত্মপ্রতিচ্ছবি কৃষ্ণের। কৃষ্ণ প্রেমময় তাই তিনি জ্যান্ত। গৌরের প্রতিমূর্তি। শরীরস্থ ‘সোনা গাছে’ জোড়া আম ধরে আছে। কৃষ্ণ যুগলরূপের আধারকণা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পদকর্তা পদ্মলোচন(পোদো) বলছেন ‘আমের ভিতর জামের গাছ।’ ‘আম’ সোনা গাছের দ্যোতক। আম রক্ত-গৌরাঙ্গ জীবন্ত গৌর। ‘জাম’ কৃষ্ণের গাত্রবর্ণেরই প্রতীক। শরীর যুগল কৃষ্ণের ক্রমনির্মিতির অধ্যায়কে সংহত, মিতবাক তিমির দিয়ে দিয়েছে। তিমির প্রেমের অসূয়া কাটিয়ে নেবার অন্ধকার। যার জন্যই গাছ তলে ‘বাঁকা নদী’র বয়ে চলা। কৃষ্ণাঙ্গ শরীরের প্রকৃতির অনুষঙ্গ লাভ করা। নদী সঙ্গিনীর প্রতীককল্প। নদীতে ‘হেম নামেতে প্রেম ঝরে।’ ‘হেম’ স্বর্ণ বা স্বর্ণ অঙ্গ বিশিষ্ট গৌরাঙ্গেরই গাত্রবর্ণ। অর্থাৎ প্রকৃতি পুরুষের মিলনে শরীর জীবন্ত গৌরেরই শিরোপা আদায় করে নিয়েছে। এই মিলন এমনই এক ভাবের মিলন যে মিলনে শত্রর সহাবস্থান পরম মিত্রের। ‘সাপ-নেউলে’, ‘হঁদুর-বেড়াল’এর প্রতীককল্পে পদকর্তা তাঁরই ইঙ্গিত দিয়েছেন। সাপের মাথাতে হাঁসের ডিমও সাধনার শুভ্র আবেগনিঝর কথা। হাঁসের ডিম(হংসের ডিম্ব) এখানে কামের আসক্তি থেকে বেরিয়ে পড়ে। নিরাসক্ত পূর্ণিমায় আত্ম-আবদ্ধ হয়ে থাকা। পূর্ণিমা যুগল প্রেমের অন্তর্লোকে বিহ্বল আদিঅন্তের কৃতাঞ্জলি। বাউলের জ্যোৎস্না, পূর্ণচন্দ্র প্রেম। সাপ তো কামাসক্তি। সেই কামের মাথাতে অর্থাৎ চূড়ান্ত মত্ততায় কামের পরতে যেন বিন্দু বিন্দু প্রবৃত্তির নিবেশ সরে গিয়ে হংসের ডিম্বর মতো ধবধবে জ্যোতি সর্বোচ্চ শান্ত, নির্মল, নিরাধার, নির্বিকার, নির্বিকল্প, দীপ্তিমান আত্মস্বরূপ প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। যোগশাস্ত্রও বলছে–’চিদাত্মা সৰ্ব্বদেহে জ্যোতিরূপেণ ব্যাপকঃ। / তজ্জ্যোতিশ্চক্ষুরগ্ৰেষু গুরুনেত্রেণ দৃশ্যতে।।’ চিদাত্মা জ্যোতিস্বরূপ সকল দেহতেই পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। গুরুনেত্র দ্বারা চোখের অগ্রভাগে তা দৃষ্ট হয়ে থাকে। পদকর্তা সেই গুরুনেত্র দিয়েই এই হংসের ডিম্বকে ‘সর্পের মাথাতে’ দেখেছেন। এই দেখা আত্মদর্শন। ‘আত্মদর্শনমাত্রেণ জীবন্মুক্তো ন সংশয়ঃ। আত্মদর্শন মাত্রে জীবদেহ মুক্ত হয়। পরমাত্মার দ্যুতি বের হয় শরীর থেকে।

হংস ডিম্ব কথাটির অন্তস্থ মানে আমরা কিন্তু আরেকভাবেও করতে পারি। হং’ শ্বাস পরিত্যাগ। যা একপ্রকার মৃত্যু। ‘স’ গ্রহণ। হংসই জীবাত্মা। হংস ইতি জীবাত্মানং। হংসের বিপরীত সোহংস হল সাধকের সাধনা। সোহংসা পরমাত্মা। যুগল মিলনে বাউল বলে থাকেন সেই রকমই এক উপলব্ধি আসে। এই উপলব্ধিকেও হংস ডিম্ব দ্যোতক। হিসাবে অনায়াসে চিহ্নিত করতে পারি।

বাউল গাইছেন–’একটা সর্পের মাথাতে/ হংসের ডিম্ব দিয়েছে তাঁর ভিতরে চোদ্দ ভুবন/ বাজার বসেছে।’

চোদ্দ ভুবন দশেন্দ্রিয় ও চারভুতের সমষ্টি। যা দেহসাধনার দ্বান্দ্বিক সোপান। পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়র ক্রিয়াকরণ ও ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎকে চক্র ক্রিয়ায় জাগিয়ে নেওয়া। ‘চোদ্দ’কে শরীরের স্বমাপ হিসাবেও দেখা যেতে পারে। দেহ আমাদের যার যার হাতের সাড়ে তিন হাত। আগে পোয়া ছিল মাপের একক। এক চার। তাহলে সাড়ে তিন হাত চৌদ্দ পোয়াও কিন্তু। বাউল গানে দেহপ্রসঙ্গ ‘চোদ্দ পোয়া’ও হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। চোদ্দ ভুবন দেহের সামগ্রিক দীপ্র দীপ্তির ঘোষণা দেহের উজ্জীবতা। জাগরণ। তাঁর জন্যই বাজার বসা–’(আবার)সেই বাজারে বেচাকেনা হচ্ছে কেবল একদরে।’ ‘এক’ এখানে যুগল দেহের একত্র তন্ময়তা। বাউল এভাবে শব্দাবরণে দেহের বহিরঙ্গকে ভাঙন ধরান। দেহের আবরণ খসিয়ে, ক্ষইয়ে, তলিয়ে, শোষক–শোষিতের বিযুক্তকে আলাদা করে দিয়ে এমন এক অসভৃত দেহের আধার তৈরি করেন সেখানে দেহ দেহাতীত ভাবের। ধ্রুপদী সঙ্গীত গাইতে থাকে। বাউলের গান প্রতীকে, উপমায় তাঁরই আবেশনক্ষত্র নিয়ে মিটমিট করে জ্বলে বাউল আসরে।

ষষ্ঠী খ্যাপা একবার বলেছিলেন, ঘর হল গিয়ে গুরুপর্যায়। গুরুই ঘর খুলে দেন গো। গুরু হলেন গিয়ে চাবিকাঠি। তাঁর ইশারাতেই ঘর খোলে, সদর দেখা যায়। ভিতরবাড়ি, চমকায়।

–কীভাবে চমকায় ভিতরবাড়ি?

–কীভাবে আবার! শ্বাসে, দমে। গুরু শ্বাস চেনান। ঘরের চাবি খুলিয়ে রাধাশ্বাস, কৃষ্ণশ্বাস চেনান।

খ্যাপা গাইতে লাগলেন:

আমার ঘরের চাবি পরের হাতে
কেমনে খুলিয়ে সে ধন দেখব চক্ষেতে।
আপন ঘরে বোঝাই সোনা
পরে করে লেনা দেনা
আমি হলাম কর্মকানা না পাই দেখিতে।
রাজী হলে দারোয়ানী
দ্বার ছাড়িয়ে দেবেন তিনি
তারে বা কই চিনি শুনি বেড়াই কুপথে।
এই মানুষে আছে রে মন
 যারে বলে মানুষ-রতন
লালন বলে পেয়ে সে ধন
পারলাম না গো চিনিতে।

থামলেন খ্যাপা।

বললেন, বাউলের সোনা হল তাঁর গান। গানই তাঁর আঘাত। রাধাকৃষ্ণের আঘাত।

জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে গান রাধাকৃষ্ণের আঘাত?

–রাধা কী?

জিজ্ঞেস করলেন খ্যাপা।

বললাম, আপনিই বলুন না রাধা কী?

বললেন, বলব কী তোমায়। আমিই জানিনে কী তা। এই না জানাই রাধা।

–কীভাবে না-জানা রাধা হল শুনি?

–রাধা আয়ত্ব। রপ্ত। রাধা প্রকৃতির ছন্দ। কৃষ্ণরে কথা লিখতে সাহায্যে করে রাধা। ছন্দ দিয়েই তো কথা লিখতে হয়। না কি?

বাউলের জিজ্ঞাসার আমি কোনও উত্তর দিলাম না।

নিমতলার হাওয়াতে বসেই খ্যাপা বাউল গাইতে লাগলেন রাধার ছন্দ দিয়ে কৃষ্ণের কথা। চৈত্রের কচি নিমপাতারা তখন দুলতে থাকল রাধাকৃষ্ণের হাওয়ায় হাওয়ায়। খ্যাপার বাড়ির চারধারে ছড়িয়ে পড়ল গানের হাওয়া।

একতারার বোল তুলে খ্যাপা তখন ভাবে নিমগ্ন। গাইছেন:

কৃষ্ণের অধীন হওয়া মুখের কথা নয়।
কেবল রসিক অনুরাগীর কর্ম,
রাগের গুণে সুলভ হয়।

অনুরাগীর এই লক্ষণ–
ভাবে মগন তনু-মন;
বাতুলের প্রায় দরশন,
বোবা-ন্যাকার ভঙ্গী তায়।
তৃণাদপি সুনীচ জন,
সর্বত্র যার সম জ্ঞান,
কৃষ্ণময় যার নিয়ন,
তার ধ্যানে সদাই কৃষ্ণ রয়।।
ছিন্ন অষ্টপাশ যে জন,
কৃষ্ণ ভজনের যোগ্য সে জন,
সদা পূৰ্ণানন্দ তাঁর
দিন-রজনী সমান যায়।
অপ্রাকৃত গোবিন্দ কয়,
সদাচার-কদাচারে নয়,
কেবল গোপী-প্রেমে ঋণী হয়,
শ্রীভাগবতে ব্যাসদেবে কয়।।
গোপী-প্রেমের বলিহারি,
শঙ্কা, স্বজন পরিহারি,
কৃষ্ণ-সুখ লক্ষ্য করি
নিশিতে নিকুঞ্জে যায়।
কৃষ্ণ-প্রেম সুনির্মল,
যেন শুদ্ধ গঙ্গাজল,
তপ্ত ইক্ষু-চর্বণ-ফল
সেই প্রেমাস্বাদে উপজয়।।
যে জন বিষামৃতের বিষে মরে,
নিজে মরে পরকে মারে,
বহে জীবন মৃতাকারে,
হবে না তার গোপী-ভাব-উদয়।
শান্ত মধুর ভাব সিদ্ধ হলে,
ব্রজ-গোপীর দেহ মিলে,
রাগ বাড়ে তার তিলে তিলে,
অহি-শার্দুলেতে নাহি খায়।।
তীর্থযাত্রা পরিশ্রম,
সকলি মনের ভ্রম,
গোবিন্দ-ভজনের ক্রম
না সাধলে কি সাধন হয়।।
ঘটে ঘটে বিরাজকারী
চৈতন্য কৃষ্ণ নাম ধরি,
তার তত্ত্ব পাবে, নিলে–
মধুর রসের আশ্রয়।।

কৃষ্ণ শরীরস্থ উচ্চদশা। যে দশাতে কেবল রসিক অনুরাগীরাই পৌঁছে যেতে পারে। পদকর্তা বলেছেন–’রাগের গুণে সুলভ হয়।’ বাউল সাধকের প্রকৃতি-পুরুষের অন্তর্নিহিত সত্তা শুক্র ও রজ। রজ হল বীজ। বীর্য শক্তি। বীর্যসত্তাকে বাউল ঈশ্বর নামে অভিহিত করেন। বীর্য তাঁদের কৃষ্ণবস্তু। মূলাধারের সুপ্ত শুক্রকে বাউল সাধক ব্রহ্মরন্ধ্রে উঠিয়ে নিতে পারেন চক্রস্থ সাধনায়। সঙ্গিনীর দেহে রজ থাকে সহস্রার চক্রে। যখন রজসত্তায় বিকাশ আসে তখন রজ নেমে আসে। সাধক অষ্টম ইন্দুকে স্পর্শ করে, ছুঁয়ে, ব্যবহার করে সঙ্গিনীর কামক্রিয়াকে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র দিয়ে ভোঁতা করে শুক্রকে ব্রহ্মরন্ধ্রে উঠিয়ে নেন। মূলাধারের বীর্য ওঠে সহস্রারের ব্রহ্মরন্ধ্রে অপরপক্ষে সহস্রারের রজ প্রবৃত্তির নিয়ম নেমে আসে মূলাধারে। দুই শরীরের মিলন হয়। রজ-বীর্য মিলিত হয় না কখনও। বাউল বলেন সহজ মানুষের কথা। তাঁরা মনে করেন, বলেন, সঙ্গিনীর সত্তায় প্রকৃতি নিয়মে রজরূপী ঈশ্বর নেমে এসে ত্রিবেণীর স্রোতধারা বয়ে চলে। সাধক বাউল সেখানে। স্নান সারেন কেবল। রজরসে অবগাহন করেন। শুক্ৰবীজকে স্বাভাবিক রেখে দেন। কিন্তু সৃষ্টি ধারাকে তাঁরা নাশ করে মিথুনানন্দ উপভোগ করেন। তাঁরা বলেন পুরুষ-প্রকৃতির এই মিলনে দেহ বৃন্দাবন হয়ে ওঠে আর মিলন হয় রাধাকৃষ্ণের মিলন। এই মিলন সম্পূর্ণ কার্য সাপেক্ষ। পদকর্তা তাই বলেছেন–’ইহা রাগের গুণে সুলভ হয়। রাগ হল সহজ মানুষে পরিণত হওয়া। যার জন্যই অষ্টপাশ ছিন্ন। ঘৃণা, লজ্জা, ভয়, শঙ্কা, জিগীষা, জাতি, কূল, মান–এগুলোর ঊর্ধ্বে ওঠা। অষ্টভাব মনেতে নিয়ে আসা। এই ভাবগুলো হল–স্তম্ভ, স্বেদ, রোমাঞ্চ, স্বরভঙ্গ, বেপথু, বৈবর্ণ, অশ্রু, মূৰ্ছা। আর অণিমা, লঘিমা, ব্যাপ্তি, প্রকাশ্য, মহিমা, ঈশিত্ব, বশিত্ব, কামবসায়িত–এই অষ্টশক্তিকেও জাগিয়ে নেওয়া। বাউল বলেন। আটপাশ আত্মচৈতন্যকে ডুবিয়ে রেখেছে গহিন জলে। তাকে আগে ভাসিয়ে তুলতে হবে। পাশ মুক্তির পর সব স্থূলতা কেটে যাবে।

শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্য একথা বলেছিলেন আমাকে। তবে তিনি তন্ত্রের কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, ক্ষুধা, তৃষ্ণা বলেননি অষ্টপাশে। তিনি বলেছিলেন কিন্তু ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘৃণা, ভয়, লজ্জা, মান, রাগ, দ্বেষ-এই অষ্টপাশের কথা। আসলে ব্যাপারগুলো সব প্রায় একই। তবে এগুলো বাবাজিদের কাছেই মূলত শুনেছি।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম বাউলকে, তা পাশমুক্তি হবে কী করে?

বললেন, ক্ষুধা জয় হল পেটের ক্ষুধাকে সাধনের অঙ্গভূত করে নেওয়া। তৃষ্ণাও তাই। সিদ্ধ স্তরে ওঠার জন্য আঁকুপাঁকু করা। ছটফটানি। এগুলো সবই ক্ষুধা-তৃষ্ণার ছটফটানি। মল-মূত্র খেয়ে-মেখে, রজও পান করে ঘেন্না জয়। ভয় হল মনকে একতানে বাঁধতে না পাড়ার অস্থিরতা। লজ্জা হল গুরুর সম্মুখেই সঙ্গিনীর সঙ্গে মিলনের বাঁধো বাঁধা ভাব। মান হল গিয়ে গুরুর কড়া কথার উর্ধ্বে ঢলে যাওয়া। রাগ হল রিপুনাশ। দ্বেষও তাই বাবা। এসব মন থেকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতে হবে। অষ্টভাবের কথা বৈষ্ণবরাও বলে থাকেন। তাঁরা বলেন এগুলো হল সাত্ত্বিকভাব। এছাড়া তাঁরা আবার দৈন্য, গ্লানি, চাপল্য, বিষাদ, আবেগ, চিন্তা, হর্য, নিদ্রা, শঙ্কা, ত্রাস, শ্রম ইত্যাদি তেত্রিশটি ব্যাভিচারি ভাবের কথাও বলেন। এগুলো সব আসলে গিয়ে হল সেই ইন্দ্রিয় দমন। অষ্টশক্তি সব চক্রস্থ পন্থারই বিষয় আশয়।

গানে বলা হয়েছে বিষামৃতের বিষ, সদাচার, শঙ্কা–এগুলো কিন্তু সবই অষ্টপন্থার অনুসারী। বাউল বলেছেন–’শান্ত মধুর ভাব সিদ্ধ হলে/ ব্রজ গোপীর, দেহ মিলে, / রাগে বাড়ে তার তিলে তিলে, / অহি-শার্দুলেতে নাহি খায়।

শার্দুল হল কামমত্ততা। প্রেমভাবে কাম-আচ্ছন্ন আবহাওয়া সৃষ্টি করে।

খ্যাপা বলেছিলেন একথা।

কী সেই আচ্ছন্নতা? জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

বললেন, শেকল ভাঙার আচ্ছন্নতা। কামের হাত পা মাথা সব কেটে দিলে আমাদের কাম তো বেদনাময় হয়ে যায়। কাম থেকে রক্ত ঝরে।

আমি চমকে উঠলাম খ্যাপার কথায়।

বলেন কী খ্যাপা! কাম থেকে রক্ত ঝরছে। মানুষটা এমন সব ভাষার খড়িমাটি দিয়ে আলপনা আঁকতে পারেন। যেন কবির গায়ের গন্ধ লেগে ওঁর জোব্বাজুব্বির গায়ে।

বললেন, গলগল গলগল সব রক্ত গো। কৃষ্ণরক্ত। রাধার ভাবধারা নিয়ে ছোপছোপ সব দাগ মনের অন্দরে লেগে। হিক্কা তুলতে তুলতে কাম মরে। কাপড় চোপড় পরে সাজগোজ করে কাম বেরিয়ে যায় কৃষ্ণপ্রেমের হাওয়া খেতে।

আমি দেখলাম খ্যাপার মুখের ছায়ায় কৃষ্ণের একতারা শুধু বেজে বেজে যাচ্ছে দিঘরার হাওয়ায়।

একতারা কৃষ্ণ সাজচ্ছে। পরে নিচ্ছে রাধার বেশ। যুগল হয়ে উঠছে বাউলের চিন্তায়, সাধনায়।

2 Comments
Collapse Comments
Pradip Kumar paul July 20, 2021 at 1:39 pm

সোমব্রত সরকার » দুই বাংলার বাউল আখড়া
এই বইটির ছাপা কপি পাওয়া যাবে ।
উত্তর পেলে খুশি হব ।

Bangla Library (Administrator) July 20, 2021 at 10:20 pm

হ্যাঁ, বাংলাদেশের বুকস্টোর বা অনলাইনে দেখতে পারেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *