০৪. খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছিলো সবকিছু

খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছিলো সবকিছু।

রেসকোর্সের মিটিং-এর পর থেকে অর্ধেক খালি হয়ে গিয়েছে ঢাকা শহর। অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ শহর থেকে দাবানলের মতো গ্রাম-গ্রামান্তরেও ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রামাঞ্চলের দিকে সরে যাচেছ ভীত-সন্ত্রস্ত শহরবাসীরা, পালাচেছ। গোটা দেশের একটি বিশাল চাকা মেঘহীন আকাশের মস্ত খিলানের গায়ে কাত হয়ে পড়ে আছে।

ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে রেক্সে ঢুঁ মারলো খোকা।

পরিচিত বন্ধুদের বিশেষ কাউকে দেখতে পেল না। এক কোণে রহমান নুরুদ্দিন আর মওলা টেবিলের উপর দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে এক বিঘত প্রমাণ একটি প্রচারপত্র ফেলে গভীর মনোযোগের সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে ঝুঁকে আছে। চেয়ার টেনে খোকাও ভিড়ে গেল।

কাগজটা একটা গোপন নির্দেশনামা। শত্রুর, অর্থাৎ সামরিক বাহিনীর রক্তলোভী কুত্তাদের সম্ভাব্য আক্রমণ শুরু হলে কিভাবে তা মোকাবিলা করতে হবে, গেরিলা যুদ্ধের কৌশল, প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা, আক্রমণ ও আত্মরক্ষা, সংক্ষেপে বোঝানো হয়েছে এইসব। নারী ও পুরুষ–সঙ্কটকালে কার কি কর্তব্য হবে পৃথক পৃথকভাবে তার বর্ণনা এবং ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

একটা মাছের বাজার; টেবিল চাপড়ানি, কাচ স্টেনলেস স্টিল আর চীনেমাটির একটানা টুংটাং-ঠুংঠাং এবং হোহো, সব মিলে একটা জ্যাজ, গমগম করছে হলরম। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার সম্ভাবনা আছে কি নেই, অসহযোগ আন্দোলনের শেষ কোথায়, পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন, এইসব নিয়ে ফাটাফাটি তুল-কালাম চলছে সমানে।

আক্রান্ত হবার ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল–ইস্তাহার থেকে চোখ তুলে খোকা বললে, কিন্তু প্রত্যাঘাতের ব্যাপারটা কিভাবে হবে শুনি! খালি হাতে, না পায়খানা ঘরের ঝাড় দিয়ে?

সেকথা পরে হবে–নুরুদ্দিন ওর দিকে কাত হয়ে বললে, ওই পায়খানা ঘরের ঝাড়টা তুই পেলি কোথায়? ওটা তো শালা মুরাদের পৈতৃক সম্পত্তি, কদিন থেকে সমানে ওটা দিয়ে রেক্স ঝাড় দিয়ে যাচ্ছে!

মুরাদ আসে নি আজ?

হয়তো এসেছিলো, আমাদের সঙ্গে দেখা হয় নি। নাও আসতে পারে; খুব একচোট হয়ে গেছে কাল, হাতাহাতি পর্যন্ত!

কার সঙ্গে?

কার সঙ্গেই-বা নয়! নুরুদ্দিন হাসতে হাসতে বললে, আমার সঙ্গে মুরাদের, মওলার সঙ্গে রহমানের, শেষে কতোগুলো অচেনা হঠাৎ দেশপ্রেমিকের সঙ্গে এক মুরাদ ছাড়া আর সকলের। যাকে বলে ফাটাফাটি।

সাংঘাতিক ব্যাপার!

রহমান বললে, এটা তো এখন নৈমিত্তিক ব্যাপারে এসে দাঁড়িয়েছে। তুই তো আর এ পথ মাড়াস না, জানবি কি করে। আড়ালে আড়ালে করছিস কি, গোপনে ট্রেনিং নাকি?

কিছুই না—

বিশ্বাস হয় না–মাথা নেড়ে রহমান বললে, এটা এমনই একটা সময় যাচ্ছে যা আমাদের জীবনে আর কখনো আসে নি, হয়তো আর আসবেও না। কিছু না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা কারো পক্ষেই সম্ভব নয় এখন। নির্ঘাৎ তলে তলে বোমা বানাচ্ছিস তুই!

নুরুদ্দিন বাধা দিয়ে বললে, তুই যেমন, বোমা না ঘণ্টা! দেখছিস না কেমন গরুচোর গরুচোর চেহারা হয়েছে কুটুকুমারের। দেদার মাগী চটকে বেড়াচ্ছে ফ্রি স্টাইলে; ঠাউরে দ্যাখ, কেমন ফ্যাকাশে মেরে গেছে! লোপাট-বিজ্ঞানের আইনস্টাইন শালা, নে নে আরেক রাউন্ড চায়ের কথা বলে দে!

চায়ের ফরমাশ দিয়ে রহমান নুরুদ্দিনের দিকে একটা সিগ্রেট তাক করে আলতোভাবে ছুড়ে দিলো। বললে, তুই তো আর বিপ্লবীদের দেখিস নি, তুই চিনবি কেমন করে। ভিতরে ভিতরে নিশ্চয়ই ও একটা কিছু নিয়ে মশগুল হয়ে আছে। আর উপরে উপরে দেখে এসব আন্দাজ করাও খুব সহজ ব্যাপার নয়। এই তো তিন-চারদিন আগে, আমার ছোট ভাইয়ের এক বন্ধু–স্কুল ফাইনাল দেবে ছোঁড়া, বললে লাগবে নাকি আপনার–

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নুরুদ্দিন আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বললে, ওই অতটুকু ফচকে ছোঁড়া ওই কথা বলতে পারলে, সর্বনাশ!

আবে শালা, মাগী না মাগী না! চিরকালই তো ফকিরনি হাঁটকে-চটকে বেড়ালি, ওটা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিস না কেন? পিস্তল, পিস্তল, হাতে তৈরি পিস্তল! পকেট থেকে বের করে আমার হাতে দিলো, বললে, লাগলে রেখে দিন, এখন আমরা দিনে দুটো করে বানাচ্ছি, কয়েকদিনের মধ্যেই প্রতিদিন বিশটার প্রডাকশন হবে। বললাম কাজ হয়, বিচিত্র হেসে আমার হাতে একটা গুলি দিয়ে বললে, আপাতত একটা চারপেয়ে কুত্তা দিয়েই পরখ করে দেখুন!

মওলা ফোড়ন কেটে বললে, দেশের তাবৎ বিপ্লবীরা রহমানের ছোট ভাইয়ের বন্ধু; ভাগ্যবান বটে আমাদের রহমান। সোর্সটা ওর ভালোই, ভাইয়ের মতো ভাই পেয়েছে একখান্!

চায়ের কাপে চিনি নাড়তে নাড়তে বরফের মতো ঠাণ্ডা গলায় রহমান। বললে, আর যাই হোক ভাইটি আমার কারো দালালি করে না; রিলিফের কাজ পাড়ার সংগঠন এইসব নিয়ে মেতে থাকে।

মওলা চটে উঠলো। বললে, দালালিটা দেখলি কোথায়?

টিভির প্রোগ্রাম প্রডিউসার আবার কি, দালাল নয়? যেমন তৈরি হয়েই ছিলো উত্তর দেয়ার জন্যে, এইভাবে বললে রহমান, মৌলিক গণতন্ত্রী চোঙামার্কা ম্যাড়ামার্কা টিপিকে এইচপিকে নিয়ে ভ্যারেন্ডা ভাজতে ভাজতে যখন শালারা বুঝলে হাওয়া খারাপ, অমনি যেদিকে পড়ে পানি সেদিকে ধরো ছাতি ফর্মুলায় গনগনে আঁচে দেশপ্রেমের খিচুড়ি চাপিয়ে জ্বাল দিতে শুরু করেছিস। গামলায় কখন তেল রাখতে হবে আর কখন এ্যাসিড, তা তোরা অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই বুঝিস। তোরা অপচুনিস্ট, তোরা ক্যারিয়ারিস্ট, তোরাই সোস্যাল ক্লাইম্বার। তোরা হোয়াট নট। দাড়ি কামানোর রেজর থেকে শুরু করে ফুলদানি হরলিক্স-এর বোতল গেঞ্জি গামছা ন্যাকড়া-চোকড়া মায় জুতো পর্যন্ত রাখা যায় তোদের শেলফে।

মওলা ক্ষুন্ন হয়ে বললে, এমনভাবে চোখ রাঙিয়ে কথা বলছিস যেন নেতৃত্ব দিতে চাস।

চোখ রাঙানোর কি আছে এতে? বাজে ব্যাপার নিয়ে ঠাট্টা করিস তুই, সেধে ধোলাই খাস!

তোর কথা যদি সত্যি হয়, সারা দেশের লোকই দালাল!

তোর তো ওকথা মনে হবেই, নইলে আত্মরক্ষা হবে কি করে! পারবি আমাকে তুই দালাল বলতে? বল দেখি।

গায়ের জোরে আমি কাউকে দোষারোপ করি না–একটু থেমে মওলা বললে, তোরা এই হঠাৎ দেশপ্রেমিকের দল আজকাল যে লাইনে কথা বলছিস তাতে কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যাবে যে মালী ফুল ফুটিয়েছে সেও দালাল; এমন কি মুরগি যদি ডিম পেড়ে থাকে, তা দিয়ে। থাকে, বাচ্চা ফুটিয়ে থাকে, তাহলে সেও দালালি করেছে–

নুরুদ্দিন এতোক্ষণ চুপচাপ শুনছিলো আর সিগ্রেট ফুঁকছিলো। সে। রহমানের পক্ষ নিয়ে বললে, কে দালালি করলে আর কে করলে না এসবে কিছু যায় আসে না। মালী কিংবা ধোপাও দালালি করতে পারে। মুরগিও যদি দালালি করে করুক, আপত্তি নেই, কেবল দেখতে হবে কার পাছায় কার ছাপ আছে। তোমাদের ওই টিভির চাকরিটাই হলো কবে, যার কাজই অহরহ কেবল ছাপ দেওয়া—

কি ভাই, আপনারা ঝগড়া করছেন নাকি? সবুজ টুপিপরা দুজন স্বেচ্ছাসেবক তড়িঘড়ি করে কাবাব উড়িয়ে হাতের চেটোয় মুখ মুছতে মুছতে এক কোণ থেকে উঠে এলো। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে সবিনয়ে বললে, আপনারা শিক্ষিত লোক এ সময়ে ঝগড়া করা শোভা পায় না আপনাদের। শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব আমাদের সকলের; বঙ্গবন্ধু বলেছেন আমাদের যেন বদনাম না হয়, ষড়যন্ত্র চলছে!

রহমান সামাল দিয়ে বললে, আপনাদের চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, এখানে আমরা সবাই বন্ধু-বান্ধব; নিজেরা নিজেরাই আর কি, নিছক গল্প-গুজব!

ঠিক আছে ঠিক আছে, গল্প করুন আপনারা! কাউন্টারে পয়সা চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল উভয়ে।

লেব্বারা! নুরুদ্দিন দরোজার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললে, কি বুঝলি কি?

রহমান বললে, এবার শালার বড় রকমের একটা কিছু ঘটবেই। সারা দেশটা যেন অধীর আগ্রহে গাল বাড়িয়ে রেখেছে–

কেন থাপ্পড় খাওয়ার জন্যে? খোকা বললে।

ঠিক তাই।

তাহলে আর লাভটা কি হলো?

লাভ আছে, লাভ আছে–উল্লসিত হয়ে রহমান বললে, থাপ্পড়টা হবে কি ব্যাপার জানিস? বারুদের কারখানায় ফস্ করে একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে দেয়ার মতো। তারপরই যাকে বলে ঘাত প্রতিঘাতের ব্যাপার। সংগ্রাম। এতোদিন তো শুধু স্লোগান আর চিৎকারের খোসার মধ্যে বাদামের মতো দেখেছিস সংগ্রামকে, এবার দেখবি তার সত্যিকার সর্বগ্রাসী রাক্ষসমূর্তি। রক্তের বদলে রক্ত, সেই রক্ত হবে স্বাধীনতা!

মওলা ভাসা ভাসা চোখে সকলের দিকে তাকিয়ে বললে, সবকিছু বন্যার তোড়ে হাতিয়া সন্দ্বীপের মতো ভেসে যাবে, আমাদের অনেকেই হয়তো থাকবে না–

ভালোই হবে–নুরুদ্দিন রগড় করে বললে, খামোকা দালালি ফালালির ধুয়ো তুলে তোকে জ্বালাতন করার লোকও অনেক কমে যাবে। তখন ধুমসে তোদের ওই টিভিতে স্তাড়ামোশে স্তাড়ামোশে করে দিলান্দে সওদে করবি!

আমি নিজেও তো চেঁসে যেতে পারি? প্রোগ্রাম প্রডিউসার মরে না, তোরা মরে গেলে টিভি চালাবে কারা? দালালির ট্রাডিশনটা কন্টিন করতে হবে না? মাঝে মাঝে এমন গোলালু মার্কা কথা বলিস, ভ!

নতুন একটা প্যাকেটের মুখ খুলে সকলের দিকে ধরে খোকা, তারপর আয়েশ করে নিজেও একটা ধরায়।

রহমান বললে, তুই কিছু বল, নুরুদ্দিনটা কেমন ছটফট করছে দেখছিস না!

খোকা বললে, লজিং-এ থেকে মা-মেয়ে দুজনেরই জয়ঢাক মার্কা পেট বানিয়ে ফেলেছে বেচারা, তিন্তিড়ীয় চিন্তায় ওর এখন মাথার ঘায়ে কুকুরপাগল অবস্থা, কোনো মানে হয় না ওকে ঘাঁটানোর!

নুরুদ্দিন ক্ষেপে উঠে বললে, তোর শালা মুখের কোনো ট্যাকসো নেই, একটা ডাস্টবিন!

খোকা ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হলেও নিজেকে সামলে নেয় পরক্ষণেই। সে সংযত কণ্ঠেই বললে, বাজারে জোর গুজব, তাই বললাম

নুরুদ্দিন বললে, ওটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, তোমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে!

রহমান বললে, আগে তো পকেটে গুচ্ছের হেঁড়া ন্যাকড়া আর ঢিল ভরে রাখতিস, এখনো চলে ওসব?

মওলা বললে, তোর সেই নারী শিক্ষা মন্দিরের বার্ষিক স্পোর্টসের কথা মনে আছে এখনো? পাঁচিলের আড়াল থেকে ঢিল মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলি হার্ডল রেসের চারজন বেপর্দা ছুঁড়ির। একজন তো শেষ পর্যন্ত কানাই হয়ে গেল–

নুরুদ্দিন বললে, তোদের কাজই হলো স্রেফ পুরানো কাসুন্দি ঘাঁটা!

বাহাদুর ছেলে বটে–রহমান বললে, ইজেলিদের সঙ্গে লড়বার জন্যে সাতজনের একটা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেছিলি তুই, মালকোঁচা মেরে রোজ প্যারেড করতো ওরা ভার্সিটির গ্রাউন্ডে–

করতোই তো, তাতে খারাপটা কি দেখলি?

রহমান বললে, খারাপ ভালোর কথা তো হচ্ছে না, তোর জোশের কথা হচ্ছে; কেমন যেন একটু নেতিয়ে পড়েছিস আজকাল, তা না হলে আর্নল্ড টয়েনবির বয়ান তো এক সময় আমাদের জন্যে নিত্যবরাদ্দ ছিলো।

নুরুদ্দিন বললে, আমি যাই করে থাকি না কেন, কারো দালালি। করিনি কখনো। ছাত্রজীবনে সবাই একটা না একটা সংগঠনের পিছনে মাতামাতি করে থাকে, আর তুই? নিজের দিকটা একবার ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখ রহমান, উপরে খদ্দরের বর্ম, ইচ্ছে করে বক সিগ্রেট ধ্বংস করা, যতো যাই করিস না কেন তোকে চিনতেও আমার বাকি নেই। খামোকা কথা বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই, তুই চাপিস করে যা!

হ্যাঁ সেই ভালো, তুই চাপিস করে যা রহমান, ওর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তোর কম্মো নয়, ও হলো জিনিস সদরঘাটের পিনিস, সারাসেনের হিস্ট্রি গিলে গিলে ওর পেট জয়ঢাক হয়ে আছে; ধোপে টিকবি তুই ওর কাছে। ওর তুলনায় চুনোপুঁটি তুই। একটু থেমে খোকা বললে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম, জাতীয় সংহতিতে শালিমার গার্ডেনের ভূমিকা, হীররাঞ্জা আর খটক নৃত্যের সৌন্দর্য মাত্র এই চারটে স্ক্রিপ্ট লিখেছিলি তুই টিভির জন্যে। তাও শালা মওলার চাপে পড়ে; ও শালাই তোকে ফাঁসিয়েছিলো। ও কিছু নয়, নুরুদ্দিনের কীর্তির তুলনায় এগুলো সব নস্যি। ও অনেক সিনিয়র আমাদের চেয়ে; খন্দকের যুদ্ধে ও ছিলো, বদরের যুদ্ধেও ছিলো, ও তারিকের সঙ্গে জিব্রাল্টারে গেছে, জয় করেছে স্পেন, গ্রানাডায় আলহামরা ওরই তৈরি, এমন তাড়ান তাড়িয়েছিলো ও আবু রুশদকে–

একটা সিগ্রেট ধরিয়ে নুরুদ্দিনের ঠোঁটে গুঁজে দিয়ে মওলা বললে, ভ্যালিয়মের কথা মনে পড়ছে নাকি সিনিয়র?

ফালতু কথা ছাড়! নুরুদ্দিন খাউ করে উঠলো।

রহমান বললে, কি যে বলিস, ভ্যালিয়ম তো আজকাল সবসময় ওর পকেটেই থাকে: হাতড়ে বের করতে দেরি হয় বলে কলপের ঢিল রাখাও ছেড়ে দিয়েছে। প্রায়ই তো বলছে, হাত-পায়ের তলা ঘামে, মাথার ভিতরে একটা কাঠঠোকরা হরদম ঠোকর মারছে, জান ধড়ফড় করছে; চেকারের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে জানটা যে-কোনো সময় চলন্ত বগি থেকে ঘপাং করে লাফ দিতে পারে

তাহলে খামোশ হয়ে যা ভাই! মওলা বললে, হঠাৎ যদি ওর শরীর খারাপ করে!

খোকা বললে, খচে গেলি নাকি নুরুদ্দিন? আর এক রাউন্ড চা হয়ে যাক?

হোক।

তোর খারাপ লাগবে না? রহমান টিপ্পনি কাটে।

তা একটু লাগবে বৈকি! তবে সঙ্গে যদি সমুচা কিংবা ফুটকেক ধরনের কিছু থাকে, অন্তত ভালো লাগাবার চেষ্টার কোনো ত্রুটি হবে না!

চান্স লিচ্ছ ব্রাদার? রহমান বললে, অবশ্য এ হ্যাবিটটা তোর আজকের নয়!

গালে সমুচা পুরে খুব আঁক করে চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক মেরে নুরুদ্দিন বললে, এসব আমি গায়ে মাখি না, যার যা ইচ্ছে বলুক, তৃপ্তি পাচ্ছে, পাক! আসল কথা যেটা সেটা এই, কুকুর কুকুরকে দংশন। করছে!

রক্ষে করো, এক লাফে একেবারে চীনপন্থী হয়ে গেলি!

কেন চীনেমাটির কাপে চা খাচ্ছি বলে?

ওই এক ধরন তাদের, কখনো কখনো এমন কথা বলিস যা নিজেরাও বুঝিস না ভালোমতন–ঊর্ধ্ববাহু হয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে রহমান বললে, অবশ্য তোর দিক থেকে মস্ত একটা লাভ হয়েছে, পর পর কয়েকটা বছর একটানা সুরমা দেওয়ার ফলে চোখের ব্যামোটাই ছেড়ে গেছে। নাকি এখনো ট্রাবল দেয়?

খোকা বললে, ছেড়ে দে, বাজে কথা আর ভালো লাগছে না! ও শালা লেবু, বেশি কচলালে তিতকুটে মেরে যাবে! চল ওঠা যাক–

মওলা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললে, আমাকেও উঠতে হবে, কাজ ফেলে এসেছি অনেক। এইরে, আবার একঝাক স্বেচ্ছাসেবক ঢুকেছে, চল চল কাটি–

রেক্স থেকে বেরিয়ে একটা পান গালে পপারে খোকা। এমনিতে সে পান খায় না; কিন্তু রেক্স থেকে বেরুনোর সঙ্গে গালে পান গোঁজার কোথায় একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে, প্রতিবারই বেরুবার সময় গলির মুখটায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখ থেকে ফস্ করে পানের কথাটা বেরিয়ে যায়।

কোনদিকে যাওয়া যায় এখন। এই মুহূর্তে বাড়ি ফেরার কোনো ইচ্ছেই নেই তার, যদিও বের হবার সময় পৈ পৈ করে বলে দিয়েছে রঞ্জু যতো শিগগির সম্ভব ফিরতে। নির্ঘাত কাঁইখাপ্পা হবে রঞ্জু। চটুক। খোকা মনে মনে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় বেশি আস্কারা দেওয়া চলবে না, খবরদারির মাত্রা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে, ভবিষ্যতে আরো অসুবিধায় ফেলতে পারে; আর কোনো গুণ থাকুক আর নাই থাকুক, হাতের মুঠো শক্ত করার বিদ্যায় সব মেয়েই কমবেশি পারদর্শিতা অর্জন করতে পারে।

এই এক স্বভাব খোকার, ঘরে থাকলে জুবড়ে পড়ে থাকে বের হলে ঘরের কথা ভুলে যায়। দীর্ঘ বিরতির পর যখন গুহা থেকে বের হয়, কিংবা নিশুতি রাত মাথায় করে সারা শহরকে ঘুম পাড়িয়ে যখন ঘরে ফেরে, তখন মনে মনে নিজেকে সংশোধন করার জন্যে তৈরি হয় খোকা; কিন্তু ওই পর্যন্তই!

আত্মীয়স্বজন খুব কম নেই ঢাকা শহরে। আর্মানিটোলায় এক মামা আছে। সিদ্ধেশ্বরীতে চাচা থাকে, একেবারে আপন না হলেও ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি! খালা-খালু, ভাই-বোনের আছে মতিঝিল কলোনিতে। ওদের সঙ্গে মিশে বেশ আনন্দও পায় সে।

তবু এই নিরালম্ব মুহূর্তে ওসব পথে পা বাড়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার। আসল কথা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে তার খুব একটা জমে

কখনোই। সাধারণত ধারেকাছে ঘেসে না, এড়িয়ে চলে; নিজেরাই উপযাচক হয়ে প্রায় সকলেই কালেভদ্রে খোঁজখবর নিয়ে যায়। অভিযোগের পাহাড় জমা হয়। এই নিয়ে রঞ্জুর সঙ্গে তার মাঝে মাঝে তীব্র কথা কাটাকাটি হয়। নিজের অনুপস্থিতিতে খোকা যখন আত্মীয়স্বজনের কাছে তিরস্কৃত হয় তখন ভীষণ খারাপ লাগে রঞ্জু র; খোকা নারাজ এসব কানে তুলতে, তার ধারণা এইসব মাখামাখি এক ধরনের স্থূল গ্রাম্যতা, সুখ বলতে সে বোঝে নিরুপদ্রব থাকা।

মতিঝিলে সেজখালার ওখানে আগে প্রায়ই ঘোটা কাটতে খোকা; সেজখালার কাছে তারা বড় আদরের পাত্র। সেজখালার ওখানে। গেলেই মার কথা শুনতে হয় খোকাকে; অনেক সময় তার ভালো লাগে না, একঘেয়ে মনে হয়, তবু শুনতে হয়। কি ভালোবাসতো, কবে কি কথা নিয়ে রাগারাগি হয়েছিলো, কিভাবে দুহাতে সব বিলিয়ে দেয়ার অভ্যেস ছিলো, রাজ্যির সব বৃত্তান্ত। বিয়ের পরও মা রেডিয়োতে গান গাইত, খ্যাতি অর্জন করেছিলো প্রচুর; তখনকার দিনে কোনো রেকর্ড কোম্পানি ছিলো না বলে আপসোসের আর শেষ নেই সেজখালার।

এখন আর সহজে ও পথ মাড়ায় না খোকা। বেলী বড় হবার পর থেকে সেজখালার বাড়ি মাড়ানো এক রকম ছেড়ে দিয়েছে খোকা। মার স্মৃতি, যা অতিদ্রুত তার কাছে ঝাপসা এবং ধূসর হয়ে গিয়েছে, বারবার একই সুরে তা নাড়াচাড়া করতে তার ভালো লাগে না। যা নেই কিংবা যা কখনো হবে না, তা নিয়ে অযথা মাথা কোটাকুটি করাটাও তার কাছে এক ধরনের গ্রাম্যতা, এইসব ফাঁপা হা-হুতাশে সে পচা বাশপাতার গন্ধ পায়। সেজখালা একটা রোগের মতো এইসব হা-হুতাশ নিজের ভিতর পুষে রেখেছে।

বাইরে থেকে দেখলে একটি অতি সাধারণ মেয়ে বেলী, যার বয়েস পনেরো থেকে যোলো। লেখাপড়ায় মাঝামাঝি, ফি-বার ক্লাসে ওঠে, স্কুলের ফাংশনে মণিপুরী নাচ নাচে, ফেব্রুয়ারির বিশ তারিখে ছোট ভাইবোনদের ফুল চুরিতে উৎসাহিত করে, একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা বাসন্তী রঙের লালপেড়ে শাড়ি পরে শহীদ মিনারে যায়, চলনে-বলনে সুন্দর, সুশ্রী; কিন্তু পরিবারের ভিতর থেকে খোকা দেখতে পেল এমন অনেক কিছুই করে বেলী যা বাইরে থেকে ধরা পড়ে না। দেদার চিঠি লেখে সে সিনেমা ম্যাগাজিনের প্রশ্নোত্তর বিভাগে, নীহারগুপ্তের বই পড়ে আর দাগ মারে, নিজে পয়সা চুরি করে ছোটদের কাঁধে দোষ চাপিয়ে মার খাওয়ায়, এবং সেই পয়সায় মার্কেটে শপিং করে, লিপস্টিক কেনে। এই বয়েসেই লিপস্টিকের তুখোড় সমঝদার বনে গেছে বেলী। পড়ার টেবিলের ড্রয়ারটা তার গুদামঘর। গুদাম বোঝাই হানি-ইন গোল্ড, টিজিং পিঙ্ক, কফি ক্যারামেল গুচ্ছের শেডের লিপস্টিক। ফরাসি সেন্ট আর মেকাপের সামগ্রীও তার সংগ্রহে কম নেই। তলে তলে একাধিক ছেলের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেমও করে, অর্থাৎ ইচ্ছেমতো বাঁদর নাচ নাচায়।

যারা তার সঙ্গে প্রেম করে তাদের কেউ চিকন মোড়ের পায়জামা আর ঢিলে পাঞ্জাবি পরে। শ্ৰীযুক্ত চারদত্ত আধারকারের জীবন। থেকে ঝেড়ে কোটেশান দিয়ে প্রেমপত্র লেখে। পিছনে হাত বেঁধে আড়চোখে ঠারেঠোরে চায় আর হরদম বাড়ির সামনে পায়চারি করে, এরই নাম নাকি ফিলডিং মারা। একটা ভোগেল, খোকা মনে মনে উচ্চারণ করে।

একজন আছে যে প্রায়ই রেসিং সাইকেলে চেপে বাড়ির সামনে রুটিন করে টহল মারে। সাইকেলের উপর উধ্বকমার মতো কুঁজো হয়ে দুমড়ে পড়ে আপনমনে ফিক ফিক করে হাসতে থাকে ছেলেটি। বাড়ির সামনে এলেই কায়দা মেরে দুহাত ছেড়ে দেয় সে, তারপর উপরমুখো হয়ে। বাইবাই করে চালানো শুরু করে। এই সময় তার ঠোঁটে মাষকলাইয়ের ডালের এঁটোর মতো যে হাসিটি লেগে থাকে, তা দেখে মনে হয় কলোনির এক হাজার ডবকা মেয়ে নিজেদের ভিতর চুলোচুলি করে ওর দুগালে চুমু খেয়ে যাচ্ছে। নির্ঘাত ছিট আছে ছোকরার মাথায়, খোকার মনে হলো।

সবচেয়ে মারাত্মক টাইপ যেটার সাধারণত সে আসে রাত্রে, একটা লাল রঙের ফিয়াট কুপে চালায় ছোকরা। একটা ঝড়। ঝড়ের মতো গাড়ি চালায়। দিনের বেলায় খোকাহোক খো–কাহোক ধরনের হর্ন বাজিয়ে দুচারটে পাক মেরে যায়। তার মানে তুমি চাগিয়ে ওঠো, সেই রাত্রিবেলায় আমি আসবো। লাইটপোস্টের নিচে গাড়ি পার্ক করে দাঁড়াবো। তারপর টাইম ম্যাগাজিনের বিজ্ঞাপনের মতো গাড়িতে হেলান দিয়ে কায়দা মেরে দাঁড়িয়ে কিং সাইজের ফিলটার টিপড় সিগ্রেট ধরাবো। ব্যাটাছেলে নিজেই একটা ফিলটার সিগ্রেট। পালক ছড়ানো সেদ্ধ হাঁসের মতো ফকফকে। ঝুলপি দুটি বিরাট। মনে হয় স্রেফ তার ঝুলপি নামাবার জন্যেই সৃষ্টিকর্তা ওর হুঁকোর খোলের মতো চোখমার্কা মুখটা দিয়েছেন; ওই ঝুলপি না থাকলে ও নিজেই কোর খোলটা ড্রেনে ফেলে দিত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে ছোকরা। ভাবখানা এই : আমি একটা চোঙা, কোন্ শালা আমায় ফোঁকে, আসুক দেখি। যথেষ্ট আছে ওর বাবার, বোঝা যায়; শালা শুয়োরের বাচ্চা, মনে মনে গাল দেয় খোকা।

তবু, এদের হয়তো কোনো দোষই নেই, এক একবার মনে হয় খোকার। ওদের নাচাচ্ছে বেলী। অদৃষ্টের মতো ওদের খেলিয়ে মজা লুটছে; ওরা নাচছে, পাগলের মতো নাচছে।

একদিন তো সামান্য একটুর জন্যে নেহাত ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছে বেচারা ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি-পায়জামা! লম্বা ঝুলপির কুপে অতিশয় লাল চোখ হয়ে বুনো শুয়োরের মতো গাঁক গাঁক করে দাবড়ানি দিয়েছিলো তাকে; কাদাপানিতে ঝাঁপিয়ে না পড়লে আলুভর্তা হয়ে যেত বেচারা সেদিন। গাড়ির ভিতর থেকে চিৎকার করে উঠেছিলো ছোকরা, মিডল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দেবো, শালা!

সত্যি, বেলীটা একটা ভ্যাম্পায়ার!

এই বেলীর জন্যেই মতিঝিল কলোনিতে যাওয়া বন্ধ করতে হয়েছে। তাকে। বেলী চায় সে নাচুক; ওই তিনজনের মতো তাকেও নাচাতে চায় বেলী। খোকার ক্ষেত্রে বেলীর নিজের সুবিধে অনেক বেশি, এসব ব্যাপারে ওর হিসেব সাধারণত নির্ভুল হয়। কখন কিভাবে কার দিকে ঝুঁকলে ফায়দা ওঠানো যাবে ও তা সহজেই অনুমান করে নেয়। পাকাপোক্ত একজন মেয়েমানুষের মতোই বেলী। সে ভালো করেই জেনে নিয়েছে তার হাতে আছে মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার অতি প্রাচীন ডাকিনী বিদ্যা। এ ব্যাপারে অতটুকু মেয়ের যে নির্বিকারচিত্ততা, খোকাকে তা বিস্মিত করে।

তুই একটা হাড়কিপ্টে, নিয়ে চল না একদিন সিনেমায়—

একটা ভ্যানিটি ব্যাগ প্রেজেন্ট করবি?

তোর সঙ্গে একদিন সাংগ্রিলায় যাব, একজোড়া আইভরির দুল চাই আমার।

তুই কি ধরনের মেয়ে পছন্দ করিস, নার্স, টেলিফোন অপারেটর না হোলিক্রসে পড়া মেয়ে?

কেমন লাগে রে বিয়ার খেতে?

তুই ঘড়ি পরিস না কেন, আমার টাকা থাকলে একটা রোলেক্স কিনে দিতাম তোকে–

আচ্ছা বয়ফ্রেন্ডকে চুমু খেলে দোষ হয়?

এক একদিন এক একভাবে এগোয় বেলী। কখনো এগোয় পা টিপে। টিপে খুব সতর্কভাবে। অনুমানের বাইরে দুধাপ বেশি এগিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংশোধন করে নেয়; অতর্কিতে নিজেকে গুটিয়ে নেবার ক্ষমতাও তার বিপুল, তখন মনে হয় ওর মতো সংযমী দ্বিতীয়টি আর নেই। নানান কথার রাশ মেলে ধরার আড়ালে সে আত্মশাসন করে, খোকা বোঝে।

আবার উল্টোটিও ঘটে দুএকদিন। তখন তার বাইরের ধীরস্থির নিরুপদ্রব স্বভাবের আবরণ একটা দমকা হাওয়ায় খসে পড়ে।

একদিন দুপুরে অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল বেলী। কোনো একটা চক্রান্ত ছিলো বেলীর, খোকা তার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝে নি; চক্রান্ত না থাকলে অকারণে কেউ অমন একরোখা হে হামলে পড়ে না।

ড্যাবড্যাব করে আমার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবি না, ভালো হবে না!

অমন বিদকুটে সং সেজেছিস কেন?

আমার ইচ্ছে, তুই বলার কে?

ঠিক আছে বাবা, ঘাট মানছি–ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়েছিলো খোকা। হাতে একটা বই নিয়ে সেজখালার খাটে সে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো। ঘরে বড়দের কেউ না থাকায় বেলীর তখন অবাধ স্বাধীনতা। সে পাখা মেলে দিয়েছিলো।

কথা বলছিস না যে বড়? আবার ঘাড় ঘোরানো হয়েছে! যদি কথা না বলিস মা ফিরে এলে তোর নামে নালিশ করবো।

কি নালিশ করবি শুনি?

বলবো জোর করে জাপ্টে ধরে তুই আমার গালে চুমু খেয়েছিস, ব্লাউস ছিড়ে দিয়েছিস; তুই মনে মনে যা যা কুচিন্তা করছিস, তার সবই বলবো। ভালোমানুষি ছুটিয়ে দেবো–

তোর যা ইচ্ছে করিস, এখন ভাগ, এখান থেকে ভাগ!

এহ, কি আমার ভাগানেওয়ালা রে!

বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে বেলী। সেজখালা ফিরে এলে আমি নিজেই নালিশ করবো তোর নামে, মার খাওয়াব তোকে!

কি বলে নালিশ দিবি?

সে তখন দেখা যাবে—

বলবি জোর করে জাপ্টে ধরে বেলী আমার গালে চুমু খেয়েছে, ঠিক আছে, তোর যা ইচ্ছে নালিশ করিস। মা তো আর বাঘ-ভালুক নয় যে কঁাচম্যাচ করে একেবারে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে! না হয় দুঘা দেবে, ও আমার অনেক আগেই রপ্ত হয়ে আছে।

তোদের এখানে আর আসছি না, দেখে নিস! তুই একটা আঁচড়ে পাকা ফাজিল ছুঁড়ি, পৌঁনে তেরোটা বেজে গেছে তোর।

বেলী ঠোঁট উল্টিয়ে তাচ্ছিল্যভরে বলেছিলো, বয়েই গেল, উনি আসায় বেজায় লাভ হচ্ছে কি না আমার। একটা সিনেমা দেখালেও তবু বলতাম হা দেখিয়েছিস একদিন, কি কঞ্জুস! চোখ খুলে কথা বল না, আমি কি ধুলোবালি না গাছের আঠা?

ধুলোবালি তো বটেই, ধুলোবালিতে ভর করা জীবাণু–

আর তুই একটা কেঁচো!

ঝটিতি হাতের বই ছুড়ে মেরেছিলো খোকা, কিন্তু গায়ে লাগেনি, খিলখিল করে হেসে একপাশে সরে গিয়েছিলো বেলী।

আমার নিজের বোন হলে জুতিয়ে সিধা করে দিতাম তোকে!

তোর নিজের বোনও তাহলে এইসব কথা বলে? হেসে গড়িয়ে পড়েছিলো বেলী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে।

মোটকথা ও বাড়িতে এই ছিলো তার শেষ দিন। আর ওমুখো হয় নি। খোকা এরপর। সেজখালার কানে কোনো কথা তুলে থাকবে বেলী, সেজখালার শীতল ব্যবহারে পরে এই ধরনের একটা সন্দেহ জন্মেছে তার মনে। বেলীর পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়, হয়তো ভিতরে ভিতরে কোনো কূট অভিলাষ চরিতার্থ করার জন্যে তার সম্পর্কে মনগড়া কদর্য অভিযোগ তুলে সেজখালার মন ভেঙে দিয়েছে সে। মাঝে মাঝে সেজখালা যখন তাদের ওখানে আসে তখন তার দিকে এমন ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকায় যে খোকার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। তার বুঝতে অসুবিধে হয় না বেলীর দুঃসাহসী চালে সে ফেঁসে গিয়েছে। বেলী যে তাকে খোজে খোকা তাও জানে; তার ইচ্ছে যেভাবেই হোক খোকার সঙ্গে একটা যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে। দুএকবার হুজ করে একা একা চলে এসেছে সে বাড়িতে, কিন্তু সুবিধে করতে পারে নি; খোকা টিপে দিয়েছে রঞ্জুকে, সর্বক্ষণ ছায়ার মতো তার সঙ্গে লেগে থেকেছে রঞ্জু।

কোন্‌দিকে যাওয়া যায় এখন? স্টেডিয়ামের চারপাশে ঘোরাঘুরি করার ফাঁকে ফাঁকে মনস্থির করতে থাকে খোকা। এখন ইচ্ছে থাকলেও মতিঝিলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। বেলী কি কদর্য একটা নাম। যে সব বন্ধু কালেভদ্রে পাড়ায় যাতায়াত করে খোকা তাদের মুখে শুনেছে। ওখানে নাকি খুব কদর বেলীর। মালা গেঁথে খোপা সাজায় মেয়েরা। বাবুদের হাতে হাতে শোভা পায়। ধুন্ধুমার গান-বাজনার ফাঁকে আধমাতাল বাবুর গলায় চৌদ্দ হাত দূর থেকে নির্ভুল তাক করে বেলীর মালা পরিয়ে দেওয়াটাও একটা পুরানো বৈঠকী কেতা। বাড়িউলী মাসীদের বেজায় পছন্দ ওই বেলী নামটি। কচুর লতি খাওয়ার মতো নেহাত সখ করে যে নামটা রাখা হয় তা নয়, কমলি, বিমলি, পটলি, মায়া, শান্তি, টগর–এসবের চেয়ে ওই নামটা নাকি বেজায় পয়মন্ত। কলতলায় ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে গোড়ালিতে ঝামা ঘষতে ঘষতে অবাক বিস্ময়ে দ্যাখে ওই নামের গাছটির ডালপালা তো দূরের কথা, পাতাটি পর্যন্ত দেখা যায় না এতো পাখি উড়ে এসে বসে ওই গাছে। নুরুদ্দিন গল্প করেছিলো, একবার সে ভৈরবের বাজেপট্টিতে এমন এক মাসীকে দেখেছে, যার সবকটি মেয়ের নামই বেলী। কালা বেলী, ধাওলা বেলী, শুটকি বেলী, ধুমসী বেলী, গন্নাকাটা বেলী, খ্যাংরাগুপোরপিয়ারী বেলী, তাড়কা রাক্ষসী বেলী, দেখনহাসি বেলী, খাদা বেলী, টিপকপালে বেলী, খুঁচিখোঁপা বেলী, বড়িখোপা বেলী, এইভাবে আলাদা করে ডাকা হয়। তাদের। এলাকাটির নামই নাকি বেলীর বাগান। হাটে-বাজারে-গঞ্জে প্রায়ই নানা জাতের গুজব রটে সেখানে; বেলীর বাগানকে কেন্দ্র করেই যাবতীয় গুজবের উৎপত্তি। যেমন, বেলীর বাগানে আজ জোড়াখুন হয়েছে, বেলীর বাগানে আজ হিজড়েরা জব্বোর নাচ নেচে গেছে, বেলীর বাগানে আজ একজনের পেট থেকে দুমাথাওয়ালা সাপ বেরিয়েছে, বেলীর বাগানের মাসীর খাড়া নতুন নাঙ বদনার ভিতরে ভরে সত্তর ভরির গহনা নিয়ে ভেগেছে, এসব।

ভালোই মানিয়েছে নামটা বেলীর!

স্টেডিয়ামের চার পাশেই ভিড়, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে জটলা পাকাচ্ছে মানুষজন। রিকশার উপর দাঁড়িয়ে স্প্রিং-এর মতো হাত নেড়ে মরিয়া হয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে কয়েকজন : আপনারা ভুলে যাবেন না, ভাইসব, মনে রাখা দরকার গোটা বিশ্ব আজ আমাদের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে, আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ হঠকারিদের চক্রান্তে পড়ে আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না। তাকিয়ে দেখুন সংগ্রামী ভিয়েতনামের দিকে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে কীভাবেই না সেখানকার সংগ্রামী জনতা মোকাবিলা করে চলেছে, এবং একই সাথে প্যারিসে চলেছে শান্তি আলোচনা। আলোচনার পথ যদি রদ্ধ হয়, সংগ্রামের ক্ষেত্র তো আছেই–

হঠাৎ মুরাদের কথা মনে পড়ে যায় খোকার। সাত তারিখে একসঙ্গে রেসকোর্স গ্রাউন্ডে যাবার কথা ছিলো, শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। একটা খালি রিকশা দেখে খোকা এগিয়ে গেলেও তার আগেই লাফিয়ে উঠলো অপর একজন উষ্কখুস্ক যুবক। উঠেই চিৎকার করে বললে : বন্দুকের নল থেকেই বেরিয়ে আসে প্রকৃত ক্ষমতা, ভাইসব, ভাইসব, আপনারা যাত্রা-থিয়েটার দেখে অনেক সময় নষ্ট করেছেন, এবার হাতে অস্ত্র তুলে নিন–

হই হই করে ছুটে এলো একদল, শুরু হলো ছোটাছুটি, হুটোপুটি। খোকা দৌড়ে একটা রিকশায় উঠলো। বললে, রামপুরায় চলো—

রামপুরায় টেলিভিশন কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকে মুরাদরা। অকারণে মুরাদের জন্যে মন খারাপ হলো খোকার। ঐদিন সত্যিই তর্ক করতে নেমে যাচ্ছেতাই অপমান করে ফেলেছে সে। শুধু অপমানই নয়, যথেষ্ট আঘাতও দিয়েছে। সন্দেহ নেই সেদিন সে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। ওভাবে মুরাদের বড়বোনের প্রসঙ্গ তোলা উচিত হয় নি তার; নোংরামির একেবারে চূড়ান্ত করে ছেড়েছিলো সে। মুরাদ নিজেও খুব ভালো করে জানে, রেক্সে বসে গুলতানি মারার সময় বন্ধুরা প্রায় সবাই তার বোন লুলু চৌধুরীকে নিয়ে কদর্যভাবে ইয়ার্কি-ঠাট্টা করে, কেবল খোকা এই দলের বাইরে। লুলু চৌধুরীর পাছাটা ঠিক যেন একটা আধমুনে ধামা, একটা চোস্ত খাজুরাহো, লুলু চৌধুরীর নদগড়ে পাছা দুলিয়ে হাঁটা, চুলটুলে চাহনি আর ফিক করে হাসা দিয়ে গোটা আদমজি জুট মিলটাই কেনা যায়, সেদিন স্বপ্ন দেখলাম ন্যাংটো হয়ে ঘোড়ায় চেপে সারা ঢাকা শহর টহল দিচ্ছে লুলু চৌধুরী, সাক্ষাৎ লেডিগোদিভা, লুলু চৌধুরীর শাড়ি পরার স্টাইলটা মারাত্মক, মনে হয় আর দেড় সেকেন্ডের ভিতর গা থেকে সব আবরণ ঝরঝর করে খুলে পড়ে যাবে, হামেশাই মওলা রহমান নুরুদ্দিনদের মুখ থেকে এইসব মন্তব্য শোনা যায়।

লজ্জিত হয় খোকা। মুরাদ তাকে আলাদা চোখে দেখে বলেই বিয়ার খেতে খেতে খুব দুঃখ করে নিজের বোনের প্রসঙ্গ তুলেছিলো। মনের জোর আছে মুরাদের, খোকা নিজেই মর্যাদা রাখতে পারে নি। খুব ছোট হয়ে গিয়েছে সে।

রিকশায় বসে খোকা ভাবতে থাকে, দিন দিন আমি একটা চাড়াল হয়ে যাচ্ছি, চাষাভষোর মতো যখন মুখে যা আসে তাই বলি, ভারসাম্য রক্ষা করতে পারি না কোনো কিছুর; লুলু চৌধুরী যে পাড়ার খাতায় নাম লেখানো বেশ্যা নয়, তার বন্ধুর বড় বোন, একথা ভালো করে ভাবা উচিত ছিলো। তার সেদিনের সেই কদর্য মন্তব্য থেকে দুয়ের তফাত ধরা যায় না।

এমনও হতে পারে ভবিষ্যতে কোনো একসময় বেলীর মতো উচ্ছনে যাবে রঞ্জু। তখন! রঞ্জু সম্পর্কে বন্ধুরা তার কানে বিষ ঢাললে কেমন লাগবে তা শুনতে! এখনো যে রঞ্জুকে নিয়ে পিছনে পিছনে মনগড়া মন্তব্য করছে না, জোর করে তা বলা যায় না। ওদের যা গাছে গরু চরানো স্বভাব, তাতে মন্তব্য না করাটাই অস্বাভাবিক।

খোকার চোখের সামনে কয়েকটি রাস্তা ও লিকলিকে লতা মৃদু মৃদু দোল খায়, এবং লতাগুলো এক সময় সাপ হয়ে যায়। তার বুকের ভিতরকুঠরির ফাঁকা কামরাগুলো গমগম করে বেজে ওঠে।

সাবধান হতে হবে এখন থেকে। মুরাদের পক্ষে যা অসম্ভব তার কাছে। তা অতি সহজ। লুলু চৌধুরীকে কড়কে দেয়ার ক্ষমতা মুরাদের নেই; রঞ্জুকে অতি সহজেই শাসনে রাখতে পারে সে, বয়েসে ছোট, এখনো চোখ ফোটেনি ওর। খোকার ভিতরের কর্তব্যবোধ দুপুরের রোদের মতোই চড়চড় করে ঝলসে উঠতে থাকে। লুলু চৌধুরী অথবা বেলীর মতো, অথবা দুজনের মাঝামাঝি অন্য কারো মতো পাগলামির নেশা কোনো অসতর্ক অসংলগ্ন মুহূর্তেও যাতে ওর মগজে ভর না করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে সেদিকে; রঞ্জুকে হতে হবে রঞ্জুর নিজের মতো, অবিচল নির্মেঘ গগনপটে একফোঁটা রঞ্জুকে আলতোভাবে শুইয়ে নিপুণ সতর্কতায় একটার পর একটা ড্যাগার ছুড়তে থাকে সে, যেন চারপাশে গেঁথে যায়, যেন ড্যাগারের মৃত্যু আঁটুনি থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে আসতে

পারে। এক হাত-পা ছাড়া নির্বোধ অসহায়তাকে শাসন করতে থাকে খোকা; অবাক হয় সে নিজেই, তার স্বাভাবিক সংযম এক মুহূর্তে যেভাবে কালিমালিপ্ত হয়ে যায়, তাতে আর নিজের ওপরে সে তেমন আস্থা রাখতে পারে না। ধূম্রকেশর বিতৃষ্ণা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে খোকার। নিজের সঙ্গে এ এক ধরনের জটিল রহস্যময় বোঝাপড়া; অথবা ভৌতিক পাশাখেলা, কানাকড়িও বাজি ধরেনি, তবু অগোচরে সর্বস্বান্ত হয়ে চলেছে।

রঞ্জুর ব্যাপারে তাকে সতর্ক থাকতে হবে, ঢিলে দেওয়া চলবে না,জটিল কাটাকুটিতে ভরে যায় খোকার মন। অশ্বারোহী তাতারের মতো ধুলো উড়িয়ে তুমুল হেষারবে দিগ্বিদিক প্রকম্পিত করে মেয়েদের বয়েস আসে না। ভিতরে ভিতরে নিঃশব্দে কখন যে হানাদার বয়েস এসে কানায় কানায় ছলাৎছল চলকে ওঠে তার কোনো হদিস পাওয়া যায় না। যেমন বেলী। এমনিতে আলস্যময় ঘুমের মতো চোখের পাতায় পাতায় জড়িয়ে আছে সব, হঠাৎ একদিন এমন দুষ্কর্ম করে বসলো যে সকল ধারণার ভিত পর্যন্ত নড়ে গেল। বোঝা গেল বড় হয়ে গিয়েছে বেলী, তার বয়েস হয়েছে। বয়স না হলে সাহস দেবে কে, বাহবা পাবে কার কাছ থেকে? বয়েসের এই উন্মত্ত হাততালির ক্রমবর্ধমান পরিণতির নামই লুলু চৌধুরী; দুনিয়াসুদ্ধ উচ্ছনে গেলেও নিজের উদগ্র বয়সের কাছে নিজেকে তুঙ্গ করে তোলার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হবে না তখন, এ এক ধরনের বন্য হিংস্রতা, লোমশ মনোবৃত্তি, তিন কোটি তেত্রিশ লক্ষ স্তনভারাক্রান্ত দামাল লুলু চৌধুরী হার্ডল রেসের তীব্র প্রতিযোগিতায় বিশ্বময় ক্যাঙ্গারুর পালের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চলেছে, আর তাদের পায়ের তলায় পড়ে নাকমুখ দিয়ে সমানে গলগল করে রক্ত তুলছে রঞ্জু!

খোকা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কি অবসাদ ঝিঝি ঝিনঝিনে শরীরে! বিতৃষ্ণা,–এতো বিতৃষ্ণা কেন, আকাশ ঝামরে ঢল নামছে বিতৃষ্ণার।

রামপুরার দিকে বাঁক নিলো রিকশা।

রাস্তার মাঝখানে ট্রাফিক আইল্যান্ডের উপরে সদ্য বাঁধানো একটি কবর; কয়েকদিন আগে একজন ছাত্রকে এখানে নির্মমভাবে হত্যা করেছে কাণ্ডজ্ঞানহীন সৈন্যরা। সিলকের কাপড়ে বড় বড় লাল অক্ষরের একটি লেখা কবরের উপরে ফরফর করে উড়ছে–তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। নিদারুণ চিত্তচাঞ্চল্যে ভিতরের নিস্তরঙ্গ হদ ঘুলিয়ে উঠলো খোকার। সারা দেশ চামুণ্ডার মতো

রক্তলোলুপ জিভ বের করে রেখেছে, রক্ত দাও, রক্ত দাও, আর রক্ত দাও। কবিতার একটি বই বেরিয়েছে কয়েক মাস আগে, তারও নাম, প্রেমাংশুর রক্ত চাই, জোর করে দেওয়া নাম। রেসকোর্সের মিটিং এর যে ভাষণ, সেখানেও ওই একই কথা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো—

এদেশের বৃষ্টির পানিতে আর ফসল ফলবে না, ফসল ফলাতে হলে বৃষ্টির বদলে চাই রক্ত। পুষ্পকুঞ্জ শুকিয়ে যাবে যদি তার গোড়ায় রক্ত না ঢালা হয়। এদেশের কেউ কবিতা পড়বে না যদি তা রক্তে লেখা না হয়। আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো কিংবা লাল ঢাকা রাজপথ, লাল ঢাকা। রাজপথ এই হলো গান, কেবল এইসবই গাওয়া হবে।

লেবু, ময়না, নুরুদ্দিন, মুরাদ, লুলু চৌধুরী, বেলী সবাইকেই কি রক্ত দিতে হবে? কতোখানি রক্ত? নখ কাটতে গিয়ে যতোখানি, না একটা হাত বাদ হয়ে গেলে যতোটা ঝরে? নাকি গলাকাটা রক্ত, ফায়ার ব্রিগেডের নলের পানির মতো হলহলিয়ে বগবগ করে যা বেরিয়ে আসবে!

রিকশার উপরে খোকা দুলতে থাকে।

আমাকেও দিতে হবে?

রঞ্জু?

আমাকে রঞ্জুকে, রঞ্জুকে আমাকে?

যদি না দিই?

দেবো না! এক মুহূর্তে ব্যারিকেড হয়ে যায় খোকা; আমরা রক্ত দিতে শিখি নি! যে দেশ রক্ত দাও, রক্ত দাও বলে দুশো বছর ধরে চিৎকার করে চলেছে আমাদের কেউ নয় সে, দেশমাতৃকা তুই নস! যে দেশ কেবল জন্মান্ধ রাক্ষসপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে লক্ষ লক্ষ দরিদ্রকে তোড়ের মুখে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ভূরিভোজের উৎসবে নিমন্ত্রণ করে হাঙরকে, তাকে বিশ্বাস নেই, দেশমাতৃকা তুই নস!

প্রবলভাবে আলোড়িত হতে থাকে খোকা। দুপাশের গাছপালা লক্ষ লক্ষ সবুজ টুপিপরা স্বেচ্ছাসেবক এখন খোকার কাছে। তার মনে হলো নির্বিকার স্বেচ্ছাসেবকেরা জড় ভাঙছে। এখন। ফিসফিস করে বলছে, আপনার মানসিক শান্তি ও শৃঙ্খলার দায়িত্ব আপনার নিজের, ষড়যন্ত্র চলছে!

অসম্ভব দীর্ঘ হাঁ হাঁ খাঁ খাঁ চৈতালী দুপুর লাঠি হাতে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে গাছগুলো, পাখিরা উড়ে যাও, নীড় রচনা করতে পারবে না এখন এখানে, কালবৈশাখী আসন্ন!

তপ্ত বাতাসের হলকা গাছের পাশ কাটিয়ে কি তীব্র বয়ে যাচ্ছে! অনেক উঁচুতে উঠেছে আকাশ, ফেলে দিয়েছে সব মই; সকল নিস্তব্ধতার ভিতর রক্তশূন্য ফ্যাকাশে ভয় নিষ্পলক চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কে চায় গায়ে আঁচড়টি লাগুক?

বাংলাদেশ, তুমি শুয়ে আছো অর্ধেন্দু দস্তিদার হয়ে, থেকে থেকে কাতরাচ্ছো, বোমা বিস্ফোরণে নিদারুণ ক্ষত-বিক্ষত তোমার মুখ; তোমার মুখ পুড়ে গেছে। বাংলাদেশ, তুমি মরে গেছ প্রীতিলতার মতো বিষপান করে। বাংলাদেশ, তুমি বুলেটবিদ্ধা আনোয়ারা, কোলের শিশুকে স্তন দিতে চাও? বাংলাদেশ, তুমি রাক্ষসী, একটা শালিকের মতো শিকার করেছো মতিয়ুরকে। বাংলাদেশ তুমি কারফিউ, গভীর রাতে যার বস্ত্র হরণ করতে গিয়ে মারা পড়েছি আমরা। তুমি টর্নেডো, বাংলাদেশ তুমি সাইক্লোন, বারবার সমুদ্রে ভাসিয়ে দাও তুমি আমাদের, হাঙরের পাকস্থলীতে বসে সুর করে তেলওয়াত করি আমরা। তুমি গর্ভিণী পুলোমা, বাংলাদেশ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে রাক্ষস কাম, একটু পরেই সে তোমাকে বলাৎকারের চণ্ড লালসায় হাত মুচড়ে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাবে গভীর নিভৃত অরণ্যে। বাংলাদেশ তুমি কিছুই নও, আবার তুমি সব; তুমি বাংলামদের একটা বোতল, মাতাল হবার তুঙ্গ অভিপ্রায়ে খালি করে গড়িয়ে দিয়েছি তোমাকে, এখন পায়ে পায়ে গড়াবে তুমি। বাংলাদেশ তুমি একটা সস্তা মদের দোকান, কে শুড়ি কে-বা তার সাক্ষী তার কোনো হিসেব নেই সেখানে। বাংলাদেশ তুমি একটা ছমছমে ঘুটঘুটে বেশ্যালয়, যার সব কুঠরি এক একটি বেলীর বাগান, যেখানে কখনো কাউকে ভূতে পায়, যেখানে জং ধরা কবজার মতো কর্কশ হিজড়েরা খ্যামটা নাচে, যেখানে ষাট বছরের বেততা মাসী নাঙ ধরে, যেখানে বেড়ানো বদনায় সাতনরীর হার ঝুমকা অনন্ত কানপাশা, যেখানে তাস পাশা জুয়া কড়িখেলা, যেখানে উপদংশ আর সন্ন্যাস রোগ, যেখানে শিকড় তুকতাক ঝাড়ফুক ঢোলের মতো মাদুলি, যেখানে ক্ষুধার্ত কাকের ঠোঁটে গর্ভপাতের লাল নাড়ি, যেখানে ঝুলকালিধরা ঘুলঘুলির টিমটিমে প্রদীপের শিখা বরাবর উদ্বন্ধনে ঝোলা জোড়াপা শূন্যে দোল খায়। লাল পেটিকোটের কষি আলগা করে বজবজে ঠাণ্ডা কুয়োতলায় নীল-সবুজ শ্যাওলায় উদোম বুকে-পিঠে-বগলে ভোসা কিংবা গামছা কিংবা ছোবড়া কিংবা চিবানো শজনে কিংবা দুর্বা কিংবা চড়ুইপাখির বাসা ডলছো তুমি, বাংলাদেশ তুমি একটা লক্ষ বছরের বেতো ডাইনী মাসী, ঘেয়োকুত্তার মতো নাঙ ধরেছে এক হাজার, ঘাটের মড়ার মতো না ধরেছো এক হাজার, ধোয়াঘাটের মুলোর মতো নাঙ ধরেছো এক হাজার, আর তোমার থলথলে পেটের রবরবা চর্বিতে সুড়সুড়ি না দিয়ে, তোমার সিংহমার্কা তামার পয়সা লাল পলা আর কড়িগাঁথা ঘুনসি জড়ানো গরুগাড়ির চাকার ক্ষতে দুষ্ট কোমরের খরখরে তেঁতুলেবিছায় তেল মালিশ না করে, খালপাড়ে যাবার অছিলায় বদনা হাতে সেই সব নাঙ ফতুর করে দিয়েছে তোমাকে তিন হাজারবার!

মাইগ্রেশন টু নো-হোয়্যার, তুমি একটা ছবি বাংলাদেশ; কতোগুলো খঞ্জ–যাদের দেহ যুদ্ধের একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, ক্রাচে ভর দিয়ে উড়ে চলেছে হাওয়ায়, সম্মুখে দিগন্ত, যা অসম্ভব ধূসর মূক ও বধির, তীব্রভাবে ছুটছে। হাওয়ার উজানে ছিন্নভিন্ন মলিন পোশাকের পাল তুলে দৃপ্ত খেলোয়াড়ের মতো বারবার নেচে রুগ্ন দিগন্তের অন্ধকার পরিব্যাপ্ত বিশাল অনিশ্চয়তার কুহকে ছুটে চলেছে। এখন আর তুমি মোদিল্লিয়ানির সেই দীর্ঘায়িত সুঠাম রতিমঞ্জরি নও, আত্মতৃপ্ত নির্ভার নিদ্রার আলস্যে যা মদিরার কুঞ্জ হয়ে আছে (নিদ্রা তার নগ্নতাকে ঢেকে রেখেছে, ল্যাট্রিনে বসে একদিন মনে হয়েছিলো কথাটা) পুরু বিছানায়, যেখানে একটি টিকটিকিও এখন ঠিক ঠিক ঠিক করে উঠবে না পাছে শিরশিরিয়ে ওঠে আলস্যময় নিদ্রা; এমন কি নির্দয় নিয়তি যে শুধু একটি দোমড়ানো সেপ্টিপিন কুড়িয়ে পরম সার্থকতায় ফিরে যাবে সেও।

মোদিল্লিয়ানির এই ছবিটি তার প্রিয়। ক্ষীণ কটিতট থেকে প্রসারিত একটি উজ্জ্বল নির্লিপ্ত, রাস্তা, এই রাস্তাই নিয়ে যাবে উরঃস্থলের মধ্যভাগে, যেখানে ধর্মাধর্মের উপাসনালয়, পরম পবিত্র সুষুপ্তি। কি নিটোল, কি তুঙ্গ, অচঞ্চল; এমন কোমল যা সামান্য একটি দূর্বাকুচির আচ্ছাদনও সইতে অক্ষম। স্তন তো নয়, অম্লান দুটি স্তৃপ, কলরবহীন এই প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন; কবিতার যা আত্মা, পরিশ্রান্ত কিন্তু স্বপ্নময়, হৃদয়ে যা ভর হয়ে থাকে সর্বক্ষণ, কিন্তু সুরম্য সুগোল, যেন পবিত্র সমাধি মন্দির, খালি পায়ে যেতে হবে ওখানে, যেন পাশাপাশি অঞ্জু আর মঞ্জুর কবর।

ধূলিময় মাতাল হাওয়া গরগর করে নাক ঘষে গেল খোকার শরীরে। মনে হয় একটা প্রাচীন রথ নারীদের বর্ষব্যাপী উৎসবান্তে সিথেরা থেকে হাওয়ায় ভেসে চলেছে। ছাগচর্ম আচ্ছাদিত এক একটি স্মৃতি নৃত্যগীত গীতনৃত্যে উল্লোল রমণীর মতো ক্রমাগত কানের দুপাশে তাম্বুরা বাজাতে থাকে। শুকনো পাতার গন্ধে বাতাস ভরপুর, যেন ঝাঁঝালো মদের গন্ধ, কখনো কটু, কখনো তীব্র, কখনো চুল ধরে নাড়া দিয়ে যায়।

চলন্ত রিকশা থেকে কখন যে স্বপ্নসলিলে ঝুপ করে পড়ে গিয়েছে খোকা তা টের পেল না :

অনেক অনেকদিন আগের কথা, এক দেশে এক সেগুনবাগিচা ছিলো, সেখানে এক নীলাভাবী ছিলো। একদিন এক নির্জন দুপুরে আমি কঁচুমাচু খোকাব্যাঙ সেই নীলাভাবীর বাড়িতে রুরুরুরু গিয়েছিলাম। একা, সেই নীলাভাবী, যার শরীর পুষ্পকরথের মতো, যার ঠোঁটে বিদ্রমের আভা, একা ছিলো। যখন নীলাভাবীকে রুরুরুরু একা পেলাম, আশ্চর্য খুব আশ্চর্যভাবে এক অতিবেল তন্দ্রার রুরু কোমলতার ভিতর আমার মনে হলো, এখন এই মুহূর্তে এখানে যা যা নেই, অনুপস্থিত, আমাকে চোখে চোখে রাখে, পাহারা দেয়, দিবালোকে যেমন পাহারা দেয় অরণ্যকে। উহুরু! আমি চিৎকার করে উঠলাম। ইন্দ্রিয়ের অন্তঃপুরের সঞ্চারমান মূৰ্ছা একগুচ্ছ গোলাপ হয়ে রুরু রুরু শোভা পাচ্ছিলো বাবেলের বুরুজের মতো ফুলদানিতে; তির তির তিরি তির করে তখন তা কেঁপে উঠলো তিনকোনা চিৎকারে। উন্মাদনার অন্ধকারে দিব্য বিভা হয়ে রুরুরুরু ঝলসে উঠলো সেই ঘর। পাখির হালকা পালক ছড়ানো ঘরময়, এবং একটি বিড়াল, নরোম যার শরীর, কামদ উষ্ণতায় ভরপুর। বিড়াল দেখিয়ে দিলো রুরুরুরু নীলাভাবীকে। নীলাভাবী দেখিয়ে দিলো ররুরুরু গোলাপগুচ্ছকে, গোলাপগুচ্ছ রুরুরুরু আমাকে, রুরুরু পরস্পর পরস্পরকে। বিড়াল বললে রুরুরুরু গোলাপ একদিন শুকিয়ে যায়; আমি পিঠ দেবো। নীলাভাবী বললে রুরুর বিড়াল কখনো মিথ্যে বলে না, দ্যাখো না চোখ নেই ওর পিছনে, বিড়াল কখনো রুরুরুরু গোলাপকে ভয় পায় না থাকুক কাটা, দংশন, বিড়াল জানে চার চারটি তার থাবা : একে যোনি, দুয়ে স্তন, তিনে দংশন, চারে বন্ধন, গোলাপের কাটার চেয়েও বেশি নখ সেই চার থাবায়। শেষে সরোবর ভেঙে ডোম্বী মৃণাল খায়, ডোম্বী তোমাকে আমি মারবো বলে রুরুরুরু খোকাকাহ্নপাদ বিড়ালের পিঠে সওয়ার হলাম। আমি জানি না কে আমাকে বারুণী দিলো, আমি জানি না কে আমাকে ডমরু শোনালো, আমি মদকলকরী খোকাকাহ্নপাদ বিড়ালের পিঠে সওয়ার হলাম। আমি জানি না কে আমাকে বারুণী দিলো, আমি জানি না কে আমাকে ডমরু শোনালো, আমি মদকলকরী খোকাকাহ্নপাদ প্রবেশ করলাম নলিনীবনে–রুরুরুরু রুরুরুরুরুরুরুরু।

কীটদষ্ট ঠাকুরমার ঝুলির কতোগুলো পাতা বাতাসের ফেনার মতো ফরফর করে ঘুরপাক খায় চতুর্দিকে। দৃশ্য পরম্পরায় কতোগুলো ছবি অলীক ছায়ানৃত্যে মূর্ত হয়ে ওঠে; এইভাবে আমার জীবনের একটি অধ্যায় অভাবনীয় আকস্মিতায় সমাপ্তির রেখা টেনেছিলো, তীক্ষ্ণ ঘৃণায়। এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায় খোকা। একটা রিকশা ধরে পাগলের মতো ঘুরেছিলো সে। একবার সেকেন্ড ক্যাপিটালের দিকে, একবার নীলখেতের দিকে, এদিকে-ওদিকে চতুর্দিকে ঘুরেছিলো কেবল, কোনো হুঁশজ্ঞান ছিলো না, এবং গভীর রাত মাথায় করে ঘরে ফিরেছিলো। আমি একটা লোচ্চা, তার এইসব মনে হয়েছে, আমার কোনো বাছবিচার নেই, আমি একটা লম্পট, কামুক; আজ আমি নীলাভাবীকে বিছানায় কাত করেছি, সবে শুরু আমার, হয়তো কালই আবার হন্যে হয়ে উঠবো, আবার কাউকে চিত করবো। পরপর কয়েকটা দিন এইভাবে সে নিজের মনের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ করেছে। ভিতরের গরল ভুড় ভুড় করে গেঁজে উঠেছে। পরিত্রাণ চাই! পরিত্রাণ! পাগলের মতো বেরিয়েছে ঘর থেকে, মুরাদকে চাই, সারা শহর খুঁড়ে বের করতে হবে মুরাদকে; শেষ পর্যন্ত সালামারে নিয়ে গিয়েছিলো মুরাদ, এপ্রিলের একটি আস্ত রাত বমি করে সে ভাসিয়ে দিয়েছিলো। সেই একবারই তার মনে হয়েছিলো মদ কি কুচ্ছিত জিনিশ; অস্থিরতার দাপটে চূড়ান্তভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিলো সে।

অঞ্জু আর মঞ্জু হারিয়ে গিয়েছিলো কিভাবে?

বাথরুমের আয়নার মতো সেই পারদ ওঠা ঝাপসা ছবিটি ঝাড়পোঁছ করে খোকা; মামাবাড়ির পুকুরের শ্যাওলা ধরা শানে পা হড়কে পানিতে ছিটকে পড়লো অঞ্জু, আর দুহাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে গেল মঞ্জু, তারপর অঞ্জু মঞ্জুকে টেনে নিয়ে গেল আরো গভীরে, শেষে অঞ্জু আর মঞ্জু, মঞ্জু আর অঞ্জু, অঞ্জু, মঞ্জু ম মঞ্জু গলা জড়াজড়ি করে ডুবে মরলো।

এক সময় মুরাদের ওখানে পৌঁছালো খোকা।

মুরাদ বললে, এসে ভালোই করেছিস, আমাকে শুধু শুধু ফিরে আসতে হতো তোর বাড়ি থেকে। এই একটু পরেই বেরুচ্ছিলাম।

চা এলো এবং কিছুক্ষণ গুলতানি চললো। ঠিক ভালো লাগছিলো না খোকার, এমন কি এ কথাও একবার মনে উঁকি দিলো, আজ ঘর থেকে না বেরুলেই বোধ হয় ভালো ছিলো।

জমছে না, চল বাইরে বেরোই বরং–

একটু বোস, বড়বোন তোর সঙ্গে কথা বলবে।

খোকার ভিতরে একটা হাইপোস্টাইল হল হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে এ কথায়।

আমার সঙ্গে আবার কিসের আলাপ?

কি জানি–গা ছেড়ে দিয়ে আলগোছে বললে মুরাদ।

একটু পরেই লুলু চৌধুরী ঢুকলো ঘরে। এসে একটা বেতের চেয়ার টেনে বসলো। হেসে জিগ্যেস করলে, কেমন আছেন?

ভালোই।

আপনাদের ওদিকে কেমন, গণ্ডগোল আছে কোনো রকম?

না, তেমন আর কই।

বড় হইচই আমাদের এই দিকটায়। কতো রকমেরই যে তোড়জোড়, একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি!

কোথায় আর! আমি তো দেখছি দিব্যি আরামেই আছেন আপনারা!

তাই বুঝি মনে হচ্ছে?

খোকার মনে হলো নীলাভাবীর সঙ্গে কোথায় একটা মিল আছে লুলু চৌধুরীর।

হঠাৎ কি মনে করে মুরাদ উঠে গেল এই সময়। খোকা দেখলো তার মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

একটা কথা জিগ্যেস করবো আপনাকে, আপত্তি নেই তো?

আপত্তি কিসের! খোকার ভিতরটা এইবার সত্যি কেঁপে ওঠে।

আমি কারো নাম ধরে বলবো না। আমার চলাফেরা গতিবিধি এইসব নিয়ে মুরাদের বন্ধুদের অনেকেরই শুনি দারুণ মাথাব্যথা। আজকাল নাকি সেটার প্রকোপ একটু বেশি রকমেরই দেখা যাচ্ছে, এটা কি সত্যি?

খোকা আমতা আমতা করে বললে, এসব প্রসঙ্গ না তোলাই ভালো। মধ্যে থেকে আমি বিপদে পড়ে যাচ্ছি–

আপনি সঙ্কোচ করছেন কেন? আমি কিন্তু আপনাকে বাদ দিয়েই কথাটা পেড়েছি। আপনার কাছে একথা তোলার একটাই কারণ, ওর বন্ধুদের ভিতর একমাত্র আপনার সঙ্গেই আমার আলাপ আছে, আপনাকে ভালো করে চিনি। ছিটেফোঁটা তো দূরের কথা, অন্যদের কাউকে চিনিই না, আর যেসব কথা শুনি তাতে চেনার খুব একটা ইচ্ছেও নেই। সঙ্কোচ

করবেন না, আপনি স্বচ্ছন্দে বলুন!

খোকা অপরাধীর মতো বললে, কিছু কিছু আলাপ হয় বৈকি!

কি ধরনের আলাপ? বেশ জোর দিয়ে জিগ্যেস করে লুলু চৌধুরী।

আন্দাজ করে নিন।

এটা কিন্তু ঠিক বললেন না। অন্যেরা কে কোন্ চোখে আমাকে দ্যাখে, তাদের কার কি রুচি শিক্ষা-দীক্ষা, তাতো আর আমার জানা নেই, খুব শক্ত আমার পক্ষে তা আন্দাজ করা–

আপনি বরং মুরাদের সঙ্গে আলাপ করবেন, মোটামুটি ও সবই জানে–

ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে–একটু থেমে হাসতে হাসতে লুলু। চৌধুরী বললে, শুধু কথা হয়েছে বললে ভুল বলা হবে, ছোটোখাটো একচোট হয়ে গেছে বলতে পারেন দুজনের মধ্যে!

মুরাদ নিশ্চয়ই কিছু কিছু বলেছে আপনাকে?

বলেছে, তবে সেগুলো না বললে ও ওর চলতো। নোংরা ঘাঁটাঘাঁটি কাদা ছোড়াছুড়িকে আমি সাংঘাতিক ঘৃণা করি। ও যা যা বলেছে সেসব শুনে মন খারাপ করার কোনো মানে হয় না। দেখুন, এটা অত্যন্ত সত্যি কথা যে আমার চাল–চলন আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো নয়, বরং কিছুটা আমার নিজের মর্জিমতো বলতে পারেন। মানে এই নয়, আমি অসাধারণ একটা কিছু। এখানে আমার পেশার কথাটা সবাইকে শুধু ভেবে নয়, বিবেচনা করে দেখতে হবে। তুচ্ছ কানাকানিতে কান পেতে বসে থাকলে আমার চলবে না, এ তো আপনি বোঝেনই। নিরর্থক সময় অপব্যয় করা ছাড়া ওটা অন্য কিছু নয়। আমাকে সবসময় আমার পেশার কথা ভেবে চলতে হয়। আমি যে কোনো কিছুর পরোয়া করি না, লাজ-লজ্জার ধার ধারি না, এসব নিয়ে কানাকানি করা আর নিছক বদনামের জন্যে বদনাম করা এক কথা। এসব একপেশে কানাকানির আমি মোটেই দাম দিতে শিখি নি।

লুলু চৌধুরী থামলেও কোনো প্রত্যুত্তর করলো না খোকা। কেবল তার ভয়টা অনেক হালকা হয়ে গিয়েছে বুঝতে পেরে সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। যথেষ্ট সংযমী মহিলা এই লুলু চৌধুরী, প্রায় আচ্ছন্নভাবে প্রয়োজন কি সে তা ধরতে পারলো না, সুকৌশলে ধোলাই চলছে না তো!

অর্ধেক জবাবদিহি দুনিয়াসুদ্ধ সবাই মেনে নিয়েছে এমনি ধরনের এক ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলো আবার লুলু চৌধুরী, তারপর ধরুন অনেক সময় অসময়ে ঘরে ফিরতে হয় আমাকে। অনেক সময় অনেক মহারথীর সঙ্গে সময়ও কাটাতে হয়। চাকরির খাতিরে আমি এসবে বাধ্য। এমন নয় এটা সময়ের অপচয়, এতে আপত্তি কিসের! আমার চাকরির ধরনটাই অমন। দুনিয়ায় হাজারো রকমের মানুষ। কতো রকমের মেজাজ, অহমিকা, তেত্রিশ কোটি কমপ্লেক্স, মাথা খারাপ হয়ে যায় ভাই–

একটু থেমে মৃদু হেসে লুলু চৌধুরী বললে, কারো কান ধরে কাজ আদায় করে নিতে হয়, কারো হাত ধরে; অনেক সময় গলাও ধরতে হয়। অনেকের। যে উদ্দেশ্যে কান ধরা, সেই উদ্দেশ্যেই গলা ধরা। সব ব্যাপারটাই আগাগোড়া একটা টাস্ক, যা সম্পূর্ণই অফিশিয়াল। অবশ্য অনেকে এক্সপ্লয়টেশনও বলে থাকে; বয়েই গেল আমাদের। প্রিমিয়ামের মোটা অঙ্কের মূল্য কষে পা বাড়াতে হয় আমাদের। এই যে ব্যাঙের ছাতার মতো চারদিকে গণ্ডায় গণ্ডায় কোম্পানি গজিয়ে উঠছে, ভুশ ভুশ করে কেঁপে উঠছে চোখের পলক না পড়তেই, এসব কি আর এমনি এমনিই! চাকরি চাকরিই, যে যার নিজের প্রতিভা দিয়ে কোম্পানির ভিত মজবুত করে চলেছে; ঠুনকো অহমিকা, শস্তা চক্ষুলজ্জা, অমুকে ছুঁয়ে দিলো, জাত গেল, এসবের চেয়ে এফিশিয়েন্সি রিপোর্টের দাম আমাদের কাছে ঢের ঢের বেশি! পারলে বন্ধুদের বলবেন, নিরর্থক কষ্ট করে তারা যেন আমার জন্যে দুশ্চিন্তা না করেন, আমি চাই না আমার নিজের ভালোমন্দের ব্যাপারে অন্যেরা খামোকা মাথা ঘামাক–

খুবই বিরক্তিকর, তবু শুনতে হয় খোকাকে! সে চোখ কুঁচকে বললে, আপনি গ্রাহ্যের মধ্যে না আনলেই হয়

তাতো বটেই! তবু অনেক সময় এসব তেতো লাগে। হাজার হোক আমরা তো মানুষই!

খোকা বললে, আপনার এই শেষের কথাটি আপনার চাকরির জন্যে খুবই বেমানান, বিশেষ করে এতোক্ষণ যা যা বললেন, যেভাবে বললেন, তা যদি মানতে হয়–

এতোক্ষণ যা বলেছি সেটাই ঠিক–লুলু চৌধুরী জোরের সঙ্গেই বললে, আমি যদি সাতহাত ঘোমটা টেনে ঘরে বসে থাকি আপনাদের বন্ধুরা আমাকে মাসোহারা দেবে? তাহলে না হয় তাই করা যাবে, আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি তাহলে–

খোকা বললে, জিগ্যেস করে দেখবো এক সময়।

তাই করবেন, খুব জানতে ইচ্ছে করে আমার–হাসতে লাগলো লুলু চৌধুরী।

আসল কথা আপনি একজন মেয়েমানুষ, এটাই শেষ পর্যন্ত বুঝলাম।

আপনার কি সন্দেহ ছিলো এতে?

খোকা বললে, তর্ক করে কোনো লাভ নেই, আপনি নিজেই জানেন, এসব কথা তুলে আপনি নিজেই হেরে গিয়েছেন।

কিছু একটা ভেবে, অল্পক্ষণ পরেই লুলু চৌধুরী বললে, আপনি তো কিছু করছেন না, চেষ্টা করছেন নাকি কোনোদিকে?

কই আর।

আসুন না আমার সাথে!

কি রকম?

আমাদের কোম্পানিতে আসুন—

এখনো সে রকম কিছু ভেবে দেখি নি!

আমি বলি কি, একটা এজেন্সি নিয়ে ফেলুন, আমার ধারণা আপনি ভালো করবেন।

খোকা হেসে বললে, ভালোই বলেছেন—

আমি কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি!

তা-তো বুঝতেই পারছি, সব ব্যাপারেই আপনি সিরিয়াস!

আপনি চিন্তা করুন–নড়েচড়ে বসে লুলু চৌধুরী বললে, আমি আপনার ওখানে একদিন আসবো!

কিন্তু—

বাধা দিয়ে লুলু চৌধুরী বললে, কোনো কিন্তু নয়, আপনি মনে মনে তৈরি হয়ে থাকুন, বাকিটা আমি করে দেবো, আমার বিশ্বাস একটু উদ্যোগ নিলেই আপনাকে চালানো যাবে।

চল উঠবি নাকি? মুরাদ ঢুকলো এই সময়।

লুলু চৌধুরীও উঠে দাঁড়ালো। চোখমুখে প্রসন্নতার ছাপ। বিদায় নিয়ে টুপ করে বেরিয়ে এলো খোকা।

দুজনে হাঁটা শুরু করলো। চারপাশে মানুষজনের মেলা। অনেকের হাতেই লাঠি। মেয়েরাও হাতে লাঠি নিয়ে ঘোরাফেরা করে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে। হাবভাবে চালচলনে মনে হয় ওই জিনিশটা হাতে থাকলেও ওর গুরুত্ব সম্পর্কে ওদের তেমন কোনো ধারণা নেই। এই এখনো কয়েকটি মেয়ে লাঠি হাতে কলরব করতে করতে ওদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। বোঝা যায় সকলেই স্কুল-কলেজের মেয়ে। কিন্তু তবু, বেশ কিছুদিন যাবৎ রাস্তাঘাটে প্রায় দেখতেই পাওয়া যায় না। মেয়েদের। ধীরে ধীরে মরে যাচেছ ঢাকা শহর। নিভে আসছে। কোনো কোনো অঞ্চল একেবারে খাখা, নীরব, সন্ধ্যার পর অকারণে গা ছমছম করে।

এতোক্ষণ জর্দা কিমাম দেওয়া খুব কোম্পানির খিলি খাওয়াচ্ছিলো নিশ্চয়ই? হঠাৎ জিগ্যেস করে মুরাদ।

ঠিক বুঝলাম না সবকিছু, ধোলাইটা বোধহয় আমার ওপর দিয়েই গেল!

অসম্ভব কিছু নয়। একচোট হয়ে গিয়েছে আমার সঙ্গে। ওকে যে বোঝাতে পারবে, সে এখনো মায়ের গর্ভে!

দারুণ ভড়কে গিয়েছিলাম, যাই বলিস, প্রথমে তো বুক ঢিপ ঢিপ করছিলো–

একটা দেশলাইয়ের কাঠি দাঁতে খোঁচাতে খোঁচাতে মুরাদ বললে, ওসব ভয় নেই। সাধারণত ও খারাপ ব্যবহার করে না, বাইরের কেউ হলে তো নয়ই। এটা ও যেমন করেই হোক রক্ষা করে চলবেই। হিশেব করে কথা বলার মতো ক্ষমতাও ওর আছে, ভালোমতো মিশলে তুইও বুঝতে পারবি।

তুই নিশ্চয়ই আমার নাম তুলেছিস, এটা উচিত হয় নি তোর!

কিছুই যায় আসে না ওতে। ওর গুডবুকে না হয় নামটাই কাটা যাবে তোর, তাতে আর কি! শুনলি না কিভাবে কথা বললে? কখনো খুলে মেলে জোর গলায় অভিযোগ তুলবে না ও, বিচার চাইবে না; এমনভাবে কথা বলবে যেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজের মতামতগুলোকেই নিছক যাচাই করে নিচ্ছে। ও জানতো যে-কোনো মুহূর্তে আমি এসে তুলে নিয়ে যাবো তোকে। হাতে বেশি সময় থাকলে দেখতিস সমস্ত ব্যাপারটা তোর কাছে কেমন অফিশিয়াল করে তুলতো। একটা আস্ত ছতলা কোম্পানির পাকস্থলীতে আইঢাই করে মরতিস তখন। ছেড়ে দে। ওকে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনো লাভ নেই, ওর আর আমাদের পথ তো আর এক নয়, ওর পথে ও চলবে–

খোকা বললে, এখন আলাদা হলেও, এক পথও তো হতে পারে? ধর এজেন্সি একটা নিলাম, তখন?

বলেছে নাকি এসব?

তা-না হলে আর বলছি কেন?

সর্বনাশ! দ্যাখ কেমন ঘাড়ে চাপে এবার, সকাল-সন্ধ্যা পাগল করে তুলবে তোকে!

অনেকক্ষণ পর খোকা বললে, এইভাবেই হন্টন মারবি নাকি?

রিকশা নে, ভালো লাগছে না কিছু। চল কোথাও গিয়ে বসি দুদণ্ড!

এক একবার ঘরে ফেরার ইচ্ছে উঁকি মারছিলো খোকার মনে। রঞ্জুর কাছে জবাবদিহি করতে হবে আজ। সেজখালাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে দিয়েছিলো রজু বারবার। কিন্তু মুরাদকে ছেড়ে এই মুহূর্তে হুট করে চলে যাওয়াও তার পক্ষে অসম্ভব। গাছের ভিজে পাতার গায়ে নিরুপদ্রব জ্যোছনার আলোর মতো এক নরোম উজ্জ্বলতায় চিকচিক করছে মুরাদের চোখমুখ। মাঝে মাঝে চলকে উঠছে, নিজেকে চেপে রাখতে পারছে না, কিছু একটা প্রবলভাবে তোলপাড় করে চলেছে তার ভিতর, বুঝতে বাকি থাকে না খোকার।

খোকা বললে, কোথায় যাবি। কোনো বারে নয় কিন্তু!

সে রকম পয়সা কোথায়?

পয়সা আছে, কিন্তু ইচ্ছে নেই।

তা বটে, ইচ্ছে থাকলে পয়সা থাকে না। আউটার স্টেডিয়ামের দিকে যাওয়া যাক বরং–

ওদিকে বেজায় ভিড়ভাট্টা। মিটিং হুটোপুটি আর খেল তামাশায় কাদার মতো বজবজ করছে মাঠটা। যে শালার মুখে সবেমাত্র বুলি ফুটেছে সেও একচোট বক্তিমে না ঝেড়ে যাচ্ছে না; সাধে কি আর বলে হুজ্জতে বঙ্গাল! আমি দেখলাম, শালার বিকেলে মাঠে খেলা দেখার মতো। একদল লোকের মিটিং-এর নেশা আছে; আসন গেড়ে বসে পুটুর পুটুর, করে চিনেবাদাম ভেঙে গালে পোরে আর লেকচার শোনে, হাত তুলতে

বললে হাত তোলে, স্লোগান দিতে বললে স্লোগান দেয়, আপার চেম্বার খালি আর কি!

মুরাদ গায়ে মাখলো না। সে বললে, রমনা রেস্তরাঁয় যাবি?

খোকা রাজি হলো।

গিশগিশ করছে রমনা রেস্তরাঁ। লেকের উপর ঝুলন্ত কাঠের পাটাতনে চেয়ার টেনে বসলো দুজন। মুখচেনা অনেকের সঙ্গেই চোখাচোখি এবং হাসি বিনিময় হলো খোকার; এক একজন এক একটা দল নিয়ে বসে আছে, ফোয়ারা ছুটছে যুক্তিতর্কের।

আডড়া শেষ করে উঠে যাচ্ছিলো প্রভাত গঞ্জালেস ও ইয়াসিন। খোকার দিকে চোখ পড়ায় ফিরে এলো আবার।

ইয়াসিন বললে, থাকিস কোথায়, দেখাই পাওয়া যায় না!

খোকা বললে, ইছাপুরায় ফিরে যাসনি এখনো?

আর ইছাপুরা। মানুষজন ঢাকা ছেড়ে সব গ্রামাঞ্চলে ভাগছে আর আমি গ্রাম ছেড়ে ঢাকায়, দেখি বরাতে কি জোটে!

সব লীলাখেলা তো এখন ঢাকায়–মুরাদ বললে, গোটা দুনিয়ার চোখ এখন ঢাকার দিকে; বিশ পকেটওলা নীলপ্যান্টে পথঘাট থৈথৈ!

গঞ্জালেস একটা হাই তুলে জড় ভাঙলো। বললে, সেই দুপুর থেকে এখানে, মেরুদণ্ড টনটন করছে, আর ভালো লাগছে না–

তার একটা হাত ধরে টেনে বসালো ইয়াসিন। বললে, আরে বোস বোস, তুইই এখন একমাত্র ভরসা সকলের; যাবো তো আমিও!

কথাটা মন্দ বলিসনি–মুরাদ বললে, পালানোর দরকার হলে তোর ওখানে গিয়ে উঠবো; কলাকোপা-বান্দুরা জায়গাটাও মন্দ নয়!

গঞ্জালেস বললে, কে যে কাকে জায়গা দেবে এখন এখানে বসে। সেকথা তোলা মুশকিল, মাথায় কাপড় তুলে আমাদেরই যে একদিকে ছুটতে হবে না এ কথা জোর দিয়ে কারো পক্ষে বলা অসম্ভব। ভিতরের খবর খুবই খারাপ।

খোকা বললে, তোর তো আবার সব বিদেশিসূত্রের খবর। ভাগ্যিশ কনস্যুলেটে কেরানির চাকরিটা ছিলো, তা না হলে দেশের ভাগ্যে যে কি ঘটতো!

গঞ্জালেস বললে, অবস্থা খুবই কেরোসিন, ঠাট্টা নয়!

ইয়াসিন মনমরা হয়ে বললে, দেশের অবস্থা যে খারাপ দিকে যাচ্ছে তা বোঝার জন্যে তোর ওই ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ ছাদা করার দরকার নেই, এমনিই বোঝা যায়। ইশ, সারারাত কিভাবেই না কুকুর কাঁদে! আমার শালা ঘুমই আসে না, মনে হয় একটা মড়ক লাগবে—

মুরাদ বললে, কুকুর আমাদের ওদিকেও কাঁদে, কিন্তু এটা একটা রদ্দিমার্কা কুসংস্কার!

ইয়াসিন চটে উঠলো। বললে, এড়ো তর্ক করাটা তোর একটা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে যা দেখতে পাচ্ছি; নিছক নিজের কোট বজায় রাখার জন্যে গায়ের জোরে তুই কথা বলিস। কি করে জানলি এটা কুসংস্কার; অভিজ্ঞতা আছে তোর কোনো?

মুরাদ বললে, লেখাপড়া শিখে এদেশের মানুষের কোনোদিন কোনো উন্নতি হবে না, সব শালা পিছনে হাঁটা মানুষ, তোদের দেখলে তাই মনে হয় আমার–

ইয়াসিন ক্ষেপে উঠে বললে, কুকুরের কান্না সম্পর্কে তোর কোনো ধারণাই নেই!

বললাম তো, অর্ধেক খনার বচন আর অর্ধেক পিথাগোরাস, তোরা হচ্ছিস এই মাল। দেশের কটা লোকে বিশ্বাস করে যে মানুষ চাঁদে গেছে? দাসত্বটা আমাদের চিরকেলে স্বভাব!

গঞ্জালেস উঠে দাঁড়ালো। বললে, আমি আর বসতে পারছি না, কিছু কাজ আছে, আবার দেখা হবে–

সন্ধ্যা পার হয়ে গিয়েছে। রাত্রির রঙ এখনো ঘনীভূত হয় নি; ধূসর আচ্ছন্নতার গায়ে অনুলিপ্ত ঘন নীল, আকাশ আড়াল হতে আর খুব বেশি দেরি নেই। খুব দূরে কোথায় রক্তাভ ধূম্রকুণ্ডলী হলহল করে ঊর্ধ্বমুখে ঠেলে উঠছে। আকাশের গায়ে আঁকা একটা খেপলা জালের মতো ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ছে; ভূগর্ভের কোনো এক প্রেতায়িত ধূম্রাগারের খোল ফেটে গলগলিয়ে বেরিয়ে আসছে, কখনো-বা একটা স্তম্ভ, আকাশকে যা নিদারুণভাবে বিদ্ধ করবে। খোকার চোখের সামনে পার্থেনন তৈরি হয়।

কোথাও আগুন জ্বলছে–খুব আচ্ছন্নভাবে বললে ইয়াসিন।

কোনদিকে মনে হয়?

ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

চতুর্দিকে নীল অন্ধকার মসলিনের ফিনফিনে যবনিকার মতো নড়ছে, দুলে দুলে উঠছে। দীর্ঘ বনস্পতি আর অবগুণ্ঠিত কুঞ্জবনের ক্ষীণ নিশ্বাসের পালকে নিজেকে সাজিয়ে এক নির্ভার জিপসী ঘাঘরা দুলিয়ে যেন উদ্যানময় নৃত্য করে ফিরছে। পানির ছাদে ব্যাঙের লাফ, ঝিঝিপোকার ঐকতান, সামান্য কয়েকটি খুচরো শব্দেই অর্থময় হয়ে উঠছে সন্ধ্যা; মনোরম যবনিকা সরে গেলেই রহস্যময় ছায়ানৃত্যের জিপসী তার কাঁধ থেকে দড়াম করে কাঠের এই পাটাতনে একটি ছাগশিশু ছুড়ে দেবে, ভিতরে ভিতরে এইসব অনুভূতি সিঁদ কাটে।

আমি হাঁপিয়ে উঠছি মুরাদ, আর ভালো লাগছে না—

তোর তো মাঝে মাঝেই এ রকম হয়। বলতে পারিস কখন তোর ভালো লাগে?

ঠিক সে রকম নয়, মনে হচ্ছে দমবন্ধ হয়ে মারা যাবো!

দূরের ওই আগুনটা দেখেই বোধহয় এরকম মনে হচ্ছে তোর। আমার এসব কোনো প্রতিক্রিয়াই হয় না–মুরাদ বললে, যা অনিবার্য তা ঘটবেই, তোর আমার যতই বুক ঢিপঢিপ করুক!

ইয়াসিন কিছু একটা ভেবে ঘড়ঘড়ে গলায় বললে, বন্দুকের দোকানগুলো সব লুট হলো, জেল ভেঙে কয়েদিরা সব ভাগতে শুরু করছে, এখানে আগুন ওখানে আগুন, লুটপাট। মোটেই ভালো লক্ষণ না এসব!

ওই তো বললাম, সব ঘটনার মুখ একই দিকে, ভালোভাবে যাচাই করে দেখলেই বুঝতে পারবি।

খোকা গা ছেড়ে দিয়ে বললে, আমার একেবারেই ভালো লাগছে না, তুই খুলে বল।

মুরাদের চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। নিষ্পলক দৃষ্টিতে খোকা তাকে নিরিখ করে চলেছে, সে বুঝতে পারে। সতর্ক হলেও খোকার চোখের ভাষা এই মুহূর্তে তার কাছে জটিল কুহেলিকাচ্ছন্ন মনে হয়।

হিটলারের সেই রাইখস্ট্যাগ জ্বালিয়ে দেয়ার কথা মনে আছে, নিজেকে ভরাডুবি থেকে রক্ষা করার জন্যে এটা তার পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়েছিলো সেদিন। একটু থেকে মুরাদ বললে, যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে তার সবকিছুর পিছনে একটা অদৃশ্য লোমশ হাত রয়েছে, যে হাতে মদ আর বারুদের গন্ধ। লুটপাট আর আগুন ঠেকাতে গিয়ে আমি কম লোকের মাথা ফাটতে দেখিনি। এখন এমন একজনও মানুষ পাবি না সে ছেলেই হোক বুড়োই হোক শ্রমিক হোক, যাই হোক না কেন, যে সজাগ নয়, সতর্ক নয়। তুই-ই বল না, এদেশের মানুষের এতো তাড়াতাড়ি আর এমন সর্বগ্রাসীভাবে আত্মােপলব্ধি ঘটবে তুই নিজেও কি কখনো ভাবতে পেরেছিলি? এর আগে কখনো আমরা এমনভাবে একাত্মতা অনুভব করি নি। সারা দেশের মানুষ আশ্চর্যভাবে এক হয়ে গিয়েছে। যারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায় তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে একতার এই দুর্ভেদ্য দুর্গটিকে গুঁড়িয়ে দেয়ার। ওরা সবসময় এমন সব বানোয়াট পরিস্থিতি তৈরি করতে সচেষ্ট থাকবে যা ওদের। আঘাত হানার জঘন্য ব্যাপারটাকে যৌক্তিক করে তুলতে সাহায্য করবে। একটা বছর ধরে এই যে সমানে ইয়াহিয়া ইয়াহিয়া-সাবধান সাবধান এর স্রোত চলছে এটা যে নিছক একটা স্লোগান নয়, ওরা তা খুব ভালো করেই জানে। যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল, এই আর কি; কেবল নিজেদের তৈরি করে নিতে যে সময়টুকু লাগে। সময় আর সুযোগ অনুকূলে এলেই হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে।

ইয়াসিন বললে, আসলে আমাদের চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। যার মুখে যা শুনছি, তাই বলছি–

খোকা নিস্পৃহকণ্ঠে মুরাদকে জিগ্যেস করলে, ধর সব দাবি যদি মেনে নেয়?

নিতেই পারে না–জোর দিয়ে মুরাদ বললে, বললাম না, সব ঘটনার মুখ একই দিকে! এতোদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তোর কি মনে হয় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো হিশেবী বুদ্ধি ওদের মাথায় ছিটেফোঁটাও আছে? রাজনীতি নামে এতোদিন প্রাসাদের অন্ধকারে ষড়যন্ত্র চালিয়ে নিজেদের মগজে যা ছিলো তাও গাবিয়ে ফেলেছে; দেশীয় কুইসলিংরাও চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করেছে। আমি বলে রাখলাম, তুই দেখে নিস, সব শালার পতন হবে, কোনো শালা টিকবে না। এ হলো বর্ণমালার ইন্দ্রজাল। আয়ুব খান থেকে এর শুরু, আমরা যাকে বলি সামরিক শাসন, কখনো নির্বাচনের মুখোশ এঁটে, কখনো গামছা ফেলে একেবারে বাবা আদমের মতো ন্যাংটো হয়ে। কিন্তু মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। এ থেকে যে ভূতুড়ে যজ্ঞের শুরু তা ওয়াই-তে এসে ঠেকেছে, এরপর জেড, চীনা জুতার সুখতলা জুলফিকার আলী, ব্যাস, তোর ওই খেল খতম, পয়সা হজম, এই-ই গানের বই গানের বই!

খোকা কোনো কথা বললো না। চুপচাপ তাকিয়ে রইলো ঘনায়মান। অন্ধকারের দিকে।

পানির উপরে হাওয়ার নাচন শুরু হয়েছে। বাংলা কবিতার একটি বিড়াল অন্ধকারকে ছোট ছোট বলের মতো থাবা দিয়ে লুকিয়ে আনছে, ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর চল নামি আষাঢ় আসিয়াছে ধরনের ঝাঁপ দিয়ে উদ্যানের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ছোটাছুটি করে নৃত্যরত জিপসী তা কুড়িয়ে নিচ্ছে, যেন শিলকুড়নি শৈশব। শৈশব জীবনে বারবার আসে

কেন? আসলে জীবন মানেই শৈশব; জীবনভর মানুষ এই একটা ঐশ্বর্যই ভাঙিয়ে খায়, আর কোনো পুঁজিপাট্টা নেই তার। এই এক অদ্ভুত জীবন, ধাপে ধাপে এরা নিজেদের ছোট করে তোলে, রক্তে মিশে আছে। এদের নিজেদের পতন।

ইয়াসিনও এক সময় উঠে দাঁড়ালো। বললে, মধ্যে থেকে আমার বিয়েটা পিছিয়ে গেল, গুলি মারি শালার আন্দোলনে। দেশের লোক আর সময় পেলো না ম্যান্ডেট দেয়ার, চলি!

এইসব ভূত যেন কখনো আমার কাঁধে ভর না করে, খোকা ভবিষ্যতের প্লীস্থ গাড়তে থাকে মনে মনে; ভিতরে যে ভুড়ভুড়ে পাক আর গরল জমে আছে খোকার ইচ্ছে নয় তা ঘাঁটাঘাঁটি করার। মিস্ট্রেস রাখলে কেমন হয়। জা পল সার্ত আর সাইমন দ্য ব্যভেয়ার আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত। কিন্তু ফরাসি মেজাজ তো আর আমানি খেয়ে খেত চষে আর পাট জাগ দিয়ে ধার পাওয়া সম্ভব নয়, আমরা সবাই এক একটা ভোদড়, ভুসিমাল, একুশে ফেব্রুয়ারি ভেঙে খাচ্ছি এখনো; গোটা দেশ কলের লাঙল দিয়ে চষে বেড়ালেও একজন বিদগ্ধ মানুষ খুঁজে বের করা যাবে না, হুব্বা, গেঁড়ে, সবকটা দিকপালই এক একটা আনকুথ, এক একটা গাঁইগুঁই, গুফি!

দ্য এসিয়েৎ এর বৈদগ্ধ চাই, চোখ চাই এনস্ট-এর। ফাঁক পেলেই ঝি চাকরানীকে পটাপট বিয়ে করে ফেলা মেজাজ আমাদের। বড় বড় পাট্টিতে সুটবুটওয়ালারা ট্যারা চোখে ঘ্যাঁসঘাস করে পাছা চুলকায় আর শব্দ করে ঢেকুর তোলে এখনো। নাজ সিনেমায় খেলে যাওয়া রঙিন মলাটের বই কিনে বাঁশের বক কক্সবাজারি ঝিনুক, শামুক আর প্লাস্টিকের খেলনার সঙ্গে সাজিয়ে রাখে ড্রইংরুমে ঘটা করে। গোটা দেশের মানুষজনই এক একটা ভুসিমাল, যে যার লাইনে দাঁড়িয়ে ঘাড়ের পাউডার মুছছে আর পিচ পিচ করে পানের পিক ফেলছে, গুফি! গুফি!

মুরাদ তার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে নীরবে। ভালো লাগে না খোকার। তার চোখ একটা পলকা প্রজাপতির মতো এখানে-ওখানে উড়ে বেড়ায়, গাছে গাছে, পাতায় পাতায়, স্বপ্নের গর্ভকেশরে :

সবকিছুই একটা স্বপ্ন। স্বপ্নের ভিতরে আমরা জন্মাই, স্বপ্নের ভিতরে আমরা চিৎকার করে উঠি, ঝনঝন ভেঙে যায় সব কাচ, তির তির করে কেঁপে ওঠে দুধের সর, কৌমার্যের পাতলা পর্দা। স্বপ্নের ভিতরে আমরা স্তন্যপান করি, স্বপ্নের ভিতরে আমরা শিল কুড়াই, স্বপ্নের ভিতরে আমরা বকুল ফুলের মালা গাঁথি, স্বপ্নের ভিতরে অঞ্জু পুকুরে পড়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে মঞ্জু তাকে ধরতে যায়, স্বপ্নের ভিতরে নীলাভাবী কাচের চুড়ির শোকেস হয়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে রাজীব ভাই বৈদুর্য-বিদ্রম হাতড়ায়, স্বপ্নের ভিতরে ফিয়াট বড় হয়ে ওড়ে, স্বপ্নের ভিতরে বেলী ব্লাউস ছিড়ে ফ্যালে, স্বপ্নের ভিতরে লিপস্টিক জড় হয়, স্বপ্নের ভিতরে লুলু চৌধুরী কান ধরে টানে, স্বপ্নের ভিতরে মোদিল্লিয়ানী রঙ ছুড়ে দেয়, স্বপ্নের ভিতরে অর্ধেন্দু মুখ পুড়িয়ে ফেলে, স্বপ্নের ভিতরে মতিয়ুর শালিক হয়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে প্রীতি বিষ গলায় ঢালে, স্বপ্নের ভিতর হাইপোস্টাইল হল ভেঙে পড়ে, স্বপ্নের ভিতর পার্থেনন গমগম করে বাজে, স্বপ্নের ভিতরে পাপ পুণ্য হয়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে আত্তিলা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে, স্বপ্নের ভিতরে অন্ধকার হড়াম করে ওঠে, স্বপ্নের ভিতরে দেখতে দেখতে আমরা আরেক স্বপ্ন হয়ে যাই।

এইসব মনে হয় খোকার।

কাচের একটি বিশাল স্বচ্ছ গোলাকার চিমনির ভিতর মাছির মতো বারবার পিনপিন করে ঘুরতে থাকে এইসব স্বপ্ন।

খুব কাছে, লেকের কোল ঘেঁসে কয়েকটি সাদা রাজহাঁস; খোকার মনে হয় স্বপ্ন। কালো বরফ, নীল চাঁদ, সবুজ সূর্য, রক্তবৃষ্টি, মাংসবৃষ্টি–এক একটি রাজহাঁস। স্তন, শিল, পুকুর, কাচের শোকেস, বিদ্রম, ছেঁড়া ব্লাউস, লিপস্টিক, বিষ, শালিক, হাইপোস্টাইল হল, সবকিছু রাজহাঁসের একটি পালক।

খোকা এমনভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যাতে একটি সিগ্রেটের পুরোটাই আঙুলের ফাঁকে নিঃশব্দে পুড়ে যায়।

আমিও একটা স্বপ্ন স্বস্তিকা, ক্রশ আর সুলেমানের তারকার মতো আমিও একটা স্বপ্ন; খোকার মনে হয়, সুরক্ষিত অতীত আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝখানে ঝুলন্ত এক সেতুর উপর কুটকুটে ন্যাতাজড়ানো ফ্যানা ছেলের মতো সর্বক্ষণ কি খেলায় যে বিভোর!

মুরাদ তুই লা হোলা পড়েছিস?

পড়িনি, কেন বলতো?

এমনি-ই! আমার ঘরে আছে, পড়ে দেখিস। আজ কদিন থেকে। মনের ভিতর কেবল লা-হোর্লা লা-হোলা চলছে, ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না!

মাঝে মাঝে এমন সব উদ্ভট কথা বলিস!

তোর ধারণাটাই বোধহয় ঠিক, ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটবে এবার!

ধানঝাড়া করবে, এই আর কি! মুরাদ হেসে বললে।

আরো অনেক বেশি। হয়তো আমরা কেউই থাকবো না; স্বপ্ন হয়ে যাবো–

মুরাদ অকারণে হাসতে লাগলো। বললে, তুই কোনটা চাস? সাত কোটি লোক মারা যাক, শুধু আমরা কয়েকজন বেঁচে থাকি, না আমরা এই কজন শুধু মারা যাই, সাত কোটি লোক অক্ষত এবং জীবিত থাকুক, কোনটা?

মুরাদ একটু থেমে কিছু একটা ভাবলো। একটা সিগ্রেট ধরালো। বললে, আর একটা ইন্দোনেশিয়া হতে চলেছে দেশটা–

তোর একটা গুণ আছে মুরাদ, সবকিছু তুই খুব সহজভাবে নিতে পারিস। ভিতরে ভিতরে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে যাচ্ছে–

গুণটুন বুঝি না–চটাস করে সিগ্রেটের ছাই ঝেড়ে মুরাদ বললে, গতানুগতিকতাকে আমি ঘৃণা করি! পরিবর্তন চাই। এমন একটা পরিবর্তন যা সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দেবে, বদলে দেবে। মানুষ আর স্রোতের শ্যাওলায় কোনো তফাত নেই এখন, এটা ঘূণ্য। শিরদাঁড়াকে এমনভাবে বেঁকিয়ে রেখেছি যা লাথি না খেলে কখনো সোজা হবে না। মার চাই আমাদের, শয়তানের মার।

তার মানে সাপের মতো খোলস বদল করে আমরাও বারবার নতুন হতে চাই।

সাপের মতো কি না জানি না–মুখ অপেক্ষাকৃত শক্ত করে মুরাদ বললে, তবে পরিবর্তন আমরা চাই, আর এই জন্যেই আমরা মানুষ। পরিবর্তন থেকে পরিবর্ধন। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নিত্যনতুন চিন্তা করার একটা ঐতিহ্য রয়ে গিয়েছে বাঙালিদের; আমরা এই তুচ্ছ হেলাফেলার জিনিস নই!

পরিবর্তন আর রূপান্তরের তফাত বুঝিস?

কি রকম? চোখ কোঁচকালো মুরাদ।

গ্রেগর স্যামসা রূপান্তরিত হয়েছিলো পোকায়–

তার মানে পরিবর্তনমান সমাজের মানুষরা তোর কাছে সন্দেহের পাত্র। গদি আঁকড়ে থাকা ক্ষমতালোভীদের মতোই নিছক মাছ ধরার জন্যে পানি ঘোলা করছিস তুই। কতোগুলো বাতিক আছে তোর, দুঃস্বপ্নের নরকে হাবুডুবু খাওয়ার অভ্যেসটা মজ্জাগত দোষ হয়ে। দাঁড়িয়েছে।

তুই শুধু চোখ দিয়ে দেখছিস কেন সবকিছু—

তুই দেখছিস কান দিয়ে–

খোকা অসহিষ্ণু হয়ে বললে, তোর কি কখনো এইসব দুমদুমারি হট্টগোল দেখে অন্য কোনো কথা মনে আসে না? ওদের সঙ্গে আমাদের তফাতটা তাহলে রইলো কোথায়? তফাতটুকু কি তাহলে এইটুকুই–ওদের গায়ে খাকি পোশাক আমাদের গায়ে গামছা, ওদের পায়ে বুটজুতো আমাদের পায়ে চটি, ওদের কাঁধে অটোম্যাটিক রাইফেল আমাদের কাঁধে ইশলের বই! তফাতটা যদি কেবল এইটুকু হয়, তার মানে এও দাঁড়ায়, প্রয়োজন হলে আমরা খাকি পোশাক পরবো, রাইফেল কাঁধে নেবো। কিন্তু খুব ভালো করে খতিয়ে দেখলে ধরা যাবে ওরা যা, আসলে আমরা তা নই। ওরা যা পারে আমরা তা পারি না। আমাদের তা পারা উচিত নয়। আমি পাঞ্জাবি সোলজারদের মতো হতে ভালোবাসি–এই জাতীয় কথা উঠলেও ঘূণায় শিউরে উঠবো আমরা। কিন্তু কেন? গুণ্ডামি পাণ্ডামি লুট হত্যা ধর্ষণের জাতীয় চরিত্র নেই বলে? ঠিক তা নয়; হয়তো উল্টোটা বলেই। আমরা মানুষ, হৃদয়হীন, চিন্তাশক্তিহীন রোবট নই; তুই আমার কথা শুনছিস?

শুনছি! মুরাদ মাথা নেড়ে বললে, আমরা যে কি মাল প্রত্যেকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাই তা বলে দেবে–

খোকা মুরাদের কথা ধার দিয়েও গেল না।

সে বললে, আমরা কি বলি? বলি পশুশক্তি! ওরা এক একটা জানোয়ার। আধা জানোয়ার থেকে এক লাফে পুরোপুরি জানোয়ার হওয়াটা এমন কোনো কঠিন ব্যাপার নয়, বরং সেটাই সহজ। আমরা এই আধা জানোয়ারের দল সবসময় পুরোপুরি জানোয়ার হয়ে ওঠার জন্যে উদগ্রীব থাকি, প্যাঁচপেচে পরিবেশ দলদলে পরিস্থিতি এসব খুঁজি, সুযোগ পেলেই গর্জন করে জাহির করতে চাই সেই পশুত্বকে। কিন্তু আমি বলছি ওরা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে এক একটি রোবট, নিছক পশু নয়। প্রয়োজনের খাতিরে আধা জানোয়ার থেকে পুরোপুরি জানোয়ার হতে পারি, কিন্তু বল, রোবট হতে পারবি, চিন্তা করতে পারিস তুই?

বরং তুই থাম খোকা। এখনই আমার গা ছমছম করছে। গ্লাসে ঢেলে যা গেলা যায়, তোর অভ্যেস মড়ার মাথার খুলিতে ঢেলে তা গেলা। তুই শালা বুজিংগো দলের পাণ্ডা; এক কাপ চাকে ইচ্ছে করে হেমলক বানিয়ে ফেলিস!

আমি কি খুব বাজে কথা বলছি?

প্যাঁচ মারাটা তোর চিরকেলে স্বভাব। আন্দোলন ইজ আন্দোলন–খুব জোর দিয়ে মুরাদ বললে, রোবট আবার কি? আগেও বহুবার তুলেছিস কথাটা, আধুনিক মানুষ তোর কাছে নিছক রোবট।

বাধা দিয়ে খোকা বললে, রবার্টসনের টিটানের কথা তোর মনে আছে? তুই কি মনে করিস নিছক সাইন্স ফিকশন? তাহলে টাইটানিকটা কি?

মুরাদ বললে, এখানে যা কিছু ঘটছে, কিংবা ঘটতে চলেছে, সেটা অভাবনীয় কিছু নয়, ইতিহাসের নিয়মেই তা হচ্ছে। বুজরুকি মেরে ধাপ্পা দিয়ে জনতার রুদ্ররোষকে ধামাচাপা দেওয়া এখন অসম্ভব। আজকের পৃথিবীর স্বাধিকার প্রমত্ত বলবান মানুষ তার দৃষ্টিকে আর আচ্ছন্ন রাখতে চায় না; তারা সদা সতর্ক। স্বাধিকারকে যা খর্ব করবে, নস্যাৎ করে দেবে, এমন সবকিছুর ওপরই তারা আঘাত হানতে বদ্ধপরিকর!

এসব ডাস্টবিনের কথা! বছরের পর বছর ওই একই গতে কথা বলে যাবি তোরা, তবু যাহোক ল্যাটিন আমেরিকার কথা ওঠেনি। তোর কথায় আজকের পৃথিবীর স্বাধিকারপ্রমত্ত মানুষের যে ছবিটা ফুটে উঠেছে তাতে তুড়িলাফ দেয়ার মতো তেমন কিছু নেই। খবরের কাগজের মাসমাইনের রিপোর্টার কিংবা পেশাদার ভাড়াটে নেতাদের মতোই দায়সারাগোছের একটা চেহারা আঁকলি তুই। আজকের পৃথিবীর মানুষ বলতে গিয়ে তুই কিছুসংখ্যক মানুষকে একফালি তরমুজের মতো আলাদা করে ফেলতে চাস। তার মানে গতকালকের পৃথিবীতে যে মানুষ ছিলো তাদের সঙ্গে এদের ঘোরতর প্রভেদ ধরতে পারছিস তুই। গতকালকের পৃথিবী সম্পর্কে তোর মনে নিশ্চয়ই কোনো স্বচ্ছ ধারণা জন্মেছে, তা না হলে ওই টনটনে ভেদজ্ঞানটা আসছে কোত্থেকে। এখন আমাকে বুঝিয়ে বল, গতকালকের সেই মানুষের সম্পর্কে তোর যাবতীয় ধারণার মূল সত্য কোটি, নাকি ওটা এমনিই কথার কথা?

তার মানে তুই আমাকে ভূতের ভয় দেখাবি এখন, এই তো? খচড়ামিটা তোর আজন্মকালের ঘোড়ারোগ। সব কথা বুঝেও না বোঝার ভান করে আমার কাঁধে গায়ের জোরে একটা মতো চাপাতে চাচ্ছিস

চোখের পলক পড়তে না পড়তে পাচশো টনের একটা কোবাল্ট বম গোটা পৃথিবীকে হিরোশিমা করে ছাড়তে পারে বলে মানুষকে আমরা আজকের মানুষ হিসেবে যেমন চিহ্ন দিতে পারি না, ঠিক তেমনি রাশিয়ার নিপীড়িত জনগণ জারতন্ত্রকে উচ্ছেদ করেছে বলে তাদেরও আমরা আজকের মূর্তিমান মানুষ বলে আখ্যা দেবো না। এই মুহূর্তে তুই আর আমি এই রমনা রেস্তরাঁয় বসে যাকে আজ বলে আখ্যায়িত করছি, আর মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তা গতকাল হয়ে যাবে। গতকাল আজ আগামীকাল এগুলোর ঠুনকো আপেক্ষিকতাকে তুই নিশ্চয়ই স্বীকার করিস। কিন্তু মানুষ, যখন আকাশে তারার অভ্যুদয় ঘটেনি তখনকারও এক সভ্যতার কথা আমরা শুনে থাকি, টিটিকাকা হ্রদের কোলে টিয়াহুয়ানাকোর সভ্যতা এই ধরনের প্রাচীন। গতকালকের মানুষ আর আজকের মানুষ বলে কোনো কথা নেই। টিয়াহুয়ানাকোর মানুষও যা, থাটমোসের মিশরীয়রাও তাই। কখনো সিজারকে সে হাতের স্টাইলাসে কুপোকাত করছে, কখনো সিংহের চামড়া পরে যোদ্ধার বেশে বাদর নাচ নাচছে মোজাম্বিকে। প্রত্যেকেই মানুষ। দলাক্রোয়াও মানুষ ছিলো, শাগালও মানুষ, রশিদ চৌধুরীও মানুষ। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ কিংবা বিনয় মজুমদারের সঙ্গে বংগো বাজানো প্রাদোর আমি কোনো তফাত দেখি না। লা-হোলা লেখা মোপাসার সঙ্গে একজন ভুডো এক্সপার্টের আদতেই কোনো প্রভেদ নেই। সবক্ষেত্রেই ওই একই কথা, মানুষ। পাঁচশো টনের কোবাল্ট বম ঝাড়তে পারিস বলে, কিংবা লংমার্চ করতে পারিস বলে তুই মুরাদ চৌধুরী কিংবা শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী আজকের মানুষ হতে পারিস না। মানুষ পিরামিড গড়েছিলো, মানুষ কলোশিয়াম নির্মাণ করেছিলো, বাগদাদের ইলেকট্রিক ব্যাটারির কথা শুনিসনি!

এখন দয়া করে কিছুক্ষণের জন্যে তোর ওই ব্যাপারটাকে তুলে রাখ, এসব ফালতু কথা ঘাঁটাঘাঁটির কোনো মনে হয় না। তাই ঘরের দরোজা বন্ধ করে ভুডো প্রাকটিস কর, আমাকে ওর ভিতর জড়াসনে। তোর লাইন আলাদা। তুই শালা ডাক্তারকে বলিস ম্যাজিশিয়ান, ভ্যালিয়মকে বলিস মাদুলি, অক্সিজেনকে বলিস ঝাড়ফুক। আমার স্পষ্ট মনে আছে এখনো গত বছর স্যালাইনকে অক্ষতযোনি ষোড়শীর টাটকা পেচ্ছাব বলায় হাসপাতালের ডাক্তাররা তেড়ে এসেছিলো তোকে মারতে।

কথাটা ঘুরিয়ে দিলি তো? ভালোই করেছিস—

এই রোবটের কথা শুনলেই আমার গা শিরশির করে। যে কথার জন্যে এসেছিলাম এখানে, তা আর বলা হবে না আজ।

কি বলতে চেয়েছিলি?

না আজ থাক। এখন আর ভালো লাগছে না। এখানে সে রকম পরিবেশ নেই। পচা নালী ঘা-র মতো থুথুক করছে, অন্য কোথাও বসা উচিত ছিলো আমাদের–

পরিবেশ-টরিবেশও আছে এর মধ্যে, ব্যাপার কি?

দোহাই তোর, জোর করিস না–অসহায় ভঙ্গিতে মুরাদ বললে, আজ আর কিছু ভালো লাগছে না!

তুই আমার রাত্রির ঘুম নষ্ট করছিস!

তোর তো রাত্রে ঘুমই হয় না—

খচড়ামি রেখে কি বলতে চেয়েছিলি বল, ভনিতার কি দরকার।

তুই আমাকে জোর করছিস, কিন্তু আমি জানি শুনলে তোর মন খারাপ হয়ে যাবে। তবু তোকে বলা দরকার, সেই জন্যেই যেতে চাচ্ছিলাম তোর কাছে।

বুঝলাম তো, তারপর? খোকা বড় বড় চোখে মুরাদের দিকে তাকালো। অবসন্ন মনে হয় মুরাদকে; মানসিক শ্রান্তিতে একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে সে।

তোর মন খারাপ হয়ে যাবে খোকা, বরং শুনে কাজ নেই—

প্যানপ্যানানি রেখে খুলে বল যা বলার।

কথা দে, সব শুনে আমাকে ঘৃণা করবি না!

ব্যাপার কি, সিফিলিস নাকি?

কি যা-তা বলছিস!

সিফিলিস যা-তা ব্যাপার হলো? বোদলেয়রের ছিলো না?

আমি তো আর বোদলেয়র নই।

হতে কতোক্ষণ! এই যে এতো ভ্যারেন্ডা ভাজলাম তাতেও কি তুই বুঝতে পারিস নি যে বোদলেয়রের সঙ্গে আদতেই তোর কোনো তফাত নেই। আর এভাবে যদি দেখতে কষ্ট হয় তাহলে খোলা চোখেও মিল খুঁজে পাবি। এটা বরং তোর পক্ষে আরো সহজ। বোদলেয়র যা যা করতো তুই-ও তাই করিস। তুই কবিতা লিখিস, দুএকবার পাড়ায় গিয়েছিস, ড্রিংক করিস, অনুবাদেও হাত দিয়েছিস। বোদলেয়রের মতো তোর শুধু লেপ্টে থাকা ধুমসো ভেনাস নেই, যে তোকে ফতুর করে ছাড়বে। তা ওটা তুই নিজেই ম্যানেজ করে নিতে পারবি, সে গুণ তোর আছে। আজকাল তোর যে চালচলন দেখছি তাতে বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না ঐসব জিনিশ লটকাবার জন্যে দিনরাত হন্যের মতো ঘুরছিস তুই। চেহারাটাও মালখোর মালখোর টাইপের হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। তা জুটিয়েছিস নাকি এক আধটা ঢাউস জিনিশ? তোর তো আবার গম্বুজমার্কা পেল্লায় পেল্লায় জিনিশের খায়েশ হয়; নৌকোর দুলুনিতে গা গোলায়, চিরকালই তুই ইস্টিমারে চাপা পছন্দ করিস। কিবে, হুব্বার মতো জিভ কামড়ে বসে আছিস কেন, মাল ছাড়! মাল ছাড়!

মুরাদ কোনো কথা বললে না। খোকার দিকে মোমের মতো অদ্ভুত এক থির দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে রইলো। এই মুহূর্তে সে বসে আছে। এক অচেনা ব্যাধের সামনে; মুখ দেখে মনে হয় তার হাত-পা পড়ে গিয়েছে, নিজেই নিজের ভার রাখতে অক্ষম এখন।

কি বলবি বল?

আমি জানি, তোর শোনার ইচ্ছে নেই—

ঘণ্টা জানিস তুই!

ভালো লাগছে না কিছু, চল, ওঠা যাক, বেশ রাত হয়েছে। রঞ্জু তোর জন্যে দুশ্চিন্তা করবে।

জটিল ব্যবধান ক্রমশ দুস্তর হয় দুজনের মাঝখানে, সেখানে টেবিলের পিঠ, এ্যাসট্রে, চায়ের কাপ, সিগ্রেটের প্যাকেট, সবকিছুই অপসৃত! দুজনের মাঝখানে আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে একটি ঠাণ্ডাহিম তরোয়াল।

বিল চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো খোকা। রিকশায় ওঠার আগে পর্যন্ত কোনো কথা বললো না মুরাদ। নিঃশব্দে হাঁটলো। খোকা একা হাত-পা নেড়ে অনর্গল কথা বলতে লাগলো। এমনভাবে হাত-পা নাড়ছিলো যে এই অবস্থায় তাকে কেউ দেখলে এ কথাই ভাবতো, একটি পাগল অন্ধকারের সঙ্গে পিংপং খেলায় মেতে উঠেছে।

চলি দেখা হবে–রিকশায় উঠতে উঠতে মুরাদ বললে।

রিকশায় উঠলো খোকাও। ছাউনি নামিয়ে দিলো মাথার। চতুর্দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঝিঝিপোকার ঐকতান; রাত্রি হয়ে আছে বহুকাল আগে ডুবে যাওয়া টাইটানিক, এ্যাঞ্জেলফিশের ক্ষীণ নিশ্বাস তার গায় দাগ কাটতে পারে না। রঞ্জুকে ভালোবাসে মুরাদ, আর রঞ্জু, ভালোবাসার ভও বোঝে না বেচারি, নিজের সঙ্গে কথা কাটাকাটির পর হঠাৎ হোহো করে হেসে ফেললে খোকা, রাক্ষস!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *