০৬. রঞ্জুকে মতিঝিল কলোনিতে পৌঁছে দিয়ে

রঞ্জুকে মতিঝিল কলোনিতে পৌঁছে দিয়ে ঘরে ফিরে এলো খোকা; দুপুরের পর তাকে আবার যেতে হবে আনতে।

গেটের মুখেই দেখা লুলু চৌধুরীর সঙ্গে; ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলো না খোকা নিজের চোখকে। তাকে না পেয়ে বিমর্ষ মুখে ফিরে যাচ্ছিলো লুলু চৌধুরী।

খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেন না?

কিছুটা–ড্রইংরুমে বসালো খোকা লুলু চৌধুরীকে।

ময়ূরনীল জর্জেট শাড়ি লুলু চৌধুরীর পরনে। বসার সময় কোলের ওপর আঁচল ঝরে পড়ে। এস্ত হাতে কাঁধে আঁচল তুলে লুলু চৌধুরী বললে, কোনো অসুবিধে করলাম না তো?

নিরুৎসাহিত খোকা বললে, ঠিক তা নয়, তবে আপনাকে যার আপ্যায়ন করার কথা, আপাতত সে ঘরের বাইরে, আমার বোন রঞ্জুর কথা বলছি–

আপনি তো আছেন!

কিছু একটা বলতে হয় তাই বলা, এমন ভঙ্গিতে গা ছেড়ে খোকা জিগ্যেস করলে, মুরাদ ঘরে, না বেরিয়েছে?

এতোক্ষণ বোধহয় বেরিয়ে পড়েছে। চিন্তা করলেন কিছু?

বুঝতে পারছি না!

বা রে, বেমালুম ভুলে বসে আছেন সব?

আপনি কি সত্যিই সিরিয়াসলি নিয়েছেন ব্যাপারটাকে?

বেশ লোক তো আপনি!

অযথা সময় নষ্ট হবে আপনার, ভুল পথে পা বাড়িয়েছেন।

আমার কাজই হলো সময় নষ্ট করা। রুটিন ধরে সময় নষ্ট করতে হয় আমাকে লুলু চৌধুরী বললে, আপনাকে ব্যাপারটা খুলে বলি, বাঘা বাঘা কর্তাব্যক্তিদের কয়েকজনকে নিয়ে আমরা একটা গ্রুপ কোম্পানির পেট চিরে বেরিয়ে আসছি খুব শিগগিরই, উদ্দেশ্য নতুন কোম্পানি খাড়া করা, হয়তো কিছু কিছু শুনেও থাকবেন–

খোকা বললে, আমি কিছু শুনি নি, এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই!

কেন, বাইরে তো যথেষ্ট কাগজপত্র ছেড়েছি আমরা। বুঝলেন না, এই হচ্ছে প্রকৃত সময়। সব টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হোক এখন আর বাঙালিদের কেউ তা চায় না।

হেড অফিসগুলো সব পশ্চিমে। দেখতেই তো পাচ্ছেন, দেশের লোক কিভাবে ক্ষেপে উঠেছে, সকলেই চাচ্ছে দেশের টাকা দেশেই থাকুক, দেশেই খাটুক—

বাধা দিয়ে খোকা বললে, সকলেই চাচ্ছে, না আপনারা তাদের জ্ঞানদান করছেন?

লুলু চৌধুরী হেসে বললে, দেশের লোকই চাচ্ছে–

খোকা আবার বাধা দিলো। বললে, দেশের লোক যে কি চায় তারা। নিজেরাই তা জানে না; হাত তুলতে বললে সবাই হাত তোলে, ঐ পর্যন্তই!

লুলু চৌধুরী অসহিষ্ণু হয়ে বললে, আপনি ঠিক ধরতে পারেন নি ব্যাপারটা। দেশে রাজনৈতিক দল রয়ে গেছে, মান্যিগন্যি নেতারা আছেন, তাঁরা তাঁদের নিজেদের কিংবা দলের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে দেশের লোককে যেদিকে ঠেলে দেবেন, তারা সেইদিকেই যাবে, কিছুই করার নেই আপনার-আমার। আমাদের কাজ হবে শুধু পাবলিক সেন্টিমেন্টটাকে মূলধন করে সময়মতো কাজে লাগানো, আমাদের ভূমিকা তো এই-ই!

এক মিনিট, চা না কোল্ড ড্রিংক?

না, চা নয়—

উঠে ফ্রিজ থেকে কোকাকোলা বের করলে সে, তারপর গ্লাসে ঢেলে লুলু চৌধুরীর সামনে দিলো।

খোকা বললে, তার মানে দেশের লোককে চুষে ছিবড়ে করে ফেলে দেওয়াটাই সব প্রোগ্রামের মূল কথা

যেমন?

শুধু বীমা কোম্পানির কথা ভাবছেন কেন, সকলেই যে যার স্বার্থে আদাজল খেয়ে ঐ সেন্টিমেন্টকেই কাজে লাগাবার চেষ্টা করবে, ফলটা কি দাঁড়াবে শেষ পর্যন্ত?

লুলু চৌধুরী বললে, আপনি কিন্তু পলিটিক্যালি চিন্তা করছেন!

খোকা বললে, যাকগে যাক, খামোকা এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনো লাভ নেই। আসল কথা আমার মতো অপদার্থকে দিয়ে আপনাদের কোনো লাভই হবে না!

দু একদিনের ভিতরই বাজারে শেয়ার ছাড়া হচ্ছে–

খোকার মনে পড়লো মুরাদের কবিতা সঙ্কলনের কথা। সে হেসে বললে, ভালো সময়ই বেছে নিয়েছেন আপনারা

লুলু চৌধুরী বললে, কোনো তাড়াহুড়ো নেই, আপনি ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন সবকিছু, কিছু শেয়ার কেনার জন্যেও তৈরি থাকুন।

কোনো উত্তর দিলো না খোকা, এটা এমনই একটি বিষয় যা নিয়ে কথা বাড়ানোর আগ্রহ তার বিন্দুমাত্র ছিলো না!

এছাড়াও লুলু চৌধুরীর প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সে অপ্রিয় দ্বিধাদ্বন্দ্বের ফেরে পড়েছিলো। লুলু চৌধুরীর এই হামলে পড়া উৎসাহের গায়ে যে রঙের আবরণই থাকুক না কেন, খোকা সেটাকে সহজভাবে নিতে পারে না। সন্দিগ্ধচিত্তে কেবল সে নিজের বিচার বিবেচনাকে তলব করতে থাকে!

লিখছেন নাকি কিছু? হঠাৎ জিগ্যেস করলে লুলু চৌধুরী। খোকার মনে হলো লুলু চৌধুরীর গলার স্বর জর্জেটের আঁচলের চেয়েও স্নিগ্ধ মধুর, কিন্তু পিছলে পড়া।

কে বললে আপনাকে আমি লিখি?

এক সময় আপনি লিখতেন, মুরাদের মুখে শুনেছি, দেখলেও বোঝা যায়। আপনার চেহারা কবির–

খোকা বললে, মুশকিলে ফেললেন। আমার তো ধারণা ছিলো খুন করার পরই মানুষের চেহারা খুনির হয়, তার আগে নয়। কবিদের মধ্যে আপনি কাকে কাকে দেখেছেন?

খুব প্যাঁচালো মানুষ আপনি–

আপনার ধারণা ভুল। এক সময় মাথায় গুবরেপোকা ঢুকেছিলো ঠিকই, ঐ পর্যন্তই; সব কাজ সবাইকে দিয়ে হয় না, আপনার কোম্পানির ঐ কাজের মতোই–

বৈরাগী হয়ে যাবেন নাকি শেষ পর্যন্ত?

