মাহ ভাদর

মাহ ভাদর

শহরের অবিরাম ঘূর্ণমান কর্মচক্রের কেন্দ্রবিন্দু থেকে অনেক দূরে নতুন বাড়ি বানিয়েছেন মুখার্জি-দম্পতি। দূরে দূরে ছোট্ট ছোট্ট বাগানের মধ্যে পুতুলের বাড়ির মতো বসানো বাসগৃহ। সুন্দর, সুন্দর ছাঁদ। লাল টালি, কাচ-ঢাকা বারান্দা, হাঁসের পালকের মতো মসৃণ গা। বেশ লাগে দেখতে। কিন্তু নির্জন। বড্ড নির্জন। রাত আটটার পরই নিশুতি হয়ে যায় একেবারে। বাজার-হাটও একটু দূরে। কিন্তু ভোর সকালে বহুবিধ গাছপালায় সবুজ ছায়াপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাও। প্রাতভ্রমণও হবে, আবার বাজারও হবে। মন্দ কী। মুখার্জিসাহেব পরিতুষ্ট মুখে চারদিকে চেয়ে গিন্নিকে বলছেন, কী গো? অসুবিধে হবে খুব?।

হলেই বা করছি কী? গৃহিণী ঈষৎ অভিমানের সুরে বললেন।

কেন? তিন লিটারের ফ্রিজ কিনে দিয়েছি। সব স্টোর করো। ওষুধপাতি, পোস্টেজ—এসবও স্টকে থাকবে। টেকনলজির যুগ। ওয়াশিং মেশিন থেকে, ভ্যাকুয়াম-ক্লিনার থেকে কোনটা নেই? বই পড়ো, বাগান করো আর গান শোনো। টেলিভিশনে সারা গ্লোবের খবরাখবর নাও। যেটা যখন ভালো লাগে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা নির্জনতা, খানদানি নির্জনতা একেবারে। উপভোগ করো। এনজয় করো সেটা।

মুখার্জিগিন্নি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বুড়ো বয়স এমনিতেই নির্জন। হাজার মানুষ আশপাশে ঘুরলেও মনে হয় কেউ নেই। যাদের সঙ্গে এক স্মৃতি ভাগ করে বাঁচা, তারা সব চলে গেছে। যারা আছে তারা অন্য প্রজাতির জীব যেন। নির্জনতা আর কাকে বলে? এই নিঃসঙ্গতা যেন পাষাণভার, বুকের ওপর ক্রমশই ভারী হয়ে চেপে বসছে। আর উনি এলেন এখন নির্জতার ওপর লেকচার দিতে। দূর দূর!

তা ভোরবেলা সত্যি সত্যিই প্রাতভ্রমণের নাম করে বাজার আর বাজারের নাম করে প্রাতভ্রমণ সারেন মুখার্জি সাহেব। পরনে খাকি শর্টস, হাফহাতা মোটা সুতির ভেস্ট, পায়ে কেডস আর হাতে লাঠি। ঘুরতে ঘুরতে একসময়ে চুরুটটা ধরিয়ে নেন। ফিরে একপট চা নিয়ে দুজনে বসবেন, পাটশাক পেয়েছি আজ, কিংবা একেবারে ফ্রেশ পটোল বুঝলে? খয়রা মাছগুলো ঠিক খাবার আগে কড়কড়ে করে ভাজবে। এসব জিনিস তুমি শহরে পাবে না। সেখানে পুঁতেয় ভেজানো পটোল, শাকে ইনসেকটিসাইডের গন্ধ, বুঝলে?

নিঃশব্দে চা ঢালতে ঢালতে স্বামীর যাবতীয় কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আর এক কান দিয়ে বার করে দ্যান মুখার্জিগিন্নি। তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে, এখন পাটপাতা আর ফ্রেশ পটোল নিয়ে আদিখ্যেতা ভালো লাগে না তাঁর। টাটকা খয়রা মাছ! হুঁ! মাছের জন্যে তো তিনি মরে যাচ্ছিলেন কি না!

চা খেয়ে বাগানে নেমে পড়েন সাহেব। খুরপি দিয়ে খোঁচাখুঁচি। এটা তুলে ফেলা, ওটা বসানো। ঝারি কিনেছেন একটা। গাছে জল দিতে দিতে মুখ থেকে হাসির ছটা বেরোতে থাকে একেবারে। গিন্নি এই সময়ে খুটুরখুটুর করে গৃহকর্ম আরম্ভ করেন। অল্পস্বল্প ফার্নিচার। সব নরম কাপড় দিয়ে ঝকঝকে করে মোছেন। কাচগুলো খবরের কাগজের টুকরো জলে ভিজিয়ে পরিষ্কার করেন। উমি আসে, সে বাসন ধুয়ে, ঘরদোর পরিষ্কার করতে থাকে, বলে, নতুন করে মোছামুছি আর কী করব দিদিমা, সব তো পরিষ্কারই আছে গো। থাকত একটা কচিকাঁচা তো হন্ডুল-মভুল করে দিত তোমার সব। তখন উমির কাজ বাড়ত। ন্যাতা টানে আর আপনমনে বকবক করে যায় উমি, সতৃষ্ণ শ্রবণে শুনতে থাকেন মুখার্জিগিন্নি। উমি কাজ সেরে চলে গেলেই একটু দূরে গুড়ি-মেরে বসে-থাকা নির্জনতাটা আবার হুড়ুম করে এসে পড়বে, গ্রাস করে নেবে এই ছোট্ট ফ্লাওয়ারি নুক।

উমি বলে, এবার চানটা সেরে নাও গো দিদিমা, আমি কাপড়চোপড়গুলো কেচে, মেলে দিয়ে যাই।

নিতান্ত অনিচ্ছুকভাবে মুখার্জিগিন্নি চানঘরে ঢুকে যান। তাঁর রান্না সারতে আর কতটুকু সময় যাবে? দুই বুড়োবুড়ির রান্না। এটা বারণ, সেটা চলে না। পরিমাণও খুব কম। তবে মুখার্জি সাহেব শৌখিন খুব। নানান রকম খেতে ভালোবাসেন। তাই টুকটাক করে হালকা হালকা খাবার বানান গৃহিণী। পনির অ্যাসপারাগাস, মটর ডালের বড়ি দিয়ে পাটপাতা, মৌরলা মাছের টুক, বেগুন-বাসন্তী। এইটুকু একমুঠো বানান। তাইতেই ঢের হয়ে যায়, ঢের। বিকেলে বাসন ধুতে এসে উমি বলে, তোমাদের যেন পুতুলের ঘরকন্না, এইটুকুনি-টুকুনি বাটিতে কী খাও গো দিদিমা?

কেন ডাল?

ঘন ক্ষীরের মতন করো বুঝি?

দূর, পাতলা সুপের মতো ডাল চুমুক দিয়ে না খেলে খাওয়াই হয় না তোর দাদুসাহেবের।

উমি, মুখার্জি সাহেব উঁচু দরের দামি মানুষ বুঝে শুধু দাদু বলে না, বলে দাদুসাহেব। আর মুখার্জি সাহেব উমিকে বলেন শেঠ উমিচাঁদ। দিদিমার সঙ্গে কথাবার্তা জমলেই তিনি বলবেন, এই যে শেঠ উমিচাঁদ, ষড়যন্ত্র কদূর এগোল?

বিকেলবেলা রোজই দুজনে হাঁটতে বেরোন। শীতকালে চারটে নাগাদ।

গরমকালে আর একটু পরে। তখন সাহেবের পরনে তাঁতের সূক্ষ্ম ধুতি, ফিনফিনে পাঞ্জাবি, কাঁধে চাদর, হাতে রুপো বাঁধানো লাঠি। এটা গরমকালে। শীতে ঢোল্লা গরম কাপড়ের ট্রাউজার্স। গিন্নির বুনে-দেওয়া কার্ডিগান, মাফলার, মাথায় কানঢাকা টুপি। মুখার্জিগিন্নি কী শীত কী গ্রীষ্ম ধবধবে সাদা বাহারি পাড়ের টাঙ্গাইল শাড়ি। সাদা ব্লাউস। শীতকালে উলের জামা, হাতা-অলা সোয়েটার আর তার ওপর গরম শাল।

