• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

পুনশ্চ পাঠ – আবদুল মান্নান সৈয়দ

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » প্রবন্ধ » পুনশ্চ পাঠ – আবদুল মান্নান সৈয়দ

১.
চল্লিশের কবিতা…মডেল হিসেবে অক্লেশে গ্রহণ করে নিল রবীন্দ্রনাথের প্রত্যন্ত বয়সের গভীরতর, বোধদীপ্ত উচ্চারণ, নজরুলের আবেগদৃপ্ত গুণমুখিনতা, তিরিশের কবিতার যুগবর্তী মনোভাব প্রকাশের উপযোগী আধুনিক প্রকরণ, কৃেকৗশল। কবিতাকে একই সঙ্গে ব্যক্তিগত অথচ সামাজিক, জটিলতায় অপেক্ষাকৃত আধুনিক অথচ জনমনগ্রাহ্য করে তোলার এই দুঃসাধ্য সাধনা ছিল চল্লিশ-দশকী কবিদের।—মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়: ‘বাংলা প্রগতি কাব্য: আদি-মধ্য-বর্তমান’, ঐকতান, ২:২। ১৯৮৯।
২.
আমরা তখন ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক সংঘের বার্ষিকী ক্রান্তির জন্য নানা জায়গায় চিঠি লিখছি। এমন সময় আবার একটা খাম পেলাম। সুকান্ত কবিতা পাঠিয়েছে। কবিতাটির নাম ‘অনুভব’, যা ‘অবাক পৃথিবী’ নামে খ্যাত। আদর করে কবিতাটি ছাপালাম ক্রান্তিতে, কিন্তু তখনো পুরোপুরি বুঝতে পারিনি এই কবিতার মধ্যে বাংলা বিপ্লবী গণমুখী কবিতার এযাবত্কালের সংসারকে অপসারিত করে দিয়ে গিয়েছে সে, হয়তো আরও নতুন নতুন কবিতার আশায় ছিলাম বলেই ‘অনুভব’ কবিতার মহাকাব্যিকতাকে তখন উপলব্ধি করতে পারিনি।—রণেশ দাশগুপ্ত: ‘এক ঝলক দেখেছিলাম’, সুকান্তসমগ্র: বদরুদ্দীন উমর-সম্পাদিত।
৩.
চল্লিশের সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং সমর সেনকে সামনে রেখে সে-যুগে কম হইহল্লা হয়নি। পরে একটা সময় এসেছিল যখন বিমলচন্দ্র ঘোষ এবং সুকান্তকে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় কবি বলে প্রগতিশীলেরা বেশ কিছুটা হইচই বাধান। গোবিন্দচন্দ্র দাস অথবা নজরুল, জীবনানন্দ দাশ অথবা বিষ্ণু দে-কে তাঁদের চোখেই পড়েনি। বেচারা রবীন্দ্রনাথ!—বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সাক্ষাত্কার, নান্দীমুখ-গৃহীত। আগুন হাতে প্রেমের গান: অনিল আচার্য-সম্পাদিত।

১৮ শ্রাবণ ১৪১৭ সকাল
কল্যাণীয়াসু,
গতকাল সকালে ছিল মুষলধারে বৃষ্টি। যেন কেউ বিশাল একটি শাদা চাদর মেশিনে বুনে চলেছে, এমন। সোজা সরলরেখায় এ বৃষ্টি—রানু ঘুম থেকে উঠেই লক্ষ করেছিল। শাওনী বৃষ্টি দেখে খুশি হয়েছিলাম খুব, আবার একটু চিন্তাও ছিল—বেরোতে হবে বলে। পরে বৃষ্টি থেমে যায়। বেরিয়েছিলামও। আজ সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ব্যালকনিতে দেখলাম, দূর তরুশীর্ষে কাঁচা সোনার বরন রোদ। আর মৃদু অতিমৃদু বাতাস। সকালবেলা সোনারঙের রোদ দেখে আর বোধহয় কারও কোমল করাঙ্গুলিতে স্পর্শ-করে-যাওয়ার মতো বাতাসে মন আমার কী-যে খুশি হয়ে উঠল। গতকাল আলসে-বিলাসে পার করেছি দিনটি। কয়েক দিন ধরে তোমার সঙ্গে গল্প করছি যাঁকে নিয়ে—সেই সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬—৪৭)—তাঁকে নিয়ে আমার সাম্প্রতিক পুনর্বিবেচনা পেশ করতে চাই তোমার সমীপে। আসলে বোধহয় বছর দশেক আগে-লেখা (তারিখহীন) দু-তিন পৃষ্ঠার সুকান্ত প্রসঙ্গিত একটি নোট পেয়ে গিয়ে সেটাকে শোধিত-বর্ধিত-মার্জিত করে কবির প্রতি আমার শ্রদ্ধানিবেদন করতে চাই। ৩৫ বছরেরও আগে—তোমার তো জন্মই হয়নি তখন, কাজেই তুমি জানবে কী করে?—১৯৭৩ সালে লিখেছিলাম দৈনিক বাংলায় সুকান্ত সম্পর্কে আমার তত্কালীন বিবেচনা। আমার নির্ভর ছিল বদরুদ্দীন উমর-সম্পাদিত সুকান্তসমগ্র। সে-লেখা আছে আমার একটি অধুনালুপ্ত প্রবন্ধগ্রন্থে। তার সঙ্গে মিলিয়ে যদি দ্যাখো, তাহলে সুকান্ত সম্পর্কে আমার তখনকার ভাবনা-ধারণাকে মিলিয়ে নিতে পারবে। আমার কৈশোরে, যখন ঢাকা কলেজে পড়ি—তখন সুকান্তের কবিতায় আত্যন্তিক বিরোধিতা বোধ করতাম। আমি ছিলাম কবিতায় অকল্মষ রোমান্টিকতার পক্ষপাতী। সেই কৈশোরে দুজন কবি—নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশ আমাকে আমূল অধিকার করে ছিলেন তাঁদের চিত্র-চিত্রকল্পজয়ী কবিতায় কবিতায়।
এই পত্র রচনার সময় ইচ্ছা করেই আমার প্রায় চার দশক আগে-লেখা সুকান্তপ্রাসঙ্গিক প্রকল্পটি দেখতে চাই না—পাছে তার দ্বারা কোনোরকম উদ্বোধিত-প্রভাবিত-প্ররোচিত হই। ভণিতাটুকু এ জন্যও—সে কি তোমাকে আর নতুন করে বলতে হবে?—রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘অপবিত্র ও কর-পরশ সঙ্গে ওর হূদয় নহিলে।’
…তোমাকে-লেখা এই পত্রের শিরোদেশে স্থাপিত উদ্ধৃতিত্রয় একটু মনোনিবেশে পড়ে দ্যাখো। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের কবিতা সম্পর্কে যত পর্যালোচনা চোখে পড়েছে আমার, তার মধ্যে মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের এই মন্তব্য সবচেয়ে লক্ষ্যভেদী। জানো তুমি, বিংশ শতাব্দীর এই চল্লিশের দশকটি ছিল সবচেয়ে সংরক্ত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, বাংলার মন্বন্তর, ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, দেশবিভাগ ইত্যাদিতে টলমল করছিল ভারতবর্ষ। চল্লিশের দশকটি আরম্ভ হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে, আর শেষ হয়েছিল ১৯৫০ সালের ভ্রাতৃঘাতী হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায়।
মানুষ অপরাজেয়, এবং বাঙালিও অপরাজেয়—তার সাক্ষ্য দেবে তখনকার তরুণ বাঙালির কবিতাবলি। অন্যান্য সাহিত্যকর্মও, চিত্রকলাও। জয়নুল আবেদিন, সোমনাথ হোর, চিত্তপ্রসাদ—এমনকি ‘ক্যালকাটা গ্রুপে’র নীরদ মজুমদার এঁদের গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকে অংশীদারি জানিয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিবাদ উত্থাপিত হচ্ছিল গণসংগীতের নবজন্মে, প্রতিবাদী নাট্যধারায়, গল্পে-উপন্যাসে তো বটেই। সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল কবিতা আর চিত্রকলা। অগণন কবির ভেতরে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের নাম করি তোমাকে—সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, আহসান হাবীব, গোলাম কুদ্দুস, দিনেশ দাস, রাম বসু, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায়, ফররুখ আহমদ, বিষ্ণু দে, অরুণ মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সানাউল হক, সৈয়দ নূরুদ্দীন, বিমলচন্দ্র ঘোষ, সিকান্দার আবু জাফর, আবুল হোসেন, সিদ্ধেশ্বর সেন প্রমুখ। ছিলেন আরও অনেকে।
এই তালিকায় লক্ষ করবে নরেশ গুহ, অরুণকুমার সরকার, বিশ্ব বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ একেবারেই ব্যক্তিগত কবিতা লিখে গেছেন। দোষ দিতে পারি না তাঁদের। এই সময়ে কি নারী-পুরুষ প্রেম করেনি? শ্রাবণ-আকাশে বৃষ্টি ঝরেনি? সব বৃক্ষের সবুজ কি পিঙ্গলবর্ণ হয়ে গিয়েছিল? বিশেষত, নরেশ গুহ ও অরুণকুমার সরকার উত্কৃষ্ট ব্যক্তিগত কবিতা লিখেছেন।
তিরিশের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ কবিকে তাঁদের আত্মবলয়ের বাইরে এনে ফেলেছিল এই কাল। বিষ্ণু দে-র কবিতা চিরকালের মতো পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। বিষ্ণু দে-র সন্দ্বীপের চর, জীবনানন্দের সাতটি তারার তিমির, সুধীন্দ্রনাথের সংবর্ত, অমিয় চক্রবর্তীর অন্নদাতা অন্ন দাও প্রভৃতি গ্রন্থ ও পুস্তিকা। ‘আমার সাগরে জেগেছে ঊর্মি’র কবি, স্বদেশি মন্ত্রে দীক্ষিত কবি বেনজীর আহমদ বাঙালি-মুসলমান তিরিশের কবিদের একজন ‘ব্ল্যাকআউটে’র মতো কবিতা লিখেছিলেন চতুরঙ্গে। ওই সময়েরই মহীউদ্দীনের মতো নৌশ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কবি নিঃশব্দ থাকতে পারেননি।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের কাব্যালোচনা করতে বসে চল্লিশ-দশকী কবিদের কথা সাতকাহন করে বলছি এ জন্যও যে পটভূমি-ও-পরম্পরা ব্যতীত কাব্যালোচনা, বিশেষত সুকান্তের মতো সমকাললিপ্ত কবির, বৃথা হতে বাধ্য।
দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি লক্ষ করো এবার। রণেশ দাশগুপ্তের সুকান্ত সম্পর্কে ২ পৃষ্ঠার ছোট্ট লেখাটি থেকে প্রমাণিত হয়, মূলত উপন্যাস-সমালোচক হলেও কবিতায় গভীর অন্তঃপ্রবেশ ছিল তাঁর। সুকান্তের ‘অনুভব’ কবিতা সম্পর্কে তিনি যে-উক্তি উচ্চারণ করেছেন, ‘মহাকাব্যিকতা’, আজ সুকান্তের প্রয়াণের ৬৩ বছর পরে সমগ্রভাবেই তো সুকান্তকে মনে হচ্ছে এক মহাকাব্যিকতারই কবি। দেশ-কাল কত পৃথক হয়ে গেছে, সুকান্তের কবিতার অন্তর্গত বাণীবিভূতি কিন্তু সমান জ্বলজ্বলে। একফোঁটা জং ধরেনি।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চল্লিশ-দশকী আরেকজন কবি-সম্পাদক-সংগঠক—যিনি আক্ষরিক অর্থে অবহেলিত। তিনি নিজে প্রকৃতার্থে বামবিশ্বাসী কবি—তাঁর কাব্যবিবেচনাও কতখানি শান্ত, স্বচ্ছ, স্থির, গভীর ও প্রযুক্ত হতে পারে, তাঁর একটি সাক্ষাত্কার থেকে উত্কলিত পত্রশিয়রে অংশটি আরেকবার পড়লেই বুঝতে পারবে।
মুশকিল হয়েছে, সুকান্তকে নিয়ে আত্যন্তিক প্রশংসার তোড়ে ভেসে গেছেন একদল, আরেকদল তাঁকে প্রায় অগ্রাহ্য করেছেন। সুকান্তের মৃত্যুর ৬৩-বছর পরে আবার আমি কলম ধরিনি তাঁকে অগ্রাহ্য করার জন্য। ৬৩-বছর পরে এ কথা বলার জন্যই লিখতে বসেছি: সুকান্ত এই একবিংশ শতাব্দীতেও প্রচণ্ডভাবে জীবিত ও জীবনময় ও জীবনসঞ্চারী, সুকান্তকে তাঁর প্রিয়জনেরা—অশোক ভট্টাচার্য, অরুণাচল বসু, সরলা দেবীরা ‘কবিকিশোর’ অভিধা দিয়েছিলেন। আজ দেখা যাচ্ছে, তাঁর কবিতাবলি পুনঃপাঠ করে মনে হলো আমার: ‘সুকান্ত তো দেখছি চিরকিশোর!’ মনে হচ্ছে, সুকান্ত চিরকালই কবিকিশোর থাকবেন।
নিজে বামপন্থী হয়েও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অতিরিক্ত সুকান্তস্তুতির সংগত প্রতিবাদ করেছেন। এর সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত রেখেছেন পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত সুকান্তসমগ্রর (আগস্ট ২০০৮) ভূমিকায়, যেখানে তিনি বলছেন, ‘সুকান্তর কবিতায় যেভাবে চিত্রিত হয়েছে যুগের আশা-নিরাশা, প্রতিবিম্বিত হয়েছে অস্থিরতা-যন্ত্রণা, তেমনভাবে অন্য কারো কলমে হয়নি। পুশকিন-মায়াকোভস্কি যুগকে তুলে ধরেছিলেন, জাতিকে জাগিয়েছিলেন। সুকান্তও জাগিয়েছেন।’ পুশকিন-মায়াকোভস্কি-সুকান্ত তিনজনই যুগ-প্রতিভূ; কিন্তু পার্থজিত্বাবু কী করে ভুলে গেলেন বিশের দশকের যুগ প্রবর্তয়িতা কবি নজরুল ইসলামকে?—তাঁরই সম্পাদিত সুকান্তসমগ্রে তিনি স্বয়ং সুকান্তের প্রবন্ধ ‘ছন্দ ও প্রবৃত্তি’ পড়লেই বুঝতে পারবেন, সুকান্ত সাচ্চা কমিউনিস্ট বলেই ইতিহাসচেতনা বিসর্জন দেননি। নজরুল সম্পর্কে সুকান্তের মন্তব্য: ‘নজরুলের ছন্দে ভাদ্রের আকস্মিক প্লাবনের মতো যে বলিষ্ঠতা দেখা দিয়েছিল তা অপসারিত হলেও তার পলিমাটি আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে সোনার ফসল ফলানোয় সাহায্য করবে।’ রেখাঙ্কিত অংশটি পড়ে বুঝতে পারছ: সুকান্ত তিরিশের কবিদেরই আধুনিক বলে ছেদ টেনে দিচ্ছেন না, নিজেও যে আধুনিক কবিতার অভিযাত্রিক তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। মঙ্গলাচরণ তাঁর ‘বাংলায় প্রগতি-কাব্য: আদি-মধ্য-বর্তমান’ প্রবন্ধে পরিব্যক্ত করেছেন সম্প্রসারে, এক গ্রহণীয় যৌক্তিকতায়।
সুকান্ত-সমালোচকদের দ্বিতীয় গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব করেছেন বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধদেব তাঁর স্বভাবশোভন ঔদার্যে সুকান্তের কবিতা তাঁর সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন (চল্লিশ-দশকী সমাজতন্ত্রী-বামপন্থী আরও আরও অনেক কবিরও), কিন্তু সুকান্তের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ওই কবিতা পত্রিকাতেই লিখলেন তিনি রীতিমতো মারমুখো হয়েই যেন, ‘তার কবিতা পড়ে মোটের উপর একথাই মনে হয় যে তার কিশোর-হূদয়ের স্বাভাবিক উন্মুখতার সঙ্গে পদে-পদে দাঙ্গা বাধিয়ে দিয়েছে একটি কঠিন সংকীর্ণ তথাকথিত বৈজ্ঞানিক মতবাদ। কবিতাগুলি যেন সেই মতবাদের চিত্রণ মাত্র; জোর গলায় চেঁচিয়ে বলা, কবিতা না-হয়ে খবরকাগজের প্যারাগ্রাফ হলেই যেন মানাতো।’ (কবিতা, আষাঢ় ১৩৬৪)
সুকান্ত-সমালোচকদের তৃতীয় গ্রুপের প্রধান সুভাষ মুখোপাধ্যায়। কমিউনিস্ট কবি হিসেবে রীতিমতো তখন তিনি প্রসিদ্ধ, খোদ তিনিই লিখছেন রীতিমতো সুকান্তসমগ্রর ভূমিকায় (ভূমিকার তারিখ: ৩১ শে শ্রাবণ ১৩৭৩), ‘সুকান্ত…মন্দভাগ্য। অকালমৃত্যু সুকান্তকে বাংলা সাহিত্যে শুধু বিপুলতার গৌরব লাভের সুযোগ থেকেই বঞ্চিত করেনি, সেই সঙ্গে লেখার সংখ্যায় আর পরিমাণে পরিণতির চেয়ে প্রতিশ্রুতির পাল্লাই ভারী করেছে।’ পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় যথার্থতই দেখিয়েছেন, সুকান্তের আরও গ্রন্থের কবিতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অন্যায় করক্ষেপ। বরং বিমলচন্দ্র ঘোষ সুকান্তের পূর্বাভাস গ্রন্থের ভূমিকায় কবির সেই প্রাথমিক কবিতাগুচ্ছের ভেতরে লক্ষ করেছেন, ‘…বীজের মধ্যে মহীরুহের বিপুল সম্ভাবনা সত্যসত্যই লুক্কায়িত ছিল।’—তাই বলে এটাও ভুলতে চাই না সুকান্ত-বিষয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সপ্রীত সহায়তা। সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন কবি, কবিতা-সম্পাদনায় তাঁর ঠিক যোগ্যতা ছিল না—এটাই ভেবে নিতে হবে আজ। আমি তো বলব, একবিংশ শতাব্দীতে সুকান্তকে নতুনভাবে বিচার-বিবেচনা করা দরকার। তোমরা করো। নিরাসক্ত আলোচনা-সমালোচনায় উন্মুখর করে তোলো খাঁটি এই কবি-মানুষটিকে।
সুকান্তের কালের কবি-সমালোচকেরা সবাই কি ভুল করেছেন বুদ্ধদেব বসু বা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো? কক্খনো না। তাহলে সুকান্ত এত খ্যাতি অর্জন করলেন কী করে? মনে রেখো, কালবারিতভাবেও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসপ্রণেতা সুকুমার সেন সুকান্ত ভট্টাচার্যকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
নির্দ্বিধ অকৃত্রিমতাই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের চারিত্র, কিন্তু তার সঙ্গে তাঁর কবিত্বশক্তি যুক্ত না হলে সবই বৃথায় যেত। নজরুল লিখেছিলেন, ‘বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই নবী’, এবং ‘অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে’ (‘আমার কৈফিয়ত’, সর্বহারা)। আর সুকান্তের ঘোষণা, ‘ইতিহাস! নেই অমরত্বের লোভ,/আজ রেখে যাই আজকের বিক্ষোভ।’ (বিক্ষোভ, ঘুম নেই) এই সুকান্তই তাঁর প্রথম গ্রন্থের প্রথম কবিতায় যে-কামনা ব্যক্ত করেছেন, তাই-ই সত্য হয়ে উঠেছে: ‘চলে যাব—তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/এ-বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।/অবশেষে সব কাজ সেরে/আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে/করে যাব আশীর্বাদ, তারপর হবো ইতিহাস।’
তোমার সঙ্গে স্বাগত সংলাপ চালাতে চালাতে কোথায় চলে এসেছি দ্যাখো। খেই হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছিলাম। তোমাকে জানাতে চাই সুকান্তর সমালোচনায় বিষ্ণু দের শান্ত-স্থির-দূরদর্শী-কিন্তু-অসাধারণ উক্তিটি: ‘আশ্চর্য হয়েছিলুম, সুকান্তের কবিপ্রতিভা প্রকাশিত হলো প্রতিশ্রুতিতে নয়, একেবারে পরিণতিতে।’ (বিস্ময়কর সুকান্ত, স্বাধীনতা, ১৮ মে ১৯৪৭। বিশ্বনাথ দে-সম্পাদিত সুকান্ত বিচিত্রা। পুনর্মুদ্রণ ১৯৮৯) সুভাষ মুখোপাধ্যায় সুকান্তের মধ্যে দেখেছেন ‘প্রতিশ্রুতি’ আর বিষ্ণু দে দেখেছেন ‘পরিণতি’। সুকান্তের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে বিষ্ণু দে-র লিখিত পর্যবেক্ষণের সুচিন্তিত প্রতিবাদ মনে হয়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনেক-পরে রচিত সুকান্তসমগ্র-এর মুখবন্ধটি।
আমার কথার মর্মকেন্দ্রে আসা যাক এইসব অলিন্দ অতিক্রম করে।
১৯৪৭-এ প্রকাশিত সুকান্তের মৃত্যুত্তর প্রথম প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থটি ছাড়পত্র। সুকান্তেরই প্রস্তুতিকৃত বটে, কিন্তু বেরিয়েছিল তাঁর প্রয়াণের পরে। বইটি কমরেড মুজফ্ফর আহমদকে উৎসর্গিত। অবাক হয়েই দেখি, ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত সমর সেনের কবিতাগ্রন্থ কয়েকটি কবিতাও কমরেড মুজফ্ফর আহমদকে উৎসর্গিত। কিন্তু অবাকই বা কেন হব? এটাই তো স্বাভাবিক। বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাকে এঁরাই তো বই উৎসর্গ করবেন। তোমাকে মনে করিয়ে দেব কি, নজরুল ইসলামই সবার আগে বই উৎসর্গ করেছিলেন কমরেড মুজফ্ফর আহমদকে। যে-বছর সুকান্তর ছাড়পত্র বেরিয়েছিল, সেই ১৯৪৭ সালেই, প্রকাশিত হয়েছিল নামজাদা পূর্বজ কবিদের মধ্যে অজিত দত্তের পুনর্ণবা, বিষ্ণু দে-র সন্দ্বীপের চর, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের নতুন দিন প্রভৃতি। সুকান্তের ছাড়পত্রর অভিনতুনত্ব ছিল না পূর্বজ কবিদের মধ্যে। সন্দ্বীপের চরে নবপ্রস্থান ছিল বটে, কিন্তু বিষ্ণু দে-র ওই পর্বের পরিণতির জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুকাল।
ছাড়পত্রর প্রথম কবিতাই ‘ছাড়পত্র’, দ্বিতীয় কবিতাটি ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’। শেষোক্ত অসামান্য কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে যে-শত শত কবিতা রচিত হয়েছে, তার শ্রেষ্ঠ কয়েকটির একটি বলে মনে করি। নিছক শ্রদ্ধাঞ্জলি এ নয়—এতে রবীন্দ্রনাথ যতখানি উপস্থিত ততটাই সুকান্ত ভট্টাচার্য। তাঁর কাল। এবং সেই পঙিক্তগুলো মন্ত্র বা সূক্তির মতো:
আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়,
আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়,
আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাতে,
আমার বিস্ময় জাগে নিষ্ঠুর শৃঙ্খল দুই হাতে।
চারটি পঙিক্ততে অন্ত্যমিল তো দেখছই, সেই সঙ্গে লক্ষ করো রেখাঙ্কিত পর্বের শেষাংশে গোপন মিল ‘কাটে/রাতে’ এবং ‘লাগে/জাগে’। ‘আমার বসন্ত কাটে’, ‘আমার বিনিদ্র রাতে’, ‘আমার রোমাঞ্চ লাগে’, আর ‘আমার বিস্ময় জাগে’ এই চতুশ্চরণে হাতুড়ির শব্দ ও মিলের পুনঃপুন আবৃত্তি ও আঘাতে কবির অন্তর্গত রক্তপাত দেদীপ্যমান শিলাবৃষ্টির মতো এসে পড়ে। দুর্ভিক্ষ, লঙ্গরখানা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, উপর্যুপরি বৃষ্টির মতো মৃত্যু—বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে রক্তময় ও ক্ষুধার্ত দশকের চিত্র ও বেদনা-রোদনাকে একটি হাহাকারের অন্তিমে নিয়ে গিয়ে একটি শপথবাক্যে যতিরেখা টানে—অপরাজেয় মানবাত্মা দৃঢ় হয়ে ওঠে, ‘প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে।’ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সুকান্তের আরও দুটি কবিতা চোখে পড়ল আমার—একটি তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে, অন্যটির বিষয় মৃত্যুদিন, ‘পঁচিশে বৈশাখের উদ্দেশে’ (ঘুম নেই) আর ‘প্রথম বার্ষিকী’ (পূর্বাভাস)। দুটি কবিতাতেই সেই নিষ্ঠুর করাল কাল এবং প্রযুক্তির আবাহনও: ‘আমি দিব্যচক্ষে দেখি অনাগত সে রবীন্দ্রনাথ: দস্যুতায় দৃপ্তকণ্ঠ’ এবং ‘এখন আতঙ্ক দেখি পৃথিবীর অস্থিতে মজ্জায়,/সভ্যতা কাঁপিছে লজ্জায়।’ এ কবিতা রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সংকট’ ভাষণেরই সহোদর। সুকান্ত তাঁর কালের জাতক, এবং সে জন্যই কালোত্তর। কবিতার কৃেকৗশল এত অল্প বয়সে সুকান্ত স্বায়ত্ত করলেন কীভাবে, সেটা ভেবেই অবাক মানি।
ছাড়পত্রর অনেক কবিতার কথাই লিখব তোমাকে ভেবেছিলাম, সময় নেই, তুমি নিজে নিবিষ্টতায় পড়ো একটু। সুকান্তর যে-অসাধারণ কবিতা ‘একটি মোরগের কাহিনি,’ তা জীবনানন্দের কাক-শালিক-চড়ুইয়ের কবিতায় নেমে আসাকে এমন এক নতুন অর্থগর্ভ আয়তন দিল, যা বিস্ময়কর বললে কম বলা হয়। একদিকে সুকান্ত লিখেছেন ‘রানার’, ‘আঠারো বছর বয়স’, ‘চট্টগ্রাম: ১৯৪৩’, ‘হে মহাজীবন’ নামের দিব্য-দীপ্র কবিতা, অন্যদিকে খুব সামান্য বিষয়কে নিজের অর্থে-অন্তরাখ্যানে মিলিয়ে দেওয়া ‘সিঁড়ি’, ‘সিগারেট’, ‘দেশলাইকাঠি’, ‘কলস’, ‘চিল’ প্রভৃতি কবিতা। বিশেষভাবে একটি কবিতার দিকে নজর দিতে বলব তোমাকে, ‘হে মহাজীবন’—সেই বহুউদ্ধৃত বহুবিস্মৃত কবিতার মন্ত্রপূত লাইনগুলো: ‘হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়/এবার কঠিন কঠোর গদ্যে আনো’ ইত্যাদি। এই কবিতার একটি উপমা সম্পর্কে তোমাকে বলি একটুখানি। চাঁদকে জীবনানন্দই প্রথম কাস্তের সঙ্গে তুলনা দিয়েছিলেন। বামাবর্তের কবি দিনেশ দাস তাঁর ‘কাস্তে’ কবিতায় ভিন্নার্থে ওই উপমাটিই প্রয়োগ করেছিলেন, ‘এ যুগের চাঁদ হলো কাস্তে’। জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘কাস্তের মতন বাঁকা চাঁদ’, দিনেশ দাস কাস্তে-হাতুড়ির বিপ্লবী অর্থে উত্তীর্ণ করে দিয়েছিলেন; কিন্তু সুকান্ত যখন লিখলেন, ‘পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’, তখন পুরো সাহিত্যজগৎ চমকে উঠল—সুকান্ত চাঁদের সঙ্গে ঝলসানো রুটির যে-তুলনা দিলেন তাতে মহাযুদ্ধ-মন্বন্তর-দাঙ্গার রক্তাক্ত মানুষের ক্ষুত্কাতর চেহারাটাই মুহূর্তে জাগ্রত হয়—এবং চিরজীবী। এ রকম উপমা আসে যার কলমে, তিনিই হতে পারেন যুগ-প্রতিভূ।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সোনালি কণ্ঠস্বরে আমরা কে না শুনেছি ‘রানার’ কবিতার সেই অপরূপ সংগীতায়ন?—মনে আছে তো ‘রানার’ কবিতায় সেই ৬-মাত্রার মুক্তক মাত্রাবৃত্তে রানারের ছুটে চলার সেই আশ্চর্য চিত্ররূপ?—‘ঘরেতে অভাব, পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া,/পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া।’—এর সঙ্গে মিলিয়ে নাও অশোক ভট্টাচার্যের স্মৃতিকথার প্রাসঙ্গিক অংশটুকু, ‘সেবার চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের সম্মিলনে। ফেরার পথে পড়লেন অসুবিধায়। পকেটে কেবলমাত্র পার্টির জন্য সংগৃহীত একটি টাকা। সারা পথে প্রায় কিছু না খেয়েই চলে এলেন কলকাতায়। তবুও সে টাকাটা কিছুতেই খরচ করলেন না।’ (কবি সুকান্ত, পঞ্চম মুদ্রণ ১৪০০)
হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সংগতভাবেই এক ‘ঐতিহাসিক ইন্দ্রজালের’ কথা বলেছেন সেদিনকার কমিউনিস্ট জীবনের অগ্রগতির সহায়ক হিসেবে আরও কারও কারও সঙ্গে সুকান্তের কবিতাকে। (তরী হতে তীর, তৃয় সং ১৯৯৫) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীক্ষ লক্ষ্যবেধী মন্তব্য আজ আমাদের নতুন করে ভাবাবে; ‘সুকান্তের কবিতায়…বাংলা কাব্যসাহিত্যের নবজন্মের সূচনা ছিল।’ (স্বাধীনতা, ১৮ মে ১৯৪৭)
অন্যপক্ষে অ-বামপন্থী অজিত দত্ত লিখছেন, ‘…সুকান্তের কবিতায় তাঁর রাজনৈতিক মত স্পষ্ট, উজ্জ্বল ও দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত হয়েছে। সেটা কাম্য হতে পারে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, তাঁর রচনায় আছে সেই শিল্পীর জাদুস্পর্শ, যার দ্বারা সাহিত্য সৃষ্টি হয়।’ (স্বাধীনতা, ১৮ মে ১৯৪৭) আর তাঁর সঙ্গে যুক্ত করতে চাই অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘সুকান্ত’নামা ওই চমত্কার কবিতাটি: ‘যে প্রাণ অপরিমাণ/অধৈর্য অপূর্বমান/তুমি সেই আদিগন্ত প্রাণের উত্থান।/অন্ধকার-ছিন্ন-করা প্রভাতের খুলে-দেয়া-দোর/অনন্ত অশান্ত তুমি সুকান্ত কিশোর।’ (অচিন্ত্যকুমারের অপ্রকাশিত মনোজকলাপ পত্রগুচ্ছ: দেবযানী চক্রবর্তী ও সিদ্ধান্তরঞ্জন চৌধুরী সম্পাদিত। ২০০৫)
সার কথা আমার: সুকান্ত ভট্টাচার্য কমিউনিস্ট-অকমিউনিস্ট সব মানুষের কবি। যেমন নজরুল ইসলাম—যেমন মায়াকোভস্কি—যেমন নেরুদা।
…কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য সম্পর্কে আমার ভাবনা-বেদনার সারাত্সার তোমাকে জানালাম কয়েকটি অনুচ্ছেদে। তার সঙ্গে আরও একটু যোগ করে চিঠি শেষ করি।
২০০২ সালে ‘কবি সুকান্ত সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা’ আমাকে ‘কবি সুকান্ত-সাহিত্য পুরস্কার’ দিয়েছিল। পুরস্কার: একটি ক্রেস্ট ও উত্তরীয়। যদ্দুর মনে পড়ছে, অনুষ্ঠান হয়েছিল পাবলিক লাইব্রেরিতে। বুঝতে পারছিলাম আমি: আমার এই পুরস্কারপ্রাপ্তির নেপথ্য-ভূমিকা ছিল কবি ত্রিদিব দস্তিদারের। ও-ই যোগাযোগ করেছিল আমার সঙ্গে। ক্রেস্ট ও উত্তরীয়ের বিশেষতা ছিল। ত্রিদিবের কল্পনা ও পরিকল্পনা ছাড়া আর কারই বা হতে পারে অমনটা! ক্রেস্টটি ছিল একটি রানারের (—সেকালের পিঠে-চিঠির-বোঝা-নিয়ে-দৌড়ে-যাওয়া বাহকের—) মূর্তি, তার পিঠের থলির ওপরে সুকান্তের খ্যাততম প্রতিকৃতি, তার সঙ্গে তাঁর কবিতার সেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক লাইন—‘এ-বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি’। উত্তরীয়টিও বিশিষ্ট। খদ্দরের কাপড়ে সুকান্তের সারিবাঁধা প্রতিকৃতি অঙ্কিত। আমি একটি টিভি প্রোগ্রাম করেছিলাম সেই উত্তরীয় পরে। সেই উত্তরীয়দৃশ্য কারও কারও মনোমোহন হয়েছিল।
কতকাল আগের এক ৩০ শ্রাবণে সুকান্তের জন্ম হয়েছিল। শ্রাবণসন্তান প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মানুষটির—‘কবিকিশোর’ এই অভিধাই সবাই তাঁকে দিয়েছেন; কৈশোরিক আবেগ, ভালোবাসা, অকলুষতা, স্বপ্নময়তা ও দৃঢ়বদ্ধতা তাঁকে ওই সুযোগ্য অভিধাই প্রাপ্য করেছে—শ্রাবণসন্তান মানুষটির কথা মনে পড়ে গেল এবারের শ্রাবণে,—যখন হূদয় আমার দীর্ণ। দ্যাখো, তার পরও যে-কথা মনে হচ্ছে, সে-কথা মনে রয়ে গেলে চলবে না—এম্নি শ্রাবণঘন বাদলদিনে সে-কথা যেন বলা যায় তোমাকে। এখন কী মনে হচ্ছে জানো?—‘ভালোবাসি!’ ‘ভালোবাসি!’—এই কথাটি আমার ভুবনপ্লাবী নৈরাশ উজিয়ে-উতরে যদি বুঝতে না-পারো তোমরা—তাহলে আমার তামস সত্তাকেই শুধু জানবে। গভীর অন্তস্তলের সন্ধান পাবে না। শুধু এটুকু অন্তত মনে রেখো তুমি, আমি জীবনের জটিল-গহিন-অসিত অন্ধকারের মধ্যে আলোর দিকে পাখা-মেলা ছোট্ট একটুখানি অঙ্কুর। তোমাদের মতো রৌদ্রবৃষ্টিকরোজ্জ্বল পুষ্পে পল্লবে সমাচ্ছন্ন তরুর মতো নিজেকে সফলায়িত করতে পারিনি—সে আমারই দীনতা।
—তোমার শিল্পী

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৩, ২০১০

Category: প্রবন্ধ
Previous Post:রশীদ করীম একজনই – পিয়াস মজিদ
Next Post:আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