চাইলেও হতে দেবেন আপনারা!

তার মানে, আপনি আমার বন্ধু হচ্ছেন?

সে তো এখনোও।

মনে হচ্ছে না আমার—

খোকা হেসে বললে, আপনার একদম ধৈর্য নেই!

লুলু চৌধুরী বললে, আপনি বোধহয় মেয়েদের খুব ঘেন্না করেন?

মেয়েদের ঘেন্না করা যায়?

কেন যাবে না, এটা মনের ব্যাপার, ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার; এ রোগে তো অনেকেই ভোগে–

আমার এ রোগের বালাই নেই। গোটা নারীজাতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা অপরিসীম–

মানে আপনার কাছে তারা ঠাট্টার বস্তু!

সেটা নির্ভর করে সম্পর্কের ওপর। ধরে নিতে পারেন এ ব্যাপারে আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই, যাকে বলে কোরা, অশিক্ষিত—

আশ্চর্য কথা! অথচ আপনার চেহারা একজন প্রেমিকের–

খোকা বুঝলো কয়েকটি অলীক শাখা-প্রশাখায় ভিজে বাতাসের ছাপটা লাগছে, শিউরে উঠছে বর্শাফলকের মতো তীক্ষ্ণ কিছু পাতা। ফলে কোমল মূৰ্ছা তার যাবতীয় ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে কিছুক্ষণের জন্যে বিবশ করে দেয়।

সে হেসে বললে, গালমন্দের একটা নিজস্ব ভাষা আছে আপনার!

লুলু চৌধুরী বললে, তবু যাহোক একটা কিছু খুঁজে পেলেন শেষ পর্যন্ত, আমার আসাটা সার্থক হলো।

সবচেয়ে মুশকিল আপনাদের মতো ধ্যানী মানুষজনকে নিয়ে; ভাঁজ খুলতে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়তে হয়।

ধ্যানী বলতে কি বোঝাচ্ছেন?

সত্যি কথা বলবো? বড় বড় চোখে তাকায়

বলবেন না কেন!

যারা শুধু অপচয় করে নিজেদের, জীবনভর–

তার মানে আপনার অভিধানে মূর্খরাই ধ্যানী। আপনার সঙ্গে আমি একমত; এই একটা ব্যাপারেই কখনো কোনো কিছু জানার দরকার হয় না।

কিছুটা দোমনা মনে হলো লুলু চৌধুরীকে এক সময়। কোলের উপরে ফেলে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আনমনা হয়ে যাচ্ছে এক একবার।

লুলু চৌধুরীর দুটি পা এতোক্ষণে চোখে পড়ে খোকার, কি ধবধবে নিটোল ও মসৃণ! মনে হয় প্রতিদিন পা দুটি দুধে ভেজানো থাকে; এখনো লেগে আছে সর।

দেহের যাবতীয় কোমলতা গড়িয়ে গড়িয়ে পায়ের পাতায় এসে জমেছে; নীলঝর্ণার কোলে একজোড়া অলৌকিক রাজহংসী যে যার নিজের শুভ্রতায় তন্দ্রাচ্ছন্ন।

মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সে তাকিয়ে থাকে; তার দুচোখ নির্লজ্জতার সম্মোহনে আত্মহারা হয়।

প্রতিটি আঙুল যেন নিস্তব্ধতার এক একটি ঠোঁট, মনে হয় একদিন এদের ভাষা ছিলো; প্রতিটি নখ যেন এক একটি মিজরাব, অসংখ্য অদৃশ্য তারে বিলোল আলস্যে মৃদু মৃদু সুর তুলে চলেছে, নৈরাকার স্মৃতির মতো অবিরল শিথিল অবসাদে এক একটি দিব্য মূৰ্ছনা অর্ঘ্য হয়ে ঝরে পড়ছে নাস্তিগর্ভে।

খোকার চোখ তার অতল মুগ্ধ সরোবরে অলৌকিক রাজহংসীদ্বয়কে এইভাবে অবগাহন করায়; তৃপ্ত হয়।

রৌদের তেজ বাড়ছে বাইরে, আকাশের দিকে তাকালে চোখ ঝা-ঝা করে। জানালার পর্দা গোটানো ছিলো, টেনে দিতে গিয়েও কি মনে করে আবার ফিরে আসে খোকা; বসে সিগ্রেট ধরায়।

কেমন ভদ্রলোক আপনি, অফার করবেন না?

প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে খোকা বললে, চলে নাকি আপনার?

কখনো-সখনো, তবে নেশা নেই। ভালোই লাগে–আলতোভাবে আঙুলের ফাঁকে সিগ্রেট ধরিয়ে লুলু চৌধুরী বললে, আমার কোনো প্রিজুডিস নেই–

এবার চায়ের কথা বলি বরং–

আমি ভেবেছিলাম ঠাণ্ডা বিয়ারের কথা বলবেন! আঁচল সামলাতে সামলাতে চটুল ভঙ্গিতে লুলু চৌধুরী বললে, এক্কেবারে রসকষ নেই আপনার।

খোকা বললে, ঘরে আমার একটি গার্জেন আছে, মেনে চলতে হয়। ওকে। ওসব জিনিশ ঘরে তুলতে দেখলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ছাড়বে। আপনার কিন্তু বিয়ার ছোঁয়া উচিত–

চামদড়ি হয়ে থাকতে বলেন নাকি, চর্বির কথা বলছেন তো?

তাই—

নিজের দিকে অগোছালো দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে লুলু চৌধুরী কৌতুক করে বললে, ছিটেফোঁটা মেদ থাকা তো ভালোই; আমারটা কি খুবই দৃষ্টিকটু?

এমন মুশকিল আপনাকে নিয়ে—

মুশকিল কিসের, সত্যিকথা বলতে আপনার এতো সঙ্কোচ কেন? এরপর আপনার হাতের জন্যে দু সেট রেশমি চুড়ি আনার কথা ভাবতে–

এর চেয়ে বেশি হলে আপনি আড়াল হয়ে যাবেন—

এ্যাশট্রের উপর ঝুঁকে আধপোড়া সিগ্রেট গুঁজে দেয়ার সময় লুলু চৌধুরীর স্খলিত আঁচল মেঝের কার্পেটে ঝরে পড়লো।

একফালি আঁটো চোলির কারাযন্ত্রণায় গুমরানো স্তনদ্বয়কে ভীষণ দুঃখিত মনে হয় খোকার! অসাধারণ লজ্জায় নিদারুণ বিস্মৃতির ভিতর জগতের এই একমাত্র উজ্জ্বল দুঃখে অঞ্জলি পূর্ণ করে চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।

এবার উঠা যাক—

উঠবেন?

অনেক বোর করলাম আপনাকে!

অনেক—

আমি কিন্তু আবার আসছি।

পায়ে পায়ে গেট পর্যন্ত এগিয়ে গেল খোকা। বললে, একটু পরে আমাকেও বেরুতে হবে, আসুন তাহলে–

ফিরে এসে ঝটপট স্নানাহার সেরে ফেললে খোকা। একটা সিগ্রেট ধরিয়ে আয়েশ করে বিশ্রাম নিলো কিছুক্ষণ, তারপর বেরিয়ে পড়লো মতিঝিলের উদ্দেশ্যে।

রঞ্জু বারান্দায় তারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলো, খোকা রিকশা থেকে নেমেই হাত দেখালো, ইশারা করলো চলে আসার।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে উঠতে হলো দোতলায়, সেজখালা ডাকলো তাকে।

খোকা বললে, দেরি করতে পারবো না!

সেজখালা বললে, কি চিন্তা করলি, যাচ্ছিস তোরা?

খোকা বললে, রঞ্জুকে বলেছিলাম, বলছে যাবে না–

আর তুই?

বাড়ি দেখবে কে?

সেজখালা অসন্তুষ্ট হয়ে বললে, কি জানি, তোরা কি বুঝেছিস তোরাই জানিস। প্রাণের ভয়ে যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে, আর তোরা বাড়ি বাড়ি করে অস্থির হয়ে উঠেছিস। বাড়িঘরদোর যেন আর কারো নেই। মারামারি বেধে গেলে তাল সামলাতে পারবি?

খোকা বললে, শুনছি তো সব মীমাংসা হয়ে যাচ্ছে–

সেজখালা বললে, সেতো আমরাও শুনছি, কিন্তু মানুষজনের শহর ছেড়ে গ্রামে পালানোও তাই বলে বন্ধ নেই। না আছে। মাথার উপর কেউ, না আছে কোনো কাণ্ডজ্ঞান, শেষ পর্যন্ত সামাল দিতে পারলে হয়–

খোকা বিরস কণ্ঠে বলল, এতোসব লম্ফঝম্প সেকি শুধু শহর ছেড়ে গ্রামে পালানোর জন্যে, কিছু আসে না আমার মাথায়!

বুঝি না বাপ, শুনছি তো হুডদাঙ্গা হবেই–

সেজখালা আড়াল হতেই বেলী এসে দাঁড়ায়। তার চোখের কোলে কালি, দুশ্চিন্তাকাতর মনে হয় খোকার।

কবে তোর রাগ পড়ে?

খোকা বললে, কোনোদিনই না—

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো বেলী, রঞ্জুকে দেখে সে থেমে গেল।

রঞ্জু বললে, যাবি তো তৈরি হয়ে নে—

বেলীর মুখ ম্লান। সে বললে, আজ থাক!

তখন যে বললি যাবি?

ইচ্ছে করছে না আর এখন–

রংবাজি!

রঞ্জুকে নিয়ে এক সময় বেরিয়ে পড়লো খোকা, রিকশা ধরলো সেগুনবাগিচার।

সেই পুরানো গো রঞ্জুর, কিছুতেই যাবে না সে, কিন্তু কোনো ওজর আপত্তিই শুনবে না খোকা, সে বললে, বড় অবাধ্য তুই!

তাই বলে সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকতে হবে?

এক-আধদিন এ রকম হয়ে যায়—

রাজীব ভাই দুদিন যাবৎ বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। খোকাকে দেখে খুশি হয়ে বললে, এ-কদিন কোথায় ছিলে খোকা সাহেব, হাতা গুটিয়ে সংগ্রামে নেমে পড়েছো বুঝি?

নিজের সঙ্গে সংগ্রাম–খোকা বললে।

আমার মতো!

আপনারাও তাই চলছে নাকি?

চলছে তো বটেই, শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না; বল পাচ্ছি না দেহে, মাথা ভার হয়ে আছে, নাক-কান বুজে শুধু বিছানায় পড়ে থাকতে ইচ্ছে। করে।

নীলাভাবী বললে, শরীর ঠিকই আছে, চিন্তায় চিন্তায় অমন হয়েছে। ওনার। দিনকাল খারাপ, ঐ সাত রাজার ধন নিয়ে বাইরে যাবেই-বা কিভাবে, বুঝলে না?

তুমি তো বলবেই—

বলবো না কেন, কথাটা কি মিথ্যে? কবে তোমার শরীর খারাপ করেছে শুনি? দুডিগ্রি জ্বর নিয়েও তো বাইরে দৌড়ও, পাগলের ছাঁট আছে মাথায়!

একেবারে পাগল হতে পারলে তো ভালোই ছিলো, আধা আধা কোনো কিছুই ভালো না, খোকা কি বলো?

নীলাভাবী রঞ্জুকে নিয়ে অন্য ঘরে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রাজীব ভাই কালিপড়া রুগ্ন চোখ তুলে জিগ্যেস করলে, কি রকম বুঝছো সবকিছু?

খোকা বললে, মহাদুর্দিন সামনে সবাই বলছে, আমার মাথায় তো কিছুই আসে না। এতোসব আলাপ-আলোচনারই-বা দরকার কি? এক একবার মনে হচ্ছে সব মিটমাট হয়ে যাবে, কখনো মনে হচ্ছে সবটাই একটা ফাঁকি, কোনটাকে ছেড়ে কোনটাকে বিশ্বাস করবো বুঝি না!

সিগ্রেট ধরিয়ে ঘন ঘন টান মারতে লাগলো রাজীব ভাই। রাজীব ভাইয়ের রুক্ষ চোয়াল বিশ্রীভাবে ঠেলে বেরিয়েছে, দাড়ি না চঁচায় পাগল পাগল চেহারা। গর্তে বসা চোখ, দুশ্চিন্তার রেখা কপালে।

খোকা বললে, শেষ পরিণতিটা কি, বুঝতে পারছেন কিছু?

আমি কেন, নেতারাও সেকথা স্পষ্ট করে বলতে পারবে না। বুঝলে না, আমাদের নেতারাও অনেক সময় বুঝতে পারে না, তারা দাবার খুঁটিমাত্র, তাদের চালা হচ্ছে।

আর সাধারণ মানুষ, তারা?

মোটের ওপর তারা অতো ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না। যে অর্থে তারা স্টেডিয়ামে চীনা এ্যাক্রোব্যাটদের শো দেখতে যায়, ঠিক সেই অর্থেই কিংবা সেই উদ্দীপনা নিয়েই পল্টনের মাঠে নেতাদের লেকচার শুনতে জড়ো হয়। যদি একদিকে স্বাধিকার আর অপরদিকে সস্তায় দুগজ লংক্লথ। দেওয়া হয়, তাহলে আগে লংক্লথের লাইনেই তারা মারপিট করবে তবে সাধারণ মানুষ আমূল পরিবর্তন চায়, একথাও সত্যি–

খোকা জিগ্যেস করলে, এ সম্পর্কে তাদের ধারণাটা কি রকম—

কারো সামনেই কোনো বাস্তব পরিকল্পনা নেই। সকলের দৃষ্টিই ঘোলা, আচ্ছন্ন হওয়ার কথা তো এই রকমই; একে জানা নেই লেখাপড়া, তার ওপর দিনের পর দিন তারা প্রতারিত হয়েছে, চোখ ফুটবে কোত্থেকে? রাজনৈতিক দলগুলোর কথা ভেবে দেখ, কেবল নিজেদের প্রয়োজনে তারা জনসাধারণকে ব্যবহার করছে এইমাত্র, আর কোনো দায়দায়িত্ব ছিলো না কারো কখনো–

একটু থেমে রাজীব ভাই বললে, এখন যে অবস্থা চলছে তাতে খুব বড় করে এইটুকুই বলা যায় আঁধার হাতড়ে বেড়ানো মানুষজন এখন কিছুটা ঐক্যবদ্ধ; এটা যদি ভেস্তে যায় দেশ অনেক পিছিয়ে যাবে

কিন্তু এর পিছনেও তো দলীয় স্বার্থ রয়ে গেছে!

তা থাকুক, সব কথা ফেরানো যায় না। এখন রাজনৈতিক দলগুলোকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে এই ঐক্যকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করতে হবে।

খোকা নিস্পৃহকণ্ঠে বললে, ঐক্যটাকে এতো দাম দিচ্ছেন কেন, গোঁজামিল নেই, ফাঁক নেই এর ভিতর?