বেরোবার সময়েই চা-টা খেয়ে নেন দুজনে। ফিরে খেলে বড়ো দেরি হয়ে যায়, রাতে ঘুম হয় না। ফিরে দুজনের কারোই কোনো কাজ নেই। গোল বারান্দায় বসে গান শোনেন মুখার্জিসাহেব। পুরোনো দিনের গান—কানা কেষ্ট, ভীষ্মদেব, শচীন দেববর্মন এইসব। কিংবা বাজনা শোনেন, মেনুহিনের ভায়োলিন। বিদেশি সব বাখ মোৎসার্ট মেন্ডেলসন-ফন গুচ্ছের কী যেন আছে! একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যান ঘ্যানঘ্যান করে বেজে যায়। সাহেবের মন রাখতে বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকেন গৃহিণী, তারপর টুক করে উঠে পড়ে গুটিগুটি ঘরের ভেতরে চলে যান। একটু আয়নার সামনে দাঁড়ান। একটু এ ছবি দেখেন, একটু ও ছবি, পিকাসো না কি ছাইভস্ম। অসভ্য ছবি সব। কাঞ্চনজঙ্ঘার লম্বা পোস্টার একখানা—বরফে বরফ। তিনি ফিরে দাঁড়িয়ে বিছানার টান-চাদর আবারও টানটান করেন। তারপর আঁচল থেকে চাবি নামিয়ে আলমারি খোলেন, লকার খোলেন। লকারের ভেতর সোনাদানা নেই। হীরে-মুক্তো কিছু নেই। রয়েছে কয়েকটা ফটো। অ্যালবাম। বাস। যে-কোনো একটা নামিয়ে নেন। তারপর খাটের পাশের হেলানো চেয়ারে বসে অ্যালবামের পাতা খোলেন বেরিয়ে পড়েন রায়বাহাদুর মাখনলাল চ্যাটার্জি। তাঁর বাবা। ইয়া গোঁফ, সুট কোট হ্যাট, একেবারে পুরোদস্তুর সাহেব। রংটি ছাড়া। তা রং তো আর ফোটোগ্রাফে বোঝা যায় না। তাঁদের বিয়ের ছবি। বিয়ের পরেই ভোলা। ইলাস্ট্রেটেড উইকলিতে দেওয়া হয়েছিল। মুখার্জিসাহেবের চেহারাটা তখন কত ভালো ছিল! স্বাস্থ্যবান, উজ্জ্বল যুবক। পাশে তিনি, খুব রোগা। গলার হাড় দেখা যাচ্ছে। চুড়িবালা হাতে ঢলঢল করছে। মাথায় ঘোমটা নেই। ঘোমটা খুলে দিয়েছিল ফোটোগ্রাফার, আজকাল আর ফোটোতে চলছে না। দেখে শাশুড়ির কী রাগ। যতই সাহেব-মেমসাহেব হও, নতুন বিয়ের কনে মাথায় ঘোমটা থাকবে না? এ ছবি দেখলে এ–বাড়ির গুরুজনরা সব বলবে কী? আবার আলাদা করে ঘোমটা দেওয়া ফোটো ভোলা হল। সেই ফোটোই বাঁধানো তাঁদের টেবিলের ফোটোস্ট্যান্ডে থাকত।-হাজারিবাগে বাড়িসুষ্ঠু সব যাওয়া হয়েছিল, রোজ পিকনিক! রোজ পিকনিক! সেখানে পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে আলাপ! কত গান, কত গল্প! সেই সব ফটো। অনিরুদ্ধ ঠাকুরপোর ছবি। জ্বলজ্বলে চেহারা, হাসিটা কী! একেবারে জ্যান্ত। চোখের সামনে যেন ভাসছে! চীনের যুদ্ধে মারা গেল। অনেকক্ষণ ধরে ছবিটা খুলে বসে থাকেন মুখার্জি গিন্নি।

আরে কোক খাবে তো ক্যানের কোক খাও, মুখের সামনে ক্যান খুলে ধরছে।

আসল জিনিস। খেলেই তফাতটা ধরতে পারবে। কত জিনিস আনত, দু হাতে উপহার দিত, এনতার খরচ করত। পাতা ওলটালেন মুখার্জিগিন্নি, একটি রুমুঝুমু চুলঅলা শিশু বেবি-ফ্রক পরা, নিদন্ত মুখে হাসছে। এ ছবি অনিরুদ্ধ ঠাকুরপোর তোলা। তলায় লেখা বুড়িমায়ি, পঁচিশে নভেম্বর, উনিশশো তেষট্টি।

খসখস শব্দ, চটি ঘষতে ঘষতে মুখার্জিসাহেব ঘরে ঢুকছেন। চকিতে গৃহিণী অ্যালবামটা বন্ধ করে দ্যান। ঘরে ঢুকে আড় চোখে অ্যালবামটা দেখেন সাহেব। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, ও সব তো পাস্ট, ইতিহাস নিয়ে কি আর বাঁচা যায় গিন্নি, বাঁচতে হয় বর্তমানে। প্রেজেন্ট কন্টিনুয়াস। এই মুহূর্তে কী হচ্ছে, আমি কী করছি, কেন করছি—এই।

বাঁচার দরকারটা কী? মৃদু, থমথমে স্বরে কথাগুলো বলে মুখার্জিগিন্নি ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। হালকা কী একটা গন্ধ-অলা ট্যালকম পাউডার মাখেন, সেই গন্ধটা অতীতের সুখস্মৃতির মতো ঘরের হাওয়ায় ভেসে থাকে। নিশ্বাস ফেলে মুখার্জিসাহেব অ্যালবামটা তুলে নেন। অন্যমনস্কভাবে যে-কোনো একটা পাতা খুলে ফেলেন। অমনি বেরিয়ে পড়ে কালো গাউন পরা মাথায় ঝালর অলা টুপি, হাতে গ্রাজুয়েশনের সার্টিফিকেটটা পাকানো, এক তরুণী। হাসছে। তলায় লেখা বুড়িমা ১৯৮৩। দেখতেই থাকেন, দেখতেই থাকেন। অবশেষে কাপড়ের খসখস শব্দ পান পিঠে ঝনাত করে চাবি ফেলার শব্দ। গিন্নি আসছেন। চট করে অ্যালবামটা বন্ধ করে বিছানার ওপর যেখানে ছিল, সেখানে রেখে দিয়ে নিজের কামানো গাল পরীক্ষা করতে থাকেন মুখার্জি সাহেব। যেন ভীষণ চিন্তিত, কাল সকালে দাড়িটা কামাবেন, না কামাবেন না।

গৃহিণী ঢুকে কোনোদিকে না তাকিয়ে ঝনাত করে আলমারি খোলেন, কড়াক করে লকারের চাবি ঘোরান, অ্যালবামটা রেখে দ্যান। চাবি বন্ধ করেন পর পর, তারপর বলেন, এত তো গান শোনো, গান শুনলে তো জানি মানুষের মনমর্জি নরমসরম হয়। তা যদি না-ই হয় তো শোনা কেন? তিনি যত দ্রুত সম্ভব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। মুখার্জিসাহেব জানালার বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। এতক্ষণ, যে মনে হয় তাঁকে কেউ স্টাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে গেছে।

সকালবেলায় বেরিয়ে একদফা আলাপ হয় স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে। তার মধ্যে সবজিঅলা তাজু, মুরগিঅলা কিষেন, মাংসকাটা আনোয়ার, ডিমঅলা ভুবন এরা আছেই।

ও সাহেব, পরশু দিনকেই তো মুরগি নিলেন। আজ আমার কাছ থেকে একটু খাসির মাংস নিয়ে যান না। অনুযোগে অনুরোধে মিশিয়ে আনোয়ার বলে।

আরে বাবা, রেড মিট আমাদের চলে না। মুরগি, তা-ও তোর দিদিমা খায় না। তবে নেব, নেব। বাড়িতে লোকজন এলে দেখবি নিয়ে যাব।

কবে তোমার বাড়ি লোক আসবে?—কাঁচা গলায় ডিমঅলা ভুবন বলে। বারো তেরো বছরের ছেলেটা। ভুবনের কাছ থেকে ডজনখানেক ডিম কিনে সবজিবাজারের দিকে এবার এগোন মুখার্জিসাহেব। উদাস গলায় বলেন, আসবে, আসবে…।

ছোটো বাজার। যা এল তা এল। তার বাইরে আর কিছু নেই। তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। —বেগুনগুলো কেমন চিকন দেখুন সাহেব তাজু তার আজকের পসরা নিয়ে বড়াই করে। মামুলি আলু পেঁয়াজ ছাড়া আজ তার কাছে ওই বেগুন।

চিকন তো বলছিল খুব! কানা নয় তো! ভাবিসনি আমি দেখতে পাবো না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেন মুখার্জিসাহেব। শাকে ভিটামিন, মিনার্যালস আছে। টাটকা শাক তিনি রোজ কিনবেন। বাঃ, আজ বড়ো বড়ো পালং পাতা রয়েছে। চট করে থলি খুলে ধরেন তিনি। মাছ? মাছ বসেনি? ছোটো ছোটো পোনা, চারাও নয়, বড়োও নয়। মাছঅলা ডোম্বল বলে, একেবারে লাফাচ্ছে দাদুসাহেব, ঝালে খাবেন, ঝোলে খাবেন, ভাজা খাবেন, মুখ ছেড়ে যাবে, তাকত বাড়বে।

ছোটো বাজারের ব্যাপারী। বড়ো বড়ো শহরে বাজারের বিক্রেতাদের ঘমন্ড এদের নেই। যত না বিক্রিবাটা হয়, তার চেয়ে বেশি হয় গল্পসল্প, একটু ডাকাডাকি করে মানুষকে বুঝি আপন করে নেওয়া।

বাজারে আসেন আরও দু-পাঁচজন ভদ্রলোক। বিকাশ গাঙ্গুলি, অজয় মান্না, প্রীতম সিংহ, বীরেশ্বর মহাপাত্র। প্রায় সকলেই মুখার্জিসাহেবের থেকে ছোটো। জিনিসপত্রের দর নিয়ে, শহরের ক্রমবর্ধমান দূষণ নিয়ে, সংস্কৃতির হাল নিয়ে আলোচনা হয়। তাঁর থেকে ছোটো হলেও দেখা যায় এঁরা তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে যাচ্ছেন। শহর থেকে দূরে হওয়া সত্ত্বেও এই জায়গায় বাস করতে এসেছেন দূষণমুক্ত হাওয়া, শব্দহীন দিনরাতের খোঁজে। বিকাশবাবু বলেন, আমি তো প্রায় বার্ডওয়াচার হয়ে গেলাম মুখার্জিদা। এত রকমের যে পাখি আছে, তারা যে শুধু বইয়ের পাতায় থাকে না, বাস্তবেও নড়েচড়ে উঠে ডেকে বেড়ায়—তা আমার জানা ছিল না। অনেকেরই গাড়ি আছে। প্রীতম তো গাড়ি নিয়েই অফিস করে। ট্রাভল এজেন্সি আছে তার। শহরে চলে যায় হুশ করে। একটা পার্ট-টাইম ড্রাইভার পেলে মুখার্জিসাহেবও গাড়ি রাখতে পারেন। নইলে আজ কাল আর গাড়ি চালাতে ঠিক ভরসা পান না। তা প্রীতম বলে, গাড়ি রাখবেন কেন আঙ্কল, হররোজ তো দরকার হচ্ছে না। কোথাও যেতে হলে প্রীতম আছে। প্রীতমকে ডেকে নেবেন।

তা এসব আলাপ মুখার্জিসাহেবের একার। আসল আলাপসালাপ হয় বিকেলবেলা। সস্ত্রীক বেড়াতে যাবার সময়ে। তখন মিসেস বিকাশ, মিসেস ও মিস মহাপাত্র, মিসেস মান্না, তাঁর দুরন্ত নাতি—এঁরাও বেরিয়ে পড়েন।

মিসেস বিকাশ একদিন বললেন, ছেলেমেয়ে সব বিদেশে, বাইরে বুঝি, বউদি?

মুখার্জিগিন্নি কিছু উত্তর দেবার আগেই সাহেব বললেন, না, নেই, আমাদের নেই অণিমা, দুর্ভাগ্য!

পরে বিকাশবাবু বাড়িতে এসে গৃহিণী অণিমাকে ভীষণ বকাঝকা করেন। শহর ছেড়ে এসেছ বলে কি সভ্যতা-ভব্যতার অভ্যেসগুলোও সেখানে রেখে এসেছ? সেই এক মেয়েলি কৌতূহল—ছেলেপিলে ক-টি? আমার দিদিমা-ঠাকুমাকেও বলতে শুনেছি, মা-মাসিদেরও বলতে শুনেছি, আর আমার ডবল এম. এ. গিন্নিকে বলতে শুনছি। ছিঃ!

অণিমা ডবল এম, এ মানুষ, মোটেই বকাবকি মেনে নেন না! ঝাঁঝাল গলায় বলেন—শহুরে সভ্যতার মুখোশ জীবনভর বয়ে বেড়াবে তো তুমিই বেড়াও। আমি মানুষ, মুখোশ নই, বুঝলে? মানুষই মানুষকে এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাকরি করে, পরস্পরকে জানতে। মেয়েলি কৌতূহলেও নয়, আর কাউকে অপদস্থ করতেও নয়।

তা সে যাই হোক, বকুনিটা অণিমা গাঙ্গুলির ওপর দিয়ে গেলেও, দরকারি খবরটা সবারই জানা হয়ে গেল। মান্নাদের, মহাপাত্রদের, সিংদের, আরও আয়েঙ্গার, সেনগুপ্ত, রায়চৌধুরি যে যেখানে ছিল সবার। অরিন্দম মুখার্জি সেন্ট্রাল গভর্মেন্টের বড়ো চাকুরে, রিটায়ার্ড হবার পরও প্রাইভেট একটা কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অনেকদিন, ধনশালী লোক, স্ত্রীটি সেকালের গ্র্যাজুয়েট হলেও অতি ভালোমানুষ। এঁদের ছেলেমেয়ে নেই। নিঃসন্তান। অনিল সেনগুপ্ত বলেন, এ নিয়ে তোমরা এতো খেদ করছ কেন আমার মাথায় আসছে না ভায়া, আমাদের অনেকেরই তো আছে। আমার তো শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে পাঁচটি। বড়ো বস্টনে, মেজ অস্ট্রেলিয়ায়, সেজ বোম্বাই, বড়ো মেয়ে ডেড অ্যান্ড গন, ছোটোটি কানেটিকাট। তা হরেদরে তো সেই একই হল, না কি? যাঁহা পাঁচ তাঁহা শূন্য কেমন কি না?

এই অনিল সেনগুপ্তর বাড়ি নিমন্ত্রণ রাখতে গিয়েই সুরাহাটা হল। অনিলের স্ত্রী সাহানার ছায়ার মতো ঘোরে একটা রোমশ বেঁটে ভুটিয়া কুকুর পুটপুটি। কালো পুঁতির মতো চোখ হালকা খয়েরি রঙের লোমের ক্লোকটি পরে সে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায় আর ছোট্ট একটি নাতিপুতির মতো সাহানার আঁচল কামড়ে থাকে। লোকজন এলে কিছু দূরে চলে যায়। এবং থাবায় মুখ রেখে পিটপিট করে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে। একটুও হিংসে-বিদ্বেষের লক্ষণ নেই। অভ্যাগতরা যতক্ষণ থাকবেন সে এইরকম সভ্যভব্য হয়ে থাকতে থাকতে এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়বে। এবং তাঁরা চলে গেলেই গোলাপি জিভ বার করে বিশাল হাই তুলে আবার সকর্মক হবে। সাহানাই পরামর্শটা দিলেন, আচ্ছা দাদা, আপনারা তো থাকেন একটেরে, একটা কুকুর পুষুন না! কুকুর যে কী ভালো সঙ্গী! কুকুরের স্নেহমমতা, বিশ্বস্ততা, এসব যে কী দুর্লভ গুণ, যারা কুকুর না রেখেছে বুঝতে পারবে না। আপনাদের কখনও কুকুর ছিল না?

মিসেস মুখার্জি বললেন, না সাহানা। কুকুরে আমার বরাবর কেমন ভয়, ঘেন্নাও বলতে পারো। কখনও পুষিনি।

মুখার্জিদা আপনি?

আরে আমার তো ভালো লাগে। কিন্তু এ সব ব্যাপারে গিন্নির ইচ্ছায় কর্ম। বুঝলে কি না?

সাহানা বললেন, ও সব বললে শুনছি না, কুকুর আপনাদের একটা কিনিয়ে দেবই। পরে আমাকে আশীর্বাদ করবেন।

সেই হাজরা রোডে জহর দাসের বাড়িতে আসা। অনিল সেনগুপ্তর অ্যামবাসাডর চড়ে। বেল বাজাতেই ভেতর থেকে ভৌ ভৌ, ঘাউ ঘাউ, কৌ কৌসারমেয়দের অর্কেস্ট্রা। দোতলার জানলায় জানলায় কৌতূহলী সারমেয়কুল ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। একজন আবার মুখ ঝুঁকিয়ে দিয়েছে, তার নোয়ানো বিঘৎ পরিমাণ ব্রাউন রঙের কান ঝুলছে। দেখেশুনে মিসেস মুখার্জি বললেন, বাপ রে!

সাহানা বললেন, ভয় পাবেন না দিদি, ওরা তো সব ঘরে ঘরে বন্ধ। কত রকমের ব্রিড আছে, নিজে দেখে শুনে পছন্দ করে নিতে পারবেন।

জহর দাস এবং তার স্ত্রী পুতুল তখন সাদা সাদা অ্যাপ্রন পরে সদ্যোজাত কুকুর শাবকদের পরিচর্যা করছিল। সে এক এলাহি ব্যাপার। এক একটা বড়ো বড়ো লোহার ক্রিবে, মা কুকুর তার ছানাদের নিয়ে সগর্বে বসে আছে। চারদিকে এমন করে তাকাচ্ছে যেন অমন কাজটি ভূ-ভারতে আর কেউ কস্মিনকালে করেনি। ওঁদের দেখে জহর দাস শ্ৰীমতী পুতুলের হাতে সবকিছু ছেড়ে তাঁদের সঙ্গে চলে এলেন। কী রকম কুকুর চান? পেট টাইপ? না প্রহরী কুকুর? চোর ডাকাত তাড়াবে, বদলোক ঢুকতে দেবে না। কী রকম?

দু তিন মাসের অ্যালসেশিয়ান বাচ্চা দেখালেন। এর আসল নাম জার্মান শেফার্ড ডগ, বুঝলেন? সবচেয়ে পপুলার এখন। ট্রেনিং দিন। দুর্দান্ত পুলিশ ডগ হয়ে দাঁড়াবে। ভালোবাসুন, খেলা করুন, সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বেরোন, একেবারে বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য বন্ধু।

বাচ্চাটাকে তো বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। বড়ো হলে কী রকম দাঁড়াবে বলুন তো?

একটা ঘরের দরজা খুললেন জহরবাবু, একটা উঁচু লম্বা ভারী কুকুর দৌড়োতে দৌড়োতে এগিয়ে এল। কিছু করল না, খালি মুখ নীচু করে আগন্তুকদের শুকতে লাগল।

এই রকমটা দাঁড়াবে, এটাই বাবা বাচ্চাটার। সাতষট্টি আটষট্টি পাউন্ডের মতো ওজন হবে।

ওরে বাবা মুখার্জি গিন্নি বলে উঠলেন,–অ্যালসেশিয়ান আমি কোনোদিনও দু চোখে দেখতে পারি না। নেকড়ের মতো। কেমন হিংস্র দেখতে। তার ওপর অত ওজন, আমি সামলাতে পারব না বাপু।

জহর দাস হেসে বললেন, আপনি যদি বাচ্চা-কাচ্চার মতো নিয়ে, আদর করে আনন্দ পেতে চান আবার এ-ও চান বাড়িতে ইঁদুর আরশোলা বেড়াল না থাক, যদি চান চোর ডাকাত এলে লড়াই করতে না পারুক অন্তত পক্ষে ডেকে আপনাকে জাগিয়ে দেবে তাহলে আপনার জন্যে আইডিয়াল কুকুর হবে মাসিমা আইরিশ টেরিয়ার। সঠিক নামটা হবে গ্লেন অব ইমান টেরিয়ার। খুব রেয়ার ডগ, মানে আমাদের এখানে। টেরিয়ার আমার কাছে দুটো বাচ্চা এসেছে, একটা রাজ্যপালের জন্যে তাঁর এডিকং নিয়ে গেছেন, আর একটা আছে আপনাকে দেখাচ্ছি।

নীলচে ছাই-ছাই রঙের একটা ছোট্ট গোল্লামতন দেখালেন জহরবাবু। বললেন পেট ডগ, বিশেষ করে যেগুলো টয় টাইপ, সবই খুব লোমশ হয়। টিবেটান অ্যাপসো, কি টেরিয়ার, ওয়েস্ট হাইল্যান্ড টেরিয়ার, পিকিনিজ, পামিরেনিয়ান, স্পিঞ্জ। লোম নিয়ে উস্তম-খুস্তম হয়ে যাবেন। এটারও লোম আছে, ন্যাড়া টাইপের কুকুর মোটেই নয়, অথচ ম্যানেজেবল। ভীষণ মজাদার, কেজো কুকুর। এটাকে মানুষ করতে আপনার কোনো অসুবিধে হবে না। ভালোবেসে ফেলবেন। বড্ড ভালোবাসবেন। বিচ কিন্তু।

বিচই ভালো, বলে বেতের টুকরিসুদু নরম স্পঞ্জের গদিতে উলের বলটি তুলে নিলেন মুখার্জি গিন্নি। সাহানা বললেন, আমাদের পুটপুটিটার সঙ্গে মিলবে ভালো। ওটাও বিচ। খেলবে এখন দুজনে খুব। ছাপানো কুকুর-পালন-বিধি নিয়ে ফিরে এলেন মুখার্জি দম্পতি।

ফ্লাওয়ারি নুক-এর ফ্লাওয়ারগুলি আছে ঠিকই। কিন্তু নুকটি এখন ঝুপলির হয়ে গেছে। ঝুপলি, সেই নীলচে ছাই রঙের গোল্লাটা পেট উলটে বোতলের দুধ খায়। ছোটো বাচ্চাদের মতো সামনের দুই থাবা দিয়ে বোতল আঁকড়ে ধরে কখনও কখনও। মোটা তুলোর বিছানায় বেতের দোলনায় শোয়ানো হয় তাকে। পিচ পিচ করে হিসি করে বড্ড কম্মো করে, সেখানকার তুলোটুকু ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। ঝুপলির উন্নতি হয়, ঝুপলি নিজের কট থেকে ঝাঁপিয়ে নামে, লুটোপুটি খায়, খাটের পারা কামড়ে ধরে, নিউ মার্কেট থেকে তার জন্যে টিদিং রিং আনা হয়। ডগ বিস্কিট আসে। খেলবার জন্যে বল আসে, ছোটো বড়ো। খেলনা আসে। ঝুপলিকে কোলে নিয়ে মুখার্জি-মা বসেন চোখ বুজিয়ে, মুখার্জি-বাবা পা চেপে ধরেন। প্যাঁট করে ইনজেকশন ফোঁটানো হয়। পাউডার সাবান, বুরুশ, চিরুনি দুতিন রকম। অ্যান্টিসেপটিক। বোরিক তুলো, পেরোক্সাইড ভিনিগার। ক্রমশ নীলচে ছাই লোমে ছেয়ে যায় শরীর, মুখ। তার মধ্যে থেকে থ্যাবড়া কালো নাকটা বেরিয়ে থাকে। বোকার মতন কুতকুতে চোখ। বেঁটে লোমশ, খাড়া ল্যাজ নড়ে। মুখার্জি সাহেব তাকে সপাটে ওপরে ছুড়ে দ্যান, লুফে নেন, আবার ছুড়ে দ্যান। রই রই করে ছুটে আসেন গিন্নি! কী করছ? তোমার বদভ্যেস কি কখনও যাবে না? অত উঁচু থেকে পড়ে গেলে মানুষ বাঁচে?।

প্রতিমাদেবী, এটা মানুষ বাচ্চা নয়,—ঝুপলিকে লুফে নিতে নিতে মুখার্জি সাহেব বলেন!

আর মানুষ বাচ্চাদেরও এমনি করে লোফালুফি করতে হয়, নার্ভ স্ট্রং করবার জন্যে, কুকুরের তো কথাই নেই!

সব সময়ে অত কুকুর-কুকুর করবে না তো! কুকুর বলে কি মানুষ নয়! সযত্নে ঝুপলিকে কোলে তুলে প্রতিমাদেবী বেরিয়ে যান।

মুখার্জি সাহেব ভারি মজা পেয়ে হাসতে থাকেন, কুকুর বলে কি মানুষ নয়? সত্যিই তো কুকুর বলে কি এটা মানুষ নয় নাকি?

মাস তিনেকের বাচ্চা যখন, তখন থেকেই কুকুর-পালন-বিধি দেখে দেখে ঝুপলির ট্রেনিং আরম্ভ হয়ে যায়। নরম সোয়েডের কলার তৈরি হয় তার জন্যে বিশেষ অর্ডার দিয়ে। তার সঙ্গে স্টিলের চেন। আনব্রেকেবল গোল ফুলকাটা বোলে ঝুপলি পরিজ খেল, চকচক করে জল খেল, এইবার মুখার্জি সাহেব ডাকবেন —ঝুপলি কলার। ঝুপলি কলার। কলার পরতে ঝুপলির ভীষণ আপত্তি। সে দূর থেকে বোকার মতো চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

প্রতিমা বলবেন পরে নাও ঝুপলি, লক্ষ্মী মেয়ে, কী সোনা মেয়ে গো! ও তো গয়না! বাবা গয়না কিনে দিয়েছে! ঝুপলি আরও বোকাটে চোখ করে পিছু হটে। মুখার্জি সাহেব বলেন—ওভাবে মানুষের মেয়েকে বলার মতো বললে হয় না আজ্ঞে! ও তো গয়না! বাবা গয়না কিনে দিয়েছে! হুঃ, খুব বুঝল ও, গয়নার লোভে লসলস করছে কি না কিছু শেখাতে হলে সোজাসুজি গম্ভীর, কঠিন গলায় নির্দেশ দিতে হবে, সম্ভব হলে মনোসিলেবল, যেমন সিট ডাউন–ডাইসিলেবলও চলতে পারে, কিন্তু ভেঙে ভেঙে উচ্চারণ করতে হবে। যেমন—ঝুপলি, কলার প রো। গম্ভীর কড়া গলায় বলে কলারটা সামনে ধরে নাচাতে লাগলেন মুখার্জি সাহেব, হঠাৎ এক পা দু-পা করে এগিয়ে এসে ঝুপলি কলারের ফাঁসের মধ্যে মাথাটা গলিয়ে দিল। ইতিউতি তাকাচ্ছে। ঠিক করেছে কিনা বুঝতে পারছে না এখনও। মাথায় কিস্যু নেই।

তখন তাকে প্রচুর আদর করতে হয়, গলায় খুশি ঢেলে দিতে হয় বুঝলে? যাতে সে বোঝে এই রকম আচরণ করলেই সে ভালোবাসা পাবে, হাততালি পাবে। এই দেখো লেখা আছে—ল্যাভিশ প্রেইজ অন হিম হোয়েন হি রেসপন্ডস টু কমান্ড, এসব ট্রেনিং-এর অঙ্গ। জহরের বইটা ভালো করে পড়ে দেখো না। তোমাকে তো তাই-ই করতে বললুম। এইবার তোমার ওই লক্ষ্মী মেয়ে, সোনা মেয়েগুলো প্রাণভরে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে পারো।–বিজয়গর্বে স্ত্রীর দিকে চেয়ে মুখার্জি বলেন।

আমার ভারী বয়ে গেছে। গিন্নি উঠে যান।

নাগ হয়েছে নাগ? ছি! ছি! ছি! মানী মানতে শেখেনি, মানী মানতে শেখেনি বলে মুখার্জি সাহেব তাঁর বয়স-টয়স ভুলে গিয়ে আঙুলে তুড়ি দিয়ে দিয়ে নাচেন, ঘুরে ঘুরে নাচেন। গিন্নিকে খ্যাপাবার এই নতুন উপায় খুঁজে পেয়ে তিনি যারপরনাই আহ্লাদিত। তাঁর রকম দেখে ঝুপলি তার কচি গলায় ডাকে পৌ পৌ পৌ, গলার চেন ঝনঝনিয়ে সে-ও দু-একটা পাক খেয়ে নেয়। কিন্তু নাচে তার মুখার্জি কর্তার মতো প্রতিভা নেই, দেখা যায়।

উমি এসে বলে, ও দাদুসাহেব কী করছ গো? দিদিমা যে কাঁদতে নেগেছে।

অ্যাঁ? সাহেবের নাচ থেমে যায়।

কুকুর বগলে তিনি তৎক্ষণাৎ দিদিমার উদ্দেশ্যে রওনা হন।

খাবার টেবিল সামনে নিয়ে চোখে আঁচল দিয়ে দিদিমা বসে আছেন।

কী হল? আরে বাবা, কুকুর যখন তোমার আদেশ ঠিকঠাক পালন করতে পারবে?

আমার পড়েও কাজ নেই। কিছু করেও কাজ নেই! গিন্নি একই রকম থমথমে মুখে বসে থাকেন।

তবে রইল তোমার ঝুপলির মর্নিং ওয়াক, সে মোটা হিপো হোক, তার গেটে বাত ধরুক, আমার কী। ঝুপলিকে গিন্নির কাছে টেবিলের ওপর বসিয়ে দিয়ে সাহেব চলে যান। আর কুকুরটাও এমনি পাজি যে পৌ পৌ করে দুবার ডেকে মায়ের কোলের ওপর লুটোপুটি খেয়েও লাফাতে লাফাতে ছোটে মুখার্জি সাহেবের পিছু পিছু, পেছনে চেন লুটোচ্ছে।

কী বিচ্ছু দেখো দিদিমা, উমি চেঁচায়, ওই যে জানে দাদুসাহেব বেই বেই যাবে?

ওরা ওইরকমই। মায়ের থেকে আদর যত্ন সেবা সব আদায় করবে। আর হবার বেলায় হবে বাপ-সোহাগি; গভীর খেদের সঙ্গে দিদিমা উচ্চারণ করেন।

উমি বালতিতে ন্যাতা ডুবিয়ে বলে, তা যদি বলো দিদিমা, ব্যাটাছেলে হয়েও দাদুসাহেব ঝুপলির জন্যে কম করে না! দৌড়োদৌড়ি ছোটাছুটি, খেলা দেওয়া! মুখের গোড়ায় খাবারটি যেমন বোঝে, ঘুমের সময় কোলটি যেমন বোঝে, খেলাটিও তো তেমন যোলো আনার জায়গায় সতেরো আনা বোঝে কি না! একটা মানুষের বাচ্চার সঙ্গে তফাত কী?

হঠাৎ বুকটা চেপে ধরেন মুখার্জি গিন্নি প্রাণপণে। বুকের মধ্যে যেন তীক্ষ্ণ লৌহশলাকা ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ। না না, সত্যিই, মানুষের বাচ্চার সঙ্গে কোনো তফাতই নেই। কোনোই তফাত নেই।

আনোয়ারের আজকাল মুখে খুশি ধরে না। মুখার্জি সাহেব নিয়মিত মাংস কিনছেন। হাড়-হাড় দেখে মাংস বেছে দেয় আনোয়ার। মেটুলি, কিডনি একেক দিন! মুরগিঅলা কিষেণের দিন খারাপ যাচ্ছে। তাকে মুখার্জি সাহেব ধৈর্য ধরে বোঝান—তাঁর নিজের জন্যে আর কতটুকু লাগে। দিদিমা যে খায় না। আর ঝুপলি? কক্ষনো ওদের মুরগি দিতে নেই। সরু সরু হাড় যদি একবার পেটের ভেতরে চলে যায় তো ইনটেসটিন ফুটো হয়ে যাবে একেবারে। তখন অ ক্কা। –নলি নলি হাড় দিস, বেটি চিবোক, যত পারে চিবোক—তিনি আনোয়ারকে নির্দেশ দ্যান। বেছে বেছে গাজর কেনেন, বাঁধাকপি কেনেন, পালং শাক, কলমি শাক। ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ যেন কম না হয়ে যায় ঝুপলির শরীরে।

ইতিমধ্যে মুখার্জি গিন্নিরও বিজয় গৌরবের কারণ ঘটে। তিনি প্রথম থেকেই ঝুপলির পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা শুচিতা সম্পর্কে খুব সজাগ। প্রত্যেকবার খাবার পর তুলো জলে ভিজিয়ে মুখ মুছে দ্যান। ঝুপলির দাঁত মাজার দরকার নেই শুনে তিনি আকাশ থেকে পড়েছিলেন। মানতেও চাননি। কিন্তু তাঁর স্বামী যখন কিছুতেই দাঁত মাজাতে দিলেন না তখন তিনি জল আর পেরোক্সাইড়ে মিশিয়ে তাতে তুলে ভিজিয়ে রোজ রাতে একবার করে ঝুপলির দাঁত পরিষ্কার করে দিতে থাকলেন। ঝুপলি হেগো পেছনে থাকবে এ-ও তিনি কিছুতেই বরদাস্ত করতেন না। তুলো ভিজিয়ে তার শৌচকার্য সম্পন্ন করতে লাগলেন। মুখার্জি সাহেব যতই ব্যঙ্গের হাসি হাসুন। আর খ্যাপান, এ কাজগুলো তিনি করবেনই। উমি পর্যন্ত তাঁকে বোঝায়, আচ্ছা দিদিমা, ধরো তুমি কোনোদিন পারলে না অদড় হলে তখন? কে ওকে চুঁচিয়ে দেবে? কে দাঁত মাজাবে? ভগবান ওদের ওমনি করেই গড়েছেন, দাঁত মাজবার, ছোঁচাবার দরকার হয় নাকো।

শুনে দাদুসাহেব বলেন, উমিচাঁদ একটা মুকখু মেয়ে যা এত সহজে বুঝে গেল, তুমি ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশনের গ্র্যাজুয়েট হয়েও তা বুঝলে না গিন্নি; তোমাকে আর উমিচাঁদকে দেখেই আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারি—নলেজ ইজ ইনস্টিংটিভ, ইট কান্ট বি অ্যাকোয়ার্ড।

তা সে যাই হোক তার মুখার্জি-মায়ের গর্বোল্লাসের উদ্রেক করে একদিন ঝুপলি ঝুম ঝুম করে বাগানে দৌড়ে গেল। ঝুপলি কোথায় গেল? ঝুপলি কোথায় গেল? দেখা গেল ঝুপলি বাগানের মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে সযত্নে তার বড়ো-বাইরে চাপা দিচ্ছে।

দেখেছ? দেখেছ। কী রকম ট্রেনিং। কাজটা যে খারাপ, জিনিসটা যে নোংরা ও ঠিক বুঝতে পেরেছে। মুখার্জি গিন্নি বলে ওঠেন।

রে রে করে ওঠেন মুখার্জি কর্তা, জিনিসটা নোংরা না হয় স্বীকার করছি প্রতিমা, যদিও জিনিসটা আমরা প্রত্যেকে দেহের ভেতরে বইছি। কিন্তু কাজটা খারাপ, মানে? কাজটা তাহলে না করাই ভালো বলছ? ঠিক আছে উমিচাঁদ, তোকে ভার দিয়ে রাখলুম, পাহারা দিবি কাল থেকে তোর দিদিমা যেন খারাপ কাজটা না করে।

উমি হি হি করে হাসতে থাকে। প্রতিমা বলেন বুড়ো যে হয়েছ, সেটা অসভ্য কথা শুনলেই বোঝা যায়। যার যত বয়স তার তত অসভ্য মুখ!

এরই মধ্যে আবার ছোট্ট একটু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে গেল। সাহানা সেনগুপ্তদের কুকুর পুটপুটি, আর প্রতিমা মুখার্জিদের ঝুপলি বিকেলের দিকে একই সঙ্গে বেড়াতে যায়। বেড়িয়ে টেড়িয়ে হয় মুখার্জিদের বাড়ির গোল পোটিকোতে নয় সেনগুপ্তদের বাগানে দুই দম্পতি কুকুর নিয়ে বসে আড্ডা দ্যান। এ সময়টা কুকুরদের চেন, কলার সব খুলে নেওয়া হয়। কলারটা খুলে সযত্নে গলাটা ক্রিম দিয়ে ডলে তবে ঝুপলিকে ছেড়ে দ্যান মুখার্জি সাহেব। দুটো কুকুরে মিলে কৌ কৌ পৌ পৌ করে, লুটোপুটি খায়, এ ওর পেছনে দৌড়োয়। একদিন দেখা গেল ঝুপলি তিরবেগে দৌড়োচ্ছে। কী? না একটা ধেড়ে ইঁদুর। দেখাদেখি পুটপুটিও দৌড়োল। কিন্তু ঝুপলি একটা টেরিয়ার, তার ভেতরের জিন তাকে ইঁদুর ভোঁদড় শিকার করতে শিখিয়ে দ্যায়। অপর পক্ষে পুটপুটি একটা চুড়ান্ত অলস ও সুখী কুকুর-দিবারাত্র পাখার তলায় শুয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ করে আর থাবা পেতে ঘুমোয়। সুতরাং অবিলম্বে ঝুপলি ইঁদুর ধরে। আছড়ে মেরে ফেলে। মুখার্জি সাহেব মন্তব্য করেন, দ্যাখো সাহানা, পুটপুটির মা বিদ্যেয় ঝুপলির মায়ের থেকে বড়ো হতে পারে, ঝুপলি কিন্তু পুটপুটিকে অনায়াসে হারিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে ঝুপলি তার জীবনের প্রথম শিকারটিকে পরম পরিতোষ সহকারে খেতে শুরু করেছে। এবং প্রতিমা চেঁচিয়ে উঠেছেন, মাগো, ঝুপলি এই, ঝুপলি—তুই কি খেতে পাস না যে ওইসব নোংরা! ছি ছি ঝুপলি খায় না। না না। ঝুপলি ভেলে গিয়ে একবার মুখ তুলে মা বাবার দিকে তাকাল, কেন যে মা তাকে বাহবা দেওয়ার পরই হঠাৎ এমন কঠোর হয়ে গেছে তা সে বুঝতে পারল না, এবং না পেরে ইঁদুরটিকে চেটেপুটে খেয়ে নিল। পুটপুটি তখন অনেক দূরে বসে পিট পিট করে দেখছে।

সাহানা বললেন, ঠিকই বলছেন মুখার্জিদা, কিন্তু কে যে বেশি খানদানি সেটাও স্পষ্ট বোঝা হয়ে গেল। একজন ইঁদুর খায়, আরেকজন ছুঁয়েও দেখে না। ঠাট্টার সুরেই বললেন সাহানা, কিন্তু পরে দুই দম্পতি যে যার বাড়িতে একা হলে এ নিয়ে বেশ মনোমালিন্য হল। প্রতিমা বললেন, আজেবাজে জিনিস খাবার ঝোঁকটা ঝুপলি তার বাবা অর্থাৎ মুখার্জি সাহেবের থেকে পেয়েছে। তিনি যে অত শুদ্ধতা, বাছবিচার মেনে চলেন সে কি এমন এমনি? আর সাহানা কোন মুখে খানদানের কথা উচ্চারণ করে? পুটপুটিকে ওরা দার্জিলিঙে এক ভুটিয়ার কাছ থেকে কিনেছিল কুড়ি না পঁচিশ টাকা দিয়ে। আর ঝুপলি? জহর দাস তো বিগত তিন পুরুষের হিসেব দিল ঝুপলির। ঝুপলির ভাই তো রাজ্যপালের ঘরে মানুষ হচ্ছে। আইরিশ টেরিয়ার। পাওয়াই যায় না এদেশে। তবে?

ওদিকে সেনগুপ্তদের বাড়িতে সাহানা বললেন, এম. এ. বি. টি করা যে এত দোষের সেটা এই প্রথম জানলুম! অনিল সেনগুপ্ত বললেন, আরে ছাড়ো তো তোমাদের মেয়েলি কুটকচালি! সাহানা তখন রাগ করে বললেন, ঠেস দেওয়া কথাটা কিন্তু কোনো মেয়ে বলেনি, একজন পুরুষই বলেছেন এবং তাঁর সত্তরের যথেষ্ট ওপরে বয়স পঁচাত্তর তো হবেই। পেডিগ্রি-ডগ কিনে অহংকারে একেবারে মটমট করছেন। আরে বাবা পরামর্শটা কে দিল? কিনিয়েটা দিল কে?

ঝুপলি কিন্তু সেনগুপ্ত-পরিবারেরও খুব নেটিপেটি। প্রথম ইঁদুরটি মারার পর থেকে সে নিজেদের বাড়িতে তো বটেই সেনগুপ্তদের বাড়িতেও ইঁদুর মারতে যায়। যদিও আর খায় না। ইঁদুরের স্বাদ তার ভালো লাগেনি। একতলা বাংলো বাড়ি। ইঁদুর-ছুঁচোর উপদ্রব আছেই, উপদ্রব বাড়লে সাহানাই বলেন, ঝুপলিকে ডাকো তো! ইনি তো একটি কম্মের ঢিপি। এই নিন্দাবাদ শুনে পুটপুটি তার ক্লোকের মধ্যে আরও সেঁদিয়ে যায়। অন্তত সাহানার তাই ধারণা। কিন্তু লজ্জা পেলে কী হবে। আরাম, ঘুম এ সমস্ত ছাড়বার কোনো লক্ষণই সে দেখায় না। সাহানা বলেন, বেহায়া তো! অপমান হজম করবে, তবু গতর নাড়বে না।

সেবার পুজোয় বিজয়ার সময় ভারি মজাই হল। বিজয়া দশমীটাই একমাত্র উপলক্ষ্য যখন মুখার্জিদের বাড়িতে প্রচুর জনসমাগম হয়। সব বাড়িতেই হয়। মুখার্জিদের বাড়ি একটু বেশিই। একাদশী থেকে কালীপুজো পর্যন্ত চলে। তা, এইরকম একটা দল সেবার বোধহয় প্রথম আসছে, আশেপাশে জিজ্ঞেস করছে বাড়ির নম্বর বলে। এদিকে পরিকল্পিত পল্লি যেমন হয়, একই রকমের রাস্তা, বাড়িগুলোও মোটামুটি একই ধাঁচের। কিছুতেই ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছে না দলটি, অবশেষে একটি বালক বলল, ও ঝুপলিদের বাড়ি? ওই তো ডানদিকে গিয়ে বাঁ দিকে ঘুরেই দুটো বাড়ি পরে।

এঁরা মুখার্জিদের মাসিমা মেলোমশায় ডাকেন। বাড়ি খুঁজে আসা হল, খাওয়াদাওয়া আড্ডা সব হল, শেষে ইতস্তত করে বললেন—মেলোমশায় কি কোনও বাচ্চা পোষ্য-টোষ্য নিয়েছেন না কি?

কেন বলো তো?

না। ওইদিকে একটি ছোটো ছেলে বলল কি না ঝুপলিদের বাড়ি। ঝুপলি তখন গ্যাঁট হয়ে তার মায়ের কোলে বসে বসে কুতকুত করে অভ্যাগতদের দেখছে। এত বোকার মতো যে দেখলেই হাসি পাবে।

মুখার্জি সাহেব তাকে দেখিয়ে হেসে বললেন, পোষ্যই বটে। এই যে ইনিই সেই ঝুপলি ঠাকরুন, যাঁর নাকি এই বাড়ি! সাধ করে নাম রেখেছিলুম ফ্লাওয়ারি নুক। ফ্লাওয়ার্সও মন্দ ফোঁটাইনি। তিন রঙের জিনিয়া, কলাবতী, রাজ্যের দোপাটি, জবা, লাল সাদা গোলাপ। কিন্তু হলে কী হবে বাড়ি এখন ঝুপলিজ নুক হয়ে গেছে! একেই বলে ফোকটেল, বুঝলে হে প্রকাশ! আর একেই বলে কপাল!

এইভাবেই চলছিল। চলছিল ভালোই। বছর বছর ঝুপলির জন্মদিনে পার্টি হয়। সবাই মিলে নানারকম মুখরোচক খাবার ধবংস করতে করতে আড্ডা জমে। কিন্তু একদিন প্রতিমা অত্যন্ত অসময়ে অস্বাভাবিক বেগে ছুটে গেলেন সাহানার বাড়ি। দুজনে মিলে ফিসফিস করে কী কথা হল। শেষে সাহানা বললেন, অত ভাবছেন কেন বলুন তো? ওরা জানোয়ার, নিজেদেরটা নিজেরা বুঝবে, ওর জন্যে কি এখন আপনি স্যানিটারি ন্যাপকিনের খোঁজে যাবেন, না কি?

কী লজ্জা, কী নোংরা! পাঁচজনের সামনে, ছি ছি!

পাঁচজন কোথায় পেলেন দিদি? বাড়িতে তো পুরুষ বলতে এক আপনার উনি। মুখার্জিদার সঙ্গে এতদিন ঘর করলেন সে কি লুকোচুরি খেলে?

তোমার যেমন কথা! প্রতিমা মুখার্জির ভাঁজ পড়া মুখ লাল হয়ে গেল।

তবে? নিজেই তো দেখে-শুনে বিচ নিলেন? তখন ভাবেননি যে ইয়ে হবে?

সত্যিই ভাবেননি প্রতিমা। কেন নিয়েছিলেন? কেন স্ত্রী-জানোয়ারের প্রতি এই পক্ষপাতিত্ব? কেন? কেন? জহর দাস যখন, বলল, বিচ কিন্তু। তিনি তো আর পাঁচটা দেখতে চাননি, একেই তুলে নিয়েছিলেন। রুমুঝুমু চুল, পশমের গোল্লার মতো, যেন নীলচে ছাই রঙের ফারকোট পরে আছে। কাশ্মীর থেকে কিনেছিলেন এটা! ছোট্ট ফারকোট! সাদা জুতো বকলশ দেওয়া। বড়ো হয়েও যখন বি. এ. পাস করে এম, এ পড়ছে সে তখনও অমনি ছোট্টখাট্টো, মিষ্টি, কোকড়া পিঠ-ছাপানো চুল! বুকের ভেতর থেকে ডাকটা পাথর ঠেলে বেরিয়ে পড়ছে বুড়ি, বুড়িমা! প্রতিমা প্রাণপণে চাপবার চেষ্টা করেন, মুখ চোখ সে চেষ্টায় একবার লাল তারপর ফ্যাকাশে হয়ে যায়, যেন পাথর গিলছেন। চোখে অন্ধকার। সাহানা বলেন, কী হল দিদি! শরীরটা হঠাৎ খারাপ লাগছে না কী? আর শরীরের বা দোষ কী? যা গরমটা পড়েছে। কথায় বলে ভাদুরে গুমোট। সাহানা ঠান্ডা জল আনেন; কপালে বরফ বুলিয়ে দ্যান। সামলে উঠে আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরে আসেন প্রতিমা।

ঘেউ ঘেউ ঘেউ! রাস্তায় কতকগুলো নেড়ি কুত্তা তাঁর পেছু নেয়। দূর! দূর! প্রতিমা কোনোমতে বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়ির গেটের কাছে এসে নেড়ি কুত্তাগুলো দ্বিগুণ জোরে ডাকতে থাকে, ঘেউ ঘেউ ঘেউ।

আমর—মোলো যা—উমি বাগান থেকে ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে মারে—দূর দূর দূর। যায় না নেড়িগুলো। যদি বা অন্যগুলো যায় একটা কিছুতেই যায় না। গেরুয়া আর কালো মেশানো রং, বেশ হৃষ্টপুষ্ট। পাত-কুড়োনো খেয়েও। গেট টপকাবার চেষ্টা করে, ডাকতে থাকে, ঘেউ ঘেউ ঘেউ। খাবার ঘরের কোণে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়েছিল ঝুপলি। তার ছোটো ছোটো কানগুলো খাড়া হয়ে ওঠে, সে একবার সাড়া দেয়—কৌ।

ঘৌ ঘৌ ঘাউ! ওদিক থেকে ভেসে আসে।

তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে ঝুপলি—কৌ, খৌ, ঘৌ, ঘৌ—সে তিরবেগে গেটের দিকে ছুটে যেতে থাকে। মুখার্জি সাহেবের সমস্ত শরীরের জোর লাগে তাকে কোলে তুলে নিয়ে আবার খাবার ঘরে আনতে, কলার এবং চেন বেঁধে আটকাতে। আটকাবার পরও ঝুপলি মেঝেতে গড়াগড়ি দেয়, আকুলিবিকুলি করে এবং ডাকতে থাকে কৌ, কৌ, ভৌ। যদিও নেড়িটাকে ততক্ষণে নির্ভীক উমিচাঁদ তাড়াতে তাড়াতে পাড়া পার করে দিয়ে এসেছে।

মুখার্জি সাহেব জরুরি বৈঠকে বসেন সেনগুপ্তের সঙ্গে। সেনগুপ্ত বলেন, আমার পুটপুটিটা যদি পুং হত তো কথাই ছিল না। দুটোতে কেমন চমৎকার মিলও। আহা জানোয়ারদের জগতে যদি হোমো থাকত দাদা।

মুখার্জি চুরুটে টান দিয়ে বলেন, না অনিল, কথাটা তুমি লাইটলি নিয়ো না।

অনিল সেনগুপ্ত বলেন, আচ্ছা রাত্তিরের দিকে সব চুপচাপ হয়ে গেলে একটা খুব গম্ভীর কুকুরের ডাক শুনি যেন। কোথায় বলুন তো? দাঁড়ান আমি খোঁজ নিই।

দু চারদিন পরে খোঁজ খবর করে এসে অনিল সেনগুপ্ত বলেন, চলুন দাদা আপনার সমস্যার সমাধান বোধহয় হয়ে গেল। যশবন্ত কাপুর বলে এক পাঞ্জাবি থাকে ওদিকে। অ্যালসেশিয়ান। আপত্তি নেই তো?

আরে বাবা জাতে খানদানি হলেই হল। অ্যালসেশিয়ানই হোক আর তোমার ডালমেশিয়ানই হোক।

বিকেলের দিকেই ঘটকালি অভিযান শুরু হল। প্রতিমা যেতে চাননি।

যত সব অনাছিষ্টি কাণ্ড! সাহানা পুটপুটিকে নিয়ে হাওয়া খেতে বেরোবেন। অগত্যা অনিল সেনগুপ্ত একাই মুখার্জিদাকে সঙ্গ দ্যান। মুখার্জি সাহেবের পাশে। পাশে হেঁটে চলে শেকলবন্দি সদ্য রজঃস্বলা ঝুপলি।

যশবন্ত কাপুর সাদরে গেট খুলে দ্যান, আই য়ে আই য়ে মুখার্জিসাব, আই য়ে সেনগুপ্তা সাব, ইয়ে তো আপকীই কোঠি হ্যায়। বইঠিয়ে, আরাম কিজিয়ে। লনের মাঝখানে বেতের চেয়ার টেবিল পাতা। কেতাদুরস্ত বেয়ারা এসে লস্যি দিয়ে যায়। বেয়ারাকে নির্দেশ দেন যশবন্ত কাপুর-রোভারকো ছোড় দো। সবে দু তিন চুমুক দেওয়া হয়েছে লস্যিতে, পশ্চাৎপটে মিসেস কাপুরকেও দেখা যাচ্ছে হাসতে হাসতে, বিপুল ফাঁদের সালোয়ার কুর্তা পরা সদালাপিনী বেরিয়ে আসছেন, এমন সময় শোনা গেল—ঘাঁউ ঘাঁউ ঘাঁউ। অর্থাৎ রোভারকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পরক্ষণেই সুপুষ্ট্র পেশিপ্রবাহে বিদ্যুৎ খেলিয়ে দৌড়োত দৌড়োতে আসতে লাগল রোভার। রোভার তো রোভারই। বালি-বালি রঙের মাজা শরীরটি। দুই কানের মাঝখানটা কালো, নাক মুখও কালো। ঝকঝকে, বলিষ্ঠ, অভিজাত, মধ্যযুগের বীর যোদ্ধাদের মতো কুকুর রোভার। জামাই করতে হয় তো এইরকম! বাতাসে নাক তুলে যেন কী শুকল, তারপর ঝড়ের বেগে ঝুপলির দিকে দৌড়ে আসতে লাগল রোভার। এবং সঙ্গে সঙ্গে মুখার্জি বাবার হাতের শেকল হ্যাঁচকা টানে খুলে টেবিলের ওপর লস্যির গেলাস উলটিয়ে ঝুপলি তার নোম-টোম খাড়া করে দিল ভোঁ দৌড়। দৌড় দৌড় দৌড়। একেবারে এ গলি পেরিয়ে সে গলি পেরিয়ে সে বাড়ি টপকিয়ে সে ফ্লাওয়ারি নুক-এ হাজির। মুখার্জি মা-র কোলের ভেতরে ঢুকে তবে নিশ্চিন্ত।

লনে লস্যির প্লাবন বইছে, দুখানা গ্লাস ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে। মুখার্জি সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন বারবার।

ইসমে আপকা ক্যা কসুর হ্যায় জী? যশবন্ত কাপুর মজা পেয়ে হাসতে লাগলেন।

গম্ভীর মুখে বাড়ি ফিরে এলেন মুখার্জি বাবা, সেনগুপ্তকাকা। বাড়ি ফিরতে সাহানা জিজ্ঞেস করলেন, কী হল?

সেনগুপ্ত বললেন, না, রিস্তা নাকচ করে দিলে বেটি! বহোৎ নারাজ।

তাই-ই! সাহানা হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগলেন সব শুনে!

মুখার্জিদের পক্ষে কিন্তু ব্যাপারটা খুব হাসির রইল না। তাঁরা ঝুপলিকে সাধারণত ছেড়ে রাখতেই পছন্দ করেন। খুব ভালো মেজাজের কুকুর। কাউকে বিরক্ত করে না, কামড়ায় না। ঘরদোর নোংরা করে না, গেট বন্ধ আছে, তার চত্বরের মধ্যে যত খুশি ঘুরে বেড়াক না। চেন পরবে একমাত্র বেড়াতে যাবার সময়ে। ঝুপলি তার এ স্বাধীনতা উপভোগ করে, অপব্যবহার করে না কখনও। মুখার্জি সাব বিকেলবেলা তাকে বেড়াতে নিয়ে যাবার সময়ে ডাকাডাকি করেও পেলেন না। আশ্চর্য! ঝুপলি তো বাড়ির মধ্যে নেই। আঁতিপাঁতি খুঁজেও তাকে পাওয়া গেল না। এ বাড়ি ও বাড়ি খোঁজা শেষ করে, উদ্বেগে হতাশায় কালো হয়ে দুজনে বসে আছেন, এমন সময়ে দেখা গেল ঝুপলি ফিরছে। গেটের ফাঁক দিয়ে গলে এলো। আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল। বাবা কিছু বলছেন না, মা কিছু বলছে না। ঝুপলি ভেতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল সে তার চেনটা মুখে করে আনছে। বাবার পায়ের কাছে চেনটা রেখে দিয়ে সে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। বোকা বোকা কুতকুতে চোখদুটো বাবার চোখের দিকে চেয়ে স্থির। প্রতিমা ধীরে ধীরে উঠে ভেতরে চলে গেলেন। মুখার্জি সাহেব আর্দ্র গলায় বললেন, ঝুপলি, ঝুপলি, নটি গার্ল তোমাকে চেন পরতে হবে না, এখন চেন পরালে তোমার মা ভীষণ কাঁদবে। কিন্তু আর কক্ষনো অমন একা একা বাইরে যাবে না। যাবে না তো? ঝুপলি তার বেঁটে ল্যাজটা প্রাণপণে নাড়াতে লাগল। তারপর লাফিয়ে বাবার কোলে উঠল, কোলের মধ্যে যদুর সম্ভব কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে বসে আদর খেতে লাগল।

জোর আলোচনা চলছে বাবা আর কাকার মধ্যে। অনিল সেনগুপ্ত বললেন, জহর দাসকে কনট্যাকট করা ছাড়া তো আর উপায় দেখছি না। কেনেল ক্লাবের ব্যাপার-স্যাপার আমরা কিছুই জানি না! ওদের শুনেছি অনেকরকম নিয়মকানুন আছে। গিয়ে শুধু শুধু অপমান হব কেন? তার চাইতে জহরকে কনট্যাকট করি। কিন্তু জহরের তো আবার ফোন পাচ্ছি না!

তা মানুষটাকে দু দিন সময় দে! জহর থাকে, সে কি এখানে? অনিলের গাড়ি গেছে গ্যারাজে, তারও তো সাতষট্টির কাছে বয়স হল। ওরকম হুড়মদুম করলে সে পারে? ঝুপলি দিব্যি সকালবেলা ব্রেকফাস্ট করলো, দুটোর সময়ে আটার রুটি মাংস, অসময়ের গাজর দিব্যি সব সাঁটাল। তিনটে নাগাদ খুব সম্ভব, দূরে শোনা গেল সেই আওয়াজ, ঘেউ ঘেউ, ঘৌ। ঘেউ ঘেউ ঘেউ!

অমনি ভৌ ভৌ! সাড়া দিয়েই ঝুপলি ছটফট করতে লাগল। মুখার্জিসাহেব রকম দেখে তাকে বেঁধে রাখলেন। প্রতিমা আড়চোখে চেয়ে দেখলেন একবার, তারপর বললেন, এ ভাবে শাস্তি দেওয়া কেন? কথায় বলে যার যেখানে মজে মন…।

তাই বলে একটা পারিয়া ডগ? নেড়ি কুত্তা? গর্জন করে উঠলেন মুখার্জি সাহেব। প্রতিমা কেঁপে উঠলেন।

ছোট্ট একটু দুপুর-ঘুমের অভ্যেস মুখার্জি সাহেবের। আর্ম চেয়ারে শুয়ে শুয়েই ঘুমোন। চটকাটা ভাঙলে মুখ-টুখ ধোবেন, চান করবেন, পোশাক পরিচ্ছদ পরবেন, তারপর দাঁতে চুরুট কামড়ে চেন হাতে ঝুপলিকে নিয়ে বেরোবেন। বেরোতে গিয়ে দেখলেন, চেন ছেড়া পড়ে রয়েছে, ঝুপলি নেই।

বিকেল কাটল, সন্ধে হল, রাত হল, রাত গড়িয়ে ভোর হল ঝুপলি নেই। রাতে দুজনে ঘুমোতে পারেননি, পোর্টিকোয় বসে কাটিয়ে দিয়েছেন। ভোরের দিকে

চেয়ারে বসে বসেই টুলেছেন। পরদিন যখন দুপুর কেটে বিকেল হচ্ছে, আকাশে সাজো সাজো রব পড়ে গেছে, গুড় গুড় করে মেঘ ডাকছে, ভরা বাদর শুরু হল বলে, এমন সময় দেখা গেল ঝুপলি ফিরছে! খোলা গেট দিয়ে ঢুকে এল, কুকুতে লোমে-ঢাকা চোখদুটো এদিক ওদিক ঘুরছে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে এবার।

মুখার্জি সাহেব গর্জন করে উঠলেন, গেট আউট, গেট আউট আই সে।

ঝুপলি ভেবলে গিয়ে তাকাল। তিনি পথ আটকিয়ে দাঁড়ালেন! যেদিক দিয়েই ঝুপলি ঢুকতে যায় তাঁর কেডস পরা পা জোড়া সেখানেই গিয়ে দেয়ালের মতো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। প্রতিমা পেছন থেকে আর্ত গলায় বললেন, কী করছ? কী করছ? এবার ছেড়ে দাও। অনেক শাস্তি হয়েছে, ওকে ঢুকতে দাও!

মুখার্জি সাহেব তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, নো।

গর্জমান আকাশের তলা দিয়ে মুখ নীচু করে ঝুপলি চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরেই আকাশে রোলার গড়িয়ে প্রচণ্ড জোরে বৃষ্টি নামল। জলের প্রবল ছাটে পোর্টিকো ভিজে যাচ্ছে, উঠে যেতে যেতে প্রতিমা কাঁদো কাঁদো গলা বললেন, দেখো তো কী করলে? এই বৃষ্টিতে কোথায় ভিজে জাব হবে এখন! নিউমোনিয়া না হলেই বাঁচি। মুখার্জি বললেন, কিসসু হবে না। কম চালাক নাকি? সেনগুপ্তদের বাড়ি সেঁদিয়েছে দেখবে। পুটপুটির সঙ্গে হয়তো খেলা জুড়ে দিয়েছে।

তাই বলে এই ভীষণ বৃষ্টির মধ্যে এইভাবে বার করে দেবে?

মুখার্জি-সাহেব দাঁতে চুরুট কামড়ে বললেন, ওর একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার।

ওই শিক্ষাই দাও জীবনভর, আর কিছু দিয়ো না, কিছু দিতে শিখো না প্রতিমা দ্রুতবেগে স্বামীর এলাকা থেকে দূরে শোবার ঘরের আশ্রয়ে চলে যেতে থাকলেন।

বৃষ্টি থামলে, চকচকে ভিজে রাস্তায় ওপর টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে মুখার্জি সাহেব চললেন সেনগুপ্তের বাড়ি। বেল বাজছে। সাহানা খুললেন, কী ব্যাপার দাদা? আপনি এতো রাতে?

ঝুপলি আসেনি?

কই না তো? বাড়িতে নেই?

নাঃ।

মহাপাত্রদের বাড়ি গেলেন মুখার্জি, ঝুপলি? আমার টেরিয়ারটা! এসেছে?

কই না।

প্রীতমের বাড়ির বেল বাজালেন মুখার্জি। প্রীতম খুলে দিয়েছে, ক্যা হুয়া আঙ্কল কুছ গড়বড় তো নহী হুয়া!

ঝুপলি ইজ মিসিং। একটু বকাঝকা করেছিলুম!

ওহ হো প্রীতম বোকার হাসি হাসল, কীধর জায়েগী উও, পেট হাউজ ডগ, কোঠী গিয়ে দেখুন, এসে বসে আছে।

কোঠীই চলে এলেন মুখার্জি। উমি খুলে দিল।—ঝুপলি ফিরেছে রে?

না তো দাদুসাহেব! এই দুর্যোগের রাতে কোথায় গেল বলো তো?

বাইরের জুতো মোজা ছেড়ে শোবার ঘরে এসে থমকে গেলেন মুখার্জি। প্রতিমা একটা অ্যালবাম বুকে আঁকড়ে মড়ার মতো চোখ বুজিয়ে শুয়ে আছেন। ঠোঁট নড়ছে। বোধহয় জপ করছেন।

তারপর দিনও ঝুপলি এল না। পর দিনও না। পর দিনও না। কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল লস্ট কলমে এ টুয়েলভ ইঞ্চ হাই ব্লয়িশ গ্রে আইরিশ টেরিয়ার আনসারিং টু দা পেট নেম অব ঝুপলি ইজ মিসিং সিনস থার্ড সেপ্টেম্বর…এটসেটেরা এটসেটেরা। একদিন দুদিন করে পুরো একমাস হয়ে যাবার পর অবশেষে মুখার্জি সাহেব বুঝতে পারলেন ঝুপলি আর আসবে না। এবং প্রিয় মানুষে আর প্রিয় কুকুরে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো তফাতই নেই। ঝুপলি তাঁর সমস্ত আদেশ বেদবাক্য বলে মানতে শিখেছিল। মনোসিলেবিক সব আদেশ। সিট ডাউন তো সিট ডাউন, স্টে পুট তো স্টে পুট, গেট আউট তো গেট আউট। সে এমনটাই বুঝছে। তার বোকাটে কুতকুতে চোখ, ভোঁতা কালো নাক আর বেঁটে খাড়া লোমশ ল্যাজ নিয়ে ঝুপলি এই নিরাত্মীয় পৃথিবীর বুকে হারিয়ে গেছে।

পোর্টিকোয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষাক্লান্ত মানুষটি শেষে একেবারে ভেঙে পড়েন। ভাঙা গলায় বলতে থাকেন, আই ড্ডিনট মীন ইট বুড়ি, ওহ বুড়ি মা, আই নেভার মেন্ট ইট। ইউ জাস্ট কাম ব্যাক অ্যান্ড সি…।

মেঘলা আকাশের তলা দিয়ে ফিরছেন সেনগুপ্ত দম্পতি। দুজনেরই মন খারাপ। সাহানা ভারী গলায় স্বামীকে জিজ্ঞেস করেন, ঝুপলিকে আবার কবে থেকে বুড়ি মা বলে ডাকা ধরেছেন মুখার্জিদা?।

অনিল সেনগুপ্ত বিষণ্ণ মুখে বলেন, কী জানি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *