প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প
আগ্রা যখন টলমল
উপন্যাস
সংযোজন
পরিশিষ্ট

০৫. রাজধানী পানামায়

১৫২১-এ যোজকের নতুন সরিয়ে-আনা রাজধানী পানামায় পিজারো আর আলমিগরো বন্ধু মোরালেস-এর বাড়িতে ঘনরামকে ক্রীতদাস হয়ে থাকতে আমরা দেখেছি, পরের দিন সরোবরের সান্ধ্যসভায় শুরু করলেন শ্রীঘনশ্যাম দাস, আর সূর্য কাঁদলে সোনার দেশের সন্ধানে যাবার জন্যে যারা ব্যাকুল তাদের একত্র মিলিয়ে পাথেয় সংগ্রহের উপযুক্ত ভূমিকা তৈরি করার ব্যাপারে তাঁর নেপথ্য হাত যে আছে তা অনুমান করা আমাদের ভুল হয়নি।

পিজারো আর আলমাগরোর স্বপ্ন সার্থক হবার সম্ভাবনা সত্যিই ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাঁরা নিজেরাই বিস্মিত হয়েছেন অপ্রত্যাশিতভাবে নানাদিক থেকে ভাগ্য তাঁদের ওপর অনুকূল হয়ে ওঠায়।

ভাইকার হার্নারেমন্ডো দে লুকে তাঁদের দুই বন্ধুর প্রস্তাব শুনে সে বিষয়ে কিছু করা। সম্ভব কি না চেষ্টা করে দেখবেন বলে আশ্বাস দিয়ে গেছলেন। কিন্তু তাঁর দিক থেকে কয়েক মাস কোনও সাড়াই পাওয়া যায়নি।

আসলে ভাইকার দে লুকে খুব প্রাণ খুলে কোনও আশ্বাস তাদের দেননি। এ-অভিযানের পরিকল্পনা যা শুনেছেন, তাতে তেমন কিছু উৎসাহবোধ করার বদলে তিনি তার সাফল্য সম্বন্ধে সন্দিহানই হয়েছেন। পিজারো আর আলমাগরোর এ-রকম অভিযান চালাবার যোগ্যতা সম্বন্ধে সংশয় জেগেছে তাঁর মনে। যত উৎসাহীই হোক, দু-জন প্রায় বুড়ো, সম্পূর্ণ নিরক্ষর বাউণ্ডুলে ছাড়া তো তারা কিছু নয়। তা ছাড়া আরও একটা কথা ভাবতে হয়েছে দে লুকেকে। নতুন মহাদেশ আবিষ্কৃত হবার পর থেকে আশাতীত অনেক কিছুর সন্ধান মিলেছে সত্যিই, কিন্তু কল্পনারঙিন কিংবদন্তি যে আশা জাগিয়েছে, তার একশোটার মধ্যে একটাও পূর্ণ হয়েছে কি না সন্দেহ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লুব্ধ করে টেনে এনে মরীচিকার মতোই আশ্চর্য সব দেশের ঘোষিত ঐশ্বর্যের সমারোহ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

দুঃসাহসী বেপরোয়া ভাগ্যান্বেষীরা না হোক, তাদের অভিযানের খরচ যারা জোগায় ভবিষ্যৎ লাভের আশায়, সেই মহাজনেরা অন্তত একটু সাবধান হয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছে তাই।

এ মহাজনির কারবারে লাভ হলে অঢেল হয় বটে, কিন্তু লোকসানের ঝক্কিও দারুণ। প্রথমত, অভিযান সফল হলেও কতদিনে হবে তার কোনও ঠিকই নেই। এক-দু বছর নয়, পাঁচ-দশ বছরেও লাভ দূরের কথা, যাদের ভরসায় টাকা খাটানো, তাদের মুখই হয়তো দেখতে পাওয়া যাবে না। বেঁচেবর্তেই তারা না থাকতে পারে। তখন যা-কিছু তাদের জন্যে ঢালা হয়েছে, সবই জলাঞ্জলি। তাদের আরম্ভ করা অভিযান হয়তো সফল হবে, কিন্তু ভিন্ন লোকের হাতে। তারা আমলই দেবে না আর কারও সঙ্গে আগেকার কোনও চুক্তিকে।

ফল হাতে পেয়ে গাছ পোঁতার দাবিদারকে তারা মানবে কেন?

এত ঝক্কি সূত্ত্বেও কল্পনার সোনার আশায় সত্যিকার সোনা প্রায় বিলিয়ে দেবার মতো মহাজন তখন দু-চারজন ছিল। তা না থাকলে নতুন মহাদেশের রহস্য-যবনিকা দিকে দিকে কতদিনে গুটিয়ে তোলা হত কে জানে! অন্তত আবিষ্কৃত হবার মাত্র ত্রিশ বছরের মধ্যে সেই পালতোলা জাহাজের যুগে এই বিরাট অজানা মহাদেশের উত্তরের লাব্রাডর থেকে দক্ষিণের শেষ বিন্দু টেরা ডেল ফুয়েগো পর্যন্ত উদঘাটিত হয়ে ১৫২১-এ স্পেনের পতাকা বয়ে পোর্তুগিজ নাবিক ম্যাঙ্গেলান-এর পক্ষে পশ্চিম সমুদ্রে যাবার সেই পরমবাঞ্ছিত প্রণালী খুঁজে পাওয়া সম্ভব হত না।

তেমনই এক মহাজন একদিন হঠাৎ দে লুকের কাছে নিজে থেকে এসেছেন। কী আলাপ তাঁদের মধ্যে হয়েছে তা বলা যায় না, কিন্তু পিজারো আর আলমাগরো নিবিড় অন্ধকারে হঠাৎ আলোর রেখা দেখতে পেয়েছেন।

দে লুকে তাঁদের অভিযানের বিস্তারিত পরিকল্পনা ছকে দেখাতে বলেছেন।

খরচা কি তাহলে সত্যিই পাওয়া যাবে? দেবেন দে লুকে সে টাকা? ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করেছেন পিজারো আর আলমাগররা।

হ্যাঁ, পরিকল্পনা বিচার করে তারপর টাকার ব্যবস্থাটা হতেও পারে। ভাসা ভাসা ভাবে বলেছেন দে লুকে, স্পষ্ট কোনও আশ্বাস দেননি।

দেবেন কোথা থেকে! আশ্বাস দেবার আসল মালিক তো তিনি নন। তবে পরিকল্পনাটা সত্যিই ভোলা মন নিয়ে তিনি বিচার করে দেখবেন। তাঁর সে বুদ্ধি-বিচক্ষণতা আর সাধুতার সুনাম ইতিমধ্যেই পানামায় অনেকের কাছে পৌঁছেছে।

কিন্তু বিচার করে দেখবেন কার হয়ে? নেপথ্য থেকে সত্যিকার চাবিকাঠি নাড়বার এই মানুষটি কে?

ইচ্ছে করেই যিনি নিজেকে নেপথ্যে আড়াল করে রাখেন তিনি কি নিজে থেকেই এই ব্যাপারে হঠাৎ আকৃষ্ট হয়ে বিস্তারিত সন্ধানের উদ্যোগ করলেন?

তা যদি না হয়, তাহলে তাঁর গোপন পরিচয় খুঁজে বার করে কে তাঁর কৌতূহল এইটুকু পর্যন্ত উসকে দিল? দিলই বা কী ভাবে!

তা জানবার উপায় নেই। তবে মানুষটির নাম ইতিহাসের অগোচরেই থেকে যায়নি। ঐতিহাসিকেরা তাঁকেও স্মরণীয় করে রেখেছেন। নাম তাঁর গ্যাসপার দে এসপিনোসা। শুধু নেপথ্য থেকে অভিযানের খরচাই তিনি জোগাননি, একদিন সূর্য কাঁদলে সোনার দেশে তাঁকে সশরীরে উপস্থিত থাকতেও দেখা গেছে। কিন্তু সে ঘটনা তখন ভবিষ্যতের অন্ধকার গর্ভে বিলীন।

পিজারো আর আলমাগরো তখন তাঁদের পরিকল্পনাটা ছকে ফেলেছেন। কিন্তু দু-জনেই তো সমান পণ্ডিত! মুখে মুখে ছকলেই তো হবে না, তা কাগজে কলমে তোলা চাই।

সেই কাজটা মোরালেস-এর বাড়িতেই হয়েছে। সন্ধে সকাল দুবেলা তিন বন্ধুর বৈঠক বসেছে, সব কিছু ভেবেচিন্তে স্থির করে লিখে ফেলবার জন্যে। আলোচনা করেছেন সবাই আর লেখার কাজটা করেছেন মোরালেস।

নিজে প্রত্যেক দিনের লেখা পরের দিন পড়িয়ে শুনিয়েছেন মোরালেস, দরকার মতো নতুন কিছু সংশোধন করার জন্যে।

নিজের লেখা পড়তে গিয়েই কিন্তু অবাক হয়েছেন এক-একদিন! সম্ভব হলে অভিযান কোন সময় নাগাদ শুরু করবেন আগের দিন আলোচনা করে তা লেখা হয়েছিল বলেই সকলের ধারণা। নভেম্বর মাসই উপযুক্ত সময় বলে তাঁরা ঠিক। করেছিলেন। কিন্তু পড়তে গিয়ে নভেম্বর মাসটা কাটা দেখে প্রথমটা বেশ একটু ধোঁকাই লেগেছে। লেখাটা কখন কাটলেন মনে করতে পারেননি। তেমন কিছু গুরুত্ব অবশ্য এ ব্যাপারে সেদিন দেননি। নিজেই ভুলে কখন কেটেছেন এখন মনে নেই, এইরকমই ধরে নিয়েছেন।

পরের বার কিন্তু বেশ একটু হতভম্বই হয়েছেন নিজের লেখা পড়তে গিয়ে। এ দেশের আদিম অধিবাসীদের কাছে আবছা যে সব বিবরণ এ পর্যন্ত সংগৃহীত হয়েছে তার অধিকাংশতেই পানামার যোজক ছাড়িয়ে দক্ষিণ-মুখে পুয়ের্তো দে পিনাস-এর পর কিছুটা অগ্রসর হলে বীরু নামে একটি নদী পাবার কথা জানানো আছে।

এই বীরু নদীর নাগাল পেলেই তাঁদের সন্ধান সহজ হয়ে যাবে বলে তিন বন্ধুই মনে করেছেন। মোরালেস কাগজে লিখেছিলেনও তাই।

লিখেছিলেন, বীরু নদী আমাদের লক্ষ্য! তার স্রোত বেয়েই রহস্য-রাজ্যের সন্ধান আমরা পাব।

পড়তে গিয়ে দেখেন, দ্বিতীয় সেনটেন্স-এর আগে হয়তো শব্দটা বসানো। হাতের লেখাটা হুবহু যেন তাঁরই, কিন্তু এ কথা লিখেছেন বলে স্মরণ করতেই পারেন না।

ওই একটা শব্দে সমস্ত বাক্যটার অর্থ একেবারে বদলে গেছে। সেটা দাঁড়িয়েছে, বীরু নদী আমাদের লক্ষ্য। হয়তো তার স্রোত বেয়েই রহস্য-রাজ্যের সন্ধান আমরা পাব।

এ হয়তো শব্দ বসিয়ে তাঁদের বিশ্বাসকে এমন দুর্বল করে দেখানো তো তাঁদের পক্ষে অসম্ভব! ভুলেও মোরালেস তা করতে পারেন না।

তাহলে আর কেউ কি তাঁর এ লেখার ওপর কলম চালাচ্ছে! কিন্তু কে তা চালাতে পারে, আর চালাবেই বা কেন?

মোরালেস বয়সে পিজারো আর আলমাগরোর প্রায় সমান হলেও নানা রোগে। ভুগে বড় বেশি ভেঙে পড়ে অথর্ব হয়ে গেছেন। তা না হলে পিজারোর অভিযানের। শুধু পরিকল্পনা করেই তিনি ক্ষান্ত থাকতেন না।

ভাঙা শরীর নিয়েও মোরালেস কিন্তু স্পেনে ফিরে যাননি। শরীর অক্ষম হলেও অজানা মহাদেশের মোহে তাঁর মন এখনও আচ্ছন্ন। সেই দেশে উত্তেজনার উৎস-মুখেই তিনি জীবনটা কাটিয়ে যেতে চান।

প্রায় একাই তিনি পানামায় একটি বাসা নিয়ে থাকেন। পানামার দপ্তরখানায় তাঁর এক দূরসম্পর্কের ভাইপো কাজ করে। সে মাঝে মাঝে কাকার সঙ্গে দেখা করে যায় মাত্র। তাঁকে দেখাশোনা আর তাঁর ফাইফরমাশ খাটার কাজ এক ক্রীতদাসই করে।

অসম্ভব হলেও, তাঁর সেই ভাইপো পেড্রো কোনও সময়ে এসে তাঁকে না পেয়ে কাগজগুলোর ওপর কলমবাজি করেছে, এইটুকু মাত্র ভাবা যেতে পারে।

পেড্রো এসেছিল কিনা জানবার জন্যে তাই তিনি ক্রীতদাসকে ডাক দেন।

একবার দুবার তিনবার ডাকেও তার কিন্তু সাড়া পাওয়া যায় না।

গানাদো বলে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে আর একবার ডেকে মোরালেস উঠে পড়েন।

না, মোরালেস-এর ক্রীতদাস গানাদোর কোনও পাত্তা পাওয়া যায় না। বাড়িতে সে নেই। একদিন খোঁজ-খবরের পর জানা যায়, পানামা থেকেই সে উধাও।

হঠাৎ লোকটা গেল কোথায়? কোন স্পর্ধায় সে যায়!

পিজারো বন্ধুকে ক্রীতদাসের পালানোটা সরকারি দপ্তরে জানিয়ে রাখতে বলেন, ধরতে পারলে যাতে ঠাণ্ডা করে দেয় মার দিয়ে।

মোরালেস হেসে বলেন, কী জানাব দপ্তরে? ও কি আমার সত্যিকার নিজের কেনা ক্রীতদাস! তোমরা হয়তো খেয়াল করোনি, মাত্র বছর দুয়েক লোকটি আমার কাছে কাজ করছে। আমার আগের ক্রীতদাস মারা যাবার পর তোক খুঁজছিলাম। হঠাৎ একদিন নিজে থেকেই এসে জানালে সে ক্রীতদাস। কিউবা থেকে পালিয়ে এসেছে গোরু-ভেড়ার জাহাজে লুকিয়ে। নামও বললে গানাদো। জানালে আমার কাছে গোলাম হয়ে থাকতে চায়। পালিয়ে-আসা ক্রীতদাস নতুন মহাদেশে অগুনতি আছে। নিজে থেকে তার সে কথা স্বীকার করাতেই অবাক হলাম। কেউ তা করে বলে আমার জানা নেই। কিউবায় গোলামদের ওপর অধিকাংশ মনিবের বাড়িতে অকথ্য অত্যাচার হয় আমি জানি। লোকটাকে দেখে পছন্দ হওয়ায় তাই এক কথায় নিয়ে নিলাম। সে জন্যে আফশোশ হয়নি কখনও। একদিনের জন্যে তার এতটুকু গাফিলি কি বেচাল দেখিনি। আজ যদি নিজের খুশিতেই চলে গিয়ে থাকে আমার নালিশ করবার কিছু নেই।

মোরালেস নালিশ করেননি কোথাও। কিন্তু তাঁর অত গুণের ক্রীতদাসের হঠাৎ তাঁকে ছেড়ে যাওয়ার কোনও কারণও খুঁজে পাননি। তাঁর কাছে কোনও রকম দুর্ব্যবহার সে তো পায়নি। লোকটির নিজস্ব একটা আত্মমর্যাদাবোধই ছিল। তাকে কোনও বিষয়ে সামান্য একটু ভৎসনাও করবার প্রয়োজন কখনও হয়নি। অতিরিক্ত পরিশ্রমও তাকে দিয়ে কখনও করিয়েছেন এমন নয়। নামে ক্রীতদাস হলেও বাড়ির লোকের মতোই তাকে দেখেছেন। তার এভাবে চলে যাওয়া সত্যিই একেবারে দুর্বোধ্য। যা আগে ভাবতে পারেননি সেরকম কোনও রহস্য লোকটির মধ্যে ছিল বলে মোরালেস-এর এতদিনে ক্ষীণ একটা সন্দেহ জাগে।

ঘনরামের হঠাৎ চলে যাওয়ার কারণ খুঁজে পাওয়া সত্যিই একটু কঠিন। মোরালেস-এর বাড়ির বৈঠকে লেখা পরিকল্পনা গোপনে সংশোধন করে তা ধরা পড়বার ভয়েই কি ঘনরামকে পালাতে হয়?

কারণটা খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না এই জন্যে যে তাঁকে মোরালেস বা আর কেউ ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করেননি। ধরা পড়বার অত ভয় থাকলে ওরকম কাজ তিনি করতে যেতেন কি?

নেহাত অহেতুক খেয়াল যদি না হয় তাহলে পানামা শহরে সম্মানিত এক অতিথি দম্পতির আসার সঙ্গে ঘনরামের নিরুদ্দেশ হওয়ার কোনও সম্পর্ক থাকা কি সম্ভব?

পানামায় গভর্নরের অতিথি হয়ে সত্যিই তখন কিছুদিনের জন্যে কেওকেটাদের একজন সস্ত্রীক এসেছেন বটে।

কিন্তু মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস আর তাঁর স্ত্রী যে মহলের লোক মোরালেস কি তাঁর বন্ধুরা সেখানে কল্কেই পান না। মোরালেস-এর ক্রীতদাসে সঙ্গে ওই রাজাগজাদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে?

সম্পর্ক কিছু না থাকুক গভর্নরের সাদা ঘোড়ার জুড়িগাড়িতে পানামার বাজারে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে একদিন সকালে মার্শনেস-কে হঠাৎ চমকে উঠতে দেখা গেছে।

কী হল? স্ত্রীর অকারণ চমকটা লক্ষ করে জিজ্ঞাসা করেছেন মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস।

কিছু নয় বলে মার্শনেস কথাটা চাপা দিয়েছেন। মুখে আর কিছু না বললেও মার্কুইস কিন্তু স্ত্রীর কৈফিয়তে সন্তুষ্ট হননি। দিন-তিনেক বাদে একদিন সকালে মার্শনেসকে কী খেয়ালে, অনেক আগেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়তে দেখা গেছে গাড়ি ডাকিয়ে!

গভর্নরের রাজকীয় অতিথিশালায় স্বামী ও স্ত্রীর ঘর পাশাপাশি। মার্কুইস যথাসমস্যা তৈরি হয়ে স্ত্রীর ঘরে এসে কাউকে দেখতে পাননি। মার্শনেস-এর পরিচারিকার কাছে খোঁজ নিয়ে স্ত্রীর অনেক আগে একা বেরিয়ে যাওয়ার খবর জানতে পেরেছেন।

মার্শনস কি কিছু বলে গেছেন?

হ্যাঁ, পানাম বন্দরের দিকটা দেখতে যাচ্ছেন এ কথা জানাতে বলে গিয়েছেন। মার্কুইস-এর তো এই ছেলেখেলার বন্দর দেখবার কোন আগ্রহ নেই। তাই তাঁকে ডেকে বিরক্ত না করে মার্শনেস একাই গেছেন।

কেউ দেখলে মার্কুইস বিরক্ত না হয়ে খুশিই হয়েছেন মনে করত তাঁর মুখের হাসি দেখে। হাসিটা শুধু সামান্য একটু বাঁকা।

সম্মানিত অতিথিযুগলের জন্যে বরাদ্দ করে রাখা পানামার হর্তাকর্তা ডন পেট্রো আরিয়াস দে আভিলা ওরফে পেড্রারিয়াস-এর দুধের মতো সাদা ঘোড়ার জুড়ি গাড়িটাকে পানামো বন্দরের দিকে যেতে সেদিন সকালে সত্যিই দেখা গেছে। গাড়িতে মার্শনেসই শুধু নেই।

একলা ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস শহর থেকে বন্দরে যাবার নির্জন পথেই মার্শনেসকে সেদিন দেখতে পেয়ে যেন চমকে গেছেন।

সে কী! তুমি এখানে দাঁড়িয়ে! তুমি গাড়ি নিয়ে বন্দর দেখতে গেছ শুনলাম!

হ্যাঁ, তাই যাব ভেবেছিলাম। সুন্দরী মার্শনেস বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে বলেছেন, হঠাৎ এই নির্জন জায়গাটায় নেমে একটু হাঁটতে ইচ্ছে হল।

হ্যাঁ, চমৎকার জায়গা। নামতে ইচ্ছে হবার মতো! মার্কুইস স্বীকার করেছেন, এদিকে জলাটার একটু পচা দুর্গন্ধ আর কাঁচা রাস্তাটা একটু এবড়ো-খেবড়ো, কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে ওরকম একটু-আধটু খুঁত অনায়াসে সহ্য করা যায়। আর নিজে না যাও, গাড়িটাকে পাঠিয়ে খুব ভালো করেছ। ঘোড়াগুলো বন্দর ঘুরে তো আসবে! ওই যে ফিরছে দেখছি।

গাড়িটা ফিরে এসে কাছে দাঁড়ালে সহিস এসে দরজা খোলার পর ঘোড়া থেকে। লাফ দিয়ে নেমে নিখুঁত আদবকায়দায় স্ত্রীকে হাত ধরে ভেতরে বসিয়ে দিয়ে আবার ঘোড়ায় চেপে গাড়ির পাশাপাশি যেতে যেতে যেন তুচ্ছ অবান্তর একটা কথা জানিয়েছেন মার্কুইস।

বলেছেন, তুমি অত সকাল সকাল বেরিয়ে গেছ দেখে আমিও একটা কাজ সেরে ফেললাম ওই অবসরে।

যে প্রশ্নটা এবার আসা উচিত তার জন্যে সামান্য কয়েক মুহূর্ত সময় দিয়েছেন মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস।

মার্শনেস সে প্রশ্ন করেননি। সামনের দিকে চেয়ে কীসের ভাবনায় যেন তিনি অন্যমনস্ক।

মার্কুইস নিজে থেকেই আবার নির্লিপ্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছেন, দপ্তরে গিয়ে পালিয়ে-আসা গোলামটাকে রাস্তায় যেন দেখেছি মনে হওয়ার কথা জানিয়ে এলাম। পরিচয়, চেহারার বর্ণনা দিয়ে নামটা যেন দাস ছিল তাও বলে এসেছি। গভর্নরের অতিথির মানে রাখতে কোথায় কার কাছে গোলামটা আছে ওরা ঠিক খুঁজে বার করবে। গোলামদের সব খবর লেখা একটা পাকা খাতাই ওদের আছে।

মার্শনেসকে আগের মতোই অন্যমনস্ক মনে হয়েছে। মুখটা একটু ফেরাননি, এমনকী একটা শব্দও তাঁর মুখে শোনা যায়নি।

গাড়িটা শুধু একটা গর্তের মধ্যে পড়েই বোধহয় একটু লাফিয়ে উঠেছে। মার্শনেস কেঁপে উঠেছেন নিশ্চয় তাতেই।

ঘনরাম দাসকে গভর্নরের মাননীয় অতিথি মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস-এর মতো লোকের পানামার পুলিসকে দিয়ে খোঁজাবার এত গরজ কীসের?

গভর্নরের অতিথির সম্মান রাখতে পুলিশ চেষ্টার ত্রুটি অবশ্য করেনি, কিন্তু মার্কুইস-এর বর্ণনার সঙ্গে মেলে এমন কারও সন্ধান পায়নি। তাদের পাকা খাতাতেও নামটা না থাক, ওরকম কোনও ক্রীতদাসের বিবরণ নেই। থাকার কথাও নয়, কারণ ঘনরাম মোরালেস-এর কাছে নিজে থেকে এসে যখন কাজ নিয়েছেন, মোরালেস পলাতক বলেই তার খবর দপ্তরে জানাননি। ঘনরাম নিরুদ্দেশ হবার পরও আগেকার মতোই নীরব থেকেছেন। সুতরাং নেহাত সামনাসামনি কেউ ধরিয়ে না দিলে পুলিসের পক্ষে ঘনরামের পাত্তা পাওয়া অসম্ভব।

হাতে হাতে কেউ ধরিয়ে দেবে এই ভয়েই কি ঘনরামকে একবেলার মধ্যে পানামা থেকে অমন নিরুদ্দেশ হতে হয়?

সামনাসামনি যে তাঁকে চিনে নির্জন একটি রাস্তায় দাঁড় করায় সে অবশ্য পুলিসকে জানাবার ভয়ই দেখিয়েছিল।

বলেছিল, নিয়তিকে এড়িয়ে পালানো যায় না, বুঝেছ? আমার চোখকেও ফাঁকি দিতে পারবে না। বলল এখন কী করব? পুলিশকে এখনই সব জানানো আমার উচিত নয় কি?

পুলিসের কছে ধরা পড়বার ভয় ঘনরামের জবাবে তখন খুব প্রকাশ কিছু পায়নি।

গোলামের পক্ষে অত্যন্ত অশোভনভাবে সোজা মার্শনেস-এর মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন, উচিত কাজ করতে কবে আপনি পেছপাও হয়েছেন, মার্শনেস!

মার্শনেস! আপনি!—হেসে উঠেছিল মার্শনেস।

মার্শনেস বলেই তো আরও আপনি। তা ছাড়া তুমি বলার ঘনিষ্ঠতা কোনওদিন আপনার সঙ্গে ছিল বলে তো মনে করতে পারছি না।—ঘনরামের মুখের হাসির দরুনই কথাটা তেমন তিক্ত মনে হয়নি।

চার হাজার মাইল দূরে চার মিনিটের দেখায় এসব কথা কাটাকাটির সময় নেই স। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে তীব্র স্বরে বলেছিল মার্শনেস, ভাগ্য যখন তোমায় আবার আমার হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে তখন আর আমি তোমায় ছাড়ব না এটুকু জেনে রাখো। অপরাধের জন্যে মাপ চেয়ে কান্নাকাটি করার মেয়ে আমি নই। আমার জন্যে তোমার যদি অশেষ দুর্গতি হয়ে থাকে তোমার জন্যেও আমি তার চেয়ে কম দুঃখ পাইনি।

একটু থেমে ঘনরামের চোখের দৃষ্টিটা লক্ষ করে আরও যেন জ্বলে উঠে মার্শনেস বলেছিল, এই ঐশ্বর্য এই বিলাস এই নাম এই সম্মান সৌভাগ্য এই যদি আমার সুখ বলে মনে করতাম তাহলে একটা ক্রীতদাসের সঙ্গে গোপনে কথা বলবার জন্যে যা আমার নেই সেই লজ্জার কথা বলছি না—অপরের মানসম্মান, নিজের অহংকার সব বিসর্জন দিয়ে এখানে ভিখিরির মতো দাঁড়িয়ে থাকতাম না। শোনো, দাস, তোমাকে আমার চাই। তুমি আমার জন্যে যা সয়েছ তার চেয়ে অনেক বেশি আমি সহ্য করতে প্রস্তুত। এ নতুন মহাশে বিরাট, বিশাল, সম্পূর্ণ অজানা। এখানে যদি আমরা স্বেচ্ছায় হারিয়ে যেতে চাই তাহলে সমুদ্রের বালির চড়ায় দুটো চিনির দানার মতো কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না কোনদিনও। আমরা হারিয়েই যাব সেই রকম। আজই সন্ধ্যায় তুমি তৈরি হয়ে আসবে। এখানে নয়।

বন্দরে যাবার নাম করে গাড়িটা সেখানে পাঠিয়ে তোমার জন্যে আমি এখানে নেমে দাঁড়িয়ে আছি। এখান দিয়ে বাজার থেকে তুমি ফেরো লক্ষ করেছি দু-দিন। আজ তোমার বাজারে যাবার আগেই তাই আরও ভোরে এসে অপেক্ষা করেছি এই ক-টা কথা বলব বলে। ভাল করে কথাগুলো শুনে নাও।

বন্দর থেকে নিকারাগুয়ার নতুন উপনিবেশে কাল ভোরে একটা ব্রিগানটাইন যাচ্ছে। গভর্নরের গাড়ির কোচোয়ানকে বকশিশ দিয়ে যেন আমাদের একজন অনুচরকে সস্ত্রীক সে জাহাজে পাঠাবার ব্যবস্থা ভাড়া দিয়ে করিয়ে রেখেছি। নিকারাগুয়া থেকে কোস্টারিকা কি ভেরাগুয়া যেখানে খুশি আমরা গিয়ে বাসা বাঁধতে পারব। কেউ আমাদের বাধা দিতে পারবে না।

আজ দুপুরে মার্কুইস গভর্নরের সঙ্গে শিকারে যাচ্ছে। আমার ওপর এর মধ্যেই। তার সন্দেহ হয়েছে, কিন্তু সন্দেহ যতই হোক, আমার সব কিছু বিসর্জন দিয়ে এ অকূলে ঝাঁপ দেওয়ার কথা তার মতো মানুষ ভাবতেই পারবে না। তাই আজ সটান আমাদের অতিথিশালায় তুমি আসবে সন্ধ্যার পর। তোমার আসার সব ব্যবস্থা আমি করে রাখব। যাও, আর এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে সাহস হয় না। শুধু কথা দিয়ে যাও, সন্ধ্যায় তুমি আসবে!

ঘনরামের চোখের দৃষ্টি কেমন অতল হয়ে উঠেছিল। শান্ত গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন, এতবড় সৌভাগ্য আমি পায়ে ঠেলতে পারি!

তাহলে এখনই গিয়ে তৈরি হও। গাঢ় স্বরে বলেছিল মার্শনেস, সারাজীবনের পাওয়ার আশা না থাকলে এতদিন বাদে এইটুকু পেয়ে নিজেই তোমায় ঠেলে সরিয়ে দিতে পারতাম না।

আর কিছু না বলে ঘনরাম বাজারের দিকেই চলে গিয়েছিলেন। মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস কিছুক্ষণ বাদে ঘোড়ায় চেপে এসে স্ত্রীকে এইখানেই পেয়ে কী বলেছিলেন আমরা জানি।

মার্কুইস আর যাই বুঝে ফেলে থাকুন, মার্শনেস যে বাজারে এক কসাই-এর দোকানে চকিতে একবার ঘনরামকে দেখবার পর থেকে তার গতিবিধির অতখানি খবর নিয়ে তার সঙ্গে সত্যি সত্যিই দেখা করতে সাহস করেছে আর দেখা হওয়ার আগেই অত বড় একটা দুঃসাহসিক ফন্দি সফল করবার নিখুঁত ব্যবস্থা করে ফেলেছে, এতখানি কল্পনা করতেও পারেননি।

নিশ্চিন্তভাবেই গভর্নর পেড্রারিয়াস-এর সঙ্গে নতুন মহাদেশের যা কুমির সেই কেম্যান শিকারে বেরিয়ে গেছেন।

তার মানে! ঘনশ্যাম দাস একটু দম নেবার জন্য থামতেই জিজ্ঞাসা করেছেন মেদভারে বিপুল ভবতারণবাবু, ঘনরাম ওই নিকারাগুয়ায় যাবার জাহাজে ওই মার্শনেস-এর সঙ্গেই পালিয়ে যান বলে পানামায় আর তাঁর পাত্তা পাওয়া যায় না?

এইটুকু আর বুঝতে পারেননি! কুম্ভের মতো উদরদেশ যাঁর স্ফীত সেই রামশরণবাবু বিস্ময় প্রকাশ করলেন ভবতারণবাবুর সরলতায়, ঘনরাম নিজেই কী বলেছিলেন, মনে নেই? এত বড় সৌভাগ্য কি আমি পায়ে ঠেলতে পারি।

হ্যাঁ, ঠিক ঠিক! রামশরণবাবুর বিচক্ষণতা স্বীকার করে ভবতারণবাবু বেশ একটু গর্বভরে বলেছেন, আমি কিন্তু ওই ছুঁড়িটাকে বুঝে ফেলেছি!

ভাষা! ভাযা সামলান, ভবতারণবাবু! শিবপদবাবু সাবধান করেছেন—কাকে কী বলছেন! উনি মার্শনেস, সে খেয়াল আছে! মার্শনেস কি মার্কুইস-এর মর্যাদা কত ধাপ ওপরে তা জানেন কিছু? আর্ল আর ডিউকের মাঝামাঝি।

তার মানে পদ্মভূষণ গোছের! সরলভাবে বলেছেন যাঁর উদরদেশ কুম্ভকে লজ্জা দেয় সেই রামশরণবাবু, ওই পদ্মশ্রী আর পদ্মবিভূষণের মাঝখানে।

না, না, ওসব শূন্যলোকের ত্রিশঙ্কু গোছের কিছু নয়। শিবপদবাবু ব্যাখ্যা করে বোঝাবার এ সুযোগ ছাড়েননি—তখনকার দিনে বেশ শাঁসালো না হলে ওই আর্ল, মার্কুইস, ডিউক আর মার্শনেস, ডাচেস কেউ হত না। বনেদি বড় ঘর বড় ঘরোয়ানা, অগাধ বিষয়সম্পত্তি, নিদেনপক্ষে দেশের মানে সম্রাটের জন্যে দারুণ কোনও কীর্তির জন্যেই এ সম্মান সম্রাট অনুগ্রহ করে বিতরণ করতেন। মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস এইরকম একটা মস্ত কেউ না হলে ওই বয়সে ও খেতাব পেতেন না। বয়স তো যা শুনলাম তাতে খুব বেশি মনে হচ্ছে না। তবে হ্যাঁ, পৈতৃক খেতাব হতে পারে!

দাসমশাই নীরবে ঈষৎ হাস্যকুঞ্চিত মুখে সভাসদদের আলোচনা শুনছিলেন, এবার নিজের টীকা যোগ করে বলেছেন, না, পৈতৃক নয়, স্বােপার্জিত খেতাব! স্বয়ং সম্রাট পঞ্চম চার্লস-এর কাছেই পাওয়া। তাও স্পেনে নয়, ইটালিতে। সম্রাট নিজের দেশ স্পেনের চেয়ে সেখানে থাকাটা বেশি পছন্দ করতেন আর একটু ফাঁক পেলেই হুট করে গিয়ে হাজির হতেন। সম্রাটের মেজাজ-মর্জি তখন একটু বেশি খুশি ছিল। পাভিয়ার যুদ্ধে তাঁর জন্মশত্রু ফ্রান্সের রাজাকে শুধু হারাননি, বন্দি পর্যন্ত করেছেন। সেই সঙ্গে জার্মানির সিংহাসনও তাঁর অধিকারে এসেছে। অনেকেরই ধারণা, সম্রাটকে এই দিলদরিয়া মেজাজে ইটালিতে গিয়ে ধরার কৌশলেই গঞ্জালেস আর্লগিরি ডিঙিয়ে একেবারে মার্কুইস হয়ে ওঠেন। শুধু যে সম্রাট নিজে খোশমেজাজে ছিলেন তা নয়, তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে বিজ্ঞ বিচক্ষণ মন্ত্রী বা সভাসদদের কেউ ছিলেন না। হাতের কাছে উলটে দেখবার মতো দপ্তরের কাগজপত্র নেই, তার ওপর খাইয়েদাইয়ে তোয়াজ করে বশ করা সম্রাটের খোশামুদে মোসায়েবদের সুপারিশে সম্রাট ঝোঁকের মাথায় উদার হয়ে দরাজ হাতে অতবড় খেতাবটা দিয়ে ফেলেছেন। সত্যি কথা বলতে গেলে, নতুন মহাদেশ সম্বন্ধে তখন বিশেষ কিছুই খবর তিনি রাখেন না, রাখার প্রয়োজনও বোধ করেননি।

অত হাঁকডাক সত্ত্বেও নতুন মহাদেশ থেকে যা এ পর্যন্ত পেয়েছেন, আশাটা বড় বেশি ফাঁপানো ছিল বলেই তা আহামরি কিছুনয় বলে মনে হয়েছে। কর্টেজ মেক্সিকো জয় করে যা পাঠাচ্ছেন, তাতে তবু নতুন মহাদেশের একটু যা মান বেঁচেছে। নইলে স্পেন ফ্রান্স জার্মানি আর ইতালির অধিকার নিয়ে ইউরোপই তাঁর কাছে বেশি দামি। খানিকটা খোশ মেজাজে আর কিছুটা হেলায় ছেদ্দায় অনুগ্রহটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কি না তিনি খেয়ালই করেননি। ভাবতেই পারেননি যে, একদিন তাঁর খেয়ালের ফলে কোথাকার জল কোথায় পর্যন্ত গড়াবে, আর তার কেলেঙ্কারি মুছে ফেলতে সরকারি মহাফেজখানার হাড়ে দুর্বো গজাবার অবস্থা হবে কতখানি।

কিন্তু—ওই কী বলে, মনের মতো সম্বোধনটা কোনওরকমে একেবারে জিভের ডগায় রুখে দিয়ে ভবতারণবাবু বলেছেন, ওই মার্শনেস মেয়েটাকে কিছু বোঝা গেল না কিন্তু। যাই হোক, সময়মতো ঘনরামকে ঠেলে বিদেয় করে দিয়েছিল এই ভাগ্যি। নইলে ওই মার্কুইস গঞ্জালেস একবার হাতে পেলে জ্যান্ত ছাল ছাড়িয়ে নিত বলেই তো মনে হয়।

সত্যি জ্যান্ত ছাল ছাড়িয়ে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু মার্কুইস নয়, আর-একজন। বলেছেন শ্রীঘনশ্যাম দাস, আর মার্শনেস সাবধান করে না দিলেও ধরা দেবার জন্য ঘনরাম ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতেন না। কারণ মার্কুইস আর মার্শনেসকে এর আগেই দেখে তিনি চিনে রেখেছেন। মার্শনেস যেদিন বাজার দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে ঘনরামকে দেখেন, সেদিন অবশ্য নয়।

তখনও পর্যন্ত পানামার গভর্নরের মাননীয় অতিথি আসবার গুজব তিনি রাস্তায় বাজারে শুনেছেন মাত্র। বিদেশবিভুয়ে ছোট জায়গায় যেমন হয়, মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস সম্বন্ধে অতিরঞ্জিত কিছু গল্পও তখন পানামায় চাউর হয়েছে। মস্ত নাকি তিনি বীর। ফ্রান্সের রাজার সঙ্গে যুদ্ধে, না কর্টেজ-এর সঙ্গে মেক্সিকো অভিযানে অসাধারণ বীরত্ব দেখিয়ে সম্রাটকে একেবারে মুগ্ধ করে হঠাৎ এই খেতাব পেয়েছেন।

ফ্রান্সের রাজার সঙ্গে পাভিয়ার যুদ্ধের কথা ঘনরাম কিছু জানেন না, কিন্তু কর্টেজ-এর অভিযানে অতবড় কীর্তি কেউ করলে তাঁর নাম ঘনরামের অজানা থাকবার কথা নয়। গঞ্জালেস দে সোলিস বলে কাউকে তিনি স্মরণ করতে পারেননি।

মার্কুইস কোন কীর্তির জোরে এমন হাউই-এর মতো উঠেছেন ঘনরাম তা নিয়ে অবশ্য মাথা ঘামাননি। মার্কুইসের পত্নীভাগ্যও যে অসাধারণ, তাঁর স্ত্রী মার্শনেস নাকি অপরূপ সুন্দরী, এ-রটনাও উনি শুধু কান দিয়ে শুনেছেন মাত্র।

প্রথম দিন গভর্নরের সাদা জোড়াঘঘাড়ায় টানা গাড়ি রাস্তা দিয়ে চলে যাবার পর তাঁর সেদিকে দৃষ্টি পড়েছিল। যে-কসাই-এর কাছে মোরালেস-এর জন্যে মাংস কিনতে গেছলেন, সে-ই আঙুল তুলে একটু উত্তেজিতভাবে বলেছিল, ওই যে, গভর্নরের খাস গাড়িতে মার্কুইস আর মার্শনেস যাচ্ছেন।

ঘনরাম তখন সামনের দিকেই ফিরে দাঁড়িয়ে কসাইকে দেবার পেসোটা গুণছিলেন। মুখ তুলে যখন তিনি তাকিয়েছিলেন তখন গাড়িটা বেশ দূরেই চলে গেছে। মার্কুইস আর মার্শনেস-এর পিঠের দিকই তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। না, মার্শনেস-এর ঠিক পিঠ নয়। কারণ সেই তিনি সবে পেছন দিকে কী যেন দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে নিচ্ছেন।

ওই চকিতে ঘুরিয়ে নেওয়া মুখ দেখে ঘনরাম চিনতে কাউকে অবশ্য পারেননি। চিনেছেন সেইদিনই বিকেলবেলা গাড়িটা আবার বাজার দিয়েই যাবার সময়। গাড়িতে মার্শনেস তখন একা। তিনি যে বেশ উদগ্রীব হয়ে রাস্তার পাশের দোকানগুলি লক্ষ করতে করতে যাচ্ছেন, তা দূর থেকেই ঘনরামের নজরে পড়েছে। এবার চিনতে তাঁর দেরি হয়নি।

গাড়িটা তাঁর পাশ দিয়ে পার হয়ে যাবার সময় ইচ্ছে করেই মুখ নিচু করে তিনি হেঁটেছেন। চোখ নীচের দিকে নামানো থাকা সত্ত্বেও মার্শনেস-এর দৃষ্টিটা তিনি যেন সমস্ত শরীরে অনুভব করেছেন।

সে-দৃষ্টির অর্থটা শুধু ঠিকমতো বুঝতে পারেননি।

বুঝতে পারলে তিনি কি কিছু করতেন?

আরও বেশি সাবধান হতেন কি?

না, আর সাবধান কী হবেন! মার্কুইস মার্শনেসকে চেনার পর থেকেই তিনি যথেষ্ট হুঁশিয়ার হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের গাড়ির সামনে আর তারপর পড়েননি একবারও।

তবু মার্শনেস তাঁকে সত্যিই বিস্মিত করে দিয়ে পথের মাঝখানে অপ্রত্যাশিতভাবে ধরেছেন।

মার্শনেস-এর সেদিনকার দৃষ্টিটার ঠিকমতো অর্থ বুঝলে ব্যাপারটা তাঁর কাছে। অপ্রত্যাশিত থাকত না, এই যা।

মুখে প্রকাশ করুন বা না করুন এই অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ আর মার্শনেস-এর নিজের হৃদয় যেন নিরাবরণ করে মেলে ধরা তাঁকে যে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে, ঘনরামের প্রায় অভিভূত আচ্ছন্নের মতো বাজার থেকে মোরালেস-এর বাড়িতে ফিরে যাওয়া লক্ষ করলেই তা বোঝা যেত।

বাড়িতে ফিরেই চলে যাবার জন্যে তৈরি হতে তাঁর বেশিক্ষণ লাগেনি। কেনই বা লাগবে? সঙ্গে নেবার মতো কোনও সম্পদ তো ক্রীতদাসের থাকে না। মোরালেস-এর কোনও কিছু নিজের প্রয়োজনে না বলে ঋণ হিসেবেও সঙ্গে নিয়ে যাবেন, ঘনরামের শিরায় সে রক্ত বয় না।

ছেড়ে যেতে মোরালেস-এর জন্যে একটু বিষণ্ণ সহানুভূতি অনুভব করা ছাড়া আর কোনও কষ্টই হয়নি।

১৫২১ খ্রিস্টাব্দে একদিন নিজে থেকে যেচে মোরালেস-এর কাছে দাসত্ব স্বীকার করেছিলেন ঘনরাম। ১৫২৩-এর একটি বিশেষ দিনে তিনি নিজেই আবার একেবারে নিঃশব্দে চলে গেছেন।

তাঁর চলে যাওয়ার দিনটি মনে রাখবার মতো বিশেষ ঠিকই, কিন্তু কার কাছে?

তাঁর নিজের ও মার্শনেস-এর তো বটেই, আর-একজনের কাছেও।

সেই বিশেষ দিনটিতে মার্কুইস কিন্তু পানামায় ছিলেন না। সত্যিই সেদিন দুপুরেই গভর্নর পেড্রারিয়াস-এর সঙ্গে তিনি শহর থেকে দূরের জংলা জলায় শুধু ও-দেশের কুমির, কেম্যান বা অ্যালিগেটর নয়, ও-দেশের গুলবাঘা চিতা, জাগুয়ার শিকারে গেছলেন। ফিরেছিলেন দিনতিনেক বাদে বেশ ক-টা কুমিরের চামড়া আর জাগুয়ারের ছাল নিয়ে।

অতিথিশালায় ঢুকে নিজের কামরায় যাবার পথে সত্যিই বিহ্বল হয়ে তাঁকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়েছিল।

সামনে জঙ্গলের জাগুয়ারের চেয়ে অনেক গুণ হিংস্র আরও এক ভয়ংকর বাঘিনী মূর্তিই যেন দেখেছেন।

প্রায় উন্মাদিনীর মতো মার্কুইস-এর কাছে ছুটে এসে তাঁর জামার আস্তিন ধরে প্রায় টেনে ছিঁড়ে ফেলে মার্শনেস তরল আগুনের মতো গলায় বলেছেন, এখন তোমার আসবার সময় হল! তিন দিন তুমি বাইরে কাটিয়ে এলে!

দাঁড়ান! দাঁড়ান! সমস্বরে দাসমশাইকে থামিয়ে বলে উঠলেন শিবপদ আর রামশরণবাবু, তার মানে ঘনরামের সঙ্গে মার্শনেস সেই নিকারাগুয়ার জাহাজে চড়ে পালাননি? তিনি পানামাতেই থেকে গেছেন?

আমি তখনই বলেছিলাম না, ভবতারণবাবু নিজেকে তারিফ করেছেন, যে ওই ছুঁ–থুড়ি, মার্শনেসকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেছল তো মেয়েটা?

না, মার্শনেস পিছিয়ে যায়নি। দাসমশাই রহস্যটা উদঘাটন করে বলেছেন, ঘনরামই কথামতো সেদিন সন্ধ্যায় অতিথিশালায় আসেননি। মার্শনেস তখন সাধারণ দরিদ্র এসপানিওল মেয়ের সাজপোশাকে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করেছেন নিজের ঘরে। নিজের পরিচারিকাকে নির্দেশ দেওয়া আছে, কেউ খুঁজতে এলে তাঁদের অনুচরদের মহলে যেন তাকে বসিয়ে রেখে তাঁকে খবর দেওয়া হয়। অন্য অনুচরদের বকশিশ দিয়ে সেদিন সন্ধ্যার মতো ছুটি দেওয়া হয়েছে। স্বয়ং মার্কুইসই শিকারে চলে গেছেন, সুতরাং এ-বদান্যতা অস্বাভাবিক কিছু মনে হবার কথা নয়। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে প্রহরের পর প্রহর বেড়েছে। গভর্নরের অতিথিশালায় মার্শনেসকে খুঁজতে কেউ আসেনি।

সারারাত জেগে কাটিয়েছেন মার্শনেস, জেগে আর নিজের ঘরে অস্থিরভাবে পায়চারি করে।

সকাল হতে না হতেই কোচোয়ানকে গাড়ি আনতে হুকুম পাঠিয়েছেন।

সে গাড়ি নিয়ে বন্দর পর্যন্ত গেছেন প্রথমেই। খবর নিয়ে জেনেছেন কিছু গোলমালের দরুন শেষ রাত্রে, মাত্র কিছুক্ষণ আগে সকাল হবার পর সে জাহাজ ছেড়েছে। সে জাহাজে যাদের যাবার ব্যবস্থা তিনি করিয়েছিলেন, তারা কেউই কিন্তু আসেনি।

না, কেউই না। কোচোয়ান ভাল করে তাঁর নির্দেশমতো জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনে এসে খবর দিয়েছে, দু-জন যাত্রীর কেউ ভাড়া দিয়ে রাখা সত্ত্বেও জাহাজে আসেনি।

মার্শনেস তারপর আর-এক নির্জন পথের ধারে গিয়ে বহুক্ষণ অপেক্ষা করেছেন। সেইখানেই ঘনরামের দেখা পেয়েছিলেন আগের দিন সকালে।

সেখানে অপেক্ষা করা বৃথা হয়েছে। এরপর বাজারে গিয়ে ঘুরে আসা নিরর্থক। তবু তাই গেছেন। তারপর অপ্রকৃতিস্থর মতো গাড়ি নিয়ে সমস্ত পানামা শহর অকারণে ঘুরে বেড়িয়ে গাড়ির সহিস কোচোয়ানকেও একটু ভাবিত করে তুলেছেন।

এ ছাড়া মার্শনেস-এর করবারই বা কী আছে। পানামা ছোট শহর, এখনও গোনাগুনতি তার রাস্তা আর বসতি। কিন্তু সেই শহরের দরজায় দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিয়ে একজন ক্রীতদাসের খোঁজ তো তিনি করতে পারেন না।

হ্যাঁ, একটা কাজ পারেন বটে!

কথাটা মনে হওয়ামাত্র মার্শনেস সরকারি কোতয়ালি দপ্তরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।

তাঁকে দেখে স্বয়ং কোতোয়ালও যে ভড়কে গিয়েছেন, তা বলাই বাহুল্য। স্বয়ং গভর্নর পেড্রারিয়াস-এর চেয়ে বেশি সন্ত্রস্ত খাতির পেয়েছেন মার্শনেস।

কিন্তু মার্শনেস তো খাতির পাবার জন্যে আসেননি। তিনি যে কারণে এসেছেন, তীব্র জ্বলন্ত স্বরে তা জানিয়েছেন।

সমস্ত দপ্তর ভীতত্রস্ত হয়ে তাঁকে জানিয়েছে যে, মার্কুইস একজন দেশ-থেকে পালানো গোলামের খবর আর বর্ণনা দিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু তিনি যা পরিচয় আর বর্ণনা দিয়েছেন, পানামা শহরে সেরকম কোনও ক্রীতদাসের খোঁজ আপ্রাণ চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

পাওয়া যায়নি আপনাদের গাফিলতি আর অকর্মণ্যতায়।—মেঝের ওপর জুতোর গোড়ালি ঠুকতে গিয়ে মার্শনেস-এর সুঠাম পায়ের গোছ একটু দেখা গেছে— একটা গোলামকে সমস্ত বর্ণনা পেয়েও এই এতটুকু পানামা শহর থেকে আপনারা খুঁজে বার করতে পারেন না, তাকে স্পষ্ট আমরা এই শহরের রাস্তায় দেখেছি বলা সত্ত্বেও? পানামা থেকে আপনাদের পাহারা সজাগ থাকলে পালিয়েই বা সে কোথায় যেতে পারে!

নগর-কোতোয়াল নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করেছেন। জানা থাকলে তিনি হয়তো জবাব দিতে পারতেন যে, এই নতুন মহাদেশ অজানা বিরাট বিশাল। এখানে কেউ হারিয়ে যেতে চাইলে সমুদ্রের চড়ার বালিতে একটা চিনির দানার মতো তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

মার্শনেস-এর সব বকুনি শাসানি শেষ হবার পর দপ্তরের সবাই নিজেরাই ক্রীতদাসের মতো নিচু হয়ে জানিয়েছে যে, নেহাত পাখি হয়ে উড়ে বা মাছ হয়ে ড়ুব-সাঁতারে যদি না পালিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে মার্কুইস ও মার্শনেস-এর গোলামকে জ্যান্ত বা মরা তারা দু-দিনের মধ্যে হাজির করবেই।

দু-দিনের একদিন বাদে মার্কুইস শিকার থেকে ফিরে মার্শনেস-এর ওই রূপ দেখেছেন।

প্রথমে স্ত্রীর উন্মত্ত প্রলাপের অর্থ কিছু বুঝতে না পেরে একটু পরিহাসের চেষ্টা করেই বলেছেন, তিনদিনটা বড় বেশি তাড়াতাড়ি কেটে গেল মনে হচ্ছে বুঝি!

থামো! গর্জনে মার্শনেস-এর মধুর কণ্ঠও কর্কশ হয়ে উঠেছে, এ হাসি-ঠাট্টার ব্যাপার নয়। জানো, তুমি এখানে নেই বলেই সেই শয়তানটা পানামা ছেড়ে পালিয়েছে। তাকে এমন পালাবার সুবিধেই যদি দেবে, তাহলে কী দরকার ছিল দপ্তরে গিয়ে তার কথা জানাবার! কী দরকার ছিল?

প্রথমটা একটু বিমূঢ় হলেও মার্শনেস কার বিষয় নিয়ে ক্ষিপ্ত তা বুঝতে মার্কুইস-এর দেরি হয়নি।

এতক্ষণে ব্যাপারটা মনে মনে উপভোগ করতে শুরু করে মার্কুইস দৃষ্টিতে উপহাসের ঝিলিকটা গোপন না করেই জিজ্ঞাসা করেছেন, সে-শয়তান যে পালিয়েছে তা তুমি জানলে কী করে?

জানলাম, জানলাম, মার্শনেস সামান্য একটু থতমত খেয়ে বলেছেন, জানলাম কোয়ালি দপ্তরে গিয়ে। তারা এখনও সে-শয়তানের কোনও পাত্তাই পায়নি। চেষ্টাই কিছু করেনি বলে আমার ধারণা।

তাহলে চেষ্টা করলেই পাবে, উদাসীনভাবে বলেছেন মার্কুইস।

কথার খোঁচা বোঝবার মতো অবস্থা তখন মার্শনেস-এর নয়। তীব্রস্বরে তিনি বলেছেন, সেই চেষ্টা তাদের দিয়ে করাতেই হবে। তুমি যদি না পারো তো আমি নিজে গভর্নরকে বলব। যেমন করে তোক সে-বদমাশকে ধরে আনা চাই-ই।

আনলে কী করবে কী? একটু বাঁকা হাসির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছেন মার্কুইস।

কী করব! মার্শনেস যেন যন্ত্রণার মতো তীব্র আক্রোশে বলেছেন, জ্যান্ত তার গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নেব নিজের হাতে।

ই, মার্কুইস-এর কথাটা মনে ধরেছে, তাহলে যেগুলো এত কষ্টে শিকার করে আনলাম, সেই কুমিরের চামড়া আর জাগুয়ারের ছালগুলো তো বাতিল করে দিতে হয়।

এ-বিদ্রূপটা বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়েছে। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে মার্কুইস-এর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে মার্শনেস ছুটে আবার তাঁর নিজের কামরায় গিয়ে ঢুকে সশব্দে খিল দিয়েছেন।

কয়েকদিন বাদে গভর্নর পেড্রারিয়াস তাঁর মাননীয় অতিথিদের সসম্মানে বিদায় দিয়েছেন।

কোতোয়ালি দপ্তর দাস নামের কর্ডোভার মূর-রক্ত-মেশানো ক্রিশ্চান-হওয়া বংশের অভিজাতদের মতো ঈষৎ শ্যামল এক সুপুরুষ ক্রীতদাসের তখনও কোনও খোঁজ পায়নি।