হয়তো আছে, কিন্তু একে উড়িয়ে দেওয়া যায় না–

খোকা বললে, আপনি হুজুগেপনাকে ঐক্য বলে মনে করছেন। যুক্তফ্রন্টকে ভোট দেয়ার সময়ও এই হুজুগেপনা ছিলো, আয়ুব খান যেদিন প্রথম আসে স্টেডিয়ামের ভিড়ের কথা মনে আছে আপনার? এরা তো তারাই, সেই মানুষজনই!

কথাটা ঠিক, কিন্তু একটা যুগ পার হয়ে গেছে এরপর। একথা ভুললে চলবে না। ঐক্যটা এবারে রাষ্ট্রবিপ্লবের চেহারা নিয়েছে, বলতে পারো আগুন ঘাঁটাঘাঁটি; ঘাড়ের উপরের মামদোরা কিভাবে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করবে চিন্তার কথা সেটাই। খেয়াল করলে দেখবে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে যতো রকমেই দেশকে শাসন করা হয়ে থাকুক না কেন তার কোনোটাই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলো না, সব সময় একটা সুনির্দিষ্ট ধারাবাহিকতা ছিলো তার ভিতর। এখনো আছে, পরেও থাকবে, ওরা চেষ্টা করবে রাখার–

রাজীব ভাই বালিশ টেনে নিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বিছানায় কাত হলো। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবলো, তারপর বললে, কিন্তু এখানে ও কথা আছে। ঊনসত্তরের গণঅভুত্থানের কথা ভুললে চলবে না। ওরা যা কিছু করুক, যে মাস্টার প্ল্যানই থাকুক না কেন, ঐ অভ্যুত্থানকে সামনে রেখেই তার আলোকে সবকিছুর ব্যবস্থা নিতে হবে। ওর চেয়ে অনেক অর্থবহ, অনেক ভয়াবহ ধরে নিতে হবে এবারের দর কষাকষিকে! ওটা যদি একটা ধাপ হয়ে থাকে এটা দ্বিতীয় ধাপ। এখন মানুষজনের আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি, তারা জেনে গেছে ইচ্ছে করলেই, ঐক্যবদ্ধ হলেই, তারা দেশের শাসনযন্ত্রকে একেবারে বিকল করে দিতে পারে–

খোকা চটে উঠলো। সে বললে, আপনি সংবাদপত্রের মতামতগুলোকে বোধহয় বেদবাক্য ভেবে মুখস্থ করেছেন–

কি রকম? সোজা কথা কাগজ না পড়ে নিজের মাথায় যা আসে তাই ভাবার চেষ্টা করবেন।

কেন, কাগজপত্র তো ভালোই লিখছে–

ভালো মানে বেশ্যাবৃত্তি করে যাচ্ছে, যা আগেও করেছে। কে বেশি করে গায়ের কাপড় খুলে নিজেকে দিতে তৈরি, ভালো কাগজ বলতে এই-ই।

রাজীব ভাই বললে, তুমি অন্যদিকে যাচ্ছো। আমি যা বলছিলাম, বাইরে থেকে সামরিক শাসন যতো ভারি জগদ্দল পাথরই মনে হোক না কেন, তার ভিতরের সীমাহীন দুর্বলতার কথা এক ধাক্কায় জেনে গিয়েছে মানুষজন; বিচার করতে হবে এইভাবে–

খোকা বললে, যারা এখানে পাহাড়প্রমাণ পুঁজি খাটিয়েছে, কিংবা যারা নিয়ন্ত্রিত পন্থায় বাজার হিশেবে পেতে চায় দেশটাকে, তাদের ভূমিকার কথা আপনাকে ভাবতে হবে। দেশের লোকটোক সব ফালতু কথা, তাদের কাউমাউ চিল্লাচিল্লিতে সত্যিই কিছু যায় আসে না, তা না হলে গোটা ব্যাপারটার সামনে এভাবে অনিশ্চয়তা ঝুলে থাকতো না–

তারাই-বা কি করবে–রাজীব ভাই বললে, বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এতোদিন সুবিধাবাদীদের ম্যাজিক দেখতে দেখতে দেশের লোক কুঁজো বাকা-বোবা-হাবা-কালা হয়ে গেছে; তা না হলে বৃটিশ সিংহকে খেদাবার পরও নতুন করে আবার এই সাত তাড়াতাড়ি রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক মুক্তির দরকার হয়ে পড়বে কেন?

মুক্তিটুক্তির কথা যে বলছেন, এ সম্পর্কে তাদের কোনো স্বচ্ছ ধারণা আছে, কোনো প্রোগ্রাম আছে? অর্থনৈতিক মুক্তি ছেলের হাতের মোয়া নয়। লেখাকথা আর কি, বোবা-ব্যাকা-হাবা-কালা বেড়েদের ঐক্য আবার ঐক্য!

কি আর করবে, সত্যিকার চেতনা আকাশ থেকে পড়ে না। রাষ্ট্রব্যবস্থার যাঁতাকলে মানুষজনকে এ যাবৎ শুধু পেষা হয়েছে, মাড়াই করা হয়েছে—

খোকা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললে, অর্থনৈতিক মুক্তিটুক্তি ওসব হাফসোল দেওয়া কথা, বানিশ করা কথা, যে যার স্বার্থের কথা ভেবে পাগলা হয়ে উঠছে, সবাই ভাবছে যার যার নিজের হাতে চাঁদ পাবে। পোকাপড়া মুখ, পেট বোঝাই হিংসা, নিজেদের বলতে যাদের সম্বল শুধু এইটুকুই তাদের জড়িয়ে খোয়াব দেখার কোনো মানে হয় না। মাথায় বেঁড়ে, চিন্তায় বেঁড়ে, নিজেদের সম্পর্কে কতোগুলো আজগুবি গালগপ্পো সৃষ্টি করে বুক ফুলিয়ে রেখেছে–

যতো কথাই বলো, এবারের ব্যাপার কিন্তু অন্যরকম।

খোকা বললে, যে রকমই হোক, আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, আমি ভাবছি আমাদের কি হবে!

তাহলে দেখ, তোমাকেও ভাবতে হচ্ছে–রাজীব ভাই হেসে বললে, সকলের যা হবে আমাদেরও তাই, রক্ত দেয়ার জন্যে সারা দেশের লোক পাগল হয়ে আছে–

গ্রামে পালাচ্ছে কারা?

এক একজন এক একভাবে রক্ত দেয়। পুশকিনের মতো লোকদের ডুয়েলে রক্ত দিতে হয়; কেননা তাদের শরীরে কোনো হ্যানিবলের রক্ত, আবার মারার মতো লোকেরা। গরম পানির চৌবাচ্চায় শরীর জুড়ে রক্ত দেয়, তাদের শরীর ভরা চর্মরোগ—

একটু ভেবে খোকা বললে, খেয়াল করে দেখেছেন, সারারাত কিভাবে কুকুর কাঁদে?

রাজীব ভাই বললে, আশ্চর্য তো, কালরাত্রে আমিও তাই বলছিলাম নীলাকে, ঘুমনো যায় না, মন হু-হু করে। তার মানে মড়ক একটা লাগবেই। লাগবে নাই-বা কেন, এতো আর সেই গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন নয়–

খোকা তাচ্ছিল্যভরে, কাজ কোরো না, অপিসে যেও না, মাসকাবার হলেই যে যার মাইনে তুলে নাও, চেহারাটা ভালোই আন্দোলনের, এর নাম চূড়ান্ত পাগলামি–

তুমি কি ঠিক করলে শেষ পর্যন্ত, যাচ্ছো কোথাও?

এখনো মনস্থির করে উঠতে পারি নি—

একটা কিছু ঠিক করে ফ্যালো সময় থাকতে; তেমন কোনো বিপাকে পড়ে গেলে দেখবে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে।

পাবে কি এখনই পেয়েছে—

যদি গ্রামের দিকে যাও, তোমার নীলাভাবীকে সঙ্গে নিও!

আর আপনারা?

আমার পক্ষে সম্ভব নয় কোথাও নড়া। হাত-পা বাঁধা আমার এখানে। তোমার সিদ্দিকাভাবী খুব সম্ভব আমার কথা মানবে না, কোথাও যেতে বললে যাবে না, ওর উপরে তেমন কোনো জোর নেই আমার, বুঝলে না! খারাপটা চিন্তা করা উচিত, তৈরি থাকা ভালো।

আপনাদের ফেলে নীলাভাবী যেতে চাইবে?

চাইবে না কেন? এ-তো তার ভালোর জন্যেই। অবশ্য অন্য কোথাও ওকে ভেড়ানো কঠিন, তুমি বলেই জোর দিয়ে বলছি।

কোনো ইঙ্গিত আছে কি এ কথার ভিতর? ভিতরে ভিতরে খোকা কিছুটা নাড়া খেল। সে দীর্ঘ দৃষ্টিতে তাকায় রাজীব ভাইয়ের মুখের দিকে। খোলা জানালার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে রাজীব ভাই; শক্ত চোয়াল ও পুরু ঠোঁটে নির্বিকারত্ব; ঝুলকালির বিন্দুমাত্র ছোঁয়া লেগেছে বলে মনে হলো না খোকার।

খোকা একটা সিগ্রেট ধরালো। কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে সে নিতে পারছিলো না প্রস্তাবটাকে। রাজীব ভাইয়ের এই শেষের কথাটির গায়ে সে উদাসীনতার গন্ধ পায়; তার অনুভূতি শিরশির করে ওঠে, গায়ে হুল ফোটে। এই ঔদাসীন্যে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আছে একটি প্রবল দুপুর; এই দুপুরে তারা ছিটকিনি তুলে দিয়েছে দরোজার, ছিটকিনি খুলে দিয়েছে সংযমের; সংযম ডেকে এনেছে পৈশাচিকতাকে, পৈশাচিকতা কেশর ফুলিয়ে দুঃখকে, দুঃখ ক্যাকটাসের গায়ে। গর্ভপাতের নারকী পুষ্পকে, দংশনে ঘর্ষণে পেষণে লেহনে কামদগ্ধ নিশ্বাসে ও চুম্বনে একটি একটি করে পাপড়ি ঝরে পড়েছে। পুপের, পাপড়ি খসে পড়েছে পায়ের পাতায়, গালে গলায় কটিতটে, কাঁধে বাহুমূলে, নাভিমূলে, মর্মমূলে, আঁখিপল্লবে, অশ্রুর মুক্তাফলে, বদ্ধমুষ্টির শঙ্খে এবং শঙ্খ বের করেছে তার জিহ্বাকে, জিহ্বা সর্পকে, শ্বেতচন্দন কুঙ্কুম আর কাচপোকার টিপে নিজেকে সাজিয়েছে। সর্প, কুঙ্কুম চন্দনকে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে তার গায়ে এসে বসেছে দিব্য। প্রজাপতি, শত সহস্র ফুলের নির্দোষ নির্মেঘ অবিচল বিস্মৃতি তার পাখায়–

খোকা দেখলো রাজীব ভাইকে, ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে আছে। একদিকে। ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে খোকা, টাল খায়। ভিতরে ভিতরে সে মাছি তাড়ানো মনের আলগা রাশকে কষে চেষ্টা করে; কিন্তু পেরে ওঠে না, বিফল হয়।

প্রতিবারই এরকম হয় খোকার। মনে হয় সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সে, একটি খল দুপুর হাহা করে ওঠে তার সামনে, সে আর তখন পালাবার পথ খুঁজে পায় না। তার অসহায়তার মর্মমূলে এক ঐন্দ্রজালিক অপচ্ছায়ার প্রসারণে উৎসমুখ খুলে যায় স্বপ্নের; অর্গলবদ্ধ একটি কামরার ভিতরে ছোটাছুটি করতে থাকে সে, ডাঙা কই, আবা আবা, আমাকে ছুয়ো না, আবা আবা, আমাকে ধরো না, আমি তোমার জলকে নামি নি, আমি রেডি বলি নি, আবাবা, তুমি চু ছেড়েছো, তোমার চু ভেঙে গেছে, তোমার নীলসুতো ছিড়ে গিয়েছে চুয়ের, তোমার তার কেটে গিয়েছে। চুয়ের, পাখনা ঝরে গিয়েছে তোমার চুয়ের, আবা আবা–

এইভাবে বুড়ি ছোঁয়ার চেষ্টা করে খোকা, বুড়ি খোঁজে। ডাঙা খোঁজে। ভিতরে এতো পাঁক, গা ঘিন ঘিন করে খোকার, মরা গুগলির খোল আর পচা খড়কে, কুটিকাটি, ভাঙা কলসির কানা, ভাঙা কাচ, নীলাভাবীর হিলহিলে পিচ্ছিল হাসি; তার কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম গড়ায়!

কি ভাবছো?

রাজীব ভাই স্থির দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।

না তেমন কিছু না—

মনে হচ্ছে সমস্যায় ফেলে দিয়েছি তোমাকে।

সমস্যা মনে করলেই সমস্যা! এড়ানোর চেষ্টা করে খোকা।

এই সময় নীলাভাবী ঘরে ঢুকলো, পিছনে রঞ্জু। তরমুজের প্লেট এগিয়ে দিলো নীলাভাবী।

রাজীব ভাই বললে, ঠিক যেন টুৰ্মেলিন। তোমাকে দেখাবো। আশ্চর্য মিল!

একটু পরে পরে সুটকেস খুলে একটা পাথরের চাকলা বের করলো রাজীব ভাই। বললে, এই দ্যাখো, তরমুজের মতো টুৰ্মেলিন। উপরটা সবুজ, তারপর সাদা, তারপর কেমন লালচে। এক সিংহলীর কাছ থেকে জোগাড় করেছিলাম বছর দশেক আগে। সবচেয়ে তাজ্জব কথা কি জানো? একটু থেমে রাজীব ভাই বললে, এই এতোদিন পর হঠাৎ আপনা-আপনিই চিড় খেতে শুরু করেছে, সারমর্মটা বুঝলাম না–

খোকা জিগ্যেস করলে, তোমারও বাতিক কম নয়, পাগলকে সাঁকো নাড়া দেয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এক্ষুণি ওষুধ গেলানোর মতো গালগপ্পো ফেঁদে বসবে।

ঠিক আছে বাবা, এই আমার মুখে তালাচাবি রাজীব ভাই টুৰ্মেলিন সুটকেসে তুলে রেখে বললে, গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না!

রঞ্জুর কাঁধে একটা হাত রেখে নীলাভাবী বললে, যা ভালো মেয়ে, এতো ভালো লেগেছে আমার ওকে–

খোকা বললে, বোনটা কার তা দেখতে হবে না!

আকাশ-পাতাল তফাত, এখন বুঝতে পারছি কেন এতোদিন আনোনি। নিজের নাক কাটা যাবার ভয় ছিলো তোমার।

ভালো—

আমার কি ইচ্ছে করে জানো–রঞ্জুর একটা হাত ধরে নীলাভাবী বললে, আমার ইচ্ছে করে ওকে একরাশ পুতুল কিনে দেই, ও খেলুক, সারাদিন বসে বসে তাই দেখি।

খোকা বললে, কিরে নিবি নাকি?

রঞ্জু মুখ টিপে হেসে বললে, যদি সারাদিন খেলতে হয়!

তবেই বোঝ—

সত্যি ওকে আমার এতো ভালো লেগেছে—

ভিতরে ভিতরে ক্ষেপে ওঠে খোকা। সে মনে মনে বলতে থাকে, কাকেই বা অপছন্দ তোমার! তুমি যদি একটা বাইসন হও রঞ্জু একটা হরিণছানা, তুমি লুলু চৌধুরী সব এক গোয়ালের গর, মালটানা গাব্দাগোব্দা লেল্যান্ড ট্রাক-বিশেষ, চাকার তলায় পড়লে খেল খতম, গনফট।

এবার থেকে সবসময় ওকে নিয়ে আসবে–

তা না হলে সুবিধে হবে কেন, ওর মাথাটি ভালো মতন চিবিয়ে খেতে হবে না, পারলে বলেই ফেলতো খোকা, কিন্তু রঞ্জু থাকায় সে বিজ্ঞের মতো নীরবে তাকিয়ে রইলো, কোনো উত্তর দিলো না।

নীলাভাবীর মাথায় গুচ্ছের চুল। রঞ্জু পাটির মতো বিনুনি করে দিয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে খোকাকে দেখালো নীলাভাবী। খোকার মনে হলো বাড়াবাড়ি, রঞ্জুটাও যেন দিনকে দিন ঠুনকো হয়ে উঠছে, কিসের এতো মাখামাখি, খোকার কাছে এসব প্লাস্টিকের ফুলের মতো খেলো মনে হয়।

খুব সম্ভব সুযোগ খুঁজছিলো নীলাভাবী। একফাঁকে খোকাকে একা পেয়ে ভুরু তুলে জিগ্যেস করলে, কি ব্যাপার, কেমন যেন একটু রাগ রাগ ভাব দেখছি তোমার?

তা তো দেখবেই, খুঁটে ঘা করা যাদের অভ্যেস তারা অমন দেখেই!

আমাকে দেখে তুমি বিরক্ত হও—

তুমি নিজেই একটা বিরক্তি!

নতুন করে কোথাও প্রেমে পড়েছো নাকি?

প্রেম ছাড়া তুমি কি আর কিছু শেখো নি?

বড্ড ঠোঁটকাটা হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন, কি হয়েছে কি তোমার? ঘাড়ে নতুন কোনো ভূত ভর করেছে, বুঝতে পারছি। চুলোয় যাক, নিয়ে যাচ্ছে তো? কি ঠিক করলে?

আমি কোথায় নিয়ে যাবো?

একটা হাত চেপে ধরলো নীলাভাবী। বললে, তুমি ছাড়া আর কে নিয়ে যাবে? আমি কি বাঘ না ভালুক, যে খেয়ে ফেলবো, না খোপার ভিতর সাপ রাখি? এতো ভয় কেন?

আমি কোনো ল্যাঠার ভিতরে নেই!

আমি বুঝি তাই–

তবে কি! অন্যের ঝক্কি নিজের কাঁধে নিতে যাবো কেন, আমাকে তো আর ভূতে ধরে নি। এ ভারি অন্যায় আবদার!

বড় নিষ্ঠুর তুমি!

সর্বনাশ, এতো অল্পেই তোমার কান্না আসে!

সত্যিই কেঁদে ফেলেছিলো নীলাভাবী। কান্নায় বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো গলার স্বর।

চোখ মুছে বললে, কারো উপরেই তোমার শ্রদ্ধা নেই, ভেবেছো এই করে সুখ পাবে জীবনে। কোনোদিন পাবে না। দগ্ধে দগ্ধে কালি হয়ে যাবে তোমার অন্তর, কোনোদিন তুমি সুখী হতে পারবে না, কক্ষনো না–

খোকা হেসে নরোম করে বললে, ভারি একটা মানুষ আমি, অথচ ভোজালি গুঁজতে হবে কোমরে; ঠিক আছে, চেষ্টা করে দেখবো কোনো ব্যবস্থা হয় কি না!

বিশ্বাস করো, নীলাভাবী আকুল হয়ে বললে, আমি মরে যাচ্ছি, বিশ্বাস করো খোকাবাবু, আমি মরে যাচ্ছি, আমি হাঁপিয়ে পড়েছি এই সংসারের ভিতর, আর টানতে পারছি না, ঘেন্না ধরে গেছে আমার। এর ভিতরে আর কোনো রস নেই, প্রাণ নেই, দিনরাত কবরের ভিতরে পড়ে আছি, আঁস্তাকুড়ে পড়ে আছি, আর পারছি না এভাবে। আমি তো একটা মানুষ-ই, কতো পারবো আর, শুধু জোড়াতালি, শুধু ভান, এই যে দিনের পর দিন হাবাকালার মতো সংসারের সঙ্গে আঠা হয়ে লেগে আছি এর চেয়ে ঘেন্নার আর কিছু নেই; অন্তত কিছুদিনের জন্যে তুমি আমাকে মুক্তি দাও। আমি পাগল হয়ে আছি একটু আলো-বাতাসের জন্যে–

আমি ভেবেছিলাম অন্য ধাতের মেয়ে তুমি, তোমার গোড়া শক্ত।

শক্তই। শক্ত না হলে এতোদিন ঘর করলাম কিভাবে, এখনো ঘানি টানছি কিভাবে? আমার দোষ কি জানো, আমি অভিনয় করে চলতে শিখি নি। কিন্তু এখন এমন একটা অবস্থা ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে তাই করতে হচ্ছে। এ আমি পারবো না। দিনের পর দিন শুধু দণ্ড দিয়ে যাবো, শুধু দণ্ড দিয়ে যাবো, এই চাও বুঝি তোমরা!

ভিতরে ভিতরে দমে গিয়েছিলো খোকা। থলি ঝেড়ে এমন কিছুই সে পেল না যা দিয়ে এই মুহূর্তে তর্ক জুড়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে, ঘাসকুটো ঝেড়ে ফেলতে পারে গায়ের।

সে বললে, সেদিন কিন্তু তুমি অন্যরকম বলেছিলে—

বলো, তুমি বুঝতে পারো নি—

কিন্তু কোথায় যেতে চাও?

যেখানে খুশি, যেখানে তুমি নেবে, যেখানে আনন্দ, শুধু এই কবর থেকে আমাকে বের করো। সবকিছু অসহ্য হয়ে উঠেছে আমার কাছে, মনে হয় সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দেই, তছনছ করে দেই, তারপর ছুটে বেরিয়ে যাই দু চোখ যেদিকে যায়–

দু একদিনের জন্যে হাওয়া বদল করে কি কোনো লাভ হবে, হয়তো আরো এলোমেলো হয়ে পড়বে মনের অবস্থা। ফিরে এসে আরো অসহ্য ঠেকবে সবকিছু তখন কি করবে?

সে তখন দেখা যাবে।

খোকা বললে, কি লাভ, এইভাবে অশান্তি বাড়িয়ে?

লাভ-লোকসানের কথা ভেবে শিকল তুলে বসে থাকতে পারবো না। লাভ করতে নেমেও তো লোকে লোকসান করে। আমাকে নিয়ে তোমার অতো ভাবতে হবে না, তুমি পারবে কি না বলো–

খোকা নিস্পৃহ কণ্ঠে বললে, দেখি, কি করা যায়!

ক্ষেপে উঠলো নীলাভাবী। বললে, আমি তোমার কাছ থেকে আধো আধো বুলি শুনতে চাই নি, পষ্ট জবাব দিতে হবে তোমাকে!

খোকা তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললে, তাই বলে সুবিধে-অসুবিধের কথা ভাবতে দেবে না?

এতো ভাবাভাবির কি আছে, তুমি তো আর আমাকে নিয়ে গা-ঢাকা দিচ্ছো না!

তুমি কি তাই চাও?

এতো বেশি চাওয়া যায় না। যার কাছে চাইবো তার নিজেরও কিছু দেয়ার ক্ষমতা থাকা চাই।

খোকা বললে, আমিও তাই বলি, নিজের উপরে আমার কোনো আস্থা নেই। তোমার কাঁধে এখন সৃষ্টিছাড়া নেশা চেপেছে, তুমি ছেলেখেলায় মেতে উঠেছে, পরে পস্তাবে, শুধু কাদা ঘাঁটাই সার হবে!

আমার ভালোমন্দ নিয়ে অতো চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। আমি শুধু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চাই। কেন আমি তিল তিল করে নিজেকে এমন কষ্ট দেবো, দেখাই যাক না স্বার্থপর হতে পারি কি না। যেভাবে খুশি, যেখানে খুশি, তুমি আমাকে নিয়ে চলো, যেভাবে খুশি আমাকে কিছুদিনের জন্যে রেখে দাও, আমি আমার ভিতকে নড়াতে চাই–

খোকা মুমূর্ষু কণ্ঠে বললে, তোমার সংসার?

আগে ভেবেছিলাম ভালোবাসার জন্যে মানুষ সংসার করে! চায়ের কাপ থেকে চেয়ার-টেবিল, সুই-সুতো থেকে খাট-পালঙ, কি না নেই সংসারে, শুধু ঐ ভালোবাসা বস্তুটি ছাড়া। অথচ সংসারের ভিতরে দাঁড়িয়ে কি অহঙ্কারটাই না আমাদের, দেখে যাও কতো কিছু নিয়ে এই সংসার, কি না নেই এখানে! থুতু দিতে ইচ্ছে করে আমার, ইচ্ছে করে ঝাড়ুর বাড়ি মারি। জানালার কাচ ঝাপসা হলে মোছো, ঘরে ঝুলকালি ধরলে সাফ করো, হাঁড়ির তলার কালি মেজেঘসে ওঠাও, নরদমা সাফ করো, শুধু শিকেয় তুলে রাখো মনকে, দেখার দরকার নেই তার গায়ে ঝুলকালি পড়েছে কি না, সিটিয়ে যাচ্ছে কি না! সংসারের তুমি কতোটুকু জানো! একটা গালভরা বুলি, লাশটানা খাটিয়া! এইসব দেখতে দেখতে আমি বিষিয়ে উঠেছি, শুধু আসবাবপত্র; মরা কাঠ, মরা লোহা, মরা কাচ, শাড়ি কাপড়ের গাঁটরি-বোঁচকা, ঝাড়ু মারি আমি এসবে। দিনের পর দিন নিজেকে ফতুর করে কেবল এইটুকু বুঝেছি মানুষ সংসার পাতে শুধু চার হাত-পায়ে ভালোবাসাকে মারতে। শুধু চুলোচুলি, খুন-খারাবি, ছুরি মারামারি, অথচ তুমি বলতে পারবে না, বলার নিয়ম নেই। সাজসজ্জা করে ঢেকে রাখো। শুধু এই একটা কৌশল শেখার জন্যেই দিনের পর দিন রক্ত পানি করো, কি করে এসব ঢেকে রাখবে, লোকচুক্ষকে ফাঁকি দেবে।

খোকা বললে, ঠিক আছে, এখন তুমি যাও তার ভয় ছিলো যে কোনো মুহূর্তে রাজীব ভাই অথবা রঞ্জু এসে পড়বে এবং সে বিপদে পড়ে যাবে।

এই প্রথম খোকা দেখলো নীলাভাবীকে হতাশায় ভেঙে পড়তে। একটু একটু করে গাঁথুনি ধসে পড়ছে ভিতরের, রুগ্ন মানুষের চেহারা এখন নীলাভাবীর। তা হোক, ঘোলা আর জটিল প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার মতো মানসিক স্থৈর্য খোকার এখন নেই।

এক সময় রঞ্জুকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয় সে। বেবিট্যাক্সিতে বসে দুপাশের অপসৃয়মান গাছপালা আর মানুষজন দেখতে দেখতে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে থাকে। অরণ্যে যেভাবে অতর্কিতে প্রেতায়িত অন্ধকার নামে, মনের মধ্যে সেইভাবে রাত্রি নেমে আসে ঝপ করে। অন্ধকারে কুটিল বনাঞ্চলে পথ হারিয়ে ফ্যালে সে, জটিলতা কখনো বাঘ হয়ে কখনো পাইথন হয়ে ক্রমাগত তার দিকে ধেয়ে আসতে থাকে।

এক সময় আবার ভর করে নীলাভাবী। এক অদ্ভুত প্রস্তাব! খুব সহজে নিতে পারে না খোকা, আকুলতার চেয়ে আতিশয্যই বেশি এর ভিতর। যদি ট্রাপ হয়, জাহাবাজ মেয়েমানুষের পাল্লায় পড়ে কত ছোকরাই তো ফেঁসে গেল। নাকি সাপের মতো পাকে পাকে তাকে জড়াতে চায় কোনো কদর্য অভীষ্ট সিদ্ধির অভিপ্রায়ে। একদিনের একটি দুর্বল মুহূর্তকে মূলধন করে স্বেচ্ছাচারিতায় মেতে উঠেছে নীলাভাবী; তার ধ্যান-ধারণার স্বাস্থ্য এইভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। নীলাভাবী হয়তো নিজের ঠুনকো বিশ্বাসকে এইভাবে দৃঢ় করেছে, তার শরীরের মতো লোভনীয় খোকার কাছে আর কিছুই নেই। কামগন্ধী স্থলনের পিচ্ছিল দুপুরকে মুঠোয় ভরে আত্মবিশ্বাসের গজদন্ত মিনারকে গগনচুম্বী করে তুলছে নীলাভাবী।

দেহ কি? শরীর কি?

খোকা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। নারীদেহ সম্পর্কে যতো বিশেষণই প্রয়োগ করা হয়ে থাক না কেন, আসলে তা নিছক তাল তাল গোবরের মতো মাংস ছাড়া আহামরি এমন কিছু নয়; স্পষ্ট মনে আছে খোকার, সেদিন সেই চরম মুহূর্তের পর কিভাবে গ্লানিতে ভরে গিয়েছিলো তার মন। অবসন্নতায়, মনহীনতায়, নিরাসক্তিতে, সে দুমড়ে পড়েছিলো যখন দেখলো সারা গায়ে দুর্গন্ধ নিয়ে প্যাঁচপেচে ভাগাড় থেকে নেড়িকুত্তার মতো সে উঠে আসছে।

সবই ভুসিমাল, ঘটনাচক্রে একবার ঘেঁটে দেখেই সে বুঝেছে। গোটা মানব সমাজটাই ভুসিমালের কারবারি, সমজদার। খোকা জানে, এই নীলাভাবীরা তাদের দীর্ঘ বিলম্বিত যৌবন নামক দেহসম্ভারকে লোকচুক্ষর সম্মুখে যতো মজবুত গদরেজের সিন্দুকেই আগলে রাখার অভিনয়পটুতা দেখাক না কেন, তাদের ঘরের সব দেয়ালই ফুটো, সব দরজাই অর্গলহীন, জানালাগুলো খোলা, হাহা। উদোম রাস্তাও বাইরে থেকে হাঁ করে দেয়ালে টাঙানো ফ্রেমের এমব্রয়ডারি দেখতে থাকে।  সেই একদিনই, কিন্তু তবু সে তো তন্নতন্ন করে ঘেঁটে দেখেছিলো। সবকিছু। এখন গা শিরশির করে ভাবতে গিয়ে। যাকে আমরা দেহ বলি, শরীর বলি, রাজভোগ বলি, দ্রাক্ষাকুঞ্জ বলি, ঘোড়ার ছাই বলি, আসলে তা নিছক প্রয়োজনের জিনিশ, খোকা ভেবে দেখেছে প্রয়োজন ব্যতিরেকে এক কানাকড়িও তার মূল্য নেই, তার কাছে নেই। ভাতের মাড় গালা মালসা, ঘরমোছা ন্যাতাকানির তাল, কিংবা জঞ্জাল ফেলার আঁস্তাকুড়, শরীর কি এর অতিরিক্ত কিছু; ডোম-চাড়াল কাওরা-মুচি থেকে শুরু করে কুষ্ঠরোগীরও প্রয়োজনের বস্তু এই শরীর!

হাওয়ায় রঞ্জুর এলোমেলো চুল উড়তে থাকে। ঘাড় মুখ সুড়সুড় করে খোকার। দুপাশের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোকে তার নীলাভাবী মনে হয়, সেগুন নীলাভাবী, অশথ নীলাভাবী, পিপুল নীলাভাবী, কৃষ্ণচূড়া নীলাভাবী, সুঠাম পতিতাশ্রেণী, দেহ বিক্রয় করবে এরা সবাই।

মনে মনে দর কষাকষি করতে থাকে খোকা।

পিপুল নীলাভাবী, তুমি কতো নাও?

তোমার উদ্যম!

কৃষ্ণচূড়া নীলাভাবী, তোমার কতো?

তোমার রত্নরাজি!

অশথ, তুমি?

তোমার সৃজনশীলতা, তোমার আনন্দ, তোমার স্বপ্ন, তোমার গৌরব, এইটুকুই। আর আমার বকশিশ, তোমার ভীষণ চোখ–

বিতৃষ্ণা কুপোকাত করে ফেলে খোকাকে। মনে হতে থাকে জীবনে আর কোনোদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না, তার মেরুদণ্ডের হাড় চুরচুর হয়ে গিয়েছে, ছিড়ে জট পাকিয়ে গিয়েছে স্নায়ুতন্ত্রী; মাথার ভিতরে বেআইনি কারখানা ফেঁদেছে শয়তান, বকযন্ত্রে কেলাসিত হচ্ছে পুঁজরক্তের এক ভীষণ আরক, রাসায়নিক গন্ধে তার নাড়ি ঠেলে আসে।

তবে কি নীলাভাবীর সন্তানের প্রয়োজন তার আছে? কেন তাকে এভাবে টানছে? সন্তানের পিপাসায় এমন টালমাটাল বল্গাহীন হতে পারে মেয়েরা? বরং একটা যুক্তি হিসেবে ধরে নিলে অনেক অসঙ্গতির জট খুলে যায় এতে। নীলাভাবী যদি তাকে সন্তান উৎপাদনের নির্ভরযোগ্য যন্ত্র বলে ধরে নিয়ে থাকে, তাহলে সে ভুল করেছে। খোকার মনে পড়ে একজোড়া বিবশ অর্ধনিমিলিত চোখের ছবি, যার ভাষা কোনো অক্ষরে সে পড়ে নি এ যাবৎ, একটি হাতের বেষ্টন কিভাবে ঠোঁটের নরোম উষ্ণতায় টেনে নিয়েছিলো, ছোবল মেরেছিলো, বিষ ঢেলেছিলো, এইসব; প্রতিটি নিশ্বাস ছিলো তন্ত্রসিদ্ধ, আগ্নেয়। গড়ান খেয়ে খেয়ে সে ভৈরবীচক্রের মাঝখানে গিয়ে পড়েছিলো, কামকুণ্ডের তপ্ত কটাহে নাড়িভুঁড়ি বিছা আর শিয়ালের রক্তের সঙ্গে সমানে টগবগ করে ফুটেছিলো।

নিজেকে উপপতির সিংহাসনে উপবিষ্ট দেখে ঘৃণায় কুঞ্চিত খোকা। ঠিক উপপতিও নয়। সে মনে করে এই বিশেষ্যে কাছাকোচা আছে, জুড়িগাড়ি আর বাগানবাড়ি আছে, আতরের গন্ধ খুনখারাবি আর হীরার নেকলেস আছে। বরং একটা টাইমের বাবু, মাকড়া।

কি অতো ভাবছিস? জিগ্যেস করে রঞ্জু।

কি করবো ভাই ভাবছি।

বাপি না ফেরা পর্যন্ত কোথাও নড়তে পারবো না আমরা, খামোকাই তুই ভাবছিস।

ঠিকই বলেছিস। একটু থেমে খোকা জিগ্যেস করলে, কেমন লাগলো তোর এদের সবাইকে?

ভালোই তো–

তার মানে তোর পছন্দ হয় নি! পছন্দ-অপছন্দের কি আছে, আমি তো আর তোর জন্যে কনে। দেখতে যাই নি। ওরা তো ভালোই, মিশুক–

তবু ভালো, তোকে নিয়ে আমি কিন্তু বেশ চিন্তায় ছিলাম। আমি নিজেও ভেবে পাই না ওদের সঙ্গে আমার এতো খাতির কিভাবে হলো, এমন সাদামাটা একটা ফ্যামিলি!

রঞ্জু খোকার মুখের দিকে তাকিয়ে খুব নরোম করে বললে, তোর উপর যথেষ্ট দুর্বলতা আছে নীলাভাবীর, ভীষণ স্নেহ করেন তোকে। বাপরে বাপ, প্রশংসা শুনতে শুনতে কানমাথা ঝালাপালা হয়ে গিয়েছিলো আমার।

খোকা তাচ্ছিল্যভরে বললে, আরে বাদ দে, আমি এসব গায়েই মাখি। আসলেই নীলাভাবীটা একটা জ্বালাতন, ঝঞাট। নীলাভাবীর সব ভালো, শুধু স্বভাবটা একটু গায়েপড়া। ছেলেপিলে হয় নি বুঝলি না, এখনো কিছু কিছু ছেলেমানুষি আছে, বুড়িখুকি আর কি!

কি যা-তা বলছিস, তোর মাথায় সত্যিই ছিট হয়েছে–শাসনের সুরে রঞ্জু বললে, সবকিছু খারাপভাবে দেখছিস কেন এ রকম? মেয়েদের সম্পর্কে ফটাফট মুখে যা আসে তা বলবি না, কি এমন জানিস তুই! কতো স্নেহ করেন তোকে, অথচ যা মুখে আসছে তাই বলছিস, অবহেলার ভাব দেখাচ্ছিস, তুই একটা খেটেচাষা! এই জন্যে মাঝে মাঝে তোর উপর আমার রাগ হয়!

খোকা অসহায়ের মতো ভেঙে পড়ে কাতরভাবে বললে, রঞ্জু তুই আজকাল আমাকে বড় বকাঝকা করিস, সামান্য একটা খুঁত পেলেই হলো। আমি তোর দুচোখের বিষ, দেখতে পারিস না তুই আমাকে–

রঞ্জু হেসে ফেললো। পোড়া পেট্রলের ঝাঁঝালো গন্ধ আসছিলো বলে নাকমুখ রুমাল দিয়ে ঢেকেছিলো সে। রুমালটা দিয়ে খোকাকে একটা বাড়ি মেরে বললে, কচিকোকা, কোকাবাবু, কাঁদে না বাবু কাঁদে না—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *