• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

ইতিহাস ও জাতি দিয়ে ঘেরা – আফসান চৌধুরী

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » প্রবন্ধ » ইতিহাস ও জাতি দিয়ে ঘেরা – আফসান চৌধুরী

দক্ষিণ এশীয় সাহিত্যে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ এক অমীমাংসিত মহৎ রহস্য হয়ে রইলেন। কবি ফয়েজ কোথায় শেষ আর কোথায় শুরু রাজনীতিক ফয়েজ? কোথায় শেষ প্যান-দক্ষিণ এশীয় মার্ক্সবাদী আর কোথায় শুরু পাকিস্তানি সত্তা? এসব বিপরীতমুখী পরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার বিষয়টি তাঁর অনুরাগীদের জন্য পীড়াদায়ক এক ধাঁধা হয়ে আছে।
কোনো বাংলাদেশি অনুরাগীর জন্য এটি আরও জটিল। এই নিবন্ধের লেখক একজন বাংলাদেশি; তাঁর জন্ম ১৯৫০-এর দশকে। তাঁর কাছে এক জটিল পরিচয়ে হাজির হন ফয়েজ—সব সীমানা পেরোনো মহান আদর্শের সঙ্গে তাঁর বন্ধন। তিনি এমন এক পাকিস্তানি, যাঁর পানে বাংলাদেশিরা সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দৃষ্টিতে চেয়ে থেকেছে। তবে এই বন্ধনের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে আসে একাত্তর ও তার যুদ্ধোত্তর ফয়েজ। যে বাংলাদেশিরা ফয়েজের সম্বন্ধে জানতেন, তাঁরা সেসব ভয়ানক দিনগুলোতে ভেবেছেন, ‘এসব বিষয়ে ফয়েজের কী ভাষ্য?’ পূর্বাংশের মানুষের চোখে তখন তিনি শুধু ‘ভালো পাকিস্তানি’ হয়ে গিয়েছিলেন। তাহলে ফয়েজ কি কোনো দিন এমন কিছুর প্রতিনিধিত্ব করতেন, যা পাকিস্তানকে ছাপিয়ে যায়? পাকিস্তানি পরিচয়ের বাইরে এসে তাঁর পক্ষে কি সম্ভব ছিল দক্ষিণ এশিয়া ও তার বাইরের গুণমুগ্ধ অনুরাগীদের ধারণ করে বৃহত্তর পরিচয় গড়ে তোলা?
১৯৬০-এর দশকের শেষভাগে মুনীর চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তানে সাহিত্যবিষয়ক একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করতেন। পাকিস্তানি লেখকদের সাহিত্যকর্মের ওপর আলোচনা করতেন। বক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতি কিংবদন্তিতুল্য। সাহিত্যজগতের মহান প্রতিভাদের তিনি নাটকীয় ভঙ্গিতে তুলে ধরতেন। ফয়েজের ওপর তেমনি এক অনুষ্ঠান করলেন তিনি। ফয়েজ তাঁর সুহূদ, সহযাত্রী। ‘মুঝসে পাহলি সি মুহাব্বাত মেরে মেহবুব না মাঙ’ কবিতার ওপর আলোচনা কেন্দ্রীভূত রেখে মুনীর চৌধুরী ফয়েজকে একজন সামাজিক বিপ্লবী এবং নিপীড়িত মানুষের কবি হিসেবে তুলে ধরলেন। এই উপস্থাপনা মুনীর চৌধুরীর সঙ্গেও মানিয়েছিল ভালো—তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন, ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের সময় তাঁর সক্রিয়তার ফলে জেল খাটতে হয়েছে। একজন আজীবন সাহিত্যকর্মী হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠেছিলেন।
সবচেয়ে জরুরি কথা হলো, ফয়েজের কবিতার প্রতি মুনীর চৌধুরীর ভালোবাসায় খাদ ছিল না। টেলিভিশনে মুনীর চৌধুরীর সেই উপস্থাপনা আমার জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত; অনুভূতি ও সৌন্দর্যের যে কবিকে তিনি চেনালেন, সেই কবিতে আমি আজও মজে আছি। তথাপি আমার ভালো লাগায় চলে আসে ঈষৎ বেদনার আভাস—যখন দেখি ফয়েজকে বানিয়ে ফেলা হয়েছে জাতীয়, আঞ্চলিক ও ভাষাকেন্দ্রিক। একদা যে কবি আমাদের সবার উদ্দেশে কথা বলতেন, তাঁর জন্য এ তো এক ট্র্যাজেডি।

বিপ্লবীর রূপান্তর
চল্লিশের দশকে ফয়েজ মার্ক্সবাদী ছিলেন, কোনো সন্দেহ নেই। তৎকালীন অবিভক্ত ভারতে থাকতেন। ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। কিন্তু ফিরে এলেন সাংবাদিক হতে। বিয়ে করেছিলেন ব্রিটিশ নারী অ্যালিসকে। অ্যালিস কমিউনিস্টদের প্রতি সহমর্মী। তাঁর বোনও বিয়ে করেছিলেন এক ভারতীয়কে, যিনি আলীগড়ে পড়াতেন। সেই সময়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি জাতিরাষ্ট্র গঠিত হলে কমিউনিস্ট পার্টি দলীয় সদস্যদের বলল নিজ নিজ ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বেছে নিতে। দলের নির্দেশ মেনে বহু কমিউনিস্ট নতুন সীমান্ত পেরিয়ে ভারত ও পাকিস্তানে চলে গেল। বহু সমালোচকের মতে, তারও আগে কমিউনিস্ট পার্টি দলীয় কর্মীদের যখন নিজ নিজ ধর্মীয় পরিচয় অনুযায়ী মুসলিম লীগ অথবা কংগ্রেসে যোগ দিতে বলে, তখনই ‘সাম্প্রদায়িক’ হয়ে ওঠে। ভারতের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা এবং পরিচালনা করার সামর্থ্য দলটির তেমন নেই বলে প্রমাণিত হলো আর কমিউনিস্ট পার্টি চলে গেল প্রান্তিক ভূমিকায়।
আগে অবাধ বিচরণ থাকলেও ভারত ভাগের পর ফয়েজ নতুন সীমান্তরেখার পাকিস্তান অংশে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন। নতুন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় মতাদর্শের (রাষ্ট্রের সনদে পরিষ্কার যেমন দেখা যাচ্ছিল, ক্রমেই সেই এক ধর্মের রাষ্ট্রের দিকেই ধাবিত হলো) প্রতি তাঁর বিশ্বাস থেকে তিনি এ সিন্ধান্ত নিলেন? ফয়েজ কখনো মুসলিম লীগার ছিলেন না, এমনকি ‘মুসলমান’ও না। তাহলে কেন তিনি পাকিস্তানকে বেছে নিলেন? হয়তো তা শুধুই তাঁর স্বদেশে ফেরা, যে স্বদেশ সব দিক থেকে ভারতের থেকে কম উন্মুক্ত। ঠিক কী কারণে তিনি পাকিস্তানের প্রতি আকৃষ্ট হলেন তা নির্ভুলভাবে বলা কঠিন, তবে নিশ্চয়ই তিনি নতুন রাষ্ট্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সেই সিদ্ধান্ত নেননি। হয়তো ঘরে ফেরাই একমাত্র উদ্দেশ্য।
১৯৪৭-এর পর ফয়েজ তাঁর চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও তৎপরতার জন্য পাকিস্তানে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর বামপন্থী অবস্থান ছিল স্পষ্ট। ট্রেড ইউনিয়ন তৎপরতার সঙ্গে শরিক ছিলেন। পাকিস্তানের জন্মের একেবারে সূচনালগ্নেও ট্রেড ইউনিয়ন করা অনেকটাই রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা গণ্য করা হতো। ১৯৫০-৫১ সালে ফয়েজ গ্রেপ্তার হলেন। তাঁর সঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা সাজ্জাদ জহির এবং জেনারেল আকবর খানের নেতৃত্বে কয়েকজন সেনা কর্মকতা। তাঁদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করার অভিযোগ করা হলো। দীর্ঘ কয়েক বছর কারারুদ্ধ থাকার পর বিচারে তাঁর চার বছর সাজা হলো।
দুনিয়াব্যাপী কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ক্ষমতার বাইরে থাকা অবস্থায় সাধারণত সেনাবাহিনীমুখী হয় না। কিন্তু কমিউনিস্টদের মধ্যে সব সময় সেনাবাহিনীর প্রতি মারাত্মক আকর্ষণ দেখা গেছে। এঁরা বিশ্বাস করেন যে সামরিক অভ্যুত্থান দ্রুত এক ঝাপটায় বিপ্লব ঘটাতে পারে—সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও স্থিতিস্থাপকতা গুণকে অদরকারি বানিয়ে দেয়। আফ্রিকায় সেই চেষ্টা করা হয়েছে—তাতে সাফল্যের ঘাটতি সুস্পষ্ট। উদাহরণ, ইথিওপিয়া ও মোজাম্বিক। বাংলাদেশেও তাই।
১৯৫০-এর অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টায় বামপন্থীদের জড়িত থাকার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আছে বলে মনে হয় না। তবে তাতে ফয়েজের সম্পৃক্ততা ছিল, অথবা আমাদের ধারণা তিনি জড়িত ছিলেন। কেননা কোনো ‘স্বীকারোক্তি’ মিলেনি। কারারুদ্ধ হওয়ার পরপরই তাঁর সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন অপসৃয়মাণ হতে থাকে। যা হোক, ১৯৫৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। জনমনে ফয়েজ ক্রমেই রাজনীতিকের বাইরে বহুমাত্রিক পরিচয়ে হাজির হতে থাকেন—আমাদের সময়ের অন্যতম মহৎ কবি, পাকিস্তানি সুফিদের সুহূদ আর অবশেষে সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্বিষ মানুষ, স্পষ্টবাদী অ্যালকোহলপ্রেমী। ফয়েজ বদলে গেলেন। তাঁর এই রূপান্তর মহৎ কবির নির্ঝঞ্ঝাট পরিচয়ের সঙ্গে ভালোভাবে খাপ খেল। নতুন রূপের এই কবি রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করেন না। তবু সত্য রয়ে যায়: তিনি তো চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, যদিও সফল হয়নি।

কবি ও কমিউনিস্ট
কবি ও কমিউনিস্ট পরিচয় সব সময় একসঙ্গে ভালো যায় না। কবিরা সচরাচর শব্দ ও অনুভূতির কারবারি, হূদয়ের টানে রাজনীতির ময়দানে আসেন, মতাদর্শের জন্য নয়। সময় গেলে পরিচয় দুটির মধ্যে বিরোধ দেখা দিতে পারে, যদি না সামনাসামনি লড়াই বেধে যায়। চিলির কবি পাবলো নেরুদা যতটা না মার্ক্সবাদী বিপ্লবী, তার চেয়েও বড় কবি। তবু তিনি উভয় পরিচয় মিলিত চর্চা করতে সচেষ্ট ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে কারাবন্দী করা হয়। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সহযাত্রী। এমনকি তিনি দলটির আনুষ্ঠানিক বাংলা সংবাদপত্রও চালিয়েছেন। কিন্তু সময় গেলে সরে গেলেন—তাঁর কবিতা ও গান প্রাধান্য পেতে থাকল।
নজরুলের চেয়ে ফয়েজ ভালো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেয়েছিলেন। মার্ক্সবাদী মতবাদ ও তার প্রায়োগিক দিক নিয়েও ফয়েজের বোঝাপড়া ভালো ছিল। তদুপরি তিনি ছিলেন অধিকতর মধ্যবিত্ত ও শরিফ (ভদ্রলোক)। তাঁর কবিতার শিকড় ও হাতিয়ার উর্দু ও ফারসি সাহিত্যের চমৎকার নির্যাস। এমনকি তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘মুঝছে পেহলি সি মুহাব্বাত’-এর ভাষা অত্যন্ত কুশলী গ্রন্থীবদ্ধ ফারসি-উর্দু, সুশিক্ষিত অল্পসংখ্যক মানুষের পক্ষেই যার অর্থোদ্ধার সম্ভব। অন্যদিকে নজরুল কৃষক পরিবারের সন্তান। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ যে শ্রেণী ও সাংস্কৃতিক শিকড় থেকে উঠে আসা তা নানা দিক থেকে নজরুলের চেয়ে ফয়েজের মধ্যে অনেক ভালোমতো ধরা পড়ে।
কিন্তু পাকিস্তানে ফয়েজের রাজনীতির জায়গা কোথায়? যদিও পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট ঐতিহ্য অনেক গভীরে প্রোথিত আর মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিককর্মীদের দ্বারা সেখানকার রাজনীতি তাড়িত হয়েছে, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে তেমন তাড়না ছিল পুরোপুরি অনুপস্থিত। ভারতের প্রতি ঘৃণায় ঐক্যবদ্ধ—তার অধিক কিছু নয়। কেউ হয়তো মিয়া ইফতেখারুজ্জামান ও ওয়ালী খানের নাম বলতে পারেন, তবে তাঁরা যতটা না মার্ক্সবাদী, তাঁর চেয়ে বেশি পশতুন।
ঢাকায় শিশুকালে শুনেছিলাম পাকিস্তানে টাইমস-এ জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক আইন জারির (১৯৫৮ সালে) প্রশংসা করে সম্পাদকীয় লিখতে ফয়েজ অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। মিয়া ইফতেখারুজ্জামান তখন পত্রিকাটির মালিক আর সম্পাদক ফয়েজ। কিছুদিন পরই পাকিস্তান সরকার পত্রিকাটি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলে ফয়েজকে পত্রিকা ছাড়তে হয়। এই স্পর্ধা দেখানোর পর রাজনৈতিক ফয়েজকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, অন্তত প্যান-পাকিস্তানি রাজনীতিতে, যে রাজনীতির অনুরণন পূর্ব পাকিস্তানেও পাওয়া যেত। তখন থেকেই ফয়েজ হয়ে ওঠেন শুধুই একজন কবি, সমাজতন্ত্রী কবি আর নন।
ফয়েজ তাঁর আদর্শের অবয়বে যে পাকিস্তানকে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন ১৯৭১-এ, সেই পাকিস্তানের অবসান ঘটে গেছে। ঢাকায় ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউন চালানোর পরের দিনগুলোতে মানুষেরা যখন ভাবছে পূর্বাংশের রক্তাক্ত ঘটনাবলিকে কীভাবে দেখছে পশ্চিমাংশের জনগণ, তখন দেখা গেল সমস্বরে তার অনুমোদন, নেতৃত্বে জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি বললেন ‘থ্যাঙ্ক গড! পাকিস্তান ইস সেভড!’ এই অকালীন বক্তব্য বিখ্যাত হয়ে আছে। শেষ পর্যন্ত ভুট্টোর সব কৌশল গতি হারিয়ে ফেলল—ডিসেম্বরে এসে পাকিস্তান লজ্জাজনকভাবে ভেঙে পড়ল। ফয়েজকে যাঁরা চিনতেন, সেদিনগুলোতে তাঁরা জানতে উৎসুক ছিলেন, কী বললেন ফয়েজ? তিনি প্রতিবাদ করেছেন? এটা যে ভুল হচ্ছে এ কথা বলে কোনো বিবৃতি দিয়েছেন? ফয়েজ আসলে কী করেছিলেন আমরা জানি না। কিন্তু এটুকু জানি, এই সেই কবি, যাঁর কাছে বহু বাংলাদেশি আশা করেছিলেন তাঁদের পাশে দাঁড়বেন তিনি। যেসব পাকিস্তানি ভিন্নমত জানাতে চেয়েছেন তাঁরা সামরিক শাসনে চালিত পাকিস্তানে তা জানাতে পারতেন—এমন আশা নিশ্চয়ই ঠিক নয়। একেবারে হাতে গোনা কয়েকজন তা পেরেছিলেন। যাঁরা তা করেছিলেন তাঁদের হয় জেলে যেতে হয়েছিল নতুবা আরও বড় মূল্য দিতে হয়েছিল। কিন্তু বাংলার জনগণের ভাবনায় কবি ও রাজনীতিক ফয়েজ যেমন মানুষ ছিলেন, তাঁর কাছে তাঁদের সেই দাবি ছিল। তাঁকে শুধু এক রক্ত-মাংসের পাকিস্তানি হিসেবে দেখতে চায়নি। একভাবে ফয়েজ হয়ে উঠেছিলেন পাকিস্তানের ইতিহাসের বন্দী।

বন্ধু ও অচেনা
১৯৭৪ সালে ফয়েজ বাংলাদেশে এসেছিলেন। সরকারি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সংস্কৃতি উপদেষ্টা হিসেবে। তিনি বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু লেখক, কমিউনিস্ট কর্মী শহীদুল্লা কায়সার, মুনীর চৌধুরী, জহির রায়হানের মতো অন্তরঙ্গতম বন্ধু নেই। যুদ্ধের সময় তাঁদের অন্তর্ধান ঘটে। বন্ধুত্বের মধ্যে স্মৃতি, আলাদা ইতিহাসের বোধ আর দূরের দুই দেশের বাস্তবতা এসে পড়ায় অন্যরা ফয়েজের সঙ্গে স্বস্তিবোধ করেননি। বন্ধুত্বের উষ্ণতার ঘাটতি ছিল। তাঁর সবচেয়ে যন্ত্রণাদীর্ণ ও সুন্দর কবিতার অন্যতম ‘হাম কে থেহরে আজনবি’ (আমরা অচেনা হলাম)-তে তাঁর ব্যক্তিগত যন্ত্রণাবোধ উঠে এসেছে। আর উঠে এসেছে বহু পাকিস্তানি ও বাংলাদেশির বোধ, যুদ্ধ যাঁদের বন্ধুত্বকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। কবিতাটির শেষের পঙিক্তগুলো হলো:
উন সে জো কেহনে গায়ে থি ফয়েজ, জা সাদকা কিয়ে
আনকাহি হি রেগ গায়ি ভো বাত, সাব বাতোন কে বাদ
বন্ধুত্ব মানুষের ভাবনার চেয়ে অনেক কঠিন। দক্ষিণ এশীয়ায় রাজনীতি বন্ধুত্বকে পুড়াতে পারে সংঘাতের আগুনে।
১৯৫০-এ কারাবন্দী হওয়ার পরপরই ফয়েজের রাজনীতির কবর হয়ে যায় পাকিস্তানে। শুধু তাঁর কবিতা বেঁচে থাকে। কবি হিসেবে প্রতিদিন তাঁর মর্যাদা বেড়েছে—সারা উপমহাদেশে খ্যাতির বিস্তার ঘটেছে। অবশেষে ফয়েজ মহত্তম কিংবদন্তিদের অন্যতম হয়ে ওঠেন। কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ১৯৪৭-এর পর যেহেতু যে দেশে তাঁর বাস সে দেশের দ্বারা তাঁর জগৎ নির্ধারিত হয়েছে, তাহলে কি তিনি নিজ জনগণকে (রাষ্ট্রের সীমা ছাড়িয়ে যে জনগণ দক্ষিণ এশীয়) গড়ে তোলার কাজে ইস্তফা দিলেন। পাকিস্তানের রাজনীতি তাঁর সমাজতান্ত্রিক মনকে আবদ্ধ করে ফেলেছিল। যে রাজনীতির বদল ঘটাতে চেয়েছিলেন সেই রাজনীতিই তাঁর মানসপট অতিক্রম করে গেল।
ফয়েজের ব্যক্তিত্ব শুধু একজন কবির ব্যক্তিত্ব ছিল না। আমার মনোবেদনার কারণ আসলে সেটাই—স্বীকার করি, এটা আমার অযৌক্তিক অনুভূতি। আমরা এমনও দেখেছি, রাজনীতি পাল্টাতে না পেরে কখনো কখনো মানুষ কেমন করে নিজেই বিরাজনীতিকৃত হয়ে যায়। একবার মুনীর চৌধুরী প্রকাশ্যে আপসোস করে বলেছিলেন, জীবনের প্রলুব্ধতার কাছে তিনি হেরে গেছেন—শিক্ষক হওয়ার জন্য দলীয় কর্মীর জীবন ছেড়ে দিয়েছেন। ফয়েজ কোন পথ অনুসরণ করেছিলেন, তা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। কিন্তু আশা করি পাকিস্তানে তিনি রাজনৈতিক দাবির পক্ষে দাঁড়িয়েই শান্তি পেতেন।
ফয়েজের কবিতা পাকিস্তানে যতটা প্রশংসনীয়, ঠিক ততটাই ভারতেও। আমার মনে হয়, ভারতের রাজনৈতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ মাটিতেই হয়তো ফয়েজ আরও ভালো থাকতে পারতেন। ভারতে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির ভগ্নদশা হলেও অস্তিত্বহীন তো নয়।
কলামিস্ট, বিদ্রোহী, সেক্যুলারপন্থী, রোমান্টিক কবি, অ্যালকোহলপ্রেমী—সব সত্তা শেষ পর্যন্ত হয়ে গেল পাকিস্তানি। তাই তিনি ১৯৭৪ সালে ভুট্টোর সঙ্গে ঢাকা এসে দেখলেন তাঁর বহু বন্ধুকে মেরে ফেলা হয়েছে কিংবা কোনো খোঁজ নেই। সে শক্তি এসব ঘটিয়েছে, তখন বাংলাদেশে তিনি সেই শক্তিরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। গভীর ফাটল হয়ে পড়েছে অসীম ও পূর্ণাঙ্গ: তাঁর সফরসঙ্গীদের সঙ্গে আর মেলামেশা সম্ভব ছিল না তাঁর বাংলাদেশি বন্ধুদের।
যারা পৃথিবীর ইতিবাচক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে, তারা কখনো কখনো ইতিহাসেরই দাস হয়ে যেতে বাধ্য হয়।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৪, ২০১১

Category: প্রবন্ধ
Previous Post:স্মৃতির ছায়া – অ্যালিস ফয়েজ
Next Post:বই পরিচিতি – মার্চ ০৪, ২০১১

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