নাফা

নাফা

শামতাপরসাদ। না, যাঁকে শান্তাপ্রসাদ তবলিয়া বলা হত, তিনি নন। ইনি নেহাতই শামতাপরসাদ কালোয়ার। বঙ্গালিলোগ শান্তাপ্রসাদ বললে তিনি কখনও কখনও শুধরে দেন। তাঁর ছেলে কামতাপরসাদ সাউ। তাঁরও ছেলে ওমপরকাশ নামের ওমটুকু গ্যাংগ্রিনগ্রস্ত প্রত্যঙ্গের মতো বাদ দিয়ে সে জায়গায় আনল একট আস্ত সুস্থ ইস্পাতশানিত জয়, পরসাদও সে আর থাকল না, পরকাশ হয়ে গেল। জয়প্রকাশ গুপ্তা।

এরা ফৈজাবাদের লোক। সেই যে উত্তরপ্রদেশ, অযোধ্যার কাছাকাছি ল্যাংড়া লুলা, হতদরিদ্র ফৈজাবাদি গাঁও। সেই। আর কালোয়ার? কালোয়াররা খুচরো লোহার বেওসা করে। রেসিডেনশাল এরিয়ার মধ্যেই কুচি কুচি অন্ধকার কুলুঙ্গির মতো গোঁজা এক একখানা বে-সহবত নাঙ্গা দোকান, তার ভেতর থেকে ভিখিরির অপুষ্ট পুরুষাঙ্গর মতো রাশি রাশি লোহার রড বেরিয়ে আছে। একখানা পাথরের খণ্ডর ওপর টকটকে লাল একটা জিনিস রেখে উলটেপালটে যাচ্ছে এক যমদূত, আর একজন পেল্লাই হাতুড়ি দিয়ে তাকে পেটাচ্ছে। এরকম ছবি প্রাগৈতিহাসিক সময়ের ছবিতেও আমরা হিস্ট্রি বইয়ে আকছার দেখেছি। তা জিনিসটা কী? অবাধ্য আত্মা-টাত্মা না কি? উঁহু, নেহাত ছেলেমানুষেও জানে ওটা লোহা। লোকদুটোও যমদূত নয় স্বভাবতই, কালোয়ারের ভাড়া-করা মজদুর, খিদমতগার, কখনও বা কালোয়ার নিজেই। লোহা পিটিয়ে পাত বানানো হচ্ছে। রাস্তাটা জনগণের সবাইকার, সুতরাং জনগণের প্রত্যেকেরও, আপনারা জানেন বোধহয়। সেই রাস্তার ধারে দেখা যাবে লোহার পাতের জায়গায় জায়গায় কী যেন একটা যন্তর ধরা হচ্ছে। শোঁ শোঁ আওয়াজ, গাঁক গাঁক নীল আলো, না না, কোনো রামদিন বা আলাদিনের দৈত্য নয়, ওটা অক্সি-অ্যাসিটিলিন গ্যাস, লোহার সঙ্গে লোহা জোড়া হচ্ছে। ওয়েল্ডিং।

তা, এই লোহার বেশিরভাগটাই আবার চোরাই। অনেক রাতে শামতা কামতাপরসাদের কুলুঙ্গি দোকান ও তৎসংলগ্ন টিনের চালের ঘরের সামনে শোনা যাবে ঝনঝনঝনঝন ঝনঝনঝনঝন, আগে পিছে চলন্ত হেভি ট্রাকের মুখ চেপে ধরা গোঁয়ার আওয়াজ। কী রে বাবা? পড়ছেটা কী? আলিবাবার মোহর? তার আওয়াজ তো আর একটু মিঠে হওয়ার কথা! উঁহু! মোহর নয়, কিন্তু মোহরের কাছাকাছি কিছু তৈরি করবার উপায়। ওগুলোই চোরাই লোহা। কিছু পয়সা খেয়ে লরি-ড্রাইভার খানিক লোহা ফেলে দিয়ে যায়। ড্রাইভারেরও কিছু হল, কালোয়ারেরও কিছু হল। ভেজনেওয়ালা, লেনেওয়ালা উভয়েই জানে কিছু মাইনাস ধরতেই হবে, এমনটা হয়ে আসছে, এমনটাই হওয়ার কথা। লিভ অ্যান্ড লেট লিভ। খারাপ কিছু?

কিন্তু বালক বয়সেই জয়প্রকাশের এই দুপুররাতের ঝনঝনানি সাক্ষাৎ কুম্ভীপাক নরকের আওয়াজ বলে মনে হতে থাকে। কারণ, প্রথমত তার অ্যাংলো-স্যানসক্রিট স্কুল, আর দ্বিতীয়ত তার প্রতিবেশী গৌতম সরকার, তার চেয়ে কিছু বড়ো এক বালক, বা কিশোর, তার মতো খাঁটি গৌরবর্ণ নয়, কিন্তু চোখেমুখে কথাবার্তায় খুব ধার। পরদিন সকালে উঠেই সে জয়প্রকাশকে জিজ্ঞেস করবে কি না, কী রে জয়? কাল রাত্তিরে তোর ঠাকুর্দার গোডাউনে আবার চোরাই মাল এল? বেশ ঘন ঘন আসছে দেখছি, এবার তোদের টিনের চালি পাকা হয়ে যাবে, দ্যাখ। বলতে বলতে ফিচকে হাসি হাসবে গৌতম।

একটা বোবা রাগে তখন জ্বলে জয়প্রকাশের তনুমন।

তাজ্জব কি বাত? চোরাই? চোরাই হতে যাবে কেন?

মাঝরাত। বুঝিস না? আমাদের এ রাস্তা দিয়ে ট্রাক চলে? পুলিশকেও কিছু দিয়ে ঢুকেছে। আর কিছুই যদি না বুঝিস, তো দাদুকে জিজ্ঞেস করিস, বাবাকে জিজ্ঞেস করিস! আববার কয়লার গুঁড়ো দিয়ে দাঁত মাজছিস? এক তাড়া দেয় গৌতম।

কয়লাগুঁড়ো! কলোয়ারের বাড়ি কয়লার গুঁড়ো ছাড়া আর কিছুই দাঁত মাজবার জন্য সরবরাহ করবেন না জয়প্রকাশের দাদা বা বাপজি। এক যদি লোহাচুর দেন। জয়প্রকাশ নয়, জয় জয়, জয়। গৌতমদাদার শত ধিক্কার অবজ্ঞা, খামখা নাক গলানো, গালাগালি সব সে মাফ করে দিতে পারে ওই নামটুকুর জন্যে। জয়! কী মধুর! কী সম্মানের। যেন অন্য কোনো সাফসুতরো জগতের অন্য কোনো দেবোপম বালকের নাম। কয়লাগুঁড়ো দিয়ে দাঁত মেজে মেজে যার দাঁতের চটা উঠে যায়নি, যার বাড়ির চালি জন্ম ইস্তক পাকা। রীতিমতো দোতলা হাবেলি, যার বাড়ির সামনে অন্ধকার কুলুঙ্গির মতো দোকান নেই, আর…আর যে দোকানে রাত্তিরে ঝনঝনঝনঝন লোহা পড়ে না। চোরাই কিংবা অ-চোরাই।

সুতরাং এই ছেলে যে শুধু জয় গুপ্তা না হয়ে জয়প্রকাশ গুপ্তা হয়েছে এই-ই তার তিন চোদ্দং বিয়াল্লিশ পুরুষের ভাগ্যি। দাদাজি অর্থাৎ শামতাপরসাদ গোড়ার থেকেই তাঁর বউমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, বহু, পোতাটাকে বড়োলোকের বাড়ির লড়কাদের সঙ্গে মিলতে মিশতে দিয়ো না ওরা আমাদের ছোটো নজরে দেখে।

সাত হাত ঘোমটার ভেতরে থেকে কাঁসার কাঙ্গন বাজিয়ে বহু বলত, দিলে কী হয়? এক ইস্কুলে যায়, বড়ো হাভেলির লড়কা হলে হবে কি মোটেই ছোটো নজরে দেখে না। কতরকম শিখায় আমাদের লড়কাটাকে। এক টিব-পুরা মাজন কিনে দিয়েছে ওকে তা জানেন? বলেছে যতদিন তোর দাদা তোকে না কিনে দেন, আমি দেব। আমাদের লড়কার রকমসকম বদলে গেছে, ভদ্দর আদমি বলে মনে হয়।

এখন সেটাই তো সবচেয়ে শঙ্কার কারণ জ্ঞানবৃদ্ধ শামতাপরসাদের। পড়ালিখা কিছু শিখতেই হয়, নইলে বেওসায় ঠকে যেতে হবে, নুকসান। সহবতও কিছু শিক্ষণীয়। সে অবশ্য তাঁদের আছেই। আসতে নমস্তে, যেতে নমস্তে। হাত জোড়। মুখে দুরবিগলিত হাসি। এ সমস্তই মন্তর। তা এসব তো ছেলেকে, পোতাকে ছোট্ট থেকে তাঁরা শেখানই। কিন্তু এরপর যদি বলে এ লোহা কি দুকানে বসব না, অন্য কাম করব! দেখেন তো এ মুলুকের ছেলেপিলেদের। বাপ-মায়ের প্রাণান্ত খরচ করিয়ে এতগুলি পাস দেয় এরা, তারপর দু পয়সার কেরানিগিরির জন্যে হাঁটাহাঁটি শুরু করে। সে নোকরি পেলে আবার গলায় টাই-মাই ঝুলিয়ে হাতে ব্রিফ-বাক্স, দশটা পাঁচটা করে। নিজেদের বলবে—অ্যাসিস্ট্যান্ট, মেনেজমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট, সেলস এগজিকিটিব। তিনি মনে মনে হাসেন, ঘাসে তো আর মুখ দিয়ে চলেন না। তাঁর খাঁটিয়ার তলায়, কোমরের গেজেতে অমন হাজার হাজার টাকা গোঁজা আছে। ইচ্ছে করলেই তিনি এ কোঠির টিনের চালি সরিয়ে ঢালাই ছাদ বানিয়ে নিতে পারেন, এমন একখানা দুখানা হাবেলিই কি পারেন না? কিন্তু তাঁর এতেই চলে যায়। লোহার কালো গুঁড়ো আর রাস্তার ধুলো মাখা ময়লা ধোতি, চোখের কোণে পিচুটি, সববাইকার চোখের সামনে বসে তিনি মজুর খাটান, একটা পয়সা বেশি কাউকে দিতে কালঘাম ছটিয়ে দেন। সবার সামনে এই দড়ির খাঁটিয়াতেই তার। দুপুরের খানা আসে—পিতলের কাঁসিতে চার-পাঁচখানা গেঁহু কি চাপাটি আর মোটা মোটা সিমলাই লংকার আচার। তাঁর মজুরদের থেকে বেশি কিছু না। লোটা ভর পানি পিয়ে নেন। বাস মহাপ্রাণী শান্ত। আবার কী চাই? ইনকামট্যাক্সঅলারা দূর থেকে পালায় এখন। গেঁজের টাকার কথা ঢালাইয়ের ছাদ বানিয়ে জানান দিলেন। আর কি। বাস করেন যে কোঠিতে তা ছিল এক বুডটি বেওয়ার, বেনারস থাকত। সেখান থেকেই ভাড়া করে আসেন। যতদিন বেঁচেছিল ভাড়া গুনেছেন, সে মরে যেতে তার ভাইপো-ভাগ্নেদের এখানে দাঁত ফোঁটাতে দেননি কিন্তু। কার্যত সুতরাং এ কোঠি তাঁর। কে কতদিন টিনের চালির গোডাউনের উত্তরাধিকার নিয়ে ঝগড়া করবে, সব কেটে পড়েছে। একটা পয়সা ট্যাক্স দিতে হয় না। কর্পোরেশনের খাতায় এ কোঠির কোনো অস্তিত্বই নেই। জল ফ্রি, বিজলি নিয়েছেন রাস্তার তার থেকে হুক করে। তা-ও সবসময় জ্বলে না, বলেন, বিল উঠবে, বিল উঠবে। বহু বা পোতা অতশত জানে না, তাড়াতাড়ি করে রসুই, পড়ালিখা সব সেরে নেয়। কিন্তু ছেলে তো জানে। সে একটু অবাক হয়ে তাকায়। বিল উঠবে? ক্যা বিল? কিসকা বিল? পরক্ষণেই তার মুখে একটা বোঝার হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। বাপজি এই বুঢ়াপাতেও তাকে কত কিছু শিখলাচ্ছেন, সাববাশ পিতাজি। যে বিজলি বিল উঠবে করপোরেশনের, কিংবা কোনো অজানা কোঠির কোঠিয়ালের সেই বিলের দোহাই পেড়ে তিনি লোককে এবং আপন পরিবারকে জানাচ্ছেন তাঁর বিজলি খরিদ করা বিজলি। মাঙনা নয়, আবার সংসারে খাওয়া-পরা-শোয়ারও একটা ডিসিপ্লিন আনছেন। ওয়াহ, ওয়াহ।

তা, শামতা বা কামতা কেউই এসব কথা বহু বা জয়পরকাশকে বলতে যান। বলেন, মছলিখোর বঙ্গালি, মছলি খেতে শিখবে, নাস্তিক বঙ্গালি, ভগোয়ানকে মেনে চলবে না। বুঢ়া বাপ-মা-দাদার কদর সম্মান করবে না।

কিন্তু কে শোনে কার কথা? বহুও না পোতাও না। বহু দুপুরবেলা তার ঘুংঘট খুলে রসুইঘরের চাতাল থেকে গৌতমের মা-জেঠিমাদের সঙ্গে লংকার আচার আর ভিসিটিবল চপের রেসিপি দেওয়া-নেওয়া করে। নাকের বেসর খুলে রাখে। প্রথমে বলে নাকে লাগে, পরে বলে শরম লাগে। আর জয়পরকাশ—গৌতমদাদার দেওয়া টুথপেস্টে মেজে, ওরই মতো ঝকঝকে হয়ে ইস্কুলে যেতে যেতে সম্পূর্ণ বাঙালি টোনে বলে, গৌতমদা লেফট হ্যান্ডার ব্যাটকে রাইট হ্যান্ডার বোলার দিলে কার সুবিধে কার অসুবিধে হয় আমাকে বুঝিয়ে দাও তো!

কিংবা,

কাল অঙ্ক সার আমায় এমন কড়কালেন এক ক্লাস ছেলের মধ্যে! সুষ্ঠু বাবার জন্যে। কিছুতেই আমাকে ইনস্ট্রমেন্ট বক্স কিনে দেবেন না।

আমি তোকে আমার পুরোনোটা দিয়ে দিতে পারি।

 উঁহু, তা কেন? আমি কেন তোমারটা নেব? কেনবার ক্ষমতা না থাকলে আলাদা কথা…

গৌতম বলে, আমার আর একটা নতুন আছে। এটা এক্সট্রা, আগেকার। তবে তোর যদি মনে লাগে জয়, লাগতেই পারে, তা হলে আমার বলার কিছু নেই। আসলে কী জানিস, এ তো গরিবের ভিক্ষা নেওয়া নয়, বোরা অবুঝ হলে, ছোটোদের পরস্পরকে সাধ্যমতো সাহায্য করতেই হয়।

জয়, জয়, জয়। কী সুন্দর। কী মধুর। কী ভদ্র। এভাবেই জয়পরকাশ হয়ে ওঠে জয়. পি. গুপ্ত। এভাবেই স্কুলফাইনাল, হায়ার সেকেন্ডারি, বিকম সে পাস দিয়ে ফেলে। খুব ভালোভাবে না হলেও খারাপভাবেও নয়। জয়. পি. গুপ্ত। সে যখন বি. কম পাশ করছে তখন তার দাদাজি পঁয়ষট্টি বছর বয়সে অতিবৃদ্ধ অবস্থায় দেহ রেখেছেন, বাবা বাড়িটাতে আর. সি. সি.-র ছাদ তৈরি করে ওপরে ছেলের জন্য একটি কামরা এবং নাহা-কামরা বানিয়ে দিয়েছেন। তাতে বিজলি বাতি, ফ্যান, টি.ভি.-সব এবার সি.ই. এস, সি-র নিয়মমাফিক। সে বাঙালিদের মতো মাছ-মাংস খেতে ভালোবাসে, খায়। তবে বাড়িতে নয়। তার ছোটোবেলাকার বন্ধু সেই গৌতমদারা আর এখন পাশের বাড়িতে নেই। শরিকি বিবাদে তাদেরই কাছে বাড়ি আধা দামে বিক্রি করে কোথায় চলে গেছে। কিন্তু জয়ের অনেক ইচ্ছে সত্ত্বেও কামতাপরসাদ সে বাড়িতে উঠে যাননি। খালি বলেন, পাপ হোবে, পাপ হোবে। বাড়িটা তিনি ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। বাড়িভাড়ার পুরো টাকাটা এখন জয়ের হাতখরচ।

কেন ও বাড়িতে থাকতে যাবেন না এর সপক্ষে যুক্তির জন্য ছেলে কিন্তু তাঁকে কচ্ছপের মতো কামড়ে থাকে। উঠতে বলে, বসতে বলে, শুতে বলে। অবশেষে জেরবার হয়ে কামতাপরসাদ ইতস্তত করে বলেই ফেলেন কথাটা। তাঁদের বসতবাড়ি ও গো-ডাউন গৌতমের ঠাকুরদার কাছে বাঁধা রেখে অনেক টাকা ধার করেছিলেন একসময় শামতাপরসাদ। তাতেই তাঁর কারবার বিশেষরকম ফলাও হয়। কিন্তু তার পরেই আসে সাংঘাতিক মন্দা। তিনি সে টাকা আর ফিরিয়ে দিতে পারেননি। শামতা তা পারেনইনি, কামতাও পারেননি। অবশেষে সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে দেখে গোরুচোরের মতো মুখ করে কামতা যান গৌতমের ঠাকুরদা সেই দ্বিজুবাবুর কাছে।

বাবু, আমাকে আর কিছুদিন সময় দিন।

দ্বিজুবাবু ইতিমধ্যে তিনবার সময় দিয়েছেন কামতাকে। কামতা একটা পয়সাও ঠ্যাকাননি। আজ হাজারখানেক এনেছিলেন।

ময়লা গেঁজে থেকে টাকা বার করতে দ্বিজুবাবু সেগুলো হাতে নিয়ে বলেন, এ যে লাখ টাকার পনেরো বছরের এক বছরের ইনটারেস্টও হয় না হে!

তা হলে?, কামতার বুক গুরগুর করছে।

তা হলে এই। দ্বিজেনবাবু তাঁর সিন্দুক থেকে বন্ধকি কাগজপত্র, দলিল দস্তাবেজের ফাইলটা এনে কামতার হাতে গুঁজে দিলেন। বললেন, তুমি আমার কতকালের পড়শি কামতা, তোমার ভিটেমাটি চাটি করে আমি কি নরকে যাব? যাও, এ সব নিয়ে যাও। তোমার ও টাকা আমি ছেড়ে দিলাম। বিপদের দিনে পরস্পরকে যারা দেখে তারাই হল পড়শি। আমি যেমন তোমার, তুমিও তেমনি আমার।

টাকা না নিয়ে যে দলিল ছেড়ে দিলেন এ কথা দ্বিজুবাবু নিজের স্ত্রীকে পর্যন্ত বলেননি। ছেলেদের তো দূরের কথা। তিনি তার কিছু পরেই মারা গেলেন। ক্রমে তাঁর স্ত্রীও মারা গেলেন। ধীরে ধীরে ওদের পার্টিশনের ব্যবস্থা হল। কামতা দরাদরি করে বাড়িটা আধাদরে কিনে নিলেন। তখন সরকারবাড়ির সব ভিন্ন হবার জন্য ব্যস্ত। পৈতৃক সম্পত্তি কত দামে গেল সে নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। কামতা বলেন, বাড়িটা তো পুরোনো হল কি না, পঁয়তাল্লিশ বছর ভরে গেল, ডেপ্রিসিয়েশন হয়ে আর কী আছে? বাড়ির তেমন ভ্যালু নেই। ভাঙতে বরং খরচা। জমিটুকুরই যা দাম। তা পাঁচ কাঠার উচিত মূল্যই আমি দেব। পড়শি বলে আপনারাও একটু কনসিডার করুন।

বাস, মার্বেলের মেঝে, সেগুন কাঠের দরজা জানলাসুদ্ধ পুরনো বাড়িটা আধা দরে কামতার হয়ে গেল।

এত কথা খুলে অবশ্য তিনি ছেলেকে বললেন না। শুধু বন্ধকি কাগজপত্র ফেরত পাওয়ার কথাটাই বললেন। ও কোঠিতে থাকলে বুঢ়াবাবু আমার উপর গুসসা হোবেন। আমার কোঠি তিনি ফিরিয়ে দিলেন, তিরিশ বছর আগেকার সেই লাখ টাকা এখন সুদে আসলে কত হয় কে জানে বাবা, ও বাড়িতে আমরা থাকতে যাচ্ছি না।

ছেলের কাছ থেকে ঘেন্না, কিছু রি-অ্যাকশন, অন্তত কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন আশঙ্কা করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেসব কিছু এল না। জয় পি. গুপ্তর গম্ভীর মুখ দেখে তার ভাবান্তর অন্তত কামতাপরসাদ সাউ কিছুই ধরতে পারলেন না। ভয়ে ভয়ে যখন ও বাড়ির সাড়ে চার হাজার টাকা ভাড়াটা ছেলের হাতে হাতখরচা বলে তুলে দিলেন, তখনও সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। হাত পেতে নিল টাকাটা। এবং নিয়েই যেতে লাগল চুপচাপ। এবং ঠাকুরদাদার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য করে সে কিছুতেই সেই লোহার দোকানে বসল না।

ঠাকুরদার অন্য ভবিষ্যদ্বাণীটাও সত্য হয়েছিল। কিন্তু কামতাপরসাদ সে কথা জানতেন না। জয়প্রকাশ চাকরি খোঁজা শুরু করে দিয়েছিল। সেই কণ্ঠ-ন্যাঙট বাঁধা—হাতে বই বাকসো-টাইপের চাকরি। কিন্তু ভালো কোথাও সে কিছু পেল না। সাড়ে চার হাজার টাকা যে হিসেবহীন মাসোহারা পায় তার তো খুব অল্পস্বল্পের চাকরি পছন্দ হবার কথা নয়। সরকারি অফিসের তো কথাই নেই, এক্সচেঞ্জ ছাড়া সেখানে ঢোকাই যায় না। কেতাদুরস্ত মার্চেন্ট অফিসগুলোও তাকে ফেরাল। মারোয়াড়ি ফার্মে সে পেয়ে যেত, যদি মারোয়াড়ি হত। কিন্তু সে তো ফৈজাবাদি, উত্তরপ্রদেশীয়। এরা ও মারোয়াড়িরা পরস্পরকে তাচ্ছিল্য ও অবিশ্বাসের চোখে দেখে। সে রোজগার ছেড়ে অন্য ধান্দায় মন দিল।

তার, সত্যি কথা বলতে কি, এখন বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা। চারদিকে কোমল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। নবনীত কোমল। কত রকম। পাকা ধানের রং, কাঁচা ধানের রং, পেঁহুর মতো, জওয়ানের মতো, চিনেমাটির ফুলদানির মতো, জ্যান্ত একেবারে জ্যান্ত। ধরতে চাইলেই ধরা যায়। সাড়ে চার হাজার তো হাতেই, তা দিয়ে কিনতেও পাওয়া যায়। কিন্তু তার অত দুঃসাহস নেই। অসুখের ভয়েই হোক, আর ধরা পড়ার ভয়েও হোক সে ব্লু ফিলম এবং স্বমেহনেই ক্ষান্ত রইল। হুইস্কির পেগে চুমুক দেয়, নীল ছবি দেখে, আর শরীরের নিম্নাঙ্গে তার হাত চলে যায়। কিছু বন্ধুবান্ধবও জুটল। তারাও একই পথের পথিক। একসঙ্গেই সব কিছু উপভোগ করে।

শেষে একদিন তার মা কপাল চাপড়ে সাশ্রু নয়নে কামতাপরসাদকে বললেন, আমাদের বহু কি আনবে না? বেটা যে হয় যোগী নয় জাহান্নমবাসী হতে চলল।

শাদি? কামতা আকাশ থেকে পড়লেন। শাদি আর এমন কি ব্যাপার? তিনি হাত ঝাড়া দিলে অমন একশোটা শাদি হয়ে যাবে। তো ছেলেকে রাজি করাও। তাঁর ধারণা ছিল রাজি হবে না। ছেলে কিন্তু দু-চারবার নিয়মরক্ষার না, নাকরেই রাজি হয়ে গেল, খালি মাকে বলল, কুৎসিত মেয়ে সে শাদি করবে না। সুন্দর চাই।

তো তারই বা অভাব কী? ফৈজাবাদি আওধওয়ালিদের মধ্যে কী সুন্দর নেই? একেবারে দেশঘরের আসলি ঘিউয়ের মতো আসলি সুন্দরীই জোগাড় হল। খোসা ছাড়ানো ঘিয়ার মতো রং। কুচকুচে কালো চুল। গালের ভাঁজে নাক-চোখ দুই-ই ডোবে, ডোবে। চোখের তো দরকার নেই। তিন হাত ঘোমটা। আর নাক তো গহনা পরবার জন্য, নাকে নথ উঠল, হিরের নাকছাবিও উঠল। হাতভরতি কাচের চুড়ি। সুহাগ রাতের সুহাগের অত্যাচারে সেই সুহাগনের কাচের চুড়ি যখন মটমট করে ভাঙল তখন ফরসা রঙে রক্তের ফোঁটাগুলো চুনির মতো জ্বলছে দেখে বাসনায় জে. পি. গুপ্তর শরীরে আগুন। কিন্তু হায়, ও আগুন তো বারবার জ্বলে না। জড়সড় একটি কাপড়-গহনার পুঁটলি, তিন হাত ঘোমটা, একটি মোটাসোটা তাকিয়া ছাড়া জয়প্রকাশ আর কিছুই পেতে পারল না। না দুটো কথা, না একটা সলাহ, একটা দুটো শায়রি কি গানা, কিছু না। কিছু না। খালি বছর বছর পয়দা হতে লাগল নাকে পোঁটা, যেখানে-সেখানে পিসাবকরনেওয়ালা, ন্যাংটা হ্যাংলা, ভোঁদাটে ছেলেপিলের পাল। তাদের মধ্যে মেয়েগুলোকে দেখলে জয়প্রকাশের আরও ঘিন্না লাগে। এগুলোও তার কাছ থেকে কাপড়-গয়নার পুঁটলি হয়ে আর কারও ঘরে যাবে, চিত হবে আর আরও একপাল শূকর শূকরী পয়দা করবে।

কিন্তু শাদিসুদা মানুষ, তার ওপরে বাপ হয়েছে, কামে-কাজে তো যেতেই হয়। অতএব কামতা ও কামতানির ইষ্টসিদ্ধি হল। জে. পি. গুপ্ত বাপের ভাঙা লোহার কারবারে গিয়ে বসল। তবে তার চেহারা বদলে দিল সে। এখন লোহার গুদাম আলাদা, অফিসঘর আলাদা, অফিসঘরে সানমাইকা-ঢাকা টেবিল, রিভলভিং চেয়ার। ভেপার ল্যাম্প জ্বলে। আরও নানান ধান্দা বার করতে লাগল সে। এই ভাঙা চোরাই লোহার খাঁচা থেকে তাকে বেরোতেই হবে, হতেই হবে নিয়মনিষ্ঠ ভদ্র ব্যবসায়ী, খানদানি ভদ্রলোক। মানিয়ে নিচ্ছে সে, মানাতেও বাধ্য করছে ক্রমাগত। তার মা ঘুংঘট ছেড়েছেন, খোঁপার ওপর আর তা ওঠে না, বাপ ভদ্র পোশাক পরিচ্ছদ পরছেন। সেই পড়ে-পাওয়া কোঠাবাড়ি এখন হয়েছে মোজেইক করা দোতলা, দোতলায় শুধু তার বসবাস। একতলায় খাবার টেবিল, গ্যাস, ফ্রিজ, গ্যারাজে মোটর সাইকেল, আধুনিক জীবনের সকল অনুষঙ্গে সে ভরিয়ে দিচ্ছে বাড়ি। তবু বাড়িতে ঢুকলেই তার মাথায় খুন চাপে। একটি জড়পুঁটলি এগিয়ে এসে জুতো খুলে দেবে, মোজা খুলে পাটসাট করবে, ফ্যান থাকা সত্ত্বেও কোথা থেকে একটা ঝালর দেওয়া গোলমতো দেশোয়ালি পাখা এনে একটি হাত বার করে হাওয়া করবে যেন একহেতে পেতনি। শূকরের পাল—নোংরা, সর্দিঝরা নাকে কেউ উলঙ্গ, হামা দিতে দিতে কেউ টলটল করতে করতে, কেউ আবার দিব্যি ছুটে কিংবা হেঁটে বাপকে তাদের দৈনিক আদর সোহাগ জানাতে আসবে। তাদের মা তাড়া দেবে, কিন্তু তারা নড়বে না, অবশেষে তার পকেট থেকে লজেন্সের ঠোঙা বার হলে একটা একটা নিয়ে পশ্চাদপসরণ করবে।

যাচ্ছেতাই একটা গালাগাল সে চাপা গলায় উচ্চারণ করবে, তার স্ত্রী পাখাধরা হাতটা একটু জোরে জোরে নড়বে। স্বামীর পৌরুষে সে ভীত এবং প্রীত। ওদিকে মা তাঁর হনমানজির পরসাদসমেত লাড়ু-কচৌরির ভোজনের থালি নিয়ে এসেছেন এবং বহুর দিকে বাড়িয়ে ধরেছেন। যেন মা না দিয়ে বহু দিলে খাবারগুলোর বিশ্রীত্ব একটুও দূর হবে।

রাত্তিরে পুঁটলিটি খানিকটা পদসেবা করবে তার, তারপর পরম কর্তব্যবোধে পতিদেবতার বুকের কাছটিতে আরও পুঁটলিকৃত হয়ে শুয়ে পড়বে। কী বলবে, জয়পরকাশের মনে হয় লাথ মেরে ওই পুঁটলিকে সে খাটের বাইরে ফেলে দেয়। কিন্তু কী করে, সে তো খানদানি হতে চাচ্ছে কিনা, তা ছাড়া ঘি আর আগুন পাশাপাশি থাকলেই একসময়ে জ্বলবেই, বহুদিন আগে মহাজনরা বলে গিয়েছেন।

তবে ধীরে ধীরে লোহার খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসার সেই উচ্চাকাঙক্ষা তার ফলতে লাগল। পুরোনো জিনিসই। কিন্তু এখন সে কেনে পুরোনো জাহাজ। কেনে আর তাকে ভেঙে তার লোহা, কাঠ, নাটবল্ট স-ব বেচে দেয়। এই কেনাবেচা করতে করতে ক্রমে তার মাথা এমনি পাকা হয়ে উঠল যে সে জলের দরে জাহাজ কিনে ফেলতে লাগল। একটার পর একটা। কামতাপরসাদ গোড়ার দিকে ভয় পেয়েছিলেন, এ কলেজে পড়া বেটার দ্বারা বেওসা হবে কি না হবে। তারপর যখন সে জাহাজ কেনা ধরল আতঙ্কে তাঁর মহাপ্রাণী খুবই লম্ফঝম্প করেছিল। কেননা টাকাপয়সা একগাদা লগ্নি করেই বেওসা করবে তো তোমার নাফা হবে কেন? তাঁর ক্যাপিটাল থাকত প্রায় শূন্য। তাই নাফার পরিমাণ আর পার্সেন্টেজ হত চমৎকার। প্রায় হানড্রেড পার্সেন্ট। তা বেটা তো তাঁর নয় দেখা যাচ্ছে, কোনো সাধুসন্তের হবে। সে তো চোরাই জিনিস ছোঁবে না।

এই সময়ে একদিন জে, পি-র বন্ধুস্থানীয় এক সুরজলাল তাকে বলল, বড়ো বড়ো বাড়ি ভাঙা হচ্ছে। বাড়ি তো নয় প্রাসাদ। তা সেসব বাড়ির জানলা, দরজা, ইটালিয়ান মার্বেল, টাইলস, মূর্তি, ফার্নিচার…সবই আচ্ছা আচ্ছা চিজ। সে যদি কিনে নেয় এক লটে তো বহোৎ নাফা আসবে। কথাটা জয়পরকাশের মনে ধরল। সুরজ তার বন্ধুলোক। চাটার্ড অ্যাকাউন্টেট-এর কাম করে, কিন্তু মার্কিট সম্পর্কে তার ধারণা খুব ভালো।

এইরকম এক বাড়ির মাল কিনতে গিয়ে ক-দিন তার এক অদ্ভুত দম্পতির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভাঙা বাড়ির রাশীকৃত জঞ্জালের মধ্যে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন! ভদ্রলোক ফরসা, ভদ্রমহিলা আধা-ফরসা। ভদ্রলোক অনেকটা লম্বা। ফুট ছয়েক হবেন, আদ্দির পাঞ্জাবি আর কুচোনো ধুতি পরা। মহিলাও তাঁর সঙ্গে মানানসই, এত সুন্দর কুঁচি দিয়ে কালো পাড় একটি হলুদ কি নীল শাড়ি পরেন যে জয়প্রকাশের একটা অদ্ভুত সম্ভম বোধ হত। একদিন, দুদিন, তিনদিন, সে সেদিন একাই ছিল, একটু সাহস করে এগিয়ে গিয়ে বলল, নমস্তে, আপনারা কি কুছু খুঁজছেন?

ভদ্রলোক তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিস্ময়ের সুরে বললেন, আপনি…মানে তুমি, জয় না?

জয় নামটা বহু বহুদিন পর শুনল সে। সুরজরা তো শুধু পরকাশ বলেই ডেকে থাকে।

সে এবার বলল, আপনি আমাকে চিনেন?

বাঃ চিনব না? গৌতমের কত বন্ধু ছিলে। দিনরাত তো আমাদের বাড়িতে পড়ে থাকতে।

আপনি?

আমি গৌতমের বড়দা, এখনও বুঝতে পারছ না?

ও হো হো, আপনি সেই দুশমনদা, হায় হায়!

জয় নীচু হয়ে তাঁকে প্রণাম করতে যেতেই তিনি হাত দুটো ধরে নিলেন। হা-হা করে হেসে বললেন, শুনছ, আমার নাম এরা কী দিয়েছিল? দুশমন! গৌতমটা এত শয়তান ছিল! ওর শয়তানি সব আমি কাকাবাবুর কাছে ফাঁস করে দিতাম, মাস্টারমশাইদের বলে দিতাম কিনা তাই আমাকে ও দুশমনদা বলত! তা জয়, তুমি তো বাংলা বুলি বেশ ভালোই বলতে!

জয় সম্বোধনে পুনঃপুলকিত হয়ে জয় বলল, এখনও তো বলি। বলতে পারি। তবে বলবার সুযোগ তো হয় না! বাঙালিরাও আমাদের সঙ্গে ভাঙা হিন্দিতে কথা বলেন। তা দর্শনদা, কী ব্যাপার?

সুদর্শন বললেন, আগে তোমার বউদিদির সঙ্গে পরিচয় করো। শিপ্রা, এ হল সেই জয়, তোমাকে বলতাম না আমাদের পাশের বাড়ি থাকত। আমাদের পুরানো বাড়ি গো…সেই যখন যৌথ…

হ্যাঁ হ্যাঁ হাসি-হাসি মুখে ভদ্রমহিলা বললেন।

জয়প্রকাশ বুঝতে পারল দর্শনদা কোনোদিনই তার বা তাদের কথা স্ত্রীকে বলেননি। বলবেনই বা কেন? ওঁরা অনেকদিন ওখান থেকে চলে গেছেন, অনেক বছর পার হয়ে গেছে। তা ছাড়া তার বন্ধু ছিল গৌতমদা, সে হলে হয়তো তার স্ত্রীকে বললেও বলতে পারত। কিন্তু এই ভাবিজি স্রেফ ভদ্রতার খাতিরে অমন বড়ো করে হ্যাঁ হ্যাঁ করলেন।

সে জিজ্ঞেস করল, গৌতমদা কোথায়?

সে তো বহুদিন ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছে। সেখানেই ডাক্তারি করে, সেখানেই বিয়ে শাদি করেছে। আসে মাঝে মাঝে…

তা আপনারা এখানে? কী ব্যাপার দাদা?

আর বলো কেন? শিপ্রার বাবার বাড়ি এটা। বিক্রি হয়ে গেল।

শিপ্রাভাবি যেন কেমন একরকম করে দাদার দিকে চাইলেন। পুরো চোখে চেয়েই আবার চোখটা ফিরিয়ে নিলেন।

তা সে যাই হোক, এসো আমার বাড়ি একদিন…ভালো কথা তুমি এখানে কেন?

আমি এই ভাঙা বাড়ি কিনেছি দাদা।

আচ্ছা! অবাক হয়ে উনি বললেন, কিনেছ!

আজ্ঞে।

কী করবে?

এই সব কাঠকাঠবা, জাফরি, মার্বেল সব আলাদা আলাদা দামে বিক্রি হবে দাদা।

ভাবি তখন দাদার দিকে চেয়ে মিনতির সুরে বললেন, তা হলে ওঁকে বলো না

কী হবে? দর্শনদা হাত উলটোলেন।

কী ব্যাপার? বলুনই না!

দর্শনদা বললেন, আরে ওঁর কিছু প্রিয় ছবি ছিল বাড়িতে। সে ছবিগুলো তো উনি বিক্রি করেননি। কিন্তু প্রোমোটাররা সবসুদ্ধ নিয়ে নিয়েছে। ভেঙে চুরে একাকার সব। আমারা ছবিগুলো খুঁজতে আসি। এটা ওটা সরিয়ে, যদি পাওয়া যায়।

জয়প্রকাশ দেখল ভাবি অন্য দিকে চেয়ে আছেন। খুব সম্ভব, সজল চোখ দুটো আড়াল করবার চেষ্টা করছেন।

আপনি কীভাবে বেচেছিলেন দাদা?

আরে ভাই আমি কি অত কুটকচালে জানি? তবে অ্যাজ ইজ হোয়ার ইজ বেচিনি। বেচেছি উইথ ফিটিংস অ্যান্ড ফিক্সচার্স। এখন তুমিই বলো না ছবি কি ফিটিংস এর মধ্যে পড়ে? ও তো হুক থেকে খুলে নিলেই হয়ে যায়। সে কথা প্রোমোটারকে বলতে বলল, আমি তো বাড়ি কিনেই ভাঙার অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। কোথায় কী ছবি আমি জানি না। তো এখন দেখো, তুমি যখন ভাঙার কনট্রাক্ট নিয়েছ, ছবিগুলো তুমি উদ্ধার করতে পার কি না। মামলা-টামলা করাই যায়। কিন্তু এখন আর এর জন্যে মামলার খরচ চালাতে আমি রাজি নই। মানে ক্ষমতা নেই।

দেখি কী করতে পারি ভাবিজি–জয় বিনীতভাবে বলল, তবে ভাঙার কনট্রাক্ট আমার না। তার জন্য অন্য নোক আছে। আমি ভাঙার পর এইসব মাল কিনেছি। যদি খুঁজে পাই নিশ্চয় আপনাকে দিয়ে আসব। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।

সল্টলেক পূর্বাচলে সুদর্শন সরকারের ফ্ল্যাট। বেশ প্রশস্ত, সুন্দর। তাতে পুরোনো বাড়ি থেকে কিছু কিছু ফার্নিচার রেখেছেন ভাবি। যেমন ডাইনিং চেয়ার। সেসব কবেকার, কোন আমলের ফার্নিচার কিন্তু গ্লেজ দিচ্ছে কী? আলমারিটা অবশ্য বেডরুমে। একবার পর্দা সরিয়ে ভাবি বেরোবার সময়ে এক ঝটকা দেখা গেল। যেমন বিরাট, তেমন সুন্দর।

দর্শনদা বললেন, বেশিরভাগই এত বড়ো আর এত ভারী যে আমাদের ভাই সাধ্যে কুলোল না যে রাখি। তোমার ভাবির এজন্য অবশ্য খুবই নালিশ আমার কাছে।

আকাশি রঙের ডুরি শাড়ি-পরা ভাবি চা দিচ্ছিলেন। এক গোছা চুল হাত দিয়ে সরাতে সরাতে শুধু বললেন, আমি কিন্তু আনরিজনেবল নই জয় ভাই। একেবারেই না।

আচ্ছা দাদা, মনে কিছু করবেন না, আপনি আজকাল করেন কী? এঞ্জিনিয়ারিং পড়তেন না?

ভাবি তাড়াতাড়ি বললেন, আরে সে তো অনেক দিনের কথা। বিচ্ছিরি ধরনের লাম্বার স্পন্ডিলাইটিস হল, উনি কাজ ছাড়তে বাধ্য হলেন।

কোনো চিকিৎসা নেই এর?

চিকিৎসা তো হচ্ছেই, হয়েই চলেছে, কিন্তু রোগটা বাড়ে কমে, একেবারে সারে না।

দু-চারদিন আসাযাওয়া করেই জয়প্রকাশ অবশ্য বুঝে গেল। এই কাজ না করে করেই শ্বশুরের বাড়িটি ফুকে দিয়েছেন ইনি। সম্ভবত ওই বাড়ির মূল্য দিয়েই এই ফ্ল্যাট কেনা এবং কিছু আমানত করা—তাতেই এঁদের চলে। ছেলেপুলের কথা তুলতেই দুজনে উদাস হয়ে যান। এ কথা জয়প্রকাশ কিছুতেই বুঝতে পারে না তার পুঁটলি পত্নী যদি তাকে বারো বছরে ছটি সন্তান উপহার দিয়ে থাকতে পারে তা হলে এই পরিপাটি চমৎকার চাঁপা রঙের ভাবিটি কেন এতদিনে একটিও…না, এসব ভগবানের খেলা।

চিৎপুরের বাড়ির চিত্রের খোঁজও চলেছে, এদিকে জয়প্রকাশও সুদর্শন সরকারের বাড়ির নিয়মিত অতিথি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কিছু না, এই চমক্কার কারুকার্যের নীচু টেবিল সামনে নিয়ে আরামদায়ক মেরুন সোফায় হলুদ কালো কুশনে ঠেস দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকা, মাছের চপ, কি মাংসের কাটলেট রেস্তোরাঁর মতো, কি তার চেয়েও ভালো বানান শিপ্রাভাবি আর চা-টা তো দার্জিলিঙের ফ্লেভারে ভরা। ঢাললে গোটা ঘরটাই সুগন্ধে ভর ভর করে। আর কিছু নয়, হলুদ কিংবা গোলাপি কিংবা আকাশি কিংবা সাদা শাড়ি পরা একজন সভ্য সুশ্রী মহিলা, যাঁর গলার স্বর, ভাষা, চলনের ধরন সবই মানুষকে নেশায় ফেলে দেয়। নেশাও নয় ঠিক। একটা শান্তি, শান্তি দেয় মানুষকে, সেই তাঁর সমীপে বসে নিজেকে শান্ত, সুস্থ, স্বস্তিমান করে তোলা, আর সেইসঙ্গে সেই ছেলেবেলার অমল দিনগুলো, গৌতমদার সঙ্গে অচ্ছিন্ন অভিন্ন খেলাধুলোর খেলাভোলার দিনগুলোর স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করা।

এই সময়েই সে খবর পেল প্রামোটার রামলগন বৈদ মুম্বই থেকে ফিরে এসেছে। রামলগন তার বন্ধু না হতে পারে, চেনাশোনাও খুব না থাকতে পারে, কিন্তু দেশোয়ালি তো! বলা-কওয়া কিছু না করে জয়প্রকাশ একদিন প্রায় প্রত্যুষে রামলগনের কোঠিতে হাজির হয়ে গেল। রামলগন তখন লোটাভর ভইসের দুধ গিলছে।

আরে আরে জয়পরকাশজি, আপ ইত্যা সবেরে!

কোনো ভূমিকা না করেই জয়প্রকাশ বলল, ধান্ধে মে আয়া ভাই। পেইন্টিং হ্যায় না ও চিৎপুর কী কোঠির? উও সব নিকলাইয়ে।

কাঁহা তসবির? ক্যা তসবির।–রাগ-রাগ মুখ রামলগনের। কিন্তু জয়প্রকাশের কঠিন দৃষ্টির সামনে সে ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে তা বুঝতে জয়প্রকাশের দেরি হল না।

উইথ ফিটিংস অ্যান্ড ফিক্সচার্স কিনেছেন শুনছি, তা তসবির ফিটিংস না ফিক্সচার্স কোন ক্যাটিগরিতে পড়ে রামলগনজি?—তার গলা উত্তরোত্তর কড়া হচ্ছে, সুদর্শন সরকার আর তার মিসেস আপনার বিরুদ্ধে কেস করবেন। খাস গাওয়া আমি আনব। বাস, হয়ে যাবে আপনার মাল্টিস্টোরিড, বারোটা বেজে যাবে আপনার রিয়্যাল এস্টেটের কারবারের।

আরে, ভাই বৈঠেন। এই কে আছিস রে? জয়পরকাশজির জন্যে মসালা চায় আর কচৌড়ি নিয়ে আয়। বসুন ঠান্ডা হয়ে, তবে তো কথা করবেন!

রামলগনের চেয়ে জয়প্রকাশের ব্যক্তিত্ব বেশি দেখা গেল। ছবির কথাটা সে বেশিক্ষণ অস্বীকার করতে পারল না। তবে কিছুক্ষণ পরেই তার চোখদুটো অন্য কোনো মতলবে চকচক করে উঠল। সে আসলে এই বিশেষ কাজেই মুম্বই গিয়েছিল, সেখান থেকেই বুঝে এসেছে কত গেঁহুর দানার কত আট্টা। ছবির বান্ডিলটা সে বার করে আনল। ভাবির দেওয়া লিস্টটা আজকাল জয়প্রকাশের পকেটেই ঘোরে। লিস্টে আসলে মেলানো শুরু হয়।

১ নম্বর—রাজা নল দয়মন্ত্রীর কাছে হংসদূত পাঠিয়েছেন। থামের ওপর সেই হংস, সামনে থামে কনুই রেখে দময়ন্তী।

২ নম্বর—দ্রৌপদী স্বয়ংবর। অর্জুন লক্ষ্যভেদ করছেন। দ্রৌপদী ধৃষ্টদ্যুম্নর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন বরমাল্য হাতে।

৩ নম্বর—নীলচে সাদা জলের টইটম্বুর সরোবর। ভেতর থেকে উঠে আসছেন গোলাপবর্ণ দেহত্বকের এক লাবণ্যময়ী সিক্তবসনা সুন্দরী।

৪ নম্বর—সাদা-কালো আরও কিছু গাঢ় রঙের আলোছায়ায় নকশা মতো। যেন ভূতের-বাড়ি।

৫ নম্বর—খোয়া-ওঠা গর্ত-অলা লালচে মাঠ। গোরুর পাল তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে রাখাল। সময় গোধুলি শেষ।

৬ নম্বর—একটা লম্বা টেবিলে বারোজন আলখাল্লা পরা শিষ্য বসে আছে। মাঝখানে যিশু। রুটি ভাগ করে দিচ্ছেন।

৭ নম্বর–কাটা ছেঁড়া মানুষের হাত পা ঘোড়ার মুণ্ডু—এসব দিয়ে এক আজব নকশা।

রামলগন বলল, সমঝলেন না জয়পরকাশজি। এই ছে আর সাত হল ছবির প্রিন্ট। বিলাইতি ছবি, ছেপে ছেপে বিক্রি করা। এগুলোর তেমন কোনো দাম নেই। কিন্তু বাকি পাঁচটা এক্কেবারে আসলি চিজ। এসব আর্টিস্টদের নিজের হাতে আঁকা, কেউই আর জিন্দা নেই। আজকাল ছবির বাজার গরম। এসব পুরোনো পেইন্টিং কোনোটা লাখ, সওয়া লাখের কম হবে না। এসব ফিরৎ দিব কেন? আপনি আমি শেয়ার করে লিবো।

কথা না বার্তা না। বাঁধানো ছবির বান্ডিলটা জয়প্রকাশ তুলে নিল। তার মুখ থমথম করছে।

রামলাল হাঁ হাঁ করে উঠতে না উঠতেই সে কড়া গলায় বলল, চোরির মতো গন্ধা কামে আমি আপনাকে মদৎ করবো সোচছেন তো ভুল সোচছেন রামগলনজি। হয় এ ছবি ফিরত, নয় মামলা। ওঁরা আমার বন্ধুলোগ।

দেখেন উ সব মামলা-উমলা আমি থোড়ি ভয় পাই।—রামলগন বলল, খালি ডেট লিব, খালি ডেট লিব। ও বাঙ্গালিবাবুকে আমি চিনি, ও সির্ফ হ্যারাস হয়ে ছেড়ে দিবে। লেকিন, আপনি যখন বলছেন আপনার বন্ধুলোগ, তো ঠিক হ্যায় জি, এক কাম করুন, ও পাঁচটার মধ্যে থেকে একটা অন্তত আমায় দিন।

ঝুললাঝুলি করে প্রথম ছবিটি আদায় করে নেয় রামলগন।

অতঃপর ছবির বান্ডিল নিয়ে একদিন সুদর্শন সরকারের ফ্লাটে গিয়ে ভাবিজির পায়ের কাছে পুষ্পর্ঘ্যের মতো সেগুলো নামিয়ে রাখে জয়প্রকাশ। শিভাবি ভীষণ আগ্রহে, ভীষণ স্নেহে খুলছেন ছবির মোড়ক। কাচ একটু আধটু ফেটেছে, ধুলোর দাগ কাচের ওপর।

আর? আরগুলো? রবি বর্মা, হেমেন মজুমদার, আমার গগনঠাকুর, যামিনী গা,… কথা শেষ করতে পারেন না শিপ্রাভাবি। গলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

এইসব মানুষদের পোট্রেট ছিল বুঝি? আপনাদের আপনজন? তা এসব তো আপনার লিস্টে ছিল না ভাবিজি।

শিপ্রা কোনো মতে বলেন, না, না, পোট্রেট নয়, ওঁদের আঁকা ওগুলো।

এ দুটো অনেক কষ্টে রাবল-এর মধ্যে থেকে উদ্ধার করেছি ভাবিজি। দেখুন না সিসা কেমন ফেটে গেছে। রামলগন আপনার প্রোমোটার বলছে বাড়ি কিনেই সে ভাঙতে দিয়ে খালাস, আর কিছু জানে না।

ফ্যাকাশে মুখে চা ঢালতে লাগলেন হলুদ শাড়ির ভাবি। হাত থরথর করে কাঁপছে। প্রাণপণে আত্মসংবরণ করতে চেষ্টা করছেন তিনি। নেহাত বাইরের মানুষ যেন বুঝতে না পারে তাঁর ক্ষতির পরিমাণ, আবেগ, কষ্ট, হতাশা। চোখ ভরে সেই বেপথুমতীকে দেখতে থাকে জয়পরকাশ, নাক ভরে নিতে থাকে বাস আর ভাবতে থাকে যদি লাখ দেড়েক করেও হয় গড়, তা হলে চারটেতে সে পায় ছয় লাখ। আর একটু কমিয়ে ধরলে পাঁচ। পিতাজি বলেন, আমি আর আমার বাবুজি জিরো ক্যাপিটাল থেকে এত বড়ো কারবার বানিয়েছি বেটা—এই মকান, হাবেলি এই গাড়ি। আর তুমি খালি টাকা লাগাচ্ছ, টাকা লাগাচ্ছ।

জয়পরকাশ একটু হাসে। এখন এটাকে পিতাজি কী বলবেন? জিরো ক্যাপিটালই তো? আর নাফা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *